জ্ঞানেন্দ্রনাথ ফিরে এলেন
ক.
জ্ঞানেন্দ্রনাথ ফিরে এলেন সম্পূর্ণরূপে আচ্ছন্নের মত অবস্থায়। দুদিন পর। মামলার শেষ দিন। সব শেষ করে বাড়ি ফিরলেন। পৃথিবীর সবকিছু তার দৃষ্টি মন-চৈতন্যের গোচর থেকে সরে গেছে। কোনো কিছু নেই। চোখের সম্মুখে ভাসছে আসামির মূর্তি। কানের মধ্যে বাজছে দুই পক্ষের উকিলের যুক্তি। মনের মধ্যে রয়েছে সমস্ত ঘটনাগুলির বিবরণ থেকে রচনা-করা পট। আর চৈতন্যকে আচ্ছন্ন করে রয়েছে আসামির কথাগুলি।
থানা থেকে শুরু করে দায়রা আদালতে এই বিচার পর্যন্ত সর্বত্র সে একই কথা বলে। আসছে। হুজুর, আমি জানি না আমি দোষী কি নির্দোষ। ভগবান জানেন, আর হুজুর বিচার করে বলবেন। এবং এই কথাগুলি যেন শুধু কথা নয়। তার যেন বেশি কিছু। জবাবের মধ্যে অতি কঠিন প্রশ্ন উপস্থিত করেছে সে। কণ্ঠস্বরের সকরুণ অসহায় অভিব্যক্তি, চোখের দৃষ্টির সেই অসহায় বিহ্বলতা, তার হাত জোড় করে নিবেদনের সেই অকপট ভঙ্গি, সব মিলিয়ে সে একটা আশ্চর্য প্রভাব বিস্তার করেছে তার চৈতন্যের উপর। অপরাধ করি নি জবাব দিয়েই শেষ করে নি, প্রশ্ন করেছে—বিচারক তুমি বল সে-কথা! ঈশ্বরকে যেমনভাবে যুগে যুগে মানুষ প্রশ্ন করেছে। ঠিক তেমনিভাবে।
এ-প্রশ্ন তার সমস্ত চৈতন্যকে যেন সচকিত করে দিচ্ছে; ঘুমন্ত অবস্থায় চোখের উপর তীব্র আলোর ছটা এবং উত্তাপের স্পর্শে জেগে উঠে মানুষ যেমন বিহ্বল হয়ে পড়ে, তেমনি বিহ্বল হয়ে পড়েছেন তিনি। ওই লোকটির সেই চরম সঙ্কটমুহূর্তের অবস্থার কথা কল্পনা করতে হবে। স্থলচারী মুক্তবায়ুস্তরবাসী জীব নিচ্ছিদ্র শ্বাসরোধী জলের মধ্যে ড়ুবে গিয়ে মুহূর্তে মুহূর্তে কোন অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছিল, কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, অনুমান করতে হবে। মৃত্যুর সম্মুখে সীমাহীন ঘন কালো একটা আবেষ্টনী মুহূর্তে মুহূর্তে তাকে ঘিরে ধরছিল। নিদারুণ ভয়, নিষ্ঠুরতম যন্ত্রণার মধ্যে আজকের মানুষকে, হাজার হাজার বছরের ইতিহাসের সভ্য মানুষকে প্রাগৈতিহাসিক আরণ্যযুগের আদিমতম মানুষের জান্তব চেতনার যুগে ঠেলে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে দয়া নাই, মায়া নাই, স্নেহ নাই, মমতা নাই, কৰ্তব্য নাই, আছে শুধু আদিমতম প্রেরণা নিয়ে প্রাণ, জীবন।
কল্পনা করতে তিনি পেরেছিলেন। কল্পনা নয়, ঠিক এই ভয়ঙ্কর অবস্থায় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার স্মৃতি তার মনের মধ্যে জেগে উঠেছিল। তিনি অনুভব করতে পারছিলেন।
খ.
অকস্মাৎ মর্মান্তিক শ্বাসরোধী সে এক নিষ্ঠুর যন্ত্রণা। কে যেন হৃৎপিণ্ডটা কঠিন কঠোর হাতের মুঠোয় চেপে ধরেছিল। তার সঙ্গে মস্তিষ্কে একটা জ্বালা। কাশতে কাশতে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল।ক যন্ত্রণায় আতঙ্ক-বিস্ফারিত দৃষ্টি মেলেও কিছু বুঝতে পারেন নি। এক ঘন সাদা পুঞ্জ পুঞ্জ কিছু তাকে যেন ছেয়ে ফেলেছে। আর একটা গন্ধ। আর চোখে পড়েছিল ওই পুঞ্জ পুঞ্জ আবরণকে প্রদীপ্ত-করা একটা ছটা।
ধোঁয়া! মুহূর্তে উপলব্ধি হয়েছিল আগুন। ঘরে আগুন লেগেছে।
মাথার উপর গোটা ঘরের চালটা আগুন ধরে জ্বলছে। জানুয়ারিশেষের শীতে ঘরের দরজা জানালা সব বন্ধ। ধোঁয়ায় ঘরখানা বিষবাষ্পচ্ছন্ন আদিম পৃথিবীর মত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। ঘরের আলো নিভে গেছে। আগুনের ছটায় রাঙা ধোঁয়া শুধু। তার সঙ্গে সে কী উত্তাপ! তাঁর নিজের মাথার মধ্যে তখন মদের নেশার ঘোর এক যন্ত্ৰণা। মৃত্যু যেন অগ্নিমুখী হয়ে গিলতে আসছে তাকে এবং সুমতিকে। সুমতি শুয়ে ছিল মেঝের উপর। সে তখন জেগেছে, কিন্তু ভয়ার্তবিহ্বল চোখের কোটর থেকে চোখ দুটো যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে। বিহ্বলের মত শুধু একটা চিৎকার।
তিনি তার মধ্যেও নিজেকে সংযত করে সাহস এনে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। ধোঁয়ার মধ্যে সব ঢেকে আসছিল, চোখ দিয়ে জল পড়ছিল, তারই মধ্যে তিনি গিয়ে সুমতির হাত ধরে বলেছিলেন—এস, শিগগির এস।
সুমতি আঁকড়ে ধরেছিল তাঁর হাত।
কোথায় দরজা? কোন দিকে?
সুমতি সেদিন দরজায় খিল, উপরে নিচে দুটো ছিটকিনি লাগিয়ে তবে শুয়েছিল। এগুলি খুলতে খুলতে তার শব্দে নিশ্চয় ওর ঘুম ভাঙবে। তিনি জানেন, ওর ভয় ছিল, যদি রাত্রে সন্তৰ্পণে দরজা খুলে বেরিয়ে যান।
তবুও ধৈর্য হারান নি। প্রাণপণে নিজের শিক্ষা ও সংযমে স্থির রেখেছিলেন নিজেকে। একে একে ছিটকিনি খিল খুলে বেরিয়ে এসেছিলেন বারান্দায়। সেখানে নিশ্বাস সহজ হয়েছিল, কিন্তু গোটা বারান্দার চালটা তখন পুড়ে খসে পড়ছে। একটা দিক পড়েছে, মাঝখানটা পড়ছে। মাথার উপরে নেমে আসছে জ্বলন্ত আগুনের একটা স্তর। ঠিক এই মুহূর্তেই হঠাৎ সুমতি চিৎকার করে উঠল, এবং ভারী একটা বোঝার মত মুখ থুবড়ে উপুড় হয়ে পড়ে গেল। তার আকর্ষণে সঙ্গে সঙ্গে তিনিও পড়লেন। তাঁদের উপরে খসে পড়ল চালকাঠামোর সঙ্গে বাঁধা একটি স্তরবন্দি রাশি রাশি জ্বলন্ত খড়। সে কী যন্ত্রণা! বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড বিলুপ্ত হয়ে গেল এক মহা অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে। তবু তিনি ঝেড়ে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু বাধা পড়ল। হাতটা কোথা আটকেছে! ওঃ, সুমতি ধরে আছে! মুহূর্তে তিনি হাত ছাড়িয়ে উঠে কোনো রকমে দাওয়ার উপর থেকে নিচে লাফিয়ে নেমে এসে খোলা উঠানে পড়ে গিয়েছিলেন। তিনি অবস্থাটা বুঝতে পারছেন। এ-অবস্থা কল্পনা ঠিক করা যায় না। তিনি পেরেছেন, ভুক্তভোগী বলেই তিনি বুঝতে পেরেছেন।
ঈশ্বর জানেন। আর হুজুর বিচার করে বলবেন। আসামির কথা কটি তার চৈতন্যকে আচ্ছন্ন করে এখনও ধ্বনিত হচ্ছে।
ডিফেন্সের উকিলও আত্মরক্ষার অধিকারের মৌলিক প্রশ্নটিকেই সর্বাপেক্ষা অধিক গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপিত করেছেন। জীবনের জন্মগত প্রথম অধিকার, নিজের বাবার অধিকার তার সর্বাগ্রে। এই স্বত্বের অধিকারী হয়ে সে জন্মগ্রহণ করে। দণ্ডবিধির সেকশন এইট্টি-ওয়ানের নজির তুলেছেন। একটি ছোট্ট দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেছিলেন তিনি। হতভাগ্য আসামি। সেকশন এইট্টি-ওয়ান ওকে জলমগ্ন অবস্থাতেও গলা টিপে ধরবার অধিকার দেয় নি। আসামির উকিল অবশ্য সুকৌশলে ও প্রয়োজনীয় অংশটুকু তুলে ধরেছেন জুরীদিগের সামনে।
A and B, swimming in the sea after a shipwreck, get hold of a plank not large enough to support both, A pushes B, who is drowned. This, in the opinion of Sir James Stephen, is not a crime…
কিন্তু এর পরও একটু যে আছে। স্যার জেমস স্টিফেন আরও বলেছেন,
……. as thereby A does B no direct bodily harm but leaves him to his chance of another plank.
এ-সেকশন যে তার মনের মধ্যে উজ্জ্বল অক্ষরে খোদাই করা আছে।
এই বিধানটি নিয়ে যে তিনি বার বার যাচাই করে নিয়ে নিজেকে মুক্তি দিয়েছেন।
সুমতির হাতখানাই শুধু তিনি ছাড়িয়ে নিয়েছিলেন, কোনো আঘাত তিনি করেন নি। আঘাত করে তার হাত ছাড়ালে অপরাধ হত তার। অবশ্য সুমতির দেহে একটা ক্ষতচিহ্ন ছিল; সেটা কারুর দেওয়া নয়, সেটা সুমতিকে তার নিয়তির পরিহাস, সেটা তার স্বকর্মের ফল, সুমতির পায়ের তলায় একটা দীর্ঘ কাচের ফলা আমূল ঢুকে বিঁধে ছিল। বাঁধানো যে ফটো কখানা আছড়ে সে নিজেই ভেঙেছিল সেই ফটো-ভাঙা কাচের একটা লম্বা সরু টুকরো। সেইটে বিঁধে যাওয়াতেই অমনভাবে সে হঠাৎ সেই চরম সংকটের মুহূর্তটিতেই থুবড়ে পড়ে গিয়েছিল।
বিধিলিপি! বিধিলিপির মতই বিচিত্ররূপ এক অনিবার্য পরিণাম সুমতি নিজের হাতে তৈরি করেছিল। নিষ্কৃতির একটি পথও খোলা রাখে নি। নিজের হাতে নীরন্ধ্র করে রুদ্ধ করে দিয়েছিল। জীবন-প্রকৃতি আর জয়প্রকৃতি একসঙ্গে যুক্ত হয়ে ক্ষুব্ধ হলে আর রক্ষা থাকে না। সেদিন তাদের জীবনে এমনি একটা পরিণাম অনিবার্যই ছিল। সুমতির হাতের জ্বালানো আগুন ওইভাবে ঘরে না লাগলে অন্যভাবে এমনি পরিণাম আসত। তিনি নিজে আত্মহত্যা করতেন। সুমতির ঘুম গাঢ় হলেই তিনি আত্মঘাতী হবেন স্থির করেই শুয়েছিলেন। কিন্তু অতিরিক্ত মদের ঘোরে তার চৈতন্যের সঙ্গে সংকল্পও অসাড় হয়ে পড়েছিল। তিনি আত্মহত্যা করলে সুমতিও আত্মঘাতিনী হত তাতে তাঁর সন্দেহ নেই। কায়ার সঙ্গে ছায়ার মত সে তার জীবনকে আঁকড়ে ধরে ছিল।
গ.
কুঠির কম্পাউন্ডে গাড়ি থামাতেই তার মন বাস্তবে ফিরে এল। জজ সাহেবের কুঠি। বর্ষার ম্লান অপরাহ্র। আকাশে মেঘের আস্তরণ দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। বাড়িটা নিস্তব্ধ। কই সুরমা কই? বাইরে কোথাও নেই সে!
নেই ভালই হয়েছে।
কিন্তু বাইরের এই প্রকৃতির রূপ তার ওপর যেন একটা ছায়া ফেলেছে। স্লান বিষণ্ণ স্তব্ধ হয়ে রয়েছে সুরমা সেই বাবুর্চিখানায় আগুন-লাগার দিন থেকে।
গাড়ি থেকে নেমে জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুহূর্তের জন্য দাঁড়ালেন।
একটা ছায়া। তাঁর নিজেরই ছায়া। পাশের সবুজ লনের উপর নিজেকে প্রসারিত করে দিয়েছে। আসামি নগেনের চেয়ে অনেক দীর্ঘ তার ছায়া। নগেনের চেয়ে অনেকটা লম্বা তিনি। দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন জ্ঞানেন্দ্রনাথ। তারপর দৃঢ় পদক্ষেপে অগ্রসর হলেন বাঙলোর দিকে। সরাসরি আপিস-ঘরের দিকে।
বেয়ারা এসে দাঁড়ালজুতো খুলবে
–না। হাত ইশারা করে বললেন–যাও। যাও।
ঘরে ঢুকে গেলেন তিনি। আপিস-ঘর পার হয়ে এসে ঢুকলেন মাঝখানকার বড় ঘরখানায়। ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চারিদিকে চেয়ে দেখলেন। ঘরখানা প্রায় প্রদোষান্ধকারের মত ছায়াচ্ছন্ন; তয় ছায়াটা পর্যন্ত মিলিয়ে গেছে। তিনি এগিয়ে গিয়ে সামনের দেয়ালে টাঙানো পরদাঢাকা ছবিটার উপর থেকে পরদাটা টেনে খুলে দিলেন।
সুমতির অয়েলপেন্টিং আবছায়ার মধ্যে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না, শুধু সাদা বড় চোখ দুটি জ্বলজ্বল করছে।
ছবিখানার দিকে নিম্পলক চোখে চেয়ে স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলেন তিনি।
সে কি অভিযোগ করছে?
তিনি কি দুর্বল হয়ে যাচ্ছেন?
—তুমি এ-ঘরে? বাইরে থেকে বলতে বলতেই ঘরে ঢুকে সুরমা স্বামীকে সুমতির ছবির দিকে চেয়ে থাকতে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলেন।
–ওদিকের জানালাটা খুলে দাও তো!
–খুলে দেব?
–হ্যাঁ।
সে কথা লঙ্ন করতে পারলেন না সুরমা। জানালাটা খুলে দিতেই আলোর ঝলক গিয়ে পড়ল ছবিখানার উপর।
সুরমা শিউরে উঠলেন। পরমুহূর্তেই অগ্রসর হলেন–ছবির উপর পরদাখানা টেনে দেবেন। তিনি।
–না, ঢেকো না।
–কেন? হঠাৎ তোমার হল কী?
সুরমার মুখের দিকে তাকিয়ে জ্ঞানেন্দ্রনাথ বললেন–সেইদিন থেকে ওকে মধ্যে মধ্যে মনে পড়ছে। মাঝে মাঝে এসে যেন সামনে দাঁড়াচ্ছে। আজ বহুবার দাঁড়িয়েছে। তাই ওর সামনে এসে আমিই দাঁড়িয়েছি। থাক—এটা খোলা থাক।
—বেশ থাক। কিন্তু পোশাক ছাড়বে চল। চা খাবে।
–চা এখানে পাঠিয়ে দাও। পোশাক এখন ছাড়ব না।
এ-কণ্ঠস্বর অলঙনীয়। নিজের ঘুমকে মনে মনে অভিসম্পাত দিলেন সুরমা। তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। নইলে হয়ত গাড়ির মুখ থেকে জ্ঞানেন্দ্রনাথকে ফেরাতে পারতেন। এ ঘরে ঢুকতে দিতেন না।
কয়েক দিন থেকেই স্বামীর জন্য তার আর দুশ্চিন্তার শেষ নাই।
দিন দিন তিনি যেন দূর থেকে দূরান্তরে চলে যাচ্ছেন;—এক নির্জন গহনের মৌন একাকিত্বে মগ্ন হয়ে যাচ্ছেন। বর্ষার এই দিগন্তজোড়া বর্ষপণানুখ মেঘমণ্ডলের মতই গম্ভীর ম্লান এবং ভারী হয়ে উঠছেন। জীবনের জ্যোতি যেন কোনো বিরাট গম্ভীর প্রশ্নের অনিবার্য আবির্ভাবে ঢাকা পড়ে গেছে। অবশ্য জ্ঞানেন্দ্রনাথের জীবনে এ নূতন নয়। ঋতুপর্যায়ের মত এ তাঁর জীবনে এসেছে বার বার। বার বার কত পরিবর্তন হল মানুষটির জীবনে। উঃ!
কিন্তু এমন আচ্ছন্নতা, এমন মৌন মগ্নতা কখনও দেখেন নি। সবচেয়ে তাঁর ভয় হচ্ছে। সুমতির ছবিকে! সে কোন প্রশ্ন নিয়ে এল? কী প্রশ্ন? সে প্রশ্ন যাই হোক তার সঙ্গে তিনি যে জড়িয়ে আছেন তাতে তো সন্দেহ নেই। তার অন্তর যে তার আভাস পাচ্ছে। আকুল হয়ে উঠেছে। তার মা তাঁকে বারণ করেছিলেন। কানে বাজছে। মনে পড়েছে। নিজেও তিনি দূরে চলে যেতে চেয়েছিলেন। টেনিস ফাইন্যালে জেতার পর তোলানো ফটোগ্রাফ কখানা পেয়েই সংকল্প করেছিলেন সুমতি জ্ঞানেন্দ্রনাথ থেকে দূরে সরে যাবেন। অনেক দূরে। পরদিন সকালেই কলকাতা চলে যাবেন, সেখান থেকে বাবাকে লিখবেন অন্যত্র ট্রান্সফারের জন্য; অথবা জ্ঞানেন্দ্রনাথকে ট্রান্সফার করাতে। বাবাকে জানাতে তার সংকোচ ছিল না। কিন্তু বিচিত্র ঘটনাচক্র।
পরদিন ভোরবেলাতেই শুনেছিলেন মুনসেফবাবুর বাসা পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। মুনসেফবাবুর স্ত্রী পুড়ে মারা গেছেন। মুনসেফবাবু হাসপাতালে, অজ্ঞান, বুকটা পিঠটা অনেকটা পুড়ে গেছে, বাঁচবেন কি না সন্দেহ!
সব বাঁধ তাঁর ভেঙে গিয়েছিল।
যে-প্রেমকে কখনও জীবনে প্রকাশ করবেন না সংকল্প করেছিলেন সে-প্রেম সেই সংকটময় মুহূর্তে তারস্বরে কেঁদে উঠে আত্মপ্রকাশ করেছিল। তিনি জ্ঞানেন্দ্রনাথের শিয়রে গিয়ে। বসেছিলেন। উঠবেন না, তিনি উঠবেন না। মাকে বলেছিলেন—আমাকে উঠতে বোলোনা, আমি যাব না, যেতে পারব না।
কাতর দৃষ্টিতে তিনি তাকিয়েছিলেন বাবার দিকে।
বাবা বলেছিলেন–বেশ, থাক তুমি।
মা বলেছিলেন—এ দুই কী করছিস ভেবে দেখ। যে-লোক স্ত্রীকে বাঁচাতে গিয়ে এমনভাবে নিজের প্রাণ বিপন্ন করে তার মনে অন্যের ঠাঁই কোথায়?
লোকে যে দেখেছিল, চকিতের মত দেখেছিল সুমতির হাত ধরে জ্ঞানেন্দ্রনাথকে বেরিয়ে আসতে। চাল চাপা পড়ার মুহূর্তে সুমতির নাম ধরে তার আর্তচিৎকার শুনেছিল—সুমতি! বলে, সে নাকি এক প্রাণফাটানো আর্তনাদ!
জ্ঞানেন্দ্রনাথ ভাল হয়ে উঠবার পর একদা এক নিভৃত অবসরে সুরমা বলেছিলেন—তোমার জীবন আমি সর্বস্বান্ত করে দিয়েছি। আমার জন্যই তোমার এ সৰ্বনাশ হয়ে গেল। আমাকে তুমি নাও! সুমতির অভাব
জ্ঞানেন্দ্রনাথ আশ্চর্য। সুরমার কথায় বাধা দিয়ে বলেছিলেন—অভাববোধের সব জায়গাটাই যে অগ্নিজিহ্বা লেহন করে তার রূপ রস স্বাদ গন্ধ সব নিঃশেষে নিয়ে গেছে সুরমা।
আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিলেন নিজের পুড়ে-যাওয়া বুক এবং পিঠটাকে।
—আমার চা-টা—শুধু চা, এখানে পাঠিয়ে দাও!
–প্লিজ!
জ্ঞানেন্দ্রনাথের মৃদু গম্ভীর কণ্ঠস্বর; চমকে উঠলেন সুরমা। ফিরে এলেন নিষ্ঠুরতম বাস্তব অবস্থায়। জ্ঞানেন্দ্রনাথ দাঁড়িয়ে আছেন সুমতির অয়েল-পেন্টিঙের সামনে।
—না। আর্ত মিনতিতে সুরমা তার হাত ধরতে গেলেন।
–প্লিজ!
সুরমার উদ্যত হাতখানি আপনি দুর্বল হয়ে নেমে এল। আদেশ নয়, আকুতিভরা কণ্ঠস্বর। বিদ্রোহ করার পথ নেই। লঙ্ঘন করাও যায় না।
নিঃশব্দেই বেরিয়ে গেলেন সুরমা।