বৃত্তের বাইরে (Britter Baire) : 03
রাত্রি সাড়ে দশটা। শীতের কলকাতা প্রায় নিঝুম হয়ে এসেছে। রাস্তার মোড়ে কিছু লোক আগুন করে বসে জুয়ো খেলছে। ঘড় ঘড় ঘড় ঘড় ট্রামের শব্দ। ট্রাকের প্রতাপ বাড়ছে রাতের সঙ্গে সঙ্গে। সামনের মৃতদেহটির দিকে তাকিয়ে বিজু রায় একেবারে অবাক হয়ে রইলেন। নিতাই ভট্চাজ্যি বলল— ‘কী হল রায়বাবু, তুলুন?’
মণিময় বলল—‘গামছাটা ভাল করে কাঁধে ঠেসে ঠুসে নেবেন। না হলে লাগবে কিন্তু।’
প্রতুল বিশ্বাস বলল—‘ভয় খাচ্ছেন কেন? আমরাও পাঁচ জনে আছি তো। কাঁধ বদল করে নেবেন একটু পরেই।’
বিজু রায় দুঃখের হাসি হেসে বললেন— ‘ওজন তো শুধু এই খাটিয়াটারই।’
—‘না না দাদা, ভুল করছেন’, নিতাই ভট্চাজ্যি বললেন— ‘যত সময় যায় মড়ার ওজন বাড়ে। সে যত রোগাই হোক। এনার আত্মীয়স্বজনের হদিশ খুঁজতে আমাদের কম সময় গেল? ছিল ইঁদুর, দেখবেন হাতি হয়েছে।’
—‘বলো হরি, হরি বোল’… মণিময় বলে উঠল। চারজনের কাঁধে কাঁধে উঠে পড়ল নলিনীকান্ত করের লাশ।
আহিরিটোলার এই আস্তানার খোঁজ পেয়েছিলেন বিজন এই নলিনী করের কাছেই মাত্র তিনদিন আগে। একটা ট্যাকসি নিয়ে প্রথমেই গিয়েছিলেন সেই বাঁধাঘাট। শ্মশানের ধারের বাড়ি। নেই। বহুতল উঠছে। দুলিচাঁদের মতো কোনও ঘাঘু প্রোমোটার কিম্বা বিজু রায়ের মতো কোনও অ্যামেচার কলকাতা, বৃহত্তর কলকাতা এবং সমস্ত পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের চেহারা পাল্টে দেবার সংকল্প নিয়েছে। আকাশ কিনছে, আকাশ বেচছে। সুতরাং বিজু রায়ের ছেলেবেলা ধূলিসাৎ। দেখে কেন কে জানে খারাপ লেগেছিল। তিনি সেন্টিমেন্টাল লোক নন। এও ভাল করেই জানেন গঙ্গার ধারের সেই বালিখসা নোনা-ধরা বাড়ি আজও টিকে থাকার কথা নয়। তাকে আগাগোড়া সংস্কার করলেও টিকত কিনা বলা যায় না। কী আশা নিয়ে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন বলা শক্ত। ঘুসুড়ির বাড়িটার জন্যে তো কতবার জি.টি. রোডের ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেছেন। একবারও তো মনে হয়নি, ছেলেবেলার সেই বাড়ি দেখে আসি। এখনই কেন হল, বলা সত্যিই শক্ত। আশাভঙ্গ কেন হল সেটা বলা আরও শক্ত। কিন্তু হল। ট্যাকসিটা ছেড়ে দিয়ে ছিলেন, খানিকটা ঘোরাঘুরি করে বাঁধাঘাটের একটা দোকান থেকে গরম গরম জিলিপি আর চা খেলেন, বেশ কয়েক ভাঁড়। তারপর অনেককাল আগেকার মতো লঞ্চে চেপে বসলেন। ওপারে আহিরিটোলা যাবেন। স্রেফ যাবার জন্যেই। কোনও উদ্দেশ্য ছিল না। বেরিয়ে আসার একমাত্র উদ্দেশ্য, ছুটকি। ছুটকিকে খুঁজে বের করা। কিন্তু সেটা সহজ নয়। চিঠিগুলো এখনও সব পড়া হয়নি। কিন্তু যতগুলো পড়েছেন কোথাও ঠিকানা নেই। অথচ মা, সবগুলোর না হলেও কোনও-কোনওটার জবাব দিয়েছে। ঠিকানাটা এই কাগজের স্তূপের মধ্যে থেকে খুঁজে বার করতে হলে একটু সময় চাই। কোথাও বসতে পারা চাই। কিন্তু কোনও হোটেলে গেলে হঠাৎ কেউ তাঁকে চিনে ফেলতে পারে। তাঁর সময় চাই। বাসে, ট্রামে, ট্রেনে তো আর পুরনো চিঠি খুলে পড়া যায় না। আহিরিটোলার জেটিতে বসে এইসবই ভাবছিলেন। খেয়াল করেননি একজন কেউ তাঁকে অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ করছে।
—‘মহাশয়ের কি এদিকে এই প্রথম আসা?’
চিন্তাক্লিষ্ট বিজু রায় মুখ তুলে দেখলেন রোগা লম্বা এক প্রৌঢ়। চওড়া পাড়ের ধুতির ওপর গরম ফ্লানেলের পাঞ্জাবি, তার ওপর জামেয়ার শাল। চকচকে বার্নিশ করা নিউ-কাট। মুখের রং, বোঝা যায় একসময়ে ফর্সা ছিল, জ্বলে গেছে। খয়েরি খয়েরি ছোপ নানা জায়গায়। চুলে বোধহয় কলপ দিতেন, সম্প্রতি ছেড়েছেন। অর্ধেক চুল পানের বাসি ছছাপের মতো লাল।
বিজু রায় তখনও ঠিক করতে পারেননি কী বলবেন। ভদ্রলোক বললেন— ‘হাতে দু দুটো সুটকেস, বাঁধাঘাটের স্টিমারে এলেন, এসে থেকে বসে আছেন, আর আকাশ পাতাল ভাবছেন, কী ব্যাপার বলুন তো। অবিশ্যি যদি বলেন পরের ব্যাপারে নাক গলাচ্ছি কেন তো চলে যাবো। কিন্তু ভাবব। ভাবনার ওপর তো ট্যাক্স বসাতে পারেন না?’ পারেন? কী দাদা পারেন?
বিজু বললেন— ‘আসলে খুঁজতে এসেছি এক জনকে। কিন্তু কোথায় উঠছেন, কীভাবে খুঁজব ভেবে পাচ্ছি না।’ বিজু রায়, বি.বি. রায় এই কথা বললেন একজন সম্পূর্ণ অজানা অচেনা লোককে।
—‘কে পালিয়েছে। ছেলে না মেয়ে? পুলিশের কাছে যাচ্ছেন না কেন। জানি ওরা একটি ওয়ার্থলেস লট। তবু লোকে তো যায়। আপনি গোপন রাখতে চাইছেন? না কি?
বিজু রায় এমনভাবে হাসলেন যার মানে ‘হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন’ এরকম হতে পারে, আবার না-ও পারে।
—‘থাকতে পারেন তো আমার বাসায় নিয়ে যেতে পারি। ভাড়া খাই খরচ লাগবে। তবে হোটলে-ফোটেলের থেকে কম। যাবেন?’
এভাবে একজন অচেনা লোকের কথায় হুট করে কোথাও যাওয়া বিপজ্জনক, সেটা স্বভাবতই বিজু রায় জানেন। কিন্তু তিনি তো আর ছেলেমানুষ নন। উঠতে উঠতে বললেন—‘পেয়িং গেস্ট রাখেন বুঝি? বাঃ এর চেয়ে ভাল ব্যবস্থা আর হতে পারে না।’
ভদ্রলোকটির চেহারা পড়তি বড়লোকদের। টাকার থলিতে বেদম টান পড়েছে। এখন এইভাবে পেয়িং-গেস্ট রেখে চালান নিশ্চয়। দেখলেই বোঝা যায়। বিজু রায়ের কথার জবাবে ভদ্রলোক হাসলেন। বললেন… ‘চলুন। দেখুন পছন্দ হয় কি না।’
—‘আপনার নাম কী?’
—‘বিজন রায়। বিহারীটা বাদ দিলেন বিজু রায়। তাঁর নাম যে বিজনবিহারী এ বোধহয় তাঁর অতি ঘনিষ্ঠরা ছাড়া কেউ জানে না। এমন কি ছেলে-মেয়েও জানে কি না সন্দেহ।
—‘আমি এন.কে. মানে নলিনী কর। মাঝে এক কান্ত ছিল, বহুদিন হেঁটে দিয়েছি।’
পলেস্তারাহীন, একঠেঙে, আদ্যিকালের যে বাড়িটাতে তাঁকে নিয়ে ঢুকলেন নলিনী কর, সেটা কোনওকালে ধনী লোকের বাড়ি ছিল না। ঠ্যাংঠেঙে উঁচু উঁচু সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে নলিনীবাবু গলা বাড়িয়ে বললেন—‘ঠাকুর, আমার গেস্ট আছে। একটা মিল বেশি নিয়ো।’ ডালে সম্বরার ঝাঁজ আসছে। বিজু রায় হেসে ফেলে বললেন—‘হোটেল নাকি?’
—‘এখন দু কাপ চা আর টোস্ট পাঠিয়ে দিয়ে ঠাকুর, টোস্টে একটু চিনি দেবে।’
গালে সাবান হাতে ক্ষুর, দোতলার ঘর থেকে দু চারজন বেরিয়ে এসেছিল। বেশির ভাগই বয়স্ক, কেমন খিঁচড়ে মুখ। দু এক জন অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সীও আছে। একজন বললেন— ‘কী ব্যাপার নলিনীদা, আপনার গেস্ট?’
—‘কেন, তোমরা কি ভাব নলিনীদা বাপে-তাড়ানো মায়ে-খ্যাদানো বলে তার গেস্ট থাকতে পারে না? নলিনীবাবু খেঁকিয়ে উঠলেন। বিজু রায়কে দেখে সবাই চুপ করে গেল। তিনতলার ঘর। একখানাই ঘর। এক চিলতে বাথরুম। বাকিটা ছাদ। একখানা তক্তাপোশ পাতা। কোণে মাটির কুঁজো। দেয়ালে গোঁজ দেওয়া। তাই থেকে একটা ধবধবে পাঞ্জাবি ঝুলছে। তক্তাপোশের বিছানাটায়ও একটা নতুন ঝকঝকে জয়পুরি বেডকভার।
—‘চলবে?’ নলিনী কর বললেন, ‘এটা মেস। যা এখন কলকেতার শহরে প্রায় অবসলিট হয়ে গেছে। এই আমার ঘর। আপনাকে একটা স্টিলের ফোল্ডিং খাট পেতে দেব পাশে। রাতে শোয়ার জন্যে। যদ্দিন ছেলে বা মেয়েকে চুপিচুপি খুঁজবেন ততদিন থেকে যান এখানে। কেউ ডিসটার্ব করবে না। আমার ঘরভাড়া একশো পাঁচ, আপনি হাফ সাড়ে বাহান্ন দেবেন। গেস্টের মিল, এরা মাছের মিল দশ টাকা, মাংসের পনেরো নেয়, নিরমিষ্যি আট। ব্রেকফাস্ট চার টাকা। চা এক টাকা পঁচিশ পয়সা। বড় কাপে দেয়। ভাল আসাম। ঠাকুর রাঁধে ভাল। ডালে ফেন চালায়। স্টিল্ল্।
বিজু রায় বললেন— ‘একলার একটা ঘর পাওয়া যায় না?’
—‘একলা? সব ফিল্ড আপ। নো ভেকান্সি। আপনি যে থাকবেন সেটা আমার খাতিরেই। তা ছাড়া আপনার ঘাবড়াবার কিছু নেই। আমি মোস্ট নন-ইনটারফিয়ারিং লোক। বুঝলেন কিছু?’
এই সময়ে একটি গেঞ্জি আর গামছা-পরা লোক, কলাইয়ের থালার ওপরে দুটো মোটা মোটা কাপে চা, এবং চার পিস টোস্ট নিয়ে এল।
—‘নিন খেয়ে নিন’— ঘরের একমাত্র টিনের চেয়ারটা টেনে বিজু রায়কে বসতে দিয়ে নলিনী কর বললেন।
বিজু রায় টোস্টে চিনিগুলো কলাইয়ের বাসনটার ওপর যথাসাধ্য ঝেড়ে ফেলে দিতে লাগলেন।
—‘মধুমেহ?’
—‘আজ্ঞে?’
—‘ডায়াবিটিস?’
—‘এখনও ঠিক নয়, ব্লাড শুগার আছে।’
—‘তবে তো মশাই এ চাও আপনার চলবে না। চিনি দেওয়া আছে।’
—‘একবার খেলে কিছু হবে না’ বিজু রায় চায়ে চুমুক দিলেন। বেশ কড়া, কিন্তু রীতিমতো ভাল চা। বিজু রায় উচ্চতম দামের দার্জিলিং খান, লিকার পাতলা, কিন্তু এই কড়া লিকারের চা যে যথেষ্ট ভাল তাতে সন্দেহ নেই। পাঁউরুটিখানাও তিনি খুব তৃপ্তির সঙ্গেই খেতে লাগলেন। মোটা মোটা পাঁউরুটি, টাটকা রুটির গন্ধটা বেরোচ্ছে। তাঁর খিদে পেয়েছে।
নলিনী তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন— ‘ভাল। না? আসলে কি জানেন, খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারটা আমরা এখানে নিজেরাই দেখি। চাঁদু মিত্তির আছে দোতলায়। এক্সপার্ট লোক। মাসকাবারি বাজারটা সে-ই করে। ডেলি বাজারও এরা পালা করে করে। নয়ত এন.কে এখানে থাকত?’
তারপরে গালের কুঁচকানো চামড়ায় আরও ভাঁজ তুলে হাসলেন—‘আমার তো ডায়াবিটিস।’
বিজু বললেন— ‘তবে এত চিনি-টিনি?’
—‘কে দেখছে?’ যেন একমাত্র কেউ দেখে ফেলবে বলেই রোগীর যা-কিছু সাবধানতা।
—‘বয়স কত হল বলুন তো?’
বিজু রায়ের মনে হল—বাহাত্তর তিয়াত্তর অন্তত, বললেন—‘চৌষট্টি পঁয়ষট্টি হবে।’
—‘ফিফটি নাইন রানিং।’
—চমকে উঠলেন বিজু রায়।
একটা কিং সাইজ সিগারেট বার করে নলিনীকান্ত বললেন—‘জীবনে কী করেছি আর কী করিনি হিসেব দিতে গেলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে মশাই। বছর তেইশ বয়সে বাড়ি থেকে পালালুম। তারপর জাহাজের খালাসি হওয়া থেকে জাহাজ কেনা পর্যন্ত করেছি। করতে পেরেছি। শেয়ারে কামিয়ে লালে লাল হয়ে গেছি। আবার বেগার, একেবারে ভিক্ষুক। ধরুন, অবস্থা যখন ছিল পাল পাল আত্মীয়স্বজনকে গ্র্যান্ডে খাওয়ানো থেকে, ব্যালকনির টিকিটে সিনেমা দেখানো, বক্সে থিয়েটার দেখানো, দামি দামি উপহার কিনে দেওয়া—কী না করেছি। যখন পকেট গড়ের মাঠ হয়ে গেল, নিজের ভাই, আমার পয়সায় যে এঞ্জিনিয়ার, সেই ভাই গলাধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বার করে দিল। নিন ধরুন একটা।’ নলিনীকান্ত সিগারেটের প্যাকেট তাঁর দিকে এগিয়ে ধরলেন।
বিজু রায় ইতস্তত করছিলেন। নলিনীকান্ত বললেন—‘রেসট্রিকশান? একদিন একটায় আসবে যাবে না।’
এই সময়ে একটি যুবক ঘরে মুখ বাড়াল, —‘আসতে পারি।’
—‘আবার জিজ্ঞেস করছো কেন? কৌতূহলে তো ছটফট করছ সবাই। এসে যাও এসে যাও। নীচে গিয়ে রিপোর্ট দিয়ো।
—‘আঃ আপনি না নলিনীদা! কোনও জিনিসটাই সহজভাবে নিতে পারেন না। এলুম আপনার ফরমাস খাটতে। এই নিন আপনার টুথপেস্ট, আর এই সুপার সফ্ট ব্রাশ। ক্রিমটা অফিস-ফেরত আনব।’
যুবকটি একটা দামি টুথপেস্ট আর ব্রাশ এগিয়ে দিল।
—‘এ হে হে হে হলদে আনলে কেন হে? হলদে আমি মোটে পছন্দ করি না। গ্রিন, গ্রিন আনতে হয়।’
—‘ভুল হয়ে গেছে দাদা। দয়া করে ফেরত দিতে বলবেন না।’
—‘এসেছ যখন কৌতূহল নিবৃত্তি করে যাও। ইনি আমার বন্ধু বিজন রায়, মানে জুনিয়র ফ্রেন্ড। এই তুমি যেমন। আর বিজনবাবু ইটি মণিময়। নামেও রত্ন, স্বভাবেও রত্ন। আচ্ছা এবার এসো গিয়ে, তোমার আপিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
মণিময় বলল— ‘নমস্কার বিজনদা, পরে আলাপ হবে।’
—‘ছেলে-মেয়ে নয় মনে হচ্ছে,’ মণিময় চলে গেলে এন.কে বললেন, ‘ছেলে-মেয়ে হলে এতক্ষণে দাপিয়ে বেড়াতেন, তবে কি ভাইপো-ভাইঝি, ভাগনে-ভাগনি গোছের কেউ?’ বলেই জিভ কেটে বললেন—‘ছি ছি এই দেখুন, ইনটারফেয়ারেন্স হয়ে গেল দাদা, মনে কিছু করবেন না।’
বিজন হেসে বললেন— ‘ও সব কেউ নয়। অনেকদিন থেকে সম্পর্ক নেই এমন এক জনের ঠিকানা খুঁজে বার করবার চেষ্টা করছি।’
—‘বুঝেছি।’ এন. কে বললেন, তারপর ঘরটা বিজনকে পুরোপুরি ছেড়ে দিয়ে নিজের কাজে, ভগবান জানেন কী কাজ, চলে গেলেন।
দিদির চার পাঁচটা চিঠি পেলেন বিজন। প্রত্যেকটাতেই কিছু টাকার প্রাপ্তিস্বীকার আছে। তাঁর মনে পড়ল, মা যতদিন ছিল মাসে হাজার টাকা করে মাসোহারা দিতেন তিনি। খুব আস্তে টাকাটা মায়ের বালিশের তলায় ঢুকিয়ে রাখতেন। মা একদিন, একদিনই বলেছিল—
—‘আমি তো একটা শোয়া-মানুষ, সব কিছুই তো অপরের ওপর। নিজে হাতে খরচ করার সাধ্যও নেই। এত আমায় দিস কেন?’
বিজু বলেছিলেন, ‘এ টাকা নিয়ে তুমি যা খুশি করবে মা।’
‘এত টাকা নিয়ে সত্যিই কখনও নাড়া-চাড়া করি নি’, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল মা। টাকা নিয়ে মা কী করত বিজন জানেন না। জানবার আগ্রহও বোধ করেননি কোনও দিন। দিয়ে দিয়েছেন ব্যস। তবে মা হয়ত নাতি নাতনিদের, বউমাদের কিছু উপহার-টার দিত অনেক সময়ে। তিতি যেন একদিন কাকে বলছিল— ‘ঠাম্মার টাকা দিয়ে এই চুড়িদারটা করিয়েছি। কেমন হয়েছে?’ কাকে বলছিল? তাঁকে তো নয়ই। ওর মাকে কি? মনে করতে পারলেন না বিজন। শুধু ‘ঠাম্মার টাকা’ কথাটা মনে লেগে আছে। কিন্তু সেদিন আলমারি, সিন্দুক ঘাঁটাঘাঁটি করে শুধু একটা সোনার হার ছাড়া আর কোনও মূল্যবান জিনিস পাননি। সামান্য কিছু খুচরো পয়সা, ব্যস। সোনার হারটা ঝকঝকে নতুন, মা কোনও সময়ে করিয়ে রেখেছে। বাক্সের মধ্যে চিরকুটে লেখা ‘ছোটখুকুকে আশীর্বাদ’। ভাই-বোনদের মধ্যে দিদিই সবচেয়ে অভাবী। চিঠি পড়ে মনে হচ্ছে সে টাকার অধিকাংশই দিদিকে পাঠিয়েছে মা। কাকে দিয়ে পাঠাল? খুব সম্ভব সুলতা আর শিবানী ওই দুটি নার্সকে দিয়ে। তারা যে মেরে দেয়নি এটা মায়ের ভাগ্য, দিদিরও ভাগ্য। কিন্তু তাঁরও তো দিদির কথা ভাবা উচিত ছিল। মায়েরও বলা উচিত ছিল। তিনি দিদির কথা ভাবেননি, তার প্রধান কারণ তিনি অতটা জানতেন না। দিদি এমন কিছু দূরে থাকে না। কিন্তু দিদি, দিদির ছেলেরা কেউ কখনও তাঁর সল্ট লেকের বাড়িতে এসেছে বলে তিনি মনে করতে পারলেন না। সল্ট লেক কেন। ছুটকি চলে যাবার পর থেকেই দিদি বাঁধাঘাটের বাড়িতেও আর আসেনি। ও। এই জন্যে। দিদির শ্বশুরবাড়ি খুব গোঁড়া, আচারপরায়ণ, বিজু একবার দিদির সুখচরের বাড়িতে গিয়ে দিদির শ্বশুরমশাইয়ের কাছে র্ভৎসনা শুনেছিল, বামুনের ছেলে হয়ে আহ্নিক করে না বলে। প্রসাদী মাংস ছাড়া ওদের বাড়ি ঢুকত না। তাহলে ছুটকির কারণেই দিদির সঙ্গে রায়বাড়ির যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেল। তাই-ই দিদির কথা ভাবেননি তিনি কখনও। মেজদার মেয়ের বিয়েতে যেন একটুখানির জন্যে দেখা হয়েছিল। আর? ওই মায়ের কাজে।
দিদি লিখেছে— ‘মনি-অর্ডার পেয়েছি। না, পেলে যে কী হত তা জানি না। ভাগ্যে তুমি ছিলে। ভাইয়েরা তো থেকেও নেই। এবারের মতো সামলে দিতে পেরেছি। তুমি দীর্ঘ জীবন লাভ করো…’ দিদিকে প্রয়োজনের সময়ে মনি-অর্ডার পাঠাবার জন্যেই কি মায়ের দীর্ঘ জীবন লাভের প্রার্থনা?
শ্রী চরণেষু মা,
তোমার দেওয়া মূলধনে তোমার ছোট নাতি নূতন করে ব্যবসা শুরু করেছে। খুবই ভাল চলছে। ওই টাকা শাঁটুল বলছে ফিরিয়ে দেবে। দিতে পারলেই আমার সোয়াস্তি। কত দিলে মা! মেয়ের বিপদে মা ছাড়া আর কে করে! সবই ঠিক। তবু লজ্জা হয়। শাঁটুল শিগগিরই বাড়ির কলি ফেরাবে।’
আশ্চর্য! দিদির এত বিপদ গেছে তবু কখনও বিজনের কাছে হাত পাতেনি? মাকে জানিয়েছে। মার সাধ্য ছিল তাই করেছে, না হলে? হঠাৎ বিজন স্থির করলেন তিনি দিদির বাড়িই আগে যাবেন। একটাই মুশকিল। তাঁর প্রাণটা এখন ছুটকির জন্য দাপাচ্ছে। ভেতরে ভেতরে তিনি ভীষণ অস্থির। ছুটকিকে খুঁজে বার না করে, তার সঙ্গে কথা না বলে বাড়ি ফিরে যাবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তাঁর নেই। তা ছাড়া, বাড়ির লোককে… তনুশ্রী, তিতি আর চিন্টু এদের একটু ভোগাবার ইচ্ছে তাঁর। এ অবস্থায় দিদির বাড়ি গেলে তিনি গোপনতাটা রাখতে পারবেন কি? বাড়ি থেকে তাঁর জন্যে বিজ্ঞাপন-টন দিলে এই আহিরিটোলার বাসও তাঁর উঠবে। দেখা যাক।
নলিনী কর ফিরে আসবার আগেই তিনি চান সেরে নিয়েছেন। বেরোবার জন্য প্রস্তুত। — ‘এ কী? চললেন কোথায় মশাই? খেয়েছেন?’
—‘বাইরে কোথাও খেয়ে নেব এখন।’
—‘সে কী? আমি মিল বলে দিয়েছি যে। দশটা টাকা গচ্চা যাবে না।’
ভদ্রলোক কিছুতেই ছাড়বেন না। একতলার খাবার ঘরে আসন পেতে বসে, থালার চারদিকে জলের ছিটে দিয়ে, বাঁ কনুই বাঁ হাঁটুর ওপর রেখে বিজু রায়ের সঙ্গে খেলেন নলিনী। চানের কথা উড়িয়ে দিলেন। শীতকালে নাকি উনি অর্ধেক দিন চান করেন না। ভোজনের পর পরিষ্কার হয়ে নেবেন।
রান্না সত্যিই খুব ভাল। এ ভাবে চুড়ো-করা ভাতের সঙ্গে সুক্তো, মাছের মুড়ো দিয়ে বাঁধাকপি, বড় বড় পার্শে মাছের ঝাল, কুমড়ো, বেগুনের অম্বল—এসব কবে শেষ খেয়েছিলেন মনে পড়ে না বিজু রায়ের। বাঙালিরা ধনশালী হলেই তাদের খাদ্যাভ্যাস পর্যন্ত আমূল পাল্টে ফেলে। তাঁরা ছোটবেলায় জলখাবার খেয়েছেন এক পয়সার চারটে করে বলের মতো হিঙের কচুরি আর খোসাসুদ্ধ আলুর তরকারি। নয়ত দুধ-জিলিপি। বাঁধা জলখাবার। তাঁর ছেলেমেয়েরা খায় দুধের মধ্যে কর্নফ্লেক্স, আধ-সেদ্ধ ডিম, দুটো করে সিঙ্গাপুরি কলা। প্রমীলাকে তিনি হোটেলের বয়-বাবুর্চির মতো বলতে শুনেছেন—‘ডিম সেদ্ধ না ভাজা?’ সেদ্ধ ভাজার বাইরে স্ক্র্যাম্বল্ড্-এগের ফরমাসও হত। দুপুরে ভাত খান না বিজু রায়, আটার রুটি, গোনা দুখানা। নলিনী বললেন— ‘আপনি বোধহয় টেবিলে খান, না? খুব অসুবিধে হচ্ছে।’
বিজু রায় বললেন—‘রান্না খুব ভাল।’
—‘ভাল তো খাচ্ছেন কই? এ যে মেয়েদের খাওয়া মশাই।’
আরেক বাটি ডাল চেয়ে নিলেন বিজু রায়। বললেন-ব্লাড শুগার, বললাম না?
—‘ওঃ হো তাই বলুন। তা আমার তো ইউরিনেও চিনি এসে গেছে। তাই বলে বাঁধাকপি দিয়ে ভাত মেখে খাব না। এমন পার্শে মাছের সর্ষে-বাটার ঝাল, ভাতে মেখে না খেলে রোচে?’
খেয়ে-দেয়ে বিজু রায় সুখচরের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লেন।
এই তাহলে এখনকার সুখচর? বিয়াল্লিশ তেতাল্লিশ বছর আগে দেখা সেই ছায়া নিবিড় মফস্বলের সঙ্গে কোনও মিল নেই। বড় বড় সুন্দর সুন্দর বাড়ি। বহুতল। কিছুকাল আগেও একটা সময় ছিল যখন বিলেত-আমেরিকা থেকে ফিরে এসে লোকে বলত— ‘এ কী? তিরিশ বছর আগে যা দেখেছি, যেমন দেখে গেছি, এখনও তো অবিকল তাই-ই?’ ইদানীং আর সেটা বলতে পারবে না তারা। অন্তত সুখচরের চেহারা দেখে বিজু রায়ের তাই মনে হল। তিনি নিজের চেষ্টায় ভটচাজ্যি বাড়ি খুঁজে বার করতে পারলেন না। রিকশা-অলা, পান-সিগারেটের দোকান, লন্ড্রি ইত্যাদিতে জিজ্ঞেস করতে করতে পৌঁছলেন যখন দেখলেন সারা সুখচর বদলে গেলেও তাঁর দিদির বাড়ির পরিবেশ এতটুকুও বদলায়নি। সেই সামনে একটা পচা ডোবা এই দুপুরবেলায়ও যার ওপর থিকথিকে মশা। এবং পেছনে বিয়াল্লিশ বছর আগে দেখা দোতলা বাড়ির কঙ্কাল। খিলেন থেকে একটা অশথ গাছ গজিয়ে প্রায় মহীরুহ হয়ে গেছে। বাড়ির গায়ে কোনও দিন কোনও পলেস্তারা ছিল বলেও মনে হয় না। বিরাট দরজাটা বহু কাল রং-টং না হওয়া সত্ত্বেও সম্ভবত কাঠের সেগুনত্বর গুণে এখনও অটুট আছে। ভেতরে ঢুকে বিজু গলা তুলে ডাকলেন—‘দিদি! দিদি।’
সদর দিয়ে ঢুকে একটা ছোট গলি মতো। তার দুধারে বাঁধানো রক। আগেকার বড়সড় বাড়িতে এমনই থাকত। গলি পেরিয়ে চৌকো উঠোন। শান জায়গায় জায়গায় ফেটে গেছে, সেখানে আগাছা। শেয়ালকাঁটা, পাথরকুচি। শানের ওপর শ্যাওলা, তার ওপর ধ্যাবড়া করে চুন ফেলা হয়েছে। বিজুর মনে পড়ল উঠোন পেরিয়ে কলঘরে যেতে হত। এখনও তা হলে তাই আছে। বড়দির ছোট ছেলে শাঁটুল তাহলে কলি ফেরাতে পারেনি। ব্যবসাটা ফেল মেরেছে হয়ত। তিনি আবার গলা তুলে ডাকলেন— শাঁটুলবাবু। শাঁটুলবাবু। দিদির খুব সম্ভব দুই মেয়ে, দুই ছেলে। মেয়েদের নাম যেন ছিল খুকি আর টুকি। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও বড় ভাগনের নাম মনে করতে পারলেন না। পোশাকি নামগুলো তো নয়ই। অগত্যা শাঁটুলবাবু! শাঁটুলবাবু!
এবারে দাওয়ার ওপরের ঘরের ভেতর থেকে একটি বউ বেরিয়ে এল। হাতে খন্তি। তার রকম দেখে বিজু রায়ের মনে হল— সে এইভাবেই মাঝে মাঝে বেরিয়ে আসে এবং গরম খন্তির ছ্যাঁকা দিয়ে দেয় তাঁর মতো বে-আক্কেলে মিনসেদের।
তাঁকে দেখে বউটি জ্বলজ্বলে সিঁদুরের ওপর গাছকোমর থেকে টেনেটুনে একটু ঘোমটা টানল। এখানে এখনও বউয়েরা বাইরে লোক দেখে ঘোমটা টানে? কলকাতার থেকে কত দূর সুখচর?
—‘কাকে চান?’ স্বরটি ভাল।
—‘আমি বিজু, শাঁটুলের ছোটমামা। দিদি আছেন?’
বউটির চোখ বড় বড় হয়ে উঠছিল, সে এক ছুট্টে ভেতরে গেল। বোধহয় রান্না এবং খন্তির একটা ব্যবস্থা করে আর একটু ভদ্রস্থ হয়ে বেরিয়ে এসে ঢিপ করে পেন্নাম করল, —‘মা ভেতরের ঘরে শুয়ে আছে। আসেন।’
—‘মা দেখো, কে আসছেন।’
দিদি ওপাশ ফিরে শুয়ে ছিল। বউয়ের কথায় এদিকে ফিরে ভুরু কুঁচকে বলল —‘কে?’
ঘরটা অন্ধকার। বউটি এসে টিমটিমে আলো জ্বেলে দিন।
—‘আমি বিজু দিদি।’
—‘বিজু! বিজু! ছোট খোকা!’ দিদি উত্তেজনায় উঠে বসল।
—‘তুমি কেন? কোথা থেকে? কী করে খবর পেলে?’
বিজু রায় বললেন— ‘কেন? আসতে নেই? তোমাকে দেখতে ইচ্ছে হল।’
—‘আমাকে দেখতে?’ দিদি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
—‘কী হয়েছে দিদি তোমার? শুয়ে কেন?’
—‘ডাক্তার তো ধরতে পারছে না কিছু। পেটে যনতন্না! তোমাকে, তাহলে এরা খবর দেয়নি! এমনিই এসেছ! —বউমা! ছোটমামার খাবার জোগাড় করো।’ দিদি শেষ কথাটা গলা তুলে বলল।
বিজু বললেন, ‘আমি খেয়ে-দেয়ে এসেছি দিদি। কাউকে ব্যস্ত করতে হবে না। ভাগ্নেরা কোথায়?’
—‘ভাগ্নেরা?’ দিদি অবাক হয়ে বলল ‘রা কোথায় পেলে? বাঁটুল তো সেই কবেই ছোটতেই…’
তখন বিজু বুঝতে পারলেন কেন বড় ভাগ্নের নাম মনে পড়ছিল না। খুব সম্ভব তিনি যখন নিরুদ্দিষ্ট, তখনই…। তাঁর কোনও দোষ নেই।
গলাটা একটু পরিষ্কার করে বললেন— ‘খুকি, টুকি সব ভাল তো?’
—‘আর কে ভাল, কে মন্দ! মেয়ে-সন্তান বিয়ে দিয়ে দিলেই পর, তার ওপর নিজের ছেলেপিলে সংসার নিয়ে জড়িয়ে পড়লে তো আর কথাই নেই। পরস্য পর। খুকি থাকে মজফ্ফরপুর। টুকির বর খুব উন্নতি করেছে, আগে কটকে থাকত, এখন বোম্বাই। এদিকে ওদের কেউ নেইও। মাঝে সাঝে চিঠি দেয়।’
—‘শাঁটুল? শাঁটুল কোথায় গেল?’
দিদি অনেকক্ষণ পরে বলল ‘—জানি না।’
—‘জানি না মানে?’
দিদি এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল—‘লেখাপড়ায় তো তেমন চৌকস ছিল না। গোড়ার থেকেই এ ব্যবসা সে ব্যবসা করে বাপের পয়সাগুলো সব ফুঁকে দিলে। তার পরেও অনেক অনেক দিয়েছি। শেষের দিকটা বেশ দু পয়সা আসছিল। তারপর একদিন…’ দিদি চুপ করে গেল।
এই সময়ে বউটি এক কাপ চা, আর দুটো দানাদার এনে রাখল।
বিজু বললেন—‘আমার মিষ্টি চলে না, ব্লাড শুগার আছে। চা-টা খেয়ে নিচ্ছি। এগুলো নিয়ে যাও মা।’
বউটি দানাদারের প্লেট তুলে নিয়ে বিনা বাক্যব্যয়ে চলে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পর দিদি আবার এদিক তাকিয়ে মাথাটা একটু তুলে চুপি চুপি বলল—‘হিন্দুস্থানী’।
—‘কে?’
—‘বউ।’
—‘তো কী? ভালই তো!’
—‘ভাল-মন্দ জানি না। শিগগিরই বোধহয় কাটান-ছাড়ান হয়ে যাবে।’
—‘তাই?’
—‘ আর কী হবে বলে! শাঁটুল তো পুলিশের হাত এড়িয়ে বেড়াচ্ছে।’
—‘সে কী? কেন?’
—‘কি জানি। সিমেন্ট বলে নাকি গঙ্গামাটি পাইল করে দিয়েছে, একদিন রাতে সাতখানা মোটর বাইক গর্জন করে বাড়ি ঘিরে ধরল। এদের সব বসিয়ে দিয়েছে নাকি। খিড়কি দিয়ে শাঁটু পালিয়ে গেল। বউ আটকে আছে আমার জন্যেই। বাপের সঙ্গে ঝগড়া করে শাঁটুকে বিয়ে করেছিল। তা অ্যাদ্দিনে বোধহয় বাপ একটু নরম হয়েছে। ছেলেটাকে নিয়ে গেছে। বউটা, হাজার হোক মানুষ তো, এমন অবস্থায় আমায় ফেলে যেতে পারছে না।’
দিদির চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল।
ময়লা বিছানায় শীর্ণ বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বিজুর মনে হল—দিদি, ইনি বি.বি. রায়ের দিদি। শুয়ে থাকতে থাকতে দিদি হঠাৎ কুঁকড়ে যেতে লাগল। মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। বিজু উঠে দাঁড়িয়ে তাড়াতাড়ি কাছে গিয়ে বললেন— ‘কী হল দিদি! ব্যথা?’
—‘উঃ, মাগো! মাঃ আর পারছি না যে!’
বিজু বাইরে এসে ডাকলেন— ‘বউমা।’
বউটি এসে দাঁড়াল।
—‘ডাক্তার দেখেছে?’
—‘হ্যাঁ।’
—‘কী বলছে?’
—‘ক্যানসার।’
বিজু রায় দাওয়ার ওপর কাঠের বেঞ্চে বসে পড়লেন।
বউটি কাঠ-কাঠ গলায় বলল— ‘ওর ছেলে ফেরার। এই রোগ বাধিয়েছে। আমার গলায় পড়েছে। আমার কোনও ক্ষমতাই নাই। আপনি ওর ভাই। শুনেছি রইস লোক। অনেক পয়সা। নিয়ে যান। নিয়ে এই নরক থেকে আমায় ছেড়ে দিন।’ বলে দাঁড়িয়ে রইল। একটু পরে রুক্ষ গলায় বলল— ‘আপনি যদি এত পয়সা-অলা লোক তো আপনার দিদির, ভান্জার এমন অবস্থা হয় কেন? আমার পিতাজিও বেওসা করেন, আমাদের মতিহারী থেকে যে দেশোয়ালি যখন এসেছে কোনও না কোনও হিল্লে লাগিয়ে দিয়েছেন। নিজের লোকের তো কথাই নাই। আপনারা বঙ্গালিরা কেমন মানুষ?’ রাগে মেয়েটির মুখ লাল হয়ে উঠেছে। সে আবার রান্নাঘরে ঢুকে গেল। এত কী রাঁধছে সে ভগবানই জানেন।
বিজু রায় গালে চড় খেয়ে বসে ভাবতে লাগলেন। এক করা যায়, দিদিকে নিয়ে এখুনি সল্ট লেকের বাড়ি চলে যাওয়া যায়। মায়ের ঘর খালি পড়ে আছে, দিদি অনায়াসেই থাকতে পারবে। নার্স রেখে দেওয়া যাবে, মায়ের মতো। তনুশ্রী সম্ভবত ব্যাপারটা পছন্দ করবে না। এরকম ঘটনা এর আগে ও বাড়িতে হয়নি। কিন্তু তার জন্য কিছু এসে যাবে না। দিদি থাকবে ওপরে, সব কিছু আলাদা। তার সেবার ভার মাইনে-করা লোকেদের। তনুশ্রীর বলবার কিছু থাকতে পারে না। হঠাৎ বিজু রায়ের একটা কথা মনে পড়ে গেল, তিনি গালে আরেকটা চড় খেলেন। তাঁদের বিয়ের কিছুদিন পরই তনুশ্রীর বাবা মারা যান। মা একা পড়ে গেলেন। ছয় মেয়ে। তনুশ্ৰীই একমাত্র খাস কলকাতায়। সে মাকে নিজের কাছে এনে রাখতে চেয়েছিল। বিজু রায় রাজি হননি—যুক্তি দেখিয়েছিলেন অনেক। দুই পক্ষের মা এক সংসারে থাকলে জটিলতা বাড়বে। অনর্থক। তাঁর বাড়ির কতকগুলো নিজস্ব নিয়ম, শৃঙ্খলা আছে, সেগুলো নষ্ট হওয়া তাঁর শুধু অনভিপ্রেত তাই-ই নয়। তাঁর জীবিকা-ইত্যাদির পক্ষে ক্ষতিকর। শাশুড়ি যদি সেগুলোতে হাত লাগান। অল শাশুড়িজ আর গ্র্যাবিং, ডমিনেটিং টাইপ্স, তখন শুধু-শুধু সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাবে। তা ছাড়া, ভদ্রমহিলার আরও পাঁচ মেয়ে রয়েছে। সাধ্যের বাইরে গিয়ে সবারই মোটের ওপর ভাল-ভাল বিয়ে দিয়েছেন, তা তারাও তো রাখতে পারে। তনুশ্রীর মুখটা কেমন হয়ে গিয়েছিল। একবার তবু বলেছিল— ‘ঠিক আছে মাকে একবার জিজ্ঞেস করতে পারি তো?’
বিজু রায় বলেন— ‘তা পারো। কিন্তু মা রাজি হলেও আমি রাজি হতে পারব না।’ তবু তনুশ্রী জিজ্ঞেস করেছিল মাকে। খুব স্বস্তি পেয়েছিলেন বিজু যখন মা-ও তাঁর মতে মত দিয়েছিল। ‘না, কুটুম্বকে ও ভাবে বাড়িতে রাখলে অশান্তি হবার সম্ভাবনা, তার চেয়ে বিজু একটা মাসোহারার ব্যবস্থা করে দিক। বউমা গিয়ে গিয়ে দেখাশোনা করুক।’
তনুশ্রীর মার হার্টের অসুখ ছিল। ঠিক কী জাতীয় তা বিজু রায় জানেন না। তিনি মাসোহারা দিতেন, চিকিৎসার ভাল ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তনুশ্রীর মা নিজের ঘরে একদিন মরে কাঠ হয়ে পড়েছিলেন। প্রতিবেশীরা দরজা কেটে বার করে। বিজু রায় গিয়েছিলেন। শাশুড়ির চোখের সেই ভয়ে ঠিকরে আসা চোখের মণি দুটো তিনি কখনও ভুলতে পারবেন না। একাকিত্বের আতঙ্কেই হঠাৎ উনি মারা গেলেন, না হার্টের অসহ্য যন্ত্রণায় ওইরকম অবস্থা হয়েছিল, কে বলবে! বিজু রায় কুঁচকে গেলেন। কেমন মনে হল, দিদিকে ওখানে তুললে তিনি তনুশ্রীর কাছে খুব ছোট হয়ে যাবেন।
দিদির চিৎকার ক্রমশ বাড়ছে। মেয়েরা এমনিতেই খুব সহনশীল হয়। তা সত্ত্বেও একজন চুয়াত্তর পঁচাত্তর বছরের বৃদ্ধা যখন এই ভাবে ডাক ছেড়ে কাঁদছে তখন অনুমান করা যায় তার যন্ত্রণার তীব্রতাটা কী রকম! বিজু রায় ভাবলেন— ‘আর এই সময়ে আমি কারও কাছে ছোট হওয়ার কথা ভাবছি। কী অদ্ভুত একা মানুষ! ভাই-বোন-ছেলে-মেয়ে সব আছে। সব থাকে। অথচ কেউ নেই। কেউ থাকে না। কিছু থাকে না। থাকে শুধু মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের মধ্যে খাড়া হয়ে চূড়ান্ত অহমিকা। অহম্, অহম্, অহম্।
তিনি তাড়াতাড়ি দিদির ঘরে ঢুকলেন। বললেন— ‘দিদি। ব্যথা বাড়লে কোনও ওষুধ খাও?’ হাত বাড়িয়ে একটা পাতা দেখাল দিদি। তুলে বিজু রায় দেখলেন স্পাজমোপ্রক্সিভন। হতাশ হয়ে বললেন—‘এতে হয়?’
—‘কী জানি। হয় হয়তো!’ দিদির গলা রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। ওষুধটা দিদিকে খাইয়ে দিয়ে তিনি বাইরে বেরিয়ে বউটিকে ডাকলেন—বললেন— ‘এখানে কোথায় কোন ডাক্তার বসেন আমি তো জানি না, একটু বলে দেবে কোনদিকে পাব?’
বউটি বলল— ‘আপনি বসেন, আমি ডাকছি। ফি-এর টাকা বত্রিশ, আগে না দিলে আসবে না।’
পকেট থেকে তাড়াতাড়ি বার করে দিলেন তিনি টাকাটা। বললেন— ‘অবস্থাটার কথা বলে ইঞ্জেকশন ওষুধ যা লাগে নিয়ে আসতে বোলো। আমি সঙ্গে সঙ্গে মিটিয়ে দেব।’
টাকা নিয়ে বউটি চলে গেল। একটা ক্যানসারের রোগী, মরণাধিক যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। ডাক্তার আগে থেকে ফি না পেলে আসবে না? বিজু রায় অবাক হয়ে রইলেন। এঁরা তো এখানকার বহুদিনের বাসিন্দা! আদি বাসিন্দাদের মধ্যেই। জমিদারশ্রেণীরই ছিলেন বোধ হয়। এখন টাকা না থাকলেও সেই পুরনো মান-মর্যাদা! তারও কি কিছুই নেই? ডাক্তার! ডাক্তার! কত লাখ টাকার সরকারি খরচে একটা ডাক্তার হয়?
ডাক্তারটি যখন এল, বিজু রায় দেখলেন নেহাতই ছোকরা। চটপট পেথিডিন ইনজেকশান দিয়ে দিল। তিনি দামটা দিয়ে দিলেন। তারপরে বললেন— ‘শুনলাম, আপনি নাকি আগে থেকে ফি না পেলে আসেন না?’
—‘কে বললে?’ ডাক্তারটি চোখ তুলে বলল— ‘রত্না! ওকে জিজ্ঞেস করুন তো কত বার ইনজেকশন ওষুধ দিয়ে গেছি এ বাড়িতে, এক পয়সাও পাইনি।’
—‘পাননি কেন সেটা চারদিক দেখেই নিশ্চয় বুঝতে পারছেন। এক জনের কাছ থেকে ফিজ না পেলে আপনার বাড়িতে হাঁড়ি চড়বে না এমন অবস্থা নিশ্চয়ই আপনার নয়।’
—‘আপনি কে?’ ডাক্তারটি রাগত স্বরে বলল, ‘কী রাইট আছে আপনার এখানে ডেকে এনে আমাকে অপমান করবার? আমি যদি চিটেড হতে না চাই, সেটা আমার অপরাধ?’
—‘চিটেড? ডু য়ু নো ইয়াং ম্যান দ্যাট ইয়োর্স ইজ দা নোবলেস্ট প্রফেশন? জানো সরকার তোমার জন্যে কত টাকা খরচ করেছে? জানো ইউ আর ডিলিং উইথ হিউম্যান পেইন, সাফারিং! মানুষের অমানুষিক শারীরিক যন্ত্রণার সামনে দাঁড়িয়ে তুমি একটা ডাক্তার, চিটিঙের কথা মুখে আনতে পারছ?’
—‘ওহ্, রত্নার কাছে শুনলাম শমিতবাবুর বড়লোক মামা এসেছেন। বিজনেসম্যান। আমরা ডাক্তাররা অনেক পেইন, সাফারিং, ডেথ দেখতে দেখতে ইমিউন হয়ে গেছি, বুঝলেন? অ্যান্ড উই ডোন্ট কজ সাফারিং, ডোন্ট কজ পেইন। আর আপনারা? আপনাদের মতো অসাধু, কালোবাজারিদের জন্যে যে দেশটা ভিখিরিতে আর নবাবে দু ভাগ হয়ে গেল, তার বেলা? গরিবের মুখের অন্ন কেড়ে খান না? আপনাদের জন্যেই না গরিবি টিকে আছে! এই তো গরিব আত্মীয়, উপায় না দেখে চিটিংবাজি সুদ্ধু ধরেছে, কিছু করেছেন তাদের জন্যে? আবার বড় বড় কথা।’
হনহন করে বেরিয়ে গেল দুর্মুখ লোকটা। বিজু রায় অনুভব করলেন তিনি ঘামছেন। এভাবে তাঁর সঙ্গে ব্যবহার… না তিনি মনে করতে পারছেন না কেউ করেছে বলে। তাঁদের কথা কাটাকাটির মধ্যে রত্না বউটি বেরিয়ে এসেছিল। ঈষৎ উৎকন্ঠার গলায় বলল— ‘কী করলেন মামা, ও তো আর হাতে-পায়ে ধরলেও আসবে না।’
—‘ওর আসবার দরকার নেই। লেট হিম গো টু হেল।’ কোন মতে বলতে পারলেন বিজু রায়। একটা কালো হয়ে যাওয়া হাত পাখা আর এক গ্লাস জল নিয়ে এল রত্না। —‘আপনাকে খুব হয়রান দেখাচ্ছে, জলটা খেয়ে নিন।’ হাওয়া করতে লাগল সে। তারপর বলল— ‘বয়স হয়ে গেছে, একসাইটমেন্ট ভাল না। ও সবের মধ্যে যান কেন?’
‘আশ্চর্য, মেয়েটি ঠিকই বুঝতে পেরেছে তাঁর বয়স হয়েছে। অথচ নলিনী কর, তাঁর সমবয়সী লোকটি, সে বুঝতে পারিনি। যুবক-যুবতীরা ঠিকই বুঝতে পারে। খুব সম্ভব চোখের দিকে তাকিয়ে পারে। বড় কাঁসার গেলাসের জলে নিজের চোখের ছায়া দেখতে দেখতে ভাবলেন বিজু রায়। তিনি বললেন, ‘অমানুষিকতা, অন্যায় আমি সইতে পারি না।’ বলেই মনে হল— ‘সত্যি? পারি না কি?’ মেয়েটির ঠোঁটে একটা বাঁকা হাসি। বোধ হল সে-ও মনে-মনে এই কথাই বলছে। পারো না। পারো না। সইতে না পারা তো দূরের কথা। অন্যায় অমানুষিকতা তুমি নিজেই প্রশ্রয় দাও। নিজেই করো।
তিনি বললেন— ‘শাঁটুল কখনও আমার কাছে যায়নি কেন?’
‘কী ব্যাপারে?’
‘নিজের কাজ-কর্মের ব্যাপারে?’
কিছুক্ষণ চুপ করে রইল রত্না, তারপর বলল— ‘ও বলত স্নব, আমাদের দেখলে চিনতে পারে না। চিনতে চায়ও না, না খেয়ে মরব তবু ওই মামার কাছে কাঁদাকাটি করতে যাব না।… কিছু মনে করবেন না বললুম বলে।’
বিজু রায় অবাক হয়ে রইলেন। চিটিংবাজেরও তাহলে এইরকম আত্মসম্মান বোধ থাকে? না খেয়ে মরব, জেলে যাব, তবু স্নব মামার কাছে যাব না! এ কী মুখ তাঁর। কী ভয়ঙ্কর বীভৎস হাস্যকর মুখ আয়নায়। একেক মানুষের কাছে কি তাঁর একেক রকম মুখ?
তিনি উঠে দাঁড়ালেন। রত্না বলল—‘চলে যাচ্ছেন! রাগ করলেন?’ তার গলায় দারুণ উৎকণ্ঠা।
বিজু বললেন, একটু হেসে বললেন— ‘ভয় নেই। আমার দিদির ভার বইতে তোমাকে আটকে রাখব না। এখুনি ওঁকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। তার ব্যবস্থা করছি।’
রত্নার মুখটা কালো হয়ে গিয়েছিল। সেদিকে তাকিয়ে বিজু বললেন —‘শাঁটুল তো অনেক দিন নেই। আসবার সম্ভাবনাও নেই। চলছে কী করে? তুমি এই টাকাটা রাখো।’ তিনি পার্স থেকে হাজার খানেক টাকা বার করতে লাগলেন।
রত্না মেয়েটি হঠাৎ তীব্র গলায় বলল—‘আপনার অনেক পয়সা-টাকা আছে, না? লোকের মুখের উপর ছুঁড়ে মারতে পছন্দ করেন! জানেন আমি আমার গয়না বিকিয়ে সংসার চালিয়েছি, শাসের ইলাজ করিয়েছি।’
বিজু রায় শান্ত গলায় বললেন— ‘খুব ভাল করেছ। মানুষের কাজই করেছ। কিন্তু ও ভাবে গুরুজনদের সঙ্গে কথা বোলো না। আমাদের ছোটতে বাবা-টাবা আমাদের ওপর অন্যায় করছেন জানলেও আমরা কিছু বলতাম না, কেন জানো? স্রেফ গুরুজন বলে। বিদ্রোহ ভাল। মুখের ওপর উচিত কথা শুনিয়ে দেওয়াও ভাল। কিন্তু জায়গা বুঝে, মানুষ বুঝে। আমি টাকা তোমার মুখের ওপর ছুঁড়ে মারছি না। হাতে দিচ্ছি। তোমার দরকার বলে। আর আমি মামা বলে।’
রত্না কেঁদে ফেলল। সম্ভবত এই কান্নাটা তার অনেকদিন ধরে জমা ছিল। সে টাকাটা হাতে নিয়ে রান্নাঘরের মধ্যে ঢুকে গেল। দিদি ঘুমোচ্ছ। বিজু রায় বেরিয়ে এলেন।
নিজের চেনা ডাক্তারদের কাছে যেতে পারছেন না। চেনাশোনা প্রভাবশালী লোকদের রেফারেন্স দিতে পারছেন না। শুধু টাকাটা আছে। বিজু রায় ব্যাঙ্কে গিয়েছিলেন টাকা তুলে এনেছেন। আরও আনবেন দরকার হলে। ব্যবস্থা করেছেন। একজন সম্পূর্ণ আনকোরা, পরিচিতিহীন নাগরিক হিসেবে বিজু রায় কোথাও কোনও সুযোগ পেলেন না। ডাক্তার, যিনি ভর্তি করাবেন হাসপাতালে, আগে নিজে দেখে রায় দেবেন তার পরে ভর্তির কথা। দিদির কোনও মেডিক্যাল রিপোর্ট টিপোর্টও নেই। স্রেফ আন্দাজের ওপর ডায়াগনোসিস। কিন্তু কোনও ডাক্তারই এখান থেকে সুখচরে গিয়ে রোগী দেখে আসতে পারবেন না। পুরোটা রাস্তা গাড়িতে নিয়ে যাওয়া আসা করলেও না। অবশেষে রাত্রি নটা নাগাদ নিজের জেদ ছেড়ে বিজু রায় চলে গেলেন ডক্টর পি. চ্যাটার্জির কাছে। প্রচুর রোগী অপেক্ষা করছে। কলকাতার সেরাদের মধ্যে একজন মেডিসিনে। নিজের একটা কার্ড পাঠিয়ে দিলেন বিজু রায়। সমুদ্র দুভাগ হয়ে গেল মন্ত্রবলে, মাঝখান দিয়ে এক ত্রাণকর্তা বি.বি. রায় আরেক ত্রাণকর্তা পি. চ্যাটার্জির কাছে চলে গেলেন।
ধৈর্য ধরে সব শুনলেন ডক্টর চ্যাটার্জি। কোনও প্রেসক্রিপশন, ডায়াগনোসিস, প্যাথলজিক্যাল রিপোর্ট, বায়পসি কিছু নেই। বললেন— ফোন করে দিচ্ছি, আমার নার্সিং হোমের অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে চলে যান, নিয়ে আসুন, এখুনি ভর্তি করে নিচ্ছি। তারপর দেখছি কী করা যায়।
রাত্তির সাড়ে এগারটার পরে দিদিকে ভর্তি করে, রত্নাকে তার বাপের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আহিরিটোলায় ফিরলেন বিজু রায়। সর্বক্ষণ গামছা পরে থাকা সেই হরিহর নামে লোকটি দরজা খুলে দিল। হা-ক্লান্ত বিজু রায় তিনতলায় চিলেকোঠায় উঠে দেখলেন নলিনী কর পেশেন্স খেলছেন। — ‘এই যে, এসো। বিজনভায়া। আমি গেস করতে পেরেছিলুম দেরি হবে। শেষ পর্যন্ত কি পুলিশেই গেলে?’
‘না, আপনাকে তো বলেইছি এ পুলিশের ব্যাপার নয়।’
‘ওঃ হে, ভুলে গিয়েছিলুম এ সেই অনে-ক কালের হারানো একজন। না? বুঝি, বুঝি বিজনভায়া, বুঝি সবই! ইন্টারফেয়ার করতে চাই না, তাই…বুঝলে না?’
শীতের রাতে বিজন বালতি বালতি জল ঢেলে চান করলেন। হরিহর রুটি বেগুনভাজা আর আলু-কপির তরকারি গরম করে নিয়ে এল। বিজন বললেন— ‘এ সবের দরকার ছিল না। খেতে ইচ্ছে করছে না।’
নলিনী কর বললেন— ‘ভাগ্য হল চোরের মতন, বা বলতে পারো জোচ্চোর। তো সেই চোর-জোচ্চরের ওপর রাগ করে মুখের খাবার কেউ ফেরায়? ফিরিয়ো না ভায়া, বড় দাদা বলছি, খেয়ে নাও, তারপরে ওষুধ দেব। গায়ের ব্যথা মরবে।’
বিজন দেখলেন হঠাৎ তাঁর পেটের মধ্যে থেকে দারুণ খিদে চাড়া দিয়ে উঠছে। তিনি রুটি বেগুন ভাজা নিয়ে বসে গেলেন।
নলিনী কর বললেন— ‘আলু কপির ডালনা থেকে আলুগুলো বাদ দিয়ে খাও ভায়া। একদিনে বড্ড অত্যেচার হয়ে যাবে নইলে।’ তিনি চৌকির তলা থেকে একটা ট্রাঙ্ক বার করলেন টেনে। তার ভেতর থেকে একটা লম্বা গোল বোতল বার হল। বিদেশি হুইস্কি। বললেন- ‘চলে না বললে শুনব না ভায়া, একটু খাও, ক্লান্তি দূর হবে, গায়ের ব্যথা মরবে, ভাল ঘুম হবে।’
নিজের তক্তাপোশটিতে তিনি নতুন চাদর পাতলেন। বালিশের ওয়াড় বদলালেন। ট্রাঙ্ক থেকে একটি বিলিতি রাগ বার করলেন। বললেন— ‘দেখলেই বোঝা যায় ভায়া শৌখিন মানুষ। চোখের সামনেই সব বদলে দিলুম। এবার আরাম করে শুয়ে পড়ো।’
—‘আপনি?’
—‘আমি এই ক্যাম্প খাটে! দুদিনের তো ব্যাপার।’
তো সেই নলিনী করই এখন খাটিয়াতে ফুলের মালা ইত্যাদিতে শোভিত হয়ে শুয়ে আছেন। মেস-বন্ধুরা ট্রাঙ্ক থেকে তাঁর চুনোট করা ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবি বার করে পরিয়ে দিয়েছে।
বিজন কদিন দিদির জন্য নির্দম ছোটাছুটি করছেন। ডাক্তার বলছে অপারেশন করার ঝুঁকি আছে। আবার করলে ভালও হতে পারে। অপারেশনের তারিখ পড়েছে দুদিন পর। দিদিকে ফলের রস খাইয়ে, কিছুক্ষণ গল্প করে, ওষুধপত্র সব কিনে দিয়ে, রত্নাকে আবার পৌঁছে দিতে হল। সে নার্সিং হোমে এসে বসে আছে। বলল, একাই চলে যেতে পারবে। কিন্তু বিজু তা দিতে পারেন না। তিনি তাকে বাপের বাড়ির গলি অব্দি পৌঁছে দিলেন। যাবার সময়ে মুখ নিচু করে বলল— ‘কাল গুড্ডুকে নিয়ে যাব মামা? খুব দাদি-দাদি করছে। ওঁর হাতেই তো মানুষ।’
‘এনো’—বিজন বললেন।
তারপর ফিরে দেখলেন এই ব্যাপার। এঁরা সবাই তাঁর জন্য অপেক্ষা করছেন। নলিনীকান্তর ট্রাঙ্ক-বাক্স হাঁটকে নাকি কোনও ঠিকানাই পাওয়া যায়নি। মণিময় বলল—‘আপনি ওর অনেকদিনের বন্ধু, আপনিই মুখে আগুনটা দিন, বামুনও বটেন।’
বিজন হেসে বললেন—‘কে বলল আমি ওঁর অনেকদিনের বন্ধু? যেদিন ওঁর সঙ্গে এলাম তার আগে চিনতাম না পর্যন্ত।’
চাঁদু, যে মাসকাবারি বাজার করে সে বলল—‘বলেন কী?’ একটু পরে বলল—‘নলিনীদার কারবারই আলাদা। আপনার হাত থেকে আগুনটা নেবেন বলেই বোধহয়…আগুনটা আপনারই হাতে মাপা ছিল।’
আহিরিটোলার মেসবাড়ির চিলেকুঠুরির ভাড়ার উত্তরাধিকার বিজু রায়ই পেলেন। ট্রাঙ্ক-বাক্স হাতড়ে যা টাকাপয়সা পাওয়া গেল তাতে কোনওমতে মেসের পাওনা চুকল। সবাই চাঁদা করে শেষ কাজের টাকাটা তুলল, গঙ্গার ঘাটেই কাজটা হবে ঠিক হয়ে গেল। বিজুকেই করতে হবে। কেউ শুনল না। তিনিই নাকি নলিনী করের একমাত্র ওয়ারিস।