Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বসন্ত কামড় কিংবা হারানো প্রেম || Sankar Brahma

বসন্ত কামড় কিংবা হারানো প্রেম || Sankar Brahma

বসন্ত কামড় কিংবা হারানো প্রেম

[ মরমী ব্যথার কত যে বীজ গোপনে, মাটির নীচে পাথরচাপা পড়ে, গুমড়ে গুমড়ে কেঁদে মরে, কান্না ফুল হয়ে ধরণীতে ফুটতে পারে না, তার খোঁজ-খবর আর ক’জনে রাখে, হায় ! ]

এক).

বাজারের এদিকটায় মাতালদের ভিড় বেশি। মদের দোকান আছে একটি। আজ ছুটির দিন নয় তবুও মত্ত মানুষদের ভিড় লেগেই আছে। এদের গায়ের ছোঁয়া লাগতেই আরও রাগ বাড়ছে সমীরের। সবকিছুই ঘৃণা করে সে। ঘৃণা চেপে রাখতে পারে না। মুখে ফুটে ওঠে তা। মুখ বেঁকে যায় তার। কয়েকদিন ধরে কবিতা না লিখতে পারলে, এমন দশা হয় তার। কিছুই ভাল লাগে না। ঘরেও মন টেকে না। বাইরে বেরিয়ে এসে অস্থির ভাবে হাঁটা শুরু করে। কোথায় যাবে, কেন যাবে? তা সে কিছুই জানে না। যে দিকে দু’চোখ যায়, যে দিকে যেতে মন চায়, সেদিকেই হাঁটতে থাকে। মনে মনে নিজের প্রতি তার একটা উদগ্র রাগ থাকে,যা ঘৃণায় পরিণত হয় । সেটা আসলে না লিখতে পারার রাগ তার কষ্টে রূপন্তরিত হয়। আর তারই প্রতিফলন ঘটে উল্টো ভাবে তার মনে। সমাজের সব কিছুর প্রতি তার ঘৃণার ভাব জেগে ওঠে মনে।
তবে তার চেহারাটা কিন্তু মন-কারা! রীতিমত সুদর্শন সে। বেশ লম্বা, দশজনের ভিড়ে দাঁড়ালে মাথা উঁচু হয়ে থাকে সবার ওপরে। ছিপছিপে শরীর অথচ সুগঠিত। দুটি চোখ গভীর কালো আর দ্যুতিময়। মাথাভর্তি একরাশ কালো চুল মুখের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তুলেছে ।
ক্ষণিকের জন্যে ঘৃণায় মুখ কুঁচকে গিয়েছিল তার । তারপরেই বিভোর হয়ে গেল সে তার নিজের ভাবনায়। এমনই মশগুল হয়ে গেল সে নিজের ভাবনায় যে আশপাশে আর নজরই রইল না তার। নজর দেওয়ার প্রবৃত্তিও রইল না। কথা বলে চলছে সে নিজের সঙ্গে আপনমনে। মনে মনে সে আওড়ে চলেছে তার আগামী কবিতার লাইনগুলি। নিজের বলা কথগুলি নিজেই শুনছে সে। আর মনে মনে বুঝতে পারছে, তালগোল পাকিয়ে গেছে তার নিজের ভিতরটা।
এই সময় একটু মাল খেতে পারলে ভাল হতো, ভাবল সমীর। কিন্তু পকেটে এতোটা রেস্ত নেই তার, যে মদের দোকানে বসে একা একা মদ খাবে সে।
আসলে গোটা দুনিয়াটার উপর বিদ্বেষে ভরে আছে তার মনের ভিতরটা। কবিতার ভাবের উপরে বিদ্বেষ। কবিতার শব্দের উপর বিদ্বেষ। কবিতার লাইনগুলির উপর বিদ্বেষ। বাইরের দুনিয়ার প্রতি তাই তার আর কোন আগ্রহ নেই।
সে নিজের মনে মনে কথা বলতে বলতে চলছে। পুরনো বন্ধু-বান্ধদের সঙ্গে দেখা হলে অবশ্য আলাদা ব্যাপার হতো। কিন্তু যেচে কারও সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার ইচ্ছে নেই তার।

দুই).

মন কেমনকরা এক চৈত্রের উদাস সন্ধ্যায় মেয়েটিকে প্রথম দেখেছিল সমীর বসু , শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ের এক কফি-শপে।
সত্যি কথা বলতে কি, দেখতে তেমন আহামরি কিছু নয়। কাপড় চোপড়েও বিশেষত্ব ছিল না কিছু। চুলগুলি অগোছালো ভাবে পিঠে ছড়িয়ে পড়ে ছিলো তার। যুবতী তাকে বলা যাবে না। ছাব্বিশের কাছাকাছি বয়স তার, আবার ঠিক মেয়ে বলাটাও ঠিক হবে না । তাকে দেখে মনে হল সমীরের, সে শুধু তারই জন্য। ওকে দেখা মাত্র হৃদকম্পন বেড়ে গেল তার, বুক শুকিয়ে যেন সাহারা মরুভূমি হয়ে গেল।
আপনাদের হয়তো একটা নির্দিষ্ট ধরণের মেয়ে পছন্দ – যার পায়ের গোছা হালকা পাতলা, কিংবা চোখ পটল-চেরা , চাপার কলির মতো আঙুল।
সমীরের নিজেরও পছন্দ-অপছন্দ বলে একটা ব্যাপার আছে । কখনও-সখনও এমন হয়েছে যে, কোন কাফেতে বসে সে কফি খাচ্ছে , তখন পাশের টেবিলের মেয়েটির দিকে হাঁ করে তাকিয়ে দেখেছে, শুধুমাত্র তার নাকের গড়ন ভাল লেগেছে বলে। নাক তার খুব পছন্দের জিনিষ। কিন্তু এই মেয়েটির ক্ষেত্রে তার নাকের গড়ন কেমন ছিল তা সে মনে করতে পারছে না কিংবা আদৌ তার নাক ছিল কিনা তা-ও খেয়াল নেই তার। তবে যা মনে আছে, তা হল মেয়েটি মোটেই তেমন সুন্দরী দেখতে ছিল না। আজব ব্যাপার হলো তাকেই সমীরের ভাল লেগে গেল।
‘মাইরী কাল যার সঙ্গে দেখা হয়েছে আমার, সে বোধহয় আমার জন্যই জন্মেছে।’
বারদুয়ারীতে( বাংলা মদের দোকান) বসে কথাটা সমীর বলল আমাকে।
– ও তাই নাকি, আমি বললাম , দেখতে কেমন ছিল সে, খুব সুন্দরী বুঝি ?
– না, মোটেই সুন্দরী নয় সে।
– তবে যে রকম ডাসা মাল তোর পছন্দ, সে রকম নাকি?
– জানি না রে ভাই। তার কোনও কিছুই মনে নেই আমার।
– তার মুখের গড়ন কিংবা ধর বুকের সাইজ?
– ওসব তো দেখিনি আমি, শুধু দেখেছি তার চোখদু’টি ।
– আশ্চর্য কথা। বললাম আমি।
– হ্যাঁ, সত্যি। আশ্চর্য-ই বটে।
গ্লাসে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে আমি বললাম, সে যাক গে, কী করলি শেষপর্যন্ত? কথা বলেছিস? পিছু নিয়েছিলি তার?
– নাহ্। শুধু পাশ কাটিয়ে চলে গেল সে।
কফি খেয়ে সে কপি-শপ থেকে বেরিয়ে গেল, আমার শুধু গায়ে একটা মৃদু বাতাস লাগল তার যাওয়ার। আর আমি বসেছিলাম কফি-শপে। কালকের বিকালটা সত্যিই খুব মনোরম ছিল আমার কাছে, সমীর কথাটা বলে কেমন উদাস হয়ে গেল। তারপর গ্লাসে একটা লম্বা চুমুক দিল।
– কথা বলতে পারতিস তার সঙ্গে।
– ইচ্ছে হয়নি। হয়তো দশ মিনিট কথা বলা যেত তার সঙ্গে। ওর নিজের সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করতে পারতাম, বলতে পারতাম আমার কথাও।
– তবে বলিস নি কেন? আমি জানতে চাইলাম।
– ওই যে বললাম, ইচ্ছে হয়নি। এখন ভাবি, কে ওকে পাঠাল আমার জন্য কফি-শপে?
ভিজে ছোলা চিবোতে চিবোতে আমি বললাম, কথাবার্তা শেষ করে তোরা কোথাও গিয়ে লাঞ্চ সারতে পারতিস, দেখতে পারতিস কোনও সিনেমা। আর বরাত ভাল থাকলে হয়তো বিছানা অবধি গড়াতে পারত ব্যাপারটা। কথাটা বলেই, আমি আমার স্বভাব-সুলভ ভঙ্গীতে, বিটেকেল হাসলাম।
সমীর আমার কথা শুনে রাগ করবে ভেবেছিলাম। তা সে করল না। বরং সে বলল, হ্যাঁ, হৃদয়ে আমারও নানা রকম সম্ভাবনা উঁকি মারছিল। কিন্তু মনের কথাটা যে কী করে বলি তাকে? আর বলবই- বা কী?
– গুড ইভিনিং। আমার সঙ্গে একটুখানি কথা বলার সময় হবে আপনার?
দুর, নেহাতই হাস্যকর। ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির দালালদের মতো ।
– মাফ করবেন, সারারাত খোলা থাকে এরকম কোনও ঔষধের দোকান কি আপনার জানা আছে ম্যাডাম?
না, এটাও একই রকম হাস্যকর। তাছাড়া ওষুধ কেনার মতো কোন প্রেসক্রিপশনও তখন আমার কাছে ছিল না, বলল সমীর ।
তারপর গ্লাসে একটা ছোট চুমুক দিয়ে বলল, কিংবা বলতে পারতাম, আপনাকে খুব ভাল লাগে আমার।
হয়তো কথাটা বিশ্বাসই করত না সে । আর বিশ্বাস করলেও হয়তো কথা বলতে চাইত না আমার সঙ্গে। কিংবা বলে বসতে পারত, আমাকে আপনার ভাল লাগে তো হয়েছেটা কী তাতে? আমার আপনাকে পছন্দ নয় মোটেও। বলতেই পারত এমন কথা সে আমাকে । তাহলে তো আমি ভেঙে মুচড়ে দুমড়ে চুরমার হয়ে যেতাম ভিতরে ভিতরে। ওই আঘাত আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারতাম না। বয়স এখন আমার বত্রিশ, দিনে দিনে তা বাড়ছে। বিষণ্ণ সুরে কথাটা বলল বসন্ত।

একটু থেমে সে বলল, আবার এক সন্ধ্যায় একটা ফুলের দোকানের সামনে আমরা পরস্পর মুখোমুখি হয়ে ছিলাম। একে অপরকে অতিক্রম করে গেলাম। তার শাড়ির একটুখানি হালকা স্পর্শ ছুঁয়ে গেল আমাকে। নাকে এল গোলাপ ফুলের ঘ্রাণ। কথা বলার জন্য কিছুতেই এগোতে পারলাম না। বাসন্তী রঙের একটা শাড়ি পরে ছিল সে, ডান হাতে ধরা ছিল তার একটা কবিতার বই। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, বইটি আমারই লেখা।
কয়েক পা এগিয়েই পেছনে ফিরে দেখি ভিড়ের মধ্যে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে সে।
এখন আমার মনে হচ্ছে, ওকে তখন আমার বলা উচিত ছিল, আপনাকে ভীষণ চেনা চেনা লাগছে আমার, কোথাও দেখেছি যেন এর আগে? কবিতার বইটি পড়েছেন? কেমন লাগলো? আর শেষ হতে পারতো….
কী দিয়ে যে শেষ হতে পারত, তা পরিস্থিতিই ঠিক করে দিত।
এ’সব আইডিয়া যখন আমার মাথায় আসে তখন তা কার্যকর করার আর কোনও উপায় থাকে না আমার কাছে, সমীর আপসোস করে বলল আমার কাছে।

তিন).

দশবছর আগে, এই কলকাতায় ছিল একটা ছেলে আর একটা মেয়ে । ছেলেটির বয়স তখন ছিল বাইশ আর মেয়েটির ষোলো। ছেলেটি দেখতে খুব হ্যান্ডসাম ছিল, তবে মেয়েটিও ছিল না তেমন নজরকাড়া সুন্দরী। তারা দু’জনেই অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে বিশ্বাস করত যে, পৃথিবীর কোথাও-না-কোথাও তাদের জন্য পছন্দসই কোনো জুটি রয়ে গেছে।
হ্যাঁ, দৈবে বিশ্বাস করত তারা, আর সেই দৈব-বশেই ঘটনাটি ঘটল।
একদিন রাস্তার এক মোড়ে মুখোমুখি দেখা হল তাদের দু’জনের। ছেলেটি বলল, খুবই আশ্চর্য ব্যাপার, সারা জীবন ধরে খুঁজছি আমি তোমাকে। হয়তো বিশ্বাস হবে না তোমার। তবে তুমি জেনে রাখ, আমার জন্যই তোমার জন্ম হয়েছে।
– আর তুমি, মেয়েটি বলল তাকে, তুমিও আমার জন্যই । ঠিক যেমন ভাবে আমি আমার মনের মধ্যে একটা মধুর স্বপ্ন এঁকে রেখিছি। তুমি ঠিক সেই স্বপ্নের রাজকুমার। বলেই তারা পরস্পর হাত ধরাধরি করে একটা পার্কের মধ্যে বেঞ্চে গিয়ে বসল আর ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে নিজেদের মধ্যে গল্প-গুজব করে যেতে লাগল। এখন আর তারা নিঃসঙ্গ নয়। কাক্ষিত মানুষের দেখা পেয়ে গেছে তারা দু’জনেই।
একেবারে অলৌকিক ব্যাপার আরকি! একটা মহাজাগতিক শক্তির টান।
মনের সাথী খুঁজে পাওয়া যে কতই না রোমাঞ্চকর আর আনন্দের ব্যাপার সেটা বলে বোঝানো যাবে না কাউকে।
এরই মধ্যে মান-অভিমান, রাগ-অনুরাগের ব্যাপারও দু’একবার ঘটেছে তাদের মধ্য।
একদিন ছেলেটি মেয়েটিকে বলল, তোমাকে নিয়ে একটা কবিতা লিখেছি, শুনবে?
মেয়েটি বলল, হ্যাঁ বল,শুনি।

” তুমি আমার মিষ্টি সোনা, তুমিই আমার মন
তোমার উপর রাগ করে আর থাকব কতক্ষণ?
সুজন আছে অনেক আমার, মিষ্টিসোনা এক
মনকে বলি, মিষ্টি সোনার দিকেই শুধু দেখ।

অনেক মায়ায় গড়েছি এই স্বপ্নের সংসার,
তুমি ছাড়া জানো সেথায় কেউ থাকে না আর,
একটি শিশুর মুখ উঁকি দেয় হঠাৎ অপলক,
তোমার কাছে পৌঁছে গেলেই সুখের স্বর্গলোক।

বাতাস জানে সে’সব কথা, আকাশ শুনে হাসে
হাস্নুহানার গন্ধ এসে বসে আমার পাশে,
আমি তাকে তোমার কাছে পাঠিয়ে দিতে পারি,
হাস্নু শুনে, বিশ্রি ভাবে হাসতে থাকে ভারী।

তোমার ভিতর মায়ার জগৎ থাকে বিলক্ষণ
সকল সময় সেইখানে যে থাকে আমার মন,
তোমার দিকে বিশ্ব জগৎ তাকায় অনিমেষ
একটি নতুন মুখ উঁকি দেয় হঠাৎ কেমন বেশ।”

ষোড়শী মেয়েটি কবিতাটি শুনে কি বুঝল কে জানে? লজ্জায় রাঙা হয়ে, মাথা নামিয়ে নিল নীচের দিকে।

একদিন কথা বলতে বলতে হঠাৎ করেই সন্দেহের এক চিলতে মেঘ উঁকি দিল ছেলেটির মনের মধ্যে। এত সহজে সত্যি হয়ে যাওয়া স্বপ্নের ভেতর, কোথাও কোনও ফাঁকি নেই তো ?
কথা-বার্তায় একটুখানি বিরতি ঘটতেই ছেলেটি মেয়েটিকে বলল, চলো, শুধু একটি বারের জন্য আমরা পরস্পর, নিজেদের ভাগ্য পরীক্ষা করে নিই, একে-অপরের জন্য সঠিক উপযুক্ত কিনা। আমরা যদি সত্যিই একে অপরের যথার্থ প্রেমিক-প্রেমিকা হয়ে থাকি, তাহলে আমাদের কোথাও-না-কোথাও, কোনও-না-কোনও সময়, আবার দেখা হবে নিশ্চয়ই। আর যখন তা হবে, তখন আমরা জানব বুঝব, আমাদের মধ্যে আসলেই সত্যিকারের ভালবাসা আছে – আর তখন আমরা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলব। তুমি কি বলো?
মেয়েটি বললো, বেশ তো , তুমি যা ভাল বোঝ, তাই হবে। তখন তারা খুব আবেগ নির্ভর ছিল।
তারপর তারা পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। যোগাযোগ রাখল না কেউ কারও সঙ্গে আর।
দুজনের সম্মতিক্রমে ভাগ্যের উপর নির্ভর করে, আবেগের বশে যে হটকারী সিদ্ধান্তটা তারা নিয়ে নিল, তা মোটেই পরিণত বুদ্ধির কাজ ছিল না, সেই বিষয়টা বোঝা একেবারেই সম্ভব ছিল না তাদের পক্ষে, কারণ তাদের বয়স বা মনের অবস্থা তখন, তা বোঝার মতো ছিল না কারোই।
দৈবক্রমে তাদের মধ্যে একবার দেখা হয়েছিল ঠিকই। আবার দৈব-দুর্বিপাকে, আচমকা একটা ঢেউ এসে তাদের দু’জনকে নির্মমভাবে ছিটকে দূরে সরিয়ে দিল।

ছেলেটি আর মেয়েটি দু’জনকেই, বসন্ত রোগ এসে ভয়াল কামড় বসাল, এক বসন্তে। জীবন-মৃত্যুর সাথে কয়েক সপ্তাহ লড়াই করার পর, তারা সুস্থ হয়ে উঠল বটে, তবে হারিয়ে ফেলল বিগত দিনের সব স্মৃতি তারা। যখন জ্ঞান ফিরল তাদের মাথার ভিতরটা একেবারে শূন্য, ফাঁকা হয়ে গেল।

তারা দুজনেই ছিল বুদ্ধিদীপ্ত মনের, দৃঢ়চেতা স্বভাবের। নিরবচ্ছিন্ন চেষ্টার পর তারা আবার অর্জন করল সেইটুকু বোধশক্তি আর জ্ঞান , যার ফলে তারা নতুন করে সমাজের স্বাভাবিক জীবনের স্রোতে ফিরে আসতে পারল। এখন তারা সুস্থ-সবল তরুণ তরুণী। তারা এখন জানে কী করে এক রাস্তা থেকে আর এক রাস্তায় গিয়ে বাস ধরতে হয়। ফুলের দোকানে গিয়ে দাম দর করে ফুল কিনতে হয়।
সময় বয়ে যায় দ্রুত গতিতে। শীগগিরই ছেলেটির বয়স বত্রিশে গিয়ে পৌঁছাল আর মেয়েটির ছাব্বিশে।
চৈত্রের এক চমৎকার মায়াময় সন্ধ্যায় তরুণীটিকে দেখে আলোড়নকারী প্রেমানুভূতির সঞ্চার হল ছেলেটির মনে , তা ধরুন আশি থেকে নব্বুই ভাগ তো বটেই।
বসন্তের মন আনচান করা সেই সন্ধ্যায় করণীয় কাজ শেষ করে কফির খোঁজে সমীর হাঁটছিল শ্যামবাজারের দিকে। আর তরুণীটিও বসেছিল শ্যামবাজারের সেই কফি-শপে, যেখানে সে গিয়ে ঢুকলো। একে অপরকে দেখল তারা। হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির একটা ম্লান সূক্ষ্ম রশ্মি মুহূর্তের জন্য আলো ছড়াল সমীরের মনের ভিতরে। তার বুকের ভিতর বেজে উঠল বসন্তের সুর-লহরী।
কিন্তু তার স্মৃতির রশ্মি তখন খুবই ক্ষীণ । ভাবনায় মনের ভিতরে, দশ বছর আগের সেই স্মৃতি তখন বড়ই ম্লান। কোনও স্বচ্ছতা নেই আর তাতে । দুবার দেখা হওয়া সত্বেও কোনও কথা না বলে তারা একে অপরকে দেখেও ভিড়ের মধ্যে দিব্যি মিশে গেল, হারিয়ে গেল চিরদিনের জন্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress