বৃত্তের বাইরে (Britter Baire) : 11
বিজনের মনে হল তিনি চোখে অন্ধকার দেখছেন। এ কী নীরন্ধ্র আঁধার যার ওপারে ছুটকি দাঁড়িয়ে আছে! তাঁর প্রার্থনা তাঁর ভালবাসা ওকে ছুঁতে পারছে না। দুর্ভেদ্য বর্মের মতো এই অন্ধকারজালিকা। প্রমীলা। তাঁর চোখে ঝলক দিয়ে যাচ্ছে তাঁর সল্ট লেকের বাড়ির সেই মহিলা। রাঁধুনি! তাকে তো তাঁরা ঠিক মানুষ বলে মনে করতে অভ্যস্ত নন। মানুষ যদি বা হয়, নিচু, খুব নিচু শ্রেণীর মানুষ। তার শ্রেণীতে আর বিজু রায়ের শ্রেণীতে যে সমুদ্র পরিমাণ ফারাক তা পোষা জন্তু-জানোয়ারের সঙ্গেও বোধহয় মানুষের থাকে না। তিনিই যদি চোখে এমন অন্ধকার দেখেন, তা হলে ছুটকি, ছুটকি কী দেখছে? তিনি প্রাণপণে গলা থেকে বাষ্প পরিষ্কার করে বললেন—‘ছুটকি, শুনেছিলুম জামাইবাবু নাকি কোটিপতি লোক। তোর জন্যে কোনও সংস্থান করে যেতে পারেননি? শেষ পর্যন্ত ছুটকি তোকে…জামাইবাবু এ কী করলেন? ছি ছি ছি।’
ছুটকি বলল—‘বিজু, তোর জামাইবাবু বলেও কেউ কোনও দিন ছিল না রে! সেই তিপ্পান্ন সালের এপ্রিল মাস থেকেই আমি একা। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পরে আমাদের সম্পর্কের আয়ু পুরো এক মাসও ছিল না।’
—‘তুই বলছিস কী?’ বিজুর মনে হচ্ছে তাকে কে গুলি করেছে। ঠিক বুকের মাঝখানে।
—‘ঠিকই বলছি রে, সেই রাত্রে আমি গলির মোড়ে এসে তার পেল্লাই স্টুডিবেকারে উঠলাম। আমাকে নিয়ে গেল পুরনো কলকাতার এক গলিতে। একতলায়। মোটামুটি সাজানো বাড়ি। কপালে সিঁদুর দিয়ে দিল। আমি বললুম, কেউ সাক্ষী রইল না যে! সে বলল—“আমাদের অন্তরাত্মা সাক্ষী। তোমার জন্যে বালিগঞ্জ প্লেসে নতুন বাড়ি হচ্ছে। সতীনের সঙ্গে তো আর থাকতে পারবে না! আমিও সেখানেই থাকব। তুমিই আমার আসল, আর সব তুচ্ছ, বাজে। তবে ব্যবসাপত্রের ব্যাপার, বোঝোই তো! মাঝে মাঝে যেতেই হবে। দু-চার দিনের মধ্যেই আনুষ্ঠানিক বিয়ের ব্যবস্থা করছি। যত তাড়াতাড়ি পারি। কিছু বন্ধুবান্ধবও আসবে! তা দিনের পর দিন কাটতে লাগল। বিজু, তার প্রেম উথলে উথলে উঠছে, সে আমাকে দু চক্ষে হারায়, তার আগেকার বিয়েটা নাকি বিয়েই নয়, কোনও দিন সে সুখী হতে পারেনি। কিন্তু সেই প্রত্যাশিত বিয়ের দিন আর এল না। তারপর একদিন ভোরবেলায় উঠে দেখলুম—চলে গেছে। প্রথমে ভেবেছিলুম যেমন কাজে যায় গেছে। তারপরে কেমন গা ছমছম করল, দেখলুম তার শৌখিন জামাকাপড়ে ভরা সুটকেস, দু-তিন জোড়া জুতো, এসেন্স, শেভিং-এর জিনিসপত্র—সব নিঃশেষে নিয়ে গেছে। মায় অ্যাশট্রেটা পর্যন্ত। কোনও পুরুষ কোনও দিন ছিল ঘরগুলোতে তার কোনও প্রমাণ নেই। খালি আমার বিদ্ধ শরীরে ছাড়া।” ছুটকি মুখ নিচু করে আঁচল দিয়ে মুখের নীচের দিকটা চেপে ধরল।
বিজু বললেন—‘ছুটকি তুই একটা অসাধারণ বুদ্ধিমতী মেয়ে, আমি ফেল করা ছেলে হতে পারি কিন্তু তুই যে ফিলসফিতে অনার্স নিয়ে বি. এ পাশ করেছিলি! তুই এমন কাঁচা কাজ করলি কী করে? কী করে?’ তাঁর ভেতর থেকে ক্রোধের আক্ষেপের অগ্নিশিখা লক লক করে বেরিয়ে আসছে। যদি পান, যদি সে লোকটাকে একবার পান।
ছুটকি শোনা যায় না এমন স্বরে বলল—‘তুই তাকে সে সময়ে দেখিসনি বিজু, তার কথাও শুনিসনি। আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি। আমার বুদ্ধি-বিদ্যা কোনও কাজে লাগেনি। আমার বুদ্ধি নাশ হয়েছিল।’
‘তো। তারপর?’
‘যেদিন সকালে ওভাবে চোরের মতো চম্পট দিল, পাগলের মতো বাঁধাঘাটে ছুটে গেলুম, মাথায় একগলা ঘোমটা টেনে। লিখে এসেছিলুম এক মাস আমার একটা প্রিয় ডুরেশাড়ি ছিল সেটা ছাদে মেলে রাখতে, যদি মা-বাবা আমাকে ক্ষমা করে। বিজু ছুটে গিয়ে দেখলুম তোরা সবাই আছিস মা-বাবার ভুবন ভরে, খালি আমি নেই। ছাদ ভর্তি করে শুকোচ্ছে জামা-পায়জামা, ধুতি, শাড়ি চাদর, খালি আমার সেই হলুদ ডুরে শাড়িটা যেটা উঁচু তারে টাঙানো থাকার কথা সেটা নেই। মা নেই, বাবা নেই, তুই নেই বিজু, আমি নেই।’ বলতে বলতে ছুটকি অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল। এবং বিজু এক চমকে সেই দৃশ্যটা পুরো দেখতে পেলেন। উঠোনের চারপাশে তাঁরা। বাবা দাঁড়িয়ে। মাঝখানে মা। দাঁত দিয়ে ছুটকির হলুদ-কালো খড়কে ডুরে, ছুটকির জীবন, প্রাণ, মন কুটিকুটি করে ফেলছে ভয়াবহ হিংস্রতায়।
ছুটকি একবার মুখ ঢাকছে। আবার ঝাঁকি দিয়ে খুলে ফেলছে মুখের আঁচল। উঠে দাঁড়িয়ে সিঁড়ির কাছে চলে যাচ্ছে, আবার এসে বসছে। মাথাটা খালি নাড়ছে যেন কার কথার জবাবে সে ক্রমাগত না না বলে যাচ্ছে। অস্বীকার করতে চাইছে যা ঘটেছে, ঘটে গেছে সেই সমস্ত পুরাঘটিত অতীতের বীভত্স নিষ্ঠুরতা। অবশেষে বিজুর কাছে এসে সে জোর করে তার মুখটা কোলের কাছে টেনে নিল। রুদ্ধগলায় বলল—‘কেন এলি বিজু? কেন? যা চলে যা। এরা সব বাড়িসুদ্ধু দক্ষিণ ভারত বেড়াতে গেছে। কবে ফিরবে বলে যেতে পারেনি। রিটার্ন টিকিটের কনফার্মেশন পায়নি। তো আমি সব সময়ে প্রস্তুত থাকি। তা ছাড়া আশেপাশে প্রতিবেশীরা টের পেতে পারে।’
—‘কী টের পাবে?’ বিজন অনেকক্ষণ পরে বলতে পারলেন, ‘আমি তোকে আজই এখনই নিয়ে যাব। আর একটা দিনও এখানে থাকতে দেব না।’
—‘তা হয় না, বিজু। আমার একটা দায়িত্ব আছে।’
—‘ঠিক আছে, তুই এরা এলে এদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিবি। তারপরে নিয়ে যাব। কিন্তু ছুটকি তুই একটা বি. এ. অনার্স ডিগ্রিঅলা মেয়ে। তুই…তোর আর কোনও কাজ জুটল না? তোকে শেষ পর্যন্ত লোকের বাড়ি রাঁধুনিগিরি করতে হবে?’
ছুটকি করুণ হেসে বলল—‘পরনের কাপড় ছাড়া কিচ্ছু তো আর সঙ্গে আনিনি! বি.এ-র সার্টিফিকেট বা অন্য কোনও পরীক্ষার মার্কশিট-টিট কিচ্ছু আমার কাছে ছিল না। কোথায় প্রমাণ দেব আমার বিদ্যের! আর রাঁধুনিগিরি তো করছি গত কুড়ি-একুশ বছর, তার আগে? অনেক অনেকবার চেষ্টা করেছি মাথা তুলে দাঁড়াতে, পারিনি। কিছুতেই পারিনি।’
বিজু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন—‘ছুটকি, এ বাড়িটার মধ্যে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। চল আমরা বাইরে কোথাও খেয়ে নেব, কোথাও, অন্য কোথাও বসব।’
—‘কিন্তু এখানে আমাকে সবাই চেনে, কোথায় যাবি? বাজার, পোস্টাপিস, সব, সব-ই আমার চেনা-জানার মধ্যে।’
বিজু বললেন—‘অত ভাবিসনি। তুই বাড়িতে চাবি দিয়ে আয়। আমার সঙ্গে যাবি। ভয় কী?’
ছুটকি খানিকটা ইতস্তত করল। তার পরে সত্যি সত্যিই তালাচাবি নিয়ে ঘরে তালা দিতে লাগল। বাইরে বেরিয়ে মস্ত বড় একটা নবতাল লাগিয়ে, সে বলল—‘দাঁড়া, পাশের বাড়িতে চাবিটা রেখে আসছি।’
—বিজু চেঁচিয়ে বললেন, ‘বলে আসিস, দেরি হবে। বলবি তোর ভাই এসেছে অনেক দিনের পর।’ বলবার সঙ্গে সঙ্গে যেন বিজু একটা ছায়া সরে যেতে দেখলেন। একজোড়া ব্লু-জিনসের পা, যা আজকাল সব যুবক সব প্রৌঢ়েরও পা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটা যেন ধূসর রঙের স্লিভলেস সোয়েটার। যুবকটি পেছন ফিরে কিছু একটা কুড়িয়ে নেবার ভঙ্গি করল। একটা রিকশা ধরে যখন দুজনে গঙ্গার দিকে চলতে আরম্ভ করলেন, তিনি বুঝলেন একটা সাইকেল পেছন পেছন আসছে। পাছে ছুটকি ভয় পায় তাই ফিরে দেখলেন না। কিন্তু তিনি জানেন, তার নীল জিনসের পা, ধুসর উলের বুক। চোখে মুখঢাকা কালো সানগ্লাস। তা হলে তনুশ্রী ডিটেকটিভ লাগিয়েছে! যাক, তনুশ্রীকে যতটা মস্তিষ্কহীন, কিংকর্তব্যবিমূঢ় ধরনের ভেবেছিলেন দেখা যাচ্ছে সে ততটা নয়!
বিজন একটা সোনার সরু পাটিহার বার করে ছুটকির গলায় পরিয়ে দিলেন। বললেন—‘পর। মা’র আলমারিতে এই একটাই উপহার রাখা ছিল, ছোটখুকুর জন্যে।’ গঙ্গায় এখন ছোট ছোট ঢেউ উঠছে। শীত বলে শীর্ণতোয়া। কিন্তু মাঝগঙ্গায় সেই শীর্ণতা টের পাওয়া যায় না। চারদিকে রোদ চমকাচ্ছে। পালতোলা নৌকায় কত বছর পর! এত বড় ছইঅলা নৌকাখানা একা মানুষটি ভাড়া নিয়েছেন। লঞ্চঘাট থেকে খুঁজতে খুঁজতে আসছেন। ভাগ্যে জগন্নাথঘাটে সে মজুত ছিল! বিকেল পজ্জন্ত ভাসবেন। দুশ টাকা ভাড়া কবুল করেছেন। বলেছেন—লাঞ্চো খাওয়াতে হবে। দুই ছেলেকে নিয়ে নৌকা ভাসিয়েছে চাঁদমাঝি।
চাঁদমাঝি বলল—‘পিপুলপাতির দোকান থেকে দুধের সর চাল নিয়েছি। ঝাল ঝাল করে ক্যাঁকড়া রাঁধছি কত্তা। আর আলুটারে শুখনো ঝাল আর পিঁয়াজ দিয়ে মাখাব। হবে তো?’
—‘কী রে?’ ছুটকির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন বিজন। ছুটকি কিছু বলল না। শুধু হাসল। তার মাথা থেকে এখন ঘোমটা খসে গেছে। বেরিয়ে পড়েছে সেই সাদা-কালো কেশের প্রাচুর্য। এখন সব মিলিয়ে মুখটার যা চেহারা হয়েছে তাতে বিজনের সঙ্গে আদল স্পষ্ট। যদিও একজন শীর্ণ, আরেকজন বেশ হৃষ্টপুষ্ট।
জলের ওপর চিকচিকে রোদের দিকে তাকিয়ে ছুটকি বলল, ‘আর শুনতে চাসনি বিজু। আর বলা যায় না। যখন শুনলে কাজ হত, তখন…। অবশ্য এ কথা বলা আমারই ভুল।’ ছুটকি কাঁদছে।
বিজন বললেন—‘সারা জীবন ধরে তোকেই খুঁজে বেড়িয়েছি ছুটকি। তুই হারিয়ে গেলি বলে বাড়ি ছাড়লুম। তুই হারিয়ে গেলি বলে জীবনে কাউকে কোনও দিন সেভাবে আপন ভাবতে পারিনি। মা-বাবাকে, দাদা-দিদিদের পুরো শ্রদ্ধা দিইনি কখনও সুদ্ধু তোকে ত্যাগ করেছিল বলে। যদি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারতুম, তুই কোথায় আছিস—সেই দিনই ছুটে চলে যেতুম। তুই এত কাছে ছিলি, মায়ের কাছে তোর চিঠি…আর আমি…পাগলের মতো শুধু কাজই করে যাচ্ছি। তৃপ্তি নেই, শান্তি নেই, শুধু কাজ, কাজ করে যাচ্ছি। টাকা জমছে। টাকা উথলে পড়ছে। থামতে পারছি না। থামলেই শূন্য খাদ…।
ছুটকি বলল—‘একজনের ঘর তো ভাঙতে গিয়েছিলুম, তারই শাস্তি এ সব। বুঝি। জল, চারিদিকে জল রে বিজু, শুধু একফোঁটা খাবার জল নেই। চারিদিকে থই থই করছে মানুষ, বাড়িঘর, বাজার, টাকার লেনদেন, আমি একা সব কিছুর বাইরে দাঁড়িয়ে। প্রতিদিন কাশী মিত্তিরের ঘাটে যেতুম ভোরবেলা, ডুবে মরব বলে। প্রতিদিন ফিরে আসতুম। তিন মাসের আগাম বাড়ি ভাড়া দেওয়া ছিল, যা টাকাপয়সা ছিল টিপে টিপে খরচ করছি। মুড়ি জলে ভিজিয়ে খেয়ে কাটিয়ে দিচ্ছি দিনের পর দিন আর প্রতিদিন আশা করছি লোকটা ফিরে আসবে। বিবেকের দংশন বলেও তো একটা জিনিস আছে! কিন্তু এবার এলে আর ভুলব না। শুধু আমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াবার ব্যবস্থাটা করিয়ে নিতে হবে। তিনটে মাস দেখতে দেখতে ফুরিয়ে এল, কোথায় কে? কোনও পাত্তাই নেই। একটা চিঠি পর্যন্ত না।’
—‘নাম কি লোকটার।’ কোথায় থাকে ঠিকানা জানতিস না?’
—‘বালিগঞ্জের দিকেই থাকে, পুরো ঠিকানা জানতুম না, জানলেও যেতে পারতুম না বিজু। এত দিনেও যাইনি কখনও। এ নিদারুণ লজ্জা বিজু সব্বাইকার সামনে প্রকাশ করব কী করে? আমি যে ভদ্রঘরের মেয়ে!’
‘এখনও বেঁচে আছে? জানিস?’
—হ্যাঁ, কাগজে জন্মদিনের অভিনন্দন-টন্দন দেখি তো। আগে দেখতুম কোথায় কি এগজিবিশন কি কোনও সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সেন্টার ওপন করতে যাচ্ছে। কত ছবি, মালা, ভাষণ।’
—‘নামটা বল’—ভীষণ উত্তেজিত হয়ে বিজু বললেন।
—‘কী করবি?’ ছুটকি হাসল।
—‘ঠিক কী করব জানি না। তবে উচিত শিক্ষা দেব।’
ছুটকি বলল—‘যাই করিস আর তাই করিস, আমার জীবনের আটত্রিশটা বছর তো আর ফিরবে না! বরং যেটুকু বাকি আছে আরও ঘুলিয়ে উঠবে।’
বিজন দেখলেন নামটা ছুটকির মুখ থেকে কোনও অসতর্ক মুহূর্তে বার করে নিতে হবে—এভাবে হবে না। বললেন—‘তারপর কী হল? বল!’
—‘গঙ্গার ঘাটেই একদিন বিধবা এক ভদ্রমহিলা কপালে ফোঁটা কাটছিলেন, আমাকে দেখে বললেন—“রোজই চান করতে এসে দেখি মা শুকনো মুখে বসে আছ, কী ব্যাপার বলো তো? আমি তোমার দিদিমা-ঠাকুমার মতো তো হবোই!” কেমন মরিয়া হয়ে গেলুম। বললুম—আমার স্বামী আমায় ত্যাগ করে চলে গেছেন মা, একটা কাজকর্মের কিছু খোঁজ দিতে পারেন? ভদ্রমহিলা বললেন—“রান্না-বান্না জানো?” আমি কী বলব। প্রথমটা স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলুম। আমি ফিলজফিতে বি. এ. পাশ, কান্ট, হেগেল, লক, হিউম, বার্কলি পড়া একটা ভদ্রবাড়ির মেয়ে, আমার চেহারায় এমনই কিছু একটা ছিল যে একটা রূপবান, কোটিপতি, বয়স্ক লোক মাথার ঠিক রাখতে পারেনি, আমি…আমাকে রান্নার কাজ দেবার কথা ভাববে লোকে? দ্যাখ বিজু, বলতে গিয়ে এখনও আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।’
ছুটকি চুপ করে গেল। গঙ্গার হাওয়ায় তার যেন শীত ধরেছে। একটু একটু কাঁপছে। বিজু নিজের গা থেকে গরম আলোয়ানটা খুলে তার গায়ে জড়িয়ে দিলেন।
—‘একবার ভাবলুম বলি, বলি আমি গ্র্যাজুয়েট, সেক্সপিয়র, রবীন্দ্রনাথ আমার কণ্ঠস্থ। তারপর ভাবলুম কী-ই বা লাভ! আমি তো প্রমাণ করতে পারব না কিছুই। “দূর হতে শুনি বারুণী নদীর তরল রব/ মন বলে এ যে অসম্ভব এ অসম্ভব।” যদি এখন আবৃত্তি করি? কিংবা “ক্যানসট নট দাউ মিনিস্টার টু এ মাইন্ড ডিজীজড? প্লাক ফ্রম দা মেমরি এ রুটেড সরো…” তারপর ভাবলুম এ একরকম ভালই হল, কাউকে মুখ দেখাতে হবে না। কী করে এ ভয়ানক সংসারে নিরাপদে থাকব সে ভাবনা ভাবতে হবে না…। তখন কি ছাই জানতুম, নিরাপত্তা অত সহজ নয়।’
বিজু বললেন—‘কত দিন ছিলি সেখানে? নিরাপদে ছিলি না?’
—‘প্রথমটা ভালই ছিলুম। ভদ্রমহিলার দারুণ শুচিবাই। দিনের মধ্যে নিজেও চারবার চান করতেন। আমাকেও করিয়ে ছাড়তেন। যা বলতেন তা-ই করতুম। শুধু রান্না নয়, সব-ই। করতুম আর ভাবতুম আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হচ্ছে। পাপক্ষয় হচ্ছে। পুরোপুরি ক্ষয় হয়ে গেলে তখন হয়ত, হয়ত আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে পারব। কিন্তু ভদ্রমহিলার এক ভাগ্নে আসত মাঝে মাঝে, সে আমাকে নাকের জলে চোখের জলে করে ছাড়ত।’
‘তারপর সে বাড়ি ছেড়ে খুঁজে খুঁজে গড়িয়াহাটার এক দোকানে সেলস গার্লের কাজ নিলুম। কিন্তু থাকব কোথায়? দোকান মালিক নিজের বাড়িতে থাকতে দেবেন বললেন। গিয়ে দেখি, সে একা থাকে, পরিবার দেশে। তিন-চার দিনও সে কাজে টিকে থাকতে পারিনি। তারপর, একের পর এক কাজ আর বাড়ি পাল্টাতে পাল্টাতে বয়স বাড়ল। ক্রমে এই ঘাটে এসে টিকে গেলাম। একদিন গৌরাঙ্গদার সঙ্গে হঠাৎ দেখা। সে-ই তোর খোঁজখবর দিল। ঠিকানা দিল, তারপরেও অনেক অনেক দিন সাহস করিনি, একদিন হিসেব করে দেখলুম মায়ের বয়স নব্বুইয়ের কাছাকাছি এসে গেছে। তখন আর থাকতে পারলুম না। ভাবিনি মা জবাব দেবে।’
খাওয়াদাওয়া হয়ে গেল। অনেকক্ষণ ধরে দুজনে ছইয়ের মধ্যে শুয়ে শুয়ে জলের ছলাত ছলাত শুনতে লাগলেন। তারপর ছুটকি উঠে বসে বলল—‘এবার ফের বিজু, আমার বড্ড দেরি হয়ে যাবে।’
—‘তুই কি সত্যি-সত্যি ওখানে ফিরে যেতে চাস নাকি?’
—‘তো কোথায় যাব?’
—‘তার মানে? আমি এতদিন পরে এত খোঁজ করে এলুম কী জন্যে?’
—‘তা হয় না বিজু। তুই ভুল করছিস। তোর কতদিকে কত কাজ, কত বড় বড় লোকের সঙ্গে ওঠা-বসা, ছেলে-মেয়ে-স্ত্রী নিয়ে ভর্তি সংসার। এতদিন পরে আমাকে সেখানে নিয়ে গিয়ে বিব্রত হওয়া ছাড়া কিছু লাভ হবে না।’
বিজন বললেন—‘এখন আমার মনে হচ্ছে, সংসার নামক দানোটা আমাকে একটার পর একটা কাজ ঘাড় ধরে করিয়ে নিয়েছে, ক্রীতদাসকে যেভাবে মালিক করায়। আমি এবার নিজে নিজের মালিক হয়ে দেখব ছুটকি। আমার বাড়িতে যেতে যদি তোর ভাল না লাগে, না লাগতেই পারে, আমারও লাগে না, আমরা দু ভাই-বোনে আলাদা একটা ছোট বাড়ি নিয়ে থাকব। বাড়ি কি ফ্ল্যাট!’ তিনি সুখচরের কথা ভাবছিলেন।
ছুটকি বলল— ‘তোতে আমাতে? সে কী তোর ছেলে মেয়ে বউ?’
—‘তোর দায়িত্বজ্ঞানটা বড্ড বেশি হয়ে যাচ্ছে রে, ছুটকি। সবই তো গেছে, তবু অন্যকে মনে করতে ছাড়বি না?’
‘ঠেকে শিখেছি রে বিজু! তা নয় তো দায়িত্বজ্ঞানের কী পরিচয়ই বা আমি জীবনে দিয়েছি বল! নিজের কক্ষপথ থেকে ছিটকে পড়লুম স্রেফ স্তোকবাক্য শুনে, মোহে মুগ্ধ হয়ে, তার ফলে আমার যা অবস্থা হয়েছিল বোধহয় শেয়াল-কুকুরে টেনে কাঁচা মাংসগুলো জ্যান্তে খেয়ে নিত। রোজ জানলার কাছে লোক ঘুরঘুর করছে, সকালবেলা তা-ও পিছু নিচ্ছে। সেলস-গার্লের কাজ করতে গেছি, ডিউটির পর মালিকের অফিসে গিয়ে কম্প্যানি না দিলে মাইনে পাব না। বিজু তুই জানিস না ওই একটা ভুলের মধ্যে দিয়ে আমি জীবনের চেহারাটা একেবারে ছবির মতো স্পষ্ট দেখতে পেয়ে গেছি। এত দুঃখের মধ্যেও ওটাই আমার একমাত্র লাভ।’
—‘লাভ? লাভ বলছিস একে?’
—‘লাভ বই কি? মানুষ যখন প্রথম জন্মাল এই পৃথিবীতে, ধর প্রথম মানুষ-মা সে তো তার সন্তানকে কদিন পালন করেই তারপর অন্যান্য জন্তু-জানোয়ারের মতনই তাকে ফেলে চলে গিয়েছিল। তারপর শুধু আদিম জঙ্গল তার ভয়াল হিংস্রতা নিয়ে, আর একটি মনুষ্য শাবক। সেই মনুষ্য শাবক কেমন করে বেঁচেছিল, আমি বুঝতে পারি বিজু। কিংবা আদিম পৃথিবীতেও যাবার দরকার কী! এই দেশের শহরে শহরে, ফুটপাতে ঝোপড়িতে কত শিশুর জন্ম হচ্ছে, একটু বড় হয়ে একেবারে অনাথ হয়ে যাচ্ছে বেশির ভাগই, তখন একটা শিশু, বিশেষ করে নারী-শিশু কেমন করে কাল কাটায়, তার অনেকটাই এখন আমি বুঝি। আমি কুড়ি বছর বয়সে পৌঁছেছিলুম। ঘর সংসার, আত্মীয়, ভালবাসা, স্কুল-কলেজ খেলাধুলো এই জীবনটা পুরোপুরি পেয়েছিলুম। তারপর একদিন স-ব পরিচয়, সব পরিচিত খসে পড়ে গেল চারপাশ থেকে। জন্মদাত্রী জননী পর্যন্ত মুখ দেখতে চাইলেন না আর। যাকে ভালবেসেছিলুম, যে বলেছিল আমায় না পেলে সে সেই মধ্যবয়সে আত্মহত্যা করবে, সেও বিনা বাক্য ব্যয়ে চুপি-চুপি চলে গেল, আমাকে যে নিরাত্মীয় নিরালম্ব করে বাইরের জগতে টেনে বার করেছে সে কথার বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দিল না, কোনও ব্যবস্থা করল না, তারপর সংসার অরণ্যে কী করে প্রাণ বাঁচাব, মান বাঁচাব, বাঁচব কিনা, বাঁচাবার যোগ্য কি না এই প্রাণ এই মান, এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে করতে অবিরত যুদ্ধ করতে করতে একদিন দেখলম বাঃ অদ্ভুত তো! আমি মোটেই আমি নয়। আমি আই. এ তে বৃত্তি পাওয়া, ফিলজফির ছাত্রী কেয়া রায় নই মোটেই, আমি একজন নামহীন বামুনদি। খুব ভাল রাঁধি, রোগীর সেবা করতে পারি নির্ঘৃণায়, বাচ্চাদের একাহাতে মানুষ করে তুলতে পারি, খুব ভদ্র, শান্ত, শালীন এবং দায়িত্বশীল। এই প্রশংসা-পত্র, এই পরিচয় পত্র নিয়েই অনেক অনেক দিন কেটে গেল রে বিজু। ওরা চলে গেলে খবরের কাগজগুলো পড়ি, শেলফে রাখা গল্পের বইগুলো পড়ি। ইংরিজি বইয়ে আবার আমার হাত দেওয়া বারণ।’
—‘কেন?’
ছুটকি হেসে বলল- ‘একদিন বই ঝাড়তে ঝাড়তে সেই বিখ্যাত নভেল দুটো তাকের ওপর দেখছি- “আনা কারেনিনা” আর “রেজারেকশন”, কৌতূহলে অধীর হয়ে নামিয়ে নিয়ে পড়ছি, এমন সময়ে বাড়ির বড় ছেলে দেখতে পেয়েছে, সে হেসেই অস্থির- “বামুনদিদি তুমি আনা কারেনিনা নিয়ে কী করছ? যাক উল্টো করে ধরোনি তবু ভাল!” সঙ্গে সঙ্গে বুঝে নিলুম— বামুনদিদি পরিচয়ের সঙ্গে আনা কারেনিনা খাপ খায় না। একবার তো মোটামুটি এই রকমই একটা কারণে একটা বাড়ি থেকে উৎখাত হয়েছিলুম।’
—‘কি রকম?’ বিজু ছুটকির কোলে মাথা রেখে জিজ্ঞেস করলেন।
—‘সে এক কাণ্ড। বাড়িতে মা-বাবা কেউ নেই, স্কুল ফাইন্যাল পরীক্ষা দেবে ছেলে, ইংরেজি ট্রানস্লেশন নিয়ে হিমসিম খাচ্ছে। ‘ত্যাজ্য-পুত্র করা’ কী হবে, শেষে তার কান্না দেখে বললুম দেখো তো বোধ হয় “ডিজওন” হবে কিংবা “ডিজইনহেরিট”। “প্রায়োপবেশন” কী হবে? বললুম বোধহয় “ফাস্ট আনটিল ডেথ”। বাবা-মা এলে সে উৎসাহ করে বলেছে বামুনদিদি এই বলেছে। তার মা আমাকে রাত্রে একা ডেকে থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করলেন—“তুমি কে?” মুখটাসুদ্ধু থম থম করছে। আমি কী বলব? তিনি আমার জবাব শুনতেও চাইছিলেন না, বললেন “যত তাড়াতাড়ি পারো অন্য জায়গায় কাজ খুঁজে নাও।” তা বিজু আমি আজও জানি না আমি আসলে কে? জন্মপরিচয় বংশপরিচয় মুছে গেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয় তা-ও লুপ্ত হয়ে গেল। কেয়া নামে কোনও রাঁধুনি হয় না। কারও বাড়ি কাজ নেবার সময়ে শুধু বলতুম নামে কী হবে? আপনারা আমাকে বামুন-মেয়ে বলে ডাকবেন।’
বিজু বললেন— ‘কী আশ্চর্য! লেখাপড়া জানিস বুঝতে পেরে কোথায় তোকে সাহায্য করবে… অদ্ভুত মানুষ তো! তা তুই সেই থেকে বই পড়া ছেড়ে দিলি?’
ছুটকি হাসল, বলল ‘তোর কি মনে হয় কেয়া রায় বই হাতে পেলে ছেড়ে দেবে?’
—‘উঁহু, মনে হয় না, আমি যেমন যেদিকে বই তার উল্টো দিকে হাঁটতুম, তুই ছিলি তেমনি বইয়ের পোকা। — তারপর ব্যবসা দাঁড় করাবার জন্যে প্রচণ্ড খাটতে হয়েছে, কাগজ আর জার্নাল-টার্নাল ছাড়া বিশেষ কিছু…’
ছুটকি বলল— ‘তাহলে আমি তোর থেকে বেশিই পড়বার সুযোগ পেয়েছি কিন্তু। সেই প্রথম যুগে যে বিধবা মহিলা আশ্রয় দিয়েছিলেন তাঁকে কালীপ্রসন্ন সিংহের মহাভারত, ব্যাখ্যাসুদ্ধু গীতা, কৃত্তিবাসী রামায়ণ পড়ে শোনাতে হত। পরে এক শয্যাশায়ী ভদ্রলোকের আয়ার কাজ করেছি। তাঁর কাছে থাকতেও বহু বই আমায় পড়ে শোনাতে হত। রাসেল, বিবেকানন্দ, রাধাকৃষ্ণান, সোয়াইটজার, এমন কি! বলে ছুটকি হাসতে লাগল।
—‘এমন কি…’
—এমন কি হ্যাভেলক এলিস, লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার, ট্রপিক অফ ক্যানসার…।’
—‘বলিস কী?’
—‘একটা একুশ বাইশ বছরের মেয়ে তাঁকে এইসব পড়ে শোনাচ্ছে এটাই ছিল ভদ্রলোকের আনন্দের ধরন। ডানদিকটা পুরো প্যারালাইজ্ড। ষাটের ওপর বয়স। ঘরে কেউ উঁকি দিয়েও দেখতে আসত না।’
—‘সে কাজটা তো তোর এক হিসেবে বেটার ছিল। ছাড়লি কেন?’
ছুটকি ম্লান হেসে বলল, ‘একটা ওই বয়সের সহায়সম্বলহীন মেয়ের জন্যে শুধু দুটো পথ খোলা থাকে বিজু। একটা আদি ব্যবসা। আরেকটা কোনও মিশন-টিশনে গিয়ে আশ্রয় নেওয়া, সেটাও খুব সহজ নয়। মাঝামাঝি কোথাও বেশি দিন টিকে থাকা যায় না। তুই কি ভাবছিস পড়ানোর কাজ আমি খুঁজিনি! কিন্তু আমার যে থাকার সমস্যা ছিল! বাড়িতে থাকতে দিতে হবে শুনেই লোকে অস্বস্তিতে পড়ত। বি.এ-র মার্কশিট দেখতে চাইত। চেনাশোনা কারুর রেফারেন্স চাইত। বাড়িঘর কোথায়, থাকতে দিতে হবে কেন এ সব প্রশ্নের সদুত্তর চাইত। আমি তো কিছুই দিতে পারতুম না। আমার এ-ও মনে হত, কোনও ভাবে চেনা বেরিয়ে পড়ে যেন বাবা-মা ভাইবোনেদের মুখ আর হেঁট না করতে হয়।’
সূর্যাস্ত হচ্ছে। আবির গোলা জলের মধ্যে দিয়ে ছপাত ছপাত করে নৌকো কূলে ভিড়ল। বিজন ছুটকিকে নামতে সাহায্য করলেন। তারপর গলা কঠিন করে বললেন—‘ছুটকি তোর আর ও বাড়ি ফিরে যাওয়া হবে না। হতে পারে না।’
—‘তা হয় না বিজু।’
—‘তুই কি মনে করেছিস আমি নিজের কাজে মেতে তোকে ভুলে যাব? অবহেলা করব?’
—‘না, তা নয়। জানি তোর এখন অনেক সামর্থ্য। আমার কোনও একটা উপায় কি আর তুই করে দিতে পারিস না! কিন্তু বিজু, আমি এখন কি রকম অদ্ভুত হয়ে গেছি। কিছু না দিয়ে কারও কাছ থেকে আর কিছু নিতে পারি না। ভালবাসার দাবিতে… না, না, ও দাবি আমার জীবন থেকে কেমন শুকিয়ে গেছে। আর তার দরকারই বা কী! এত দিনে আমার সামান্য কিছু সঞ্চয় তো হয়েছেই! যৎসামান্য। ধর ত্রিচীবর আর ভিক্ষাপাত্র, তবু সে আমার নিজের উপার্জন করা। কুড়ি বছর বয়সের পর থেকে যেটুকু পেয়েছি, অতি সামান্য, তবু তা কুল, অর্থ, এমন কি বিদ্যাও নয়, পেয়েছি আমার নিজের শ্রম, নিজের চরিত্রের জোরে। ভেবে দ্যাখ একটা মানুষের নিজস্বতম সত্তার অর্জন সেটুকু। এখন তাই আর কিচ্ছু চাই না।’
বিজু দেখলেন ছুটকির এ অভিমান সহজে যাবার নয়। খুবই স্বাভাবিক! কৈশোরের দিনগুলোতে ছুটকিকে যতটুকু চিনেছিলেন এই অভিমান, এই জেদ তার ছিল। কিন্তু ষাট বছর বয়স হতে চলল এখনও ছুটকি শারীরিক পরিশ্রম করে অন্নসংস্থান করবে? বিজন থাকতে? এ হয় না, হতে পারে না! কিন্তু অভিমান যে যুক্তির ধার ধারে না! কী করে বোঝান এখন তিনি ছুটকিকে! তাঁকে তাহলে বারবার আসতে হবে। বারবার বোঝাতে হবে। ফেরাতে হবে। ফেরাতেই হবে।
যদি রায়-পরিবারের পুরনো আবহাওয়ায় বা নতুন প্রেক্ষিতে না-ও হয়, অন্ততপক্ষে বিজুর কাছে, শুধু বিজুর কাছে ছুটকি ফিরে আসুক। ছুটকি তার বিষণ্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে বলল—‘রাগ করিসনি বিজু, কিন্তু একজনের জিনিস চুরি করেছিলুম, সেই পাপের শাস্তি কী, কখন কোথায় তার শেষ আমায় বোধহয় এইভাবেই জানতে হবে।’
তখন বিজু দেখলেন তাঁর গোপন কথা বলবার সময় এসেছে। তিনি আস্তে আস্তে বললেন—‘অনেকক্ষণ থেকে চুরি-চুরি, পাপ-পাপ করছিস ছুটকি। তাহলে শোন। বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছি। উদ্দেশ্যহীন। কাশীর টিকিট কিনে দুন এক্সপ্রেসে চড়ে বসেছি। চাপাচাপি ভিড়। পাশে বসেছে এক ভুঁড়োপেট অবাঙালি। মাঝরাত্তিরে ঘুমের মধ্যে শুনলাম কামরায় গোলমাল। যেন পুলিশ উঠেছে। সকালে কাশীতে নামবার সময়ে ব্যাগটা অসম্ভব ভারী লাগল। সেই চেক-চেক ডাকব্যাকের ব্যাগটা মনে আছে? দু-চার দিনের জন্যে কোথাও খেলতে-টেলতে গেলে যেটা নিতুম? কাশীতে নেমে একটা ধর্মশালায় উঠেছি। লাক্সার রোডের কাছে। ব্যাগ থেকে জামাকাপড় বার করতে যাব, চানে যাব বলে, চেনটা টেনেই আমার চক্ষুস্থির। থাকে থাকে একশো টাকার নোট। গুনে-গেঁথে দেখলুম পুরো এক লাখ। ভাবতে পারিস? আমার ব্যাগটাতে ছিল দুটো গেঞ্জি, দুটো প্যান্ট, দুটো পুরনো শার্ট, একটা গামছা আমার খেলার বুটজোড়া দু-চারটে নিম-দাঁতন। বদলে গেছে। পাশের লোকটাকে মনে পড়ল। প্রথমে ভেবেছিলুম, নিশ্চয়ই জাল টাকা। পুলিশ উঠেছিল হয়ত এরই জন্যে। তারপর দেখি সুতো-টুতো সব ঠিক আছে। নোটের নম্বরও এলোমেলো। ব্যাংকের নম্বর মিলোনো নোট নয়। দু-চার দিন অপেক্ষা করলুম যদি মালিকের সন্ধান পাই। পেলুম না। স্রেফ মেরে দিলুম। আজও জানি না সে কার টাকা, কিসের টাকা। স্মাগলারদের? না ব্ল্যাকমানি কেউ কোথাও সরাচ্ছিল। কিন্তু সেই টাকা থেকেই আজকে আমার ‘রায় ইন্ডাস্ট্রিজ।’ কীভাবে তাকে কাজে লাগিয়েছি, কার কার পরামর্শ নিয়েছি, কীভাবে ছোট থেকে বড় আরও বড় ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছি সে এক ইতিহাস। অন্য ইতিহাস। কিন্তু ভিত হল স্রেফ কুড়িয়ে পাওয়া টাকা। চুরিও বলতে পারিস। ছুটকি আমরা জোড়া ভাইবোন, তুই দু ঘণ্টা চোদ্দ মিনিটের বড়, দু জনেই দুটো পুঁটলি কুড়িয়ে পেয়েছিলুম। পরিত্যক্ত পুঁটলি। চুরি বলিস চুরি, কুড়নো ধন বলিস কুড়নো ধন। এখন তাকে যদি পাপ বলে সারা জীবন শিঁটিয়ে থাকতে হয়, তো আমারও তো এক্ষুনি প্রায়শ্চিত্তের জন্যে কিছু করা দরকার। সমস্ত বিলিয়ে-টিলিয়ে দিয়ে ভ্যাগাবন্ড হয়ে যাব, না কী। বল!’
ছুটকি বলল—‘তা নয় বিজু। তুই পেয়েছিলি টাকা, জড় বস্তু। তাকে আঁকড়ে থাকলে সে থাকে। বাড়াতে পারলে বাড়ে। আমি পেয়েছিলাম ভালবাসা, সজীব শক্তি। আঁকড়াতে চাইলেই সে থাকবে কোনও মানে নেই। তা ছাড়া বিজু তুই আর আমি দুইয়ে মিলে এক। চাঁদের এ পিঠ আর ও পিঠ। আমার পিঠে শুধু অন্ধকার।’
ছুটকি পাশের বাড়ি থেকে চাবি এনে তালা খুলল। আস্তে আস্তে ভেতরে ঢুকছে। বিজু দরজার মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। অপেক্ষা করছেন। কতক্ষণ! শেষে হতাশ বিজু পেছন ফিরলেন। এ কাজ একদিনে হবার নয়। হঠাৎ শূন্য বাড়ির ভেতর থেকে আর্ত গলায় ছুটকি ডেকে উঠল—‘বিজু…!’ যেন ডুবন্ত মানুষের আর্তনাদ। একলা দ্বীপে দণ্ডিতকে নামিয়ে দিয়ে যেন জাহাজ চলে যাচ্ছে। শূন্য দ্বীপের পাহাড়ে পাহাড়ে ধাক্কা খাচ্ছে ছুটকির ডাক ‘বিজু! বিজু!’
চকিতে ফিরে দাঁড়িয়ে বিজু ছুটকির আর্তনাদে নিজের আর্তনাদ মিশিয়ে বললেন—‘ছুটকি, ছুটকি, এই তো আমি! তোর বিজু। তোকে নিতে এসেছি। এক্ষুনি চল। চলে আয়।’
ছুটকি জলভরা চোখে তাঁর দিকে চেয়ে বলল—‘না বিজু, তুই আগে বল, আগে কথা দে তুই পারবি?’
—‘কী পারতে হবে?’
—‘আমাকে আমার সমস্ত পরিচয়সুদ্ধু, সেই কুল ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া মেয়ে, সেই একজনের ভোগ করে এঁটো পাতের মতো ফেলে যাওয়া নারী, সেই আয়া, রাঁধুনি, সেলসগার্ল, দাসী, দূর দূর করে খেদিয়ে দেওয়া টিউশনি খুঁজতে আসা মেয়ে, বামুন-মা—এই সমস্ত পরিচয়সুদ্ধু যেখানে বসাতে চাইছিস, তোর পাশে, তোর বোন বলে, দিদি বলে। পারবি? বসাতে?’
তখন বিজু রায় বুঝতে পারলেন ছুটকিকে। পুরোটা হয়ত নয়। তবে অনেকটাই। বোঝাটা এল ঝলকে ঝলকে। ছুটকি জীবনে নিষ্ঠুর আঘাত খেয়েছে একটার পর একটা। সমাজের চোখে সে হয়ত অনেক নীচে নেমে গেছে। কিন্তু এই সমস্ত অভিজ্ঞতা দিয়ে সে শেষ পর্যন্ত জীবনকে আবিষ্কার করেছে। যে জীবনকে আড়াল করে থাকে সমাজ, সম্পর্ক। নিজেকে ঘনিষ্ঠভাবে জেনেছে ছুটকি। জেনেছে যা তার স্ব-রূপ। নিজের সেই নিজত্বটুকু তার যুধিষ্ঠিরের কুকুর। তাকে ত্যাগ করে সে স্বর্গে যেতেও চায় না।
একটু দেরি হল জবাব দিতে। তারপর নিশ্বাস ফেলে তিনি বললেন—‘পারব ছুটকি। ঠিক দু দিনের মাথায় তোকে নিতে আসছি। তৈরি থাকিস।’ বলে বিজু হঠাৎ নিচু হয়ে ছুটকির পায়ের ধুলো নিলেন, একটা চুরি, চুরির ফলই বলো কিংবা প্রতিফলই বলো, তারই ওপর তাঁদের দুজনের জীবন দাঁড়িয়ে আছে অথচ তিনি ক্রমশ আত্মবিস্মৃত এবং ছুটকি ক্রমশই আত্মসচেতন। ক্রমশই আরও আরও অন্বেষু এবং আত্ম-নির্ধারণের কঠিন পথে বহু বহু দূর অগ্রসর হয়ে গেছে বুঝতে পেরে।