একটা শনিবার বিকেলে
একটা শনিবার বিকেলে ব্যোমকেশ প্রতুলবাবুর বাড়িতে উপস্থিত হয়ে বলল, ‘সত্যবতী দাদার কাছে গিয়েছে, অজিত নিরুদেশ, আমার হাতে কাজ নেই, তাই নিরুপায় হয়ে আপনাকে বিরক্ত করতে এলাম।’
প্রতুলবাবু বললেন, ‘শ্ৰীমতী সত্যবতীর দাদার কাছে যাওয়া বুঝলাম, মেয়েদের মাঝে মাঝে বাপের বাড়ি যাওয়ার বাসনা দুৰ্দমনীয় হয়ে ওঠে। কিন্তু অজিতবাবু নিরুদ্দেশ হলেন কেন?’
ব্যোমকেশ একটু বিমনাভাবে বলল, ‘কি জানি। কিছুদিন থেকে লক্ষ্য করছি ভোর হতে না হতে অজিত বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়, ফিরে আসে রাত ন’টার পর। প্রশ্ন করলে উত্তর দেয় না, মিটমিটি হাসে।’
‘প্রেমে পড়েননি তো?’
‘অজিতের হৃদয়ে প্ৰেম নেই, আছে কেবল অর্থলিন্সা। তাছাড়া প্রেমে পড়ার বয়স পেরিয়ে গেছে।’
‘তা বটে। চলুন, তাহলে থিয়েটার দেখে আসি।
‘থিয়েটার?’
‘হ্যাঁ। কয়েক মাস থেকে একটা নতুন নাটক চলছে। বিশু পালের দল করছে। খুব ভাল রিপোর্ট পাচ্ছি। চলুন না, দেখে আসা যাক।।’
‘মন্দ কথা নয়। বোধহয় ত্ৰিশ বছর থিয়েটার দেখিনি। নাটকের নাম কি?’
‘কীচক বধ।’
‘অ্যাঁ-পৌরাণিক নাটক!’
‘না না, আপনি যা ভাবছেন তা নয়। নামটা কীচক বধ বটে। কিন্তু পরিস্থিতি আধুনিক; একজন নবীন নাট্যকার লিখেছেন। বর্তমান যুগেও যে কীচকের অভাব নেই, বরং এ যুগের কীচকেরা সে-যুগের কীচকের কান কেটে নিতে পারে এই হচ্ছে প্রতিভাবান নাট্যকারের প্রতিপাদ্য। স্বয়ং বিশু পাল কীচকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।’
‘বিশু পাল কে?’
‘নটকেশরী বিশু পালের নাম জানেন না! দুর্ধর্ষ অ্যাকটর। চলুন চলুন, দেখে আসবেন।’
‘নিতান্তাই যদি আপনার রোখি চেপে থাকে-চলুন! নেই কাজ তো খাই ভাজ।’
‘আচ্ছা, আমি তাহলে টেলিফোনে দুটো সিট রিজার্ভ করে আসি।।’ প্রতুলবাবু পাশের ঘরে গেলেন।
ব্যোমকেশ কেয়াতলার বাড়িতে আসার পর প্রতুলবাবুর সঙ্গে আলাপ হয়েছে। দু’জনেই বুদ্ধিজীবী; উপরন্তু প্রতুলবাবু হৃদয়বান পুরুষ, সত্যবতীকে একটি মোটর কিনিয়ে দেবার জন্যে ব্যোমকেশের পিছনে লেগেছিলেন। সত্যবতীর বয়স বাড়ছে, এখন তার পক্ষে পায়ে হেঁটে বাজার করা কিম্বা সিনেমা দেখতে যাওয়া কষ্টকর, এই সব যুক্তি দেখিয়ে তিনি ব্যোমকেশের মন গলাবার চেষ্টা করেছিলেন। ফলে তিনি সত্যবতীর হৃদয় জয় করে নিয়েছিলেন। কিন্তু ব্যোমকেশকে বিগলিত করতে পারেননি। ব্যোমকেশের আপত্তি, মোটর কেনার টাকা না হয়। কষ্টেসূষ্টে যোগাড় করা যায়, ছয় সাত হাজার টাকায় একটা সেকেন্ড-হ্যান্ড গাড়ি পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু তারপর? গাড়ি চালাবে কে? একটা ড্রাইভার রাখতে গেলে মাসে দেড়শো দুশো টাকা খরচ। ঢাকের দায়ে মনসা বিকিয়ে যাবে। মধ্যবিত্ত গৃহস্থের পক্ষে বেশি বাড়াবাড়ি ভাল নয়। মাথায় চুল নেই। লম্বা দাড়ি অত্যন্ত অশোভন।
‘সিট পাওয়া গেছে। চলুন, বেরিয়ে পড়া যাক।’ প্রতুলবাবু নিজের মোটরে ব্যোমকেশকে নিয়ে যাত্রা করলেন। অনেক দূর যেতে হবে, শহরের অন্য প্রান্তে। প্রতুলবাবু প্রচণ্ড পণ্ডিত হলে কি হয়, সেই সঙ্গে প্রগাঢ় থিয়েটার প্রেমিক।
ঐরা যখন রঙ্গালয়ের দিকে যাচ্ছিলেন। সেই সময় কলেজ স্কোয়ারের এক কোণে গাছের তলায় একটি ভদ্রশ্রেণীর লোক দাঁড়িয়ে কারুর প্রতীক্ষ্ণ করছিল। তার হাতে একটি ছোট ব্যাগ, ব্যাগের মধ্যে এক সেট জামা-কাপড়। লোকটি অধীরভাবে ঘন ঘন কন্ডিজর ঘড়ি দেখছিল। যদিও এ পাড়ায় তার চেনা লোকের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতের সম্ভাবনা কম, তবু লোকটি রুমাল দিয়ে মুখের নিম্নাৰ্ধ ঢাকা দিয়ে রেখেছিল। এই সময় এখানে ছাত্রদের ভীড় হয়, ছাত্ররা জলভ্বমির মত পুকুরের চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে, তন্ময় হয়ে নিজেদের মধ্যে গল্প করছে। তবু বলা যায় না, পরিচিত কোনো ছাত্র তাকে দেখে চিনে ফেলতে পারে।
গলা খাঁকারির শব্দে চমকে উঠে লোকটি ঘাড় ফেরাল, দেখল। অলক্ষিতে কখন একটা লোক সুপ্রিল এসে দাঁড়িয়েছে। মুখে অর্জন দাঁড়ি গোঁফ্্, হাতে একটা মোটা লাঠি। লোকটি বলল, ‘এনেছি।‘
প্রথম ব্যক্তি বলল, ‘কোথায়?’
দ্বিতীয় ব্যক্তি পাশের পকেট থেকে একটি রুমালের মত ন্যাকড় বার করল। ন্যাকড়ার এক কোণে গিট বাঁধা, যেন সুপুরির মত একটা কিছু বাঁধা রয়েছে। প্রথম ব্যক্তি সেটি ভালভাবে দেখে বলল, ‘এতে কাজ হবে?’
দ্বিতীয় ব্যক্তি বলল, ‘হবে। খুব পাতলা কাচের অ্যামপুল। একটু ঠোকা পেলেই ফেটে যাবে।’
আর কোনো কথা হল না,। প্রথম ব্যক্তি ব্যাগ থেকে কয়েকটা নোট বার করে দ্বিতীয় ব্যক্তিকে দিল, দ্বিতীয় ব্যক্তি টাকা পকেটে রেখে অ্যামপুলটি ভাল করে ন্যাকড়ায় জড়িয়ে প্রথম ব্যক্তিকে দিল। প্রথম ব্যক্তি সেটি সযত্নে জামা-কাপড়ের মধ্যে রেখে দিয়ে দ্বিতীয় ব্যক্তির পানে চাইল। দ্বিতীয় ব্যক্তির ঝাঁকড়া গোঁফের আড়াল থেকে এক ঝলক হাসি বেরিয়ে এল। সে বলল, ‘শুভমস্ত্র।’
তারপর দু’জনে ভিন্ন দিকে চলে গেল।
প্রতুলবাবু ব্যোমকেশকে পাশে নিয়ে প্রেক্ষাগৃহের প্রথম সারিতে বসেছিলেন। আশেপাশে কয়েকটি সিট খালি ছিল, কিন্তু পিছন দিক একেবারে ভরাট।
সাহেববেশী একটি লোক সামনের সারিতে এসে বসল। তার হাতে একটি ব্যাগ। বসবার পর সে দেখতে পেল পাশেই প্রতুলবাবু; অপ্রস্তুতভাবে একটু হেসে বলল, ‘কেমন আছেন?’
প্রতুলবাবু বললেন, ‘ভাল। আপনি কেমন?’ দু’ এক মিনিট শিষ্টতা বিনিময়ের পর লোকটি উঠে পড়ল, বলল, ‘যাই। এদিকে একটা কেসে এসেছিলাম, ভাবলাম দাদাকে দেখে যাই।–আচ্ছা।’
লোকটি ব্যাগ হাতে চলে যাবার পর প্রতুলবাবু বললেন, ‘বিশু পালের ছোট ভাই। ডাক্তারি করে।’
ব্যোমকেশ বলল, ‘কিন্তু পসার ভাল নয়।’
‘না, কষ্টেসৃষ্ট চালায়। কি করে বুঝলেন?’
‘ভাবভঙ্গী পোশাক পরিচ্ছদ দেখে বোঝা যায়।’
ঠিক সাড়ে ছাঁটার সময় পদাঁ উঠল, নাটক আরম্ভ হল। সাড়ে ন’টা পর্যন্ত চলবে। মাত্র তিনটি অঙ্ক!
গল্পটি মহাভারতের বিরাট পর্ব থেকে অপহৃত হলেও একেবারে মাছিমারা অনুকরণ নয়, যথেষ্ট মৌলিকতা আছে। বস্তুত নাটকের শেষ অঙ্কে ঠিক উল্টো ব্যাপার ঘটেছে, অর্থাৎ বর্তমান কালের কীচক বর্তমান কালের ভীমকে বধ করে দ্রৌপদীকে দখল করেছে। নাটকের চরিত্রগুলির অবশ্য আধুনিক নাম আছে, পাঠকের সুবিধার জন্যে পৌরাণিক নামই রাখা হল।
নাটকের অভিনয় হয়েছে উৎকৃষ্ট। ক্রূর নায়ক কীচকের ভূমিকায় বিশু পালের অভিনয় অতুলনীয়। দ্ৰৌপদীর চরিত্রে সুলোচনা নামী যশস্বিনী অভিনেত্রী চমৎকার অভিনয় করেছে; তাছাড়া ভীম অর্জুন সুদেষ্ণা উত্তরা প্রভৃতির চরিত্রও ভাল অভিনীত হয়েছে। সব মিলিয়ে এই নাটকটিতে চিরন্তন মনুষ্য সমাজের বিচিত্র আলেখ্য যথাযথভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ধমোপদেশ বা নীতিকথা শোনাবার চেষ্টা নেই।
প্রতুলবাবু পরমানন্দে থিয়েটার দেখছেন, ব্যোমকেশও আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে। নাটক ক্রমশ তৃতীয় অঙ্কে এসে পৌঁছল। এবার চরম পরিণতি।
শেষ দৃশ্যটি হচ্ছে একটি শয়নকক্ষ। কক্ষে আসবাব কিছু নেই, কেবল একটি পালঙ্ক। এটি দ্ৰৌপদীর শয়নকক্ষ। ভীম পালঙ্কের ওপর চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে, কীচক আসবে।
ইতিপূর্বে ভীমের সঙ্গে দ্রৌপদীর পরামর্শ হয়েছে, দ্ৰৌপদী কীচককে তার ঘরে ডেকেছে। ভীম দ্ৰৌপদীর বদলে বিছানায় শুয়ে আছে, কীচক এলেই ক্যাঁক করে ধরবে।
নাটকের পরিসমাপ্তি এই রকম; ভীমের সঙ্গে কীচকের মল্লযুদ্ধ হবে; কীচক পরাজিত হয়ে মৃত্যুর ভান করে পালঙ্কের পায়ের কাছে পড়ে যাবে, ভীম তখন দ্ৰৌপদীকে ডাকতে যাবে। মিনিটখানেকের জন্যে মঞ্চ অন্ধকার হয়ে যাবে। তারপর অস্পষ্ট সবুজ আলো জ্বলবে। আস্তে আস্তে আলো উজ্জ্বল হবে। দ্ৰৌপদীকে নিয়ে ভীম ফিরে আসবে; কীচক ছুরি নিয়ে পিছন থেকে ভীমকে আক্রমণ করবে। ছুরিকাহত ভীম মরে যাবে। কীচক তখন পৈশাচিক হাস্য করতে করতে দ্ৰৌপদীকে পালঙ্কের দিকে টেনে নিয়ে যাবে। যবনিকা।
এবার দৃশ্যের আরম্ভের দিকে ফিরে যাওয়া যাক। ভীম পালঙ্কে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে; ঘরের আলো খুব উজ্জ্বল নয়, তবে অন্ধকারও নয়। কীচক পা টিপে টিপে প্রবেশ করল, পা টিপে টিপে পালঙ্কের কাছে গেল। তারপর এক ঝটিকায় চাদর সরিয়ে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের আলো আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
যিনি ভীম সেজেছেন তাঁর বপুটিও কম নয়, শালপ্ৰাংশু মহাভুজ। কীচক পরম কমনীয়া যুবতীর পরিবর্তে এই ষণ্ডামার্কা পালোয়ানকে দেখে ক্ষণকালের জন্যে স্তম্ভিত হয়ে গেল, সেই ফাঁকে ভীম দাঁত কড়মড় করে তাকে আক্রমণ করল। কীচকের পকেটে ছুরি ছিল (পরস্ত্রী লোলুপ লম্পটেরা নিরস্ত্রভাবে অভিসারে যায় না) কিন্তু সে তা বের করবার অবকাশ পেল না। দু’জনে ঘোর মল্লযুদ্ধ বেধে গেল।
স্টেজের ওপর এই মরণাস্তক কুস্তি সত্যিই প্রেক্ষণীয় দৃশ্য। মনে হয় না এটা অভিনয়। যেন দুটো ক্ষ্যাপা মোষ শিং-এ শিং আটকে যুদ্ধ করছে; একবার এ ওকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, একবার ও একে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। লোমহর্ষণ লড়াই। শুধু এই লড়াই দেখবার জন্যেই অনেক দর্শক আসে।
শেষ পর্যন্ত কীচকের পরাজয় হল, ভীম তাকে পালঙ্কের পাশে মাটিতে ফেলে বুকে চেপে বসে তার গলা টিপতে শুরু করল। কীচকের হাত-পা এলিয়ে পড়ল, জিভ বেরিয়ে এল, তারপর সে মরে গেল।
ভীম তার বুক থেকে নেমে চোখ পাকিয়ে ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলল, ঘাড় চুলকে ভাবল, শেষে স্টেজ থেকে বেরিয়ে দ্রৌপদীকে খবর দিতে গেল।
ভীম নিষ্ক্রান্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে স্টেজ ও প্রেক্ষাগৃহ অন্ধকার হয়ে গেল। এই নাটকে আলোর কৌশলে গল্পের নাটকীয়তা বাড়িয়ে দেবার নৈপুণ্য ভারি চমকপ্রদ। শেষ অঙ্কের চরম মুহুর্তে মূল সম্পূর্ণ ভিয়ে দিয়ে পরিচালক বিত্ত পাল দর্শকের মান উৎকণ্ঠ ও আগ্রহ বাড়িয়ে দিয়েছে।
মিনিটখানেক পরে দপ করে আবার সব আলো জ্বলে উঠল। দেখা গেল কীচক পূর্ববৎ খাটের খুরোর কাছে পড়ে আছে।
দ্ৰৌপদীকে নিয়ে ভীম প্রবেশ করল। ভীমের ভাবভঙ্গীতে উদ্ধত বিজয়োল্লাস, দ্ৰৌপদীর মুখে উদ্বেগ। তাদের মধ্যে হ্রস্বকণ্ঠে যে সংলাপ হল তা সংক্ষেপে এই রকম–
দ্ৰৌপদী : এখন মড়া নিয়ে কী করবে?
ভীম : কিছু ভেবো না, শেষ রাত্রে মড়া রাস্তায় ফেলে দিয়ে আসব। নাটকের নির্দেশ, এই সময় কীচক মাটি থেকে চুপি চুপি উঠে। ভীমের পিঠে ছুরি মারবে। কিন্তু কীচক যেমন পড়েছিল তেমনি পড়ে রইল, নড়ন চড়ন নেই। ছুরি মারার শুভলগ্ন অতিক্রম হয়ে যাবার পর ভীম উসখুসি করতে লাগল, দুচারটে সংলাপ বানিয়ে বলল, কিন্তু কোনো ফল হল না। ভয়ানক সত্য আবিষ্কার করল প্রথমে দ্ৰৌপদী। শঙ্কিত মুখে কীচকের কাছে গিয়ে সে চীৎকার করে কেঁদে উঠল, ‘অ্যাঁ-একি! একি–!’
কীচক অর্থাৎ বিশু পাল সত্যি সত্যিই মরে গেছে।