Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বৃত্তের বাইরে || Bani Basu » Page 10

বৃত্তের বাইরে || Bani Basu

নীলাদ্রি, সাহেবের ছেলে অফিসে বসছে। রোজ। সাধন বিশ্বাস অনেকটা নিশ্চিন্ত। আইন মাফিক কিছুই করতে পারবে না এখনও নীলাদ্রি। কিন্তু কাজগুলো দেখছে, বুঝে নিচ্ছে একটু একটু করে। সাহেবের এগজিকিউটিভ চেয়ারটা শূন্য দেখতে হচ্ছে না। এটা, এটাও অনেক। ফ্যাকটরিতেও যাচ্ছে নীলাদ্রি। রোজ একবার করে। ক্যানিং স্ট্রিট থেকে বেলিলিয়াস রোড। সময় নিয়ে যাচ্ছে। নিয়ে আসছে। অনেক দিন আগে থেকেই কর্পোরেশনের নোটিস এসে পড়ে আছে। ঘুসুড়ির বাড়ি ওরা ডিমলিশ করে দেবে। সাধন বিশ্বাস—সাহেব বাইরে ট্যুরে গেছেন বলে অনেক হাঁটাহাঁটি করে অনেক কষ্টে ঠেকিয়ে রেখেছেন। আজ নীলাদ্রিকে ঘুসুড়ির বাড়িটা দেখাতে যেতেই হবে। কারখানায় যাবে না। ঘুসুড়ি যাবে। নীলাদ্রি আজকে তার ডার্ক ব্রাউন স্যুটটা পরেছে। বড় বড় চেক-কাটা চওড়া টাই। লিগ্যাল অ্যাডভাইসার সুখেন্দু দত্ত একটু আগেই কতকগুলো কাগজপত্র ‘ফর’ দিয়ে সই করা যাবে, জানিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। ‘মে আই কাম ইন, সাহাব!’

নীলাদ্রি মুখ তুলে দেখল সুইং ডোরের ওপর থেকে শ্রীমান সোহনের মাথাটা উঁচিয়ে আছে। আর সুইং ডোরের তলায় দুজোড়া পা। অর্থাৎ দুজন আছে। সোহন চাপা গলায় বলল, ‘প্লিজ, স্টে লাইক দ্যাট।’ বিদ্যুতের মতো ক্যামেরা তুলে ক্লিক করল, ফ্ল্যাশগান ঝলসে উঠল। ‘দ্যাটস লাইক আ গুড বয়,’ মন্তব্য করল সোহন। ‘এগজিকিউইটভ নীলাদ্রি রায়ের একটা ছবি নিলুম।’

সোহন ভেতরে এসে বসল। পেছনে অবধারিত ভাবে শুক্তি। নীলাদ্রি গম্ভীর। বলল, ‘কী মনে করে? হঠাৎ?’

সোহন বলল, ‘শুক্তির নতুন নামকরণ হয়েছে। সেটার অনারে একটা খানাপিনা নাচাগানা হবে, চিন্টু রায় না থাকলে জ্যাকসন মার্কা নাচটা করবে কে?’

—‘আমার এখন ওসব বাজে ব্যাপারে সময় দেবার মতো সময় নেই! তোমরা আসতে পারো।’

—‘যাচ্চলে, নামটা আগে শোন, হাতের কাছে পড়েছিল মাইরি, চোখে পড়েনি। সেই আছে না? আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে, দেখতে আমি পাইনি তোমায় দেখতে আমি পাইনি। নামটা হল শুঁটকি। জাস্ট একটা চন্দরবিন্দু। আর একটু বর্ণ বিপর্যয়। দুর্দান্ত একটা কনোটেটিভ প্রপার নেম হয়ে গেল।

শুক্তি বলল, একটা দন্ত্যবর্ণ ছিল তো সেটা মূর্ধন্যবর্ণ হয়ে গেল। সেটাও বল।’

চিন্টু হঠাৎ সব কিছু ভুলে বলল, ‘তুই রাগিসনি যে বড়? আঁচড়ে কামড়ে ছিঁড়ে দেবার কথা তো তোর সোহন শালাকে।’

‘রেগে গিয়েছিলুম, বিশ্বাস কর, রেগে একেবারে যাকে বলে অগ্নিশর্মা, সোহনটা এত পাজি যে কোকের একটা ক্যান ধরিয়ে দিলে, ওর জাহাজি দাদা রেগুলার সাপ্লাই মানে নিয়মিত সরবরাহ করে জানিস তো? তো তারপর নামটার উইটটা আমাকে এমনভাবে আক্রমণ করল, আচ্ছন্ন করে ফেলল যে আমি হেসে ফেললুম, রাগটা একেবারে জলে গেল রে নীল।’

—‘তা বেশ করেছিস। এখন ফোট, কাজ আছে।’

—‘একটা ঠাণ্ডাও খাওয়াবি না?’ শুক্তি করুণ মুখ করে বলল।

এই সময়ে বেয়ারা তিন কাপ কফি নিয়ে প্রবেশ করল। একটা করে ছোট্ট কাঠের ম্যাট সামনে রেখে কফির কাপগুলো নিঃশব্দে নামিয়ে রাখল। সোহন বলল, ‘থ্যাংকিউ ভাই।’

—‘নে, খেয়ে নে’ নীলাদ্রি কফিটা মুখে তুলল।

—‘কোথায় যাবি রে এখন? নীচে সমরদা বলছিল।’

—‘ঘুসুড়িতে একটা বাড়ি হচ্ছে। সেখানে।’

—সল্ট লেক থেকে ঘুসুড়ি এসে থাকবি? মাইরি তোর ব্রেইন আছে।’ সোহন কফিতে চুমুক দিয়ে বলল।

—‘আজ্ঞে না। এটা মাল্টিস্টোরিড। ড্যাড করছিল। দেখাশোনা করতে হয় এবার।’

—‘আমি যাব।’ শুক্তি ঘোষণা করল।

—‘আমিও যাচ্ছি’, সোহন সঙ্গে সঙ্গে বলল।

‘ওটা নাচাগানার জায়গা নয়। ইটস ক্রুড রিয়্যালিটি। উই আর ইন ট্রাবল ওভার দ্যাট ব্লাস্টেড মাল্টিস্টোরিড।’

‘কঠিন বাস্তব আমি ভালবাসি।’ শুক্তি দ্বিতীয়বার ঘোষণা করল।

সোহন বলল ‘মনে হচ্ছে কয়েকটা ইন্টারেস্টিং ছবি তুলতে পারব। কর্পোরেশন প্ল্যান এবং নিয়মকানুনকে কলা দেখিয়ে ঘুসুড়িতে কোটিপতির বহুতল, ধসে পড়তে যাচ্ছে, রাজমিস্ত্রি কেয়ারটেকার তলায় শুত, একেবারে চেপ্টে গেছে, বেশ ভালই খাবে কাগজগুলো।’

—‘মাফ করতে হচ্ছে, তুমি বা তোমরা জাহান্নামে যেতে পারো, ঘুসুড়ি যাচ্ছ না।’

‘জাহান্নাম তো ঘুরে এসেছি’ সোহন অবাক চোখ করে বলল, ‘এক জায়গায় কি দুবার যেতে ভাল্লাগে রে চিন্টু?’

নীলাদ্রি উঠে দাঁড়িয়ে সুইং ডোর ঠেলে বেরিয়ে এল। সাধন বিশ্বাসকে বলল, ‘সাধনকাকা আমি বেরোচ্ছি, ঘুসুড়ির ফাইলটা দিন, আর আমার অফিসের দরজা বন্ধ করে দিন!’ সে হুড়হুড় করে নেমে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসল—‘সমর স্টার্ট দাও, কুইক।’

সমরও গাড়ি ছাড়ল। পেছনে সোহনের মোটরবাইকও সগর্জনে চালু হল। সোহনের পেছনে শুক্তি ওরফে শুঁটকি।

সমর বলল, ‘দাদা আপনার বন্ধুরা তো গাড়িতেই যেতে পারতেন।’ চিন্টু কোনও জবাব দিল না। হতে পারে বস নিরুদ্দেশ। হতে পারে বস একটা ধনী, খ্যাতনামা ব্যবসায়ী। ব্যবসাতে ‘বাটার ওন্ট মেল্ট ইন হিজ মাউথ’ টাইপদের কোনও স্থান নেই, এটাও সে মানতে পারে। কিন্তু বস জেনেশুনে একটা ইললিগ্যাল বাড়ি করছে আর পাঁচটা কমন প্রোমোটরের মতো, এ সাজেশ্‌চন অসহ্য, অপমানকর! কী ভেবেছে সোহন! কবে একটা সিভিল এঞ্জিনিয়ারিং-এর ডিগ্রি নিয়েছিল খড়্গপুর থেকে, আর লন্ডন থেকে ফটোগ্রাফির কোর্স করে এসেছে বলে সবজান্তা হয়ে গেছে? ব্লাডি ফুল! হোয়াট ডাজ হি থিংক অফ হিমসেলফ?

বাড়িটার সামনে এসে সমর গাড়ি পার্ক করল। চিন্টু একবার চেয়ে দেখে নিল চেহারাটা তারপর কোনওদিকে না তাকিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। তার পেছন পেছন যেতে যেতে শুক্তি মন্তব্য করল, ‘কী সুন্দর দেখেছিস সোহন? জানলার ওপর ওইরকম তেকোনা টুপি আমার ভাল লাগে, আর ঝুল বারান্দা!’

নীচে ভাবী অ্যাসোসিয়েশনের ঘর। শিবশঙ্কর সন্ত্রস্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল। চিন্টু টেবিলের সামনে গম্ভীরভাবে চেয়ার টেনে বসল। সোহন বলল, ‘হোয়াটস দা ট্রাবল ম্যান?’ তার কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ। দু হাত কোমরে দিয়ে পা ফাঁক করে হিরো-হিরো স্টাইলে দাঁড়িয়েছে।

শিবশঙ্কর কাকে জবাব দেবে ভেবে পাচ্ছিল না। এরা কে? চিন্টুবাবু গুণ্ডা নিয়ে এসেছে? সঙ্গে আবার একটা বাচ্চা মেয়ে। সে সোহনকে ভয়ে ভয়ে বলল, ‘বাড়ির প্ল্যান ভাল নয়। বলছে কর্পোরেশন। বলছে সিমেন্ট বাজে কোয়ালিটির, লোহা মাপমতো নয়।’

—‘প্ল্যান তো স্যাংশন হয়েছিল, না কি?’

—‘অবশ্যই। তবে সে হল গিয়ে আগেরবারে। ইলেকশনের পর এ ওয়ার্ডে নতুন কাউন্সিলর।

—‘তাই বলে তো স্যাংশনড প্ল্যান বাতিল হয়ে যেতে পারে না? পারে?’ সোহন এক ধমক দিল।

—‘না, তা নয়। ওই বিল্ডিং মেটিরিয়ালস…’

—‘কনট্র্যাক্টর কে?’ সোহনের গলা কড়া থেকে কড়াতর।

—‘আজ্ঞে আমি।’

—‘আপনি গঙ্গা মাটি চালিয়েছেন? সাহস তো কম নয়?’

—‘না না। আমি যথাসাধ্য ভালই সব দিয়েছি। দিচ্ছি। তবু কর্পোরেশন বলছে…’

—‘চলুন, চলুন তো দেখি। চিন্টু আয়, শুক্তি আয়।’

সোহনের পেছন পেছন শিবশঙ্কর। তার পেছনে শুক্তি, সবার পেছনে চিন্টু উপরে উঠতে লাগল। দোতলা তেতলা ঘুরে ঘুরে দেখল।

শিবশঙ্কর বলল—‘সব হাজার তিরিশ স্কোয়ার ফুটের ফ্ল্যাট। কাটিং কী চমৎকার দেখুন। সব দুটো বড় বড় ঘর, ড্রয়িং, ডাইনিং, দুটো ডাবলু সি, কিচেনে সব ঢালাইয়ের তাক-টাক রেডি। মোজেইকটা দেখুন। সে জুতোর ডগা দিয়ে মেঝের আবর্জনা প্লাস্টারের গুঁড়ো কিছুটা খুঁচিয়ে পরিষ্কার করে দিল।

সোহন উবু হয়ে বসে ভাল করে পরীক্ষা করে বলল, ‘ক্লাস ওয়ান। চমৎকার। এই যে গ্রিনের এতগুলো শেডের পাথর দিয়েছেন এ কি আপনিই পছন্দ করলেন?’

—‘না, না, ওসব বিজুবাবু মানে সাহেবই করেছেন।’

সোহন তার বাহিনী নিয়ে তেতলায় উঠল। ডাঁই করা রয়েছে সিমেন্টের বস্তা, বালির স্তূপ, লোহা রয়েছে একদিকে কিছু। লোহাগুলো কিছু উঠিয়ে নিয়ে ভাল করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল সোহন, উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ঠিকই আছে তো! সিমেন্ট দেখান তো?’

ওপর থেকে একটা বস্তা নামিয়ে দিল শিবশঙ্কর।

—‘কোম্পানির নাম তো খুব। ভেতরে কি দু নম্বরি করেছেন?’

—‘না, না, আজ্ঞে না!’

সোহন বলল, ‘একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে আমি সাম্পল নিয়ে যাব। শিগগির আনুন।’

‘শিবশঙ্কর দুড়দাড় করে নীচে নেমে গেল।’

—‘এইরকম মেনিমুখো দেখতে একটা লোককে আঙ্কল বিশ্বাস করেন কী করে? আশ্চর্য!’

সোহন বলল, ‘আই ডেফিনিটলি স্মেল রটন ফিশ।’

একটু পরে শিবশঙ্কর ওপরে উঠে আসছে দেখা গেল। পেছনে-পেছনে আর একটি লোক। সাদা ধবধবে মাখন জিনের প্যান্ট। কালো টি শার্ট একটা। ইয়া মাস্‌ল। বুকের ছাতি। গলায় একটা মোটা সোনার হার। ফর্সা রং এখন গাঢ় তামাটে হয়ে গেছে।

শিবশঙ্করের হাতে একটা প্ল্যাস্টিকের প্যাকেট। লোকটি বলল, ‘নমস্কার বাবুসাহেব, আপনি কে হচ্ছেন?’ সে সোহনের দিকে তাকিয়ে বলল।

—‘হু আর য়ু?’ সোহন প্যাকেটটাতে সাবধানে সিমেন্ট ভরতে ভরতে বলল।

—‘হামি ভানপ্রতাপ।’ লোকটি এমনভাবে বলল, যে বোঝাই গেল তার পদবি-টদবির মতো উদ্বৃত্ত জিনিস দরকার হয় না।

—‘এ সাইটে আপনি কেন?’ সোহন সোজা তাকিয়ে বলল।

—‘হামি ধরুন কেয়ারটেকার আছি।’

—‘ধরতে হবে কেন? সত্যি সত্যি কেয়ারটেকার নন?’

—‘ইয়ে বহোত খতরনাক এরিয়া আছে সমঝলেন? তো কেয়ারটেকার সমশের হমাকে রাতে থাকতে বলে।’

—‘বাঃ আপনি তো খুব পরোপকারী লোক ভানপ্ৰতাপজি!’ ভানপ্রতাপ একটা সিগারেট ধরাল, খুবই আত্মতৃপ্তভাব। প্যাকেট খুলে বাড়িয়ে ধরল। সোহন ছাড়া কেউ নিল না।

—‘কত পাচ্ছিলেন বি. বি. রায়ের কাছ থেকে?’

একটু ইতস্তত করে ভানপ্রতাপ বলল, ‘উ সব ছোটি ছোটি বাত আছে, কোনও কুছু ঠিক হয়নি এখনও সাব। তো আপনি কে হচ্ছেন? বললেন না তো?

—‘আমি সোহন সিং। কলেজ স্ট্রিটের জাভেদ আনসারিকে চেনেন?’

ভানপ্রতাপ চমকে উঠল।

—‘আচ্ছা আজ চলি।’ সোহন প্যাকেটটা নিয়ে সিঁড়িগুলো তরতর করে নেমে গেল। পেছনে পেছনে শুক্তি, চিন্টু।

নেমে এসে অ্যাসোসিয়েশনের ঘরে ঢুকে সোহন হঠাৎ কাগজপত্র দেখতে দেখতে নাটকীয়ভাবে ঘুরে গেল পেছনে দাঁড়ানো শিবশঙ্করের দিকে, ভানপ্রতাপ বাইরে দাঁড়িয়ে, হুঙ্কার দিয়ে বলল, ‘টেক কেয়ার শিবশঙ্করবাবু।’ কথাটা বাইরে ভানপ্রতাপের কানে গেল নিশ্চয়ই। সোহন বাইরে বেরিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, ‘আমার ফোন নম্বরটা রাখুন ভানপ্ৰতাপজি’ হিপপকেট থেকে সে একটা নোটবই বার করল, তার ভেতর থেকে ছোট্ট একটুকরো কাগজ। তার ওপর খসখস করে ফোন নম্বর লিখল। তারপর গটগট করে বেরিয়ে মোটরবাইকে স্টার্ট দিল, চেঁচিয়ে বলল, ‘শুক্তি তুই চিন্টুর সঙ্গে যা। আমার কাজ আছে।’

শুক্তি বলল, ‘নীল লাঞ্চ টাইম তো হল, চল তোকে আজ খাওয়াই।’

চিন্টু বলল, ‘ভাল লাগছে না রে শুক্তি।’

—‘চল না ট্রিলিয়নস-এ যাব। দারুণ দারুণ মেয়ে আসে। কলকাতার যত সুন্দরী মেয়ে—সিন্ধি, পার্সি, পাঞ্জাবি, বাঙালি, দক্ষিণী—সব ওখানে ঢুঁ মারে। দারুণ রে জয়েন্টটা।’

চিন্টু বলল, ‘ট্রাই টু গ্রো আপ শুক্তি, হোয়াট ডাজ আ সুন্দরী মেয়ে মীন? অ্যাবাউট ফিফটি টু পাউন্ডস অব ফ্লেশ, সাম ফ্যাট, অ্যান্ড দা এক্সক্রিটরি সিস্টেম! জাস্ট অ্যান অ্যানিমল!’

হাসি চেপে শুক্তি বলল, ‘তুই যে প্রায় বিবেকানন্দর মতো কথা বলছিস রে চিন্টু।’

—‘মে বী, বিবেকানন্দ টূ ওয়জ ইন মাই পোজিশন। ড্যাড নিরুদ্দেশ। তেইশ দিন হল। কোনও খবর নেই। একটা ডিটেকটিভ এজেন্সিকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছি বেশ কিছুদিন হয়ে গেল। নাথিং ডুয়িং। আমার অ্যাকাউন্টে সব টাকা শেষ। তিতির, মানে আমার বোনের অ্যাকাউন্টে আছে কিন্তু ও দিচ্ছে না, বলছে যখন তখন কাজে লাগতে পারে। ওর একথা বলার রাইট আছে। শী সেলডম ইউজেস আ কার। মোস্ট ইনএক্সপেনসিভ ক্লোদস পরে। মা-ও গাড়ি চড়ছে না। শর্মাজি আমার বাবার বন্ধু কাঁচা রসিদে টাকা ধার দেবেন বলেছেন, তাই দিয়ে ফ্যাকটরির, অফিসের যাবতীয় খরচ আপাতত মেটাতে হবে। কী সব অর্ডার ক্যানসেল হয়ে গেছে, টের পেয়েছে বি. বি. রয় নেই। কিন্তু নেই, একদম নেই এর কোনও প্রমাণ না দিতে পারলে আমাদের সবাইকার হাত-পা বাঁধা। লিগ্যালি কিছু করতে পারব না। কোনও লোকাস স্ট্যান্ডই নেই। আ গ্রিম ডার্ক নাইট ইজ ডিসেন্ডিং অন আস। আই ডোন্ট নিড উওমেন, শুক্তি, আই নিড ফ্রেন্ডস, রিয়্যাল ফ্রেন্ডস!’

—‘বাট ইউ হ্যাভ গট দেম? হ্যাভ্‌ন্‌ট য়ু?’ শুক্তি চিন্টুর হাত ধরে তার দিকে তাকাল, নরম গলায় বলল, ‘শিগগির একটা না একটা কিছু বার হবে। দ্যাখ না, অত ঘাবড়াচ্ছিস কেন?’

—‘একটা না একটা কিছু মানে তো ড্যাডের ডিকম্পোজড ডেড বডি, ফ্রম সাম ডোবা অর পুকুর, মাইলস অ্যাওয়ে ফ্রম হোম!’

শুক্তি শিউরে উঠে বলল, ‘না, না, পজিটিভ চিন্তা কর, নীল এভাবে ভাবিস না।’

—‘তা আর কী ভাবব বল? এইরকমই তো ঘটে! সবচেয়ে ট্র্যাজিক ব্যাপার আমরা—আমার মা, বোন আর আমি নিজে দিস ব্লাস্টেড ফুল অব আ ম্যান আমরা দিনের পর দিন জিনিসটাকে হালকাভাবে নিয়েছি। ড্যাড? ওহ তার কথা আমাদের চিন্তা করবার কিছু নেই। ড্যাড? ওহ দ্যাট মানি স্পিনিং ওল্ড ফুল? হি ক্যান শিওর টেক কেয়ার অব হিমসেলফ। লাস্ট ফোর ইয়ার্স আমি ড্যাডের সঙ্গে কতবার খেতে বসেছি, গুনে বলে দিতে পারি। অ্যান্ড আয়্যাম শিওর, আমারই জন্য কেউ, কোনও গুণ্ডাদল অনেক টাকা ক্লেইম করেছিল, সেটাই ড্যাড দিতে গিয়েছিল। যে ভোরে দু ব্যাগ ভর্তি টাকা নিয়ে ড্যাড বেরিয়ে গেল, কেউ ছিল না যে সামান্য একটা ইন্ডিকেশন, একটা ক্লু দিয়ে যাবে। খুঁজেছিল সবাইকে। পায়নি। মা, তিতি আমি, আমরা সব যে যার মতো ফুর্তি করছিলুম। ডু য়ু নো হোয়্যার আই ওয়জ? অ্যাট জুনিপার্স, ড্রাঙ্ক, উইথ আ গার্ল অন ইচ সাইড, ডান্সিং অ্যান্ড হ্যাভিং ফান।’

—‘দাদাবাবু!’ হঠাৎ সমর হাউমাউ করে গাড়িটা ঘ্যাঁচ করে রাস্তার পাশে থামিয়ে দিল। তখন চিন্টু সমরের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হল। সে অনেক কথা বলে ফেলেছে অসাবধানে। যদিও বেশির ভাগ ইংরেজি। তবু কিছুটা সমর ধরতে পেরেছে। সে হাউমাউ করে কাঁদছে—‘দাদাবাবু, সাহেব আমাকে আঠারো বছর বয়স থেকে নিজের হাতে শিখিয়ে পড়িয়ে মানুষ করেছেন, দিদিমণি, আমার সাহেবের মতো মানুষ হয় না, তাঁর জন্যে আজ আমার দেশে বাড়ি, ছেলে ডাক্তারি পড়ছে বর্ধমানে। আমার মেয়েটার অ্যাপেন্ডিসাইটিস ফেটে গেছিল, সাহেব না থাকলে…’ স্টিয়ারিং-এর ওপর মাথা রেখে সমর এমন করে কাঁদতে লাগল যে মনে হল তাকে আর কোনওদিন সান্ত্বনা দেওয়া যাবে না।

শুক্তি বলল, ‘সমরদা, সমরদা, তুমি এত ভেঙে পড়ছ কেন। চিন্টুদাদা ভয় পেয়ে ওসব বলেছে। আমরা সবাই সবরকম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কাকুকে ঠিক পাওয়া যাবে।’

চিন্টু বলল, ‘সমরদা আমরা সব এক নৌকায়। আমাদের কী হবে আমরা জানি না। সত্যিই জানি না।’

—‘হ্যাভ কারেজ, হাভ সাম কারেজ নীল’ শুক্তি এবার মৃদু ধমক দিল। চিন্টু বলল ‘আমার বোনটা সাইটস এন সাউন্ডস-এ বসছে। কলেজ করতে পারছে না। গড নোজ আর হয়ত কোনওদিন করতেও পারবে না। অত দূরে দোকানটা, প্রায় গড়িয়ার কাছে, গাড়ি নেয় না। বাসে যাতায়াত করে, বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় সাড়ে আটটার সময়ে, লাঞ্চ প্যাক নিয়ে যায়। ফিরতে ফিরতে নটা।’

শুক্তি বলল, ‘এক কাজ করা যায় না, আমরা ওখান থেকে তিতিকে তুলে নেব, তারপর খাব।’

—‘শী ওন্ট কাম শুক্তি, শী ইজ টু রেসপনসিবল টু ডু দ্যাট। তা ছাড়া এই অ্যামবাসাডর নিয়ে এখন গড়িয়া যাওয়া মানে, অনেকটা পেট্রল খরচ। আমাদের বুঝে চলা উচিত। সামনে কী আছে জানি না তো! বরং চলো, আমাদের অফিসেই ছোট্ট ক্যানটিন আছে মোটামুটি করে দিতে পারবে কিছু। যাবে?’

শুক্তি বলল, ‘তা-ই-ই চল।’

নির্ধারিত দিন কেটে গেল, কর্পোরেশন থেকে ঘুসুড়ির বাড়ি ডিমলিশ করতে কিন্তু এল না। বরং তার কদিন পরেই কর্পোরেশন থেকে নো অবজেকশন্‌স্‌ সার্টিফিকেট গোছের কিছু একটা বার করে নিয়ে এল সোহন। সে নিজে পাশ করা সিভল এঞ্জিনিয়ার, যদিও কোনও চাকরিতে ঢোকেনি, তার কাকা দুঁদে উকিল। তা ছাড়া দেখা গেল ভানপ্রতাপ তাকে সাংঘাতিক খাতির করতে আরম্ভ করে দিয়েছে। কাগজপত্রে রয়েছে এ বাড়ির প্রোমোটর বি. বি. রায় এবং তনুশ্রী রায় যুক্তভাবে। তিনতলার থেকে আরম্ভ করে যারা ফ্ল্যাট বুক করেছিল তারা সবাই এবার তাদের দেয় টাকা দিতে থাকল। খালি শিবশঙ্কর আর কেয়ারটেকার সমশের বরখাস্ত হয়ে গেল। নীলাদ্রি, সোহনের পরিচিত একজন কনট্রাকটরকে নিয়োগ করল। সমশেরের বদলে রইল ভানপ্রতাপ স্বয়ং। ঘুসুড়ির বাড়ির কাজ দ্রুত এগিয়ে চলল। নীলাদ্রি একদিন সোহনকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী করে কী করলি রে?’

সোহন ভীষণ ব্যস্ত। ‘উলটপুরাণ’ নাম দিয়ে সে ঘুসুড়ির বাড়ি নিয়ে সত্যিই একটা ফিচার লিখেছে। সঙ্গে যথেষ্ট ফটো। তার প্রতিপাদ্য সারা হাওড়ায় যেদিকে তাকাও বেআইনি বহুতল উঠছে। পনেরো কুড়ি ফুট চওড়া রাস্তায় ছ তলা সাত তলা বাড়ি আখচার। বহু বাড়ি আইনমাফিক জায়গা ছাড়েনি। স্যাংশনড প্ল্যানের বাইরে কাজ করেছে, জলের বন্দোবস্ত করেনি, লিফটের বন্দোবস্ত করেনি। কিন্তু কর্পোরেশন নীরব। অথচ ঘুসুড়িতে একটা বাড়ি একেবারে কাঁটায় কাঁটায় নিয়ম মেনে চলেও কর্পোরেশনের আক্রোশে পড়ে গেছে। কেন? কেন? কেন? ফিচার রাইটারের প্রশ্ন। পাশ করা সিভল এঞ্জিনিয়ার বিল্ডিং মেটিরিয়াল দেখে এসেছেন, একেবারে ঠিকঠাক, কিন্তু কর্পোরেশনের ইন্সপেক্টর যে-ই দেখতে যাচ্ছে সে ভেজাল সিমেন্ট, বাজে লোহা দেখতে পাচ্ছে। কী করে? কী করে? কী করে? ফিচার রাইটারের প্রশ্ন। বেশ শোরগোল তুলে দিয়েছে খবরটা।

—‘এসব কী করেছিস?’ নীলাদ্রি অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।

—‘আরে, অ্যাদ্দিনে একটা সাবজেক্ট জুটিয়ে দেবার জন্যে তোকে ধন্যবাদ’ সোহন বলল, অনেকদিনের সাধ জার্নালিস্ট হব।’

—‘কী ব্যাপারটা পুরো বলবি তো?’

—‘কী আর ব্যাপার? লোকাল মাল কিছু থাকে এসব জায়গায়, জানিস না? আঙ্কল সে সব না বুঝে বা না গেরাহ্যি করে বাড়ি তুলে দিচ্ছেন, সবাই মিলে বখেড়া বাধিয়ে দিয়েছে। কেয়ারটেকারটা আর শিবশঙ্কর ওদের ভয়ে যোগসাজস করে এইসব কারবার করছিল। বিল্ডিং মেটিরিয়াল দিনের পর দিন বদলে রাখছে। ভানপ্রতাপকে বাদ দিয়ে ওখানে কেউ কিছু করতে পারে না। ওকে মোটা টাকা দিতে হবে।’

—‘মানে? কিছু করবে না, শুধু শুধু টাকা?’

—‘হ্যা রে চিন্টু। না দিলেই এমনি ফাঁদে ফেলে দেবে।

—‘তো শিবশঙ্করের লাভ? ও তো ফেঁসে গেল।’

—‘গেল। ব্যাপারটা প্রথমেই ওর জানানো উচিত ছিল আঙ্কলকে। কীভাবে আরও মোটা লাভ করা যায় তারই অঙ্ক কষছিল বোধ হয়। খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে কাল হল তাঁতির এঁড়ে গরু কিনে।’

—‘তা ভানপ্রতাপ তো টাকা পেল না! তুই দিলি নাকি?’

—‘ভানপ্রতাপ একা নয়। আরও আছে ভেতরে। অন্ততপক্ষে লাখ তিনেক টাকার ধাক্কা! আমি কোথায় পাব?’

—‘তবে?’

—‘আমি এই ফিচারটা লিখলুম আর আমার ফ্রেন্ড জাভেদ আনসারিকে জানিয়ে দিলুম। ভানপ্রতাপ যদি বাবা হয়, তা হলে জাভেদ হল গিয়ে ওরে বাবা। বুঝলি কিছু?’

—‘এইসব সাঙ্ঘাতিক গুণ্ডাদের সঙ্গে তুই মিশিস?’

—‘আমি তো আর বাপের লালটুস পুত্তুর নই।’ নীলাদ্রির থুতনিটা নেড়ে দিয়ে সোহন বলে, ‘বাপ-মরা, মা-মরা। সিংগিবাড়ির ওই ব্যাচেলর কাকা না থাকলে কবে মায়ের ভোগে চলে যেতুম, দুনিয়ার প্রতিটি ইঞ্চি জমি লড়ে জিততে হয়েছে। ঘাবড়াস না। যা বাড়ি যা।’

রাতে খেতে বসে তিতি বলল—‘মা, তোমার অ্যাসোসিয়েশনের কাজ নেই? বেরোচ্ছ না তো।’

তনুশ্রী খাবার নাড়াচাড়া করছিলেন। বললেন, ‘কী হবে?’

—‘মানে? মা, আমাদের যথাসাধ্য স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে হবে। তুমি এরকম ব্রুড করলে আমরা জোর পাব কোত্থেকে?’

চিন্টু বলল—‘কাল অফিস বেরোবার সময়ে আমি তোমাকে নামিয়ে দিয়ে যাব। ফেরাটা…আমার তো একটু দেরি হবে, তুমি একা পারবে না? না হয় বসাক আঙ্কলকে বলে দেব…।’

—‘না না’ তনুশ্রী তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন। তারপর প্রায় কিছু না খেয়েই উঠে গেলেন।

চিন্টু তিতির দিকে তাকাল। তিতি বলল—‘তুইও আবার খাবার-টাবার ছেড়ে উঠে যাস না। আমি তো বারেবারেই বলছি মা ভীষণ দুর্বল প্রকৃতির। আমাদেরই শক্ত হতে হবে। তা ছাড়া তুই সেদিন যা করলি…’

—‘আমি কী করলুম!’

—‘সেই ওয়ার্ডরোবের ভেতরে…বাবাকে খোঁজা।…ছিঃ।’

চিন্টু বলল—‘আমার মাথার ঠিক ছিল না। মা কিছুতেই পুলিশে খবর দিতে দিচ্ছিল না, স্ট্রেঞ্জ বিহেভ করছিল…’

—‘তাই বলে ওইরকম ভাববি? থ্রিলার পড়ে পড়ে তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে।’

—‘হতে পারে,’ চিন্টু মেনে নিল। তারপর বলল—অপরাধী গলায় বলল—‘মা কি ওই জন্যে খাচ্ছে না!’

—‘আমি জানি না। হতে পারে!’ তিতি বলল।

—‘মাফ চাইব?’

—‘দাদা, প্লিজ যথেষ্ট বোকামি করেছিস। আর করিস না!’

তনুশ্রী হাত মুখ ধুয়ে শুয়ে পড়লেন। যদিও জানেন ঘুম আসবে না সহজে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে ওষুধ খেতে হবে। তারপরেও দুঃস্বপ্ন দেখতে হতে পারে। তাঁর সমস্যা সম্পূর্ণ আলাদা। অতি জটিল। ছেলে-মেয়ের সঙ্গে তা আলোচনাও করা যাবে না। তিতি ঠিকই বলেছে। সমস্ত ব্যাপারটাকে একটা স্বাভাবিক চেহারা দেবার জন্য তিনি অ্যাসোসিয়েশনে যেতে চেয়েছিলেন। শর্মাজিই তাঁকে ফোনে জানিয়ে দেন তিনি যখনই বেরোতে চাইবেন শর্মাজি গাড়ি পাঠিয়ে দেবেন। তনুশ্রী তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে জানান, তাঁর তো নিজের গাড়ি রয়েছেই। ইচ্ছে হলে তিনি বেরোবেন। গাড়ি পাঠাবার দরকার নেই। পরদিন চিন্টু তিতি বেরিয়ে যাবার পরই শর্মাজি এলেন, চা খেলেন, বললেন—‘মিসেস রয়, এখন কিছুদিন তেল কম খরচ করুন, আমি যাচ্ছি ওদিকে—চলুন পৌঁছে দিচ্ছি। বাড়ি বসে ব্রুড করবেন না।’ তনুশ্রী তৈরি হয়ে বেরিয়ে এলেন। শর্মাজি নিজেই ড্রাইভ করছেন। নিজের পাশের দরজাটা সসম্মানে খুলে ধরলেন। তনুশ্রী উঠে বসলেন। ডায়মন্ডহারবার রোডে পড়বার পর থেকেই রাস্তা মোটামুটি নির্জন। তবু শর্মাজির গাড়ি মাতালের মতো আচরণ করছিল, এক-এক ধাক্কায় হেঁচকি তোলে আর তনুশ্রী অতর্কিতে শর্মাজির গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েন এবং সলজ্জভাবে দুঃখপ্রকাশ করেন। শর্মাজি তাঁর পাকা চুলের মধ্যে হাত চালিয়ে বলেন—‘প্লেজার, প্লেজার।’ এই ধরনের রসিকতা শর্মাজির পক্ষে একটু বিসদৃশ। রাজেশ পাইন কিংবা বসাক করলে মানিয়ে যেত।

তাঁকে নামিয়ে দিয়ে শর্মাজি বললেন— পাঁচটার সময়ে আবার তুলে নিতে আসবেন। তনুশ্রী তিনটে বাজতেই বসাককে ফোন করলেন।

—‘একটু গাড়িটা নিয়ে আসতে পারবে। আমারটা হঠাৎ খারাপ হয়েছে। আমার শফার আলি ফোন করেছিল।’

—‘ওহ শিওর।’

মিনিট পনেরোর মধ্যে বসাক গাড়ি নিয়ে উপস্থিত। রেসকোর্সের পাশ দিয়ে আসতে আসতে বসাক হঠাৎ ভিক্টোরিয়ার দিকে গাড়ি ঘোরাল। পার্ক করে বলল— ‘তোমাকে কয়েকটা কথা বলা দরকার ভাবী। য়ু চুজ ইদার মি অর রাজেশ।’

তনুশ্রী বললেন—‘কী বলছ আজেবাজে? প্রথম বললে বলে লাইটলি নিচ্ছি। আর কখনও বললে অপমান মনে করব কিন্তু!’

বসাক অনেকক্ষণ তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তনুশ্রীর দিকে। আস্তে আস্তে বলল—‘সজনেখালির ব্যাপারটা আমি জানি। রাজেশ নিজেই আমাকে বলেছে। উই আর ফ্রেন্ডস। সোজা আঙুলে যদি ঘি না ওঠে তো বিজুদা তো রইলই। টুরে গেছে না কি শুনছিলাম—আসলে বলা যাবে তাকেই।’

তনুশ্রীর ওপর দিয়ে কদিনই ঝড় বইছে। এই কথার পর তিনি ভয়ে প্রায় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। অজ্ঞানের মতোই হয়ে আছেন।

আজ ছেলে সেই বসাক আঙ্কলকে মায়ের এসকর্ট করতে চাইছে, যেচে।

তনুশ্রী জানেন না, তিনি কী করবেন। এমনকি, এখন বিজু রায় ফিরে আসা ভাল না খারাপ তা-ও তিনি বুঝতে পারছেন না। বিজু রায় না এলেও সামাজিকভাবে তিনি নিশ্চিহ্ন। আর এলে? এলেও বোধহয় তাই। শুধু তাই নয়। কী লজ্জা! কী অপমান! এখন কী হবে? তনুশ্রী জানেন মিসেস শর্মা, রাজেশের স্ত্রী, প্রীতা সোম, রবিনা, এরা যা-খুশি করে। কেতাদুরস্তভাবে যা খুশি। মিসেস শর্মা ছিলেন শর্মাজির সেক্রেটারি, অন্তত চার-পাঁচ বছর দুজনে খোলাখুলি বাস করবার পর বিয়ে করেছেন। আর তিনি একবার, মাত্র একবার গণ্ডির বাইরে পা বাড়িয়েছেন বলে সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মৃত্যুদণ্ড হয়ে গেল? এ কী রকম বিচার? কার বিচার? তনুশ্রী মাথার ওপর সিলিং ফ্যানটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শিউরে ওঠেন, শেষ পর্যন্ত ওই-ই কি তাঁর নিয়তি? না না বরং স্লিপিং পিল। জোগাড় করতে হবে—এ দোকান ও দোকান থেকে। একটু একটু করে জমাতে হবে। আর বোধহয় কোনও উপায়, কোনও পথই নেই।

ছেলে-মেয়ে দেখছে মা খায় না, সাজগোজ করে না, কেমন অবিন্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। রোগা, জৌলুসহীন হয়ে যাচ্ছে। তারা স্বভাবতই ভাবে—বাবা, বাবার অন্তর্ধানই এর জন্য দায়ী। খুবই স্বাভাবিক। তবে তিতি চিন্টু মনে মনে খুব গোপনে ভাবত—যে বাবার প্রতি তাদের মায়ের আন্তরিক টান জিনিসটা একটু কম। তিতি ভাবত—শুধু বাবা কেন? মা একটু অগভীর ধাতের, ছেলে-মেয়ের প্রতিও তেমন টান নেই। কেমন যেন! এখন মায়ের চেহারা, মায়ের আচরণের দিকে চেয়ে তিতি নিজেকে ধিক্কার দেয়। এগুলো সে খোলাখুলিই আলোচনা করে অর্জুনের সঙ্গে।

অর্জুন, অর্জুন এসেছে সাইটস এন সাউন্ডস-এ। তিতি ক্যাশ কাউন্টারে। চুপচাপ ক্যাশ কাউন্টারে বসে থাকা আর মাঝে মাঝে ক্যাশমেমো দেখে টাকা নেওয়া, ভাঙানি দেওয়া—এই একঘেয়ে কাজের মধ্যে অর্জুন এলে তার দিনটা ঝলমল করে ওঠে। এই দোকানটাই এখন তিতিদের বড় ভরসা।

অর্জুন খুব সমালোচনার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে, তারপর বলে—‘তুই না খেয়ে থাকলে তো মেসো তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন না! আসবেন!’

—‘আমি যথেষ্ট খাই, আসলে আমার চেহারাই এমনি। তুই সেদিন ঠাম্মার ঘরে কী কাগজপত্র পেলি, দেখালিও না, কিছুই না।’

—‘নাথিং ইমপর্ট্যান্ট, বাট ইনটরেস্টিং।’

—‘বাবাকে খোঁজার কাজে লাগবে?’

—‘লাগতেও পারে, আবার না-ও পারে।’

—‘তবে তুই আমাদের ফ্যামিলি-পেপার্স নিয়ে কী করছিস, দিয়ে দে।’

—‘এক্ষুনি দিয়ে দিতুম, কাছে থাকলে।’ আহত গলায় অর্জুন বলে, ‘পরের দিন দিয়ে দেব।’

তিতি গম্ভীরমুখে বলে—‘আমি তাই বলেছি?’

—‘বললি তো?’

—‘তুই খুব ভাল করেই জানিস কোনটা আসল বলা আর কোনটা নকল। তাড়াতাড়ি কিছু কর অর্জুন। মায়ের অবস্থা আর চোখে দেখা যাচ্ছে না। আর যদি বুঝিস ওই ডকুমেন্টটা পেলে ওই “রক্সি”দের কোনও সুবিধে হবে, তো ওদের দিয়ে দে। ওরা আফটার অল প্রোফেশন্যাল!’

অর্জুন হঠাৎ বলল—‘কিছু মনে করিস না তিতি, একটা কথা জিজ্ঞেস করছি। মেসো-র কোনও বাল্য-প্রেম ছিল?’

—‘মনে করব কেন?’ তিতি বলল, ‘থাকতেই পারে, সেভেনটি পার্সেন্টের থাকে। আবার বাবাদের যুগের লোকেরা যা রোম্যান্টিক ছিল! ছাদে-ছাদে, জানলায়-জানলায় প্রেম হত। তবে আমি জানি না, দুঃখের বিষয়। বাবার সঙ্গে আমার এমন রিলেশন ছিল না যে বাবা আমাকে ডেকে ডেকে বলবে—“তিতি তিতি শোন, আমার না একটা বাল্য-প্রেম ছিল।”

অর্জুন হেসে ফেলল, তারপরেই চিন্তিত মুখে বলল—‘না, এমন কেউ যাকে ঠাম্মাও খুব চিনতেন, ভালবাসতেনও অথচ বোধহয় মেনে নিতে পারতেন না।’

তিতি বলল—‘বলছি তো থাকতেই পারে এসব ঘটনা, তবে আমি জানি না। তুই কি বলছিস এতদিন পরে হঠাৎ সেই শৈবলিনীর খোঁজে বাবা বিবাগী হয়ে গেল? মোস্ট আনলাইকলি। হী ইজ দা মোস্ট লেভ্‌ল-হেডেড পার্সন আই হ্যাভ সীন। ভেরি প্র্যাকটিক্যাল!’

অর্জুন বলল—‘কিছু মনে করিস না তিতি, মাসির সম্পর্কেই বা তোর কী ধারণা ছিল? ধারণাটা তো বদলাতে বাধ্য হয়েছিস? তোদের ফ্যামিলিতে পরস্পরের মধ্যে বিরাট বিরাট কমিউনিকেশন গ্যাপ, তোরা কেউ কাউকে কোনও দিন বুঝিসনি।’

তিতি জানে কথাটা সত্যি, তবু ঝেঁঝে উঠে বলে—‘তুই একাই সব বুঝিস, না?’ অর্জুন থেমে থেমে বলে—‘বুঝি না। তোদের কথা আমার বোঝার ব্যাপার না। কিন্তু চেষ্টা করছি।’

ওই ডকুমেন্ট বা চিঠিটা অর্জুনের মুখস্থ হয়ে গেছে। সে তিতির কাজ শেষ হওয়ার অপেক্ষা করে বসে বসে, আর মনে মনে চিঠিটা ভাঁজে। তিতিকে জানতে দেয় না।

‘মাগো,

আমি কে বলো তো? এতদিনে বোধহয় ভুলেই গেছ মা বলে ডাকবার তোমার আরও কেউ ছিল? বিজু, বিজুও নিশ্চয় ভুলে গেছে। নিজের সংসার অত সম্পদ পেয়ে বিজু কি আমাকে ভুলে গেল? মা, তুমি যতই মনকে চোখ ঠারো, নিশ্চয়ই জানো বিজু আর আমি পরস্পরের আধখানা। আমি সবার অবহেলা, সবার বিরহ সইতে পারি। শুধু বিজুরটা পারি না। আমি নিশ্চিত জানি একদিন না একদিন বিজুর সঙ্গে আমার মিলন হবেই। তুমি যদি দয়া করে এ চিঠির উত্তর দিতে চাও, শ্যামবাজার পোস্ট অফিসে দিয়ো। আমি সংগ্রহ করে নেব। আমার প্রাণভরা ভালোবাসা নিয়ো। সমস্ত হৃদয় নিয়ে মাথা নত করছি তোমার পায়ের কাছে। নেবে না?—ইতি।

চিঠিটার ওপরে ঊননব্বই সালের মার্চ মাসের ঠিকানা। চিঠিটা মেঝেয় ঠাম্মার পালঙ্কের ভারী পায়ার কাছ ঘেঁসে পড়েছিল। অর্জুনের ধারণা, মেসো ঠাম্মার আলমারি আর সিন্দুক ঘেঁটেছিলেন খুব। যা নিয়ে গিয়েছিলেন তা একরাশি কাগজপত্র। সম্ভবত চিঠি। কারণ আলমারির মধ্যে গরম জামা, শাল ইত্যাদির ভেতর থেকে এক থলি হাজারখানেকের মতো চকচকে রুপোর টাকা এবং আরও শ’পাঁচেকের মতো নোট পাওয়া গেছে। তিতির যুক্তি হচ্ছে, সিন্দুকে গয়না থাকতে পারে। আরও অনেক টাকা থাকতে পারে, সে টাকার কাছে এই সামান্য দেড় হাজার কিছুই না। কিন্তু অর্জুন মাসির কথাকে গুরুত্ব দিয়েছে। মাসি নাকি বলেছে—ও সিন্দুকে কিছু মূল্যবান থাকত না। মাসি মূল্যবান বলতে যা বোঝায়, অর্থাৎ টাকাপয়সা, গয়নাগাঁটি তা অর্থাৎ ছিল না। তবু সিন্দুকটা বন্ধ ছিল। এবং ভেতরটা নিশ্চয় ফাঁকা ছিল না। অর্জুন ওর ভেতরে খুব পুরনো ইনল্যান্ডের টুকরো পেয়েছে, একটা সরু ফিতে পেয়েছে হলুদ রঙের। তার অনুমান ঠাম্মার কাছে যা মূল্যবান, অর্থাৎ আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের চিঠিপত্র, তাই-ই ছিল সিন্দুকটায়। এবং মেসো সেগুলোই নিয়ে বেরিয়ে গেছেন। তিতি হেসে উড়িয়ে দিলেও তার মনে হয়েছে—মেসো ওই চিঠির মেয়েটিকে, মানে ভদ্রমহিলাকে খুঁজতে গেছেন—যিনি ওইভাবে আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে ঘোষণা করেছেন বিজুর সঙ্গে নাকি একদিন তাঁর মিলন হবেই। তিনি আর বিজু নাকি পরস্পরের আধখানা।

অর্জুন সন্তর্পণে এটা পকেটস্থ করেছিল। তিতিকে দেখায়নি। বলেছিল—‘ঠাম্মাকে তো অনেকেই চিঠি লিখত, তেমনি একটা সাধারণ চিঠি। তবু নিয়ে যাচ্ছি যদি অনুমতি দিস।’ —আসলে ব্যাপারটা সে তনুমাসির কাছেই গোপন করতে চায়। তনুমাসির ধারণা হয়েছে এর ভেতর নারীঘটিত কিছু আছে। সে সংশয় তিনি তিতির কাছে প্রকাশ করেছেন। যেটা বোঝেননি সেটা হল—এ বর্তমানের কোনও ব্যাপারই নয়। এ সুদূর অতীতের ইতিহাসের কোনও আনারকলি। যে তার কবর ঠেলে উঠে পড়েছে। যার সঙ্গে মেসোর সম্পর্ক এত নিবিড় যে, মেসো তার ডাক কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারেন না। তবে সোজাসুজি মেসোর কাছেই বা উনি লেখেননি কেন, সেটাও একটা প্রশ্ন। একটা সমস্যা। এগুলো নিয়ে অর্জুন ভাবছে। শ্যামবাজার পোস্ট অফিসে খোঁজ করেছিল সে। ঊননব্বুই সালে কেন আরও অনেক সময়ে অনেকেই পোস্ট অফিস থেকে চিঠি নিয়ে যেতেন। যান। সে সব নাম তাঁরা অর্বাচীন এক ছোকরার কাছে প্রকাশ করবেন না। পুলিশ বা গোয়েন্দা হলেও বা কথা ছিল!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress