Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বাসভূমি || Samaresh Majumdar » Page 4

বাসভূমি || Samaresh Majumdar

বাবুদের ব্যাপারটা হঠাৎ ঘটে গেল

বাবুদের ব্যাপারটা হঠাৎ ঘটে গেল। ধর্মঘটের আগের রাতে ওরা ঠিক করেছিল, লেবার য়ুনিয়ন যখন ধর্মঘট করছে তখন বাবুদের কাজে যেতে কোনো বাধা দেওয়া হবে না। ফ্যাক্টরি না চললে গুদামবাবুরা বেকার, পাতি না তোলা হলে পাতিবাবুর কিছু করার নেই। ওরা কজন অফিসে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকলে তাদের আর কি ক্ষতি হবে। প্রথম দু-তিন দিন সেইমত কাজ হচ্ছিল। বাবুরা নিয়ম করে সকাল বিকেল সাইকেলে করে অফিসে গিয়ে হাজিরা দিয়ে আসছিল। শুধু হাসপাতাল ছাড়া আর কোথাও কাজ হচ্ছিল না তখন।

কিন্তু গোলমালটা বেধে গেল এখানেই। সাধারণ লোক দেখছিল বাবুরা বেশ হাসতে হাসতে যাচ্ছে আর আসছে। কাজ না করেও ওরা মাসের শেষে মাইনে নেবে। আর ধর্মঘট করার জন্য শ্রমিকরা মাইনে পাবে না। কথাটা কানাকানি হতে লাগল দ্রুত। মানুষ নিজের কষ্ট সহ্য করতে পারে কিন্তু অন্যের সুখ চেয়ে দেখা আরো কষ্টকর। য়ুনিয়ন অফিসে শ্রমিকরা এসে ভিড় করল। বাবুদের অফিস যাওয়া বন্ধ করতে হবে। চাপ বাড়াতে লাগল ক্রমশ। য়ুনিয়ন ফুনিয়ন বুঝি না, বাবুরাও নোকর আমরাও নোকর, দুজনের ভাগ্য আলাদা হবে কেন? নেতারা মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিল যে বাবুদের অনুরোধ করা হবে যেহেতু শ্রমিকরা উত্তপ্ত তাই বাবুরা যেন এই কয়দিন অফিসে না যায়। সিরিল গেল ফ্রান্সিসের মাধ্যমে বাবুদের খবরটা দিতে।

কোয়ার্টারের বারান্দায় ফ্রান্সিস বসেছিল খালি গায়ে। সিরিল দেখল যতই ও বাবু হোক চেহারাটা একটুও পালটায়নি। সিরিলকে দেখে যেন খুশি হল ফ্রান্সিস। হেসে বলল, খুব খেল শুরু করেছিস তোরা। সাহেব ঘাবড়ে গেছে এখন।

সাহেবের কোনো প্রতিক্রিয়া জানত না সিরিল। মেজাজে পাইপ মুখে গাড়ি চালিয়ে ক্লাবে যায় যেন কিছুই হচ্ছে না বাগানে। ফ্রান্সিসের কথা শুনে জিজ্ঞাসা করল, কেন, কী বলছে সাহেব?

বলবে আবার কি, মাথায় বাজ পড়েছে। বিরাট একটা এক্সপোর্ট অর্ডার পেয়েছে কোম্পানি। চল্লিশ দিনের মধ্যে দিতে হবে। এদিকে তোদের জন্য প্রোডাকশন বন্ধ। অর্ডারটা ফিরিয়ে দিলে বদনাম তো বটেই প্রচুর লস হয়ে যাবে।

তাই যদি হয় আমাদের বোনাস দিয়ে দিক, কাজ হয়ে যাবে।

এখন লড়াই হচ্ছে। আর কি পেছনে ফেরা যায়!

সিরিল লক্ষ্য করল ফ্রান্সিস হেসে কথা বললেও তাকে বসতে বলছে না। তাদের আন্দোলন সমর্থন করছে হাবেভাবেও, কেন? ফ্রান্সিস সিগারেট ধরিয়ে জিজ্ঞাসা করল, হঠাৎ কী মনে করে?

সিরিল তখন য়ুনিয়নের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অনুরোধটা ফ্রান্সিসকে জানাল। ফ্রান্সিস যেন অবিলম্বে বাবুদের জানিয়ে দেয়।

ফ্রান্সিসের ভুরু কুঁচকে গেল, তোরা কি ভয় দেখাচ্ছিস?

ভয় না। পাবিলক খেপে গেলে কিছু একটা হয়ে যেতে পারে বলে সতর্ক করা হচ্ছে। সিরিল ঠাণ্ডা গলায় বলল।

ফ্রান্সিস মুখ বেঁকিয়ে বলল, তোদের যুনিয়ন হরতাল করছে, নাফা করবি তোরা, আমাদের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক!

সিরিল ফ্রান্সিসের মুখটা একবার দেখে গেটের দিকে হাঁটতে শুরু করল। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করল, নাফা শুধু আমরা একাই করব না। সাহেব বোনাস দিলে শুধু আমাদের দেবে না, তোমাদেরও দেবে। আমাদের কথা বলে গেলাম এখন বাবুদের বলো তারা যা ইচ্ছে হয় করুক।

খবরটা পেয়েও গুরুত্ব দিল না বাবুরা। য়ুনিয়ন হুকুম করল যে সব মদেসিয়া ছেলে বাবুদের কাজ করে তাদের অবিলম্বে লাইনে ফিরে আসতে। বাবুরা সব একসঙ্গে গিয়ে সাহেবকে ধরল একটা বিহিতের জন্যে। সাহেব সাফ বলে দিলেন হাজিরা না দিলে মাইনে কাটা যাবেই। এসময় কোনোরকম ছুটি মঞ্জুর করা সম্ভব হবে না। তবে দুবেলা আসবার বদলে একবেলা এলেই কাজ হবে। কথাটা শোনার পর মাইনের লোভ ছেড়ে তিনজন বাবু ফ্যামিলি নিয়ে জলপাইগুড়ি চলে গেল। টাইপবাবু তাদের একজন। প্রাণে বাঁচলে আবার চাকরি করতে আসা যাবে। কিন্তু যাঁরা। দীর্ঘকাল এখানে কাজ করছেন তারা ব্যাপারটাকে বিশ্বাসই করতে পারলেন না। এতদিন যাঁদের ওরা হুকুম দিয়ে এসেছেন, মাথা নিচু করে যারা সে হুকুম পালন করেছে তারা কখনই তাদের। অপমান করতে পারে না। তবে ঠিক হল, সাইকেলে নয়, পায়ে হেঁটে ওঁরা দল বেধে হাজিরার জন্যে অফিসে যাবেন।

সাধারণত দিনে তিনবার কোয়ার্টার আর অফিস করতে হয় বাবুদের। সেদিন সকাল সাতটা নাগাদ সবাই দল বেঁধে অফিসে চললেন। এরকম অভিজ্ঞতা ওঁদের কাছে নতুন। দীর্ঘকাল ধরে সাহেবের স্নেহ পাওয়ার জন্যে পরস্পরের মধ্যে একটা চাপা রেষারেষি রয়েছে যার জন্যে এ ওকে দেখতে পারেন না। কিন্তু এই রকম বিপদের সময় ওঁরা সেসব মনে রাখতে চাইছেন না।

মাথার ওপর পাখি ডাকছে, গায়ে কচি রোদ মাখতে মাখতে ওরা চায়ের গাছগুলোর পাশ দিয়ে হেঁটে এলেন। না, কেউ তাদের বাধা দিতে এল না। নিজেদের কাল্পনিক ভয় নিয়ে ওরা অফিসে বসে রসিকতা করছিলেন। এখন অফিস ঘরে বসলে চারপাশে অস্বাভাবিক লাগে। ফ্যাক্টরির সেই একটানা শব্দ কানে আসছে না, নদীর ওপর হুইলটাও নিঃশব্দ। আশেপাশে কোথাও একটা কুলি নেই, এমনকি এক গ্লাস জল খেতে হলে বাবুদের নিজেদের তার ব্যবস্থা করতে হবে। এর মধ্যে সাহেব এসে কিছুক্ষণের জন্যে ঘুরে গেলেন। বাবুরা তাকে ধরলে তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন যে বাবুদের নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা তার পক্ষে করা অসম্ভব। পরিস্থিতি ক্রমশ হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। দু-একদিন মধ্যে ফয়সালা না হলে লকআউট ঘোষণা করা হতে পারে।

সাহেবের মুখে এই কথা শোনার পর বাবুরা সত্যিকারের আতঙ্কিত হলেন। দুপুরের খাওয়ার সময় যখন তারা দল বেঁধে ফিরে আসছেন তখন মিছিলটাকে চোখে পড়ল। উলটো দিকে রাস্তা। ধরে স্নোগান দিতে দিতে আসছে। ওঁদের দেখতে পেয়ে মিছিলটা যেন আচমকা উত্তেজিত হয়ে উঠল। বাবুরা দেখলেন মিছিলের কেউ কেউ তাদের আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে। যে ভঙ্গিতে ওরা চা বাগানের ভেতরে হিংস্র জন্তু চোখে পড়লে সবাইকে আঙুল দিয়ে দেখায়। কিছু বলার আগেই দুজন বাবু ছুটতে শুরু করলেন, তাঁদের দেখাদেখি অন্যান্য বাবুরাও পা চালালেন। বাবুদের কাছে। এইরকম দৌড় স্বপ্নাতীত কারণ তাদের শরীর বিশ্বাসঘাতকতা করছিল। পেছনের হল্লাটা বাড়ছিল। চিৎকার সঙ্গে সঙ্গে আমোদ পাওয়া উল্লাস ওঁদের কানে আসছিল। কোনো রকমে অত্যন্ত বিপর্যস্ত অবস্থায় ওঁরা কোয়ার্টারে ফিরে আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করলেন না। যে যা পারলেন দ্রুত গুছিয়ে নিয়ে সপরিবারে বাগান ছাড়বার জন্য পা বাড়ালেন। প্রত্যেকেই অনুভব করলেন এতদিনের বিশ্বাস আজ অচল হয়ে গেছে। কুলিদের উল্লাস তাদের মৃত্যুও ডেকে আনতে পারে। পোঁটলাপুটলি বেঁধে ওঁরা কোয়ার্টারগুলো ছেড়ে হাইওয়েতে ওঠা মাত্রই কালো কালো মাথাগুলোকে দেখা গেল। বন্যার ঢেউএর মত তেড়ে আসছে হইহই করতে করতে। সমস্ত কুলি লাইন যেন ভেঙে পড়েছে। বাবুদের কোয়ার্টারের সামনে। তাদের পালাতে দেখে ওরা হইহই শব্দে হাতের লাঠি উঁচিয়ে ধাওয়া করল। বড়বাবু তার বিশাল ভূঁড়ি নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে দেখলেন তাদের এত বছরের গৃহিণী হরিণের মত ছুটছেন। অন্যান্য বাচ্চাদের চিৎকার কান্নার মধ্যে দিয়ে ওঁরা প্রাণের ভয়ে ছুটতে ছুটতে বাগানের সীমানা পেরিয়ে খাসমহলের জমিতে প্রবেশ করলেন। এদিকে কুলিরা প্রথমে নিছক উল্লাসে পেছন-ধাওয়া করেছিল কিন্তু কেউ কেউ সেটাকে প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ হিসেব গ্রহণ করল। যতই দুপক্ষের মধ্যে দুরত্ব কমে আসছিল ততই উত্তেজনা বাড়ছিল। এর মধ্যে কেউ কেউ বাবুদের উদ্দেশে ঢিল ছুঁড়তে শুরু করে দিয়েছে। ছোট গুদামবাবু সস্ত্রীক এই দলে আছে। তার ছোটা স্বচ্ছন্দ হলেও স্ত্রীর জন্যে তাকে পিছিয়ে থাকতে হচ্ছিল। আচমকা একটা পাথর এসে তার পিঠে পড়তেই যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল ছোট গুদামবাবু। কিন্তু সেদিক নজর দেবার সময় কারো নেই। দিশেহারা অবস্থা তখন সবায়ের। ঠিক এই সময় বাবুদের চোখে পড়ল ওঁরা ছোটসাহেবের কারখানার সামনে এসে পড়েছেন। হই হল্লা শুনে ছোটসাহেব বাইরে বেরিয়ে এসে এই দৃশ্য দেখতে পেয়েই চিৎকার করে ওঁদের কারখানার ভেতরে ঢুকতে বললেন। যেন হঠাৎ মরূদ্যান দেখতে পেয়েছেন এই ভঙ্গিতে বাবুরা পিল পিল করে সপরিবার কারখানার মধ্যে ঢুকে পড়তেই ছোটসাহেবের নির্দেশে দরজা বন্ধকরে দেওয়া হল। বাইরে তখন প্রবল চিৎকার। কারখানার ওপর পাথর বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে। ছোটসাহেব চিন্তিত মুখে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনাদের কারো কিছু হয়নি তো! বড়বাবু বললেন, আর কী হবে, সর্বনাশ হয়ে গেল। আমাদের কুকুরের মত তাড়িয়ে নিয়ে এল। ওঁর গলাটা কান্নায় বুজে গেল।

ছোটসাহেব হাত নেড়ে তাকে থামিয়ে বললেন, আপনারা সবাই নিশ্চিন্তে এখানে বিশ্রাম নিন, আমি ওদের বুঝিয়ে বলছি। একপাশে ফ্রান্সিস জামা খুলে স্ত্রীকে পিঠ দেখাচ্ছে। পাথরের ধারে পিঠ কেটে গিয়ে রক্ত ঝরছে ফোঁটা ফোঁটা। ছোটসাহেব এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করতেই ফ্রান্সিস দুর্বল গলায় বলল, চোঙাসে খুন নিকলায়। সবাই ফ্রান্সিসের কালো চকচকে পিঠটা দেখছিল। বড়বাবু বললেন, নিজের জাতভাইকে যদি এই অবস্থা করে তাহলে আমাদের যে কী করবে ভাবাই যায় না। দিনকাল যে কি হল, বাগানের মালিক যেন ওরাই!

ছোটসাহেব অন্যমনস্ক গলায় বললেন, জাত তো এখন দুটো। তারপর পাশের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন।

.

কারখানার দরজার উপর তখন লাথি পড়ছে। মরিয়া হয়ে গেছে মুখগুলো। বাবুরা ডরপুকের মত এখানে লুকিয়ে আছে তাদের টেনে বের করতে হবে এইরকম একটা জিদ সবার মনে। আচমকা ছোটসাহেবকে দেখতে পেয়ে চিৎকারটা থমকে গেল। কিন্তু তারপরেই একজন ছুটে এসে দাবি জানাল, শালাদের বের করে দাও, দালালদের আমরা উচিত শিক্ষা দেব। কথাটা কানে যাওয়া মাত্রই সবাই হইহই করে ছোটসাহেবকে ঘিরে ধরল। ছোটসাহেব উত্তেজিত মুখগুলো দেখছিলেন। এদের সঙ্গে এখন যুক্তি দিয়ে কথা বলে কোনো লাভ হবে না। বেশি ভাগ মুখই অপরিচিত। এই সময় তার চোখ পড়ল সিরিল আর রেতিয়ার দিকে। দুজনে একপাশে দাঁড়িয়ে কিছু পরামর্শ করছে। চিৎকার করে সিরিলকে ডাকতেই সে এগিয়ে এল। তারপর দু পা ফাঁক করে অমিতাভের মত পোজ নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, তুই আমাদের বন্ধু না শত্রু?

কেন?

বন্ধু হলে দরজা খুলে দে।

দরজা খুলে দিলে কী করবি? ছোটসাহেব চোখের দিকে তাকালেন।

আমরা বদলা নেব। দালালদের শিক্ষা দেব।

সেটা করলেই তোদের ধর্মঘট সার্থক হবে?

সিরিল থমকে গেল প্রশ্নটা শুনে, কিন্তু পরক্ষণেই বলে উঠল, তুই ওদের বাঁচাচ্ছিস?

না, আমি তোদের বাঁচাচ্ছি। আজকে ওই কটা লোককে মারবি তোরা কিন্তু তারপর এই বাগান হয়তো চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। তখন খাবি কী? নিজেরা যে জন্যে ধর্মঘট করছিস সেটা সার্থক কর, এদের গায়ে হাত তুলে কী লাভ? দেখছিস তো এর মধ্যেই ওরা ভয়ে কেঁচো হয়ে গেছে। ছোটসাহেব বোঝালেন।

ভিড় থেকে একজন চিৎকার করে উঠল, ওসব কথা শুনছি না, দালালদের খুন চাই।

ছোটসাহেব বললেন, ঠিক আছে। মনে রাখিস এটা বাগানের জমি নয়। এখানে যদি কোনো হামলা হয় তবে তা ডাকাতি হবে। আর আমাকে খুন না করে কেউ দরজা খুলতে পারবে না। তোরা যদি চাস তবে তাই কর।

কথাটা শোনামাত্র গুঞ্জন উঠল চারধারে। যে উত্তেজনা নিয়ে একদল পালিয়ে যাওয়া লোকের পেছনে ছোটা যায় সেই উত্তেজনা এরকম ঠাণ্ডা গলায় বলা মানুষের সামনে দাঁড়ালে থাকে না। কেউ কিছু যখন স্থির করতে পারছে না তখনই সাঁই সাঁই করে একটা ঢিল ছুটে এল পেছন থেকে, এসে ছোটসাহেবের কপালে আছড়ে পড়তেই চিৎকার করে কপাল চেপে ধরলেন তিনি। দরদর করে রক্ত গড়িয়ে এসে জামা কাপড় ভিজিয়ে দিল তার। কুলিরা এমন হতভম্ব হয়ে গেল যে কয়েক মুহূর্ত কেউ কোনো কথা বলতে পারল না। রক্তে ছোটসাহেবের মুখ ভিজে যাচ্ছে। যন্ত্রণায় লোকটা কুঁকড়ে যাচ্ছে। সিরিল ছুটে গেল ওর কাছে। তারপর একটানে নিজের জামাটা খুলে ক্ষতস্থানে চেপে ধরে চিৎকার করে উঠল, যে শালা ঢিল ছুঁড়েছে তাকে ধরে আন এখানে।

হইহই করে ভিড়টা তালগোল পাকিয়ে গেল। তার মধ্যে দেখা গেল একটা শরীর তিরের মত উলটো দিকে দৌড়ে যাচ্ছে। কয়েকজন তার পেছন তাড়া করলেও শেষে ধরতে না পেরে ফিরে এল। পিছু ধাওয়া করার চেয়ে এখানেই বেশি আকর্ষণের নাটক আছে যা ছেড়ে যেতে ওদের মন চাইছিল না।

ছোটসাহেবকে নিয়ে সিরিল রেতিয়া পাশের ডাক্তারখানায় এল। অনেকটা গর্ত হয়েছে। ডাক্তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিয়ে বললেন, এটা পুলিস কেস হতে পারে, থানায় খবর দেওয়া দরকার। ছোটসাহেবের মাথায় সাদা ব্যান্ডেজে লাল ছোপ, বলল, না, তার দরকার নেই। আপনাকে অনেকে ধন্যবাদ।

সাহায্য চাইছিল না ছোটসাহেব কিন্তু সিরিলরা কিছুতেই ওকে ছাড়ল না। ধরে ধরে নিয়ে এল কারখানার ওপরের ঘরে। চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে সিরিল বলল, তোর জন্যে এবার ওরা বেঁচে গেল। আমি সবাইকে নিয়ে ফিরে যাচ্ছি, কিন্তু তুই ওদের বলে দিস যেন হরতাল শেষ হবার আগে কেউ যেন বাগানে না যায়।

আচমকা এতবড় নাটকের এইরকম পরিসমাপ্তিতে অনেকের মন ভরছিল না। কারখানার সামনে জমায়েত কুলিরা সিরিলদের সিদ্ধান্ত অনেক তর্কবিতর্কের পর মেনে নিল। ছোট ছোট দলে ওরা সরে যেতে থাকল ওখান থেকে। কারখানার ভেতরে বাবুদের বুকের ধুকপুকুনি তখনই চলছে। দরজার ফুটো দিয়ে ছোটসাহেবের আহত হবার দৃশ্যটা ওঁরা দেখেছেন। ছোটসাহেব যদি আহত হন তাহলে ওদের যে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী এ তথ্য আবিষ্কৃত হওয়ায় মেয়েদের মধ্যে কান্নার রোল উঠেছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ চেঁচামেচির পর যখন কুলিরা ফিরে গেল তখন ওঁরা ভীষণ অবাক হয়ে গেলেন। বাইরে বেরতে সাহস হচ্ছে না অথচ এই বন্ধ ঘরে বেশিক্ষণ থাকাও যায় না। প্রায় ঘণ্টা দুই বাদে ছোটসাহেব নিচে নেমে এল, বাবুদের চেহারা দেখে আচমকা খাঁচার মুরগির কথা মনে হল তার।

ছোটসাহেব বলল, আপনারা এবার ফিরে যান। ইচ্ছে হলে কোয়ার্টারে যেতে পারেন নাহলে অন্য কোথাও। আমি ওদের কথা দিয়েছি যে হরতাল চলার সময়ে আপনারা কাজে বের হবেন না।

বড়বাবু মুখ কাঁচুমাচু করে বললেন, সাহেব যে মাইনে কাটবে অফিসে না গেলে–এটাও তো সমস্যা। বুঝতেই পারছেন।

ছোটসাহেব যেন নিজেকে আর সামলাতে পারল না, চিৎকার করে বলল, এতক্ষণ আপনারা কী করছিলেন? মুরগির মত ওদের ভয়ে লুকিয়ে ছিলেন। যখন আপনাদের প্রাণসংশয় হয়েছিল তখন কোম্পানি আপনাদের কি হেল্প দিয়েছে? বড়সাহেব আপনাদের বাঁচিয়েছে? ছি ছি ছি, আপনাদের এইরকম দাস মনোভাবের জন্যেই কোম্পানির সব কিছু সহজে করে যেতে পারে। যাক, আমার যা বলার তো বলে দিলাম, এখন নিজের মর্জি মত কাজ করুন।

মুখে যাই বলুন বাবুদের আর কোয়ার্টারে ফিরে যাওয়ার সাহস ছিল না। বিরাট এলাকা নিয়ে এক একটা কোয়ার্টার। রাত দুপুরে চিৎকার করলেও পাশে কোয়ার্টারের মানুষ বেরুবে না। নির্জন চা বাগানের কাছাকাছি থানা আট মাইল দূরে। অতএব যাদের ভরসায় এতদিন এখানে প্রতাপে থাকা গেছে তারাই যদি আতঙ্কের কারণ হয় তাহলে থাকার প্রশ্নই ওঠে না। দেখা গেল চৌমাথায় গিয়ে সবাই জলপাইগুড়ি কিংবা আলিপুরদুয়ারের বাস ধরলেন।

বাবুরা চলে যাওয়ার ঘণ্টা তিনেক বাদেই একটা জিপ এসে থামল ছোটসাহেবের কারখানার সামনে। পাঁচটা স্টিচ হয়েছে, দুর্বল ছোটসাহেব একটা ইজিচেয়ারে শুয়েছিল কারখানার ভেতরেই। জিপ থেকে যিনি নামলেন তাকে দেখে বিব্রত হল ছোটসাহেব। উঠে বসতে চেষ্টা করতে দু হাত তুলে তাকে নিষেধ করলেন এই চা বাগানের সর্বময় কর্তা বড়সাহেব। বৃহৎ চেহারার এই উত্তরপ্রদেশীয় মানুষটি যথেষ্ট শক্তিশালী। ছোটসাহেব এঁর আগমনে বেশ অবাক হয়ে তাকিয়েছিল কারণ চাকরি ছেড়ে দেবার পর এঁরা কখনো সামান্য সৌজন্য দেখিয়ে এই কারখানার সামনে গাড়ি দাঁড় করাননি।

বড়সাহেব চিবোনো ইংরেজিতে বললেন, আমি অত্যন্ত দুঃখিত যে ওরা তোমাকে এরকম আহত করেছে। যাহোক, তুমি এখন কেমন আছ?

ছোটসাহেব বলল, এমন কিছু ব্যাপার নয়, সামান্য রক্ত পড়েছিল। বসুন।

না না, বসার জন্যে আসিনি। তুমি বাবুদের সেভ করার জন্যে এতবড় রিস্ক নিয়েছি এটা গর্বের কথা। যাহোক, তুমি অ্যাকশন নেবে ভেবেছ?

অ্যাকশন! কী ব্যাপারে?

ওহো! তোমার রক্তপাতের জন্য যারা দায়ী তাদের শাস্তি হওয়া দরকার। তুমি আমার সঙ্গে থানায় চলো। তোমার ডায়েরি নেবার পর পুলিস বাগান রেইড করে যারা দোষী তাদের তুলে নিয়ে যাবে। আমি তাদের উচিত শিক্ষা দিতে চাই। তুমি কি নিজেই উঠতে পারবে?

একটুও চিন্তা না করে মাথা নাড়ল ছোটসাহেব, দুঃখিত। আমার আহত হবার জন্যে কাউকে দায়ী করতে চাই না। আপনি এই ব্যাপারে চিন্তা না করলেই খুশি হব।

ওয়েল, তুমি আমাকে সাহায্য করলে না? আফটার অল তুমি একদিন ম্যানেজার ছিলে। বড়সাহেব ছটফট করছিলেন।

ছিলাম, এখন তো নই। ওরা উত্তেজনায় যে কাজ করেছে আমরা ঠাণ্ডা মাথায় তার প্রতিশোধ নিতে চাইলে কোনোদিনই ব্যাপারটার শেষ হবে না। অতএব এটা ভুলে যাওয়াই ভাল। ছোটসাহেব হাসল। কথাটা শোনার পর আর একটুও দাঁড়াননি বড়সাহেব! জিপ নিয়ে সোজা বাগানে ফিরে গিয়েছিলেন। সন্ধের পর খবর রটে গেল যে বড়সাহেব জিনিস গুছিয়ে বাগান ছেড়ে চলে গিয়েছেন। যাওয়ার আগে অফিস বাড়ি এবং চায়ের ফ্যাক্টরির দরজায় নিজের হাতে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন। আর সেই সময়েই হাসপাতাল বন্ধ হয়ে যায়। ডাক্তারবাবুও একা এই বাগানে থাকতে সাহস পাননি। ফলে এখন সমস্ত চা বাগান খাঁ খাঁ করছে। কোথাও কোনো শব্দ নেই।

উত্তেজনায় যদি নিয়মিত তাত না লাগে তাহলে তা দীর্ঘ জীবন পায় না। বাবুরা নেই, সাহেবও নেই, কুলিদের মধ্যে ঝিমুনি এসে গেল। হপ্তার মাইনে না পাওয়ার পর লাইনে লাইনে সাইকেলে কাবুলিওয়ালা আসা-যাওয়া শুরু হল। সবাই ধার করছে, হরতাল মিটলেই বোনাস পেয়ে শোধ করবে। চার হপ্তার টাকা জুড়লে তিনশো টাকা হয়। বিশ পার্সেন্ট বোনাস মানে সাতশো টাকার ওপর পাওনা হবে। এ ব্যাপারে কারো মনে কোনো দ্বিধা নেই। কোলকাতায় কোম্পানি য়ুনিয়নের বাবুদের ডেকে পাঠিয়েছে। মিটমাট হলেই বাগান খুলবে। যে কদিন তা না হচ্ছে সে কদিন। চালাবার জন্যে ধার করতে হবে।

কিন্তু দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষেও ফয়সালা হল না। সিরিলরা যতই বোঝাক সাধারণ কুলিরা কিছুতেই তাতে রাজি হচ্ছে না। খাওয়ার সমস্যা মেটাতে সংগ্রাম তহবিল থেকে লাইনে লাইনে চুল্লি জ্বালানো হয়েছিল। তাতে দুবেলা খিচুড়ি তৈরি করে সবাইকে দেওয়া হতো। কিন্তু নেতাদের কোলকাতায় যাওয়া থাকার টাকার প্রয়োজনে ব্যাপারটা বাতিল করতে হওয়ায় অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ল সবায়ের মনে। মাংরা সর্দার তার বয়সীদের নিয়ে য়ুনিয়ন অফিসে এসে প্রকাশ্যে গালাগাল করে গেল। সিরিলদের হঠকারিতায় এসব ঘটনা ঘটছে। বেশি লোভেই সর্বনাশ ডেকে আনে। এই চা-বাগানে এত পাতা থাকতেও সাধারণ কুলিরা প্রায় অনাহারে দিন কাটাচ্ছে–সেজন্যে এরাই দায়ী। সিরিলরা বোঝাতে গিয়েছিল নেতাদের কথামত, বৃহৎ স্বার্থে জন্য ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করতে হয়। আন্দোলন বাঁচাতে অনেক কষ্ট স্বীকার করতে হয়, এ তো তুচ্ছ।

কিন্তু হাতের কাছে চা পাতা, পেটে খিদে, এক জ্যোছনার রাতে সব মানুষ পিল পিল করে বেরিয়ে এসে নিজের ব্যবস্থা করে নিল। চা-বাগানের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে তারা সেই জ্যোছনায় মিশে চায়ের পাতা তুলতে লাগল। এরই মধ্যে একজন পাশের চা বাগানের মালিকের সঙ্গে কথা বলে এসেছেন। তাঁকে লোক রেখে মাইনে বোনাস মিটিয়ে কাজ পেতে হয় তার চেয়ে অনেক অল্প পয়সায় প্রোডাকশন পেলে তিনি খুশিই হবেন। তার ওপর নিজের চা-পাতা। অক্ষত থাকল অথচ কাজও ভালভাবে চলল। ভোর হবার আগেই ঝুড়ি ভর্তি পাতি নিয়ে হরতালি শ্রমিকরা যাত্রা করল পাশের চা বাগানের উদ্দেশে। না, সেই চা-বাগানের ফ্যাক্টরি অবধি এরা যাবে না, কাছাকাছি একটা খোলা মাঠে ট্রাক্টর থাকবে ক্যারিয়ার নিয়ে। সেখানে চা-পাতি মেপে নগদ বিদায় করা হবে। এমন অভিজ্ঞতা এর আগে কখনো হয়নি। বস্তুত চা বাগানের মধ্যে একটা রেষারেষি রয়েছে চিরকাল। এই বাগানের চা ওই বাগানের চেয়ে ভাল এরকম একটা গর্ব নিয়ে প্রায়ই তর্ক চলে। এই রাতের আলোয় পাতি আহরণে মাংরা সর্দার যোগ দেয়নি। এরকম দৃশ্য দেখতে গিয়ে তার শরীর জ্বলছে। নিজেদের ফ্যাক্টরি নিঃশব্দ হয়ে রয়েছে আর অন্যের ফ্যাক্টরির যন্ত্রগুলো এই পাতিগুলোকে পিষবে–এব ভাবা যায় না। অর্থকষ্ট আছেই, হপ্তা না পেয়ে ধার বাড়ছে এবং এসবের জনে দায়ী হল ওই সিরিলরাই কিন্তু সেকারণে নিজের বাগানের পাতা অন্যের হাতে তুলে দিতে হবে? সিরিলরা শেষ পর্যন্ত এই অপহরণপর্বে অংশ নিতে পারল না। ওরা দেখল পাশের বাগানের শ্রমিকরা এ ব্যাপারে খুব ক্ষুব্ধ। কারণ তারা সারাদিন খেটে পাতি তুলে মালিকের কাছে যে অর্থ পায় তাতে তাদের একটা সন্তুষ্টি আছে। কিন্তু মালিক যখন বিনা ঝামেলায় অন্য বাগানের পাতি পেয়ে যাচ্ছে অনেক কম খরচে তখন ওই বাগানের শ্রমিকেরা ভয় পেয়ে যাবেই। সিরিলরা দেখল পাতি কিনতে গিয়ে ওই বাগানের মালিক অবিশ্বাস্য কম দাম দিচ্ছে। কারণ তারা জানে এই বাগানের শ্রমিকদের তা না নিয়ে কোনো উপায় নেই। সিরিল পিছিয়ে গেলেও সাধারণ শ্রমিকরা কিন্তু তখন মরিয়া। লাইন বেঁধে ঝুড়িগুলো চলল এই বাগান ছেড়ে।

ট্রাক্টর দাঁড়িয়ে আছে ক্যারিয়ার নিয়ে। একটু চুপচাপ, গোপনীয়তা যেন সবার হাবভাবে। এক চা-বাগানের মালিক প্রকাশ্যে অন্য চা-বাগানের পাতি কিনতে পারেন না তার মালিকের অজান্তে। গুরুতর অপরাধ এটি। তাই একটা তাড়াহুড়ো ভাব আছে, যত শিগগির কাজ শেষ করা যায় ততই মঙ্গল কিন্তু তার আগেই হইহই শব্দ উঠল। ক্রেতা চাবাগানের শ্রমিকরা দলে দলে ছুটে আসছে বাধা দিতে। তারা কিছুতেই মালিককে অন্য বাগানের পাতি কিনতে দেবে না। বিক্রেতারা প্রতিরোধ করার সাহসই পেল না কারণ ওদের উপস্থিতি টের পেতেই ট্রাক্টর ক্যারিয়ার নিয়ে হাওয়া হয়ে গেল।

ক্লান্ত কুলিরা দুপুর রোদে ঝুড়ি বোঝাই পাতি নিয়ে ফিরে এল নিজের লাইনে। এখন হতাশা চারধারে। হরতালের নেতারা সামনে আসছে না।

শুকরা বুড়ো মাচায় বসে ব্যাপারটা শুনল। পিছ করে থুতু ফেলে বলে উঠল, মর শালারা, মর। যেমন লোভ হয়েছে সাহেবদের সঙ্গে লড়ার, ঠিক হয়েছে। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে বলে উঠল, ব্যাটাদের মাথায় বুদ্ধি নেই এক ফোঁটা! নিজের বেইজ্জত নিজের হাতেই করলি! কেন হাত মাড়াই ছিল না? নিজের হাত থাকতে পরের কাছে ভিক্ষে চাইতে গেলি সব! হাতমাড়াই কর।

ব্যস। সঙ্গে সঙ্গে লাইনে লাইনে কথাটা কানাকানি হয়ে গেল। হাতমাড়াই শুরু কর। ধান শুকুবার মত চায়ের পাতা বিছিয়ে দেওয়া হল রোদে। এই রোদ এই মেঘ। বৃষ্টি এলেই হইহই করে ঘরে তোলে। আবার কড়া রোদ এলে মুখে হাসি। রোদে পোড়া পোড়া হতে লাগল নধর চায়ের পাতাগুলো। লাইনময় তারই গন্ধ ছড়ানো।

চা গাছের পাতা আর বাক্সের চায়ের মধ্যে অনেকরকম কার্যপ্রকরণ আছে। কচি কুঁড়ি আর নধর পাতা তুলে ঝুড়িতে করে যা ফ্যাক্টরিতে আসে তা চায়ের আকার নিতে অনেক প্রক্রিয়া এবং পরিশ্রমের সাহায্য নেয়। তাপ যত বাড়ে লিকার তত গাঢ় হয়, শীতলতায় শুধু সুগন্ধ বহন করে। এই শর্ত গাছে থাকতেই চা পাতায় আসে। দার্জিলিং-এর পাতায় তাই গন্ধ বেশি, ডুয়ার্সের সমতলে লিকার বাড়ে। ফ্যাক্টরির একটি শর্টকার্ট ব্যবস্থা চালু আছে। রোদে শুকিয়ে পাতাগুলোকে ঝুরু ঝুরু করে নিয়ে হাতের তেলোয় ডলতে ডলতে তাকে গুঁড়ো করে ফেলে পানীয় চায়ের আকার দেয় ওরা। স্বাদে নিশ্চয়ই খামতি থাকে, মানের পাল্লায় পিছিয়ে যায় অনেক, কষা স্বাদই বেশি কিন্তু তাই কেনার জন্য মুদিখানার মালিকরা নারাজ নয়। কাজটা অত্যন্ত পরিশ্রমসাধ্য। সারাদিন খেটে সামান্যই চা তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু লাইনের কুলিরা এই হাতমাড়াই-এর লেগে গেল।

একমাত্র ভাটিখানায় ধারে মদ পাওয়া যায়। তৃতীয় সপ্তাহের শেষে শ্রমিকরা যেন হাঁড়িয়া খেয়েই শুয়ে থাকল লাইনে লাইনে। মেয়েরা হাতমাড়াই করে সেই চা বিক্রির টাকায় উনুন ধরায়। শুকরা বুড়ো সবাইকে ডেকে ডেকে বলে, এখান থেকে পালা সব। ওই চা বাগান বন্ধ হলে আমাদের পেটে ভাত পড়বে না। এক ফালি জমি নেই যে চাষ করবি! তার চেয়ে চল সবাই মিলে টেবুয়াতে। সেখানে গিয়ে মাটিতে ফসল ফলাবি। এতদিনে অনেক বৃষ্টি পড়েছে সেই মাটিতে। নিশ্চয়ই উর্বর হয়েছে সে ভিজে ভিজে। এতদিন যে কথাগুলো শুনে সবাই হাসত এখন তাতে খটকা লাগে অনেকের। এইভাবে আধপেটা হয়ে মালিকের দয়ার জন্যে না বসে থেকে শুকরা বুড়ো যা বলছে তা শুনলে কেমন হয়? কিন্তু এই মাটি চা বাগান ছেড়ে অনিশ্চয়তায় পা বাড়াতে আড়ষ্ট হয়ে যায় সবাই। দলে দলে এসে সারাদিন য়ুনিয়ন অফিসের সামনে ভিড় করে। চুপচাপ চেয়ে থাকে যদি খবর পাওয়া যায়। হাত-মাড়াই করতে গিয়ে অনেকের হাতেই একধরনের ঘা দেখা দিয়েছে।

কোলকাতা থেকে শেষ পর্যন্ত খবর এল। মালিক হেরে গিয়েছে।

সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ বইল শরীরে শরীরে। য়ুনিয়ন অফিস থেকে ঢোল মাদল নিয়ে শোভাযাত্রা বেরিয়ে এল। ইয়ে বাগান হামারা হ্যায়। খুন দো ইজ্জত নেহি! কুড়ি দিনের দিন কোম্পানি মেনে নিল শ্রমিকদের দাবি। এই কুড়ি দিন কোনো মাইনে পাবে না শ্রমিকরা। না পাক, সিরিলরা বোঝাল, সারাজীবনের লাভের জন্য কুড়ি দিন সহজেই ত্যাগ করা যায়। একটা শ্রমিক যদি মাসে তিনশো টাকা বেতন পায় তাহলে সাতশ টাকার ওপর বোনাস পাবে। তাই কুড়ি দিনের দুশো টাকা মাইনে স্বচ্ছন্দে ছেড়ে দেওয়া যায়। উৎসবের চেহারা নিল লাইনগুলোর।

কিন্তু বিকেলেই খবরটা এল। কোম্পানি মেনে নিয়েছে দাবি। য়ুনিয়নের দাবি ছিল বিশ পার্সেন্ট কোম্পানি দিতে চেয়েছিল সাড়ে আট। সেটা দশে রফা হয়েছে। কোম্পানির পরাজয়, কারণ সাড়ে আট থেকে দশে উঠতে হয়েছে তাদের এটা শ্রমিকদেরই জয় বলে নেতারা মনে করছেন। বিপ্লব একদিন হয় না, ধীর পায়ে লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হয়।

সিরিলরা খবর পেয়ে থমকে গেল। লাভ হল তাহলে মাত্র দেড় পার্সেন্ট। তার মানে চুয়ান্ন টাকার মতন। দুশো টাকা ক্ষতি করে চুয়ান্ন টাকা লাভের মধ্যে কী ধরনের বিজয় থাকতে পারে? তার উপর, এই কুড়ি দিনে কাবুলি থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় যে ধার শ্রমিকরা করেছে তার সুদ তো ওই চুয়াম টাকায় কুলোবে না। তাহলে? কী করে শ্রমিকদের কাছে মুখ দেখাবে সিরিলরা। মাংরা সর্দাররা এখন হাসবে, বলবে কাদের কথায় তোরা বিশ্বাস করেছিলি দ্যাখ? মদেসিয়া ছেলেরা দরজা বন্ধ করে আলোচনায় বসল। প্রত্যেকেই উত্তেজিত। এই ধরনের ফালতু বিজয় তারা চায় না। হয় বিশ পার্সেন্ট বোনাস চাই নইলে কুড়ি দিনের মাইনে কাটা চলবে না।

আলোচনা যখন উত্তপ্ত তখন সিরিল উঠে দাঁড়াল। তার দিকে তাকিয়ে থাকা মুখগুলোর দিকে সে অমিতাভ বচ্চনের মত তাকাল। গলা পরিষ্কার করে বলল, নেতাদের এই সিদ্ধান্ত আমরা মানব না। কিন্তু একথা ঠিক আমরা যদি আরো কিছু দিন বিশ পার্সেন্টের জন্য হরতাল চালাই তো সবাই আমাদের ছেড়ে যাবে। নেতারা বিগড়াবে। তাই আমার মাথায় সম্পূর্ণ অন্য চিন্তা এসেছে। তোমরা যদি সবাই হাত মেলাও তো কারো কোনো অসুবিধে হবে না। আমরা দেখাতে পারব যে আমাদের কম শক্তি নেই।

সবাই কিছুটা সন্দেহ এবং আগ্রহ নিয়েই সিরিলকে দেখল। ঘোলা জলে পাক খেতে খেতে হঠাৎ যদি কেউ পায়ের তলায় নিটোল মুক্তো দেখায় তখন বুক খুলে বিশ্বাস করতে অসুবিধে হয়। রেতিয়া বলল, রাস্তাটা বল।

সিরিল বলল, এক মাস কাজ করে যে টাকা আমরা পেতাম তা তিন ভাগের দুই ভাগ মার হয়ে যাবে কুড়ি দিন হরতালের জন্যে। বেশি যে টাকা বোনাস আমরা পাচ্ছি তাতেও লোকসান মিটবে না। এখন, বাকি দশ দিনে যদি আমরা পুরো মাসের কাজ করে দিই তাহলে সাহেবকে বলতে পারব যে পুরা মাইনে দিতে হবে।

কেন দেবে? আর একজন চিৎকার করল।

কেন দেবে না? এক মাস কাজ করলে সাহেব যে প্রোডাকশন পেত তাই আমরা দশ দিনে। করে দেব। সাহেবের কোনো লোকসান না হলে আমাদের কেন দেবে না? আমি যা বলছি তা বুঝতে পারছ? সিরিল দু হাত নেড়ে বোঝাতে চাইল।

কিন্তু দশ দিনে কি এক মাসের কাজ করা সম্ভব? পাগলামি। একজন বেজার মুখে জানাল, না, তা সম্ভব নয়। এমনিতেই দিনের কাজ শেষ হতে চায় না তো আড়াইগুণ কাজ করতে বললে সবাই যেন করবে।

রেতিয়া উঠল, করতে হবে। আমরা সবাইকে বোঝাব। সিরিল যা বলছে তা করতে পারলে সবাই পুরো টাকা আদায় করতে পারবে।

গুঞ্জন বিশ্বাস আর অবিশ্বাসে টলতে লাগল। অলস এবং কিছুটা কর্মবিমুখ প্রৌঢ়দের সহযোগিতা কতটা পাওয়া যাবে তাই নিয়ে রাত দুপুর পর্যন্ত আলোচনা চলল। য়ুনিয়নের নেতারা অপমানিত হতে পারেন এই ভেবে যে তাদের নির্দেশ অমান্য করা হয়েছে। কিন্তু সিরিল বলল, এই দেশ আমাদের দেশ, এই বাগান আমাদের রক্ত দিয়ে তৈরি। এর বাঁচা মানে আমাদের বাঁচা। ইয়ে বাগান হামারা মা, তাই কেউ রাগুক কিংবা আমাদের ছেড়ে যাক তাতে আমাদের কিছুই এসে যায় না। আমরা জানব, আমরা আমাদের মায়ের সেবা করছি।

কথাটা সবার মনে লেগে গেল। সেই রাতেই হইহই করে বেরিয়ে পড়ল। সবাই লাইনে লাইনে লোক চলে গেল বোঝাতে। আগামী দশ দিন ছেলেবুড়ো সবাইকে দিনরাত খাটতে হবে। যতটুকু বিশ্রাম না নিলে নয় তার বেশি কেউ নেবে না। এখন জোছনার রাত, আকাশে মেঘ না থাকলে পাতি তোলার কাজ চলবে রাতেও। সদারদের একসঙ্গে ডেকে সিরিলরা এ ব্যাপারে যা করার তা করতে অনুরোধ করল। এ ধরনের অমানুষিক এবং অস্বস্তিকর কাজের কথা চিন্তা করে সর্দাররা ইতস্তত করছিল। কোম্পানি থেকে মাইনে ছাড়া বেশি কিছু পাওয়া যাবে না। এমনকি সাহেব সন্তুষ্ট হবেন কি না তাও বোঝা যাচ্ছে না। কটা টাকার জন্যে এইরকম ফালতু ঝামেলা জড়ানো ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছিল না ওরা।

সিরিল সোজা মাথা নিচু করে হেঁটে এসে মাংরা সর্দারের সামনে এসে দাঁড়াল। লাঠির ঠেক দিয়ে অন্য সর্দারের সঙ্গে দাঁড়িয়ে মাংরা একটু বিরক্তমনে কথাগুলো শুনছিল। ছেলেকে এগিয়ে আসতে দেখে একটু সচকিত হয়ে মুখ অন্যপাশে ঘুরিয়ে নিল। মাংরা সর্দারের সামনে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল সিরিল। তারপর খুব গাঢ় গলায় বলল, বাপ, আমরা প্রমাণ করব এই জায়গা আমাদের। তুমি সাহায্য করে।

মাংরা সর্দারের বুকের মধ্যে একটা কিছু পাক খেয়ে উঠল। সে কথা বলল না। সিরিল বলল, বুড়া বাপ যা বলে তার কাছে ঠিক কিন্তু আমার কাছে নয়। তোমার কাছে কি ঠিক বাপ?

ঠিক সেইসময় একটা চিৎকার ভেসে আসতে সবাই চমকে ফিরে তাকাল। একটি কিশোরী ছুটতে ছুটতে চিৎকার করে সিরিলকে ডাকছে। কাছাকাছি হয়ে সে জানাল নিরির যন্ত্রণা হচ্ছে। বাচ্চা হবে এখনই। সিরিলকে দেখতে চাইছে সে।

কথাটা শোনামাত্র মাংরা সর্দার বাঘের মত লাফিয়ে উঠল। ছেলেকে ধাক্কা দিয়ে তোর মাকে নিয়ে আয়। আমার নাতি হচ্ছে। কথাটা শেষ করেই সে ছুটল সিরিলদের নতুন ঘরের দিকে। সিরিল নিজের চোখ-কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। আজও সে নিরিকে দেখে এসেছে স্বাভাবিক চেহারায়। এত জলদি যে বাচ্চাটা আসবে ভাবাই যায় না। আর সেই খবর শুনে বাপের যে এই রকম প্রতিক্রিয়া হবে তাই বা কে জানত।

সিরিলের মা খবর পেয়ে ছেলের ঘরে আগেই পৌঁছে গিয়েছিল। সিরিল যখন তার ঘরের কাছে পৌঁছালো তখন মাংরা সর্দার দরজার বাইরে উবু হয়ে বসে আছে। ভেতরে মেয়েদের। কথাবার্তা। এই মুহূর্তে সিরিলের সব রকম সপ্রতিভতা অসাড় হয়ে গিয়েছিল। চারধার চুপচাপ। এবং তারপরেই সেই আকাঙ্ক্ষিত কান্নাটা শোনা গেল। একটি মেয়ে বাইরে মুখ বাড়িয়ে জানিয়ে দিল, ছেড়িয়া হোলাক রে।

সঙ্গে সঙ্গে মাংরা সর্দার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বুকে কাঁধে হাত ছুঁইয়ে দু হাত জোর করে আকাশের উদ্দেশে প্রণাম জানাল। বন্ধুরা সব আনন্দ জানাতে সিরিলকে জড়িয়ে ধরেছে। মিষ্টি খাওয়াবার আবদার করছে সব। সিরিল কোনরকমে তাদের হাত থেকে রেহাই নিয়ে বাপের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মাংরা সর্দারের তখন অন্য চেহারা। ছেলেকে হুকুমের গলায় বলল, এদিকটা তোমরা দেখবে। তুই সবাইকে কাজে যেতে বল। দশ দিনে এক মাসের কাজ হওয়া চাই।

.

ঠিক উৎসব বললে কম হবে। এখন চাবাগানে তার চেয়ে বেশি কিছু হচ্ছে। বাবুরা নেই, সাহেবও নেই। সিরিল ছোটসাহেবের সঙ্গে দেখা করল। ভদ্রলোক এখন বেশ দুর্বল। সিরিলের মুখে পরিকল্পনা শুনে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞাসা করল ছোটসাহেব, পারবি?

জরুর।

কিন্তু, ফ্যাক্টরিতে নিশ্চয়ই তালা দিয়ে গেছে বড়সাহেব। তালা ভাঙলে থানা-পুলিস হতে পারে। বাবুরা নেই, তোরা নিজে নিজে প্রোডাকশন চালাতে পারবি?

বাবুরা তো শুধু হিসাব রাখত, কাজ যা করবার আমরাই করতাম। তালা ভাঙার জন্যে পুলিস ধরে তো পুরো লাইনকে ধরতে হবে। কিন্তু কাজ পেলে কি সাহেব খুশি হবে না?

বলা শক্ত। কিন্তু তোরা কর। এরকম জিনিস কেউ করে না। সবাই কিছু না দিয়েই পেতে চায়। তোরা দেখিয়ে দে তোরা যোগ্যতা দেখিয়ে অর্জন করতে পারিস। কিন্তু সাবধান, কোনো গোলমাল করিস না।

ছোটসাহেব আর একটা কথা বলল, সবাই কাজ করবে কথা দিয়েছে, মেনে নিয়েছে?

হ্যাঁ। বুড়োদের আপত্তি ছিল, এখন হাওয়া দেখে রাজি হয়েছে।

তাহলে একটা কাজ কর। তোরা দল বেঁধে গিয়ে ভাটিখানার মালিককে অনুরোধ কর আগামী দশ দিন দোকান বন্ধ রাখতে। ওটা খোলা থাকলে কাজ করানো মুশকিল হয়ে যায়। সাদা চোখে একরকম কিন্তু নেশায় ডুবলে কোন হুঁশ থাকলে না।

ছোটসাহেবের কথাটা তাৎপর্য বুঝতে অসুবিধে হল না সিরিলের। রেতিয়াদের বলতেই সবাই দল বেঁধে ছুটে গেল চৌমাথায়। অনেক কথা কাটাকাটি হুজ্জোতের পর ভাটিখানা দশ দিনের জন্য বন্ধ হল। এরা শাসিয়ে এল যদি এই সময়ের মধ্যে কোন শ্রমিককে মদ বিক্রি করা হয় তাহলে ভাটিখানা জ্বালিয়ে দেওয়া হবে।

কাজ শুরু হয়ে গেল। দীর্ঘদিন বাদে হুইল চলল নদীতে, ফ্যাক্টরিতে পরিচিত শব্দটা বাজতে লাগল। সাহেব নেই, বাবুরাও নেই তাতে উৎসাহ বেড়ে গেল যেন সবার। এটা হুকুমের কাজ নয়, নিজের প্রয়োজনের কাজ–এই বোধ প্রত্যেকের মনে। তিন শিফটে দিনরাত কাজ হয়ে যাচ্ছে। সিরিলরা পালা করে ডিউটি দিচ্ছে। কাজের গতি দেখে সর্দাররাই অবাক। তারা এতকাল চিৎকার চেঁচামেচি মারের ভয় দেখিয়েও এর অর্ধেক কাজ কখনো আদায় করতে পারেনি। অভিজ্ঞতা হিসেব করে বলল এইরকম কাজ যদি চলে তাহলে নদিনের মাথায় এক মাসের প্রোডাকশন হয়ে যাবে। সবকটা মেশিন একসঙ্গে চলছে, বাছাই পাতি শুকোবার জন্যে যে তারের স্লাভ ছিল তাতে জায়গা হচ্ছে না। গরম হাওয়ার মেসিন চালিয়ে পাতাগুলোকে মুচমুচে করে নেওয়া হচ্ছে।

তিন দিনের মাথায় য়ুনিয়নের বাবুদের নিয়ে সাহেব বাগানে ফিরলেন। ফিরে ব্যাপার দেখে তাজ্জব। তার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া তিনি বাংলোয় গিয়ে জানালেন। য়ুনিয়নের বাবুরা সেখানে ছিল। সিরিল আর রেতিয়া প্রতিনিধি হিসেবে ওঁদের মুখোমুখি হল।

বড়সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ফ্যাক্টরি চলছে কেন?

সিরিল উত্তর দিল, কাজ হচ্ছে তাই?

বড়সাহেব চিৎকার করে উঠলেন, কার হুকুমে কাজ হচ্ছে। আমি ফ্যাক্টরিতে তালা দিয়ে গিয়েছিলাম। সেই তালা খুলল কে? আমি এখনই থানায় খবর দিচ্ছি। আমার দামি দামি মেসিন আছে ওখানে। একটা যদি চুরি যায় তাহলে তার জন্য কে দায়ী হবে?

রেতিয়া বলল, নেহি সাহেব, হামলোক ঠিক খেয়াল রাখা হ্যায়।

হু আর ইউ? কে তোমাদের অর্ডার দিয়েছে ফ্যাক্টরি চালাতে?

সিরিল জবাব দিল, আমরা সবাই মিলে ঠিক করেছি।

এবার য়ুনিয়নের বাবু বললেন, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না তোরা এই কাজটা কেন করলি। কোম্পানি আমাদের দাবি কিছুটা মেনে নিয়েছে। এটা আমাদের জয়। কোথায় তোরা ফুর্তি করবি না ফ্যাক্টরি চালিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছিস? কার মতলবে চলছিস তোরা? সাহেব ঠিক বলছে, যদি তোদের নামে পুলিস কেস হয় তাহলে কিছু করার থাকবে না।

সাহেব বললেন, অন্য সময় তো কাজ করাতেই পারি না। নো নো দেওয়ার মাস্ট বি সাম প্ল্যান! কে তোমাদের সুপারভাইজ করছে?

আমরাই।

দেন এগেন, হোয়াই? কেন ফ্যাক্টরি চালাচ্ছ তোমরা উইদাউট মাই পারমিশন? বড়সাহেব ভেবে পাচ্ছিলেন না।

তখন আপনারা কেউ ছিলেন না যে জিজ্ঞাসা করব।

তাহলে অপেক্ষা করলে না কেন?

অপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না।

হোয়াই?

ধর্মঘটের কুড়ি দিন কি আমরা মাইনে পাব সায়েব?

নো নো। তোমাদের য়ুনিয়নের সঙ্গে সেই চুক্তিই হয়েছে। নো ওয়ার্ক নো পে।

কেন?

গুড গুড। তোমরা কুড়ি দিন কাজ করোনি বলে আমাদের প্রোডাকশন হয়নি। আমরা ব্যাডলি সাফার করেছি। যেখানে আমার কোনো লাভ হচ্ছে না আমি কেন তোমাকে পয়সা দিতে যাব?

ঠিক তাই। কিন্তু যদি আমরা বাকি দশ দিনে এক মাসের কাজ তুলে দিই, যদি প্রোডাকশন ঠিক থাকে তাহলে পুরা মাসের টাকা আমাদের দিতে হবে।

হাউ ফানি! দশ দিনে এক মাসের কাজ করবে তোমরা! হা হা হা! এইরকম প্রতিজ্ঞা আরো আগে কেন এল না মনে? ফ্যাক্টরিতে তাহলে দিন রাত কাজ হচ্ছে!

হ্যাঁ। রাতেও পাতি তোলা হচ্ছে।

শোনো, যদি তোমরা দশ দিনে ওই প্রোডাকশন শেষ করতে পার তাহলে আমি আর এই নিয়ে হইচই করতে যাব না। কিন্তু তা যদি না হয় তাহলে আমি ছেড়ে দেব না। আর হ্যাঁ, তোমরা যাই করো না কেন এই কাজের জন্যে ওভারটাইম চেয়ে বোসো না যেন। আমার সঙ্গে এই কাজের কোনো সংস্রব নেই। সিরিল বলল, না সাহেব তা হবে না। আমরা কাজ করে পয়সা নেব। এক মাসের প্রোডাকশন করে আমরা পুরা মাসের মাইনে চাইব। কোনো কাটাকাটি চলবে না। প্রোডাকশন দেখাই হল আসল কাজ, কখন হল কে করল এসব নিয়ে নাই বা ভাবলেন।

সাহেব কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। তারপর বাবুদের দিকে তাকিয়ে সম্মতির মাথা নাড়লেন, ঠিক হ্যায় মেনে নেব, আগে প্রোডাকশন দেখি নিজের চোখে।

য়ুনিয়নের বাবু জিজ্ঞাসা করল, তোরা তো আমাদেরও জিজ্ঞাসা করলি না। এটা কি ভাল কাজ হয়েছে?

সিরিল গম্ভীর গলায় বলল, নিজের মায়ের সেবা তাতে আলোচনা করার কী আছে। কথাটা বলে বেরিয়ে এল সে। কাম চালাও কাম চালাও।

লাইন এখন একদম ফাঁকা। এতদিন বাতিল বৃদ্ধ এবং কচি শিশুরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকত এখানে ওখানে, আজ তারাও নেই। আজ উৎসবের দিন।

শুকরা বুড়ো অনেক কষ্টে মালাকে ধরে রেখেছে। মেয়েটা ভোর হতে না হতেই যাওয়ার জন্য ছটফট করছিল। শুকরা বুড়ো অনেক বলে কয়ে দুপুর অবধি থাকতে রাজি করিয়েছে। শুকরা বুড়ো তাকে লোভ দেখিয়েছে যে আজ তাকে সে রেল দেখাবে। অনেক শর্তের পর এই লোভ দেখানো, ঘুণাক্ষরে যেন কেউ জানতে না পারে। আর এ রকম একটা অভিনব প্রস্তাব পাওয়ার পর মালা অপেক্ষা করছে কখন বুড়ো বাপের সময় হয়। লাইন তো ফঁকা। দশ দিন পুরো হয়ে গেল। ফ্যাক্টরির সামনে মেলা বসে গেছে। কুলিরা এক মাসের কাজ দশ দিনে শেষ করেছে। প্রাণ জুড়ানো আনন্দ প্রত্যেকের। ফ্যাক্টরিকে ঘিরে তাই উৎসব আজ। সাহেব চেক করে গেছে আজ সকালে। বলেছে, তোমরা অসাধ্যসাধন করেছ। প্রত্যেকে পুরা মাইনে পাবে বোনাসের সঙ্গে।

এরকমটা কখনো হয়নি। প্রবীণ কুলিদেরও আনন্দটা স্পর্শ করেছে। আজ দুপুরের পর ভাটিখানা খুলবে। সবাই মুখিয়ে আছে সময়টার জন্যে। দশ দিন পেটে পড়েনি কারো, আজই তো ফুর্তির আসল সময়। প্রত্যেকেই মনে করছে এটা তাদেরই জয়। নিজের হাতে দিনরাত পরিশ্রম করে ওরা বাক্সগুলোয় চা ভরেছে, কোনো বাবুর নির্দেশ নিতে হয়নি। দেড় পার্সেন্ট বেশি বোনাস পাওয়ার চেয়ে এর আনন্দ হাজারগুণ বেশি।

খবরটা শুকরা বুড়োর কানে এসেছিল। অবিশ্বাসের পানসে চোখ মেলে সে বিড়বিড় করেছিল, হয়ে গেল, শেষ হয়ে গেল। সাহেবের কাজ বাবুদের কাজ করছিস মদেসিয়ারা! আস্পর্ধা কত দ্যাখো! সাহেব নেই তবু গুদাম চালাচ্ছিস, জেলে যাবি সব, পুলিস তোদের নরকে পুরে রাখবে।

তারপর আজ সকালে যেই শুনল কাম খতম, ঠিকঠাক কাজ শেষ করেছে, সবাই, সাহেবও খুশি, তখন তাজ্জব হয়ে গেল শুকরা বুড়ো। যতই পরিশ্রম করুক, এটা তো অন্যায় কাজ। সাহেব কী বলে সমর্থন করল? দিনকাল পাল্টে গেছে একদম। এই মাচায় এতগুলো বছর বসে সে এই পাল্টানোর কথা টের পায়নি এমন করে। শুকরা বুড়ো সোজা হয়ে বসল। বাইরে আজ বড় মিঠে রোদ। নাতনির কাঁধে হাত রেখে বলল, আশেপাশে কেউ আছে কি না একবার দ্যাখ তো চেয়ে।

মালা মাথা নাড়ল, কে আবার থাকবে এখানে! সবাই গুদাম দেখতে গেছে।

ঠিক বলছিস?

হ্যাঁ, তুমি কখন রেল দেখাবে আমাকে?

মন স্থির এখন শুকরা বুড়োর। এক হাতে লাঠি অন্য হাত নাতনির কাঁধে রেখে সে হাঁটতে শুরু করল মাচা থেকে। কয়েক পা যাওয়ার পর পেছন ফিরে এত বছরের প্রিয় জায়গাটার ওপর আর একবার নজর রাখল। কয়েক মুহূর্ত, তরপর হেঁটে চলে এল সেই কঁকড়া গাছটার তলায়। শুধু মুরগি আর ঘুঘুর ডাক ছাড়া কোন শব্দ নেই লাইনে। দূরে গুদামের সামনে যে মাদলগুলো বাজছে তার শব্দ অবশ্য গড়িয়ে গড়িয়ে আসছে–দ্রিমি দ্রিমি। নিজের হাঁটার ক্ষমতা দেখে আজ নিজেই অবাক হয়ে গেল সে। কি সোজা পা পড়ছে তার, একটুও কাঁপছে না অন্যদিনের মতো। ওর মনে হল মালা নয়, সেই মেয়েটা যে মাটির তলায় শুয়ে ছিল এতদিন, সে আজ উঠে এসে তার হাত ধরেছে, তাকে টেবুয়াতে ফিরে যেতে সাহায্য করছে। শিহরিত হল শুকরা বুড়ো।

গাছটার নির্দিষ্ট কোণে এসে শুকরা বুড়ো বসে পড়ল। হাত বাড়িয়ে মাটিটাকে স্পর্শ করল। আঃ কি আরাম। তারপর কোমর থেকে লোহার শিকটা বের করে গর্ত খুঁড়তে বসল সে। মালা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, মাটি খুঁড়ছ কেন?

শুকরা বুড়ো হাসল, খুঁড়ছি খুঁড়ছি, দেখতে পাবি কী আছে এতে?

কী আছে?

রেল দেখার মন্ত্র। কত্তো বছর জমিয়ে রেখেছি একে, আজকের জন্যে, এই দিনটার জন্যে। হাত লাগা না রে, আমি বুড়ো মানুষ, একা পারি?

শিরায় জড়ানো হাতের সঙ্গে কচি হাত যুক্ত হল। গর্ত বড় হচ্ছে তো হচ্ছেই। শুকরা বুড়োর মুখ এখন উদ্বেগে টান টান। আর তারপরেই সেই ভাঁড়টার মুখ দেখা গেল। হাসিতে মুখ ঢলো ঢলো এবার, সাবধান, সাবধানে তোল, ওইটার মধ্যে আমার সব আছে। নাতনির হাত সরিয়ে দিয়ে নিজেই ভাঁড়টাকে তুলল সে। নরম হয়ে গেছে কেন? কেন হাতের বাঁধনে শক্ত থাকছে না? স্পষ্ট মনে আছে একটা কাপড়ের পুটলির মধ্যে ভাঁড়টাকে রেখেছিল সে। কাপড়টাই বা নেই কেন? শুকরা বুড়োর মনে আছে ভাঁড়ের মধ্যে আর একটা ছোট্ট পুঁটলিতে ছিল সেগুলো। কিন্তু এখন ভাঁড় জমাট হয়ে আছে মাটিতে। এত মাটি কোত্থেকে এল? প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে যাচ্ছে আঙুলগুলো, কাঁপছে। বুকের মধ্যে পাহাড় ধসার টাল।

ওপরের স্তর সরিয়ে ফেলার পর মাটিটা যেন অন্যরকম দেখাতে লাগল। আর তারপরেই সেই নথটায় আলো লাগতেই চিকচিকিয়ে উঠল।

হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল শুকরা বুড়ো। খেয়ে নিয়েছে, মাটি সব টাকা খেয়ে নিয়েছে। মাথা ঠুকতে লাগল শুকরা বুড়ো গাছের তলায়। হেই বাপ যীশু, এই তোর মনে ছিল! এই মাটি আমার সব নিয়েছে, আমার বউকে, আমার যৌবন, জীবনকে। শেষতক আমার যাওয়ার টাকাকেও খেয়ে ফেলল গো। আমি কী করে জানব মাটির পেটে এত খিদে, সব খেয়ে নেবে সে?

নাতনির হাত পড়ল মাথায়। শুকরা বুড়ো জলমাটিতে নিকানো মুখ তুলে নাতনির দিকে তাকাতেই যেন স্ত্রীকে দেখতে পেল। তার চোখে জল দেখে সেই চোখও টলটলে। দু হাতে নাতনিকে বুকে জড়িয়ে ধরে আবার হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল শুকরা বুড়ো, আমার যাওয়ার টাকা সব মাটি হয়ে গেছে রে।

খানিক বাদে শুকরা বুড়ো আবার ভাঁড়টাকে পরম স্নেহে দু হাতে তুলে নিল। সেই টাকা আজ মাটি। এমন করে মায়ায় বাঁধে কেন মাটি? অথচ নথটার একটা কোণ এখনও চকচকে। সেটাকে জীর্ণ আঙুলে তুলে ধরল সে। খাঁজে খাঁজে মাটি জমে গেছে। এই নথ সেই মেয়ের নাকে ঝলসাত। বড় ইচ্ছে ছিল তার, শুকরা বুড়ো যখন টেবুয়ার মাটিতে গিয়ে শোবে তখন এই নথটাকেও যেন পাশে নেয়। তাহলেই তার ইচ্ছা পূর্ণ হবে। এখন তো আর টেবুয়াতে যাওয়ার কোনো উপায় থাকল না। কী করে এই নথটা সেই মাটিতে শোবে? কান্নাটা আবার বুক উপচে বেরিয়ে এল।

মালা বুঝতে পারছিল না। কিছু একটা ছিল বুড়া বাপের যা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এখন। যা না থাকায় রেল দেখা যাবে না। কিন্তু বুড়া বাপের হাতে ওটা কি? কী সুন্দর নথ! সে হাত বাড়াল। চমকে গিয়ে হাত সরিয়ে নিল শুকরা বুড়ো। মুখে বলল, না। কক্ষনো না। এটা তার নথ। আসল জায়গায় যাওয়ার জন্যে এতদিন বেঁচে আছে এটা। একদম হাত বাড়াবি না?

নিজের নাকের হলদে কাঠি গোঁজা ফুটোটা এখন খালি। নাক তার ফোঁটানো হয়েছে কিন্তু নাকছাবি কিনে দেয়নি কেউ। তার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল দাদুর হাত থেকে নথটাকে ছিনিয়ে নেয়। কিন্তু শুকরা বুড়োর হাতের আঙুলে যে এখন হাজার বাঘের শক্তি, কিছুতেই নথটাকে ছাড়ল না সে। চেষ্টা করেও যখন পারল না মালা তখন শুকরা বুড়ো উঠে দাঁড়াল। এক হাতে মাটি হয়ে যাওয়া টাকা অন্য হাতে নথ। বিড় বিড় করতে লাগল সে, রেলের বাবুকে গিয়ে বলব, আমার আর কিছু নেই রেলের বাবু; এই এমুঠো মাটি যা কিনা একদিন টাকা ছিল আর এই নথটা ছাড়া। নথটা তো দিতে পারব না, তোমার পায়ে পড়ি আমাকে টেবুয়াতে নিয়ে চল।

এখন আর তার হুঁশ নেই কিছু। লাঠিটা পিছনে পড়ে রইল। মালা দেখল বুড়া বাপ হাঁটছে একা একা। নিশ্চয়ই রেল দেখতে যাচ্ছে। সে ছুটে এসে বুড়োর কোমর ধরল। চমকে তাকাল শুকরা বুড়ো, সেই মুখ, অবিকল এক গড়ন। ফিসফিস করল সে, বউ, চল আমার সঙ্গে, নিয়ে চল এখান থেকে।

ওরা লাইন পেরিয়ে আসতেই রাস্তা দু ভাগ হয়ে গেল। একটা রাস্তা চলে গেছে গুদামের দিকে অন্যটা চা বাগান পেরিয়ে হাইওয়েতে। আর এখানে মাদলের শব্দটা তীব্র হল। গুদামের পথটা ছেড়ে শুকরা বুড়ো অন্য রাস্তায় পা বাড়াতেই পেছন থেকে ডাকটা ভেসে এল। মালা চিৎকার করে উঠে ছুটে গেল পেছনে। শুকরা বুড়ো দুটো মুঠো চোখের ওপর তুলে আলো আড়াল করে দেখল একজন ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে। মালার পাশাপাশি সে হেঁটে এল শুকরা বুড়োর সামনে। চিনতে পারল শুকরা বুড়ো, নিরি। দু হাতে বুকের ওপর ধরে রেখেছে যাকে তার শরীর দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু কপাল আর ঘুমন্ত চোখ নাক স্পষ্ট। কালো হীরের মত ঝকঝকে।

এই প্রথম নাতির বেটা পুতিকে দেখল শুকরা বুড়ো। এই কদিন কেউ তাকে নিয়ে যায়নি দেখাতে। তার ইচ্ছে হলেও এতদিন যে নিজেকে শাসন করছিল, আর মায়ায় জড়াস নে। এখন নাতবউ-এর মুখের দিকে তাকিয়ে সে দেখতে পেল যেন নতুন বৃষ্টি পেয়ে চা গাছের শরীর থেকে কুঁড়ি মুখ তুলছে। লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিরি বলল, আমিও যাব।

শুকরা বুড়ো জিজ্ঞাসা করল, খানিকটা অবাক হয়েই, কোথায়?

কোথায় আবার? সবাই যেখানে গেছে।

কেন যাচ্ছিস সেখানে?

বাঃ, আজ আমাদের জয়ের দিন আনন্দের দিন। এই প্রথম আমরা প্রমাণ করলাম আমরা পারি। এই জায়গা আমাদের, এখান থেকে আমাদের কেউ সরাতে পারবে না।

এই জায়গা আমাদের?

নিশ্চয়ই। জায়গাটাকে ভাল না বাসলে ওরকম কাজ কি কেউ করতে পারে? একেও নেয়ে যাচ্ছি তাই, বাপ কাকাদের কাজ দেখবে না ও?

শুকরা বুড়োর চোখ শূন্য। বুকের মধ্যে চৈত্রের আকাশ। মালা বলল, চল না, একবার দেখেই সেখানে যাব আমরা।

নিরি বলল, তুমি যাবে না নাতিদের দেখতে?

আর কোলের দশ দিনের বাচ্চাটা সেই সময় ট্যাঁ ট্যাঁ করে উঠতেই শুকরা বুড়ো চমকে গিয়ে হাত বাড়িয়ে তার গাল স্পর্শ করতে গেল। ঝুর ঝুর করে মুঠোর মাটি মাটিতে পড়ে গেলেও অদ্ভুত তুলতুলে গালের স্পর্শে বিদ্যুৎ বইল যেন ওর শরীরে।

দূর থেকে ওদের দেখতে পেয়ে কয়েকজন ছুটে গেল ভেতরে। আজ বাবুরা এসে গেছেন। তাঁরাও বিস্ময়ে তারিফ করছেন কুলিদের এই উদ্যোগকে। সিরিল তাই শুনছিল। খবরটা শুনতেই দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এল। এক হাতে বাচ্চা অন্য হাতের শুকরা বুড়োকে ধরেছে নিরি। শুকরা বুড়োর আর এক পাশে মালা। বুড়ো আসছে ফোকলা দাঁতে হাসতে হাসতে, এক পা এক পা করে। কথা বলতে বলতে। সিরিল বুঝল কথা হচ্ছে দশ দিনের শিশুর সঙ্গে। বাইরে জমজমাট। মেলার মানুষ অবাক হয়ে দৃশ্যটা দেখছিল। সিরিল আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। এক ছুটে দূরত্বটা অতিক্রম করে শুকরা বুড়োকে কাঁধে তুলে নিল। চমকে গিয়েছিল বুড়ো, নাতির গলা শুনে ধাতস্থ হল। মাথায় বুড়োকে নিয়ে এক পাক ঘুরে সিরিল চেঁচাল, তোমরা সবাই দ্যাখো। কে এসেছে, এই বুড়ো আশি সাল আগে এখানে এসেছিল। সঙ্গে সঙ্গে সবাই হইচই করে ওদের ঘিরে ধরল।

শুকরা বুড়ো ঘাবড়ে গেল খুব। কোনোদিন কেউ তার সঙ্গে কথা বলে না ডেকে, আজ এমন করছে কেন সবাই তাকে নিয়ে?

সিরিল বলল, বুঝতে পারছ না? তুমি এসে বীজ পুঁতেছিলে এখানে, আজ প্রথম সেই বীজের গাছে ফল ফলল।

শুকরা বুড়ো কাঁধের ওপর বসে জিজ্ঞাসা করল, তোরা সব নিজের হাতে করেছিস?

জরুর। শুধু সিরিল নয়, অনেকগুলো গলা থেকে শব্দটা বের হল। শুকরা বুড়ো শুধু বলতে পারল, আমি দেখব।

চারধারে টাটকা চায়ের গন্ধ ম ম করছে। একটাও মেসিন চলছে না এখন কিন্তু তবু বাতাসে কাজের স্পর্শ। শুকরা বুড়োর মনে হল অনেক দিন বাদে যেন নিজের ঘুরে চুল সে। কাঁধ থেকে তাকে মেঝের ওপর নামিয়ে দিতেই সে বিহ্বল চোখে চারপাশে তাকাল। চা-গুদামের কত পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। কত নতুন রকমের মেসিন, এমন কি জানলা দরজাগুলো পর্যন্ত অন্যরকম চেহারা নিয়েছে। এই গুদামে সে তিন কুড়ি বছর কাটিয়ে গেছে। হিসেবটা এখন অবশ্য মাঝেমাঝেই গোলমেলে হয়ে যায় তবু ওরকম একটা সময় তো বটেই। সে দেখল ছেলেরা তার দিকে মজার মুখ করে তাকিয়ে আছে। মুখ ঘোরালো বুড়ো, ওপাশে থাকে থাকে চায়ের বাক্স রয়েছে। সেদিকে দেখতে দেখতে তার মাথার ভেতর চিড়বিড় করে উঠল। কীভাবে প্যাকিং করেছে দ্যাখো, মুখ হাঁ করে আছে! বাতাস যদি ভেতরে ঢোকে তাহলে কি আর মুচমুচে চা থাকবে ঠিকঠাক! নড়বড়ে পায়ে এগিয়ে গেল সে। বাক্সটা হাত রেখে চিৎকার করে উঠল, কোন শালা হারামীর বাচ্চা এই কাজ করেছে? শুধু ফাঁকি দেবার মতলব, এটা কি প্যাকিং হয়েছে?

যেন আচমকা বোমা ফাটল। নিস্তব্ধ হয়ে গেল চারধার। কারো মুখ কথা সরছে না। সবাই বিস্ময়ে হতবাক। লাল চোখে ঘুরে দাঁড়াল শুকরা বুড়ো। সিরিল এগিয়ে গেল কাছে, কী হয়েছে?

হাড়িয়া খাওয়ার মত হাঁ হয়ে আছে বাক্সগুলো। ঠিক করো, জলদি জলদি ঠিকসে কাম করো। শুকরা বুড়ো ধমকাতেই ভুলটা চোখে পড়ল সবার। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন ছুটে গিয়ে বাক্স মেরামতের কাজে লেগে গেল। শুকরা বুড়ো এক একটা ভুল ধরিয়ে দিচ্ছে আর ছেলেরা খুশি মনে তাই সংশোধন করছে। একজন বুড়ো সর্দার পাশের মানুষকে বলল, সেকালের লোকের কাজের নমুনাই ছিল আলাদা, ফাঁকি পাবে না।

শুকরা বুড়ো মনে হল সে তার যৌবনে ফিরে গেছে। এমন আনন্দ সে গত কুড়ি বছরে পায়নি। যতই বদলাক, এই গুদামের গন্ধটা তো একই রকম আছে। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল সে। ঘুরতে ঘুরতে কোনার থামটার কাছে যেতেই সে থমকে দাঁড়াল। তখন তার বয়স কত? বড় জোর দেড়কুড়ি। গুলাং সাহেব ওই থামটার গায়ে বেঁধে বেত চালিয়েছিল তার ওপর। কারণ? দু মুঠো দামী চা হাতে নিয়ে সে বেরিয়েছিল গুদাম থেকে। বউটার বড় শখ ছিল সেই চা খাবার। চুরি করেনি। গুদামবাবুকে বলে কয়েই নিয়েছিল ওইটুকু চা। সাহেব সেসব কথা শুনতেই চাইল না। বেত চালিয়ে পুরো একটা দিন তাকে বেঁধে রাখা হয়েছিল থামটার গায়ে। রক্ত লেগেছিল থামটায়।

থামটার গায়ে হাত রাখল শুকরা বুড়ো। অবিকল একই চেহারায় আছে, শুধু রক্তের দাগটাই নেই। হঠাৎ কি মনে হল, থু থু ছিটোতে লাগল সে, বাঁ পা তুলে লাথি মারল মাটিতে। পেছনে ভিড় করে দাঁড়ানো মানুষরা অবাক হয়ে দেখল শুকরা বুড়ো থর থর করে কাঁপছে। সিরিল এগিয়ে গিয়ে তাকে ধরা আগেই শরীরটা বেঁকেচুরে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল।

হইহই করে উঠল সবাই। খবর পেয়ে মাংরা সর্দার ছুটে এসেছে। সিরিল গিয়ে সদ্য ফেরা ডাক্তারবাবুকে নিয়ে এসেছে এখানে। শুকরা বুড়ো অসাড় হয়ে পড়ে আছে, দুটো হাতের মুঠো বন্ধ। মালা তার বুকের পাশে। ইঞ্জেকসান দেবার পর চোখ খুলল শুকরা বুড়ো। তার শরীর এখন কাঁপছে, গলায় গোঁ গোঁ শব্দ।

কথা বলার আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও কথা বের হচ্ছে না। শুকরা বুড়ো অসহায় চোখে সামনের বিষণ্ণ মুখগুলোকে দেখল। এরা তাকে এত ভালবাসে? ওই যে সব নতুন নতুন লোকজন? সাহেবদের আমলে সবাই তাকে চাবুক মেরেছে, চাবুক মেরে কাজ করতে শিখিয়েছে। এমন করে কেউ ভালবাসা জানায়নি। শুধু একজন ছাড়া, যে মাটির তলায় শুয়ে আছে। কিন্তু সে ছটফট করছে না কেন মাটির তলায়? সারাজীবন যে তাকে খোঁচাতো টেবুয়াতে ফিরে যাওয়ার জন্যে, সে এখন শান্ত কেন? আজ এই মাটিতে শুয়ে তার ছোঁয়া পাচ্ছে বুঝি, তাই কি সে আজ এত শান্ত? এরও নাম কি ভালবাসা, এটাই কি আসল জায়গা?

চোখ খুলতেই চমকে গেল বুড়ো। দু চোখে জল কেন ওই শিশুর! নাকের পাটা ফুলছে। হলদে কাঠি বের করা ফুটোটায় কিছু নেই ওর। শুকরা বুড়ো সারাক্ষণের মুঠো করে রাখা হাতটা খুলল। কোনরকমে হাতের চেটোয় রাখা নথটা বাড়িয়ে দিল নাতনির দিকে। কচি হাতে মালা তুলে নিল নথটা। শুকরা বুড়ো বলল, পর, নাকে লাগা, আমি দেখি।

যতটুকু মাটি পরিষ্কার করা সম্ভব করে দু-একজন মালার নাকে নথটা পরিয়ে দিতেই বুক জুড়ে নীল আকাশ টলে উঠল শুকরা বুড়োর। চোখের সামনে তার বউ, যার নাকে এমনি করে নথটা ঝলসাত।

শুকরা বুড়োর মুখে কোনোরকম কুঞ্চন নেই। কারণ কেউ তার শিরায় শিরায় তখন ফিস ফিস করছিল, ঠিক জায়গায় গেছে গো নথটা। আমার বুক জুড়িয়ে গেল তাই। জানো বুড়ো, এই মাটি, এই চায়ের গন্ধ। এই ভালবাসা আরও ওই তোমার রক্ত নিয়ে গড়া কচি মুখের ওপর ঝকঝকে নথ-এর কাছে কোন টেবুয়া বড় হবে? এই আমাদের বাসভূমি গো, আমাদের স্বর্গ।

এই চা বাগানের ইতিহাসে এর চেয়ে বড় মিছিল আর কখনো হয়নি। সবাই, সাহেব বাবুরা থেকে ছোটসাহেব পর্যন্ত এসেছিল সেই মিছিলে। প্রবীণতম মানুষটি মাটির তলায় যাতে ভালভাবে ঘুমুতে পারে সেজন্যে ফ্যাক্টরির সামনে একটি বিশেষ জায়গা নির্দিষ্ট করা হল। তখন আকাশ জুড়ে একটি কালো শিশুর মুখ, যার চোখে জলের ধারা, নাকের পাটায় ভালবাসার হিরে জ্বলছে। সেই মুখের ভেতরে অস্পষ্ট সবুজ ঢেউ-খেলানো চায়ের বাগান। সেই মুখের একপাশ দিয়ে দীর্ঘ মিছিল এল মৃতদেহ নিয়ে। এসে সেই হিরের কাছে থমকে দাঁড়াল। এই দৃশ্য যারা দেখতে পেল তারা জানল, শেকড় নামিয়ে গাছ মাটির ভালবাসা নিল, নিয়ে বাঁচল।

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress