Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বক্তা ও বক্তৃতা || Tarapada Roy

বক্তা ও বক্তৃতা || Tarapada Roy

সেই গল্পটা তো সবাই জানেন। দীর্ঘ বক্তৃতার অন্তে এক বক্তা দেখলেন সভাকক্ষ সম্পূর্ণ শূন্য। শুধু একটি মাত্র লোক বসে রয়েছে। কোনও কোনও গল্পে এই লোকটি হলের দারোয়ান, চাবি হাতে অপেক্ষা করছে, বক্তৃতা শেষ হলে ঘরে তালা দেবে বলে। কোনও গল্পে সে হল মাইকওলা, মাইকটা খালি হলে ফেলে যেতে পারছে না। আবার আরও পুরনো গল্পে ওই লোকটি শতরঞ্জির মালিক, যে শতরঞ্জির ওপর দাঁড়িয়ে বা বসে বক্তা এতক্ষণ বক্তৃতা করছেন, বক্তৃতা শেষ হলেই সে শতরঞ্জিটা নিয়ে বাড়ি চলে যাবে।

এই গল্পটি বহুল প্রচারিত। নানা জায়গায় নানাভাবে এই গল্পটি আমি শুনেছি। এমনকী বিহারের অজ পাড়াগাঁয়ে দেহাতি হিন্দিতে এক স্কুলশিক্ষক আমাকে এই গল্পটি শুনিয়েছিলেন। তাঁর গল্পে ওই শেষ শ্রোতাটি ছিল একজন চৌকিদার, যার উপরে স্থানীয় থানা থেকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এই সভা সম্পর্কে রিপোর্ট দেওয়ার।

তবে সবচেয়ে চমকপ্রদ এবং কৌতুককর ছিল এক বিলিতি জোকবুকের গল্পটি। সেই গল্পটিও একটি বক্তৃতা সভা নিয়ে, একের পর এক বক্তা বক্তৃতা করে যাচ্ছেন। বিষয় খুবই গুরুতর যথা পারমাণবিক অস্ত্রের নিরস্ত্রীকরণ অথবা আবহাওয়া দূষণ।।

সে যাই হোক বক্তার অভাব হয় না এসব কোনও বিষয়েই। সুতরাং বক্তৃতা চলতে লাগল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অবশেষে একজন বক্তা তাঁর বক্তৃতা শেষ করার পর যথারীতি দেখতে পেলেন হলের মধ্যে একজন মাত্র ব্যক্তি বসে রয়েছেন। ডায়াস থেকে নেমে বক্তা যখন এই শেষ শ্রোতাটিকে তাঁর ধৈর্যশীলতা এবং আগ্রহের জন্যে ধন্যবাদ দিতে যাবেন, দেখা গেল সেই শ্রোতাটিও ডায়াসের দিকে এগিয়ে আসছেন। বক্তা ভাবলেন শ্রোতা বুঝি তাঁকে কিছু বলতে চান। কিন্তু দেখা গেল তা নয়। আসলে শ্রোতাটিও এই সভার একজন নির্দিষ্ট বক্তা। তিনি আগের বক্তাকে বললেন, ‘আমি আপনার পরের বক্তা। আর তো কেউ নেই। একটু বসে শুনে যাবেন।’ তারপর একটু থেমে বললেন, ‘অবশ্য আমি খালি সভাতেও বক্তৃতা করতে পারি।’

বক্তৃতা করা অনেকের কাছে নেশার মতো। দু’-চার দিন কোথাও বক্তৃতা দেওয়া বাদ পড়ে গেলে তাঁদের দমবন্ধ হয়ে আসে। তারা হাঁফিয়ে ওঠেন। তাঁরা হিল্লি, দিল্লি, গৌহাটি, ভাগলপুর ঘুরে বেড়ান বক্তৃতা করার জন্যে। সবসময় যে উদ্যোক্তারা তাদের যাতায়াতের খরচ বহন করেন এমন নয়, বহু ক্ষেত্রেই বক্তারা নিজেদের পয়সা খরচ করে নিকট দূর জায়গায় জায়গায় গিয়ে বক্তৃতা করে আসেন।

ঠিক এ জাতের নয়, এর চেয়ে একটু উঁচু জাতের এক বক্তা এক মফস্বল শহরে গিয়েছেন বক্তৃতা করতে। সেই শহরের সভার উদ্যোক্তারা ভেবেছিলেন বক্তা ট্রেনে আসবেন তাই তাঁরা দলবেঁধে গাড়ি আসার নির্দিষ্ট সময়ে রেলস্টেশনে উপস্থিত হয়েছিলেন বক্তাকে স্বাগত জানানোর জন্যে।

কিন্তু বক্তা ভদ্রলোক নিজের গাড়িতে করে সড়ক পথে সেই শহরে আসেন। ফলে যখন তিনি সভামঞ্চে পৌঁছে গেছেন তখন অভ্যর্থনাকারীরা অপেক্ষা করছেন তাঁর জন্যে রেল স্টেশনে।

পরে সভার শেষে এই ঘটনার জন্যে উদ্যোক্তারা যথেষ্ট দুঃখ প্রকাশ করলেন এবং উদ্যোক্তাদের তরফ থেকে সমিতির সভাপতি মহোদয় বক্তাকে বললেন, ‘স্যার আপনি আসার সময় আমরা আপনাকে অভ্যর্থনা জানাতে পারিনি তার জন্য আমরা দুঃখিত। কিন্তু আপনি চলে যাওয়ার সময় সে ভুল হবে না। আমরা সবাই মিলে আপনাকে বিদায় দেব।’

সেই বক্তা ভদ্রলোক এ রকম দুঃখপ্রকাশ দেখে খুশি হয়েছিলেন কিনা বলতে পারব না। তার চেয়ে বক্তা থাক। বক্তৃতার কথা বলি।

অনেকদিন আগে কোথায় যেন পড়েছিলাম যে প্রত্যেক বক্তার তিনটে করে বক্তৃতা থাকে।

প্রথম বক্তৃতাটি হল, তিনি যে বক্তৃতাটি করবেন বলে ভেবেছেন। তারপর দ্বিতীয় হল, যে বক্তৃতাটি তিনি আসলে করলেন। এবং শেষ বক্তৃতা হল, প্রকৃত বক্তৃতা সারা হওয়ার পর যা বললে ভাল হত এবং যা না বললে ভাল হত এই বিবেচনা করে বক্তা মনে মনে যে আদর্শ বক্তৃত করলেন।।

অতঃপর দুটো বক্তৃতার আখ্যান বলি।।

এক ছোট শহরের অধিবাসীরা তাঁদের শহরের এক সফল ধনী ব্যক্তিকে যাট বছর পূর্তি উপলক্ষে সংবর্ধনা জানাচ্ছিলেন। ধনী ভদ্রলোক এই শহরের আদি বাসিন্দা নন, তিনি বাইরে থেকে এখানে এসেছিলেন।

সংবর্ধনার জবাবে তিনি অভিভূত হয়ে বললেন, ‘বন্ধু ও প্রতিবেশীগণ, আপনাদের আন্তরিকতায় আমি মুগ্ধ। আপনারা আমাকে অনেক দিয়েছেন। আপনাদের এই শহর আমাকে অনেক দিয়েছে। আমার মনে পড়ছে চল্লিশ বছর আগের কথা যখন আমি এক অপরিচিত আগন্তুক আপনাদের এই শহরে একাকী এসেছিলাম। আমার ক্লান্ত দেহ, শ্রান্ত চরণ। সঙ্গে কিছুই নেই। শুধু কাঁধে একটা ক্যানভাসের ঝোলা। এই সম্বল করে আমি এখানে এসেছিলাম। তারপর আমার এত সাফল্য এসেছে। এত উন্নতি হয়েছে।…’

ভদ্রলোক আরও অনেক কিছুই বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু হঠাৎ সভার মধ্য থেকে একজন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আচ্ছা আপনার কাঁধের ওই ক্যানভাসের ব্যাগের মধ্যে কী ছিল?’

বক্তা একটু ঢোঁক গিলে বললেন, ‘লাখ পনেরো নগদ টাকা আর আড়াইশো ভরি সোনা।’

এ গল্পেরই অন্য একটা রকমফের। গল্পের মূল কাঠামো একই। সেই সফল ব্যবসায়ী, তাঁর ষাট বছর বা পঁচাত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষে গণসংবর্ধনা। তবে তাঁর বক্তৃতাটা একটু অন্যরকম। তিনি বললেন, ‘আমার সেই মাঘ মাসের ঠান্ডা রাত্রির কথা মনে পড়ছে। দুর্দান্ত শীত, সঙ্গে বৃষ্টি আর ঝোড়ো হাওয়া। আমি সেই দুর্যোগের মধ্যে এই শহরে এলাম। কাউকে চিনি না। কাউকে জানি না। আমার সারা শরীরে কোনও জামাকাপড় নেই। আমি ঠকঠক করে কাঁপছি। কাঁপতে কাঁপতে কাঁদছি। ভাল করে গলা ছেড়ে কাঁদতেও পারছি না, গলায় জোর নেই। হাত-পা সেও চলছে না।

সেই সময়ে হঠাৎ শ্রোতাদের মধ্য থেকে একজন উঠে দাড়িয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘কিন্তু স্যার আমরা। যে শুনেছিলাম আপনি এই শহরেই জন্মেছেন?’

বক্তা ভদ্রলোক একটু থতমত খেয়ে বললেন, ‘ঠিকই শুনেছেন। আসলে আমি আমার জন্মদিনের কথা বলছিলাম, ওই মাঘ মাসে বৃষ্টির রাতে আমার জন্ম কিনা, তাই বলছিলাম।’

পুনশ্চঃ এক নির্বাচন প্রার্থী এক বিতর্কিত অথচ বিখ্যাত ব্যক্তির কাছে ভোটের আগে সাহায্য চাইতে গিয়েছিলেন।

সেই বিতর্কিত ভদ্রলোক এক বাক্যে ওই প্রার্থীকে সাহায্য করতে এবং তার জন্যে বক্তৃতা করতে রাজি হলেন, তবে বললেন যে, ‘তুমি একবার ভাল করে ভেবে এসো, তোমার পক্ষে যাদ আমি বক্তৃতা করি তা হলেই তোমার বেশি লাভ হবে নাকি তোমার বিপক্ষে বক্তৃতা করলে তোমার বেশি লাভ হবে?’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *