বাক্সের ভিতরে কী আছে?
প্রশ্নটা করে কৃপানাথ মজুমদার আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। প্রত্যাশায় দু-চোখ জ্বলজ্বল করছে। ময়লা হয়ে যাওয়া বাবের আলো তেরছাভাবে পড়েছে ওঁর মুখে। তোবড়ানো গাল আর চামড়ার ভঁজে ছায়া পড়ে অদ্ভুত দেখাচ্ছে।
বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি। খোলা জানলা দিয়ে ছাট আসছে। বর্ষার প্রথম বৃষ্টি। তাই বেশ লাগছে। সেইজন্যেই বোধহয় কৃপানাথ জানলা খুলে দিয়েছেন।
কালো আকাশ চিরে গেল আঁকাবাঁকা বিদ্যুতের রেখায়। তারপর শোনা গেল গুড়গুড় শব্দ। ক্যামেরার ইলেকট্রনিক ফ্ল্যাশগানের মতো বিদ্যুতের ঝিলিক পলকের জন্যে ছুঁয়ে গেল বিশাল বাক্সটাকে। ওটা ধাতব গা চকচক করে উঠল হঠাৎ। আর তখনই একটা অদ্ভুত খচড়-খচড় শব্দ ভেসে এল বাক্সের ভিতর থেকে।
কৃপানাথ মুচকি হাসলেন। আবার প্রশ্ন করলেন, কী হল, বলুন, বাক্সের ভিতরে কী আছে?
কৃপানাথ মজুমদারের সঙ্গে আমার আলাপ মাত্র ঘণ্টা দুয়েকের। কিন্তু প্রথম থেকেই ভদ্রলোককে আমার কেমন একটু অদ্ভুত মনে হয়েছে।
অফিস ছুটির পর, বিকেল পাঁচটা নাগাদ, দাঁড়িয়ে ছিলাম এসপ্ল্যানেডের মোড়ে। চারপাশে মানুষজনের ভিড়। বাস, ট্যাক্সি আর গাড়ির জটলা। দূরে একটা ডবল ডেকার বাস আসছে দেখে আমি গলা উঁচিয়ে দেখতে চেষ্টা করছিলাম বাসটা কত নম্বর। এল-৯ যদি হয় তা হলে আমি নিশ্চিন্ত। এক বাসে চড়েই সোজা বাগবাজার। বাড়ি ফেরার যে খুব একটা তাড়া আছে তা নয়। তবে আকাশে সকাল থেকেই ভয়-দেখানো কালো মেঘ। গত বিশদিন ধরে একটানা যে-গরম চলেছে তাতে সবাই বলছে আজ-নয়কাল শহর ভাসানো বৃষ্টি হবেই। সেইজন্যেই ঘরে ফেরার পথে অযথা দেরি করব না ভেবেছি।
বাসটা কত নম্বর বলুন তো!
প্রশ্নটা কি আমাকে লক্ষ্য করেই? পাশে তাকিয়ে দেখি রোগা ঢ্যাঙা চেহারার এক প্রৌঢ়। মাথায় কাঁচাপাকা চুল। পরনে পাটভাঙা ধুতি-পাঞ্জাবি। চোখে মেটাল ফ্রেমের শৌখিন চশমা। ডান হাতের আঙুলে তিন-তিনটে রঙিন পাথর বসানো সোনার আংটি, বাঁ-হাতে একটা হালকা ব্রিফকেস।
ভদ্রলোকের গাল তোবড়ানো, মুখের চামড়ায় বয়েসের ভাঁজ। কিন্তু সব মিলিয়ে একটা প্রাচীন বনেদিয়ানার ছাপ রয়েছে। আর তার চোখের নজর অদ্ভুতরকম শান্ত।
আমি আবার বাসটার দিকে তাকালাম। ওটা অনেক কাছে এসে গেছে। না, এল-৯ নয়, পাঁচ নম্বর।
ভদ্রলোককে বাসের নম্বরটা বললাম। একবার দেখলাম ওঁর চোখের দিকে। চশমা পরেও কি ঠিকঠাক দেখতে পান না।
ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে অকারণেই হাসলেন। তারপর বললেন, আমার নাম কৃপানাথ মজুমদার। ব্যবসা করি…।
অপরিচিত লোকের আত্মজীবনী শোনার কোনওরকম আগ্রহ কোনওকালেই আমার ছিল না। তাই আবার নজর ফেরালাম বাস-রাস্তার দিকে।
বলুন তো, এর পর কত নম্বর লাল রঙের বাস আসবে?
কী অদ্ভুত প্রশ্ন! একটু অবাক হয়েই তাকালাম কৃপানাথের দিকে। ভদ্রলোক প্রথমটা একটু সিঁটিয়ে গেলেন। কিন্তু তারপরই দিব্যি সামলে নিয়ে বললেন, কিছু মনে করবেন না। এটা স্রেফ একটা মজার খেলা। সারাদিনের খাটাখাটুনির পর ব্রেনটা একটু রিল্যাক্স করা আর কী! ওই দেখুন, দূরে একটা লাল বাস আসছে। বলুন তো, কত নম্বর হতে পারে?
কেমন এক দোটানার মধ্যে পড়লাম। এই বিচিত্র লোকটার বায়নায় ধরা দিয়ে কিছুক্ষণের জন্যে ছেলেমানুষ হয়ে যাব? বাড়িতে বুবু-টুটুর সঙ্গে যে মাঝেমধ্যে ছেলেমানুষি করি না এমন নয়। বুবু ফাইভে পড়ে, আর টুটু ওয়ানে। ওদের সঙ্গে হুল্লোড় করার সময় অনুরাধা এক-এক সময় ভীষণ খেপে যায়। বলে, তিন-তিনটে ছেলে নিয়ে আমার হয়েছে যত জ্বালা! তার মধ্যে একটা অবশ্য ধেড়ে! উত্তরে আমি শুধু হাসি। আর খেলা চালিয়ে যাই। টুটু তাতে মায়ের দিকে তাকিয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু তাই বলে এখন এরকম ছেলেমানুষি খেলা!
আরে তাড়াতাড়ি বলুন, বাসটা কাছে এসে যাচ্ছে–এরপর নম্বর স্পষ্ট দেখা যাবে…।
কৃপানাথের অধৈর্য তাড়ায় কী যে হয়ে গেল! বাসটা একতলা, তাই ফস করে আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, চোদ্দো নম্বর।
বাসটা কাছে আসতেই তার নম্বরটা পড়া গেল। চোদ্দো। কৃপানাথ হেসে উঠে বললেন, শাবাশ! আপনি জিতেছেন।
তারপরই আমাকে অবাক করে দিয়ে পাঞ্জাবির পকেট থেকে কড়কড়ে একটা একশো টাকার নোট বের করে গুঁজে দিলেন আমার হাতে।
কয়েক মুহূর্ত কোনও কথা বলতে পারলাম না। কৃপানাথ মজুমদার এখনও পর্যন্ত আমার নামও জিগ্যেস করেননি। সুতরাং সম্পূর্ণ অজানা-অচেনা একজন মানুষকে অযথা একশোটা টাকা দিয়ে দেওয়া…নাঃ, ভদ্রলোক যতই বড়লোক হোন না কেন ব্যাপারটা অস্বাভাবিক।
নাকি এটা এক ধরনের জুয়া খেলা! বাসের নম্বর না মিললে আমাকে কি একশো টাকা দিতে হত?
কৃপানাথ আমার অস্বস্তি আঁচ করে বললেন, মাপ করবেন, আপনার নামটা এখনও জিগ্যেস করা হয়নি…।
আমি বললাম, আমারই বলা উচিত ছিল। অচিন বন্দ্যোপাধ্যায়।
একশো টাকার নোটটা তখনও আমার হাতের মুঠোয় ধরা। বুঝতে পারছি না নোটটা নিয়ে এখন কী করা উচিত।
অচিনবাবু, এই সামান্য টাকাটা আপনি নিলে আমি খুব খুশি হব। না, আপনি যা ভাবছেন তা নয়। এটা জুয়া নয়। বাসের নম্বর না মিললে আপনাকে কোনও টাকা দিতে হত না। একটু থেমে উদাস চোখে কালচে আকাশের দিকে দেখলেন কৃপানাথ। তারপর বললেন, আসলে ব্যাপারটা এক বড়লোক বৃদ্ধের খেয়াল বলতে পারেন। গত বিশ-তিরিশটা বছর একা-একা আছি। সঙ্গী বলতে একটা মানুষও নেই। তাই রোজ বিকেলে, অফিস কাছারি ছুটির সময় ধর্মতলায় এসে ঘোরাফেরা করি, মানুষজনের সঙ্গে একরকম গায়ে পড়েই আলাপ করি… একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন কৃপানাথ। তারপর কিছুটা হতাশ করুণ সুরে বললেন, আশা করি এই বুড়োর ছেলেমানুষিতে আপনি কিছু মনে করেননি। ভেবেছিলাম আপনার সঙ্গে গল্প করে মজা করে খানিকক্ষণ সময় কাটাব, চা-টা খাব, কিন্তু..কপালে নেই…।
আমার মনের মধ্যে একটু-আধটু তোলপাড় চলছিল। মাসের শেষ সপ্তাহ। সুতরাং যথারীতি টাকার টানাটানি চলছে। এরকম পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা কি ছেড়ে দেওয়া উচিত? তা ছাড়া আমি তো খেলায় জিতেছি। আবার এই খামখেয়ালি বুড়োটার সঙ্গে গল্পগাছা করেও বেশ খানিকটা সময় নষ্ট হবে। আমার সময়ের দাম হয়তো কম, কিন্তু তবু তার দাম তো আছে!
এইসব ভাবতে-ভাবতেই মনের মধ্যে বেশ কতকগুলো জোরালো যুক্তি তৈরি হয়ে গেল। এবং একশো টাকার নোটটা দিব্যি পকেটে চালান করে দিয়ে কৃপানাথকে বললাম, চলুন, কাফে ডি মোনিকোয় বসে একটু কফি খাওয়া যাক।
কৃপানাথ মজুমদার খুশিতে একেবারে ফেটে পড়লেন। চশমার আড়ালে ওঁর ঘোলাটে চোখ পলকের জন্যে চকচক করে উঠল। তারপর আগ্রহী পা ফেলে আমার পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করলেন রাস্তা পার হওয়ার জন্যে।
ঠিক তখনই ঘটনাটা ঘটল।
কয়েকটি স্কুলের মেয়ে রাস্তা পার হচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎই ট্রাফিক সিগন্যাল বদলে যাওয়ায় গাড়ি, বাস, ট্যাক্সির মিছিল চলতে শুরু করে দিল। জনা আষ্টেক মেয়ে মাঝরাস্তায় জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ওদের মুখে দিশেহারা ভাব। বোধহয় স্কুল থেকে এদিকে মিউজিয়াম বা বিড়লা প্ল্যানেটারিয়াম দেখতে এসেছিল। দেখলাম, আমাদের দিকের ফুটপাথে ওদের দলের বাকি সবাই দাঁড়িয়ে রয়েছে। হাত নেড়ে চিৎকার করে মাঝরাস্তায় আটকে পড়া বন্ধুদের ডাকাডাকি করছে।
এমন সময় গাড়িগুলোর গতি একটু কমতেই তাদের ফাঁকফোকর দিয়ে তিনটে মেয়ে ছুট লাগিয়ে চলে এল এপারে।
আর সঙ্গে-সঙ্গে কৃপানাথ আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলে উঠলেন, বলুন তো, আর কটা মেয়ে এক্ষুনি রাস্তা পেরিয়ে এপাশে চলে আসতে পারবে?
আবার ফাটকা? নাকি কৃপানাথ মজুমদারের মজা?
আমি অবাক চোখে ভদ্রলোকের দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকাতেই উনি অপ্রস্তুতভাবে হাসলেন, বললেন, বলুন না, মশাই। এ তো স্রেফ মজার খেলা!
আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, দুজন পারবে মনে হয়।
কিন্তু না, এবার হেরে গেলাম। এক ঝেকে আরও চারটে মেয়ে রাস্তা পেরিয়ে চলে এল। এপারে দাঁড়ানো দলবলের কাছে।
কৃপানাথ মুচকি হেসে বললেন, ব্যাড লাক, মিলল না…।
মিলে গেলে কি আবার একশো টাকা পেতাম নাকি!
বেশ বুঝতে পারছিলাম, আমার মনের মধ্যে লোভ উঁকিঝুঁকি মারছে। কিন্তু আশ্চর্য, আগে কখনও আমি জুয়া খেলিনি।
একটু পরেই ট্রাফিক সিগন্যাল বদলে গেল। আমরা দুজনে নিরাপদে রাস্তা পেরিয়ে রওনা হলাম কাফে ডি মোনিকের দিকে। ফুটপাথের ভিড়, হকারদের উৎপাত, গাড়ির হর্নের শব্দ–এইসব মিলিয়ে বাকি পথটুকু কোনও কথাই বলতে পারলাম না আমরা।
সন্ধের অন্ধকার ঘন হয়েছে। বড় বড় অট্টালিকার ওপরতলায় গ্লো-সাইনের লাল-সাদা সবুজ নকশা জ্বলছে-নিভছে। আর হঠাৎই কয়েকটা বৃষ্টির ফোঁটা ঝরে পড়ল কালো আকাশ থেকে।
রেস্তোরাঁয় ঢুকে দরজার কাছাকাছি একটা টেবিলে বসলাম আমরা। কৃপানাথ বেয়ারাকে দুটো কফি দিতে বললেন। তারপর আমার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে গলা নামিয়ে বললেন, অচিনবাবু, প্রাণীদের মধ্যে একমাত্র মানুষেরই কৌতূহল আছে। চাঁদকে দেখে কৌতূহল হয়েছিল বলেই জ্যোতির্বিজ্ঞানের জন্ম হয়েছে। আর লেখাপড়ার মোদ্দা ব্যাপারটাই তো কৌতূহলের ভিতের ওপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
আমি আর কী বলব! একটু আগেই এই ভদ্রলোক প্রায় অকারণেই আমাকে একশোটা টাকা দিয়েছেন। সুতরাং ওঁর একটু-আধটু জ্ঞান আমার শোনা উচিত।
কৃপানাথ পকেট থেকে ক্লাসিক সিগারেটের প্যাকেট বের করলেন। আমাকে অফার করলেন। তারপর নিজে একটা নিলেন। আমি মামুলি একটা লাইটার বের করে ওঁর সিগারেট ধরিয়ে দিলাম, তারপর নিজেরটা ধরালাম। প্রথম ধোঁয়া ছাড়তে না ছাড়তেই কৃপানাথ রেস্তোরাঁর কিচেনের দিকে চোখের ইশারা করে বললেন, কফি আসছে।
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম, একজন রোগা ঢ্যাঙা উর্দি পরা বেয়ারা কফির ট্রে হাতে এগিয়ে আসছে। তার দিকে নজর রেখে চোখ ছোট করে সিগারেটে জোরালো টান দিলেন কৃপানাথ। তারপর আচমকা বলে উঠলেন, বলুন তো, বেয়ারাটা কার সামনে আগে কফির কাপ রাখবে? আপনার, না আমার?
আমি কিছু বলে ওঠার আগেই বৃদ্ধ ঝটপট তাগাদা দিলেন আমায় : কী হল, জলদি বলুন, কুইক–।
আবার ওই একশো টাকার নোট। আবার লোভ। আবার মাসের শেষ সপ্তাহের অভাব। এই তিন-তিনটে ব্যাপার মিলেমিশে সবকিছু কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল। তার ওপর একটু আগে বলা কৃপানাথের কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছিল মাথার ভিতরে। কৌতূহল। কৌতূহল থেকেই বাজি, জুয়া, সবকিছুর জন্ম। এই কৌতূহলের খপ্পরে পড়েই কৃপানাথের আজগুবি খেলায় নাম লিখিয়েছি আমি।
সুতরাং বলেই ফেললাম, আপনার সামনে আগে কাপ রাখবে।
কথা শেষ করার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই কৃপানাথের সামনে কফির কাপ রাখল বেয়ারা। তারপর আমাকে কফি দিল।
লোকটা সরে যেতেই কৃপানাথ হাসলেন। বললেন, আপনি দারুণ লাকি, অচিনবাবু। বলেই পকেট থেকে আবার একটা একশো টাকার নোট বের করে টেবিলের ওপর দিয়ে এগিয়ে দিলেন আমার সামনে।
আমি কফিতে চুমুক দেওয়া থামিয়ে আপত্তি জানালাম ও এ আপনি কী শুরু করেছেন, কৃপানাথবাবু! খেলা খেলাই–তার সঙ্গে এভাবে টাকা-পয়সা জড়ানো কি ঠিক?
ভদ্রলোক একেবারে আমার হাত চেপে ধরলেন। চাপা আন্তরিক গলায় বললেন, দয়া করে এই বুড়োটার তৃপ্তি কেড়ে নেবেন না। আমার আর টাকার দরকার নেই–শুধু একজন বন্ধু দরকার– আপনার মতো। প্লিজ, এই সামান্য টাকা কটা ফিরিয়ে দিয়ে আমাকে কষ্ট দেবেন না।
গত এক-দেড় ঘণ্টার লড়াইয়ে আমার বিবেক ক্রমশই কাহিল হয়ে পড়ছিল। সুতরাং টাকাটা নিয়ে পকেটে ঢোকাতে খুব বেশি সময় লাগল না।
তারপর চলতে লাগল আমাদের কফির কাপ আর সিগারেটে চুমুক। রেস্তোরাঁর খোলা দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আকাশে গুড়গুড় করে মেঘ ডাকছে। ফুটপাথের জনস্রোতে মাঝে-মাঝেই ছাতা চোখে পড়ছে। আবার কখনও বা ব্যাগ কিংবা রুমাল ছাতার বিকল্প হিসেবে কাজ করছে।
কফি আর সিগারেট শেষ হতেই কৃপানাথ মজুমদার আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন। আমার স্বাস্থ্য নাকি নজর কাড়ার মতো। আমার ব্যক্তিত্ব একটু অন্য ধরনের–সাদামাঠা নয়। আমার চোখ বেশ অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে পারে। আমার সৌজন্যবোধের কোনও তুলনা নেই। এইরকম আরও কত কী!
মুখোমুখি বসে একটানা অহেতুক প্রশংসা শুনতে হচ্ছিল। সুতরাং যেই গুনগুনিয়ে একটু আধটু বিনয়ী প্রতিবাদ করতে শুরু করেছি তখনই হঠাৎ কৃপানাথ বলে উঠলেন, অচিনবাবু।
বলুন।
আমার একটা ছোট্ট অনুরোধ রাখবেন? বলেই কৃপানাথ মজুমদার আমার হাত চেপে ধরলেন। অনুনয়ের সুরে আবদার করলেন, এ অনুরোধটুকু আপনাকে রাখতেই হবে।
এই খ্যাপাটে বৃদ্ধ এবার কী অনুরোধ করবেন কে জানে! খানিকটা সতর্ক হয়েই প্রশ্ন করলাম, কী অনুরোধ?
আধঘণ্টার জন্যে আমার বাড়ি যাবেন? ঠিক আধঘণ্টা। একটুও বাড়তি সময় নেব না। চলুন, আপনাকে একটা দারুণ ইন্টারেস্টিং জিনিস দেখাব।
ওঁর বাড়ি কতদূর কে জানে! তা ছাড়া এই বৃষ্টিভেজা সন্ধের প্যাঁচপেচে পথ পেরিয়ে ওঁর ইন্টারেস্টিং জিনিস দেখার তেমন একটা আগ্রহ আমার নেই। তবে যদি…।
কৃপানাথ বোধহয় আমার মতো মধ্যবিত্তদের মন জানেন। কারণ, আমার চোখেমুখে সামান্য ইতস্তত ভাব লক্ষ করে চাপা গলায় বললেন, এবার আর একশো টাকা নয়, এক লক্ষ টাকা!
এক লক্ষ টাকা! আমি কানে ঠিক শুনছি তো!
বৃষ্টির তেজ হঠাৎই দ্বিগুণ হয়ে গেল। আর আমার কানের ভিতরে কেউ যেন তপ্ত তাওয়ায় রুটি সেঁকতে শুরু করল।
রেস্তোরাঁর রান্নাঘর থেকে চপ-কাটলেটের ম-ম গন্ধ আসছিল। আচমকা সেই গন্ধ মুছে গিয়ে একটা নেশা-ধরানো মিষ্টি গন্ধ ভেসে এল নাকে।
ওই ঝিমঝিম অবস্থার মধ্যেই কৃপানাথের চাপা অথচ স্পষ্ট গলা শুনতে পেলাম ও এক লক্ষ টাকা, অচিনবাবু! আর হেরে গেলে আপনাকে একটি টাকাও দিতে হবে না। এ একেবারে পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা।
আমি কোনওরকমে বাঁ-হাতের কবজি উলটে ঘড়ি দেখলাম। সাড়ে ছটা। আধঘণ্টার ব্যাপার। তা ছাড়া এক লক্ষ টাকা। ওঁর বাড়ি খুব একটা কি দূরে হবে?
আপনার বাড়ি কোথায়? প্রশ্নটা করার সময় আমার গলার স্বর সামান্য কেঁপে গেল।
এই তো, কাছেই…বাদুড়বাগান। ট্যাক্সি ধরব আর টপ করে পৌঁছে যাব।
অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় বিল মিটিয়ে ব্রিফকেস তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন কৃপানাথ। আমাকে হাত নেড়ে তাড়া দিলেন : চলুন, চলুন, বৃষ্টি আরও জোরে এসে গেলেই মুশকিল।
খুশিতে ডগমগ শিশুর মতো কাফে ডি মোনিকো থেকে ফুটপাথে নেমে পড়লেন কৃপানাথ। বৃষ্টিকে ভ্রূক্ষেপ না করেই তড়িঘড়ি পায়ে এগিয়ে গেলেন রাস্তার দিকে। আমি ওঁর কাছে গিয়ে পৌঁছোতে না পৌঁছোতেই ট্যাক্সি পেয়ে গেলেন। কারণ, এবারেও সেই একশো টাকার নোট। তেমন ওজর-আপত্তি তোলার আগেই তিনি একটা একশো টাকার নোট ধরিয়ে দিয়েছেন ট্যাক্সি-ড্রাইভারের হাতে। লোকটার মুখ দেখেই বোঝা গেল, আমাদের গন্তব্য যদি বাদুড়বাগান না হয়ে জাহান্নম বা দোজখ হত তা হলেও তার আপত্তি হত না।
বৃষ্টি, জল আর যানজট পেরিয়ে কৃপানাথ মজুমদারের বাড়ির সামনে এসে যখন পৌঁছোলাম, তখন সাতটা বেজে গেছে। গলিতে জমে ওঠা বৃষ্টির জল গোড়ালি ছাড়িয়ে হাঁটুর দিকে রওনা দিয়েছে। লম্বা সরু গলিতে মাত্র দুটো বাতি টিমটিম করে জ্বলছে। আলোছায়ায় যে কটি বাড়ি দেখতে পেলাম তার সবগুলোই পুরোনো আমলের। আকারে বিশাল অথচ চেহারায় জীর্ণ।
বৃষ্টির জলে ছপছপ শব্দ তুলে কৃপানাথ একটা রংচটা গোলাপি বাড়ির কাছে এগিয়ে গেলেন। বড় মাপের ভারী কাঠের দরজার নানান কারুকাজ। একটা নম্বর প্লেট বসানো থাকলেও আলো আঁধারিতে নম্বরটা ঠিক ঠাহর হল না।
শঙ্কর! শঙ্কর! বলে কৃপানাথ কাকে যেন ডাকলেন।
একটু পরেই বেশ শব্দটব্দ করে দরজা খুলে গেল। দরজার অল্পবয়েসি একটি রোগা ছেলে। বয়েস বিশ-বাইশ হবে বড়জোর। চোখগুলো ড্যাবড্যাবে। মাথায় কঁকড়া চুল। পরনে স্যান্ডো গেঞ্জি আর হাফপ্যান্ট।
কৃপানাথ আমাকে ডাকলেন? আসুন, ভিতরে আসুন, অচিনবাবু।
ভিজে জামাকাপড়ে সপসপ আওয়াজ তুলে দরজা পেরিয়ে ঢুকে পড়লাম ভিতরে।
জায়গাটা উঠোন মতো। বেশ বড়সড়ো। একপাশে বড়-বড় টবে কয়েকটা ক্যাকটাস জাতীয় গাছ। টবগুলো ইট দিয়ে ঘেরা।
উঠোন পেরিয়েই তিনতলা বাড়ি। বাড়ির কার্নিশে লতাপাতা-পরির কারুকাজ। সামনেই শান বাঁধানো সিঁড়ির তিনটে ধাপ। তার দুপাশে মার্বেল পাথর বসানো রোয়াক। রোয়াকের কিনারায় কয়েকটা নকশা কাটা লোহার থাম।
শঙ্কর দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। আমি আর কৃপানাথ তিনটে সিঁড়ির ধাপ উঠে ঢুকে পড়লাম বাড়ির ভিতরে। যেতে যেতে পেছনদিকে মুখ ফিরিয়ে শঙ্করকে লক্ষ্য করে কৃপানাথ বললেন, ওঁকে দোতলার ঘরে বসাচ্ছি। তুই চায়ের ব্যবস্থা কর।
বাড়িটার অলিন্দ, সিঁড়ি, বারান্দা সবকিছুর মধ্যেই যেন জমিদারি মেজাজ। কিন্তু গোটা বাড়িটা খাঁ-খাঁ করছে। মোট তিনটে প্রাণী ছাড়া আর কোনও সাড়াশব্দ নেই। কিন্তু একটু পরেই বুঝতে পারলাম, আরও একটা প্রাণী বাড়িতে আছে।
দোতলার একটা সাবেকি ঘরে আমাকে বসালেন কৃপানাথ। বললেন, আগে একটু চা-টা খেয়ে নিন, তারপর খেলা-টেলা হবেখন।
ঘরটা একইসঙ্গে বসবার ঘর এবং শোওয়ার ঘর। মেঝেতে যথারীতি মার্বেল পাথর। দক্ষিণের দেওয়ালে খড়খড়ি দেওয়া বিশাল দুটো জানলা। জানলার সামনে রঙিন কাচের শার্সির ভাজ করা পাল্লা সামান্য খোলা রয়েছে। খাটটাকে খাট না বলে পালঙ্ক বললেই মানায় বেশি। বোঝা যায়, কৃপানাথ এই ঘরেই বাস করেন।
ঘরটা সাজানো-গোছানো শৌখিন। তবে আলোর ব্যবস্থা পুরোনো ধাঁচের। অলিন্দ, সিঁড়ি, বারান্দা, ঘর–সব জায়গাতেই সাধারণ বৈদ্যুতিক বা, টিউব লাইটের কোনও ব্যাপার নেই।
তা হোক। এক লক্ষ টাকা সব সময়েই এক লক্ষ টাকা–তা সে যে আলোতেই গুনি না কেন!
কৃপানাথ একটা তোয়ালে নিয়ে এসে আমার হাতে দিলেন। বললেন, গা-হাত-পা-মাথা সব মুছে নিন। যা ভেজান ভিজেছেন!
আমি বৃষ্টির শব্দ শুনতে-শুনতে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছলাম। তারপর গা-হাত-পা যতটা সম্ভব মুছে নিলাম। নাকটা সুড়সুড় করে তিনবার হাঁচি হল। কৃপানাথ তোয়ালে ফেরত নিতে নিতে বললেন, এক কাপ গরম চা খেলেই সব সেরে যাবে। আপনি একটু বসুন, আমি ভিজে জামাকাপড়গুলো ছেড়ে আসছি।
কৃপানাথ চলে যাওয়ার পর আমি একটা সিগারেট ধরালাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শঙ্কর ঘরে ঢুকল। হাতের ট্রে থেকে কাপ-প্লেটগুলো নামিয়ে দিল টেবিলে। কাপে সুন্দর রঙের ধোঁয়া-ওঠা চা। আর প্লেটে ডিমের বড়া, সঙ্গে টোম্যাটো সস।
আমি আর দেরি করতে পারলাম না। শীত শীত ভাবটাপ কাটাতে সিগারেটে টানের সঙ্গে-সঙ্গে চা খেতে শুরু করলাম।
একটু পরেই কৃপানাথ ঘরে এলেন। ভিজে পোশাক পালটে একটা ঘিয়ে রঙের হাফহাতা হাওয়াই শার্ট আর পাজামা পরে এসেছেন।
আমার প্রায় মুখোমুখি একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়লেন কৃপানাথ। ওঁকে সিগারেট অফার করতে হাত তুলে না বললেন। তারপর ডিমের বড়ায় কামড় দিয়ে তৃপ্তির একটা শব্দ করলেন। বললেন, শঙ্করটা বড় ভালো রান্না করে।
হঠাৎই আমার চোখ পড়ল কৃপানাথের বাঁ-হাতের দিকে। এতক্ষণ ওঁকে পাঞ্জাবি পরা অবস্থায় দেখেছি, তাই ব্যাপারটা আগে নজরে পড়েনি।
অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, কৃপানাথের বাঁ-হাতের কবজি থেকে কনুই পর্যন্ত অনেকগুলো শুকনো ক্ষত। ক্ষতের চেহারা পুরোনো আমলের টিকের দাগের মতো–যেন চিতাবাঘের চাকা-চাকা দাগ।
আমার নজর কৃপানাথের চোখ এড়ায়নি। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে খানিকটা সময় নিলেন। তারপর শান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে সামান্য হেসে জিগ্যেস করলেন, কী দেখছেন, অচিনবাবু?
আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। ওঁর বাঁ হাতের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। বললাম, না, কিছু না।
কৃপানাথ এক দুর্জ্ঞেয় হাসি ফুটিয়ে তুললেন ঠোঁটে। বললেন, একটু আগেই আপনাকে বলছিলাম না, কৌতূহলই সব কিছুর মূলে। তবে আপনার কোনও চিন্তা নেই–একটু পরেই সবকিছু জানতে পারবেন।
জানলায় বৃষ্টির শব্দ রীতিমতো বেড়ে উঠেছে। ঝোড়ো হাওয়ার দাপটে কোথায় যেন খটাস খটাস শব্দ হচ্ছে। মাথার ওপরে ফ্যান ঘুরছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও কেমন গুমোট ভাব। ঘরের মার্বেল পাথর বসানো মেঝেতে আমাদের অদ্ভুত ছায়া নড়ছে।
সিগারেট ও চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে ভাবছিলাম, কৃপানাথ কখন আবার এক লক্ষ টাকার প্রসঙ্গ তুলবেন। বুঝতে পারছি, পাগলের পাল্লায় পড়েছি। তবে বড়লোক পাগল বলেই এখনও খানিকটা আশা নিয়ে অপেক্ষা করছি।
খেতে-খেতে আমরা টুকটাক গল্প করছিলাম। আমি অনুরাধা, বুবু-টুটুর কথা বললাম। কৃপানাথ ওঁর জমিদার বাপ-ঠাকুরদার কথা বললেন। তারপর হঠাৎই বিষণ্ণ হেসে বললেন, আপনার মতো আমিও বিয়ে করেছিলাম। প্রায় তিরিশ বছর আগে। বিয়ের বছর দুয়েকের মধ্যেই বেচারি বউটা মরে গেল।
কৃপানাথের শান্ত চোখ আচমকা কেমন চঞ্চল হয়ে উঠল। চেয়ারটা পেছনে ঠেলে দিয়ে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলুন, আর দেরি করে লাভ নেই।
আমিও উঠে পড়লাম।
কৃপানাথ ফ্যানটা অফ করে দিলেন। তারপর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে বারান্দা ধরে হাঁটা দিলেন। আমি ওঁকে অনুসরণ করলাম। বুকের ভিতরে কেমন যেন ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছিল।
বৃষ্টির ছাটে চওড়া বারান্দার অনেকটাই ভেসে গেছে। বাতাসে উড়ে আসা অসংখ্য জলকণা মিহি পাউডারের গুঁড়োর মতো আমাদের শরীরে ছড়িয়ে পড়ছিল। কেমন এক অদ্ভুত ঠান্ডা আমেজ টের পাচ্ছিলাম। কোথায় যেন কড়কড় শব্দে বাজ পড়ল।
বারান্দার রেলিঙের কাছে গিয়ে ওপরে তাকিয়ে আকাশ দেখলাম। সেখানে বোধহয় জমাট কালো মেঘ, কারণ কিছুই দেখতে পেলাম না। তারই মাঝে হঠাৎ বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল।
কৃপানাথ আমাকে তাড়া দিলেন : কী হল! আসুন–দেরি হয়ে যাচ্ছে।
দেরি! কিসের দেরি!
প্রশ্ন না করে তাড়াতাড়ি কৃপানাথকে অনুসরণ করলাম।
বারান্দার একেবারে শেষ প্রান্তে এসে একটা ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন কৃপানাথ। দরজার ভারী তালা ঝুলছে। পকেট থেকে চাবি বের করে তালা খুললেন। তারপর দু-হাতে ঠেলে দরজার পাল্লা দুটো খুলে দিলেন।
অন্ধকার ঘরের মধ্যেই ফুলঝুরির মতো কয়েকটা রঙিন আলোর ফুলকি হঠাৎ যেন ঝলসে উঠেই নিভে গেল। কোথা থেকে এল এই রঙিন আলো? নাকি আমার দেখার ভুল?
ঘরে ঢুকেই কৃপানাথ আলো জ্বেলে দিলেন, ফ্যান অন করলেন। ওঁকে অনুসরণ করে ভিতরে ঢুকেই কেমন একটা মিষ্টি গন্ধ পেলাম। সামান্য ঝাঁঝালো অথচ মিষ্টি গন্ধ।
ঘরটার চেহারা বা চরিত্র কৃপানাথের ঘরের মতোই শুধু মাপে একটু ছোট। আর ঘরের বাঁ-দিকের দেওয়ালের খানিকটা অংশ কালো পরদা দিয়ে ঢাকা।
ঘরের জানলা মাত্র একটি। কৃপানাথ জানলার রঙিন শার্সির পাল্লা খুলে দিলেন। তারপর জানলার পাল্লাও খুলে দিলেন। বর্ষা ঘরের ভিতর ঢুকে পড়ল। সেই সঙ্গে ঠান্ডা বাতাস।
ঘরের যে জিনিসটা প্রথমেই চোখ টানে সেটা একটা প্রকাণ্ড বাক্স। বাক্সটার মাপ অন্তত ছফুট বাই ছফুট বাই আট ফুট। অ্যালুমিনিয়াম অথবা স্টেইনলেস স্টিল, ওই জাতীয় কিছু দিয়ে তৈরি। বাবের আলো পড়ে বেশ চকচক করছে। লক্ষ করলাম, বাক্সের গায়ে তিন-চার জায়গায় বেশ কয়েকটা করে ফুটো রয়েছে।
অদ্ভুত বাক্সটা আমাকে বেশ অবাক করল।
বাক্স ছাড়া ঘরের মধ্যে রয়েছে একটা টেবিল, দুটো চেয়ার আর একটা শৌখিন ক্যাবিনেট। টেবিলে কয়েকটা লেখার প্যাড আর ডট পেন রয়েছে।
কৃপানাথ একটা চেয়ারের দিকে ইশারা করে আমাকে বসতে বললেন। তারপর ক্যাবিনেটের কাছে গিয়ে চাবি ঘুরিয়ে তার পাল্লা খুলে ফেললেন।
তখনই আমার চোখে পড়ল থরে থরে সাজানো নোটের বান্ডিল।
আন্দাজেই বুঝতে পারলাম, এক লক্ষ নয়, তার অন্তত চার-পাঁচ গুণ টাকা রয়েছে ক্যাবিনেটে।
কৃপানাথ শব্দ করে দু-হাতে তালি দিয়ে হাত ঝাড়লেন। তারপর আমার মুখোমুখি চেয়ারে বসে মুচকি হেসে বললেন, অচিনবাবু, এইবারে শুরু হোক মজার খেলা। বলুন দেখি, ওই বাক্সের ভিতরে কী আছে?
প্রশ্নটা করে কৃপানাথ মজুমদার আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। প্রত্যাশায় দু-চোখ জুলজুল করছে। ময়লা হয়ে যাওয়া বাবের আলো তেরছাভাবে পড়েছে ওঁর মুখে। তোবড়ানো গাল আর চামড়ার ভঁজে ছায়া পড়ে অদ্ভুত দেখাচ্ছে।
বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি। বাজ পড়ছে। মেঘ ডাকছে। তবু তারই ফাঁকে বাক্সের ভিতর থেকে ভেসে আসা একটা খচড়-খচড় শব্দ কানে এল।
কৃপানাথ আবার একই প্রশ্ন করলেন। তারপর বললেন, যদি ঠিক ঠিক বলতে পারেন তা হলে ওই ক্যাবিনেট থেকে ক্যাশ এক লাখ টাকা আপনাকে দিয়ে দেব।
আর যদি না পারি? মিথ্যে বলব না, আমার কেমন যেন ভয় ভয় করছিল। কী আছে ওই বাক্সের ভিতরে? কী রহস্য লুকিয়ে আছে রঙিন আলোর ফুলকি আর ঝাঝালো মিষ্টি গন্ধের পেছনে?
কৃপানাথ আবার হাসলেন। দূরে কোথাও বাজ পড়ার শব্দ হল। বৃষ্টির একটানা ঝমঝম আর আলাদা করে কানে আসছে না।
একবারে ঠিক-ঠিক বলতে হবে তা তো বলিনি! কৃপানাথ বাক্সটার দিকে শান্ত উদাস চোখে তাকিয়ে বললেন, একবার না পারলে আবার চেষ্টা করবেন। তাতেও না পারলে আবার।
মনে একটু ভরসা পেলাম। যাক, তা হলে অনেকবার সুযোগ পাওয়া যাবে। কিন্তু ঠিক কবার? সেকথাই জিগ্যেস করলাম কৃপানাথকে।
তিনি হেসে বললেন, আপনিই বলুন, কতবার চান্স দেব আপনাকে।
বুকের ভিতরে কেমন গুড়গুড় শব্দ হল। কবার সুযোগ চাইব? একশো, দুশো, তিনশো, না কি পাঁচশো?
এক হাজার এক বার। সংখ্যাটা আচমকাই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল আমার। আর তখনই বাক্সটার ভিতর থেকে ঝটাপটির শব্দ পেলাম।
কৃপানাথ চট করে উঠে চলে গেলেন বাক্সের কাছে। বাক্সের গায়ে পরম মমতায় হাত বোলাতে বোলাতে চুকচুক শব্দ করলেন মুখ দিয়ে, তারপর আলতো করে শিস দিয়ে এক অদ্ভুত সুর ছড়িয়ে দিলেন বাতাসে।
বাক্সের ভিতরে সব শান্ত হয়ে গেল।
আমার দিকে তাকিয়ে কৃপানাথ মলিন হেসে বললেন, দেরি হচ্ছে তো, তাই বড় অধীর হয়ে উঠেছে। একটু থেমে আবার বললেন, আপনার কথাই সই। এক হাজার এক বার চান্স দেব আপনাকে। তার মধ্যে নিশ্চয়ই পেরে যাবেন। নিন, শুরু করুন।
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে বাক্সটার কাছে এগিয়ে গেলাম।
লক্ষ করলাম, বাক্সটার একদিকে একটা ছোট্ট চৌখুপি জানলা রয়েছে। তবে জানলাটার পাল্লা ছোট্ট হাঁসকল দিয়ে আটকানো।
এটুকু বুঝতে অসুবিধে হল না, বাক্সের ভিতরে কোনও প্রাণী রয়েছে। কৃপানাথের পোষা প্রাণী।
আমি বাক্সের গায়ের ফুটোগুলোয় চোখ রাখলাম। কিন্তু ভিতরে জমাট অন্ধকারে ঠিকমতো কিছু ঠাহর করতে পারলাম না।
তখন ঝুঁকে পড়ে বাক্সের ঠান্ডা ধাতব দেওয়ালে কান পেতে মনোযোগ দিয়ে শব্দ শোনার চেষ্টা করলাম। একটা খড়খড় শব্দ, আর তার সঙ্গে জোরে-জোরে নিশ্বাস ফেলার ফেস-ফোঁস শব্দ–আর কিছু শোনা গেল না।
আমি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললাম, শজারু?
কৃপানাথ হেসে মাথা নাড়লেন। বললেন, হল না। তারপর টেবিলের কাছে এগিয়ে গেলেন। ডট পেন তুলে নিয়ে একটা প্যাডের পাতায় খসখস করে কী লিখলেন। বললেন, আপনি কতবার চেষ্টা করলেন প্যাডের পাতায় তার হিসেব রাখছি। নিন, বলুন, আর হাজারটা চান্স রয়েছে। আপনার–।
ইঁদুর?
নাঃ, হল না। প্যাডের ওপরে পেন সক্রিয় হল আবার।
কুকুর? বেড়াল?
না
খরগোশ? বেজি?
হল না। কৃপানাথ শান্তভাবে আমার অনুমান খারিজ করে দিলেন।
শুয়োর? হায়না? না কি নেকড়ে?
উঁহু, কোনওটাই না।
বানর? হনুমান?
উঁহু–আর নশো নব্বইটা চান্স আছে আপনার। কৃপানাথ ঠান্ডা গলায় বললেন। খোলা জানলা দিয়ে বৃষ্টির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর বাক্সের একটা ফুটোর কাছে মুখ এনে সুর করে শিস দিলেন। বাক্সের ভিতর থেকে যা সামান্য কিছু অস্থির শব্দ আসছিল সব পলকে শান্ত হয়ে গেল।
আর নশো নব্বইটা চান্স বাকি! টাকার বান্ডিলগুলোর দিকে চোখ গেল আমার। আবার কান পাতলাম বাক্সের গায়ে। কোন হতচ্ছাড়া প্রাণী লুকিয়ে আছে এই বাক্সের ভিতরে? এর মধ্যেই এগারোবার আমার ভুল হয়েছে। যদি বাকি নশো নব্বইবারও ভুল হয়? তা হলে কী হবে! কৃপানাথ আমার এই প্রশ্নের উত্তর দেননি। না কি এবারও সেই আগের তিনবারের মতো একমুখো বাজি?
আমার দ্বিধাগ্রস্ত মুখ দেখে কৃপানাথ হাত উলটে জানতে চাইলেন, কী ব্যাপার? কী ভাবছেন?
একটু দোনামনা করে আমি বলেই ফেললাম, যদি বাকি নশো নব্বইবারও আমার ভুল হয়, তা হলে কী হবে?
কৃপানাথ কিছুক্ষণ ঠোঁট টিপে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর এক পা এগিয়ে এলেন আমার কাছে। বাতিটা পেছনদিকে থাকায় ওঁর মুখটা অন্ধকার দেখাল। থেমে থেমে তিনি বললেন, ভয় নেই, এক লাখ টাকা চাইব না। তবে খুব সাধারণ একটা জিনিস চাইব। খুব সাধারণ–একেবারে মামুলি।
কী সাধারণ জিনিস? যদি সেটা না থাকে আমার কাছে!
আমি একটু হোঁচট খেয়ে বললাম, না, মানে…যদি সেটা আমি দিতে না পারি…।
কৃপানাথ হাসলেন। বললেন, পারবেন না মানে! একেবারে মামুলি জিনিস..আপনার সঙ্গেই আছে..।
আমার সঙ্গেই আছে! সঙ্গের জিনিস বলতে তো জামা-প্যান্ট, চশমা, কিছু খুচরো টাকা পয়সা, কৃপানাথের দেওয়া দুটো একশো টাকার নোট, একটা ছোট ডায়েরি, রুমাল, আর অফিসের আলমারির চাবি। এর মধ্যে কোন জিনিসটা কৃপানাথ মজুমদারের দরকার?
কড়কড় শব্দে বাজ পড়ল। ঝোড়ো বাতাসে বৃষ্টির ছাট তীব্র হয়ে উঠল। বাক্সের ভিতরের নাম-না-জানা প্রাণীটা আচমকা দাপাদাপি শুরু করে দিল।
কৃপানাথ চোখ থেকে চশমা খুলে নিয়ে জামার খুঁট দিয়ে কাচ মুছলেন। তারপর সেটা আবার যত্ন করে নাকের ওপরে বসিয়ে আমার খুব কাছে এসে দাঁড়ালেন। ঝাঁঝালো মিষ্টি গন্ধটা আবার হালকাভাবে ভেসে আসতে লাগল বাক্সের দিক থেকে।
কৃপানাথ বললেন, অচিনবাবু, আপনাকে প্রাণীটা সম্পর্কে কয়েকটা হিন্টস দিতে পারি– তবে নাম বলতে পারব না। আপনি আপনার খুশি মতো প্রশ্ন করতে পারেন, আমি যদূর সম্ভব উত্তর দেব।
আমি বাক্সটাকে একবার দেখলাম, তারপর বাক্সের মালিককে, আর সবার শেষে তাকালাম খোলা ক্যাবিনেটের দিকে। টাকার আকর্ষণী ক্ষমতা চুম্বকের চেয়েও বেশি। হাতে এখনও নশো নব্বইবার চান্স রয়েছে। নিশ্চয়ই তার মধ্যে পেরে যাব।
সুতরাং কিছু হিন্টস চেয়েই দেখা যাক।
প্রাণীটা কি স্থলচর?
আমি অন্তত সেরকমই জানি। কৃপানাথ মজুমদার হেঁয়ালিভরা সুরে উত্তর দিলেন।
ওটার কটা পা?
আমার হিসেবমতো চারটে।
লেজ আছে?
একটু সময় নিয়ে তারপরঃ আছে।
কটা চোখ?
বোধহয় দুটো।
নিজের পোষা প্রাণী নিয়ে কৃপানাথ কি আমার সঙ্গে মজা করছেন? আমি একটু রুক্ষভাবেই জিগ্যেস করলাম, বোধহয় দুটো মানে?
কৃপানাথ হেসে আমার কাঁধে হাত রাখলেন। বললেন, রেগে যাচ্ছেন কেন, ভাই। এই ধরুন মাছির চোখ। এমনিতে দেখলে মনে হয় দুটো, অথচ আসলে অনেক–মানে পুঞ্জাক্ষি আর কি! এই প্রাণীটারও হয়তো সেরকম হতে পারে। আমি ঠিক জানি না।
সবকিছু কেমন যেন জট পাকিয়ে যেতে লাগল। চারটে পা, একটা লেজ, স্থলচর প্রাণী– অথচ পুঞ্জাক্ষি? আমি স্বপ্ন দেখছি না তো!
কৃপানাথ এবার ছোট ছোট পা ফেলে চেয়ারে গিয়ে বসলেন। শান্ত চোখে আমাকে দেখতে লাগলেন।
আমি জিগ্যেস করলাম, টিকটিকি?
কৃপানাথ বললেন, না।
গোসাপ?
না। কোমোডো দ্বীপের ড্রাগন? আর্মাডিলো?
উঁহু।
আমি একের পর এক প্রাণীর নাম বলে যেতে লাগলাম। আর কৃপানাথ শান্ত ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে প্রত্যেকবারই জানিয়ে দিতে লাগলেন, হয়নি। একইসঙ্গে তিনি প্যাডের কাগজে পেন দিয়ে লিখে হিসেব রাখছিলেন। আমার শিশুপালের কথা মনে পড়ছিল। এক হাজার এক কখন শেষ হবে?
ক্রমেই আমার ধৈর্য কমছিল, আর কৌতূহল বাড়ছিল। আমি একের পর এক প্রাণীর নাম বলতে-বলতে কান্ত হয়ে পড়লাম। অবাক হয়ে শুনলাম, আমি বাঘ, সিংহ, গণ্ডার, হাতি, উট, জিরাফ, এমনকী জেব্রার নামও বাদ দিলাম না। তারপর একসময় সাপ, ব্যাঙ, কচ্ছপের নামও বলেছি, কিন্তু যথারীতি ঠিক হয়নি। ক্লান্ত হয়ে ভুল করে তিমি আর হাঙরের নামও উচ্চারণ করে ফেলেছি। মরিয়া হয়ে ড্রাগন আর খোকা ডাইনোসরের কথাও বলেছি। তখন কৃপানাথ হেসে বললেন, আপনার মাথা আর কাজ করছে না, অচিনবাবু। একটু ভেবেচিন্তে বলুন। এখনও আপনার সাতশো বত্রিশটা চান্স রয়েছে।
এখনও সাতশো বত্রিশ!
আমার মুখে ফেনা কাটছিল। জিভে টক স্বাদ। জানলা খোলা থাকা সত্ত্বেও কেমন দম বন্ধ হয়ে আসছিল। একসময় আর না পেরে বলে উঠলাম, আমি আর পারছি না, কৃপানাথবাবু। আর কোনও প্রাণীর নাম ভাবতে পারছি না।
কৃপানাথ প্যাড-পেন একপাশে সরিয়ে রেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। আপনমনেই বিড়বিড় করে বললেন, আড়াইশো নাম হতে না হতেই সব হাঁফিয়ে পড়ে। একজন মাত্র সাড়ে চারশোর মতো নাম পর্যন্ত বলতে পেরেছিল।
কৃপানাথ আমার কাছে এগিয়ে এলেন। বললেন, তা হলে এই খেলাটায় আপনি হেরে গেলেন, অচিনবাবু?
আমি ক্লান্তভাবে মাথা নাড়লাম ও নাঃ, পারলাম না। এক লাখ টাকা আমার আর জেতা হল না।
কৃপানাথ স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। ওঁর চোখেমুখে উল্লাস এখন আর লুকোনো নেই। বললেন, আপনি এবার প্রাণীটাকে দেখতে পারেন। তা হলেই বুঝতে পারবেন, কেন ওটার নাম আপনি বলতে পারেননি–কোনওদিনও পারতেন না। আসলে আমিও ওটার নাম জানি না। কী নামে ডাকি বলুন তো ওকে! কিম্ভুত?
আমি কোনও জবাব দিলাম না। আমার কেমন ভয়-ভয় করছিল। মনে হচ্ছিল, আজ বিকেলে এই অদ্ভুত মানুষটির সঙ্গে আমার দেখা না হলেই ভালো হত। বিনা পরিশ্রমে পাওয়া দুশো টাকার তৃপ্তি কখন যেন উবে গেছে মন থেকে। ঘড়িতে প্রায় নটা বাজে। অথচ তখনও বাইরের কালো আকাশে শুধু বিপর্যয়ের ছবি।
আসুন, ওটাকে দেখবেন আসুন। কৃপানাথ আমাকে বাক্সের কাছে ডাকলেন, ওই ফুটোগুলোয় চোখ রাখুন, আমি ভিতরের একটা আলো জ্বেলে দিচ্ছি।
আমি চোখ রাখলাম।
প্রথম কয়েকটা মুহূর্ত অন্ধকার। তবে তারই মধ্যে ছিটকে বেরোল কয়েকটা রঙিন আলোর ফুলকি। আর পরক্ষণেই জোরালো আলোর ভেসে গেল বাক্সের ভিতরটা। এবং অদ্ভুত প্রাণীটাকে আমি দেখতে পেলাম।
কৃপানাথ মজুমদার মিথ্যে বলেননি। এরকম বিচিত্র গা শিরশির করা প্রাণীর নাম পৃথিবীর প্রাণিজগতের তালিকায় যে নেই, একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
বুলডগের মতো থ্যাবড়া মুখ। চ্যাপটা মাথার ওপরদিকে দুটো টকটকে লাল চোখ। মুখের সামনের দিকে কয়েকটা ছুঁচোলো দাঁত বিশ্রীভাবে বেরিয়ে আছে। উজ্জ্বল গোলাপি রঙের পুরু ঠোঁট। ঠোঁট আর দাঁতের ফাঁক দিয়ে মোটা পাইপের মতো একটা কালো জিভ বারবার বেরিয়ে আসছে বাইরে। লম্বায় জিভটা প্রায় হাত দুয়েক হবে। জিভটা সাপের মতো এপাশ-ওপাশ নড়ছে–যেন কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছে।
প্রাণীটার সারা শরীর যেন এবড়োখেবড়োভাবে সিমেন্ট জমিয়ে তৈরি। কোথাও উঁচু, কোথাও নীচু। রং ধূসর, তার মাঝে কালো ছোপ-ছোপ। এ ছাড়া আঁশের মতো চাকা-চাকা কোনও জিনিস দিয়ে সারা শরীরটা ঢাকা।
কৃপানাথ ঠিকই বলেছিলেন, প্রাণীটার চারটে পা, আর একটা লেজ আছে।
তবে ঠিক বলতে শুধু ওইটুকুই। কারণ চারটে পা চার রকম মাপের এবং শরীরের বেখাপ্পা চারটে জায়গা থেকে বেরিয়ে আছে সাধারণ প্রাণীর মতো কোনও সামঞ্জস্য সেখানে নেই। তবে প্রত্যেকটা পায়েই দশ-বারোটা করে আঙুল, আর আঙুলের ডগা থেকে ছুঁচের মতো সরু-সরু নখ বেরিয়ে রয়েছে।
প্রাণীটার লেজটাও ভারি অদ্ভুত। আঁশ দিয়ে ঢাকা একটা মাংসপিণ্ড ওটার শরীরের পেছনদিকে ঝুলছে। পিটার চেহারা অনেকটা পানের মতো। আর তার রং লাল-সবুজ ডোরাকাটা।
সব মিলিয়ে প্রাণীটার দৈর্ঘ্য তিন-সাড়ে তিন ফুট হবে। অদ্ভুত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ওটা চলে বেড়াচ্ছে বাক্সের ভিতরে–মেঝে, দেওয়াল, সিলিং–সব জায়গায়। ক্ষিপ্রভাবে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় চলে যাচ্ছে বুলেটের গতিতে। তারপর থামছে। ওটার চোখ নড়ছে, জিভ নড়ছে। আর সারা শরীরে লেগে রয়েছে হলদেটে সবুজ শ্যাওলার মতন লালা। ওটার মুখ থেকেই ওই আঠালো তরল বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে বাক্সের নানা জায়গায়।
হঠাৎই ঝাঁঝালো মিষ্টি গন্ধটা পেলাম। তবে সেটা লালার গন্ধ, না ওটার শরীরের গন্ধ, তা বুঝতে পারলাম না।
আমার মুখ থেকে অস্ফুট একটা শব্দ বেরিয়ে এল। সঙ্গে-সঙ্গে ভিতরের বাতিটা অফ করে দিয়ে কৃপানাথ আমাকে জিগ্যেস করলেন, ভয় পেলেন, অচিনবাবু?
আমার মাথা ঝিমঝিম করছিল, বমি পাচ্ছিল। তবু তারই মধ্যে লক্ষ করলাম, অন্ধকার বাক্সের ভিতরে কয়েকটা রঙিন আলোর ফুলকি ঠিকরে বেরোচ্ছে। কৃপানাথের সঙ্গে এ-ঘরে ঢোকার সময় অন্ধকারে এই রঙিন আলোর ঝিলিকই আমি দেখতে পেয়েছিলাম। প্রাণীটার দেখছি গুণের শেষ নেই!
আমার কাছ থেকে কোনও উত্তর না পেয়ে কৃপানাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, বললেন, ওকে দেখে সবাই ভয় পায়। অথচ ও যে কী ভালো আপনাকে কী বলব! সেই জন্ম থেকেই তো ওকে দেখছি। আমিই ওর মা, আমিই ওর বাপ। আসুন, আপনাকে একটা মজার জিনিস দেখাই। বাক্সের ফুটো দিয়ে আবার দেখুন।
আমি বোধহয় সম্মোহিত হয়ে পড়েছিলাম। নইলে কৃপানাথের সব কথা সুবোধ ছাত্রের মতো শুনবই বা কেন!
ওঁর কথায় বাক্সের গর্তে আবার চোখ রাখলাম।
কৃপানাথ টিউব লাইটের মতো একটা আলো জ্বেলে দিলেন। সঙ্গে-সঙ্গে একটা বিচিত্র ব্যাপার আমার চোখে পড়ল।
প্রাণীটার সারা শরীর নানান রঙে রঙিন হয়ে গেছে। জিভটা নীলচে বেগুনি, আর মাথা বুক সব গনগনে লাল–তার মধ্যে হলদে রঙের ছিটে। ওর শ্যাওলার মতো হলদেটে সবুজ লালার রং এখন উজ্জ্বল নীল।
কৃপানাথ বাক্সের অন্য দেওয়ালের গর্ত দিয়ে প্রাণীটাকে দেখছিলেন। আমাকে উদ্দেশ করে বললেন, যে-আলোটা জ্বেলেছি সেটা আলট্রাভায়োলেট আলো। দেখেছেন, ওর গায়ের রং কেমন পালটে গেছে! খিদেয় পাগল হয়ে গেলে এই আলোর ওর চেহারাটা এরকম গনগনে লাল দেখায়।
বাক্সের ফুটো থেকে চোখ সরিয়ে কৃপানাথ মজুমদার আলো নিভিয়ে আমার কাছে এলেন। নীচু গলায় বললেন, অচিনবাবু, আপনাকে আমার বউয়ের কথা বলেছিলাম–বিয়ের দু-বছর পর মারা গেছে। ওর ছবি দেখবেন?
আমি ফ্যালফ্যাল করে কৃপানাথের দিকে তাকালাম। শেষ বাজিটায় হেরে গিয়ে আমি বোধহয় একটা মানসিক ধাক্কা খেয়েছি। অনুরাধা-বাবু-টুটু এখন যেন কত দূরের মানুষ। শুধু এই ঘোরতর বৃষ্টি, বাজ পড়ার শব্দ, সাবেক আমলের বাড়ি, কৃপানাথ মজুমদার, এই রহস্যময় বাক্স এবং তার বাসিন্দা ওই ভয়ংকর প্রাণী–শুধু এইসবই সত্যি।
কোথায় আপনার স্ত্রী-র ছবি, দেখি?
কৃপনাথ সতেজ পায়ে বাক্সের পেছনদিকের দেওয়ালের কাছে চলে গেলেন। দেওয়ালটার খানিকটা জুড়ে যে-কালো পরদা ছিল সেটা টেনে সরাতেই ধুলো উড়ল, মাকড়সার জাল-ঝুল-কালি চোখে পড়ল। আরও চোখে পড়ল মলিন দেওয়ালে টাঙানো একটা ছবি। এক মহিলার ছবি। সম্ভবত তেলরঙে আঁকা।
কিন্তু এ কেমনধারা ছবি!
লাল টকটকে বেনারসি কাপড়ে মহিলার কপাল আর চোখের বেশ খানিকটা ঢাকা। থ্যাবড়া মুখ। লালচে চোখের তারা। পুরু গোলাপি ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে কয়েকটা ছুঁচোলো দাঁত বেরিয়ে রয়েছে।
বিশ্রী শব্দে বাজ পড়ল কোথাও। মনে হল যেন বুকের ভিতরে। বৃষ্টি ভেজা বাতাবরণে শনশন শব্দে বাতাস ছুটল। বড় একটা গাছের ডাল মিটাস করে ভেঙে পড়ল কাছাকাছি।
ছবিটার দিকে আঙুল দেখিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন কৃপানাথ, আমার ওয়াইফ সহধর্মিণী! বিয়ের দু-বছরের মাথায় বাচ্চা হতে গিয়ে মারা গেছে। তবে বাচ্চাটা বেঁচে গিয়েছিল।
ছেলে? অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রশ্নটা বেরিয়ে গেল আমার মুখ থেকে।
কৃপানাথ তেতো হাসলেন। ওঁর শান্ত চোখ এখন উন্মাদ, উদ্ভ্রান্ত। দু-পাশে ধীরে-ধীরে মাথা নেড়ে ভয়ংকর সুরে বললেন, হুঁ! ছেলেও নয়, মেয়েও নয়–বাচ্চা। তবে কীসের বাচ্চা কে জানে! সেটাকেই আমি মায়ের মমতায় আর বাপের স্নেহে আটাশ বছর ধরে বাঁচিয়ে রেখেছি–ওই বাক্সের ভিতরে–ওই ইবলিশের বাচ্চাটাকে।
আমার বুকের ভিতরে ঢং-ঢং করে ঘণ্টা বাজতে শুরু করল। এতক্ষণ ধরে ভিজে কাপড়ে থাকার জন্যেই বোধহয় শীত-শীত করতে লাগল আবার। কৃপানাথ মজুমদারের কালো ছায়ার খানিকটা বাক্সের গায়ে, খানিকটা দেওয়ালে কালো পরদার পাশে। পরদাটা জোলো বাতাসে অল্প-অল্প কাঁপছে। নাকে মিষ্টি ঝাঁঝালো গন্ধ বেশ টের পাচ্ছি। আমার কেমন ঘুম পেতে লাগল।
কৃপানাথ ভাঙা গলায় বিকৃত স্বরে বলতে লাগলেন, ওই তো আমার বউ–আর এই তো আমি! বুকে হাত চাপড়ালেন তিনি? অথচ এই কিস্তৃত বাচ্চাটা যে কেমন করে জন্মাল ঈশ্বর জানেন! ওটার জন্মের সময় দুজন নার্স অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। আর একজন ডাক্তার মারা যায়– কে যেন তার শরীরের সমস্ত রক্ত চুষে বের করে নিয়েছিল। হঠাৎই ডুকরে কেঁদে উঠলেন কৃপানাথ। জড়ানো গলায় বললেন, পরে বুঝতে পেরেছি, কে ওই কাজ করেছে।
ছবির দিকে আঙুল তুলে অভিযোগের সুরে চেঁচাতে লাগলেন কৃপানাথ, তোমার বাচ্চা, সুরমা, তোমার বাচ্চা! এই আটাশটা বছর ধরে প্রতি মাসে একবার করে ওর খাবার জোগাড় করতে করতে আমি পাগল হয়ে গেলাম। মাসে একবার করে অচিনবাবুর মতো সোজাসাপটা ভালোমানুষ কোনও লোকের সঙ্গে গায়ে পড়ে আলাপ করে, ভুলিয়ে-ভালিয়ে, টাকার লোভ দেখিয়ে, কৌতূহল চাগিয়ে, আমাকে খুঁসলে নিয়ে আসতে হয় এই বাক্সের কাছে। তারপর সেই একই খেলা–মজার খেলা। বলুন, বাক্সের ভিতরে কী আছে! ওঁদের লোভ আর কৌতূহলই আমার ভরসা।
আচমকা হাসতে শুরু করলেন কৃপানাথ মজুমদার। কিন্তু এক অদ্ভুত হাহাকার লুকিয়ে ছিল সেই হাসিতে। এক ক্লান্ত পিতার সন্তান লালনপালনের কষ্ট আর একইসঙ্গে মমতার টান কী বিচিত্র টানাপোড়েনের মধ্যেই না ফেলেছে মানুষটাকে!
এক রিনরিনে হাসির আওয়াজ শুনলাম মনে হল। না কি বৃষ্টির শব্দে ভুল শুনেছি? সুরমার ছবিতে বেনারসি শাড়ির ঘোমটা সামান্য নড়ে গেল। না কি আমার দেখার ভুল? গোলাপি রঙের লিপস্টিকে রাঙানো ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে লাল টুকটুকে জিভের ডগা সামান্য উঁকি মারল, আরও কটা দাঁত দেখা গেল।
আমার বুক কেঁপে উঠল ভয়ে। আর সঙ্গে-সঙ্গে এক ঝটকায় ছবির ওপরে পরদা টেনে দিলেন কৃপানাথ। দাঁতে দাঁত চেপে চোয়াল শক্ত করে এগিয়ে এলেন আমার কাছে। খপ করে আমার হাত চেপে ধরলেন। ওঁর গায়ের জোর অনুভব করে তাজ্জব হয়ে গেলাম। কে বলবে কৃপানাথ বৃদ্ধ!
আসুন, অচিনবাবু–আপনি হেরে গেছেন। সুতরাং আপনার কাছ থেকে একটা মামুলি জিনিস চাইছি–আপনার সঙ্গেই সেটা আছে অনেক আছে।
আমি কোনও বাধা দিতে পারলাম না। মনে হল, বাড়তি কোনও শক্তি কৃপানাথ মজুমদারকে সাহায্য করছে। কারণ, অতি অনায়াসে বৃদ্ধ আমাকে টেনে নিয়ে গেলেন বাক্সের কাছে। বাক্সের ভিতর থেকে তখন উত্তাল ঝটাপটির শব্দ ভেসে আসছে।
বাক্সের চৌখুপি জানলার কাছে আমাকে দাঁড় করিয়ে দিলেন কৃপানাথ। বললেন, শুধু-শুধু বাধা দেবেন না, অচিনবাবু। কারণ শঙ্করকে ডাকলে সে তো আসবেই–তা ছাড়া বাক্সের পেছনের দরজাটা যদি খুলে দিই তা হলে যার খিদে পেয়েছে সে নিজেই আপনাকে।
মাঝপাথে কথা থামিয়ে বিচিত্র সুরে শিস দিয়ে উঠলেন তিনি। বললেন, আঃ, এবার একটু শান্ত হ দিকি। তারপর আমার দিকে ফিরে : খাবার জোগাড় করতে দেরি হলেই ও এমন অধৈর্য হয়ে পড়ে। খানিকটা মায়ের ধাত পেয়েছে।
হাঁসকল সরিয়ে জানলার পাল্লা খুলে দিলেন কৃপানাথ। আমার ডান হাতটা টেনে নিয়ে ঢুকিয়ে দিলেন চৌখুপির ভিতরে। শেষ মুহূর্তে বোধহয় আমার ঘোর কেটে গিয়েছিল, কারণ আমি হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে শুরু করেছিলাম।
কিন্তু ওই পর্যন্তই!
বাক্সের ভিতরে এক ভয়ংকর জাঁতিকল চোখের পলকে এঁটে বসল আমার কবজিতে। যন্ত্রণায় আমার সারা শরীর অবশ হয়ে গেল। চিৎকার করতে গিয়েও পারলাম না। যেন টুটি টিপে ধরেছে। কেউ। মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। প্রবল বৃষ্টির ছাট জানলা দিয়ে ঢুকে পড়ে আমার চোখমুখ ভিজিয়ে দিল। হঠাৎই বিকট শব্দে বাজ পড়ল কোথাও। আর আমার আমার প্যান্ট ভিজে গেল।
স্পষ্ট বুঝলাম, অনুরাধা-বুবু-টুটুর কাছে আর কোনওদিনও আমি ফিরতে পারব না।
ঝাপসা চোখে দেখলাম, কৃপানাথ চেয়ারে গিয়ে বসেছেন। মাথা সামান্য ঝুঁকিয়ে বৃদ্ধ বিড়বিড় করে বলছেন, খা, খা, সব্রাহ্মণের রক্ত খা–। তোর সময়মতো খাবার জোগাড় করতে না পারলে আমি কি তোকে কম রক্ত দিয়েছি! ক্ষতচিহ্ন ভরা নিজের বাঁ-হাতে হাত বোলাতে বোলাতে বলে চললেন কৃপানাথ, শুধু বাপ বলে প্রাণে রেহাই পেয়েছি। কী করে যে তুই আমাকে চিনিস কে জানে! যাক, আবার একটা মাস বিশ্রাম…।
একটু পরেই চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন কৃপানাথ। ঘরের দরজার কাছে গিয়ে বৃষ্টির আওয়াজ ছাড়িয়ে শঙ্করকে ডেকে বললেন, শঙ্কর, পিছনের বাগানে এবার একটু জায়গা তৈরি কর। আর বড় বস্তাটা এ-ঘরে দিয়ে যা।
একটা চিনচিনে ব্যথা আমার ডান হাতে শুরু হয়েছিল। সেটা এতক্ষণে পৌঁছে গেছে আমার মাথার ভিতরে। ঝাঝালো মিষ্টি গন্ধটা এখন এত বেড়ে গেছে যে, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। দুকানে ভোঁ-ভোঁ শব্দ। আর বুকের ভিতরে ঢিপঢিপ। আটাশ বছর আগে মারা যাওয়া সেই ডাক্তারবাবুর কথা মনে পড়ল আমার। কৃপানাথের সাজিয়ে দেওয়া কৌতূহল আর লোভের ফাঁদে পা দিয়ে এ কোন পিশাচের হাতে নিজেকে তুলে দিলাম। আমার চোখ ফেটে হু-হু করে জল বেরিয়ে এল। অনুরাধা-বুবু–টুটু, তোদের ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে। আর যে সময় নেই!
চেতনা হারানোর মুহূর্তে আমি ঘণ্টার শব্দ শুনতে পেলাম।