Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বিশ্বাস || Samaresh Basu » Page 3

বিশ্বাস || Samaresh Basu

গালে হাত দিতে আমার কেমন যেন লজ্জা-ই করল অথচ হাত দিয়ে ঘষতে পারলে একটু বোধ হয় ভাল লাগত। কিন্তু রাগে দুঃখে লজ্জায় আমার চোখে প্রায় জল এসে পড়বার অবস্থা, আমি দাঁতে দাঁত চেপে এ অবস্থাটাকে চাপা দেবার চেষ্টা করলাম। অবিশ্যি এর থেকেও আমি বেশি মার খেয়েছি, ডিবেটে জিতে কফি হাউসে মার খেয়েছি, সব থেকে বেশি মার খেয়েছিলাম নিখিলের কাছ থেকে–নিখিল, আমি আগে যে-পার্টিতে ছিলাম তার লড়াকু শ্রমিক নেতা নিখিল, যখন আমি সংশোধনবাদী বলে রীতিমতো চিঠি দিয়ে জানিয়ে ওদের পার্টি ছেড়ে এসেছিলাম, তার কয়েক দিন পরেই নিখিল আমাকে এসে সন্ধেবেলা ডেকে নিয়ে গিয়েছিল, যদিও গম্ভীরভাবে তথাপি মনে হয়েছিল বন্ধুর মতোই, কেন না নিখিল তো বরাবরই আমার বন্ধু ছিল ছেলেবেলা থেকে। দুজনে প্রায় একই সঙ্গে পার্টিতে এসেছিলাম। ও লেখাপড়া বিশেষ করেনি, তা বলে দিগা-দিগন্ত হয়নি। সতেরো বছর বয়েসেই একটা এঞ্জিনিয়ারিং কারখানার অ্যাপ্রেনটিস হয়ে ঢুকেছিল আর সেখান থেকেই ও লড়াকু মজুর নেতা হয়েছিল এবং চাকরি চলে যাবার পরে এখন কেবল পার্টিই করে। ও আমাকে সরখেলপাড়ায় সরকারি গোডাউনের কাছে সন্ধেবেলায় ডেকে নিয়ে গিয়েছিল, সেখানে সেই পার্টির আরও দু-তিন জন ছিল, সকলেই আমার চেনা, সেখানে গিয়ে পৌঁছুতেই আমার মনটা কেমন করে উঠেছিল, মনে হয়েছিল নিখিলের ডাকে এভাবে আসা বোধ হয় আমার ঠিক হয়নি। টিমটিমে আলোয় ওদের কয়েকজনকে ছায়ার মতো দেখাচ্ছিল, ওরা নিজেদের দিকে নিজেরা তাকাচ্ছিল আর আমাকে দেখছিল, তখন মনে হয়েছিল অন্ধকারে বাঘটাকে না দেখা গেলেও যেমন তার চোখ জ্বলতে দেখা যায়–যেমন আজ কিছুক্ষণ আগেই রকের ছেলেদের চোখগুলো দেখাচ্ছিল নিখিলদের চোখগুলো তেমনি জ্বলছিল। প্রায় এক মিনিট ওরা কোনও কথাই বলেনি। আমি নিখিলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমাকে এখানে ডেকে নিয়ে এলি কেন?

নিখিল নিচু স্বরে গর্জন করে উঠেছিল, বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি দিতে।

আমার শিরদাঁড়াটা কেঁপে উঠেছিল তথাপি আমি যেন ওদের আসল ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আর একটা গলা শোনা গিয়েছিল, ইউ আর এ রেনিগেট।

রেনিগেট। বলছে কিনা এমন একটা সংশোধনবাদী পার্টি লোক, বলতে গেলে, যারা গোটা দেশের সঙ্গেই বিশ্বাসঘাতকতা করছে। আমার বুকটা ধকধক করছিল, তবু শুকনো ঠোঁটটা জিভ দিয়ে চেটে নিয়ে বলেছিলাম, তা কেন, আমি রেনিগেট না, যে-পার্টির নীতিকে আমার

চুপ, পার্টি সম্পর্কে সমালোচনা করার কোনও রাইট তোমার নেই, কারণ তুমি পার্টির কেউ না।

সেটা কার গলা, মনে করতে পারি না। নিখিল বলে উঠেছিল, আর তোর চিঠিতে শালা মুতে দিই, বুঝলি, আর জেনে রাখ পার্টি থেকে পদত্যাগ করা যায় না, আমরা তাড়িয়ে দিই, একসপেল করি। পার্টির শত্রু জনসাধারণের শত্রুকে আমরা ক্ষমা করি না।

কথাটা শেষ হয়েছিল কি না মনে করতে পারি না, আমার শরীরের সামনে পিছনে ধারে প্রচণ্ড ঘুষি আর থাপ্পড় আর লাথি পড়তে আরম্ভ করেছিল। মনে হয়, হাত দিয়ে মার বাঁচাবার চেষ্টা করতে করতে আমি যেন বলেছিলাম, নিখিল, শোন, আমাকে মারলেই তোদের নীতি– ঠিক সেই সময়েই চিবুকে ঘুষি লেগে আমার দাঁতের ঘায়ে জিভ কেটে গিয়েছিল, আর কথা বলতে পারিনি, আমি রাস্তার ওপরে পড়ে গিয়েছিলাম। কতক্ষণ পরে, জানি না, ওরা দৌড়ে চলে গিয়েছিল, সেটা টের পেয়েছিলাম, কিন্তু আশ্চর্য, ওরকম মার খেয়েও আমি জ্ঞান হারাইনি, অন্যান্য লোকজনের ছুটে আসা টের পেয়েছিলাম, তাদের কথাবার্তা শুনতে পেয়েছিলাম, কে যেন বলেছিল, না, ছুরি-টুরি মেরেছে বলে মনে হচ্ছে না, জোর পেঁদিয়েছে।

আমি চোখ মেলে তাকাতে চেষ্টা করছিলাম, একটা চোখের পাতা খুলতে চাচ্ছিল না, বোধ হয় ওপরটা এত ফুলে উঠেছিল যে, চোখটা ঢাকা পড়ে গিয়েছিল আর একটা চোখ মেলে টিমটিমে আলোয় সবাইকেই অস্পষ্ট ছায়ার মতো দেখতে পাচ্ছিলাম, একজনকেও চিনতে পারছিলাম না। আমি উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করেছিলাম, কোমরের আর তলপেটের কাছে ব্যথা লাগছিল, বেশ ভারী জুতো দিয়েই লাথি মেরেছিল। কেউ কেউ নিজেদের মধ্যে তখন জিজ্ঞাসাবাদ করছিল, কোন পাড়ার লোক রে? চেনাশোনা নাকি? নাকি অন্য পাড়া থেকে ফেলে দিয়ে গেল। মালকড়ি না মাল নিয়ে বোঝা যাচ্ছে না। পার্টিবাজি হতে পারে।বলতে গেলে শেষের লোকটার কথাই সত্যি, ঘটনাটাকে এক রকমের পার্টি খোয়ারিই বলা চলে। আমার ওঠবার চেষ্টা দেখে কেউ একজন আমার হাত ধরেছিল, আমার মুখের কাছে মুখ এনে বলে উঠেছিল, আরে, নীরেদা না কিকথাটা শেষ হবার আগেই শোনা গিয়েছিল পুলিশের ভ্যান

শোনা মাত্রই আমি যেন ইলেকট্রিকের শক খেয়ে সোজা হয়ে উঠেছিলাম। যে আমার হাত ধরেছিল, তাকে কোনওরকমে বলেছিলাম, তাড়াতাড়ি চল।

সেই অবস্থায় আমি আর অ্যারেস্ট হতে চাইছিলাম না। সে আমাকে নিয়ে ছুটেছিল, আর খানিকটা গিয়েই কেষ্টকলি লেনে পরিমলের বাড়িতে ঢুকে গিয়েছিল। সেই মুহূর্তে আমার মনে পড়েছিল, পরিমল আমার বিরোধী পার্টির লোক, যদি বা সে আমার পুরনো বন্ধু, ছেলেবেলারই, যেমন নিখিল, এবং ভেবেছিলাম পরিমল নিশ্চয়ই জানে না, আমি এখন বরং ওদের পার্টিকে সমর্থন করি, আগের পার্টিকে সংশোধনবাদী বলেছিলাম বলেই নিখিলরা আমাকে মেরে ফেলে রেখে গিয়েছে। পরিমল বাড়িতেই ছিল, দোতলা থেকে নেমে এসেছিল, আমাকে দেখে কেবল জিজ্ঞেস করেছিল, কে মারল?আমি জিভ নেড়ে কোনওরকমে বলেছিলাম, নিখিলরা…।

পরিমল তৎক্ষণাৎ খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, আমাকে বাইরের ঘরে শুইয়ে দিয়েছিল, এমনকী ওর চেনাশোনা একজন ডাক্তার ডেকে এনে আমাকে দেখিয়েছিল। একটু ভাল হবার পরে বলেছিল, তুই একবার বল নীরেন, ওদের পার্টি অফিস অ্যাটাক করে নিখিলের লাশ ফেলে দিয়ে আসি।

পরিমলের কথায় আমি এত খুশি হয়েছিলাম–মানে আনন্দ হয়েছিল, কিন্তু আমি তাকে বারণ করেছিলাম। সেই সময়ে পরিমলরা নিখিলদের অ্যাটাক করে মারতে গেলে মনে হতে পারত, আগে থেকেই একটা ষড়যন্ত্র করা ছিল, বা পরিমলদের পার্টির সঙ্গে আগেই আমার একটা বোঝাপড়া ছিল। তা ছাড়া সত্যি বলতে কী, এই পার্টি পার্টিতে মারামারি আমার ভাল লাগে না, এতে আসল যা উদ্দেশ্য সেটাই নষ্ট হয়ে যায়। অবিশ্যি জানি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খাবার কোনও মানে হয় না। কিন্তু আমরা মারামারি করলেই আসল আন্দোলনের সুরাহা হবে না। কিন্তু সত্যি বলতে কী, একটা দলকে কোণঠাসা করতে গিয়ে, রিয়াল জনবিরোধী এমনকী সেই দলটা জাতীয় বিরোধীও, তাদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে এতগুলো দল দাঁড়িয়ে গিয়েছে, হাতে হাত মিলিয়ে বসেছে, যাদের নিজেদের মধ্যেই নীতি আদর্শ সমস্ত কিছুরই প্রচুর অমিল আর সেই অমিলটা প্রকট হয়ে উঠতেই বিরোধটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, ওই–ওই– কথাটা ঐক্যবদ্ধ হ্যাঁ ঐক্যবদ্ধ চেহারাটা হাস্যকর ভাবে ফুটে উঠেছে এবং এখন সবাই সবাইয়ের অস্তিত্বের লড়াইয়ে উঠে পড়ে লেগেছে–অস্তিত্বের লড়াই মানে, নামে মাত্র একটা অস্তিত্বের প্রশ্ন না, সব দিক থেকেই তাকে বড় করে তোলার লড়াই চলেছে, যে কারণে যে-কোনও একটা সামান্য ব্যাপারেই মারামারি রক্তারক্তি শুরু হয়ে যেতে পারে। খড়ের গাদা তেতেই আছে, একটা দেশলাইয়ের কাঠি ঘষে ছুঁড়ে দেওয়ার অপেক্ষা। কিন্তু নীতি বা তত্ত্বগত দিক দিয়ে রাজনৈতিক সংগ্রামের ছবি বা তাৎপর্য যে কিছু আছে, তা প্রায় চোখেই পড়ে না, যা দিয়ে জয়পরাজয়–যাকে বলে বাকতাল্লার ওপরে থাকবে, অত্যন্ত ক্ষীণ আর অস্পষ্ট। অবিশ্যি এর দ্বারা আমি, পণ্ডিতদের মতো পরমতসহিষ্ণুতার মতো কোনও কথা বলতে চাই না, কারণ, কথাটার মানে অনেক সময় কেমন যেন, কেমন যেন-নেতিবাচক, কারণ কথাটা অনেক সময়েই, শত্রুর মতের বিরুদ্ধে লড়াইকে যেন দুর্বল করে দিতে চায়। যা আমি বিশ্বাস করি না, মানি না, তার বিরুদ্ধে আমি সবসময় লড়াই করতে চাই, তার আদর্শ তত্ত্বনীতির বিরুদ্ধে আমার আদর্শ তত্ত্বনীতির দ্বারা এবং সংগ্রামের দ্বারা, তার জন্য আমি অধৈর্য অস্থির হতে চাই না, কারণ তাতে আসল চেহারাটা–মানে ইমেজটাই ভেঙে যায়, ঘুলিয়ে যাওয়া থাকে বলে, কারণ, তখন নিজেদের কোঁদল বাড়ে, শত্রু সুবিধা মতো অস্ত্র ছুঁড়তে আরম্ভ করে।

কিন্তু তত্ত্ব আর আদর্শ তো অনেক দূরের কথা, নীতিকে যেভাবে ঢাকের খোলের মধ্যে পুরে, দগরবাজি (ঢাকের তাল, কে কত ঘন ঘন দমে কাটি মারতে পারে, চোখে কাটি দেখা যাবে না, দেখলে সত্যি সশালা! বলতে ইচ্ছে করবে।) হচ্ছে এবং অস্তিত্বের লড়াইয়ে নামা হচ্ছে, আর সেটা নিতান্তই ভোটের লড়াইয়ে। তা না হলে চেহারাটা কী দাঁড়াত। কিন্তু সে সব কথা থাক গিয়ে, পরিমল পরেও অনেক বার নিখিলদের মারবার কথা তুলেছে, কারণ, আমার মার খাওয়াটা উইদাউট রিভেঞ্জ যেতে দেওয়া যায় না, আমিই সেটা বারবার বারণ করেছি, যে জন্য পরিমল আমাকে হেসে বলেছে, তুই একটা কাওয়ার্ড আছিস।

হতে পারে, কিন্তু এক্ষেত্রে আমি কাওয়ার্ড ছিলাম না। আমি তখন একটা পার্টির মধ্যে, মানে পরিমল যে পার্টিতে আছে এখন আমি যে পার্টিতে আছি, কারণ ও পার্টি থেকে এ পার্টির রাজনীতি আর সংগ্রামের আদর্শবাদ অনেক ভাল মনে হত, সংশোধনবাদী বলে মনে হত না। পরিমল অবিশ্যি কোনওকালেই রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাত না, আজকাল, বছর তিনেক দেখছি, বামপন্থী রাজনীতি করছে, সেটাও আমার এক দিক থেকে খুবই ভাল লেগেছে। একটা চূড়ান্ত ব্যবসায়ী বাড়ির ছেলে রাজনীতি করতে নেমে এসেছে–অবিশ্যি ভয়ও করে, আবার কী মতলবে এসেছে কে জানে, আশা করি সেরকম কিছু না। হতে পারে আমি কাওয়ার্ড। যদিও আমি একটা পার্টির মধ্যে আছি, আমার আর কিছু নেই। অবিশ্যি অনেক সময়েই, যাকে বলে ঘোরতর অন্যায়, আমার চোখের সামনে ঘটে গেলেও আমি আর দশজন ভদ্রলোকের মতো চেয়ে দেখি এবং দাঁতে খড়কে খুঁটি, এমনকী কেউ হাসলে হেসেও ফেলি, কিন্তু মনে মনে বাঘের থেকেও ভীষণ ফুলতে থাকি, যে অন্যায় করছে তাকে ছিঁড়ে খেতে থাকি, বাইরের থেকে ল্যাজ গুটানো নিরীহ কুকুরটির মতো শান্ত থাকি। দলের মধ্যে থাকলে ও সব কিছুই হয় না, বরং তখন যেন আমার তেজ বেড়ে যায়, এমনকী, দলের মধ্যে থাকলে, নিজেরা অন্যায়ও করতে পারি, তখন সেটাকে তেমন অন্যায় মনে হয় না। তবে আমার মতো জীব তত আমি একটি-ই, তাতেই যা রক্ষা, অথচ ভিতরে ভিতরে একটা বিরুদ্ধ ক্রিয়াও ঘটতে থাকে। যেরকম আগের পার্টি সম্পর্কে ঘটেছিল, কেবলই মনের মধ্যে বিরোধিতা জেগে উঠছিল। অথচ সাহস পাচ্ছিলাম না এবং নিজের এই অক্ষম দুর্বলতার জন্য নিজেকে এত ছোট মনে হয়, আমি বোধ হয় কখনওই খুব সাহসী হতে পারব না। হতে গিয়ে নিখিলের হাতে-থাক, আসলে, আর একটা মারামারিতে নিখিলদের পার্টির সংশোধনবাদ ঘুচবে না, তাও আবার বিশেষ করে আমার মারের বদলা নেবার জন্য পার্টিতে পার্টিতে মারামারি আমি চাইনি। যাই হোক, এখন বাবার হাতের থাপ্পড়টা খেয়ে, নিখিলদের হাতে মার খাওয়াটা, কয়েকটা বিদ্যুৎ চমকের মতো ঝলকে উঠল কেন।

.

কতটুকু সময় কেটেছে জানি না, মনে হল আমি আবার কানে শুনতে পাচ্ছি, চোখে দেখতে পাচ্ছি, আসলে কয়েক মুহূর্ত, কেউ একটি কথাও বলেনি, ইনস্পেক্টরের যাক মারধোর করবেন না ছাড়া। আমার ধারণা, যারা এরকম রেগে অন্ধের মতো মারে, তাদের মধ্যে আসল চরিত্রের কোনও তফাত নেই, বাবা বা নিখিল, এদের কারও মধ্যে, কারণ, এরা নিজেদের ইচ্ছা বিশ্বাস এ সব ছাড়া আর কারওটাই মানে না, তার ওপরে আমি তো আবার বাবার ছেলে। বাবা হয়তো এখনও মনে মনে ভাবছেন, আই হ্যাভ অল রাইটস টু হিট হিম। কিন্তু না, আমি তা মানতে পারি না। আমি আস্তে আস্তে ঘাড় ফিরিয়ে বাবার দিকে ফিরে তাকালাম, বাবা তখন একবার এদিকে একবার ওদিকে তাকাচ্ছেন, মুখটা এখনও রাগে শক্ত, তবে মনে হল হাতে এখনও বেশ জোর। আমি অবাক হয়ে, দুঃখীর মতো, বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি আমাকে মারলেন?

বাবা যেন অবাক রাগের চোটে হুমকে উঠলেন, তার মানে?

সঙ্গে সঙ্গে এমন একটা শব্দ হল, আমি খুকুর দিকে না তাকিয়ে পারলাম না, তার মানে ঠিক শুনেছি, ও হেসে উঠেছিল, যা ভাবা যায় না। খুকু আর মা লিপিকে দু চোখে দেখতে পারত না, কেন জানি না, ওদের মতে, লিপির থেকে খারাপ মেয়ে হয় না, মায়ের কাছে তো, বাজারের মেয়ের থেকেও খারাপ বাজারের মেয়ে বলতে মা বোধ হয় বেশ্যাই বলতে চেয়েছে, আমাকে কেটে ফেললেও যা ভাবা সম্ভব না, কিন্তু তা বলে খুকু হাসবে। বাবার হুমকানিই আবার শোনা গেল, মেরেছি তো কী হয়েছে, আই উইল বিট য়ু এগেন।

আবার মারবেন বলছেন, তার মানে কী, নিয়ম-নীতি সত্যি-মিথ্যা সব এক লহমাতেই উলটে গেল নাকি। আবার বললাম, আমি এত বড় একটা ছেলে মানে একজন যুবক তার গায়ে

বাবা যেন আরও রুখে আমার সামনে চলে এলেন, চিৎকার করে বললেন, হ্যাঁ, আমি আবার তোর গায়ে হাত তুলব কী করবি। ডেকে নিয়ে আয় তোর পার্টিকে, তোর মস্তান দলকে।

–আমার কোনও মস্তান দল নেই, আপনি বিশ্বাস

–থাকলেও আই ডোন্ট কেয়ার।

সেটা বাড়িতে, দোতলায় নিজের এই ঘরে দাঁড়িয়ে, তা জানি, কিন্তু এসব রাগের কথা বলে বাবাকে আমি আরও রাগিয়ে দিতে চাই না, উনি যাতে আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারেন সেই ভেবেই বললাম, আপনি আসলে ভেবে দেখুন, এত বড় ছেলের গায়ে হাত দিয়ে

বাবা তো বাবা-ই, এঁকে কী করে যে বোঝাব। আরও জোরে চিৎকার করে উঠলেন, তার মানে কী, বড় হয়েছিস বলে কি আমার গায়ে হাত তুলবি, সেই ভয় দেখাচ্ছিস।

আমি অবাক হয়ে বললাম, না তো

–তবে কী, অ্যাঁ, য়ু লায়ার!

হঠাৎ মায়ের কথা শোনা গেল, উনি (ইনস্পেক্টর) যখন বলছেন, ওরাই যখন রাজি, তখন তুই বলেই দে না, লিপিকে কোথায় রেখে এসেছিস।

ওহ ভগবান বিশ্বাস করি না, নিরুপায় অভ্যাসবশত ভগবানের নাম মনে এসে যায়, কিন্তু এদের কী বলব, কী করে বোঝাব। আমি বললাম, কিন্তু মা, আমি লিপিকে নিয়ে কোথাও রেখে আসিনি, যাইওনি।

আমার কথা শেষ হবার আগেই বাবা আবার হাত তুলতে যাচ্ছিলেন, ইনস্পেক্টর বাধা দিয়ে, আমার দিকে চেয়ে বলল, দেখো, তোমার সঙ্গে বাড়িতে আমার কোনও কথা বলবারই দরকার নেই। ফৌজদারি দণ্ডনীয় বিধি অনুযায়ী তোমার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে, থানায় এমনিতেও নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু ব্যাপারটা যাতে কোর্ট অবধি না গড়ায়, থানা থেকেই মিটিয়ে দেওয়া যায়, সেই চেষ্টাই আমি করছিলাম। কিন্তু তা বোধ হয় হচ্ছে না।

ভেবে দেখতে গেল, ইনস্পেক্টরের কথাগুলো বেশ যুক্তিযুক্ত আর নিরীহ, অন্তত এরকম একটা ক্ষেত্রে, যখন আমার শাস্তি বেঁচে যাচ্ছে, একটি মেয়ে এবং পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, কিন্তু আমি কী করব, কী করবার আছে। এদের তো বিশ্বাসই করাতে পারছি না।

ইনস্পেক্টর আবার বলল, তুমি বোধ হয় অপরাধের গুরুত্বটা বুঝতে পারছ না ভাই নরেশ ।

নীরেন। আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, জানি না, পরোয়ানায় ওই নামটাই লিখে এনেছে নাকি।

–সরি নীরেন, নাবালিকা হরণের কথাটা তোমাকে আমি আগেই বলেছি।

কথাটা একমাত্র খবরের কাগজেই আমি পড়েছি, এবং ভাবতেই লজ্জা করছে, আমাকেও সেই রকমের অপরাধী মনে করা হচ্ছে। আমি একজন ভদ্রঘরের শিক্ষিত ছেলে-যাক গিয়ে সেটা কোনও সতোর ক্রাইটেরিয়ন না কিন্তু রাজনীতি করানা না, সেটাও সতোর ক্রাইটেরিয়ান বলে কেউ মানতে চাইবে না, আসলে আমি যে-অপরাধের কথা ভাবতেই পারি নাকী যেন কথাটা– নানাবালিকা হরণ অসম্ভব–সে কথা এই ফরসা ভোঁদকা ইনস্পেক্টরকে আমি কী করে বোঝাব। তবু এ লোকটা তো আমার, যাকে বলে জন্মদাতা, তা না, তিনি বা গর্ভধারিণী স্বয়ং কেউ-ই বিশ্বাস করছেন, এর থেকে অবাক হবার আর কী আছে। আমি বললাম, আপনি এ কথা আমাকে বলেছেন, আমি অস্বীকার করিনি তো। কিন্তু আমি তার জন্য কী করতে পারি বলুন।

ইনস্পেক্টর হাসল, অমায়িক আর ধৈর্যের–মানে সহনশীল মানুষরা যে রকম হাসে সেইরকম এবং খানিকটা ক্ষমাশীলও বটে। আমি অনেক বাজে ধরনের লোককেও এভাবে হাসতে দেখেছি, এমনকী খবরের কাগজে তাদের ছবিও বেরোতে দেখেছি কিন্তু আমার তো গাড়ল, মানে বোকা ছাড়া কিছু মনে হয় না, বা শয়তান, একমাত্র এদের পেছনেই প্যাঁক দেওয়া যায়, যেমন রকের ছেলেরা বোকা অথচ চালাক ভেবে আমাকে দিচ্ছিল। ইনস্পেক্টর কিছু বলবার আগেই বাবা আবার আওয়াজ দিলেন– আওয়াজই বটে, দেখুন, কথার ভাবখানা দেখুন।

ইনস্পেক্টর তেমনি গোঁফ ছড়ানো হাসি হাসি ভাবেই বাবাকে ঘাড় নাড়িয়ে শান্ত করে আমাকে বলল, তুমি কী করতে পার তা তুমি ভালই জান। তুমি আমাকে একটা সত্যি কথা বলো তো, ব্যাপারটা কোথায় আটকাচ্ছে, তা হলে আমি বুঝতে পারব।

এখনও সত্যি কথা শুনতে চায় লোকটা, ভাবা যায় না, বললাম বলুন।

ইনস্পেক্টর একবার সকলের দিকে দেখে নিল, খুকুর দিকে যেন বিশেষ করে, তারপরে গলা খাঁকারি দিয়ে, সরু গোঁফ কয়েকবার কাঁপিয়ে টাপিয়ে বলল, আচ্ছা হিপির–মানে মেয়েটার

আপনি লিপির কথা বলছেন বোধ হয়।

আয়ামসরি, লিপি, নট হিপি।

বলেই সারা শরীর কাঁপিয়ে হাসল, সকলের দিকে চেয়ে এমন ভাব করল যেন, ভুলে যায়নি, বরং আমাকে ইচ্ছে করেই হিপি শব্দটা শোনানো হল, কারণ তাতে আমাকে একটু খোঁচা দেওয়া গেল, কিন্তু ও শব্দটা নিয়ে, এমনকী আমি ল্যাটরিনে বসেও কোনওদিন ভাবিনি, আসলে, ইনস্পেক্টরের মাথায় হিপি, তা-ই লিপি–যাকে বলে উধাও। খুকুটা কী ভেবেছে, এই গোবদা ফরসা সরু গোঁফওয়ালা উনিফরম পরা লোকটার সঙ্গে এখন থেকে চোখাচোখি করে হেসে যাচ্ছে যে বড়। ইনস্পেক্টর হাসিটা একটু সামলে, গলা নিচু করে বলল, তোমার অসুবিধেটা কী, লিপির কি কনসেপশন হয়ে গেছে?

আমি যেন আকাশ থেকে পড়ে বললাম, তা আমি কী করে জানব।

ইনস্পেক্টর এত জোরে হেসে উঠল, ঠিক থিয়েটারের কংসর মতো, আমি চমকে উঠলাম, আর সেই সঙ্গে খুকুও। বাবা যেন দম বন্ধ গলায় বলে উঠলেন, হি শুড বি কিলড।

আমি যেন কেমন ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলাম, খেয়েই আছি, এমন একটা মিথ্যা হুজ্জোত হয়রান অস্থির বিভ্রান্ত অবস্থা আর কখনও আমার হয়নি, আবার বলে উঠলাম, তা কী করে হবে।

ইনস্পেক্টর আবার হেসে উঠল, এবং খুকুও। আমি জানি, খুকু সবই বোঝে, কিন্তু আমি এভাবে ওদের হাসাতে চাই না। মা কি খুকুকে ধমক দিতে পারছে না। ইনস্পেক্টররা যে এত হাসতে পারে, কে জানত। তবে কথাটা তো সত্যিই বলেছি, কী করে হতে পারে। আমার দ্বারাই যদি লিপি কনসিভ করে থাকে, তা হলে আমার তা জানার কথা, কিন্তু তা করেনি, সেইজন্য করলেও আমি তা জানি না, (উহ ছি-ছি, লিপি সম্পর্কে আমি এরকম ভাবতে পারলাম, লিপিকে আর কেউ গ–গ–গর্ভ–প্রেগনেন্ট করেছে!) এবং এখন তো অসম্ভব, সে রকম কোনও সুযোগই আমাদের আসেনি, অতএব তা কী করে হবে। এতে হাসির কী আছে।

ইনস্পেক্টর আবার বলল, সেটা তুমিই ভাল বলতে পার, আমি কী করে জানব। সেটা হবে একেবারে ফ্যাটাল, অপরাধের চূড়ান্ত। কিন্তু সে বিষয়েও তোমাকে আমি অ্যাশিওর করছি, মেয়ের বাবা-মা তার ব্যবস্থা করে নেবে, হয়তো কিছু খরচ তোমার কাছে দাবি করতে পারে। তাতে অবিশ্যি তুমি বেঁচেই যাবে, একটা গুরুতর অভিযোগের হাত থেকে

সব এক ব্যাপার, লাটাই ভর্তি সুতো যত খুশি ছেড়ে যাও, কিন্তু সুতো ছাড়তে তো পয়সা লাগে, কথায় তা না। হঠাৎ খুকুর–মানে আমার বোন না, পরিমলের ইয়ে–আমার বোন খুকুই বা কী হতে—- যাচ্ছে কে জানে, পরিমলের খুকুর কথা মনে পড়ে গেল, সব এক লাইনে চলে এসেছে। খুকু অনেক বেশি জানে, তাই আগেই এই কথাটা জিজ্ঞেস করেছিল, এত টালবাহানা করেনি, এবং খুকুকে টিপ গুরু। আমি ইনস্পেক্টরকে বললাম, ইচ্ছে করেই, একটা চালাকি, যাতে মনে করে, আমি এ সব বুঝি, আর ধরুন, আমি যদি লিপিকে নিয়ে পালাতাম চলে যেতাম–তা হলে নিশ্চয়ই ওকে আমি ডাক্তার দেখিয়েই নিতাম।

ইনস্পেক্টর যেন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, মানে?

মানে লিপি নাবালিকা না সাবালিকা, সেটা দেখিয়েই নিতাম।

হাসি-টাসি সব চলে গেল, সবাই এমন চুপ হয়ে গেল, বিশেষ করে ইনস্পেক্টর, আর লোকটা আমার দিকে এমন চোখে তাকাল যেন আমাকে চিনতেই পারছে না। লোকটার চোখে এখন একটু সেই, সেই যাকে বলে, হকচকানো দৃষ্টি, প্রায় এক মিনিট লোকটা চুপ করে রইল, তারপরে বলল, তা হলে বলছ, দেখিয়ে নাওনি।

না।

তাই বলো। তা হলে কোথায় রেখে এসেছ, সেটাই বলল।

আরে, লোকটা গাঁজা খেয়েছে নাকি, নাকি রকের ছেলেরা যেমন ভেবেছিল–মাল–মানে মদ খেয়ে এসেছি আমি, সেরকম খেয়ে এসেছে নাকি। বললাম, কোথায় আবার, নিয়ে গেলে তো ডাক্তার দেখাতাম।

ইনস্পেক্টরের মুখ এবার একটু গম্ভীর হল, আস্তে আস্তে ঘাড় নেড়ে বলল, তোমাকে আমি যতটা বোকা ভাবছিলাম, তুমি ততটা নও।

বলে সে বাবার দিকে তাকাল, বোধ হয় আবার দু-এক ঘা মারবার জন্য বাবাকে উসকে তোলার ফন্দি, কিন্তু আমি বললাম, আচ্ছা, কেন আমাকে বোকা ভাবছেন, কেন তুমি বলছেন, কিছুই জানি না।

ইনস্পেক্টর আমার দিকে তাকাল, আবার বাবার দিকে, আর তার মুখটা এবার বেশ শক্ত দেখাল, চোখ দুটো লাল হল, বলল, তা হলে তুমি বলতে চাও, মেয়েটা মিথ্যে কথা লিখে রেখে গেছে?

এ কথার জবাবটা দিতে পারলাম না। কিন্তু লিপি-লিপি কী লিখে গিয়েছে, কোথায় গিয়েছে, আমি যে কিছুই জানি না। পরিমলটা কি এতক্ষণে এসে পড়তে পারত না। পরিমলই বা কোথায় গেল! অবিশ্যি পরিমল বললেই যে এরা আমাকে ছেড়ে দেবে, তা মনে হয় না, কারণ পরিমলকে হয়তো বিশ্বাস নাও করতে পারে, তবু ঘটনাটার সত্যি-মিথ্যা বলতে পারতাম। আমার পক্ষে মিথ্যা কথা বলাও সম্ভব না, কারণ লিপি লিপি এর সঙ্গে জড়িত, ওকে নিয়েই কথাটা। আমি বললাম, লিপি মিথ্যে কথা লিখে রেখে গেছে বলে তো আমার মনে হয় না।

ইনস্পেক্টরের গোঁফের একটা দিক যেন তীরের ফলার মতো, এক দিকে ছিটকে পড়ল, হাসি। বাবার চিৎকার না, নিচু অধৈর্য গর্জন শোনা গেল, ইনস্পেক্টর, আপনি ওকে আমার সামনে থেকে নিয়ে যান, না হলে আমি হয়তো ওকে খুন করেই ফেলব।

ইনস্পেক্টরের বড় বড় চোখ দুটো চক চক করে উঠল। আমার যেন কেমন গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল, কেন তা বলতে পারি না। ইনস্পেক্টর বাবাকে বলে উঠল, জাস্ট এ মোমেন্ট স্যার, হি ইজ অলরেডি অন দি পয়েন্ট।

ইনস্পেক্টর আমার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, আমি জানি, তোমার পক্ষে মিথ্যে কথা বলা সম্ভব না। এ কথাটাই আমি শুনতে চেয়েছিলাম। হিপি–আয়ামসরি–লি-লিপি মিথ্যে কথা লিখে রেখে যায়নি, সে তোমার সঙ্গেই বাড়ি থেকে চলে গেছে। কোথায় গেছে?

এ লোকগুলোকে কোনও কথা বোঝানো যায় না। আমার নিজেরই মনে হচ্ছে, আমি যেন এদের একটা মিথ্যার ফাঁদে পা দিয়েছি। আমি অবাক হয়ে বললাম, তা কী করে জানব।

ইনস্পেক্টর খুব তাড়াতাড়ি বলে উঠল, মানে তুমি তাকে কোথায় রেখে এসেছ, সেটা বলল। বলল বলল, তাড়াতাড়ি বলে ফেলো, অ্যান্ড লেট দি ম্যাটারস এন্ড হিয়ার।

আমি আবার দাঁতে জিভে বিরক্তিসূচক শব্দ করলাম। বাবা মা খুকু, সকলের দৃষ্টি আমার ওপর, আমার ঠোঁটের ওপর সকলের বড় বড় চোখের অধৈর্য দৃষ্টি, যেন ঠোঁট ফাঁক হলেই, সেই কী বলে– কী–মানে চিচিং ফাঁক, আলিবাবার ঐশ্বর্য আবিষ্কার হয়ে যাবে। আমি ইনস্পেক্টরের দিকে ফিরে বললাম, ব্যাপারটা একটু বোঝবার চেষ্টা করুন, আমি কী বলতে চাইছি। আমি বলতে চাইছি মানে, লিপি হয়তো মিথ্যে কথা লিখে যায়নি, আমার বিশ্বাস লেখেনি, কিন্তু সে আমার সঙ্গে যায়নি।

তার মানে?

ইনস্পেক্টরের গলায় এই প্রথম চড়া ধমক শোনা গেল, চোখগুলো হঠাৎ বেশি লাল হয়ে উঠল। আমি হাত উলটে বললাম, তার মানে, তা-ই, আমি কী করব।

থামো।

ইনস্পেক্টর ধমক দিয়ে আমাকে হুকুম করল, আর নিচু স্বরে গরগর করে বলল, তখন থেকে আমরা তোমার সঙ্গে ইয়ার্কি করছি না। তোমার কথা থেকে মনে হচ্ছে তুমি তখন থেকে কেবল কথার মারপ্যাঁচ কষে যাচ্ছ। কিন্তু মনে রেখো, এ সবের জবাব আছে। (এ সময়ে বাবার দিকে একবার দেখল, বোধ হয় মারের কথা বলতে চাইছে।) নিজেই বলছ, হিপি তোমার (এবার আর নামটা সংশোধন করল, উত্তেজনা) সঙ্গে বাড়ি ছেড়ে গেছে বলে মিথ্যে কথা লিখে যায়নি, আবার বলছ তোমার সঙ্গে যায়নি, তবে কার সঙ্গে যেতে পারে।

আমি কথা বলবার চেষ্টা করলাম, ইনস্পেক্টর এবার বাবার মতো বলল, শাট আপ। আমরা আরও খবর নিয়েছি, তোমার আরও কয়েকটা চিঠি পাওয়া গেছে হিপিদের (যা খুশি বলুক গিয়ে, আমি আর সংশোধন করতে পারছি না) বাড়িতে, তাতেই তোমাদের ফিউচার প্ল্যান প্রোগ্রামের কথা লেখা আছে, দো–আই মিন, তুমি না বলে চলে যেতে আপত্তি করেছিলে, একটা চিঠিতে সে কথাও লেখা আছে। কিন্তু হিপির (আবার–যাক গিয়ে) ইচ্ছা মেনে নিয়ে রাজি হয়েছ। পাড়ার লোকেদের কাছে তোমাদের মেলামেশার খবর পাওয়া গেছে, মেয়ের মায়ের কাছ থেকেও অনেক খবর পাওয়া গেছে। কী জন্যে তোমাকে ওদের বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে সে খবরও মিসেস ঘোষাল আমাকে বলেছেন। এর পরেও তুমি চালাকি করবার চেষ্টা করছ।

এতগুলো কথা হাত-পা নেড়ে, আর বেশ উত্তেজনার সঙ্গে বলবার জন্য, ইনস্পেক্টর যেন হাঁপিয়ে পড়ল, তার চেহারাটা ফুল গ্যাস-এর আগুনের মতো জ্বলজ্বল করতে লাগল। আমি বুঝতে পারছি, ব্যাপারটা ক্রমশই খারাপের দিকে চলে যাচ্ছে, যে কারণে, ভয়ের ভাবটাই আমার মধ্যে জাগছে, একটা অশুভ, অমঙ্গলের ছায়া যেন ঘিরে আসছে আস্তে আস্তে। ব্যাপারগুলো এইরকমই হয়, ওদের মতে মত দাও, ওদের কথাই কথা বলে মেনে নাও, তা না হলেই জেল, রাস্তায় ধরে মার, বা যা খুশি। আমি বললাম, কিন্তু আমি তো কী বলব, সত্যি চালাকি করবার চেষ্টা করিনি। আমি দিব্বিতে বিশ্বাস করি না, তবু যদি বলেন

ইনস্পেক্টর এবার রাগে কেমন যেন হয়ে উঠল, বলে উঠল, স্টপ, এ সব কথায় আমার দরকার নেই, ওনলি ফর টু ফ্যামিলিজ–এনি হাউ, তুমি তা হলে বলবে না, হিপি (বলুক গিয়ে, কেউই যখন বলে দিচ্ছে না–) কোথায় আছে।

বিরক্তিকর, আমি জানি একটা খারাপ কিছুই ঘটতে চলেছে, কিন্তু আমি কী করতে পারি। এটা অবিশ্যিই একটা সামান্য ব্যাপার, তথাপি, আমার মনে হয়, আমি পৃথিবীর–মানে বিশ্বের সমস্ত কী বলে–ওটাকে বলে, বিশ্বের সমস্ত মঙ্গল কর্মের মধ্যে থাকতে পারি, কিন্তু আমি কী করতে পারি। অর্থাৎ আমার স্বাধীনতা কতখানি, আর সেই স্বাধীনতার স্বরূপটাই বা কী। এখন যে কেবল আমার রাগ হচ্ছে, তা-ই না, একটা দুঃখ এবং তার সঙ্গে, যাকে বলে একটা উদাসীনতা যেন মনকে ছেয়ে আসছে। মনে হয়, এ সবের কিছুই দরকার ছিল না, তার চেয়ে আমি কিছু কবিতা লিখতে পারতাম। সারাদিন সব কাজকর্মের পরে আমি হয়তো কিছু কবিতার মধ্যে ডুবে থাকতে পারতাম। সকলের তুলনায়, এর থেকে বেশি আর কী স্বাধীনতা আমি ভোগ করতে পারতাম। অবিশ্যি স্বপ্ন দেখা আমার বোধ হয় একটা বাতিক, আমার অনেক স্বপ্নই অনেকে বিশ্বাস করতে চায় না। কিন্তু সে সব স্বপ্ন আমার বিশ্বাস। যে সব স্বপ্ন বর্তমান সময়ের মানুষেরা বিশ্বাস করতে চায় না। সে সব স্বপ্ন, এ সব স্বাধীনতা চিন্তার ধারে কাছে নেই, কারণ সেই স্বপ্নের জগতে মানুষ তার এই সব স্বাধীনতার কথা চিন্তা করবে না।…আমার কানের কাছে হঠাৎ জোরে বেজে উঠল, আর কিছু ভাববার নেই, তুমি বলবে কি না, বলো।

আমার মুখের পাশেই ইনস্পেক্টরের মুখ, লোকটা আমার থেকে লম্বা না, গরম নিশ্বাস আমার মুখে লাগছে, জিজ্ঞেস করলাম, কী?

এবার খুব সোজা প্রশ্ন, হিপি (মরুক গিয়ে খুকুও তো বলতে পারে) কোথায়?

দুঃখের মধ্যেও আমার রাগ হল। এ সব প্রশ্নের কোনও অর্থ হয় না, বললাম, তা হলে তো একটা লিপি আমাকে বানাতে হয়। মানে আপনারা যদি

মানে?

মানে?

ইনস্পেক্টর এবং বাবা, একসঙ্গেই উচ্চারণ করল, আর চকিতে মায়ের মুখের দিকে আমার চোখ পড়ল। কারণ, দু কথা এক হলে না কি বাড়িতে অতিথির–মানে অবাঞ্ছিত অতিথির–অর্থাৎ চোরের আবির্ভাব হয়, কিন্তু এখন মায়ের মুখে (আমার মুখটা নাকি মায়ের মতো? তবু মায়ের মন গলছে না। বাবার তো গলা উচিত ছিল, তাঁর স্ত্রীর মতো আমার মুখের–) চোর আসার মতো কোনও দুশ্চিন্তার ছাপ দেখলাম না, বরং আমার থেকে মাত্র আঠারো বছরের বড় মহিলার মুখটি রাগে দপদপ করছে। আমি বললাম, মানে, তা হলে লিপিকে আমার জন্ম দিতে হয়।

ইনস্পেক্টর আমাকে দেখিয়ে বাবাকে বলল, হিয়ার।

বাবা চিৎকার করে হাত তুলে বললেন, দ্যাটিজ নট য়ুর ডিউটি টু গিভ বার্থ লিপি, য়ু স্কাউড্রেল।

আমি এবার ঘাড়টা একটু ঝুঁকিয়েই ফেলেছিলাম, বাবা যদি সত্যি মেরে বসেন, কিন্তু আসল কথার সব মানেই যখন ওলটপালট হতে আরম্ভ করে, তখন এ কথার আর দোষ কী। তা না হলে বাবা কী করে ভাবলেন, লিপিকে জন্ম দেওয়া আমার কর্তব্য না। এ তো ভাবাই যায় না–মানে লিপি তো আমার প্রেমিকা।

ইনস্পেক্টর যেন অনেকটা হতাশ ভাবে হাত নেড়ে বলল, আমার আর কিছু করার নেই স্যার, আই অ্যাম টেকিং হিম টু দি কাস্টডি।

বাবা যেন অতিরিক্ত মাত্রায় ব্যস্ত হয়ে বললেন, না না, আপনি অনেক চেষ্টা করেছেন, টেক হিম।

ইনস্পেক্টর আবার বলল, আগামীকালই কোর্টে প্রডিউস করা যাবে কি না, জানি না।

বাবা দু হাত নেড়ে বলে উঠলেন, দ্যাটিজ নট আওয়ার লুক আউট। যা খুশি তা-ই হোক গে।

ইনস্পেক্টর একবার আমার দিকে তাকাল, তারপরে বলল, আমাকে এক গেলাস জল দিন।

বাবা আরও ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। খুকু ছুটে চলে গেল। বাবা বললেন, একটু চা–।

ইনস্পেক্টর এতক্ষণে মাথার থেকে টুপিটা খুলল এবং একটি প্রায়-যুবক প্রৌঢ়ে পরিণত হল কেবল মাত্র ফরসা লালচে চকচকে টাকের জন্য। কিন্তু যাঁর ছেলেকে, যাঁদের ছেলেকে, বিনা অপরাধে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে, সেই পুলিশকে কী করে বাবা-মা আপ্যায়ন করে চা খাওয়াতে চাইছেন, বুঝি না। সত্যি কি আমি এত বড় মিথ্যাবাদী! বাবা-মা ভাবতে পারলেন, আমি তাঁদের কাছে মিথ্যা কথা বলেছি! একটা ঘটনা মাত্র, সামান্য কি না আমি এখনও বুঝতে পারছি না এবং ঘটনার অন্যান্য দিকের বিচারে, লিপির চলে যাবার (চলেই গিয়েছে কিংবা একটা কিছু সর্বনাশ হয়েছে, কিছুই বুঝতে পারছি না) সঙ্গে, আমার যোগাযযাগটা একেবারে অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু, সেই সব ব্যাপারকে বিশ্বাস করে বাবা-মা-বোনের কাছে আমার এতদিনের সমস্ত রেপুটেশন নষ্ট হয়ে গেল। আমি মিথ্যাবাদী, অবিশ্বাসী, একটা নানা–ওহ, অসম্ভব, একটা নাবালিকা হরণকারী! লিপি কি সত্যি নাবালিকা, যে-লিপিকে মা অতি অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে, সামনাসামনি বললে বা কোনও প্রমাণ থাকলে মাকে মানহানির দায়ে দায়ী করা যায়, মা এখন তাকে নাবালিকা মনে করছে? হতে পারে, লিপির ওপরে মায়ের যথেষ্ট রাগ, ঘৃণা আছে। সেই লিপিকে আমি বিয়ে করতে চেয়েছি বলে মাও সত্যি-মিথ্যার ধার ধারল না। আমি কি লিপির বিষয়ে বাড়িয়ে কখনও মিথ্যা কথা বলেছি। নিজে যেচে অবিশ্যি কোনও দিন কোনও কথা বলিনি, বলব ভেবেছিলাম। কিন্তু তার আগেই খুকুর (আমার বোন) মুখ থেকে শুনে, মা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আমি সত্যি কথাই বলেছিলাম। মা আমার সামনে লিপির বিষয়ে যা বলেছিল, তা তো কান পেতে শোনাই যায় না, এবং আমার কেমন ধারণা হয়েছিল, লিপির মায়ের জন্যই, লিপির ওপরে মা এত চটা। যত দিন গিয়েছিল ততই বোঝা গিয়েছিল, তা না। লিপি আর লিপির মা, দুই-ই আমার মায়ের কাছে সমান।

কিন্তু আমি কী করে এতটা অবিশ্বাসী হলাম বাড়ির লোকের কাছে। দিগদিগন্ত, খুকু (পরিমলের প্রেমিকা), পরিমলের বোন, বউদি, রকের ছেলে এবং সম্ভবত পার্টি সকলের চোখে আমি এক হয়ে গেলাম। বেলা দেড়টার আগে পর্যন্ত যাদের কাছে আমার একটা পরিচয় ছিল, দেড়টার পরেই তাদের কাছে আমার সমস্ত চরিত্র পরিচয়, সবকিছু বদলে গেল কী করে, আমি বুঝতে পারছি না। মনের মধ্যে এমন একটা কষ্ট হচ্ছে, একটা–একটা ব্যথা, ঠিক এই বললেই যেন মনের অবস্থাটা বোঝাতে পারি না। কোনও রাজনৈতিক কারণে না, শেষ পর্যন্ত নাবালিকা হরণের, ফোঁসলানোর, এবং কে জানে, আরও কত কিছুর দায়ে আমাকে আজ পুলিশে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। লিপিকে ভালবাসা ছাড়া নিজে যেচে অন্য মেয়ের সঙ্গে কিছু করিনি, অবিশ্যি ঘটেনি, তা কেমন করে বলব, কিন্তু আমার নিজের তাতে কোনও হাত ছিল না। এই যেমন নীচের তলার ধৃতি–না থাক, এ সব চিন্তা থাক, তা হলে এরকম কয়েকটি ঘটনার কথাই বলতে হয়, ময়দানে মাতাল খুকু (পরিমলের প্রেমিকা) থেকে আরও কয়েকজনের কথা। অথচ কোনওদিন এইরকম অভিযোগে পুলিশে ধরে নিয়ে যাবে, ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি। হঠাৎ মনে হচ্ছে, আমি যেন ভাগ্যবাদী হয়ে উঠেছি, অথচ কর্মেই আমার বিশ্বাস, ভাগ্যে না, কর্মই ভাগ্যকে চালনা করে। অথচ এখন মনে হচ্ছে নিয়তির মতো কিছু যেন আমাকে চালিয়ে নিয়ে চলেছে। নিশ্চয়ই ব্যাপারটা এমন না যে, নিয়তি যেন আমার পিছনে পিছনে একটা জাল নিয়ে ঘুরছিল, সুযোগ বুঝে, আজ বেলা দেড়টার সময় ঝপ করে আমার ঘাড়ের ওপর জাল ফেলে শিকার ধরেছে। আর–আর আমার এতদিনেরচেনাশোনা মানুষেরা, এমনকী যাঁরা আমাকে জন্ম দিয়েছেন, তাঁরা পর্যন্ত আমাকে অবিশ্বাস করছেন, রাগ করছেন, মনে হচ্ছে ঘৃণাও করছেন, যেমন বাইরের সবাই করছে ঠাট্টা আর বিদ্রূপ। আমার কষ্ট হচ্ছে, ক্লান্ত লাগছে, বুকের ভিতর থেকে একটা বড় নিশ্বাস উঠে আসছে।

নিশ্বাসটা পড়বার আগেই হঠাৎ আমার কানের কাছে ইনস্পেক্টরের গলা শোনা গেল, মেয়েটাকে নিয়ে কোথাও যাওনি তো বলছ, যাবার প্ল্যান তো ছিল?

কথাটা শুনে আমি চমকে ইনস্পেক্টরের দিকে তাকালাম। দেখলাম, তার হাতে শূন্য জলের গেলাস, তার মানে জল খাওয়া হয়ে গিয়েছে, খুকু ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি আর এ সব কথার জবাব দেওয়া প্রয়োজন বোধ করছি না, মুখটা ফিরিয়ে নিলাম।

বাবা বলে উঠলেন, হি ইজ ব্ল্যাকশিপ অব আওয়ার ফ্যামিলি। আমাদের ফ্যামিলিতে এরকম ন্যক্কারজনক ঘটনা কখনও ঘটেনি।

ইনস্পেক্টর একটু ঝুঁকে গেলাসটা খুকুর হাতে দেবার মুহূর্তেই, বাইরে, কাছেই কোথায় দুম দুম করে দুটো বোমা ফাটল। ইনস্পেক্টর সোজা হয়ে দাঁড়াল, তার চোখে ত্রস্ত হুশিয়ারি। খুকু দৌড়ে রাস্তার দিকে ব্যালকনিতে ছুটে গেল। এই সময়ে আরও দুটো বোমা ফাটল। বাবা উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন, ওরা বোধ হয় এসে পড়েছে।

ইনস্পেক্টর বাবার দিকে তাকিয়ে, কিছু না ভেবেই যেন জিজ্ঞেস করল, কারা?

বাবা যেন উত্তেজনায় কাঁপছেন, বললেন, মস্তানস, হিজ সেভিয়ারস!

ইনস্পেক্টর ঘাড় ফিরিয়ে আমার দিকে তাকাল। তার চোখে দ্রুত চিন্তার ছায়া খেলছে। খুকু ছুটে এসে বলল, আমাদের পাড়ার মধ্যে না, বড় রাস্তায়। তবে আমাদের বাড়ির কাছে কিছু লোক দাঁড়িয়ে আছে।

ইনস্পেক্টরের মোটা ভুরু কুঁচকে উঠল, কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইল, তারপরে আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বলল, অন্য কোনও ব্যাপার বলেই আমার মনে হচ্ছে। এনি হাউ, আমি চলি স্যার। একটু বিরক্ত করলাম, কিছু মনে করবেন না।

বাবা কী বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই ইনস্পেক্টর আমার পাশে, গায়ে গায়ে ঘেঁষে চলল। আমার এক বার ইচ্ছা হল, পিছন ফিরে তাকাই এবং তাকালাম, প্রথমে মায়ের সঙ্গেই আমার চোখাচোখি হল, আর মা তৎক্ষণাৎ চোখের দৃষ্টিটা অন্যদিকে সরিয়ে নিল। তা হলে কি মা আমার দিকে তাকিয়েছিল। মায়ের কি মনে হচ্ছে, আমি মিথ্যা বলিনি। আমার জন্য কি মায়ের মনে কষ্ট হচ্ছে। আমার ছেলেবেলার কথা কি মায়ের মনে পড়ছে, মা যে তখন আমাকে কত ভালবাসত, কত…দেখলাম মা আমার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিল। বাবা আমার দিকে দেখছিলেন না, তাঁর চোখে মুখে কেমন যেন উত্তেজিত দুশ্চিন্তার ছায়া, কেবল খুকু আমার দিকে চেয়ে রয়েছে। ওর চোখে কেমন একটা অবাক ভাব–অবাক কী বলা যায়, খানিকটা মজা দেখে অবাক হবার মতো। খুকুটা বোধ হয় এখনও রিয়্যাল নাবালিকা।

ঘরের বাইরে এসে দেখলাম, ধৃতি চিনা মেয়েদের মতো পায়জামা আর জামা পরে বারান্দায় এখনও দাঁড়িয়ে আছে। নাবালিকা কি না জানি না, তবে খুব সাংঘাতিক মেয়ে। চোখাচোখি হতেই ঠোঁট টিপে যেন একটু হাসল। আমি অবাক হলাম, আর মোটেই ভাল লাগল না, কিন্তু ধূতি হঠাৎ বলে উঠল, এত নার্ভাস হচ্ছেন কেন। লিপি মোটেই আন্ডার এজেড না, আপনার কাঁচকলা করবে।

এর থেকে আমার সামনে বোমা পড়লে এমন তাজ্জব হতাম না। আমি কিছু বলবার আগেই ইনস্পেক্টর বলে উঠল, কে আপনি?

লোকটা ধৃতিকে আপনি বলছে, আমাকে তুমি। ধৃতি ইনস্পেক্টরের মুখের ওপরেই বললে, চিনবেন না, ধৃতিময়ী মুখার্জি।

বাবা ধমকে উঠলেন, ধৃতি।

ধৃতি তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল, আমি মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলাম না এবং আমার চিন্তা বা ভাবনা মতো, কোনও কথা বা একটা মানুষও মিলছে না। ধৃতি এরকম কথা বলল কেমন করে, ওর কি ভয় বলে কিছু নেই। নেই বলেই আমার ধারণা, তা না হলে, ছেলেবেলা থেকেই যে-মেয়ে–সে কথা থাক, আমার মা বোন যাকে পছন্দ করে না, হয়তো ঝগড়া-ই–যাকে আজকাল আমাদের ওপরে আসতে দেখা যায় না, আমি তো কথা-ই বলি না, গম্ভীর মুখে এমন একটা ভাব করে থাকি, যেন একজন অপরাধীকে দেখতে পেয়েছি। ধৃতির অবিশ্যি তাতে কিছু আসে যায় বলে মনে হয় না, ও ঠোঁটের কোণে হাসে, ভুরু ওঠানামা করে, আমি-ই যেন কেমন অস্বস্তি বোধ করি।

কথা না বললেও এমন অদ্ভুত নির্লজ্জ মেয়ে, যেচে কথা বলে, অকারণেই হয়তো জিজ্ঞেস করে, আপনার ঘড়িতে কটা বাজল নীরেনদা?

যেন আমি কখন নীচে নামব এবং ও আমার ঘড়ির সময় জিজ্ঞেস করবে বলে নীচে সিঁড়ির ধারে দাঁড়িয়ে থাকে। কেবল যে ঘড়ির সময়ের কথা জিজ্ঞেস করে তা না, আজেবাজে অদরকারি নানান কথা জিজ্ঞেস করে। এক এক সময় মনে হয়, আমার পিছনে লাগবার জন্যই এরকম করে, আমাকে রাগাবার জন্য। কিন্তু আমাকে রাগানো এত সস্তা নয়। অনেক সময়ই, ওর কথার কোনও জবাব না দিয়ে চলে যাই। মনে মনে অনেক বার ভেবেছি, মেয়েটা পারভার্ট–মানে বিকৃত মনের মেয়ে। তা না হলে এমন করবে কেন। যেভাবে আমার মনের পবিত্র কিশোরী ভাবনাটা ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল, সেই চার বছর আগে, একটা মেয়ে–যাক, ও সব আমি ভাবতে চাই না, কিন্তু এটা কী ব্যাপার, আমি বুঝতে পারছি না। যখন সবাই আমার বিপক্ষে কথা বলছে, না, যাচ্ছেতাই, নাবালিকা হরণের কথা বলছে, তখন দারোগার মুখের সামনে, আমার বাবা মায়ের মুখের সামনে, এরকম একটা কথা বলল কেমন করে। অবিশ্যি এ মেয়ের অসাধ্য কিছুই নেই, পাড়ায় বা রাস্তাঘাটে যেভাবে চলে, আমি তো দেখলেই শত হাত দূরে। রকের ছেলেদেরদের যে-কোনও বীরপুরুষ আর কী বলে বীরপুরুষের স্ত্রীলিঙ্গবীরা বীরাঙ্গনা এবং পুলিশ পর্যন্ত ভয় করে, ধৃতি তাদের মানুষ বলে মনে করে না যেন। আশেপাশের সব রকের ছেলে ওর চেনা, প্রত্যেকের নাম জানে এবং প্রত্যেকটা ছেলেকে ও তুই তোকারি করে। ওর থেকে অনেক বড় বড় ছেলেকে, যাকে বলে অনায়াসে ও তুই বলে ডাকে। একদিনের কথা তো আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে, সেদিন আমার কানে তালা লেগে গিয়েছিল, দেখেছিলাম, ধৃতি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল, একটা রকে কয়েকটা ছেলে বসে ছিল, হঠাৎ রক থেকে শিস বেজে উঠেছিল। ধৃতিও তৎক্ষণাৎ রকের দিকে ফিরে, মুখে আঙুল ঢুকিয়ে দু বার চিলের ডাকের মতো শিস দিয়ে উঠেছিল। আমার সত্যি কানে তালা লেগে গিয়েছিল। তারপরে রকের ছেলেদের সঙ্গে ওর কী কথা হয়েছিল আমি জানি না, একেবারে অন্য দিক দিয়ে চলে গিয়েছিলাম, কেন না আমার এ সব ঘটনার সামনা সামনি হওয়া উচিত না, কারণ পাড়ায় একটা যাকে বলে–ইয়ে তো আছে। আজ অবিশ্যি একটা ব্যাপারেই সব ইয়ে শেষ হয়ে গিয়েছে। সেটা যাই হোক, তা বলে দারোগার সামনে নীচে এসেও দেখলাম, কয়েকজনের সঙ্গে ধৃতি দাঁড়িয়ে আছে, কেবল ওর বাবা মা নেই। আমি তাড়াতাড়ি ওর দিক থেকে চোখ নামিয়ে নিলাম, ও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। না, ধৃতিকে আমি বুঝতে পারছি না, কাউকেই না।

দরজা পেরিয়ে বারান্দায় এসে দেখলাম, জিপটা দাঁড়িয়ে আছে এ-পাশে, আর কিছু লোক, ছেলেরাই বেশি, এদিকে ওদিকে আছে। আলোর আবছায়ায় কারোকেই ভাল দেখা যাচ্ছে না, কারোকেই চিনতে পারছি না। নিশ্চয় আমাদের পাড়ার ছেলেরাই আছে। আমার খুবই লজ্জা করছে, অন্য কারণে না, সবাই আমাকে যা ভাবছে বা আমি যা করেছি বলে মনে করছে, আমি তা নই বা করিনি, কিন্তু কারোকে সে কথা বোঝাবার নেই। খুব জোরে কান ফাটানো শিস বেজে উঠল দুবার, তারপরেই আবার গলির বাইরে থেকে কয়েকবার পর পর কয়েকটা বোমা ফাটবার শব্দ হল। ইনস্পেক্টর আমার খুব কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল, রাস্তার লোকজনদের দেখছিল, বোমার শব্দ হতেই আমার আরও গায়ে ঘেঁষে এল, রাস্তার লোকদের দিকে আর গলির যে-মোড়ে বোমা ফাটছে, সেদিকে তাকাল। আমি মাথা নিচু করে বারান্দার সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলাম, ইনস্পেক্টর জিপের ডান দিকের সিটটা নামিয়ে দিয়ে বলল, তুমি ভিতরে যাও।

এই সময়েই যেন কার গলা শোনা গেল, বিয়ে করতে চলল রে সসলা।

কথাটা যেন কানের মধ্যে লম্বা একটা ছুঁচের মতো ছুঁড়ে দিল। হঠাৎ কয়েকজন আমাকে ঘিরে জিপের খুব কাছে চলে এল। ইনস্পেক্টর কোমরের কাছে, রিভলবারের খাপের ওপর হাত রাখল, কিন্তু শান্ত আর নিরীহ গলায় বলল, সরে যান ভাই আপনারা, একে উঠতে দিন।

ইনস্পেক্টর এরকম করে বলছে কেন। আমাকে কেউ ছিনিয়ে নিয়ে যাবে, এরকম সন্দেহ করছে। নাকি। আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবার কেউ নেই, এবং ছিনিয়ে নিতে চাইলেও কারওর সঙ্গে আমি যাব না। ইনস্পেক্টর আমাকে জিপের গায়ে ঠেলে দিয়ে এমনভাবে দাঁড়াল, যেন কেউ আমার গা ছুঁতে না পারে, অর্থাৎ টেনে নিয়ে না যেতে পারে। ঠিক এ সময়েই, জিপের ওপরে পা দেবার মুহূর্তে, একটা ঝকঝকে ধারালো দাঁতের হাসি আমি দেখতে পেলাম, দিগা–মানে দিগন্ত। ও আমাকে বেশ যেন বিদায়ের সুরেই জিজ্ঞেস করল, চললি?

এ কথার জবাব দেবার কিছু নেই, জানি ও দাঁতে দাঁত চিবিয়ে আমাকে ঠাট্টা করছে। ইনস্পেক্টর ওর দিকে তাকাল, চোখ দুটো যেন সাবধানী হয়ে উঠল, বলল, দিগা যে, এখানে কী করছ?

দিগা বলল, ছেলেবেলার বন্ধু স্যার, নিয়ে যাচ্ছেন, তাই দেখতে এলাম।

তারপরেই আমার দিকে ফিরে বলল, তবে হতিস আমাদের গ্রুপের লোক, তা হলে স্যারকে নিয়ে যেতে দিতাম না।

দিগা ইনস্পেক্টরের দিকে চেয়ে হাসল। আমি ভাবতে পারি না, একজন পুলিশ ইনস্পেক্টরের সামনে একটা মস্তান এভাবে কথা বলতে পারে। ইনস্পেক্টর গম্ভীরভাবে শব্দ করল, হুম্।

শব্দ করেই, তার ভারী কোমরের সামনে দিয়ে আমাকে একটু ঠেলে দিল, আমি জিপে পা তুলে দিলাম।

এক বার ওপরের ব্যালকনির দিকে তাকাতে ইচ্ছে করছিল, পারলাম না। ড্রাইভার উনিফর্ম-পরা। পিছন দিকে যেতে গিয়ে দেখলাম, সেখানে দুজন কনস্টেবল বসে আছে, যাদের আগে দেখতে পাইনি। আমি ওঠবার পরেই ইনস্পেক্টর লাফ দিয়ে উঠল, সিটটা টেনে নিয়ে বসবার আগেই বলল স্টার্ট।

এঞ্জিন শব্দ তুলতেই কারা একসঙ্গে বলে উঠল, বলো হরি, হরি বোল। তার মানে আমি কি একটা মৃতদেহ নাকি, আমাকে কি শ্মশানে নিয়ে চলেছে। অবিশ্যি এক দিক থেকে দেখতে গেলে, আমার নিজের কাছে, এটা এক ধরনের নরক যাত্রাই বটে। ঘন ঘন হরিবোল ধ্বনি পাড়াটাকে যেন এক ধরনের উল্লাসে মাতিয়ে তুলল, তার মধ্যেই কেউ কেউ রাম নাম সথহ্যায় বলে চিৎকার করল এবং লিপির নাম কয়েক বার শুনতে পেলাম। এই সব হট্টগোলের মধ্যে গাড়িটা যখন চলতে আরম্ভ করল, ঠিক তখনই, জিপের খুব কাছেই, পর পর কয়েকটা পটকা ফাটল, অনেকেই দৌড়োদৗড়ি শুরু করল, কোনও বাড়ির ছাদ থেকে মহিলার চিৎকার শোনা গেল, নমন্তু পালিয়ে আয়। এবং দিগার গলা শোনা গেল, ভয় নেই স্যার, আপনি চলে যান, ছোঁড়ারা মাতামাতি করছে।

সেটা অবিশ্যি ঠিক, এ সব না হলে মাতামাতি ঠিক জমে না, আমারও ভয় করছিল, জিপের ওপর এসে একটা যদি পড়ে, অথচ লজ্জায় আর দুঃখে আর কষ্টে, এমন কী, সত্যি বলছি, বাবা মায়ের ওপর কেমন যেন একটা অভিমানও হচ্ছে, তার মধ্যে, প্রাণের ভয়টাও কেমন যেন বিদ্যুৎ চমকের মতো চিক চিক করে উঠল। গাড়িটা যেন হঠাৎ গোঁয়ারের মতো শব্দ করে ছুটতে লাগল, আর আমার পিছনের হাসি চিৎকার ধ্বনির শব্দ কমে আসতেই শুনতে পেলাম, বন্ধুগণ, সেই সব লম্পট দুশ্চরিত্রদের চিনে রাখুন, তারা আজ কোন পার্টিতে আছে, এই সব নোংরামির পিছনে কারা মদত জোগাচ্ছে। এদের মুখে রাজনীতির বুলি, কাজে সমাজবিরোধী, পাড়ার মেয়েদের ইজ্জত নিয়ে খেলা করে…।

জিপটা বড় রাস্তায় পড়ে মোড় ঘুরে যেতেই কথাগুলো আর শোনা গেল না। গলা শুনেই চিনতে পারলাম, নিখিল বলছে, এবং গলির মোড়ে, হঠাৎ এই স্ট্রিট কর্নার মিটিঙের কী প্রয়োজন পড়ল, তাও বুঝতে পেরেছি। লক্ষ্য আমি, কিন্তু এটা যদি কেবলমাত্র একটা ব্যক্তিগত আক্রমণ হত, তাতে আমার আপত্তি ছিল না, পার্টিকে জড়িয়ে এই গালাগাল দেবার সুযোগটা নিখিল ছাড়েনি। সেটাই আমার সবথেকে লজ্জা, এবং ভয়েরও কারণ, আমার সমস্ত ব্যাপারটা এমন দিকে ঘুরছে যে, পার্টি কিছুতেই আমাকে ক্ষমা করতে পারবে না। অথচ কারোকে কিছু বোঝাবার নেই। ইনস্পেক্টর পিছন ফিরে এক বার আমার মুখের দিকে তাকাল, বোধ হয় দেখতে চাইল, নিখিলের বক্তৃতা শুনে আমার অবস্থা কী, কারণ ব্যাপারটা সে বুঝতে পেরেছে, নিশ্চয় বেশ মজাও পেয়েছে।

সত্যি বা মিথ্যার কোনও ব্যাপার নেই, কেউ তার ধার ধারছে বলেও মনে হয় না, সবাই উল্লাসে চিৎকার করছে, পটকা ফাটাচ্ছে, বক্তৃতা করছে; বোধ হয়, যাকে বলে জনতা, তাদের সামনে বিচারের জন্য আমাকে ছেড়ে দিলে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই, হাসতে হাসতে, উল্লাসে তারা আমাকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলত। সত্যি কি ব্যাপারটাকে কেউ ভেবে দেখতে চায় না! রোম দেশের ঘটনা নিয়ে হলিউডের তৈরি ছবির মতো যেন ঘটনাগুলো ঘটছে। মানুষের এই রূপটা আমার জানা ছিল না। বিচার বিবেচনাহীন একটা অন্ধ বিশ্বাসে আজকের মানুষ যে এরকম করতে পারে, ভাবতে পারি না। নিখিল সময় বুঝে হয়তো একটা কার্যসিদ্ধি করেছে, প্রতিশোধ নিতে চেয়েছে, কিন্তু আমার ধারণা, আসলে মিথ্যাটা ও বিশ্বাস করেছে।

মিথ্যা। কথাটা আমি আগাগোড়াই ভেবে যাচ্ছি। এখন এই মুহূর্তে আমার উলটোদিকে যখন দুজন কনস্টেবল বসে আছে, আমি একটা ঢাকা খোলের মধ্যে বসে দুলছি, কাত হয়ে পড়ছি, এবং ইনস্পেক্টর আর ড্রাইভারের মাঝখান দিয়ে উইন্ডস্ক্রিনের ভিতর দিয়ে চেনা রাস্তাটা দেখতে পাচ্ছি–আলো ঝলকানো রাস্তাটা, দোকানপাট সবই আমার চেনা, এমনকী ভাল করে দেখলে হয়তো অনেক লোকও চেনা দেখা যাবে, যদি বা এ সমস্ত কিছুই যেন অনেক দুরে বা সত্যি আমার চোখের সামনে নেই, মনের পরদাতে একটা ছবির মতো ভেসে যাচ্ছে, ঠিক এসময়েই আমার মনে হল, আমি বারে বারে সমস্ত ব্যাপারটাকে মিথ্যা ভাবছি কেন।

লিপিকে নিয়ে আমি চলে যাইনি, ঘটনাটা, যাকে বলে, রিয়্যালি ঘটেনি, কিন্তু সবাই যা বলছে বা বিশ্বাস করেছে, ঘটনা ঠিক ঠিক মতো ঘটলে, সমস্ত ব্যাপারটাই সত্যি। লিপিকে নিয়ে আমার চলে যাবার কথাই ছিল, এবং সমস্ত ব্যাপারটা আগে থেকে বেশ প্ল্যান প্রোগ্রাম করে, যাকে বলে, প্রায় একটা ষড়যন্ত্র করে, বাবা মা কাউকে না জানিয়ে, বন্ধুবান্ধবদের মধ্যেও, একমাত্র পরিমল ছাড়া, কারোকে না জানিয়ে, সেই সেই জঘন্য ব্যাপারটা, পালিয়ে যাবার কথাই ছিল। যেহেতু ঘটনাচক্রে, (কী ঘটনা, তা আমি এখনও কিছুই জানি না। আমার চোখের সামনে হঠাৎ ভেসে উঠল, লিপির গায়ে জামা কাপড় নেই, সব কেড়ে নেওয়া হয়েছে, ওর চোখে গায়ে আঁচড়ানোকামড়ানোর দাগ, ও এক হাত দিয়ে সেই ওর সেইনা থাক, এখন আমি আর লিপির সেই বুকের কোনও সুন্দর বিবরণ বা উদাহরণ দিতে চাই, কেবল আমার চোখের সামনেই ওর সেই–ওর সেই অপরূপ শরীরটা ভাসছে, এই মুহূর্তে, দারুণ আতঙ্কে লিপি অসহায়ভাবে বুকে আর নীচে দুটো হাত দিয়ে লজ্জা রক্ষা করতে চাইছে, আর ওকে ঘিরে বাঘের মতো তিনটে–আশ্চর্য, তিনটেই কেন, লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে, ঝাঁপ দেবে বলে। দারুণ উদ্বেগে, এই একটা ছবি, আমার চোখের সামনে এক বার ভেসে উঠেই মিলিয়ে গেল) লিপিকে নিয়ে আমার পালিয়ে যাওয়া হয়নি, সেই হেতু সমস্ত ব্যাপারটা মিথ্যা হয়ে যাবে কেন।

অবিশ্যি আমি জানি, একটা মানুষকে মনে মনে মেরে ফেলা বা একটা মেয়েকে মনে মনে যাকে বলে বেআবরু করে ফেলা বা তার থেকে বেশি কিছু বাইরের দিক থেকে কোনও অপরাধ না, কারণ সে অপরাধ সংঘটিত হয়নি। আইন বা সমাজের চোখে এ ধরনের মানুষকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় কানো যায় না, কিন্তু এ ক্ষেত্রে অপরাধী নিষ্ক্রিয়ভাবে, নিজের মধ্যেই আত্মগোপন করে থাকে। অপরাধী নিজেকে নিজেই একমাত্র চিনতে পারে, এবং এটা অপরাধ না, এ কথা বলা চলে না। আমার ব্যাপারটা তা না, অনেকটা তা-ই। যদি লিপিকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়াটা অপরাধ হত, বা হয়, তা হলে আমি অপরাধী। আমি বলতে চাইছি, লিপিকে নিয়ে সশরীরে পালাইনি, ঘটনাটা বাস্তবে ঘটেনি, কিন্তু পালিয়ে যাবার জন্য সব ব্যবস্থাই করা হয়ে গিয়েছিল। আমি মনে মনে পালিয়ে ছিলাম এবং পালাবার জন্য যা যা করা সম্ভব, তার সবই আমি মনে মনে করেছি, আমি বিয়ে রেজেস্ট্রি করেছি, মধ্যমগ্রামে সেই বন্ধুর বাড়িতে লিপির সঙ্গে এক বিছানায় শুয়েছি, আর জীবনে যা কখনও করিনি–ভাবতে পারছি না, কারণ আমি জীবনে যা কখনও করিনি (লিপিকে) তা আমি ভাবতে পারি না, অথচ তা-ই করেছি।

কিন্তু এখন কথা হচ্ছে, লিপিকে নিয়ে পালালেই আমি অপরাধী হব কেন। পালানো ব্যাপারটা অর্থাৎ বাড়িতে না বলেকয়ে চলে যাওয়াটা, যা আমাদের চোখের সামনে আকছার ঘটছে, ছেলেমেয়েরা বাড়ি থেকে পালিয়ে যাচ্ছে, সেটা আমি কোনওদিনই চাইনি। আমার মতো একজন যুবকের পক্ষে, সব দিক দিয়েই, এটা একটা প্রে–প্রেমানে প্রেসটিজের, মান সম্মানের প্রশ্ন। কিন্তু লিপি কারোকে না জানিয়ে, নিঝঝুম দুপুরে, টুক করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসবে, একটা চিরকুট লিখে রেখে আসবে, আর তারপরে থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে, ঘন ঘন নিশ্বাসে, ভয়ে আর উদ্বেগে পালাতে থাকবে, এটাই চেয়েছিল। আমি জানি, ও মোটেই সিরিয়াস না, পালানো ব্যাপারটা ওর কাছে একটা থ্রিলিং, সেজন্যই ওভাবে পালাবার প্ল্যান করতে হয়েছিল, তা না হলে, লিপি আমাকে বিয়ে করত না। এখন তো সবইযাকে বলে ফিনিশ, পালানো, বিয়ে, সবই রসাতলে। ও যে-যাক, এখন এই মুহূর্তে, এ কথা আমি ভাবতে চাই না। আমি বুঝতে চাইছি, লিপিকে নিয়ে আমি যদি চলে যেতাম, তা হলে অপরাধটা কীসের।

নাবালিকা–লিপি। এটা একটা ভয়ংকর বিচ্ছিরি যাচ্ছেতাই মিথ্যা কথা। এখন আমি মনে করছে। পারছি, এ কথাটা স্পষ্ট করে দুটি মেয়ে বলতে পেরেছে, একজন পরিমলের বোন ঝরনা আর ধৃতি উহ্, কোন সাহসে মেয়েটা দারোগার সামনে আমাকে ওভাবে বলেছিল জানি না। তবে ও মেয়ে বোধ হয় সব পারে। যাই হোক, লিপি যে নাবালিকা না, তার অনেক প্রমাণনা প্রমাণ শব্দটা আমার বলা উচিত না, ওটা একটা আইন ঘটিত শব্দ, অনেক ঘটনা আমার জানা আছে। আমি আট মাস লিপিদের বাড়িতে যাই না–আট মাস কয়েক দিন হল, সিঁড়িতে চুমো খাবার সেই ঘটনা নিয়ে, লিপির মা আমাকে তাদের বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল। আট মাস, তারও প্রায় মাস দুয়েক আগে, লিপির জন্মদিন হয়েছিল। আমাকে অবিশ্যি ওর মা খেতে বলেনি, আর যাকে যা বলবার, তা ওর মা-ই তো বলবে, অথচ পরিমলকে রাত্রে খাবার নিমন্ত্রণ করেছিল, আরও কয়েকজনকে বলেছিল, তার মধ্যে ওর মায়ের সেই সে ছিল, ওর বাবার অফিসের দু-একজনকে বলেছিল, আমাকে খেতে বলেনি, তবে সন্ধেবেলা বিশেষভাবে যেতে বলেছিল, মিষ্টি আর চা খাইয়েছিল। জন্মদিনের সপ্তাহ দুয়েক আগে থেকেই, ওর মা কয়েক বার একটা কথা শোনাচ্ছিল, লিপির নাকি একটা রেকর্ডপ্লেয়ারের খুব শখ। লিপি যদিও আমাকে কিছু বলেনি, ওর মা আমাকে কয়েক বারই কথাটা শুনিয়েছিল, এবং এমনকী কোন কোম্পানির কী নামের রেকর্ডপ্লেয়ার লিপির পছন্দ বা শখ, সেটাও বারে বারে বলেছিল। কথাগুলোর ধরন এইরকম ছিল মেয়েটাকে যে শখ মেটাবার জন্য একটা রেকর্ড প্লেয়ার কিনে দেব, তার উপায় নেই। বুঝতেই তো পারছ নীরেন, ওর বাবার তো সেরকম একটা আয় না। যাকগে, গরিবের মেয়ের ওরকম কত শখ হয়, সবই কি আর মেটে।

আমাকে কথাগুলো ওভাবে শোনাবার কী মানে, তা যে আমি একেবারে বুঝতে পারিনি, তা না। হতে পারি বাংলায় থার্ড ক্লাস, কিন্তু ও সব বোঝবার মতো বুদ্ধি ছিল। কিন্তু যাকে শোনানো হচ্ছিল, সে তখনও এই অস্থায়ী চাকরিটাও পায়নি, কয়েকটা টুইশানি পর্যন্ত তার দৌড়। নিজেদের বাড়িতে রেকর্ডপ্লেয়ার নেই–তা না-ই থাকুক, কেনো আমার বাবার রুচি ওটা, তা না হলে তিনি ইচ্ছে করলে বাড়িতে ও বস্তুটি আনতে পারতেন। কিন্তু আমার মতো একজন বেকার যুবকের পক্ষে বাবার কাছ থেকে টাকা চেয়ে প্রেমিকাকে প্রেজেনটেশন কিনে দেওয়া সম্ভব ছিল না, যে কারণে শেষ পর্যন্ত আমি লিপিরই শরণাপন্ন হয়েছিলাম। নিশ্চয়ই আমি লিপির কাছে টাকা চাইনি, ওকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, সত্যি রেকর্ডপ্লেয়ারে ওর শখ আছে নাকি। জন্মদিনের পাঁচ দিন আগে ওদের বাড়ির ছাদ। সময় সন্ধে। নীচের তলায় সে এসেছে, লিপির মা ব্যস্ত, আমার মাথায় রেকর্ডপ্লেয়ার, আমি লিপিকে আসবার ইশারা করে ছাদে চলে গিয়েছিলাম। লিপির মনোভাবটা না জানতে পারলে আমি ঠিক স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। মা ওর মাথায় রেকর্ডপ্লেয়ারটা কতখানি ঢুকিয়ে রেখেছে সেটা আমার বোঝা দরকার ছিল। কথাবার্তা এই রকম হয়েছিল:

লিপি: (ভুরু কাঁপিয়ে, নিচু স্বরে) কী?

আমি: এদিকে এসো না।

লিপি: (পিছনে ফিরে দেখে নিয়ে কাছে আসতে আসতে) মা হয়তো খোঁজাখুঁজি করবে।

আমি: (লিপির হাত ধরে) তোমার সত্যি রেকর্ডপ্লেয়ারের খুব শখ?

লিপি: জানি না, যাও।

আমি: না, সত্যি বলো না, রেকর্ডপ্লেয়ারের তোমার সত্যি খুব শখ?

লিপি: বা রে, রেকর্ডপ্লেয়ারের শখ আবার কার না হয়। কিন্তু সে কথা বলবার জন্যে তুমি আমাকে এখানে ডেকে নিয়ে এলে!

আমি: না, মানে, আমি তোমার মায়ের কাছে শুনছিলাম—

লিপি: মা কি তোমাকে দিতে বলেছে নাকি?

আমি: না না, তাই কখনও বলতে পারেন। তোমার মায়ের মুখে শুনলাম, তোমার একটা রেকর্ডপ্লেয়ারের খুব শখ।

লিপি: (ওর চোখে মুখে যেন আলো ঝলকে উঠেছিল। চোখ দুটো চিকচিক করে উঠেছিল। ও খুব আনন্দে ঘাড় নাড়িয়েছিল) সত্যি, একটা রেকর্ডপ্লেয়ার থাকলে কী মজা, তাই না? রেকর্ড লাগাও আর বাজাও। আহ্, কী মজা, যে সব গান আমার ভাল লাগে, সেগুলো যখন ইচ্ছে শুনতে পাব।

লিপি কতকগুলো গান আর গায়কের নাম বলেছিল, সবই বাংলা আর হিন্দি আধুনিক গায়ক-গায়িকাদের গান, যা আমি পছন্দ করি না–মানে, ভাল লাগে না, লিপি তা জানে। বোধ হয় আমার কানটা সেভাবে তৈরি হয়নি।

আমি: তা হলে তোমার জন্মদিনে আমি তোমাকে একটা রেকর্ডপ্লেয়ার দেব।

লিপি: তুমি! তোমার কাছে এত টাকা কোথায়। না না, তুমি ও সব করতে যেয়ো না।

আমি: (লিপিকে কাছে টেনে) তোমার যখন শখ, ওটা আমিই তোমাকে দেব।

লিপি: দিয়ো, দেবার সময় তো চলে যাচ্ছে না। তুমি একটা চাকরি করো, তারপরে দিয়ো।

আমি: (কথা বলবার আগে, লিপির ঘাড়ের পিছনে চুলের গোছায় হাত দিয়ে) কিন্তু জন্মদিনটা একটা বিশেষ দিন, সেই দিনই আমি ওটা তোমাকে দিতে চাই।

লিপি: (মুখ ভার। অনুযোগের স্বরে) না, এখন তোমার ও সব কিছু করতে হবে না। জান, সেলট্যাকস ফ্যাকস দিয়ে, চারশো টাকার ধাক্কা। এখন তুমি এত টাকা কোথায় পাবে।

আমি: সে ম্যানেজ হয়ে যাবে। এখন যেভাবেই কিনি, ওটা তো তোমার আমারই থাকবে।

লিপি কাজলটানা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, কোনও কথা বলেনি। আমি ওকে আরও কাছে টেনে চুমো খেয়েছিলাম। ওকে যেন অন্যমনস্ক আর চিন্তিত দেখাচ্ছিল। মুখটা নামিয়ে নিয়েছিল। আমি আবার ওকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে, ওর সমস্ত শরীরটা আমার শরীর দিয়ে অনুভব করেছিলাম। আর এই সব অনুভূতি একটা ইলেকট্রিকের ভোলটেজের মতো, অন্যদিকে নিভতে থাকে, একদিকে কেবল বাড়তে থাকে, বাড়তেই থাকে, যে কারণে, ও যেন অনেকটা ছেলের কাছে মায়ের মতো দাঁড়িয়েছিল, আর আমি খেয়ে খুঁটে ওকে আদর করছিলাম, তারপরে চিবুক তুলে ধরে, মুখটা কাছে টেনে নিয়েছিলাম, তখন ও আমাকে চুমো খেয়েছিল, মনে হয়েছিল, ওর চোখে যেন একটা আবেগ ফুটে উঠেছিল, নাকের পাটা ফুলে ফুলে উঠছিল, আর এক বার কষ্ট পাওয়ার মতো শব্দ করে উঠেছিল, উহ্। আমি ওর গায়ের থেকে হাতটা সরিয়ে নিয়েছিলাম। আকাশে তখন একটা একটা করে তারা ফুটছিল, ছায়া ছায়া অন্ধকার ঘনিয়ে আসছিল, লিপিকে যেন অনেকটা সিনেমার ছবির মতো লাগছিল, ও অন্যদিকে তাকিয়েছিল, কিন্তু কিছু দেখছিল বলে মনে হয় না, যেন অনেকটা আপন মনে বলে উঠেছিল, আমি খুব তাড়াতাড়ি বুড়ি হয়ে যাব এবার।

কথাটা না বুঝতে পেরে আমি হাঁ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম, ওর শরীরটা আমার শরীরে ঠেকানো, এবং আমার অবাক লাগছিল, কোথাও তো ওকে বুড়ি বলে মনে হচ্ছিল না! ওর সেই কোমর-নি-নি-নিতম্ব যাকে বলে, ওই শব্দটাই আমাকে বহু বার বহুভাবে পড়তে হয়েছে, পরীক্ষার জন্যই, অবিশ্যি আর একটা শব্দ আছে, মাজা, কথাটা খারাপ না, এক দিক থেকে অনেক বেশি কী। বলে অ্যাপ্রোপ্রিয়েট–যথার্থ–অথবা পাছানা ওটা বোধ হয় কেবল পেছন দিকটাকেই বোঝায়, যাই হোক, ওর সেই বিশাল বিশাল কি না জানি না, একেবারে গোল না, গোল মতো, ভারী আর চওড়া কোমরে আমার হাত ছিল, ডান হাতটা হাতের তলা দিয়ে পিঠের ওপরে রেখেছিলাম। বগলের ঘাম আমার হাতের একটা জায়গা ভিজিয়ে দিয়েছিল, আর আমার বুকের একটু নীচেই, ওর বুক ছুঁয়েছিল সে বুকের এক হাজার বর্ণনা আমি দিতে পারি, কিন্তু সেগুলো কেবল বৈষ্ণব কবি বা রবীন্দ্রনাথের কল্পনা, তাতে বর্ণনাই হবে, অন্যান্য কবিদের বর্ণনায় লিপির বুকের ছবি ফুটবে না, কারণ পৃথিবীতে লিপির মতো বুক কারোরই নেই, কোনও মেয়েরই নেই, কালিদাস তাঁর নায়িকাদের বুকের বুকের না, ওঁদের আবার স্তন না পয়োধর, যত বর্ণনাই দিয়ে থাকুন, তিনি বা তাঁরা তো লিপিকে দেখেননি, লিপির স্তন শুধু লিপিরই লিপে লিপি-লিপিস্তন তাকে বলা যায়, কেন না, যারা বলে, মেয়ে মানেই মেয়ে, মানে বলতে চায়, সব মেয়েই এক, সব মেয়ের শরীরই এক, আমি তা ভাবতে পারি না, লিপি লিপি-ই। অনেকটা সেই তোমার তুলনা তুমি, এবং ওর সেই সমস্ত শরীরটাকে শরীরের মধ্যে জড়িয়ে রেখে, কোথাও ওকে বুড়ি বলে মনে হচ্ছিল না, বরং আরও যেন অনেক বেশি যুবতী বলে মনে হচ্ছিল। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন, এ কথা বলছ কেন লিপ।

লিপ! হ্যাঁ আমি যখন ভালবাসতে বাসতে, কাদার গোলার মতো গলে যেতাম, আবার একই সঙ্গে, যাকে বলে অনেকটা ভীমাকৃতি–এরকম আবার কখনও হয় নাকি!) কঠিন হয়ে উঠতাম, তখন ওকে লিপ বলে ডাকতাম, আমার লিপ লিপলিপালিপলিপ। লিপি ওর অন্যমনস্ক চোখ আমার দিকে ফিরিয়ে বলেছিল, বারে, জান না, মেয়েরা কুড়িতেই বুড়ি। আর আমি তো কয়েক দিন পরেই বাইশ বছরে পড়ব।

কথাটা শুনে আমার নিজেরই যেন অবাক লেগেছিল, বাইশ! বাইশ বছরে পড়তে যাচ্ছিল লিপি! এতখানি বয়স ওর কবে হল, তা-ই ভাবছিলাম আমি, কারণ, তার মাত্র বছর চারেক আগে তো ও ফ্রক ছেড়েছিল, আমার ধারণা ও বরাবর ছেলেমানুষই ছিল, এবং আমি ওর মায়ের মুখে অনেক বার শুনেছি, লিপি এখনও যথেষ্ট ছেলেমানুষ। অবিশ্যি, লিপির গায়ে হাত দিলে বা ওকে আদর করার সময়, কোনওদিনই আমার খুব ছেলেমানুষ মনে হয়নি, ছেলেমানুষ–মানে, কিশোরী বলে ধরে নিচ্ছি আবার কিশোরী। একি সেই কিশোরী ভজন, কিশোরী পূজন, কিশোরী আমার গুরুরু-উ-উ হাল হল নাকি। হুতোমের সেই ব্যঙ্গ রচনাটা আমার মনে পড়ে যাচ্ছে কিশোরীকে গুরুপ্রসাদি করিয়ে নেওয়া, আর গুরুর পিঠে লাঠির বাড়ি। কিন্তু কিশোরীদের শরীরও তো আমি দেখেছি, ধৃতিনা, এ সব ভাবনায় আমি যেতে চাই না, তবে লিপিকে আমার কোনওদিনই, অন্তত যখন থেকে ওর গায়ে হাত দিয়ে আদর করবার অ-অ-অধিকার আমি পেয়েছি তখন থেকে কোনও সময়েই মনে হয়নি। আমার যেন মনে হয়, মেয়েরা একটা বয়স পেরিয়ে গেলে এই আর কী, আঠারো-উনিশ বা কুড়ি, এইরকমই হবে, পেরিয়ে গেলে, তাদের গায়ের গন্ধও বোধ হয় বদলে যায়। বয়সের একটা গন্ধ আছে, গন্ধ শরীরের এবং ভিতরের ভিতরের একটা গন্ধও আছে, যা নিশ্বাসের সঙ্গে পাওয়া যায়, বয়সের একটা সময় পার হয়ে গেলে, গন্ধ দুরকম হয়ে যায়, অবিশ্যি, তার মধ্যে ভাল মন্দ বিচার করা যায় কি না জানি না, কারণ লিপির গন্ধই আমার কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গন্ধ। আমি লিপির কথা শুনে কেমন যেন বোকা হয়ে গিয়েছিলাম। ওর কথাটা অবিশ্বাস করিনি, কিন্তু ও বাইশে পড়তে যাচ্ছে, কথাটা যেন ভাল লাগেনি, তা-ই বলেছিলাম, বাইশ কী বলছ। তুমি তোমার বয়সের কথা জান না।

লিপি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল, আমার চোখের দিকে, আর গাঢ় করে কাজল লাগানো ছিল বলে, সেই ছায়া অন্ধকারে, ওর চোখ দুটো যেন ঠাণ্ডা বাতির মতো জ্বলছিল। আকাশের তারা বলতে ইচ্ছা করে, যাকে বলে স্নিগ্ধ নক্ষত্রের মতো, তবে ওটা বুদ্ধদেবের জন্যই থাক, ঠাণ্ডা মিষ্টি তেলের বাতির মতো চোখে আমার দিকে তাকিয়েছিল, এবং সেই চোখে একটা সন্দেহ দেখা দিয়েছিল, জিজ্ঞেস করেছিল, তার মানে?

জিজ্ঞেস করেই ওর কালো সরু ভুরু একটু বেঁকে গিয়েছিল। আমি যেন একটু অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিলাম। আসলে আমি একটু ন্যাকামোই করে ফেলেছিলাম, এটা আমার এমন একটা খারাপ অভ্যাস, ভিতরে এক ভাবনা অথচ বাইরে মুখের ভাবে একেবারে আলাদা। আমি তো স্পষ্ট করে বললেই পারতাম, তাই নাকি, বাইশে পড়তে যাচ্ছ তুমি।কী বলব ভেবে যখন লিপির মনের মতো কথা খুঁজছি তখনই লিপি আঙুল দিয়ে আমার মুখের দিকে দেখিয়ে বলে উঠেছিল, এই তো, এই তো, তোমার মুখ বলছে, মিথ্যা কথা বলছ, বদমাইশি করছ। ন্যাকা, তুমি জান না, আমি বাইশে পড়তে যাচ্ছি।

আমি হেসে উঠেছিলাম, ওকে গায়ের কাছে আরও চেপে নিয়েছিলাম, কোমর থেকে হাতটা তুলে নিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে, মুখটা কাছে টেনে নিয়ে চুমো খেয়েছিলাম। লিপি আমাকে অনেকখানি বুঝতে পারে–পারত না, পারে পারে। পারত কেন ভাবছি আমি, লিপি কি পৃথিবীতে জীবিত নেই আর। এমন কথা আমি ভাবছি কেমন করে। আমার ভিতর আর বাইরের ব্যাপারটা লিপি অনেকখানি বুঝতে পারে। আমি আর সে প্রসঙ্গে না গিয়ে আবার রেকর্ডপ্লেয়ারের প্রসঙ্গে এসেছিলাম, আর লিপি অনেকটা যেন দুশ্চিন্তায় বলেছিল, জানি না, যা ভাল বোঝ তাই কর এবং আমি তাই করেছিলাম, পরিমলের কাছ থেকে টাকা ধার করে–ঠিক পরিমল না, ও আবার মোটামুটি একটা সুদে টাকাটা ধারের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল…দুম দুম দুম্…

একটা ধাক্কা, মাথাটা ঠুকে গেল ইনস্পেক্টরের সিটে। ইনস্পেক্টর পিছন ফিরে তাকাল, আমার আঘাত দেখবার জন্য না, রাস্তা দেখবার জন্য, আর ড্রাইভারকে বলল, ব্যাক করো। ব্যাক করে, বাঁ দিকের মন্দিরের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা গেছে সেখান দিয়ে ঢুকে পড়ো।

বলে সে পিছন দিকেই চেয়ে রইল, জিপটা গোঁ গোঁ করে ব্যাক করতে লাগল, আমি সামনে তাকিয়ে দেখলাম, রাস্তা অন্ধকার, ধোঁয়া উড়ছে, বাতাসে বারুদের গন্ধ। বোমা মারামারি হচ্ছে, ইটপাটকেলও ছোঁড়াছুড়ি হচ্ছে নিশ্চয়। রাস্তার আলো নিভিয়ে দিয়ে কারা যেন যুদ্ধ করছে, অন্ধকার বলে বিশেষ কিছু দেখা যাচ্ছে না, কেবল বোমা ফাটবার সঙ্গে সঙ্গে আলোর ঝলক দেখা যাচ্ছে, তার মধ্যেই হঠাৎ এক একটা মানুষের মূর্তি দেখা যাচ্ছে, আর জিপের গোঁ গোঁ শব্দের মধ্যেও শুনতে পেলাম, কে যেন চিৎকার করছে, এই সসলা গোপলা, মাল দে না। জিপটা ব্যাক করে যাচ্ছে, রাস্তায় লোকজন ছুটছে, এবং অন্ধকার যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে, একটু ওপরে চোখ তুলে তাকালেই বোঝা যায়, ছায়া ছায়া মা বোনেরা ব্যালকনিতে ঝুঁকে পড়ে যুদ্ধ দেখছেন, আর যুদ্ধের উত্তেজনা যেন তাদের সর্বাঙ্গে একটা সুখে, হিনা, উনা, হি-হিল্লোলিত হচ্ছে। নীচে নিরাপদ জায়গায় বাবা ভাইয়েরা যুদ্ধের হার জিত লক্ষ করছে এবং উত্তেজনা তাদের লুঙ্গি এবং গেঞ্জি ঢাকা শরীরের মধ্যেও প্রবাহিত হচ্ছে। এলাকাটা আমাদের না, তবে জানি, প্রায় গোটা সাতেক পার্টির অফিস খুব কাছাকাছি, যদি বা, পার্টির লড়াই হচ্ছে না কি মস্তানদের ওপন ফাইট হচ্ছে, বুঝতে পারছি না। আমাদের জিপটা মন্দিরের পাশ দিয়ে বেঁকে যাবার আগেই চড়া আলো এসে আমাদের গায়ে পড়ল, তার মানে যুদ্ধক্ষেত্রের দখলদার পুলিশ এসে পড়ল।

কিন্তু সে কথা থাক, আমি লিপির বয়সের কথা ভাবছিলাম। সমস্ত ব্যাপারটা আমাকে ঠিক মতো ভাবতে হবে। একটা মেয়েকে নিয়ে একটা ছেলে চলে যাবে, বিয়ে এবং সংসার পাতবে বলে, এখন আর এ ব্যাপারটা আমার কাছে কোনও অপরাধ বলে মনে হচ্ছে না। তবে হ্যাঁ, বিয়েটা যেমন একটা নিয়মমাফিক ব্যাপার, যাকে বলে ট্রাডিশনাল, একটা ছেলে একটা মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যাবে, সেটাও একটা পচা পুরনো ব্যাপার, অর্থাৎ ট্রাডিশনাল-ই বলা যায়, কিন্তু ব্যাপারটাকে যেহেতু একটু অন্য রসে মজিয়ে নেওয়া হয়, সেই হেতু, আমার আপত্তি ছিল। ওটা আমার ডিগনিটিতেযাই হোক, কিন্তু একটা নাবালিকাকে ফোঁসলানো এবং হরণ করা অপরাধ। আট মাস আগে লিপি নিজেই জানিয়েছিল, ও বাইশ বছর বয়সে পড়তে যাচ্ছে, তার মানে এখন ওর বাইশ বছর চলছে।

পরিমল অবিশ্যি এক বার আমাকে একটা খুব খারাপ সংবাদ দিয়েছিল–সংবাদ, মানে একটা ঘটনা বলেছিল, লিপি নাকি না, ভাবতে কী রকম কষ্ট হচ্ছে, পরিমল বন্ধুর মন বোঝে না। ঘটনাটা যদি সত্যিই হত, তা হলেও কি আমাকে বলা উচিত ছিল। তবে এ সব ক্ষেত্রে, মনটা একটু কেমন যেন প্যাঁচ কষতে ভালবাসে, যেমন আমি খুকুর ব্যাগে জন্মনিয়ন্ত্রণের সেই জিনিসের কথা ওকে বলেছিলাম। খুকুকে আমার এত খারাপ লাগে, আমি চাইতাম না পরিমল ওর সঙ্গে প্রেম করুক, এবং সত্যি বলতে কী, আমি খুকুর ব্যাগ থেকে ও সব পড়ে যেতে দেখে ভয়ও পেয়েছিলাম। মনে মনে চেয়েছিলাম, পরিমল যেন খুকুকে ছেড়ে দেয়, আর সেইজন্যই কথাটা পরিমলকে বলেছিলাম, যদি বা, প্ল্যান–হ্যাঁ প্ল্যানই বলতে হবে, বেশ ভেবে চিন্তেই তো কথাটা পরিমলকে বলেছিলাম, কিন্তু কাজে লাগেনি।

পরিমল আমাকে বলেছিল, লিপি নাকি নার্সিংহোেম থেকে ঘুরে এসেছে। যাক ভাবব না, এখনও কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু লিপিকে নাবালিকা বলার দরুনই কথাগুলো না ভেবে আমি পারছি না। নার্সিংহোম থেকে ঘুরে আসা মানে–হ্যাঁ, লিপি নাকি কিউরেট করিয়ে এসেছিল। আমি পরিমলের কথার প্রতিবাদ করেছিলাম। লিপির মুখটা আমার চোখের সামনে ভেসেছিল, সেই সুন্দর ফরসা একটু গোল ভাবের মুখ, বড় বড় টানা চোখ-না না, অসম্ভব। পরিমল যেন ছেলেমানুষের পাগলামি দেখে হেসেছিল, আর বেশ ঠাণ্ডা শান্ত ভাবেই বলেছিল, তুই আমার বন্ধু বলেই কথাটা তোকে বললাম। আমার কথা বিশ্বাস না হয়, লিপিকে জিজ্ঞেস করে দেখিস।

লিপিকে! পরিমলের কি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল, আমি লিপিতে জিজ্ঞেস করব, তুমি কি নার্সিংহোম থেকে, ইয়ে, মানে– অসম্ভব, এখনই তো কথাটা উচ্চারণ করতে পারছি না। পরিমল আমাকে বলেছিল, তুই লিপির দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখিসনি। তুমি শালা একটু ন্যাকা আছ। এ আবার বলে দিতে হয় নাকি। দেখিস না, তিন-চার দিন ধরে লিপি সবসময় প্রায় শুয়েই আছে, আস্তে চলাফেরা করছে, মুখ ফ্যাকাশে।

আমি পরিমলকে কিছু বলতে পারছিলাম না, কিন্তু লিপির সেই ক্লান্ত, একটু ফ্যাকাশে ফ্যাকাশে মুখটা আমার চোখের সামনে ভাসছিল, আর বুকের মধ্যে কী রকম করছিল। যদি বা লিপি আমাকে বলেছিল, ওর শরীরটা খারাপ, এবং এমনকী, ওর মাকে ফাঁকি দিয়ে যখন শোবার ঘরে ওর কাছে গিয়েছিলাম, কাঁধে হাত রেখেছিলাম, জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমার কী অসুখ করেছে? ও তখন আমার চোখের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে আমার মাথাটা টেনে নিয়ে কানে কানে বলেছিল– বলেছিল, মানে, একটা কথা বলেছিল, খুব বেশি হচ্ছে, পেটে ভীষণ ব্যথা।

এ তো খুবই সোজা কথা, খুব বেশি হচ্ছে, পেটে ভীষণ ব্যথা, অর্থাৎ পেটে খুব ভীষণ ব্যথা হচ্ছে, যদি বা কথাটা ভাবতেও যেন আমার বুকের মধ্যে কেমন গুরগুর করছিল। কথাটা আমি পরিমলকে বলেছিলাম, পরিমল হেসেছিল, বলেছিল, তুই সত্যি একটা রাম ক্যালানে।

পরিমলের মুখ একটু ওইরকম, ওই ধরনের কথা বলতে ভালবাসে আর ওর কাছে থেকেই কিনা কে জানে, খুকু–ওর প্রেমিকা, সে যে কী না বলতে পারে, তা একমাত্র ভগবাঈশ্ব-দুত্তোরি, তা একমাত্র খুকু নিজেই জানে। যাই হোক, পরিমল আমাকে নানারকম কাঁচা কাঁচা কথা বলেছিল, তারপরে হঠাৎ যেন পাঁজরায় ছুরি বিধিয়ে আমাকে চিত করে ফেলার মতো একটা কথা বলেছিল, যে কথা শোনবার পরে আমি আর নড়তে-চড়তে পারিনি। ও আমাকে বলেছিল, তা হলে চল, যে নার্সিংহোমে লিপির পেট খসানো (উহ্, ভাষাটা ইংরেজিতে বলল না কেন) হয়েছে, সেখানে তোকে নিয়ে যাচ্ছি। আমার কাছে ও সব মজাকি পাবি না। ওখানকার নার্সের সঙ্গে আমার খুব ভাব আছে, তার মুখ থেকে শুনে আসবি। মুখের কথায় যদি বিশ্বাস না করিস, নার্সিংহোমের খাতা দেখিয়ে দেব। যাতে কোন রুগি কী জন্য এসেছিল, সব লেখা থাকে। অবিশ্যি ডাক্তারকে ফাঁকি দিয়ে সে সব করতে হবে, ওটা হল ওদের বিজনেস সিক্রেট, নার্সকে কিছু মালকড়ি দিলেই

আমি আর শুনতে পারছিলাম না। কারণ আমার মাথা ঘুরছিল, গা বমি বমি করছিল, পরিমলের কাছ থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। গিয়েই সোজা বাথরুমে। মুখে ততক্ষণে বমি উঠে এসেছে, যদি বা সেগুলো কোনও অপাচ্য খাবার না, টক টক তেতো তেতো জল মতো, আর ফেনা ফেনা ভাব। অনেকখানি বেসিনের মধ্যে উগরে ফেলেছিলাম, আর মুখ না ধুয়েই হাঁটু মুড়ে বসে, কেঁদে ফেলেছিলাম। আমার সেই চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠলে নিজেরই মনে হয় পিছন থেকে গিয়ে গাদাম করে একটা শুট মারি, তবে, এটাও সত্যি, আমার অসম্ভব কান্না পেয়ে গিয়েছিল। পরে আমি পরিমলকে বলেছিলাম, আচ্ছা, ও তো কিছু উজ করতে পারত, মানে আজকাল তো অনেক কিছু বেরিয়েছে।

কথাটা শুনে পরিমল আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়েছিল। হাঁ করে তাকাবার কী ছিল। আমি বলতে চেয়েছিলাম, নার্সিংহোমে গিয়ে লোকজনের মাঝখানে ও সব কাটা-ছেঁড়ার কষ্ট থেকে, লিপি তো অন্য কোনও মেথড উজ করলেই পারত। আজকাল তো অনেক কিছুই বেরিয়েছে। পরিমল সেইরকম অবাক–শুধু অবাক না, যেন একটা সন্দেহও ওর চোখে ছিল, যাকে বলে সন্দিগ্ধ বিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, তুই কি লিপির বিষয়ে এ কথা বলছিস?

বলেছিলাম, হ্যাঁ আর কার বিষয়ে বলব।পরিমলের এত অবাক হওয়ার কী ছিল বুঝতে পারছিলাম না। ও যেন থমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, মানে? বলেছিলাম, মানে, আমি বলছি, লিপি যখন কিছু করেই ছিল, আগে থেকে সাবধান হলেই পারত, আজকাল তো অনেক কিছু বেরিয়েছে। তথাপি পরিমল আমার দিকে তেমনি করে তাকিয়ে ছিল, এমনভাবে আমার চোখের দিকে দেখছিল যেন আমার ভিতরের রক্ত হাড় পাঁজরা লিভার-টিভার সুদ্ধ সব দেখে নিচ্ছিল, বলেছিল, তুই কি শালা আমার সঙ্গে ইয়ার্কি করছিস না কি। নাকি সত্যি তুই ইয়ে ক্যালানে গাড়ল রাম ভগুড়ে।

আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম, রাম ভগুড়ে? কথাটা তার আগে কোনওদিন শুনিনি। পরিমল বলেছিল, তা ছাড়া তোকে আর কী বলব। তা না হলে তুই শালা একটা মস্ত ঘুঘু ছাড়া কিছু নোস। লিপির পেট খসানোর (ইংরেজিতে বলছিল না কেন) ব্যাপারটা তুই এরকমভাবে বলতে পারছিস।

কী যন্ত্রণা, এর থেকে আর ভালভাবে কী বলা যায়, আমার মাথায় সত্যি আসছিল না। আমার কষ্টটা আমি পরিমলকে বোঝাতে পারছিলাম না, কোনওদিন পারিওনি, বলতে পারিনি, কথাটা মনে হলে, সেই সময়ে আমার রাত্রে ঘুম হচ্ছিল না, কথাটা ভাবলেই কেমন করে উঠত, বেশি ভাবলে বমি আসত, কিন্তু যদি লিপি, আর সবাই যা করে–যা হয়তো ওর মাও করত, সেরকম কিছু করলে তো আর ওরকম হত না, কোনও কিছু জানাজানি হত না। পরিমল আমার দিকে ভুরু কুঁচকে, চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, তোর জানতে ইচ্ছা করে না লিপি কার সঙ্গে কারবার করে পেট বাঁধিয়েছে (ইংরেজিতে)?

আমি যেন জানতাম না, ওরকম একটা জিজ্ঞাসা আমার মধ্যে ছিল। ঠিক যেন অন্ধকার গর্তে সাপের মতো জিজ্ঞাসাটা ঝিম মেরে পড়েছিল, পরিমলের কথাটা শুনেই হঠাৎ জেগে উঠেছিল, কিন্তু সত্যি বলতে কী, সে-সাপটার কোনও অন্ধ রাগ বা বিষ ছিল না, যা ছিল, আমার মনে হয়, সেটা একটা কোমর ভাঙা ব্যথার মতো কিছু। কেন না, ব্যাপারটা যখন ঘটেছেই, লিপি যখন কনসিভ করেই ছিল, তখন কার সঙ্গে করেছে, সেটা জেনে আর কী লাভ হত। খুব হয়তো একটা অবাক নাম শুনতে হত, হয়তো আমার বাবার নামটাই শুনতাম–অবিশ্যি সেটা কথার কথা ভেবেছিলাম মাত্র, বাবার সম্পর্কে আমি সেরকম ভাবতেই পারি না বা লিপির সেই ভোদকা মুখো বাবার কথাও ভাবতে পারি না। নামটা জেনে এমনি আর কী লাভ হত, খুব অবাক হওয়া ছাড়া, কিংবা রাগ বা দুঃখ, হয়তো পরিমল নিজেই লিপিকে–সেটা ভাবতেও আমার পক্ষে কষ্ট হয়, বিশ্বাসও হয় না, আর তা হলেও আমার কিছু করার ছিল না, কেবল কষ্টটা বাড়ত। পৃথিবীর যার সঙ্গে প্রেম করেই–প্রেম ছাড়া আর কী বলব, একজন অবিবাহিতা মেয়ের কনসেপশন হলে, সেটাকে তো প্রেমই বলতে হবে, পরিমল হলে হয়তো বলত, যার সঙ্গে শুয়েই কথাটা আমার ভাবতে ভাল লাগে না, পৃথিবীর যার সঙ্গে প্রেম করেই লিপি কনসিভ করত আমার কাছে ব্যাপারটা একই, একইরকমের কষ্ট হত, একইভাবে মাথা ঘুরত, বমি বমি লাগত, ঘুম আসত না, আর–আর কী বলে, চোখে জল আসত এবং মনে হত, কেন আমার দ্বারা হল না। আহ্, সত্যি আমি যদি লিপিকে কনসিভ করাতে পারতাম–মানে লিপি যদি আমার সঙ্গে, প্রেম তো ছিলই, যে কাজটা যেটাকে ইয়ে বলে, লাভ-লাভ মেকিং যে কাজটা ও বিয়ের আগে আমার সঙ্গে করতে চায়নি, কেন না করতে নেই অথচ করেছিল। সেই কষ্টের মধ্যেও, মিথ্যা বলব না, একটা রাগ কেমন যেন আমার দাঁতে দাঁতে চেপে বসেছিল এবং আমি আবার ভেবেছিলাম, এক বার ঘরে তুলতে পারলে হয়, ছাড়া পাখি যত দিন যেখান থেকে পারছে দানা খেয়ে নিক, এক বার খাঁচায় তুলি, তারপরে– তবে সত্যি আমি কী-ই বা করতে পারতাম। মেয়েদের সঙ্গে এ সব বিষয় নিয়ে লড়ে কে কবে জিতেছে। এটা তো আর লড়াই না, দাবি আদায় করে নেবে বা দখল করে নেবে, বেশি চালাকি করবে, অন্য কারোর কাছ থেকে পেট করে নিয়ে আসবে, বাচ্চাটি প্রসব করে দিয়ে বলবে, তোমার সন্তানের কী সুন্দর চেহারা।

আমি নীরেন্দ্রচন্দ্র সোনা মুখ করে, চাঁদ মুখখানিতে হামজে হামজে চুমো খাব–অসম্ভব, ভাবা যায়, না না, এ সব নিয়ে লড়াই চলে না, ত্যাগ করা চলে। কিন্তু কাকে ত্যাগ। লিপিকে? সেটাও অসম্ভব। পরিমলের জিজ্ঞাসাটা শুনে আমার বুকের মধ্যে তীরের মতো বিধে গিয়েছিল, পরিমল হয়তো তা বুঝতে পারেনি। সংবাদটা জানবার পরে আমি অনেক ভেবেছিলাম, মনে মনে অনেক কিছু করেছিলাম, লিপিকে দাঁতে নখে আক্রমণ করেছিলাম, টুকরো টুকরো করে ছিঁড়েছিলাম, শক্ত পায়ে পাছায় লাথি মেরেছিলাম, কিন্তু আসলে আমি নিজেকেই ঘায়েল করেছিলাম, নিজেকেই, কারণ তারপরেও আমি লিপিকেই চেয়েছিলাম। আমি জানি না, তার মধ্যে আমার কোনও প্রতিশোধের যাকে বলে আকাঙ্ক্ষা, তাই ছিল কিনা বা সারা জীবন লিপির হাড় মাস কালি করব। কারণ, সেই ঘটনার পরে লিপির ওপর যেন নতুন করে আমার টান বেড়ে গিয়েছিল, মনে হয়েছিল, তবু–তথাপি, লিপি, আমি লিপিকেই চাই। আমি জানি না, এ ব্যাপারটাকে পণ্ডিতে আবার পারভারশন বলবে কি না, কিন্তু লিপি আমার কাছে, জীবনের সেই সব স্বপ্নের মতো, জগৎ সংসার সম্পর্কে যে সব স্বপ্ন আমি দেখি, যে সব বিশ্বাস আমার আছে। আমি পরিমলকে বলেছিলাম, কে লিপির সঙ্গে কী করেছে, তা আমার জানতে ইচ্ছে করে না।

পরিমল আমার দিকে অনেকক্ষণ চুপ করে তাকিয়েছিল, অনেকক্ষণ, তারপরে বলেছিল, শালা হয় তুই হাঁদা, না হয় বদমাইশ, আর তা না হয় তো, তুই শালা সত্যি প্রেমিক।

তা জানি না, পরিমল যা খুশি তা-ই বলতে পারে। কিন্তু আমার জানতে ইচ্ছা করেনি, বরং আমার খারাপ বা ভয় লাগছিল, পরিমল হয়তো আমাকে তা বলে দেবে। পরিমল কেন আমাকে খবরটা দিয়েছিল, কী ভেবে, আমি জানি না। আমি যেরকম খ–খচ্চর, মানে ছুঁচোর মতো পাজি, খুকুর ব্যাগের জন্ম নিয়ন্ত্রণের জিনিসটার কথা ওকে বলে দিয়েছিলাম, মনে মনে পরিষ্কার উদ্দেশ্য ছিল, যেন পরিমল রেগে যায়, সন্দেহ করে, খুকুকে ছেড়ে দেয়। পরিমল কি আমাকে সেইভাবে সংবাদটা দিতে চেয়েছিল। না, পরিমলকে আমি আমার মতো ছুঁচো ভাবতে পারি না, ও হয়তো আমার ভালর জন্যই, বিশেষ করে আমরা একই পার্টির লোক, আমার উপকারের জন্যই কথাটা বলেছিল, আমি যেন একটা খারাপ মেয়ের ব্যাপারে সাবধান হয়ে যাই। আমি ওকে বলেছিলাম, তা বলতে পারিস।

পরিমল তৎক্ষণাৎ জিজ্ঞেস করেছিল, কী বলতে পারি?

আমি বলেছিলাম, যা বললি।

পরিমল রেগে উঠে বলেছিল, আমি তো শালা অনেক কথা বলেছি। হাঁদা বদমাইশ প্রেমিক। নিজেকে তুই কোনটা মনে করিস।

আমি পরিমলের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলেছিলাম, তুই আমার ওপর রাগ করছিস?

পরিমল তেমনি ভাবেই বলেছিল, হ্যাঁ শালা, তোর ওপর আমার রাগ হচ্ছে। তুই শালা খচ্চরের বাদশা। তোকে আমি মোটেই বিশ্বাস করি না। তা হলে আর পরিমল আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করছিল কেন, আমাকে যখন ও বিশ্বাসই করতে পারছিল না, তখন আর আমাকে জিজ্ঞেস করে লাভ কী, যদি বা হাঁদা বদমাইশ প্রেমিক কোনওটাই না বলে, খচ্চরের বাদশা তো বলেছিল। তার মানে কী, খচ্চরের বাদশা। বোধ হয় বলতে চেয়েছিল, টপ, মানে টপ খচ্চর। তা হলে আর কী, হাঁদা বদমাইশ প্রেমিক, কোনওটাই না, একেবারে খচ্চরের বাদশা। তারপরে আমি পরিমলকে অনেক কিছু বোঝাতে চেয়েছিলাম, মানে রিয়্যাল কনসেপশন অব ম্যারেজ। গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতে, একজন বামপন্থী বিপ্লব প্রয়াসী-থার্ড ক্লাস বাংলার লোক এর থেকে আর ভাল বাংলা কী বলতে পারে, যা কনসেপশন অব ম্যারেজ হতে পারে, আমি তা-ই ওকে বোঝাতে চেয়েছিলাম, মার্কস এবং লেনিনের উদ্ধৃতি দিয়েছিলাম, ক্লারা জেটকিনের কথা বলেছিলাম, হয়তো তারপরে আনটি ডুরিং থেকেও কিছু বলতাম, তার আগেই পরিমল আমাকে এমন খেঁকিয়ে উঠেছিল, আমি মনে মনে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। ও আমাকে খেঁকিয়ে উঠেছিল দ্যাখ নীরে, প্যাঁদানি খেয়ে মরবি, তুমি শালা খুব বড় আঁতলেকচুয়াল হয়েছ। লিপি পেট খসিয়েছে, (ইংরেজিতে বললেই পারত) তার সঙ্গে পলেটিকসের কী আছে। ভড়কিবাজি হচ্ছে?

আশ্চর্য, এটাকে আবার পলেটিকস বলে নাকি, আর আমি ওর সঙ্গে কখনও ভড়কিবাজি করতে পারি। আমি আরও কিছু বলতে চেয়েছিলাম, পরিমল আমাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়েছিল, হয়তো বেশি কিছু বললে মারতই, কিন্তু আবার খুব অবাক লাগে, কেউ কিছু শুনতে চায় না, পড়াশোনাও করতে চায় না। খবরের কাগজ আর পার্টি বুলেটিন পড়েই সবাই মনে করে, সবকিছু বুঝে ফেলেছে। তাও সবাই পড়ে বলে আমার মনে হয় না এবং কেন কী করছে, কিছুই জানে না, যেন একটা কী বলে ওটাকে, একটা সম্মোহনের ঘোরে চলেছে। এ চলাটা কত দূর–মানুষ কতক্ষণ সম্মোহিত থাকতে পারে–মানে যাকে বলে ঘোরে। ভেঙে গেলেই তো খোয়ারির পালা শুরু।

যাই হোক, এ সব কথা এখন আমার ভেবে লাভ নেই। প্রায় বছর দুয়েক আগে লিপির এই সংবাদটা আমাকে পরিমল দিয়েছিল। আমি অবিশ্যি লিপিকে কোনওদিনই সে কথা বলিনি। আর সবথেকে খারাপ কথা যেটা, সেটা হল, পরিমল আমাকে তার নাম না বলে ছাড়েনি, লিপি যার সঙ্গে প্রেম–হ্যাঁ প্রেম করেই ব্যাপারটা ঘটিয়েছিল। সে হল, লিপির মায়েরই সেই সে। কথাটা যেন আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারি না, কেন না, সেটা কী করে সম্ভব, ওর মায়ের প্রেমিকের একটি লোক-দেখানো অলংকারের মতো সুন্দর যুবক প্রেমিক, তার সঙ্গে কী করে লিপির সেরকম ঘটতে পারে। তারপরেও কয়েকশো দিন লিপির কাছে গিয়েছি কিন্তু কোনওদিন জিজ্ঞেস করিনি। তবে সংবাদটা শোনবার পরে, প্রথম প্রথম কয়েক দিন আমি লিপির মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে যেতাম, কথা বলতে পারতাম না। লিপির ভুরু কুঁকড়ে যেত–মানে লতিয়ে উঠত, আমার চোখের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করত, ওরকম হাঁ করে কী দেখছ।

আমি চমকে উঠতাম, আর আমার নিজেরই তখন সেই আঁতলেকচুয়াল বক্তৃতাগুলো মনে হত, যেগুলো পরিমলকে আমি বলেছিলাম। দেখেছিলাম, ও সব কথার সঙ্গে, মন আর–আর কী–এই বুকের কথা বলছি আর কী, ঠিক মেলানো যায় না যেন। যুক্তি আর বুদ্ধি দিয়ে, যাকে বলে, মন কেমন করা, একটা কষ্ট, একটা কেমন যেন করে ওঠাটাকে দমিয়ে রাখা যায় না। আবেগ-টাবেগগুলো খুব খারাপ ব্যাপার, বি-বি-বিজ্ঞানসম্মত আর যুক্তিসম্মত চিন্তা ও সবের কোনও ধারে না, তথাপি লিপির দিকে চেয়ে আমি যেন কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যেতাম আর লিপির কথা শুনলেই চমকে ওর দিকে তাকিয়ে বলতাম, কই, কিছু না তো।

লিপি তবু আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকত, আমার চোখের দিকে, আর আমার কেমন যেন ভয় করত ও আমার মনের কথাটা বুঝি টের পেয়ে যাবে, কারণ ও আবার আমার চোখের দিকে তাকালে, আমার ভিতরের ভাবটা অনেক সময়েই বুঝে ফেলত। কিন্তু সেই বুঝে ফেলার ব্যাপারটা ছিল আমার দুষ্টামি। আমার চোখের দিকে চেয়ে সেই দুষ্টামিটা ও ধরে ফেলতে পারত। কিন্তু তখন আমার চোখে দুষ্টামি থাকত না, আর তা-ই লিপি আমার চোখের দিকে চেয়ে নিজেই কেমন যেন চিন্তিত হয়ে পড়ত, জিজ্ঞেস করত, তোমার কী হয়েছে বলে তো। তুমি আমার দিকে ওরকম হাঁদার মতো তাকিয়ে থাকলে আমার বিচ্ছিরি লাগে।

হাঁদা। ওরে আমার হাঁদা, হাঁদাটাকে ঘা মেরে তুই কাঁদা। চমৎকার! ঠাকুর, মার্জনা করবেন এ ধরনের একটা চুরির জন্য, তবে আধমরারা উঠে দাঁড়িয়েছে না গর্ত থেকে সব উঠে এসেছে, তা আপনিই এখন ভাল দেখছেন। ঘা মারবার অস্ত্রটা কার হাতে যে আপনি কল্পনা করেছিলেন, আমার বিভ্রান্ত আর অস্থির চোখে এই মুহূর্তে ঠিক চোখেই পড়ছে না।

আমি হাঁদার মতোই, তাড়াতাড়ি লিপির দিকে হাত বাড়িয়ে দিতাম–অবিশ্যি কাছে পিঠে কেউ না থাকলে বলতাম, সত্যি, কিছু না হলে কী বলব। তোমাকে দেখতে যেন কেমন বেশি ভাল লাগছে, মানে, তোমাকে আগের থেকে যেন সুন্দর দেখাচ্ছে। কথাটা আমি মিথ্যা বলতাম না। দু বছর আগে, সেই ঘটনার পরে, লিপিকে দেখতে যেন আরও সুন্দর হয়েছিল, যেন একটা ছবিকে চার পাশ থেকে ঘষেমেজে, যা কিছু বাড়তি রেখা বা রং সব তুলে দেওয়া হয়েছিল, তার সর্বাঙ্গে যা কিছু চড়া রঙের প্রলেপ ছিল সব তুলি বুলিয়ে হালকা করে দেওয়া হয়েছিল, যে কারণে ওকে অনেক অনেককী কথাটা, ওকে স্নিগ্ধ আর মার্জিত আর শান্ত আর একটা ক্লান্তি মেশানো চেহারা, অথচ রোজই যেন একটা নতুন আভা ওর ভিতর থেকে ফুটে উঠছিল। সেই সময়ে আর একটা ব্যাপার ঘটেছিল, আমার কাছে ও অনেক বেশি উদার হয়েছিল মানে আমার প্রেমের-হ্যাঁ প্রেমেরই বলতেই হবে, প্রেম না থাকলে আদর করা যায় কেমন করে, আমার আদরকে যেন ও নিজেই দু হাত বাড়িয়ে নিত, দু হাত বাড়িয়ে দিত, কেন আমি তা জানি না। তখন ও অনায়াসে পায়রার ঠোঁট দিয়ে খুঁটে দেওয়ার মতো, আমারই গালে চুমু খেত, ঠোঁটে ঠোঁট দিয়ে অনেকক্ষণ থাকত আর আমার ইচ্ছার আগেই, বুকের জামা খুলে, যেমন ছেলেকে টেনে নেয়, তেমনি করে টেনে নিত। আমার তখন মনে মনে একটা জিজ্ঞাসা জেগে উঠত, আমি মুখ আড়াল করে, ওকে লুকিয়ে লুকিয়ে ওর খোলা শরীরটা দেখতাম, কিন্তু কোনও তফাতই বুঝতে পারতাম না। আমার যে সেই রকমই সব ধারণা ছিল, মেয়েদের বাচ্চা হলে বা পুরুষের সঙ্গে মেলামেশা করলে, তাদের শরীরের পরিবর্তন হয়, আমি তার কিছুই লিপির শরীরে দেখতে পাইনি। সেই সময়ে লিপি আমার কাছে এত বেশি নরম হয়ে পড়েছিল, এক একদিন আমার বুকের মধ্যে থেকে ওর নিশ্বাস গভীর আর ঘন হয়ে উঠত চোখ একটু যেন লাল দেখাত, আর আমার দিকে এমনভাবে তাকাত যেন কী একটা কথা বলতে চাইছে, বলতে পারছে না। আমিই জিজ্ঞাসা করতাম, কী, লিপ কিছু বলছ। লিপি বলত, এখন না, পরে, যখন আমরা এখান থেকে পালিয়ে যাব।

কথাটা শুনে সেই মুহূর্তে আমি কেমন একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যেতাম, কেন না, শরীরে মনে যা-ই হোক, আমাদের সেটাই তো স্থির হয়েছিল, তথাপি কেন লিপি ওরকম বলছিল, আমি হঠাৎ বুঝতে পারতাম না। অবিশ্যি এখন–এখন আমি বুঝতে পারি, লিপি কী বলতে চেয়েছিল, বলতে চাইত মানে লিপিরই তখন-ইয়ে মানে–থানা। থানার কমপাউন্ডে জিপটা ঢুকছে।

তা ঢুকুক, আমার এ বিষয়ে কিছু করার নেই এখন আর। কিন্তু যে কারণে আমি কথাগুলো চিন্তা করছিলাম, তা হল, না– নাবালিকা বিষয়ে মানে লিপি নাবালিকা কি না। না, লিপি নাবালিকা না, কেন না, এখন আমার পরিষ্কার মনে পড়ছে, আমি একেবারে টাটকা গন্ধ পাচ্ছি, ওর নিশ্বাসে সাবালিকার গন্ধ ছিল, ওর শরীরেও।

নেমে এসো।

ইনস্পেক্টর বলল। আমি জিপ থেকে পিছন দিয়ে নেমে–কিন্তু লিপির বাবা মা, মানে যারা ওকে জন্ম দিয়েছে, তারা বলছে, বলছে মানে, পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছে, লিপি নাবালিকা, আমি নাবালিকা ফুসলেছি (জঘন্য), হরণ করেছি। কিন্তু তা তো হতে পারে না। পরিমল আমাকে অবিশ্যি ঠাট্টা করে বলত, তোর মাগির খবর কী।

এ ধরনের কথা নিয়ে আগে পরিমলের সঙ্গে রাগারাগি হয়ে যেত, কারণ লিপিকে ও ওরকম ভাষায়–অ–মানে অভিহিত করে, তা আমি একেবারেই পছন্দ করতাম না, মনে করতাম, আমার, প্রেমিকাকে আমার বন্ধু যাই হোক একটা রেসপেক্ট করে কথা বলবে, যে কারণে আমি রেগে বলেছিলাম, আমি যদি তোর খুকুকে এরকম করে বলি, তা হলে কি তোর ভাল লাগবে?

পরিমল হেসে বলত, বল না, আমি তাতে কিছুই মনে করব না। খুকু কি খুকি নাকি, ও-ও তো একটা মাগিই।

কুৎসিত, আমি মনে মনে বলেছিলাম এবং খুকুর নামটা শুনেই রাগটা আরও বেড়ে যেত, বলতাম, তোর খুকু যা খুশি তাই হতে পারে। লিপি–মানে, লিপি অনেক ছেলেমানুষ, ওকে ও সব বলা চলে না।

পরিমল হাসি আর ঠাট্টার সুরটা ছাড়ত না, বলত, হ্যাঁ, কেবল ওর মায়ের থেকেও বড়।

এ আবার কেমন কথা, মায়ের থেকেও বড়। মেয়ে আবার মায়ের থেকে বড় হয় কেমন করে। কিন্তু পরিমলকে আমার আর ও সব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হত না।

এখন কথাটা আমার এই জন্য আরও বিশেষ করে মনে হল যে, লিপি নাবালিকা না। লিপি গত আট মাস আগে বাইশ বছরে পড়েছে। তা ছাড়া, আমি ওর শরীরের ব্যাপার যা জানি, দেখা এবং শোঁকায়, লিপি কখনও নাবালিকা হতে পারে না। অবিশ্যি নার্সিং হোমে যাওয়াটা কিছু না, লিপির থেকে অনেক ছোট ডজন ডজন মেয়ে তা যাচ্ছে। সেই জন্যই লিপির মায়ের মুখ আমার মনে পড়ছে, সেই ভয়ংকর মুখ, অথচ ফোম ব্রা আঁটা সবসময়ে সেজে থাকা মহিলাটি!না, ওকে আমি মহিলা বলতে চাইনা, একটা মেয়েমানুষ–মেয়েমানুষটি বরাবরই বলে এসেছে, তার মেয়েটি এখনও ছেলেমানুষ। সেই ছেলেমানুষ বলবার পিছনে না হয় একটা মতলব ছিল, ছেলেমেয়েরা যত ছেলেমানুষ থাকবে, মা নিজেও তেমনি খুকিটি থাকতে পারবে, তাই ছেলেমেয়েদের আর বয়স হতে দিতে চায় না, কিন্তু এত বড় মিথ্যা কথাটা কী করে বলল। আমি এও জানি, পুলিশের কাছে এই পয়েন্টব্ল্যাংক মিথ্যা কথাটা, সেই মেয়েমানুষটিই বলেছে। সেই মেয়েমানুষটির অসাধ্য কাজ কিছুই নেই, এ কথা আমার বরাবরই মনে হয়েছে, এবং হুমদো মুখো, চাপ চাপ মাংসলো ব্যাটাছেলেটি আসলে কিছুই না, মেয়েমানুষটি যা শেখাবে, তা-ই বলবেন, তা-ই করবেন। মেয়েমানুষটি আমাকে শাস্তি দেবার জন্য মিথ্যা কথা বলেছে, স্বামীকে দিয়েও তাই বলিয়েছে। এখন আমার স্পষ্টই মনে পড়ছে, বছর পাঁচেক আগে এক বছরের জন্য লিপি ইস্কুল ফাইনাল পাস করে কলেজে পড়তে গিয়েছিল। মোটের ওপর এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, নাবালিকা হরণ, অ্যাবডাকশন বা সেডিউস যে অপরাধে অপরাধী করা হোক, সে অপরাধ আমি করিনি, তারপরেও যদি শাস্তি পেতে হয়, বুঝতে হবে, বিনা অপরাধেই সে শান্তি আমাকে পেতে হবে। এ বিষয়ে আমি আর ভাবতে চাই না, এখন একমাত্র চিন্তা, আবার আমার বুকের মধ্যে কী রকম করতে আরম্ভ করছে, লিপি কোথায়। কিন্তু তার আগে কয়েক দিন ধরে লিপির সঙ্গে আমার যে সব কথাবার্তা হয়েছে, সেগুলো আমি ঠিক মতো মনে করতে চাই। বুঝতে চাই, ব্যাপারটা কী ঘটতে পারে যে কারণে বাড়ি গিয়েছিলাম, একটু চুপচাপ বসে–

এদিকে এসো।

ইনস্পেক্টরের কথা শুনে ঘুরে দাঁড়াবার আগেই আমি শ্লোগান শুনতে পেলাম–রাজনৈতিক শ্লোগান, সেই সঙ্গে পুলিশের জুলুমবাজি, চলবে না চলবে না, জোর করে আটক করা, চলবে না চলবে না শুনে আমি আবার থানার উঠোনের দরজার দিকে তাকাতে গেলাম। ইনস্পেক্টর তখন আবার আমাকে বলল, এদিকে এদিকে।

ভেবেছিলাম, জোর করে আটকে রাখার প্রতিবাদে বা কারোকে থানা থেকে নিয়ে যাবার জন্য বোধ হয় থানা ঘেরাও করতে এসেছে, কিন্তু বাইরে কারোকেই দেখতে পেলাম না। চিৎকারের শব্দটা যেন কোনও ঘরের মধ্য থেকে আসছে। থানাকে বেশ ব্যস্ত মনে হচ্ছে। কয়েকটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, জিপ আর ভ্যান। আমাকে একটা ঘরের মধ্যে নিয়ে গেল, যেটাকে খানিকটা অফিস ঘর বলেই মনে হচ্ছে, টেবিল চেয়ার এবং কাঠের আলমারি দেখে। দুজন য়ুনিফর্ম পরা লোক ধ্যাবড়া ধ্যাবড়া লম্বা খাতায় কী যেন লিখে চলেছে। বাঁ দিকের একটা দরজা দিয়ে দু-তিনজন সেপাইকে আসতে যেতে দেখা যাচ্ছে। ঘরে ঢোকার মুখেই রাইফেল হাতে নিয়ে একজন সেপাইকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। বাঁ দিকের দরজার কাছেও দেখলাম, একজন রাইফেলধারী সেপাই। সকলের মুখই বেশ শক্ত, এবং মনে হয়, বাইরে থেকে তেমন বোঝা না গেলেও সবাই ভিতরে ভিতরে বেশ উত্তেজিত। এ ঘরটার মধ্যে ঢুকে শ্লোগান যেন আরও জোরে শোনা গেল, মনে হল পাশের ঘরেই যেন সবাই রয়েছে। হঠাৎ চমকে উঠে আমি শুনলাম, শ্লোগানের মধ্যেই, শিস্ শোনা গেল। সেই রকম কান ফাটানো। ইনস্পেক্টর যেন আমার কথা ভুলেই গেল, সে ছুটে বাঁ দিকে দরজার কাছে এগিয়ে গেল, আবার হঠাৎ থেমে আমার দিকে ফিরে ডাকল, এদিকে এসো।

জীবনে এই প্রথম থানায় এলাম, থানার মধ্যে, চিরদিন বাইরের থেকেই দেখেছি। আজ প্রথম দিন থানার মধ্যে এলাম, একেবারে সোজা কাস্টডিতে যাবার জন্য, তাও নারীহরণনা, নারীহরণ হলে তো তবু একটা কথা ছিল, নাবালিকা হরণের দায়ে। ইনস্পেক্টরের সঙ্গে গেলাম। দরজার বাইরে, একটা সরু লম্বা এবং ঢাকা বারান্দা সেখানে দেখলাম, অনেকে বসে বা দাঁড়িয়ে আছে, আর তারাই শ্লোগান দিচ্ছে। বারান্দাটার কোনও দিকই খোলা না, এক দিকে দেওয়াল আর এক দিকে পর পর ঘর। বারান্দার একটা জায়গা জুড়ে একটা দলই রয়েছে, খানিকটা জায়গা জুড়ে তারাই শ্লোগান দিচ্ছে এবং আরও খানিকটা এগিয়ে যেতেই লোহার গরাদ বন্ধ একটা ঘর, তার ভিতরে টিমটিমে লালচে আলোয় কেবল কতকগুলো জোড়া জোড়া চোখ আর ঝকঝকে দাঁত জ্বলজ্বল করছে, সন্ধেবেলায় যেমন সেই রকে দেখেছিলাম। ওদের চোখ আর দাঁতগুলো সব আমার দিকেই যেন এবং যারা বাইরে শ্লোগান দিচ্ছিল, তারাও আমার দিকে তাকিয়েছিল, এক মুহূর্তের জন্য আমি যেন প্রায় ভুলেই গেলাম, কোথায় এসেছি, কোনও অন্ধকার গভীর জঙ্গলে কিনা, যেখানে নেকড়ে আর চিতারা চারদিকে জড়ো হয়ে আছে। গরাদ বন্ধ ঘরটা থেকে একটা দুর্গন্ধ আসছে, বদ নিশ্বাস, ঘাম আর প্রস্রাবের গন্ধের সঙ্গে হালকা ফিনাইল, ব্লিচিং পাউডার মেশানো এবং তৎক্ষণাৎ আমার মাথায় বিধে গেল, এটা কাস্টডি–থানার কাস্টডি মানে হাজত, আমাকে এখানে থাকতে হবে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে একটু বোধ হয় বসবার জায়গাও খালি নেই, কী করে ওখানে থাকব। এই মুহূর্তেই, শ্লোগান ছাপিয়ে কার গলায় যেন গর্জনের মতো চিৎকার শোনা গেল, যেন কাদের কে হুকুম করছে। গর্জনের মধ্য থেকে যেটুকু কথা আমি বুঝতে পারলাম বা শুনতে পেলাম, কে যেন আমাকে ধাক্কা দিয়ে ছুটে গেল, আমি দেওয়ালে ঘা খেলাম। তারপরেই হঠাৎ শ্লোগান বন্ধ হয়ে গেল, দেখলাম কয়েকজন সেপাই হাতে লাঠি নিয়ে শ্লোগান দেওয়া দলটার সামনে দাঁড়িয়ে, তাদের মাঝখানে একজন মুনিম-পরা লম্বা-চওড়া লোক দাঁড়িয়ে, তার কালো মুখটা রাগে শক্ত, চোখ দুটো ধকধক করে জ্বলছে। যারা শ্লোগান দিচ্ছিল, তাদের মুখগুলোও শক্ত, চোখ জ্বলজ্বলে, তারা সেই লোকটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে, এবং লোকটা চিবিয়ে চিবিয়ে আর যেন দম টেনে টেনে বলল, দিস ইজ নট ইয়োর পার্টি অফিস অর কলেজ অ্যান্ড য়ুনিভার্সিটিজ অর এনি কাইন্ড অব ডেন, দিস ইজ অফিস, পুলিশ স্টেশন। এখানে আমাদের কাজ করতে হয়। শ্লোগান দিতে হয়, তার জন্য অন্য জায়গা আছে। দিস ইজ থার্ড টাইম, থার্ড ওয়ার্নিং, ইউ উইল কিপ কোয়ায়েট অ্যান্ড লেট আস ওয়ার্ক, আদারওয়াইজ

কথাটা লোকটা, লম্বা-চওড়া য়ুনিম-পরা ঠ্যাং ফাঁক করে দাঁড়ানো লোকটা, শেষ করল না, এবং এই আমি প্রথম টের পেলাম, ইনস্পেক্টর আমার হাতটা জোরে চেপে ধরে আছে, যে ইনস্পেক্টর আমাকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে এসেছে। কথাটা থামিয়ে, লম্বা-চওড়া লোকটা হয়তো আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, ঠিক সে সময়েই আবার শিস বেজে উঠল, আর সেটা লোহার গরাদ দেওয়া বন্ধ ঘরটা থেকেই। লম্বা-চওড়া লোকটা তৎক্ষণাৎ লাফ দিয়ে বন্ধ গরাদের সামনে দাঁড়াল, চিৎকার করল, চাবি।

পাশেই একজন আধবুড়ো সেপাই দাঁড়িয়েছিল, সে সঙ্গে সঙ্গে গরাদের আংটায় লাগানো তালা খুলে দিল, আর সেই লোকটা লোহার গরাদের দরজা দু হাতে জোরে ঠেলে দিয়ে ভিতরে এক পা বাড়িয়ে অনেকটা চাপা গর্জনের স্বরে বলল, কে?

কোনও সাড়া-শব্দ নেই। এতটা চুপচাপ, মানে যাকে বলে স্তব্ধতা, আমি যেন ঠিক সহ্য করতে পারছিলাম না। গোলমাল চিৎকারের থেকে এটা যেন আরও ভয়ের, ভয়ংকর, আমার শিরদাঁড়ার কাছে একটু একটু কেঁপে যাচ্ছে। ঘরের ছায়া, ছায়া মূর্তিগুলো সবাই য়ুনিফর্মপরা লোকটার দিকে তাকিয়ে এবং এখন মনে হচ্ছে, কেউ কেউ যেন দেওয়ালে ঢলে পড়ে ঘুমিয়ে রয়েছে বা কালো কম্বল পাতা মেঝেতেই আধশোয়া হয়ে রয়েছে। হঠাৎ য়ুনিফর্মপরা লোকটা নিচু হয়ে ছোঁ মেরে একজনকে তুলে নিল, আর আমার মনে হল, আমি লোকটার দাঁত কড়মড়ানি শুনতে পেলাম। দেখলাম, একজনের চুলের মুঠি ধরে সে তুলেছে, আর লম্বা শক্ত হাত দিয়ে–সেই যে কী বলে, বিরাশি সিক্কা ওজনের একটি থাপ্পড় কষিয়ে দিল। আমিও সঙ্গে সঙ্গে গালটা ফিরিয়ে নিতে গিয়ে দেওয়ালে মুখ ঠুকে ফেললাম, বাবার থাপ্পড়টা বোধ হয় ভুলতে পারিনি এবং শুনতে পেলাম, লোকটা বলছে, এটা মাগিবাড়ি না জুয়ার আড্ডা, আঁ? না বাইরের রাজত্ব।

যাকে মারা হল এবং বলা হল, তার পোশাক-চেহারার মধ্যে একটা বৈশিষ্ট্য আছে, যেটা রাস্তায় দেখা যায়, চুলের ভঙ্গি প্যান্ট জামা, কিন্তু ছেলেটাকে ভদ্রলোকের ছেলে বলেই মনে হচ্ছে। সে বলল, আমি না স্যার।

কে?

আমি দেখিনি, মাইরি বলছি স্যার।

ইউনিফর্মপরা লোকটা আবার মারতে লাগল, যাকে বলে শেয়ালকে সিংহের মতো, আর দম চাপা চাপা অস্পষ্ট গর্জনের মধ্যে শোনা গেল, তা আমি…একজনকে…পেতেই গুণ্ডামি এখানে…চোর লোচ্চা…।

তারপরে বোধ হয় মুনিফর্মপরা লোকটা হাঁপিয়ে উঠল, আর ছেলেটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল বাকিদের ঘাড়ের ওপর। কিন্তু কেউ একটা কথা বলল না। ছেলেটা নিশ্চয়ই তার কোনও বন্ধুকে বাঁচাবার জন্য স্বীকার করতে পারল না, এভাবে মার খেল, সবাই তা দেখল, অথচ কেউ কবুল করতে পারল না, এটা আমি যেন ঠিক মেনে নিতে পারলাম না। এটা ঠিকই, দল বেঁধে কোনও কাজ করতে গেলে একজনের দোষে আর একজনকে শাস্তি পেতে হয়, কিন্তু শিস দেওয়া কাজটা নিশ্চয়ই দল বেঁধে কাজ করার মতো সেরকম কোনও মহৎ কিছু না। এই চিন্তার মধ্যেই, আমার অন্য কথাটাই আবার বিশেষভাবে মনে এসে গেল, এসে গিয়েছিলই, হঠাৎ এ সব তুলকালাম ব্যাপার দেখে থতিয়ে গিয়েছিলাম। কাস্টডি মানে হাজত–আমাকে কি এই হাজতে থাকতে হবে। আমি ভাবতেই পারছি না, তাই আমার হাত ধরে রাখা ইনস্পেক্টরকে বললাম, আমি একটা কথা বলতে চাই।

ইনস্পেক্টর আমার দিকে তাকাল, কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করল না। আমি বুঝিয়ে বলবার মতো করে বললাম, দেখুন, আমার পক্ষে, মানে–আমি এখানে থাকতে পারব না।

ইনস্পেক্টর আমার হাত ধরেছিল। হাতটা ছেড়ে দিয়ে এবার ঘাড়ে ধরল, আর ঠেলে দিয়ে বলল, চল।

আমি যা বললাম, এটা তার কোনও জবাব হতে পারে না, কিন্তু লোকটার মধ্যে যেন একটা কী রকম পরিবর্তন এসে গিয়েছে মনে হচ্ছে। সেটা কি এই বাড়িটার জন্য মানে, এ বাড়িটার মধ্যে ঢোকবার জন্য নাকি, চোখের সামনে যা ঘটল, সেই সব দেখে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। লোকটা রীতিমতো ঘাড়ে ধরে খানিকটা ঠেলে আমাকে একটা ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, চুপ করে দাঁড়াও।

কতক্ষণ ধরেই তো দাঁড়িয়ে আছি, কিন্তু এখন আমার সঙ্গে এরকম আচরণের কারণ কী। আমি তো আর নতুন করে কোনও অপরাধ করিনি। কোনও অপরাধ-ই আমি করিনি, একমাত্র পৃথিবীতে জন্মানো ছাড়া। হ্যাঁ, এ কথাটাই এখন আমার মনে হচ্ছে, আমার এই অস্তিত্বটাকে নিয়ে কী করা উচিত, এই মুহূর্তে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, আমাকে নিয়ে কী করা হবে, কী ঘটতে যাচ্ছে, কিছুই জানি না। এরকম ক্ষেত্রে আমি আমার এই অস্তিত্বটাকে তো আর ফাঁকি দিতে পারছি না। এই অস্তিত্বটা, মানে আমি–আমিই নিশ্চিত, আমার বাকি সবই দেখছি অনিশ্চিত, বিভ্রান্তিকর একটা অস্থিরতার মধ্যে যাকে বলে দিগবিদিক ঠিক নেই।

আমার বসতে ইচ্ছা করছে, দাঁড়িয়ে থাকতে সত্যি কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু বসবার হুকুম নেই, লোকটা ইনস্পেক্টর তো আমাকে তাই বলল, চুপ করে দাঁড়াও। চুপ করে থাকব না তো কী, এখানে আর আমি কার সঙ্গে কথা বলব। আমাকে যদি বাইরের বন্ধ বারান্দা আর গরাদ বন্ধ ঘরের ছেলেগুলোর সঙ্গে কথা বলতে দিত তোনা না, সেটাও বোধ হয় খুব সুবিধার হত না, কারণ চেনা শোনা কেউ থাকলে বা চিনতে পারলে ওরা হয়তো নেকড়ের মতোই আমাকে ঘিরে ধরত। তার দরকার নেই, চুপচাপই ভাল, চুপচাপ করে স্থিরভাবে লিপির সমস্ত ব্যাপারটা আমায় ভেবে দেখতে হবে। কিন্তু তার আগে আমি একটু বসতে চাই। আজ সকাল থেকে কতটুকু সময়, কবার আমি বসেছি, হিসেব করলে দেখা যাবে, ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে মানে পায়খানায় প্রায় দশ মিনিট, বেলা নটায় খেতে বসার জন্য মিনিট ছয়েক, পরিমলদের বাড়িতে মিনিট আটেক, সেখান থেকে অফিসে গিয়ে ছুটি নিয়ে আসতে প্রায় আধ ঘণ্টা তারপরে আর বসা হয়নি। অফিস থেকে বাসে করে দাঁড়িয়েই এসেছিলাম, তারপরে তো পৌনে একটা থেকে সেই যে দাঁড়িয়েছিলাম তারপরে আর এক সেকেন্ডের জন্যও বসা হয়নি।

এ ঘরটা তো বেশ ভালই, টেবিল চেয়ারগুলো ভাল, ঘরটাও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, এবং এমন নয় যে, সব চেয়ারগুলোতে লোক বসে আছে, বরং সব চেয়ারগুলোই খালি। ইনস্পেক্টর দরজার দিকে বাইরে তাকিয়ে দেখছে। আমার বসতে ইচ্ছা করছে, একটু জল খেতে ইচ্ছা করছে, আর এক বার ল্যাভেটরিতে যেতে ইচ্ছা করছে। আমি বসবার কথাটা বলবার জন্য ইনস্পেক্টরের দিকে ফিরতে গেলাম সে সময়েই লম্বা-চওড়া য়ুনিফর্মপরা লোকটা ঢুকল। ঢুকে টেবিলের কাছাকাছি যেতে গিয়ে আমার দিকে চোখ পড়ল। ইনস্পেক্টরের দিকে লাল চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, এ কে?

ইনস্পেক্টর এগিয়ে এল, বলল, এ স্যার সেই নীরেন চাকলাদার

আমি তাড়াতাড়ি শুধরে দিলাম, হালদার।

স্যার–মানে লম্বা-চওড়া লোকটি আমার দিকে হাত তুলে অধৈর্যভাবে বলে উঠল, আচ্ছা, সেটা পরে দেখা যাবে, ঘটনাটা শুনি।

ইনস্পেক্টর বলল, সেই মিসেস অ্যান্ড মিস্টার ঘোষাল এসে কমপ্লেন করে গেছেন, ডায়রিও করেছেন, তাদের মেয়ে হিপিকে (বলুক গিয়ে বুন্ধু!) নিয়ে এ-ই পালিয়েছে।

আমার বলতে ইচ্ছা করল, পালাইনি মোটেই, কিন্তু স্যার-এর দিকে তাকিয়ে সে কথা আমার বলতে ইচ্ছা করল না। স্যার আমার আপাদমস্তক দেখল, বলল, হি লুকস ইনটেলিজেন্ট অ্যান্ড সোবার।

আমি লোকটার কথায় কৃতজ্ঞতা বোধ করলাম। যাই হোক, তবু একজন আমাকে এইটুকুও বলেছে। আমার একটু হাসা উচিত কিনা, বুঝতে পারলাম না। না হাসাটাই বোধ হয় ভাল, লোকটা যেভাবে গর্জন করছিল আর মারছিল, এদের মেজাজ ঠিক বোঝা যায় না।

ইনস্পেক্টরের গোঁফ ছড়াল, মানে হাসি, চোখের কোণ দিয়ে আমাকে এক বার দেখল, তারপরে স্যারের কাছাকাছি হতে হতে বলল, সেটা ঠিক কথাই স্যার, হি ইজ টু ইনটেলিজেন্ট অ্যান্ড সোবার, সব দিক থেকেই। আমি নানানভাবে জিজ্ঞেস করেও একটি সত্যি কথা এর কাছ থেকে আদায় করতে পারিনি।

স্যার একবার আমার দিকে তাকাল, যেন দেখে নিল, মেপে নিল, আমার কাছ থেকে সে কথা আদায় করতে পারবে কি না। আমার দিকে চোখ রেখেই জিজ্ঞেস করল, একে পেলেন কোথায়?

দ্যাটজ লাক স্যার।ইনস্পেক্টর বলল, যে কোনও কারণেই হোক এ এক বার বাড়িতে ঢুকেছিল, বোধ হয় কোনও জিনিসপত্র ফেলে গেছল, নিয়ে যাবার জন্য এসেছিল। সে সময়েই আমার কাছে খবর এসে যায়। আমিও সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যাই।

গুড। স্যার ঘাড় নাড়তে নাড়তে বলল, এর তো আবার একটা পলিটিকাল পার্টির সঙ্গে অ্যাফিলিয়েশন আছে।

ইনস্পেক্টর বলল, সে তত আপনি জানেন স্যার।

সেদিক থেকে কোনওরকম

একেবারেই না।

হুম!

স্যার আমার দিকে তাকাল এবং কয়েক সেকেন্ড তাকিয়েই রইল। ইনস্পেক্টরকে এখন আমার সত্যি বলদের মতো মনে হচ্ছে। তার থেকেও খারাপ, খানার পাঁকে খুশিতে গা ভোবানো শুয়োরের মতো যেমন খুশি গুঙিয়েই যাচ্ছে। তবে আমার আর বলার কিছু নেই, এই আপন খুশিমতো গোঙানো আমার পক্ষে থামানো সম্ভব না। সে আবার বলল, আমি সবরকম চেষ্টাই করেছি স্যার, মিসেস অ্যান্ড মিস্টার ঘোষাল যা যা বলেছিলেন, সবই, মেয়েটিকে ফিরে পেলে আর কোনও গোলমালই ঘটবে না, কিন্তু!

বলতে চাইছে না? স্যার আমার দিকে তাকাল। কালো মুখ আর রক্তবর্ণ চক্ষু সবই যেন একটা অন্যরকম ভাব ধারণ করছে, এ সব ভাবভঙ্গি আমার মোটেই ভাল লাগছে না, যেন বিশেষ একটা কিছু করবার আগের মুহূর্তে স্যার-এর চোয়াল নড়ছে, মানে দাঁতে দাঁত পিষছে। লোকটা কি নিখিল বা বাবা হয়ে উঠতে যাচ্ছে নাকি। আমি আর এখন কিছুই অসম্ভব মনে করছি না। ইনস্পেক্টর আবার বলল, আবার এ কথাও বলছে, সেরকম বুঝলে নাকি মেয়েকে ডাক্তার দিয়ে দেখিয়ে নিত, সত্যি নাবালিকা কি না। এর বাবা নিজেই একে মারধোর করেছে। মোটের ওপর বেশ বোঝা যাচ্ছে…।

স্যার আমার দিকে তেমনি তাকিয়ে আছে। ইনস্পেক্টর কথা শেষ করল না। স্যার একটা গোঙাননা মতো শব্দ করল, কিন্তু মেয়েটা সত্যি আন্ডার এজেড কি না, এ বিষয়ে শিওর হওয়া গেছে?

আমি যাকে বলে, একেবারে থ হয়ে গেলাম। স্যার যে এরকম একটা কথা বলবে, আমি ভাবতেই পারিনি। আমি সত্যি কিছুই বুঝতে পারছি না, আমার ভাবনা মতো একটা লোক বা একটা ঘটনাও মিলছে না।

ইনস্পেক্টর বলল, স্যার, মেয়ের বাবা মা নিজেরা এসে বলছেন—

এনি এভিডেন্স? স্যার জিজ্ঞেস করলেন।

চমৎকার, চমৎকার! এ ছাড়া আমার আর কিছু মনে আসছে না। বোধ হয় সারাদিনের মধ্যে এই প্রথম, বুদ্ধিমানের মতো, যাকে বলে যুক্তিপূর্ণ কথা শুনলাম। কেবল বলদ বা শুয়োরের মতো যেমন খুশি ডাকা বা গোঙানো না। ইনস্পেক্টর বলে উঠল, দে মাস্ট প্রডিউস দি এভিডেন্স, ইটজ দেয়ার রেসপনসিবিলিটি।

গাড়ল গাধা বলদ শুয়োর শুয়োরের বাচ্চা–এ ছাড়া এ লোকটাকে আমার আর কিছু বলতে ইচ্ছা করছে না, যদি বা সত্যি খারাপ গালাগাল দিতে আমি মোটেই অভ্যস্ত না, কিন্তু কী বলতে চায় লোকটা, বাবা মা হলে কি তারা ছেলেমেয়ের জন্মের সময়টাও বদলে দিতে পারে। লিপির মা কি ইনস্পেক্টরকে–যাক গিয়ে, আমি এখন ও সব কথা ভাবতে চাই না, মনে হচ্ছে, অবস্থার উন্নতি হতে যাচ্ছে। স্যার আমার দিকে তাকাল, শব্দ করল, হুম। তা মিটিয়ে নিলেই তো হয়।

বলতে বলতে ইনস্পেক্টরের দিকে চোখ ফেরাল। কথাটা আমাকেই বলল কি না, ঠিক যেন বুঝতে পারলাম না, তাই এক বার ইনস্পেক্টরের দিকে তাকালাম, আবার স্যারের দিকে। দেখলাম স্যার আমার দিকেই চেয়ে। বলল, য়ু আর এ লারনেড ম্যান অ্যান্ড এ পলেটিকাল বিইং–আই মিন এ লেফটিস্ট, আপনার (অসম্ভব অসম্ভব, অপূর্ব! অবস্থার উন্নতি নিশ্চয়ই হতে যাচ্ছে!) একটা রেপুটেশন আছে, ব্যাপারটা মিটিয়ে নিলেই তো ভাল হয়। আমাদের অবস্থা তো দেখছেনই, এ সব কেস নিয়ে কাজ করবার সময় আমাদের নেই।

আমি কথা বলবার জন্য প্রায় অস্থির হয়ে উঠলাম, একমাত্র এই লোকটির সঙ্গেই কথা বলা যায়, তাই তার কথা শেষ হবার আগেই আমি বলে উঠলাম, কিন্তু স্যার (স্যার! বলতে পারলাম। এটা আবার কোনওরকম অধঃপতন নয় তো, আপনি বিশ্বাস করুন, মিটিয়ে নেবার মতো কিছু ঘটেনি।

স্যার-এর লাল চোখ দুটোর দৃষ্টি যেন আরও তীক্ষ্ণ হল, ভুরু কোঁচকাল, বলল, তার মানে?

বলে ইনস্পেক্টরের দিকে তাকাল। আমার আগেই ইনস্পেক্টর বলে উঠল, ও কথা স্যার আমি আগেই বলেছি, আমি তো মিটিয়ে নেবার কথাই বলছিলাম।

স্যার আবার আমার দিকে তাকাল, লাল চোখের ভাবটা ঠিক বুঝতে পারছি না। বলল, বেশ তো, মেয়েটিকে নিয়ে আসুন, ইফ সি ইজ নট আন্ডার এজেড, আমিই আপনার পক্ষে থাকব। দেন য়ু মে গো এনিহোয়ার য়ু লাইক উইথ দ্য গার্ল।

অবস্থার উন্নতি হতে হতে কোথায় যেন একটা বাধা আসছে। আমি বললাম, কিন্তু দেখুন, আমি কিছুতেই এটা বিশ্বাস করাতে পারছি না, আমি মেয়েটিকে নিয়ে কোথাও যাইনি।

ইনস্পেক্টর বলে উঠল, কিন্তু মেয়েটির নিজের হাতের লেখা চিঠিটা আপনি দেখেছেন স্যার।

আমি তাড়াতাড়ি কথা বলতে গেলাম, তার আগেই স্যার গর্জন করে উঠল, শাট আপ। লজ্জিত হওয়া উচিত, যারা দেশে বিপ্লব করতে যাচ্ছে, তারা একটা সামান্য সত্যি কথা বলতে পারে না।

কিন্তু

আই উইল সিমপলি চেঞ্জ য়ুর ফেস টু এ কান্ট অব য়ুর দ্যাট দ্যাট—

হিপি স্যার। ইনস্পেক্টর তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আর আমার মনে হল, আমার কানে বব-বজ্রপাত হয়েছে। অবস্থার এখন যাকে বলে, চরম অবনতিই ঘটতে যাচ্ছে। ইনস্পেক্টরটা তো লিপিকে হিপি বলেই যাচ্ছে, ওটা এখন সংশোধনের উর্ধ্বে চলে গিয়েছে, কিন্তু স্যার যা বলল, মানে, আমি যা শুনছি, লোকটা আমার মুখটা একটা স্ত্রী জননেতোও লিপির, ওহ, অসম্ভব, আমার হঠাৎ সেই দাঁড়কাকের কথা মনে হল, দিগা যা বলেছিল, দাঁড়কাকে খাবলে খাবে। এখন কি সেই রকম কিছু ঘটতে যাচ্ছে নাকি। মিলছে না, কিছু মিলছেনা, এক মিনিট আগে পরে বিরাট ফারাক। দেখলাম, স্যার আমার দিকে এগিয়ে আসছে আর সেই মুহূর্তেই টেলিফোন বেজে উঠল, স্যার ঘুরে গেল, রিসিভার কানে তুলল, থানার নাম বলল, তারপরে অফিসার ইনচার্জ, হ্যাঁ। কোন নিউজ পেপার বললেন…ও..নজন..না, এখনও সেটা ডিটেকটেড হয়নি…এগারো…আনসোশ্যাল এলিমেন্টস-হ্যাঁ, আর একটা খবর লিখে নিতে পারেন, (আমার দিকে এক বার তাকাল) নীরেন..নীরেন হালদার, একটি লেফট পার্টির লোক, নাবালিকা হরণের দায়ে…হা হা হা…ইয়েস অ্যারেস্টেড-ও কে!…

স্যার রিসিভারটা রাখল, আমার বুকের মধ্যে ভয়ংকর ধকধক করছে, তার মানে খবরের কাগজে ছাপা হবে, আমি–আমি কী করব, লোকটার ঘাড়ের ওপরে পড়ে, ঘাড়ে কামড়ে ধরব, না কী করব। আমি বলে উঠলাম, আপনি, মানে দেখুন, খবরের কাগজে এরকম একটা…

স্যার আবার রিসিভার তুলে ডায়াল করল, কালো মুখে হাসি, দাঁতগুলো সত্যি সাদা আর ধারালো, যদি বা দাঁড়কাকের দাঁত আছে বলে শুনিনি বা দেখিনি, শুনতে পেলাম, হ্যাঁ…কে মিস্টার চক্রবর্তী নাকি। আমার তো হাউস ফুল…সে আর শুনে কী করবেন…হ্যাঁ হাঁ…আচ্ছা, অন্তত একটাকে পাঠাচ্ছি, দিন দুয়েক…আচ্ছা, ঠিক আছে।

স্যার রিসিভার নামিয়ে রাখল, ইনস্পেক্টরকে কিছু বলবার জন্য তার দিকে তাকাতে গিয়ে দরজার দিকে তাকাল। দরজায় একজন এস আই বলল, স্যার, এম এল এ বাজপেয়ী।

তার কথা শেষ হবার আগেই একজন ঢুকে এল, চিনতে পারলাম, এম এল এ বাজপেয়ী, একজন বামপন্থী দলের নেতা বলে নিজেদের বামপন্থী, কিন্তু কেন বলে, তা জানি না। অনেকেই অনেক কিছু বলে, কেন বলে, সবসময়ে তার যুক্তি আর ব্যাখ্যা দেওয়া চলে না। আদর্শ কৌশল বা কর্মসূচি যাই হোক, আমরা যখন বলছি আমরা বামপন্থী, তখন নিশ্চয়ই আমরা বামপন্থী অনেকটা এইরকম। কারোর জীবন যাপন, কাজকর্মের ধারা যাই হোক, সে যদি বলে আমি অমুকবাদী, তমুকবাদী, এবং তারপরে যদি সে, যাকে বলে চ্যালেঞ্জের সুরে ডেকে বলে, তাতে কার বাপের কী তা হলে কারোর বাপেরই কিছু না বলে বাকি লোকেরা চুপ করে থাকবে কিংবা বলতে পারে, চালিয়ে যাও ওস্তাদ, শেষ রাত্রে যাদের দেখবার, তারা দেখবে। স্যার বাজপেয়ীকে দেখে বলল, আসুন স্যার, বসুন।

বাজপেয়ী বসতে বসতে বলল, না এসে কী উপায় বলুন, আমাদের পার্টির নির্দোষ ছেলেগুলোকে

স্যার বলে উঠল, ওটি বলবেন না স্যার, অন স্পট অ্যান্ড অ্যাকশন অ্যারেস্ট করা হয়েছে।

বাজপেয়ী ঘন ঘন মাথা নাড়তে লাগল, অর্থাৎ এ সব কথা মানতে পারছে না, এবং স্যার-এর কথা শেষ হলেই বলল, কিন্তু অপোজিট পার্টির এক জনকেও আপনি অ্যারেস্ট করেননি।

স্যার-এর প্রতিবাদ, কে বলল করিনি। দুজনকে করেছি।

বাজপেয়ী উত্তেজিত, বলল, দু জন, আর আমাদের সাত জন, এটা কী…।

স্যার আমার দিকে তাকাল বলেই বাজপেয়ীর কথা আমি আর শুনতে পেলাম না–মানে কান দেওয়া গেল না। আমার দিকে চোখ ফিরিয়ে ইনস্পেক্টরের দিকে চেয়ে ঘাড় নেড়ে বলল, একে নিয়ে যান।

এই সময়ে বাজপেয়ী আমার দিকে ফিরে তাকাল এবং ইনস্পেক্টরও হাত আমার দিকে নেড়ে বলল, এসো

আমি ভাবছিলাম, অবস্থার উন্নতি হতে যাচ্ছে, আর যে লোকটাকে নিয়ে তা ভেবেছিলাম, সেই লোকটা যে ওরকম একটা ভয়াবহ খারাপ কথা বলতে পারেনা, ভাবা যায় না। আমি ইনস্পেক্টরের সঙ্গে আবার একই পথে বেরিয়ে গেলাম এবং এবার গরাদ বন্ধ ঘর থেকে না, বাইরে যারা শ্লোগান দিচ্ছিল, তাদের মধ্য থেকেই কে যেন একটা শব্দ করল, প্যাঁক দেবার মতো। এদেরই ছাড়িয়ে নিয়ে যাবার জন্য বাজপেয়ী এসেছে। আমি ইনস্পেক্টরের ঠিক পিছনে পিছনেই একেবারে বাইরে চলে এলাম, যেখানে গাড়িগুলো দাঁড়িয়েছিল। এখানে সেখানে কিছু লোকজনও ভিড় করে আছে, নিশ্চয়ই বাজপেয়ীর সঙ্গে এসেছে। আমি ইনস্পেক্টরকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা আমি এখন কী করব।

ইনস্পেক্টর জিপের কাছে দাঁড়িয়ে আমার গায়ে একটু ঠেলে দিয়ে বলল, গাড়িতে উঠতে হবে।

কিছুই বলতে পারছি না। দেখলাম, আগের কনেস্টবল দুজনই এগিয়ে এল, এবং এবার আমাকে পিছন দিক দিয়ে জিপের খোলের মধ্যে ঢুকতে হল। ইনস্পেক্টর বা ড্রাইভার, সামনে এখনও কেউ এসে বসেনি। আমি কনেস্টবলদের জিজ্ঞেস করলাম, আমরা কোথায় যাচ্ছি?

একজনের জবাব শোনা গেল, মালুম নহি।

মিনিট খানেক পরেই ইনস্পেক্টর আর ড্রাইভার এসে উঠল, আর এঞ্জিনটা গোঁ গোঁ করে উঠতেই কয়েকজন জিপের পিছনে ছুটে এসে খোলের মধ্যে উঁকি দিয়ে দেখল, একজনের গলা শোনা গেল, না না।

না-ই বা কী, হ্যাঁ-ই বা কী, কিছুই বুঝতে পারছি না। কোথায় যাচ্ছি, নিশ্চয়ই কোথাও যাচ্ছি, সেটা কেউ বলছে না, আর ইনস্পেক্টরটাকে একটা মোটা ভাজা গলদা চিংড়ির মতো চেহারা এখন আমার যেন সেইরকমই মনে হচ্ছে, এ লোকটাকে আমার আর কিছু জিজ্ঞেস করার প্রবৃত্তি হচ্ছে না। এখন আর আমার ভালভাবে কোনও কথাই ভাবতে ইচ্ছা করছে না, কিন্তু যেখানেই নিয়ে যাক, আমি লিপির কথা ভাবতে চাই, একটু স্থির হয়ে ভাবতে চাই, কয়েকদিন ধরে ওর সঙ্গে আমার যা কথাবার্তা হয়েছে, তার মধ্যে এমন কিছু ছিল কি না, যার থেকে আজকের এই ডিজাসটারের কোনও সন্ধান পাওয়া যায়। এখনও কী ঘটবে আমি কিছুই জানি না, লিপির কী ঘটেছে, তাও জানি না। পরিমল কি এখনও বাড়ি ফেরেনি, ফিরে কি সমস্ত ব্যাপারটা শোনেনি। তা হলে তো এতক্ষণে ওর থানায় চলে আসা উচিত ছিল। ও তো অন্তত সমস্ত ব্যাপারটা জানে। ও সবাইকেই আসল ব্যাপারটা বলতে বা বোঝাতে পারবে, পার্টিও, মানে প্রিয়তোষদা বুঝতে পারবে, রাজনীতির বিষয়ে আমি যা-ই বলি, তার জন্য আমার ওপর তার যত রাগই থাক, অন্তত এ ব্যাপারে যে আমি সত্যি কিছু করিনি, সেটা জানতে পারবে। কিন্তু পরিমল তো আমার মাথাটা আরও খারাপ করে দিচ্ছে। ও যদি অন্য কোনও জরুরি কাজেই গিয়ে থাকবে, তবে সেটাও আমাকে জানাতে পারত। ও তো জানত, আমি কোথায় ওর আর লিপির জন্য অপেক্ষা করছি। সেই জায়গাটার কথা মনে করলে এখন যেন আমার বুকের মধ্যে আরও বেশি গুরগুর করে উঠছে, আমি প্রায়–যাকে বলে, কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছি, মনে হচ্ছে, সেই জায়গাটাই যেন একটা অশুভ অমঙ্গলের জায়গা, একমাত্র উঁচু ছাদে সেই পায়রাগুলো ছাড়া কিছুই ভাল দেখিনি। গোরুটাই বা ওভাবে আমার গায়ের কাছে এসে প্রস্রাব করে দিয়েছিল কেন, সে সময়েই কি খারাপ ঘটনা কিছু ঘটেছিল।

Pages: 1 2 3 4 5

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress