Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বৃত্তের বাইরে || Bani Basu » Page 4

বৃত্তের বাইরে || Bani Basu

শুক্তি মেয়েটি ছোটখাটো, রোগা, রং-ও ময়লা, কিন্তু মুখটা ভীষণ মিষ্টি। খুব বুদ্ধিযুক্তও বটে। সে শার্ট-প্যান্ট ছাড়া পরে না। গরমকালে শর্টস। এই শুক্তি তার নিজের মহলে যাকে বলে ক্রেজ। শুক্তির এম. এ. ফাইন্যাল ইয়ার। কিন্তু সে ইতিমধ্যেই অন্য অনেক কিছু করছে ও করেছে। যেমন টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনে মডেলিং। স্টেটসম্যানের ‘নাউ অ্যান্ড এগেইন’ কলামে লেখা। বস্তির বাচ্চাদের নিয়ে নাইট স্কুল। আনন্দবাজারেও দু-একবার আর্টিকল লিখেছে। তার বন্ধুরা তাকে জিজ্ঞেস করে থাকে সে ওইসব হাই-ব্রাও কাগজে অ্যাট অল পাত্তা পেল কী করে! কনসিটেড পিপল, ওরা তো ঢোকবার পথেই পাবলিককে আটকে দেয়।

এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া শুক্তি তার সম্মানের পক্ষে হানিকর বলে মনে করে। সে মুখের ওপর একটা মৃদু তাচ্ছিল্যের ভাব ফুটিয়ে ডান হাত দিয়ে ক্রমাগত সামনে ঝুঁকে-আসা চুলগুলোকে পেছনে ঠেলে দেয়। শুক্তির মধ্যে দুটো জিনিস খুব শক্তিশালী। এক, সে যা করতে চায় তা করেই ছাড়ে। ভীষণ জিদ্দি, তার মা বলে থাকেন তাকে বাধা দিয়ে কিছু লাভ হয় না এমত সময়ে। একটি সাময়িক পত্রিকায় সে একবার খিদিরপুরের ফ্যান্সি মার্কেট সম্পর্কে একটা আর্টিকল লিখেছিল। সম্পাদকের নামেই সে সেটা পোস্ট করে দেয়। খুবই স্পর্শকাতর অথচ কৌতূহলপ্রদ বিষয় বলে সম্পাদক তাকে ডেকে পাঠান, এবং তার চেহারা ও বয়স দেখেশুনে হাঁ হয়ে যান। বেশ কিছুটা সম্পাদনা করে, তেমন তেমন ফটো বাদ দিয়ে লেখাটা ছাপা হয়েছিল। কিন্তু শুক্তি এই সম্পাদনায় অত্যন্ত আহত অপমানিত বোধ করে। সে সম্পাদকের ঘরে গিয়ে বেশ ভালই ঝগড়া করে আসে। যেমন সে বলে—‘আপনি আমার কাছ থেকে আরও কৌতূহলপ্রদ বিষয়ে লেখা পেতে পারতেন, কিন্তু পাবেন না। এবং একজন বিকচমান সংবাদদাতাকে আপনি হত্যা করলেন।’ শুক্তি যখন বাংলা বলে ইংরিজি ব্যবহার করে না এবং শুদ্ধ পরিষ্কার বাংলা বলার চেষ্টা করে। যাই হোক তার ক্রোধ দেখে সম্পাদক মুচকি হেসে তাকে চা খাওয়ালে সেটা সে খেয়ে নিয়েছিল। শুক্তির দ্বিতীয় ব্যাপার তার পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গে রূপ। পতিত-পতিতা সে যেমনভাবেই যে অর্থেই হোক, তাকে সে রেহাই দেয় না। এটাতেই সবচেয়ে গণ্ডগোল বাধে। যেমন ড্রাগ বিক্রেতা এক পান-সিগারেটওয়ালাকে ধরে ফেলতে পেরে সে নিত্য সেখানে পান খেতে এবং সিগারেট পিতে যেতে আরম্ভ করে। ফাঁকে ফাঁকে তার ধর্মোপদেশও চালায়। ফলে পানওয়ালা ঠিক জায়গায় খবর পৌঁছে দেয় এবং সে উত্তম-মধ্যম ধোলাই খায় এক সন্ধেবেলা বাড়ি ফেরবার পথে। শুক্তির চরিত্রে প্রতিহিংসা নেই। তাই তার আতঙ্কিত বাবা-মা পুলিশে এফ আই আর ইত্যাদি করলেও সে এ ব্যাপারটাতে আর কোনও কৌতুহল দেখায় না। না হলে কী হত বলা যায় না। মার খাওয়ার পর তখনও ঘা শুকোয়নি, কপালে ব্যান্ডেজ, হাতে পায়ে নানা জায়গায় স্টিকিং প্লাস্টার…এই অবস্থায় সে সেই পানওয়ালার কাছে যায়। কোমরে দু হাত রেখে পান এবং সিগারেট চায়। দুটোই কেনবার পর সেগুলো সজোরে মাটিতে ফেলে পিষে দেয় পা দিয়ে তারপরে পানওয়ালাকে ডেকে ডেকে যথেষ্ট ঘৃণা সহকারে নিজের ক্ষতচিহ্নগুলো দেখাতে থাকে। বলে—‘দেখো ইয়ে তুমহারী জওয়ানী কী রোশনি, ঔর ইয়ে সব তুমহারী মর্দানগী কী নিশানী।’ তারপর ধীর পদক্ষেপে এমনভাবে চলে আসে যে পানওয়ালার বোধে আসে যে এই মেয়েটিকে ঠেঙিয়ে ঠেকানো যাবে না।

সংস্কারক শুক্তির সাম্প্রতিকতম লক্ষ্য হল নীলাদ্রি ওরফে চিন্টু। সংস্কারক শুক্তির করুণা আকর্ষণ করার জন্যে অবশ্য তার অনেক বন্ধুই এক পায়ে খাড়া। এ নিয়ে তাদের নিজেদের মধ্যে ফাটাফাটিও হয়ে যায়। ষড়যন্ত্রও হয়। যেমন বন্ধুমহলে রটে গেল সোহন তার গার্লফ্রেন্ড তাকে ডিচ করবার পর ভীষণ ডিপ্রেশনে ভুগছে। শুক্তির ছোট ছোট কান দুটো খাড়া। কিন্তু সে কিছু বলছে না। —‘শুক্তি জানিস, সোহনটা বোধহয় পাগলই হয়ে যাবে!’ দীর্ঘশ্বাস।

দু-তিন দিন পরে শুক্তি ঠিক সোহনের ঘরে পৌঁছে গেছে। সোহনের একমুখ দাড়ি। পরনে ময়লা পাজামা, একটা অনুরূপ ফতুয়া। সে যেন শুক্তিকে লক্ষই করেনি এমনি ভাব। শুক্তি তার সামনে গিয়ে নিজে একটা সিগারেট ধরাল, সোহনকেও একটা দিল। সোহন আস্তে মাথা নেড়ে মুখ ফিরিয়ে রইল। শুক্তি তখন সোহনকে পুলকিত করে তার কোলের ওপর বসে পড়বে এবং তার ময়লা ফতুয়া ছিঁড়ে ফেলতে থাকবে।

—‘এই শুক্তি কী হচ্ছে, কী হচ্ছে, এই এই ছাড় বলছি।’

কিন্তু এর ক’দিন পরে যখন শুক্তি সোহনকে নিয়ে তাদের আড্ডায় যাবে এবং সোহন উজ্জ্বল মুখে একহাতে চায়ের কাপ আর এক হাতে শুক্তির কাঁধ জড়িয়ে ধরে—‘শুক, লেটস লীভ দিস স্টিংকিং জয়েন্ট’ বলবে তখন সোহনেরই পরম বন্ধু এবং ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণকারী পারভেজ হঠাৎ লাফিয়ে উঠে কোথা থেকে একটা পেনসিল কাটা ছুরি আস্ফালন করে বলবে—‘দাস ফার, সোহন, নো ফার্দার।’ এর পর স্বভাবতই পারভেজে-সোহনে একটা বিরাট ঝটাপটি লাগবে। অন্য বন্ধুরা দু ভাগে ভাগ হয়ে যাবে এবং মোরগা-লড়াইয়ের মতো দুজনকে উত্তেজিত করতে থাকবে। এই সময়ে সকলের অলক্ষ্যে শুক্তি বেরিয়ে আসবে। তার মুখের ভাব শান্ত, ধীর, উজ্জ্বল। সে সোহনকে, প্রাণচঞ্চল, মজাদার ছেলে সোহনকে লড়াইক্ষম করে দিতে পেরেছে। তার কাজ ফুরিয়েছে। সে সফল। এই ধরনের একটা তৃপ্তি নিয়ে সে ফেরে।

নীলাদ্রির মুশকিল হল সে কোনও কিছুতেই মন বেশিদিন বসাতে পারে না। শুক্তিও খেয়ালি। কিন্তু সে যেটা করে সেটা খুব সুন্দরভাবে করে। নীলাদ্রি কিছুই করতে পারে না। এম এ পড়ছিল, পরীক্ষা দিল না। ফ্রেঞ্চ ক্লাসে ভর্তি হয়েছে, কিন্তু জে সুই নীলাদ্রি, ভু জেৎ মঁসিয় বানার্জি আর এলে মাদমোয়াজেল শুক্তি পর্যন্ত শিখে আর এগোতে চাইছে না। তার দিক্‌তে অর্থাৎ ডিকটেশন থেকে রাশি রাশি ভুল বার হচ্ছে, মঁসিয় বানার্জি ধৈর্য রাখতে পারছেন না। এমনকি নীলাদ্রি যে শুধু সুন্দর সুন্দর মেয়েদের দেখবার জন্যেই আলিয়াঁস ফ্রাঁসেতে এসে জুটেছে এ কথা তিনি প্রকাশ্য ক্লাসেই বলেছেন।

‘অব্যবস্থিতচিত্ততা!’ শুক্তি দাঁতের তলায় চেপে নিজের মনে বলেছে। এর যা লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, একে সাহায্য না করলে শেষ পর্যন্ত সাট্টাবাজ, ড্রাগ-পেড্‌লার, খুনি যা খুশি হয়ে যেতে পারে।

ডেনিমের একটা মিডি স্কার্ট আর বাসন্তী রঙের পুলোভার পরে অতএব শুক্তি নীলাদ্রির বাড়ির সিঁড়ি টপকে টপকে উঠছে। তার কাঁধে একটা খাদির ব্যাগ। নীলাদ্রিদের বাড়ি সব সময়ে ফাঁকা। বাবা থাকেন না, মা থাকেন না, বোন আছে একটা, তার চেহারা পর্যন্ত কখনও দেখেনি শুক্তি। দূরে দূরে কিছু লোকজন ঘুরে বেড়ায়। তাদের রকম-সকম পিংপং বলের মতো। শুট্‌ করে কোথায় ছিটকে সরে যাবে আবার শুট করে কখন নেটের ঠিক পাশটিতে এসে ড্রপ খাবে বলা যায় না। এইরকম নির্জন শীতালো দুপুরে শুক্তি নীলাদ্রির ঘরের দরজার পর্দা সরিয়ে নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়েছে।

নীলাদ্রি তিন-চারটে বালিশ মাথায় দিয়ে বিছানায় আধশোয়া। হাতে একটা ছোট্ট অ্যালবাম মতন। অখণ্ড মনোযোগে দেখছে। শুক্তি এসেছে, ঘরে ঢুকেছে, এবং নিঃশব্দে তার মাথার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে সে কিছুই বুঝতে পারেনি। শুক্তি বিদ্যুদ্বেগে অ্যালবামটা ছিনিয়ে নিল। চমকে বিছানার ওপর লাফিয়ে উঠল চিন্টু।

‘এই, এই দে দে, প্লীজ দে শুক্তি।’

মন দিয়ে অ্যালবামের ছবিগুলো দেখতে দেখতে শুক্তি বলল—‘ওহ্‌ নীল তুই তাহলে একটা বুড়ো ভাম! আউটওয়ার্ডলি ইয়াং, ইনওয়ার্ডলি রটন।’

—চিন্টু বলল, ‘এই শুক্তি ধ্যাত, ওগুলো দে।’

—‘কোথায় পেলি এগুলো?’

—‘মেট্রোর পাশের গলিটায় একজন সেল করছিল। জাস্ট আউট অফ কিউরিয়সিটি! নাথিং সিরিয়াস! এই শুক্তি প্লীজ!’

শুক্তি ততক্ষণে পুরো ঘরটায় চক্কর দিচ্ছে আর সব জিনিসপত্র উল্টে-পাল্টে দেখছে। চিন্টু তার পেছন পেছন ভিক্ষুকের মতো হাত বাড়িয়ে আসছে আর ক্রমাগত বলে যাচ্ছে, ‘শুক্তি প্লীজ!’

শুক্তি বলল—‘তাই ভাবি, একটা যুবক ড্রাগ খায় না, অতিরিক্ত মদ্যপান করে না, প্রেমে পড়ে না অথচ হয় ফেল করছে আর নয়ত ড্রপ। পরীক্ষা দিচ্ছে না। গোপন কথাটা তা হলে এই!’ বলে সে আবার ঝটিকাবেগে একটা ক্যাসেট তুলে নিয়ে ভি. সি. পি-তে চাপিয়ে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুটি প্রায় উলঙ্গ নর-নারী টি ভি-র পর্দায় ওলটপালট খেতে লাগল। শুক্তি দেখছে খুব কৌতূহল নিয়ে। চিন্টু মাথাটা দু হাতে ধরে বসে পড়েছে একটা চেয়ারে। কিছুক্ষণ পর টি ভি-র সুইচ অফ করে দিয়ে শুক্তি ক্যাসেটটা বার করে নিল, তার পরে অ্যালবামটা তুলে ধরে বলল, ‘এগজিবিট নম্বর এক, তারপর ক্যাসেটটা লুফতে লুফতে বলল—এগজিবিট নম্বর দুই। নীলাদ্রি রায়ের বিচার হবে।’

চিন্টু মুখ তুলছে না।

শুক্তি বলল—‘এগুলো কারা দেখে জানিস? বুড়ো ভামরা, আর গেরুয়ারি স্বামীজী জাতীয় লোকেরা। তোর মতো একটা অল্পবয়সী ছেলের মধ্যে সেক্স প্রকাশ পাবে প্রেমের মধ্যে দিয়ে, আর যদি খুব ওভারসেক্সড হোস তো জাস্ট হ্যাভ হেলথি সেক্স উইথ সামবডি উইলিং! তাই বলে নীল ছবি দেখবি বাড়ি বসে বসে? এসপ্লানেড থেকে উলঙ্গ মেয়ের ছবি এনে দেখবি? রিয়্যালি…।’ শুক্তি পর্দা সরিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। পেছনে পেছনে চিন্টু চেঁচাচ্ছে ‘শুক্তি! এই শুক্তি। প্লীজ।’

দু-চারটে করে সিঁড়ি টপকাতে টপকাতে শুক্তি তার ঝোলা নিয়ে নীচে নেমে গেল। চিন্টু হতাশ হয়ে সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে রইল। তার এখনও আশা শুক্তি দয়া করে জিনিসগুলো তাকে দিয়ে যাবে। এদিকে শুক্তি বেরিয়ে যাবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নীচে গাড়ি এসে দাঁড়াল। চিন্টু দেখল তার মা নামছে। সাদার ওপর লাল ছোপ ছোপ একটা সিল্কের শাড়ি। কপালে ধ্যাবড়ানো তেল-সিঁদুরের ফোঁটা। গলায় একটা জবাফুলের মালা। হাতে বেতের ছোট চ্যাঙারি। দৃশ্যটা এত অবাস্তব যে চিন্টু হাঁ করে তাকিয়ে রইল। তার মা তনুশ্রী রায় উঠে আসছে সিঁড়ি দিয়ে, গলায় জবাফুলের মালা। মাথাতেও সিঁদুর মাখামাখি। সে বেরিয়ে এসে অবাক হয়ে বলল—‘এ কি? মাম্মি? কোথায় গিয়েছিলে?’

তনুশ্রী জবাব না দিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে যেতে লাগলেন তাড়াতাড়ি। সমস্ত ব্যাপারটাই চিন্টুর কেমন অস্বাভাবিক লাগল। সে মায়ের পেছন-পেছন যেতে যেতে আবার জিজ্ঞেস করল—‘কোথায় গিয়েছিলে? মাম্মি?’

তনুশ্রী এবার কেমন নিস্তেজ গলায় বললেন—‘ঠাকুরবাড়ি।’

তখন চিন্টুর মনে পড়ল আজ তিন-চার দিন হয়ে গেল বস বাড়ি নেই। কোথাও থেকেই কোনও খবরও পাওয়া যায়নি।

সে বলল ‘ওসব ঠাকুর-ফাকুর কী হবে? অল বোগাস। আমি বুঝতে পারছি না তুমি এখনও পুলিশে খবর দিচ্ছ না কেন? তিনদিন হয়ে গেল চারদিন চলছে। ব্যাপারটা বিপজ্জনক হয়ে যাচ্ছে।’

তনুশ্রী তার কথার জবাব না দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন। দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। চিন্টু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁধ দুটো শ্রাগ করে ফিরে এল।

ঘরে এসে সে চটপট তার ঝোল্লা জিনস আর টি শার্ট পরে তৈরি হতে লাগল। আসলে এখন এম.এ. পরীক্ষা চলছে। তার দেওয়ার কথা ছিল, সে বসছে না। তার য়ুনিভার্সিটির বন্ধুরা সকলেই পরীক্ষা দিচ্ছে। অন্যান্য বন্ধুরাও যে যার কাজে ব্যস্ত। দুপুরবেলায় শুধু শুধু ঘরে বসে কেউ নেই। ধুস্‌। বাড়িতে ভাল লাগছে না। মায়ের যে রকম মুড তাতে ঘরে মিউজিক-টিক চালানোও বোধহয় ঠিক হবে না। কোথাও থেকে ঘুরে আসা যাক।

সিঁড়ির মাথায় এসে পৌঁছেছে। এমন সময়ে তনুশ্রীর ঘরের দরজা খুলে গেল। তনুশ্রী বললেন—‘পুলিশে যাচ্ছ নাকি, চিন্টু! খবর্দার থানায় যাবে না কিন্তু।’

—‘বাট হোয়াই?’ চিন্টু ফিরে দাঁড়াল।

—‘সে তুমি বুঝবে না। ইউ নো নাথিং।’

হঠাৎ চিন্টুর শিরদাঁড়ার মধ্যে দিয়ে একটা হিম স্রোত নেমে গেল। মা কি বাবাকে খুন-টুন করেছে নাকি? লাশটা লুকিয়ে রেখেছে! কী অদ্ভুত ব্যবহার করছে! সে এগিয়ে এসে মায়ের মুখোমুখি দাঁড়াল— বলল— ‘অল রাইট। জানি না। কী জানি না? যা নাকি তুমি জানো!’

তনুশ্রী কাঁপা-কাঁপা গলায় বললেন—‘বিজনেসের ব্যাপার। কোথায় কী করে রেখেছে কে জানে, কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে যদি সাপ বেরোয়!’

—‘এই তো সেদিন তুমি বলছিলেন বাবা কাঁচা কাজ করে না।’

তনুশ্রী ভয়ার্ত দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন, কিছু বলতে পারলেন না।

—‘কিছু লুকোচ্ছ আমার কাছে। ডেফিনিট। কী লুকোচ্ছ বলো তো?’ চিন্টু কড়া গলায় জিজ্ঞেস করল।

—‘ঠিক আছে। যাও, তোমার যদি ইচ্ছে হয় থানায় যেতে পারো। কিন্তু ফল ভোগ করতে হবে তোমাকেই। যাও, ঠিক আছে যাও।’ কেমন অসংলগ্ন ভাবে কথাগুলো চেঁচিয়ে বলে তনুশ্রী আবার দরজা বন্ধ করে দিলেন।

গারাজের কাছে বাগানে একটা ঢিপির ওপর সমর বসেছিল, চিন্টুকে আসতে দেখে উঠে দাঁড়াল। বলল—‘দাদা, সাহেবের কোনও খবর পাওয়া গেল?’

চিন্টু বলল— ‘বাবা হঠাৎ একটা এস.টি.ডি পেয়ে পাটনা গেছে।’

—‘পাটনা?’ সমর অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

—‘সাহেব কি ফোন-টোন করেছিলেন?’

—‘না হলে আর জানছি কোথা থেকে?’ রুক্ষ গলায় বলল চিন্টু।

—‘বিশ্বাসবাবু বড্ড ব্যস্ত হচ্ছেন। ওঁকে তো কেউ জানায়নি, তাহলে বলে আসব খবরটা?’

—‘বলতে পারো। তবে ড্যাড দু-চার দিনের মধ্যেই এসে যাচ্ছে।’

সমর ড্যাবড্যাব করে চিন্টুর দিকে তাকিয়ে রইল। সে একটা কথাও বিশ্বাস করেনি। সে সাহেবকে চেনে কিন্তু তাঁর এই ছেলে-মেয়েদের একেবারেই চেনে না। এরা তার কাছে বিলেত-আমেরিকার মানুষ। কিন্তু শুধু-শুধু মিথ্যে কথাটা কেন বলল সাহেবের ছেলে সেইটা তার মাথায় কিছুতেই এল না। চিন্টু তার পাশ দিয়ে গাড়িটা নিয়ে বোঁ করে বেরিয়ে গেল। শীতের হাওয়ায় তার চুল উড়ছে। চোখে সানগ্লাস, তলায় চোখের ভাব কিছুই পড়া যায় না।

মায়ের সঙ্গে থানা-পুলিশের কথা হলেও চিন্টু কিন্তু আদৌ সে দিকে গেল না। এই সিদ্ধান্ত নিতে হলে মায়ের সমর্থন চাই। তার জীবনের বৃত্তের মধ্যে থানা-পুলিশ এসব গুরুত্বপূর্ণ এবং জটিল ব্যাপার পড়ে না। সে বাইরে শিস দিতে দিতে গাড়ি চালালেও ভেতরে-ভেতরে এসব ভয় পায়। প্রথমটা কোথায় যাবে সে ঠিক করতে পারেনি, তার পরে ভেবে-চিন্তে সোহনের বাড়ির দিকে গাড়ি চালাল। সোহন ফটোগ্রাফার, তাকে এ সময়ে তার ডার্করুমে পাওয়া গেলেও যেতে পারে। বেথুন কলেজের পেছন দিকের গলিতে থাকে সোহন। একটা বিরাট পোড়ো বাড়ির একতলায়। বিডন স্ট্রিটে ঠিক বেথুন কলেজের গেটের দিকে মুখ করে সে বেশ কিছুক্ষণ গাড়ি থামিয়ে বসে রইল। তেমন কেউ যদি বেরোয়। কিন্তু কিছুক্ষণ পর তার হঠাৎ শুক্তির সমস্ত কথাগুলো মনে পড়ে গেল। সে বলল— ‘ধুস, মুডটাই দিলে নষ্ট করে।’ তারপর সোহনের বাড়ি গিয়ে হাজির হল।

এ বাড়ি কলকাতার আদি ধনীবাড়ির একটা। শরিকে শরিকে ভাগ হয়ে গেছে। অনেকে এ বাড়ি থেকে চলেও গেছে। একতলার বাঁ দিকে বিরাট একটা লাইব্রেরি। ঠাসা আইনের বই এবং বাঁধানো জার্নাল। এটাতে বসেন সোহনের কোনও কাকা-টাকা। ডান দিকে দু খানা ঘর। প্রথমটাতে সোহন বসে, আড্ডা মারে। ঘরটা ভর্তি তার তোলা নানা ফটোর প্রিন্টে। কিছু বাঁধানো, কিছু সুদ্ধ বোর্ডের ওপর পিন দিয়ে আটকানো। ভেতর দিকটায় সোহনের ডার্করুম। দরজায় টোকা দিয়ে চিন্টু চেঁচিয়ে বলল— ‘সোহন, কাম আউট ম্যান।’

—‘কে দুপুরবেলা চিল্লাচিল্লি করছিস! উল্লুক কাঁহাকা!’

চিন্টু গলা ছেড়ে বলল— ‘কুইক’।

ডার্করুমটার ভেতর থেকে সাবধানে শুক্তি বেরিয়ে এল। চিন্টু তাকে দেখে ঘাবড়ে গিয়ে ঢোক গিলল। তারপর বাঁকা হাসি হেসে বলল— ‘মাদ্‌মোয়াজেল কি ডার্করুমে লাল ছবি দেখছিলেন?’

শুক্তি গম্ভীরভাবে কেটে কেটে বলল—‘একজিবিটগুলো এখনও পীপলস কোর্টে পেশ করিনি।’ এই সময়ে সোহনও বেরিয়ে এল, বলল— ‘এই শালা, চাঁচাইছিলি ক্যানে?

চিন্টু বলল— ‘না মানে, আমি ঠিক তাদের ডিসটার্ব করতে চাইনি। আই কোয়াইট আন্ডারস্ট্যান্ড। পারভেজ মে গেট ম্যাড। বাট আই আন্ডারস্ট্যানড।’

শুক্তি ঝোলার ভেতর থেকে অ্যালবামটা বার করে চট করে সোহনের দিকে ছুঁড়ে দিল, বলল ‘পেশ করলুম, এগজিবিট এ।’ জিনিসটা ছিনিয়ে নিতে চেষ্টা করেছিল চিন্টু কিন্তু সোহন তার থেকে অনেক ক্ষিপ্র। সে একেবারে সোজা ক্যাচ লুফে নিয়ে অ্যালবামটা খুলেই বলল— ‘হা! দিস ইজ সামথিং। কার কাছে তোলালি রে শুক্তি! আমি তো মনে করতে পারছি না তুলেছিলুম বলে।’

চিন্টু টেবিল চাপড়ে বলল— ‘হিয়ার হিয়ার!’

শুক্তি রাগে কথা বলতে পারছিল না, ফুঁসতে ফুঁসতে শুধু বলতে পারল— ‘ইউ মীন থিংস!’ সে বেরিয়ে যাচ্ছিল, সোহন লম্বা হাত বাড়িয়ে, তার চুলের ঝুঁটিটা খপ করে ধরে ফেলে বলল— ‘আরে রাগ করিস কেন?’

চিন্টুর হঠাৎ তার সমস্যাটার কথা মনে পড়ে গেল। সে বলল— ‘শুক্তি তুই তো নিজের আই.কিউ নিয়ে খুব বোস্ট করিস। আমার একটা প্রবলেম সল্‌ভ্‌ করে দিতে পারবি?’

—‘তোর প্রবলেম? তুই তো বিরাট একটা নিজেই প্রবলেম, আশিরনখদন্তহস্তপদ।

—‘কী কী বললি? বিরাট একটা গালাগাল দিলি মনে হচ্ছে?’

শুক্তি বাঁকা হাসি হেসে বলল— ‘এবারটা থাক। পরের জন্মে নিশ্চয়ই বুঝতে পারবি। আশা রাখ। আশা হারাস না।’

চিন্টু বলল— ‘না রে রাট-টাগ রাখ। সোহন উই আর ইন আ ফিক্স। আমার বাবাকে পাওয়া যাচ্ছে না।’

সোহন কাগজ পাকিয়ে কানে সুড়সুড়ি দিতে দিতে বলল— ‘কী বললি। আবার বল? কানে শালা এমনি খোল জমেছে। তোর বাচ্চাকে পাওয়া যাচ্ছে না। এর মধ্যে কবে আবার বাচ্চা পাড়লি বাওয়া।’

চিন্টু বলল—‘দিস ইজ নো জোক সোহন। আজ নিয়ে সাড়ে তিনদিন পুরো হয়ে গেল ড্যাড বাড়ি ফিরছে না। ভোরবেলায় দুটো সুটকেস হাতে করে বেরিয়ে গেছে। কোনও খবর নেই। কাউকে কিছু বলেও যায়নি।’

—‘দ্যাখ, ইনকাম ট্যাক্স থেকে রেইড-টেইড করবে খবর এসেছে হয়ত।’

চিন্টু রাগ করে বলল— ‘ঠিক হ্যায়। চললুম। মনে থাকবে। বিপদের সময়ে সো-কলড্‌ বন্ধুদের ব্যবহার মনে থাকবে। সানগ্লাসটা সে মাথার ওপর থেকে নামিয়ে নাকের ওপর বসিয়ে দিল। পেছন ফিরছিল।

শুক্তি বলল— ‘কী ব্যাপার? একটু আগেই তো তোর বাড়ি থেকে ঘুরে আসছি। তখন তো বলিসনি কিছু।’

চিন্টু বলল— ‘সরি। একদম ভুলে গিয়েছিলাম। ইনফ্যাক্ট উই আর নট অ্যাকাসটম্‌ড টু হ্যাভিং আওয়ার ড্যাড অ্যারাউন্ড। তুই চলে যাবার পর আমার মা কোথা থেকে পুজো-টুজো দিয়ে মা-কালী সেজে বাড়ি ফিরল তখন মনে পড়ে গেল। ইট ইজ সীরিয়াস। মাকে আমার কেমন অ্যাবনর্ম্যাল লাগল। অথচ কিছুতেই পুলিশে খবর দিতে দেবে না।’

শুক্তিকে দেখে মনে হল তার দুর্গে দুর্গতিনাশিনী রূপটা আগেকার পতিতোদ্ধারিণী রূপটার দখল নিয়ে নিয়েছে। সে বলল— ‘সোহন এদিকে একটু মন দে, কানটা পরে পরিষ্কার করিস। ইজিয়ান স্টেবল্ একদিনে পরিষ্কার হয় না।’

সোহন তার চেয়ারটা এগিয়ে নিয়ে বসে বলল— ‘বল কী বলবি।’

চিন্টু মুখ গোমড়া করে বলল— ‘আর কী বলব? আই হ্যাভ অলরেডি টোল্ড ইয়ু। অ্যাবাউট থ্রি ডেজ ব্যাক, ড্যাড জাস্ট ওয়াকড আউট উইথ টু ব্যাগস।’

—‘কে দেখেছিল?’

—‘ন্যাচারেলি নো বডি। নো বডি ওয়াজ দেয়ার টু সি। এনি ওয়ে ইট ওয়াজ ইদার আফটার মিডনাইট, অর দ্য স্মল আওয়ার্স।’

—‘কী করে জানলি দুটো ব্যাগ না কী নিয়ে গেছেন?’

—‘ওই দুটোই মিসিং। একটা ভি.আই.পি, মাম্মি বলছে সব সময়ে ট্যুরের জন্যে রেডিকরা থাকতই। আর একটা।’

—‘তাহলে হয়ত ট্যুরেই গেছেন। বলছিস বাড়িতে কেউ ছিল না? হাউ কাম?’

চিন্টু বিরক্ত মুখে বলল—‘এগুলো আনইমপর্ট্যান্ট। ছিল না কেউ। বাস।’

শুক্তি বলল— ‘কেউ নেই সারারাত, এরকম তোদের বাড়িতে প্রায়ই হয় না কি?’

চিন্টু চিবিয়ে চিবিয়ে বলল— ‘কেন? তুই তাহলে যাবি? না কী? নাইট স্পেন্ড করতে?’

শুক্তি খুব রেগে-মেগে কিছু বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ চুপ করে গেল। তারপর বলল— ‘সোহন, এত স্পর্শকাতর সাক্ষী হলে তদন্ত সম্ভব নয়। আমি চললাম।’ সে আর একটুও দাঁড়াল না। বলতে বলতেই চলছিল, একেবারে চৌকাঠের বাইরে নাগালের বাইরে চলে গেল।

চিন্টু রাগে মুখ লাল করে বলল— ‘সোহন তোর হিপক্রিসির একটা সীমা থাকা। উচিত। তুই জানিস না মনডে নাইট আমি কোথায় ছিলাম? রাসকেল একটা!’

সোহন ডানহাতটা তুলে বলল— ‘ঠিকাছে ঠিকাছে। আম্মো যেখানে, তুম্মো সেখানে। কিন্তু বেবি, তোমার সিসু, তোমার মা? তারাও কি সেখানে বা ওইরকম কোথাও ছিল?’

চিন্টু বলল— ‘জবান সমহালকে সোহন, য়ু আর টেকিং টু মেনি লিবার্টিজ। দেয়ার্স নো নীড টু পোক ইয়োর ব্লাডি নোজ ইনটু আওয়ার প্রাইভেট অ্যাফেয়ার্স।’

—‘অ রাইট, অ রাইট, বাট ইয়োর পা ইজ অ্যাবসকন্ডিং, দ্যাট টূ ইজ ইয়োর প্রাইভেট অ্যাফেয়ার। তো সেই থলি কা বিল্লি ভি তুমি এখানে ছাড়লে কেন? এতে যদি টাচি।’

চিন্টু বলল— ‘অ্যাবসকন্ডিং? হোয়াট ডু ইউ মীন সোহন?’

—‘আরে খেপছিস কেন?’ সোহন এবার চেয়ার আরেকটু এগিয়ে নিল, পা দুটো সোজা করে ঝুলিয়ে দিল, পিঠ সোজা। —‘আফটার অল আমাদের তো ইনভেস্টিগেটিং স্পিরিটেই সবটা দেখতে হবে। কী কী সম্ভাবনা আছে, থাকতে পারে? এতে একটা বাচ্চা মেয়ের মতো থেকে থেকেই ঠোঁট ফোলাবার কী মানে? ইভন শুক ইজ মোর ম্যাচুওর দ্যান য়ু।’

—‘ঠিক আছে বলো, কী বলছ!’

—‘তোমার বাবা বড় বিজনেস ম্যান। দুটো বড় বড় স্যুটকেস হাতে মাঝরাতে কি ভোর সকালে বেরিয়ে গেছেন, অ রাইট?

—‘রাইট।’

—এখন প্রথমেই যেটা মনে হবে সেটা হচ্ছে, বাড়িতে ঠেসে রাখা সোনার বিস্কুট-টিস্কুট, টাকা, না বিস্কুট ওনলি বিস্কুট, এনি ওয়ে দা ডিটেইলস মে বি সেট্‌লড্‌ লেটার। এই সমস্ত নিয়ে কোথাও রেখে আসতে গেছেন আই.টি. থেকে রেইড করবে জানতে পেরে।’

—‘তা, তিনদিন হয়ে গেল রেইড কই হল না তো? কোনও চিহ্নই নেই।’

—‘ঠিকাছে। বাবার অফিস, টফিস এরা কী বলছে?’

—‘ড্রাইভার থেকে, ওয়ার্কস ম্যানেজার থেকে সব্বাই ফোন করে জানতে চাইছে, সাহেব আসছেন না কেন! ইনকাম ট্যাক্‌স ফ্যাক্‌স নিয়ে কোনও কথাই কেউ বলেনি।’

—‘অ রাইট। তোর বাবার ইনকম-ট্যাক‌স্‌ নিয়ে কে ডীল করে, জানিস?’

—‘নো। আই নো নাথথিং।’

—‘জেনে নিতে পারবি তো? অফিসের কোনও কর্মচারী নেই, যাঁর সঙ্গে এসব কথা বলা যায়?’

—‘ও, নো,’ চিন্টু বলল, তারপর তর্জনী নেড়ে বলল—‘আছে একজন। সাধন বিশ্বাস, বোধহয় সবচেয়ে পুরনো লোক। কিন্তু আমার সঙ্গে কোনও কানেকশন নেই।’

—‘ওঁর কাছ থেকে জানতে চা, ইনকাম-ট্যাক্স কে দেখে। আয় আমি ডায়াল করছি। নম্বরটা বল।’

চিন্টু ভীষণ ইতস্তত করতে লাগল, বলল—‘আমি কখনও ড্যাডের অফিসে কারও সঙ্গে…মানে দা হোল থিং উইল বি আউট।’

—‘তোর ড্যাড যদি আজকালের মধ্যে ফিরে না আসেন, তাহলে এনি মোমেন্ট ইট উইল বি আউট, সেই জন্যেই একজন বিশ্বস্ত লোকের কথা বলছি। অলরাইট কী নাম বললি ভদ্রলোকের সাধন বিশ্বাস? কী বলে ডাকিস?’

—‘ছোটতে সাধনকাকা বলতাম। এখন কিছু বলি না।’

—‘নম্বরটা বল, তুই বুঝতে পারছিস না, আমাদের এক-একটা করে সম্ভাবনা বাদ দিতে হবে। প্রসেস অফ সায়েন্টিফিক এলিমিনেশন। নম্বরটা বল, কুইক! কিছু হবে না। ঘাবড়াও মাত।’

নম্বরটা শুনতে শুনতে ডায়াল করতে লাগল সোহন।

—‘মে আই স্পিক টু সাধন বিসোয়াস প্লীজ।’ সোহন নিজেই কথা বলতে লাগল।

—‘ও, সাধনকাকা! আমি চিন্টু মানে নীলাদ্রি বলছি। ড্যাডের ইনকাম-ট্যাক্স কারা দেখেন?’

ওদিক থেকে সাধন বিশ্বাস আর্তগলায় বললেন—‘কেন চিন্টু! দাদা কোথায়? আমাদের এদিকে একগাদা কাজ-কারবার সব আটকে আছে। কোথায় গেলেন দাদা?’

—‘আরে ড্যাড তো রাঁচি গেছে।’

—‘রাঁচি? এই যে সমর বলছে, তুমি বলেছ পাটনা!’

চিন্টু এদিক থেকে লাফিয়ে উঠে ঢোক গিলল, বলল—‘সর্বনাশ!’ সোহন তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বাঁ হাতটা নাড়ল, তারপর ফোনের মধ্যে বলল—‘সরি, সাধনকা, অ্যাকচুয়ালি ড্যাড কোথায় গেছে, কাউকে বলে যায়নি। মানে আমরা কেউ সে সময়টা ছিলাম না। কিন্তু গেছে, খুব কাজে এটুকু জানি।’

—‘তো ইনকাম ট্যাক্সের কথা জিজ্ঞেস করছ কেন?’

—‘মানে, ইজ ইট ইন অর্ডার?’

—‘প্রতিটি পাই-পয়সা। দাদা এসব বিষয়ে খুব সাবধান।’

—‘ওক্কে, আমার এক বন্ধুর সঙ্গে বাজি ছিল, তাই জিজ্ঞেস করছিলুম, বা-ই।’ ফোন রেখে দিল সোহন।

চিন্টু চোখ বড় বড় করে তার দিকে চেয়েছিল। সোহন বলল—‘বাকআপ বেবি, দিস সাধনকা ম্যান সীমস রিলায়েবল। ইটস নট আই. টি.।’

—‘তা হলে?’ চিন্টু বলল।

—‘ঘাবড়সনি। ধর কোনও বদমাশ তোর ড্যাডের কাছ থেকে একটা হিউজ অ্যামাউন্ট চেয়েছে। প্রাণের ভয় দেখিয়েছে। তোর প্রাণও হতে পারে। ওই ত্রিপুরা আসামের মতন। হয়ত সেটাই পৌঁছে দিতে গিয়ে বিপদে পড়ে গেছেন।’

—‘এই কথাটা আমি একেবারে গোড়ার থেকেই বলে আসছি। যখন দেখলাম আয়রন-চেস্ট একদম ফাঁকা। মাম্মি কিছুতেই মানতে চাইছে না। খালি বলে যাচ্ছে ও চেস্টে কিছু থাকত না। এদিকে মাই মাম্মি ইজ অ্যাক্টিং মিস্টিরিয়াস। পুলিশে খবর দিতে দেবে না। ড্যাড কোনও বদলোকের খপ্পরে পড়েছে মানবে না।’

চোখ সরু করে সোহন বললে—‘কী বললি? মাম্মি অ্যাক্টিং মিস্টিরিয়াস! পুলিশে খবর দিতে দিচ্ছেন না?’

—‘হ্যাঁ। এদিকে ঠাকুরবাড়িতে পুজো দিতে গিয়েছিল।’

—‘ডোন্ট মাইন্ড নীলাদ্রি, তোর বাবা-মা’র মধ্যে সম্পর্ক কেমন?’

—‘কেমন?’ চিন্টু আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগল।

—‘মানে ঝগড়া, মন-কষাকষি, ফাইটিং।’

—‘নট দ্যাট আই নো অফ’ চিন্টু বলল, তারপর বলল—‘মাই মাম্মি ইজ আ গ্রেট লেডি। শী ডাজ লটস অফ সোশ্যাল ওয়ার্ক। অ্যাকচুয়ালি শী হ্যাজ আ লাইফ অফ হার ওন।’

—‘প্যারালাল?’ শোহন জিজ্ঞেস করল।

—‘কী বললি?’

বললাম, ‘—ইজ ইট আ লাইফ রানিং প্যারালাল টু ইয়োর ড্যাড’স? দা টোয়েন শ্যাল নেভার মীট…টাইপ?’

চিন্টু কিছুক্ষণ ভেবে বলল—‘আমি ঠিক বলতে পারছি না। ইন ফ্যাক্ট, আমি বাড়ি-টাড়ি মা-বাবা-টাবা নিয়ে কোনও দিন ভাবিনি।’

সোহন হঠাৎ গম্ভীরমুখে বলল—‘চিন্টু, লেটস ড্রপ ইট। মানে তোর মা যখন বলছেন পুলিশে খবর দেবার দরকার নেই, তখন…ইটস হার প্রবলেম। আফটার অল।’

—‘সো আই অ্যাম ব্যাক টু স্কোয়ার এ?’ চিন্টু আরও গম্ভীর মুখে বলল।

—‘দ্যাখ না, দু-চার দিনের মধ্যেই একটা কিছু খবর পেয়ে যাবি।’ হালকা গলায় সোহন বলল, ‘ডোন্ট ওয়ারি। চল বরং একটু ঘুরে আসি। তোর ঘোড়াটা রয়েছে তো?’

চিন্টু বলল— ‘চল।’

সোহন তার ব্যাগের মধ্যে একটা ক্যামেরা বেছে ভরে নিয়ে বলল, —‘চল আজ ফুলের ছবি তুলব। হর্টিকালচারে চল।’

অন্যমনস্কভাবে কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে গাড়ি ঢোকাচ্ছিল চিন্টু। সোহন বলল—‘এই, এই, সোজা বিডনি স্ট্রিট দিয়ে সার্কুলার রোড ধরে নে। পার্কসার্কাস থেকে পারভেজকে তুলে নেব। যদি খচ্চরটা থাকে।’

চিন্টু বলল—‘বিডনি স্ট্রিটটা কী বস্তু?’

—‘জানিস না? বিডনি স্ট্রিট, কলেজে স্কোয়ার, হরি ঘোষের স্ট্রিট—এসব শুনিসনি?’

—‘নেভার ইন মাই লাইফ।’

—‘আরে বাঙালি জিভ ইংরিজি যুক্তাক্ষর উচ্চারণ করবার আগে একটু দম নিত, ফট করে হসন্ত থেকে যুক্তাক্ষরে যেতে চাইত না। আমার ঠাকুর্দা, বাবার মুখে শুনেছি, জ্যাঠাদেরও বলতে শুনেছি। বিউটিফুল লাগত শুনতে।’

—‘হরিব্‌ল’ চিন্টু বলল, ‘বাস-ড্রাইভারগুলো বর্বন রোড বর্বন রোড় করে চেঁচায়!’

—‘ওহ নো নো নো’ সোহন সজোরে প্রতিবাদ করে উঠল, ‘এই জ্যাঠা-কাকারা কিন্তু যখন ইংরিজিতে সওয়াল করবে, তর্কবিতর্ক করবে, পরিষ্কার বলবে। কিন্তু বাংলায় বলবার সময়েই ইনভেরিয়েবলি কলেজে স্ট্রিট। অদ্ভুত সাইকলজি আর অদ্ভুত জিভ। জিভের সাইকলজি বলতে পারিস। এই চিন্টু দাঁড়িয়ে গেলি কেন?’

চিন্টু বলল, ‘একটা মেয়ে রাস্তা ক্রস করছে দ্যাখ।’

সোহন দেখল, তারপর বলল, ‘তোর সানগ্লাসটা দে একবার।’ চিন্টুর সানগ্লাস পরে সে ভাল করে মেয়েটিকে দেখল। চিন্টু বলল—‘লিফট দিতে চাইব?’

—‘চা’ সোহন সানগ্লাসটা পরে সিটে হেলান দিয়ে চূড়ান্ত বিশ্রামের ভঙ্গিতে নিজেকে ন্যস্ত করল। চিন্টু শাঁ করে গাড়িটা নিয়ে মেয়েটির পাশে পার্ক করল। মেয়েটি বাস স্টপে দাঁড়িয়েছে। সালোয়ার কামিজ পরেছে, কোনও শীতের পোশাক নেই। কাঁধ থেকে একটা বড়সড় ব্যাগ ঝুলছে।

—‘হাই!’ চিন্টু বলল।

প্রথমে মেয়েটি চমকে উঠেছিল, তারপরে বলল—‘হাই।’ সামান্য একটু হাসির আভাস মুখে।

—‘হোয়্যার ক্যান আই ড্রপ য়ু?’

মেয়েটি দাঁত ঝিকিয়ে হাসল। একটা খুব মনোহর গজদাঁত বাঁদিকে।

রাস্তার দিক থেকে চিন্টুর কাঁধের ওপর হঠাৎ একটা থাবামতো হাত পড়ল।

—‘হোয়াটস হ্যাপনিং হিয়ার?’ একটি লম্বা-চওড়া যুবক।

চিন্টু খানিকটা কুঁকড়ে গিয়ে বলল—‘ওহ নাথিং। ওনলি অফারিং হার আ লিফট। নো ট্রাবল।’

—‘গেট অ্যালং।’ তার কাঁধের ওপর একটা থাবড়া দিয়ে যুবক সরে গেল। চিন্টু গাড়িতে স্টার্ট দিল।

যুবকটি মেয়েটির পাশে গিয়ে দাঁড়াল, বলল—‘যত্ত বড়লোকের বকা ছেলে! এক পয়সা রোজগার করতে হয় না। ফান্টু সেজে ঈভ-টিজিং করে বেড়াচ্ছে। দোব শালা একদিন এমনি চাবকে…’

চিন্টুর গাড়ি দ্রুত সার্কুলার রোডের দিকে চলে যাচ্ছে। সোহন সিটে এলিয়ে থেকেই বলল—‘শুনলি?’

চিন্টুর ভেতরটা চিড়বিড় করছিল। সে চুপ করে রইল। সোহন একটু পরে আবার বলল—‘কী রে ডাম নাকি?’

—‘ইয়া ডেফ অ্যান্ড ডাম। এবার বল তোকে কোথায় নামিয়ে দেব।’ টোম্যাটোর মতো লাল হয়ে চিন্টু বলল।

—‘কোথায় নামিয়ে দেব, মানে? পারভেজকে তুলে হর্টিকালচারে যাবি না?’

—‘ন্‌ নো। তুই এইখানে তোর এই বিডনি স্ট্রিটে নেমে যা। যা বলছি।’ কাঁধ দিয়ে সে সোহনকে জোরসে ঠেলা দিল।

—‘যা বাব্বা,’ সোহন গাড়ির দরজা খুলে টলমল করতে করতে নেমে গেল।

—‘সি ইউ।’ কোনও জবাব দিল না চিন্টু। শাঁ করে সে সার্কুলার রোডে পড়ল। তারপর দক্ষিণের দিকে গাড়ি ছুটিয়ে দিল।

যত জোরেই গাড়ি ছোটাতে ইচ্ছে থাক, ছোটানো যায় না। প্রত্যেক মোড়ে গোঁত্তা খেয়ে খেয়ে থেমে যেতে হয়। এবং দাঁতে দাঁত পিষে গালাগাল দিতে হয়। হোয়াট আ কানট্রি! হোয়াট আ স্টেট! হোয়াট আ সিটি! হোয়াট স্ট্রিটস! হোয়াট পীপল। মাই গড! রাগে উন্মত্ত হয়ে থামতে থামতে, গোঁত্তা খেতে খেতে অবশেষে লোয়ার সার্কুলার রোডে এসে রাস্তা একটু স্বচ্ছন্দ হল। বালিগঞ্জ সার্কুলারে পৌঁছে সে ভেবেছিল এবার একটা ছোট্ট ট্র্যাফিক লাইট পেরোলেই সব ফাঁকা! কিন্তু তা হল না। সে দেখল বুড়োমতো একটা মুখ তার দিকে চেয়ে আছে, গাড়ি কাটিয়ে কাটিয়ে চলে এল পাশে।

‘নীলাদ্রি। কোথায় যাচ্ছ?’

মেজ জ্যাঠা। বহুদিন দেখা-সাক্ষাৎ নেই। সম্প্রতি ঠাম্মার কাজে না দেখে থাকলে চিন্টু চিনতে পারত না।

—‘তুমি কোথায় যাচ্ছ?’

—‘যাব বাড়ি। গড়িয়াহাট পর্যন্ত একটু পৌঁছে দেবে নাকি? ও দিকেই তো যাচ্ছ!’

—‘এসো।’ চিন্টু গাড়ির দরজা খুলতে টুক করে ঢুকে ধুপ করে বসে পড়ল মেজ জ্যাঠা। আড়চোখে দেখল চিন্টু। মাথায় গোল টাক। ধারে ধারে চুলগুলো সবে গজাতে শুরু করেছে। সাদা হয়ে আছে। তার ড্যাডের মাথায় প্রচুর চুল। দু-পাঁচটা সাদা হয়েছে কি হয়নি! যেগুলো সাদা হয়েছে মাথাময় কেমন বিউটি সৃষ্টি করে ছড়িয়ে থাকে। ঠাম্মা মারা যেতে মেজ জ্যাঠা, সেজ জ্যাঠা সবাই ন্যাড়া হল, খালি ড্যাড হয়নি। ঠাম্মা নাকি বারণ করে গিয়েছিল। গড নোজ হোয়াই। ওল্ড হ্যাগ। যত রকম কুসংস্কারের ডিপো একটা। হঠাৎ ড্যাডের চুলের ওপর থেকে ধর্মীয় অনুশাসন উঠিয়ে দিল কেন সে জানে না।

—‘তোমার এম. এ পরীক্ষা চলছে না?’

বাস। নাও এবার। চ্যারিটির ঠেলা সামলাও। বুড়ো। আরেকটা বুড়ো। সব খবর রাখে। মাস্টারি ব্রেইন। সব টুকে রেখেছে। কবে পরীক্ষা আরম্ভ, কবে কী পেপার, কবে রেজাল্ট বেরোচ্ছে। এভরিথিং!

—‘আজ নেই।’ সে আন্দাজে একটা ছুঁড়ে দিল।

—‘নেই?’ মেজ জ্যাঠা বিড়বিড় করে বলল। ‘আমার ধারণা ছিল আজ সেকেন্ড পেপার।’

চিন্টু উত্তর দিল না।

—‘বউমা, তিতি সব ভাল আছে?’

—‘হ্যাঁ।’

—‘বিজু?’

আড়চোখে আরেকবার চাইল চিন্টু। জানে নাকি? জেনে গেছে? দিস ওল্ড নেভ? জেনেশুনেই বোধহয় আরও জানবার জন্যে গাড়ির অলিগলি পেরিয়ে এসে জুটল। সে বলল, —‘কী মনে হয়?’

মেজ জ্যাঠা হতভম্ব হয়ে তার দিকে চাইল। —‘কী মনে হয়? মানে?’

—‘মানে, ড্যাড, তোমার ছোট ভাই কীরকম থাকতে পারে?’

মেজ জ্যাঠার চোখের ভাবটা বদলে গেল। সেখানে একটা রাগ বা ক্ষোভ ধরনের কিছু দেখতে পাচ্ছে চিন্টু। সে বলল—‘ভাল আছে। আবার কী?’

—‘সেটা গোড়াতেই বললে পারতে! দেখা হলে আপনার লোক কুশল প্রশ্ন করেই থাকে।’

—‘অলরাইট, সরি, ইট ওয়াজ আ জোক।’

—‘জোক!’ মেজ জ্যাঠা কিছুটা আহত কিছুটা হতবুদ্ধি চেহারা নিয়ে বসে রইল। চিন্টু একবারও জানতে চাইল না মেজ জ্যাঠা, রবিদা, কুমকুমদি, টুলটুলদি, কুমকুমদির বর এদের সব কী খবর। কে কেমন আছে। ড্যাম ইয়োর সোশ্যাল ফর্ম্যালিটিজ—সে একটা বুড়ো নয়। বুড়ো ভাম। কে যেন কথাটা ব্যবহার করেছিল? অনেকক্ষণ ভাববার পর মনে হল শুক্তি। তাকেই বলেছিল বুড়ো ভাম। বুড়োটা বোঝা গেল। ভামটা কী? ভ্যাম্প নাকি? বিডন স্ট্রিটকে বিডনি স্ট্রিট বানানোর মতো কোনও বেঙ্গলিফিকেশন করেছে ভ্যাম্প শব্দটার?

গড়িয়াহাটের মোড়ে নেমে গেল মেজ জ্যাঠা। গম্ভীর মুখে বলল —‘আচ্ছা। কষ্ট দিলাম তোমাকে।’

‘প্লেজার! প্লেজার!’ যথাসাধ্য হাসিমুখ করে চিন্টু বিড়বিড় করল। মেজ জ্যাঠা দুটো স্টলের মাঝখান দিয়ে যাবার সময়ে কী জানি কী ভেবে একবার ফিরে তাকাল। হঠাৎ যেন একটা আচমকা ধাক্কা খেল চিন্টু। ড্যাড। অবিকল তার ড্যাড। বুড়ো। টাক মাথা। রোগা। ধুতি পাঞ্জাবি-ছাতা-তালতলা-শালে একেবারে বিপরীত। তবু, তা সত্ত্বেও তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে। নির্ভেজাল তার ড্যাড।

ড্যাডকে বড় হওয়ার পর সেভাবে চেয়ে দেখেনি সে। ছোটবেলায় সাংঘাতিক অ্যাডমায়ার করত। ড্যাড় যেন স্পাইডারম্যান, টার্জান, যেখানে যা কিছু বীরত্বব্যঞ্জক, পুরুষালি, সব কিছুই ড্যাড। গ্রে সুট, মেরুন টাই পরে মসমস করে চলে যাচ্ছে ড্যাড। একটা মৃদু সুগন্ধ ছড়িয়ে গেল বাতাসে। সমর গাড়ির দরজা খুলে ধরেছে। —‘ড্যাড, ড্যাড।’

চিন্টু একটু দেরি করে ফেলেছে। ড্যাড বোধহয় শুনতে পায়নি। কেননা গাড়িটা হুশ করে বেরিয়ে গেল। সত্যি কথা বলতে কি সেই থেকেই, এরকম কারুর নাকের ওপর দিয়ে হুশ করে গাড়ি হাঁকিয়ে বেরিয়ে যেতে ভালবেসেছে সে। রাত্রে একসঙ্গে ডিনার খায় না তারা কত দিন হয়ে গেল। অর্ধেক দিন মাম্মি থাকে না। তিতি আর ড্যাডের সঙ্গে বসে খেতে তার ভাল লাগে না। কেমন যেন উদোম বোধ করে সে। মা থাকলে একটা ভদ্র আড়াল। একটা সুচারু অনুষ্ঠান। নইলে কে কী বলে উঠবে, কার দৃষ্টি কিসের ওপর পড়বে—সে জানে না। সে বদনকে বলে রেখেছে মা না থাকলে তার ডিনার যেন ঘরে সার্ভ করা হয়। তাই-ই চলে আসছে। তিতি জেনে গেছে। কিছু বলে না। ড্যাড কোনও দিন ভুলেও জিজ্ঞেস করেনি—চিন্টু কোথায়। সে কেন টেবিলে বসেনি। অন্তত সে শোনেনি। জিজ্ঞেস করলে বদন কি প্রমীলা তাকে বলত একবারও। অবশ্য এমন নয় যে সে তার জন্য অভিমান করে বসে আছে। শিট! এসব কথা মনেই হয়নি তার। এখন তিন দিন ধরে ড্যাড বেখবর বেপাত্তা হয়ে থাকায়, মেজ জ্যাঠাকে হঠাৎ অবিকল ড্যাডের মত দেখানোয় ঝট করে কথাগুলো তার মনে এল। কোথায় গেল বস? সোহন হঠাৎ তার বাবা-মা’র সম্পর্কের কথা জিজ্ঞেস করল। তারপর দুম করে সাবজেক্টটা ড্রপ করল কেন? সোহনেরও কি সন্দেহ হয়েছে তার মা কিছু একটা করেছে। পেপারে কত রকম উদ্ভট খবর বেরোয়! ছেলে মা-বাবাকে খুন করছে, মেয়ে মা-ঠাকুমাকে খুন করছে। সেই ছেলে বা সেই মেয়ের বাবা-মা’রা কি আন্দাজ করতে পেরেছিল কার হাতে তাদের মৃত্যু নাচছে? বাবা-মা আফটার অল হাজব্যান্ড-ওয়াইফ। তাদের সত্যিকারের সম্পর্ক কী, কে তা। বলতে পারে? মা যে কিছু একটা জানে, লুকোচ্ছে সেটা খুব স্পষ্ট। আবার পুজো দিতেও তো গিয়েছিল! স্ট্রেঞ্জ! কে জানে হয়ত নিজের সেফটির জন্যেই পুজো দিতে গিয়েছিল! ইয়েস, দ্যাটস কোয়াইট পসিবল। মা, তার মা, তাকে কোলে করে ঘুম পাড়াত, স্কুলে যেতে চাইত না বলে, কিসি দিত, একটা দুটো তিনটে চারটে…। সেই মাম্মি! ঘরের দরজাটা বারবার বন্ধ করে দিচ্ছিল কেন মাম্মি? ওই ঘরেই কি? ওয়ার্ডরোবের ভেতর? চিন্টুর বুকের ভেতরটা হিম হয়ে যেতে থাকল। সোহন। সোহন ইজ ডেভিলিশ ক্লেভার! আঁচ করেছে বোধহয় ব্যাপারটা।

চিন্টু রাসবিহারী দিয়ে বেরিয়ে গেল। আরেকটু হলে একটা অ্যাকসিডেন্ট হত। কোনও মতে মহানির্বাণ রোডে ঢোকাল সে গাড়িটা। তাকে যেতে হবে বালিগঞ্জ সার্কুলারেই। ওইখানেই তার গন্তব্য ছিল। মেজ জ্যাঠার জন্য এতটা সময় গেল। যাকগে। সময়টা বড় কথা নয়। সময় তো কাটতেই চাইছে না! তার ওপর ওয়ারিজ। তার একদম অভ্যেস নেই এসব। যাক, দেখা যাক সঞ্জয় হিরানীর ওখানে গেলে হয়ত একটা হিল্লে হতে পারে তার।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress