ফ্রান্ৎস কাফকা
১৮৮৩ সালে ৩ জুলাই তৎকালীন অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের প্রাহা (প্রাগ) শহরে (বর্তমানে চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী) একটি মধ্যবিত্ত জার্মানভাষী পরিবারে ফ্রান্ৎস কাফকার জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম হারমেইন কাফকা এবং মায়ের নাম জুলি৷
ফ্রান্ৎস কাফকার প্রাথমিক পড়াশুনা শুরু হয় ডয়েশ ন্যাবেন্সচুল জার্মান বয়েজ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে (Deutsche Knabenschule German boys’ elementary school) ৷ তিনি ১৮৮৯ থেকে ১৮৯৩ সাল পর্যন্ত এই বিদ্যালয়ে পড়েছিলেন৷ তেরো বছর বয়সে তাঁর ইহুদি শিক্ষা সম্পন্ন হয়৷ কাফকা উপসনা গৃহে যেতে পছন্দ করতেন না বরং বাবার সঙ্গে ঘুরতে যাওয়ায় তিনি বেশি আনন্দ পেতেন৷ জার্মান ভাষায় পড়াশোনা করলেও চেক (Czech) ভাষায় তিনি কথা বলতে এবং লিখতে পারতেন৷ কাফকা আট বছর ধরে জিমনেসিয়ামে পড়াশোনা করেছিলেন। ১৯০১ সালে তিনি মাতুরা (Matura) পরীক্ষায় পাশ করে কার্ল- ফার্ডিনান্দস-ইউনিভার্সিটিতে (Karl-Ferdinands-University) ভর্তি হন৷ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি রসায়ন নিয়ে পড়া শুরু করলেও দু সপ্তাহের মধ্যে বিষয় বদলে আইন নিয়ে পড়া শুরু করেন৷ যদিও আইন নিয়ে পড়তেও তিনি বিশেষ উৎসাহিত ছিলেন না তবুও তাঁর বাবার খুশির জন্য তিনি পড়া চালিয়ে যেতে থাকেন৷ এর পাশাপাশি তিনি জার্মান ভাষা এবং সাহিত্য ও ইতিহাস পড়তে থাকেন। কাফকা বরাবরই আগ্রহী পাঠক ছিলেন। তিনি এবং তাঁর বন্ধু ব্রড এক সঙ্গে মূল গ্রীক ভাষায় প্লেটোর ‘প্রোটাগোরাস‘(Protagoras) থেকে শুরু করে গুস্তাব ফ্লবেয়ারের ‘সেন্টিমেন্টাল এডুকেশন’ (Sentimental Education)পর্যন্ত পড়েছেন, আলোচনা করেছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
ফ্রান্ৎস কাফকার কর্মজীবন শুরু হয় ১৯০৭ সালের ১ নভেম্বর। তিনি আশিকুরাজিওনি জেনারেলির একটি বীমা সংস্থায় প্রায় একবছর কাজ করেছিলেন৷ কাফকা এই কাজে খুশি ছিলেন না কারণ দিনের বেশীর ভাগ সময়ে কর্মক্ষেত্রে থাকার জন্য নিজের সাহিত্য চর্চায় বাধা পড়ছিল৷ ১৯০৮ সালের ১৫ জুলাই তিনি কাজ থেকে ইস্তফা দেন। এরপর তিনি চাকরি নিলেন শ্রমিকদের দুর্ঘটনা সংক্রান্ত একটি বীমা সংস্থায়। দিনে ছয় ঘন্টার কাজ, সঙ্গে চালিয়ে গেলেন লেখালেখি।
ফ্রান্ৎস কাফকা ছিলেন একজন জার্মানভাষী উপন্যাস ও ছোটগল্প লেখক। তিনি বিংশ শতাব্দীর সর্বাধিক প্রভাবশালী লেখক এবং সমালোচক হিসেবে খ্যাত ছিলেন৷
কাফকা মূলত জার্মান ভাষায় সাহিত্য রচনা করলেও চেক ভাষায় মাইলেনা জেসেনস্ককে তিনি কয়েকটি চিঠি লিখেছিলেন, যার সাহিত্যমূল্য অপরিসীম। জীবদ্দশায় তাঁর সাহিত্যকীর্তির যা সামান্য কিছু প্রকাশিত হয়েছিল তা জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কাফকা এমন একজন সাহিত্যিক যিনি তাঁর পূর্ণ দৈর্ঘ্যের কোনও উপন্যাসই শেষ করেননি এবং প্রায় তাঁর প্রায় নব্বই শতাংশ কাজই তিনি পুড়িয়ে দিয়েছিলেন৷ ১৯০৮ সালে প্রকাশিত হয় কাফকার প্রথম বই ৷ এতে আটটি গল্প ছিল যা Betrachtung নামে সাহিত্য জার্নাল Hyperion এর প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।
১৯১২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা ‘Das Urteil’ – এই গল্পের ভিত্তি নির্মাণ হয়েছে বাবা আর ছেলের সম্পর্কের টানাপোড়নের বুননে। ১৯১৫ সালে জার্মানির লিপজিগ থেকে প্রকাশিত হয় কাফকার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম দ্য মেটামরফসিস(‘The Metamorphosis’)। এরপর একে একে প্রকাশিত হয়েছে ‘ইন দি পেনাল কলোনি'(In the Penal Colony), ‘আ হাঙ্গার আর্টিস্ট’(A Hunger Artist) এর মতো কালজয়ী সব সাহিত্যকর্ম। কিন্তু তাঁর শারীরিক অসুস্থতা(যক্ষা-রোগ) তাঁকে ক্রমশ দুর্বল করে দিচ্ছিল। তাঁর গলার অবস্থা এতই খারাপ ছিল যে তিনি ভালো করে খেতেও পারতেন না৷ অনাহারে তাঁর শরীরে পুষ্টির মান কমে যায় ৷ কাফকা মৃত্যু শয্যাতে শুয়েও ” A Hunger Artist ” গল্পটি সম্পাদনা করেছিলেন৷
১৯২৪ সালের ৩ জুন মাত্র একচল্লিশ বছর বয়সে কাফকার মৃত্যু হয়।
জীবদ্দশায় তিনি তেমন ভাবে খ্যাতি পান নি৷ মৃত্যুর পর তিনি দ্রুত খ্যাতি অর্জন করেন৷
একত্রিশ বছর বয়সে ১৯১৪ সালে কাফকা ‘ডের প্রসেস ‘ উপন্যাস লেখা শুরু করেছিলেন। এই উপন্যাসটিও তিনি শেষ করতে পারেননি কিংবা বলা ভালো শেষ করেননি৷
আবার ১৯২১ সালে তিনি উপন্যাস লেখা শুরু করেন আটত্রিশ বছর বযসে ৷ তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘ডের হেইজার’ অসম্পূর্ণ।
তাঁর প্রথম আটটি গল্প সাহিত্যের সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছিল। কাফকা একশোটির বেশী চিঠি তাঁর আত্মীয় স্বজন পরিচিত বন্ধুদের লিখেছিলেন ৷ মিলেনা নামের এক সাংবাদিকের প্রেমে পড়ে কাফকা লিখেছেন শয়ে শয়ে চিঠি। মিলেনাকে লেখা কাফকার চিঠিগুলো নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে কাফকার অন্যতম সর্বাধিক বিক্রিত বই ‘Letters to Milena।
সাহিত্যে উইলিয়াম শেক্সপিয়ার এর পর যাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে তিনি আর কেউ নন, জার্মান ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রভাবশালী লেখক ফ্রানৎস কাফকা।
কবি W. H. Auden কাফকাকে বিংশ শতকের দান্তে বলে অভিহিত করেছেন ৷ ১৯১৬ সালের প্রথম দিকে বার্লিনার বিট্রিজে অস্কার ওয়ালজেলের “ডাই ভার্ভান্ডলং” এবং “ডের হেইজার” এর পর্যালোচনাতে কাফকার স্টাইলটি ক্লেইস্টের সাথে তুলনা করা হয়। কাফকার গদ্যের প্রকৃতি বিভিন্ন বর্ণনার ব্যাখ্যা দেয় ; তাঁর লেখা বিভিন্ন বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে স্থান পেয়েছে । কাফকার লেখাকে কেউ কেউ অভিযোগ এনেছেন বাস্তবতা বিকৃত করার আবার অন্যরা দাবী করেছেন যে তিনি পুঁজিবাদের সমালোচনা করছেন। তাঁর কাজগুলির মধ্যে সাধারণ হতাশা ও অযৌক্তিকতা অস্তিত্ববাদের প্রতীক হিসাবে দেখা হয়৷ ১৯৬১ সালে ম্যালকম পাসলি অক্সফোর্ড বোডলিয়ান লাইব্রেরির জন্য কাফকার বেশিরভাগ হাতে লেখা পান্ডুলিপি সংগ্রহ করেছিলেন ।
১৯৯০ এর দশক থেকে বিশ্বজুড়ে গড়ে প্রতি ১০ দিনে একটি করে বই প্রকাশিত হয়েছে, কাফকার সম্পর্কে। এখন পর্যন্ত নোবেল পাওয়া চৌত্রিশ জন নোবেলজয়ী সাহিত্যিক তাদের মধ্যে কাফকার লেখার প্রভাব রয়েছে বলে স্বীকার করেছেন।
কলম্বিয়ার নোবেলজয়ী সাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস একবার তার দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেনঃ-
” আমি যখন কলেজে ভর্তি হই, সাহিত্যের সাধারণ পড়াশোনা আমার ভালোরকমই ছিল, আমাদের বন্ধুদের চেয়ে গড়পরতা অনেক বেশি। বোগোতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে আমার নতুন নতুন বন্ধু তৈরী হতে থাকে, যারা আমাকে সমকালীন লেখকদের সঙ্গে পরিচিত করানো শুরু করে। এক রাতে এক বন্ধু আমাকে ফ্রানৎস কাফকার ছোটগল্পের একটি বই ধার দেয়। আমি যে মেসে থাকতাম, সেখানে যাই, আর সে রাতেই কাফকার ‘রূপান্তর’ গল্পটি পড়া শুরু করি। প্রথম লাইনটা পড়ামাত্র আমার প্রায় বিছানা থেকে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। কী যে অবাক হই আমি।
প্রথম লাইনটা ছিলঃ- ‘এক ভোরে গ্রেগর সামসা অসুখী সব স্বপ্ন থেকে জেগে উঠে দেখে সে তার বিছানায় প্রকাণ্ড এক পোকায় রূপান্তরিত হয়ে পড়ে আছে …।’ আমি লাইনটা নিজেকে নিজে পড়ে শোনাতে লাগলাম, ভাবলাম , এভাবে যে কেউ লিখতে পারে তা-ই তো আমার জানা ছিল না। যদি জানতাম, তাহলে আমি নিশ্চয় আরও কত আগেই লেখালেখি শুরু করতাম। তারপরই, আর দেরি না করেই, আমি ছোটগল্প লেখা শুরু করলাম।
এরপরই… আমার সাহিত্যে পদচারণার শুরু।”
কাফকা যক্ষা রোগে ভুগছিলেন ৷ কিছুতেই সুস্থ হচ্ছেন না দেখে তিনি অর্ধ সমাপ্ত পান্ডুলিপিগুলো পুড়িয়ে ফেলেন আর পরম বন্ধু ব্রডকে চিঠি লিখে জানান “Dearest Max, my last request: Everything I leave behind me … in the way of diaries, manuscripts, letters (my own and others’)। বন্ধুকে বলেছিলেন তাঁর অসমাপ্ত কাজগুলো যাতে পুড়িয়ে ফেলা হয়৷ তিনি কাফকার অনুরোধ রাখেননি।
১৯২৫ থেকে ১৯৩৫ সালের মধ্যে তিনি কাফকার সাহিত্য কীর্তিগুলো প্রকাশ করেছিলেন৷ প্রকাশিত হয় কাফকার বিখ্যাত উপন্যাস ‘The Trial’, এছাড়াও তাঁর চিঠি-পত্রের সংকলন, অসম্পূর্ণ উপন্যাসও প্রকাশের ব্যবস্থা করেন তিনি। সাহিত্যের এক নতুন ধারা তিনি এনে দিয়েছিলেন যেটি ‘Kafkaesque’ নামে পরিচিত।
যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে ক্ষণে ক্ষণে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে রোগা আর ছিমছাম গড়নের এক ব্যক্তি। অন্তিম এক মূহুর্তে তার জীবনের সব কাজ পুড়িয়ে দেওয়ার অদ্ভুতুড়ে এক অনুরোধ করে গেলেন প্রিয় বন্ধুকে। শুধু বন্ধুকে অনুরোধ করেই ক্ষান্ত হননি, হাতের আশেপাশে থাকা নিজের কাজের একটা বড় অংশ নিজেই পুড়িয়ে দিয়েছেন। শরীরে শক্তি ছিলো না আর পাণ্ডুলিপিগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো বলে সব পুড়িয়ে দিতে যেতে পারেননি। তাই বন্ধুকেই অনুরোধ করে গেলেন বাকী কাজটুকু সমাধা করার জন্য।
বন্ধু ম্যাক্স ব্রড বরং যত্ন করে সেই লেখাকে প্রকাশ করে দিলেন। পাণ্ডুলিপিতে অক্ষরের বেড়াজাল থেকে বের করে আনলেন পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম বিখ্যাত এক উপন্যাস ‘The Trial’ কে। ধরাধাম ছেড়ে চলে যাবার অনেক পরে পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম প্রভাবশালী লেখক হিসেবে জায়গা করে নিলেন ফ্রান্ৎস কাফকা। তার উপন্যাসে, ছোটগল্পে প্রভাবিত হয়ে সাহিত্য রচনা শুরু করলেন শত শত লেখক। নিজের অজান্তেই জন্ম দিয়ে গেলেন ‘Kafkaesque’ বলে নতুন এক ধারার।
উনিশ শতকের শেষ ভাগে জন্ম হয়েছিলো কাফকার। ইউরোপে তখন শিল্পায়নের ছোঁয়া লাগছে একটু একটু করে। চারপাশে হাজারও সমস্যা, অবিচার-অনাচারের ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে পুরো পৃথিবী। ইউরোপের অন্যতম শহর প্রাগ তখন শিল্প সংস্কৃতির অন্যতম চর্চা কেন্দ্র। বর্তমানে চেক প্রজাতন্ত্র হিসেবে পরিচিত হলেও ১৮৮৩ সালে সেই অঞ্চলটি অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের অধীনে বোহেমিয়া নামে পরিচিত ছিলো। জার্মান আর চেক দুই ভাষাভাষীদের সেই শহরে এক মধ্যবিত্ত ইহুদী পরিবারে জন্ম ফ্রান্ৎস কাফকার।
হারমান কাফকা আর ইয়ুলি কাফকার প্রথম সন্তান ফ্রান্ৎস কাফকা। জীবিকার প্রয়োজনে ব্যস্ত বাবা-মায়ের সঙ্গ শৈশবে খুব একটা না পেলেও তিন বোন এলি, ভ্যালেরি আর ওটলির সাথে শৈশব কেটেছে কাফকার। এর মধ্যে ওটলি ছিলেন ফ্রান্ৎসের সবচেয়ে কাছের মানুষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইহুদি বন্দীশিবিরেই প্রাণ হারিয়েছেন তিন বোনের সবাই।
যেভাবে কাফকা হয়ে উঠলেন সাহিত্যিক
প্রাগের মাসনা স্ট্রিটে ‘জার্মান বয়েজ এলিমেন্টারি স্কুলে’ হাতেখড়ি কাফকার। ১৮৮৯ থেকে ১৮৯৩ সাল পর্যন্ত এই স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষার পাট চুকিয়ে ওল্ড টাউন স্কয়ারের জার্মান মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। পাঠ্যক্রম ছিলো জার্মান ভাষায়, বাড়িতে সবাই কথা বলতো ইদ্দিশ ভাষায় আর প্রাগের সাধারণ মানুষ কথা বলতো চেক ভাষায়। তাই কাফকা অনেকটা নিজের গরজেই তিন ভাষাই শিখে নিয়েছিলেন। কাফকা ছিলেন অসাধারণ রকমের এক মনোযোগী পাঠক। হাতের পাশে জার্মান কিংবা চেক ভাষায় লেখা কোনো কিছু পাওয়া মাত্রই পড়ে ফেলার জন্য অনেকটা উদগ্রীব হয়ে পড়তেন এই তরুণ।
মাধ্যমিকের গণ্ডি পাড়ি দিয়ে কাফকা পাড়ি জমালেন কার্ল-ফার্দিনান্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সময়টা ১৯০১ সাল, নতুন সেই শতাব্দীর শুরুতে জার্মানী জুড়ে বয়ে যাচ্ছে বিজ্ঞানের জোয়ার। ম্যাক্স প্লাংকের মতো বিজ্ঞানীরা তখন তরুণদের আদর্শ। অনেকটা সে জোয়ারেই কাফকাও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে গেলেন রসায়ন পড়বেন বলে। কিন্তু রসায়নের সাথে তার বোঝাপড়া হয়ে উঠছিলো না। তার বিষয় পরিবর্তনের ব্যাপারটি জেনে বাবার পরামর্শ অনুযায়ী ভর্তি হলেন আইন বিষয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম বছরেই দেখা হয় তার সারা জীবনের সঙ্গী হয়ে যাওয়া ম্যাক্স ব্রডের সাথে। ম্যাক্সের শুরুতেই ভালো লাগে কাফকাকে। সবাই যখন কথা বলে যেতেন কাফকা ধীর স্থিরভাবে সেই কথা শুনে যেতেন। সবার সঙ্গ এড়িয়ে চলা এই ছেলেটির সাথে কথা বলে ম্যাক্স ব্রড ধারণা পেলেন কতটা জ্ঞান আর প্রজ্ঞার অধিকারী সে। কাফকা আর ব্রড দুজন মিলে প্লেটোর ‘Protagoras‘ থেকে শুরু করে গুস্তাব ফ্লবেয়ারের ‘Sentimental Education‘ পর্যন্ত পড়েছেন, আলোচনা করেছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তবে দস্তইয়েফস্কি, ফ্লবেয়ার, ফ্রানৎস গ্রিলপারসার আর হাইনরিখ ফন ক্লাইস্ট এই চার লেখকের লেখা পড়ে মুগ্ধ কাফকা তাদের ‘সত্যিকার অর্থে নিজের রক্তের ভাই’ বলেই ঘোষণা করেছিলেন। জার্মান সাহিত্যের আরেক দিকপাল গ্যোয়েটের সাহিত্যকর্ম পড়েও বেশ অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন তরুণ কাফকা। কিন্তু লেখালেখির জগতে কাফকার পদচারণা তখনও শুরু হয়নি। হয়তো বিশ্বকে জয় করবেন প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ভিতরে ভিতরে।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে পাশ করে চাকরিতে ঢোকেন কাফকা। পাশাপাশি লেখালেখিও শুরু করেন। প্রথম কর্মস্থল হিসেবে ইতালিয়ান বিমা কোম্পানি ‘Assicurazioni Generali’ তে যোগ দিলেন। তবে অভিজ্ঞতা সুখের ছিল না। সকাল আটটা থেকে শুরু করে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত কাজ করে লেখালেখিতে সময় দিতে পারছিলেন না বলে চাকরিটাই ছেড়ে দিলেন। চাকরি নিলেন ‘Workers’ Accident Insurance Institute for the Kingdom of Bohemia’-তে। দৈনিক ছয় ঘন্টার চাকরি, সাথে চলছে লেখালেখি। ১৯০৮ সালে কাফকা তার প্রথম লেখা ছাপেন। ১৯১২ সালে প্রকাশিত হয় তার লেখা ‘Das Urteil’ (literally: ‘The Verdict’)।
কাফকা প্রথম উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে ‘Das Urteil’ একটি। মূলত এই গল্প নির্মিত হয়েছে বাবা আর ছেলের সম্পর্কের টানাপোড়নের বুননে। বিশ্লেষকদের মতে কাফকার নিজের জীবনের প্রতিচ্ছবিই ফুটে উঠেছে এই গল্পে। কাফকার জীবনজুড়ে তার বাবা তার উপর এত বেশি প্রভাব খাটিয়েছেন যে তিনি অনেকটা দুঃখের সাথেই লিখেছিলেন,
“বাবা আমার পৃথিবীর পুরো মানচিত্রের উপর শুয়ে ছিলেন। তিনি আমার জন্য খুব কম জায়গাই রেখেছিলেন।”
১৯১৫ সালে জার্মানির লিপজিগ থেকে প্রকাশিত কাফকার অন্যতম সেরা সাহিত্যকর্ম ‘Die Verwandlung’ (‘The Metamorphosis’)। এই উপন্যাসের প্রথম লাইনটিকে গণ্য করা হয় পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম সেরা একটি লাইন হিসেবে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র গ্রেগর সামসা একজন ট্রাভেলিং সেলসম্যান। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলেন তিনি পোঁকা হয়ে গেছেন। অর্থাৎ তার রূপান্তর হয়ে গেছে। এই উপন্যাসের প্রথম লাইনটিই ছিলো ঠিক এমন,
“এক সকালে ঘুম থেকে উঠে গ্রেগর সামসা দেখলো – সে পোঁকা হয়ে গেছে!”
পৃথিবীর হাজারো মানুষকে এই একটি লাইন যুগ যুগ ধরে ভাবনার খোরাক দিয়েছে। নোবেলজয়ী সাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ আন্দোলিত হয়েছিলেন এই একটি লাইন পড়ে। কী সাবলীলভাবে একজন মানুষের শারীরিক রুপান্তরের খোলসে সামাজিক রুপান্তরের কথা বলে গেলেন। যে গ্রেগর সামসার উপর নির্ভর করে দাঁড়িয়ে ছিল তার পুরো পরিবার, কয়েকদিন পরে তিনিই পরিণত হলেন পরিবারের অনীহার পাত্রে। এই উপন্যাসেও বাবাকে তিনি দেখিয়েছেন ভয়ানক চরিত্রে। বাবার নিক্ষেপ করা আপেলের আঘাতেই পোঁকায় রুপান্তরিত ছেলে এগিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর দিকে। এই উপন্যাসের লেখনী শুধু মার্কেজের মতো তরুণ সাহিত্যিককেই প্রভাবিত করেনি, যুগের পর যুগ ধরে প্রভাবিত করে গেছে শত সহস্র সাহিত্যবোদ্ধাকে।
এরপর একে একে প্রকাশিত হয়েছে ‘In the Penal Colony’,’A Hunger Artist’ এর মতো কালজয়ী সব সাহিত্যকর্ম। কিন্তু শরীরের অবস্থাটা যে তার ভালো নেই।
১৯১৭ সালে চৌত্রিশ বছর বয়সেরকাফকার যক্ষ্মা ধরা পড়ে। ভয়ংকর ছোঁয়াচে এই রোগের চিকিৎসা তখনও তেমন প্রচলিত না থাকায় নিজেকে অনেকটাই গুটিয়ে নিতে বাধ্য হোন কাফকা। এই সময় লিখছেন নিজের আরেক মাস্টারপিস ‘The Trial’। যক্ষ্মার কারণে কাফকাকে চাকরি থেকে পেনশন দিয়ে বাধ্যতামূলক অব্যাহতি দেওয়া হয়।
লেখালেখিতে আরো ভালোভাবে মনোনিবেশ করতে চেয়েও পারছিলেন না। ক্রমান্বয়ে রোগা হয়ে যাচ্ছিলেন, হাসপাতাল আর যক্ষ্মা নিবারণ কেন্দ্রগুলোতে দিন কাটছিলো কাফকার। হতাশা আর একাকীত্বও হয়তো চেপে বসেছিলো কাফকার কাঁধে।
বিয়ে করেননি কাফকা, বলতে গেলে সুযোগ হয়ে ওঠেনি। অনেক নারীর সংস্পর্শেই এসেছেন, কিন্তু কাউকেই ধরে রাখতে পারেননি। কাফকার প্রথম প্রেমিকা ছিলেন ফেলিস বাউয়ার। তাকে কম করে হলেও কাফকা পাঁচশত চিঠি লিখেছেন। মৃত্যুর পরে সেই চিঠির সংকলন নিয়ে ‘Letters to Felice’ নামে বইও বেরিয়েছে। কিন্তু তার সাথে দুবার বাগদান হলেও দুবারই তা ভেঙে যায়।
১৯২০ সালে যক্ষ্মার কবলে পড়া কাফকা মিলেনা জেসেন্সকা নামে এক চেক সাংবাদিকের প্রেমে পড়েন। বাস্তব জীবনে যতটা প্রেমিক ছিলেন কাফকা তার চেয়ে অনেক বেশি ছিলেন কাগুজে প্রেমিক।
মিলেনাকেও লিখেছেন শয়ে শয়ে চিঠি। তার কাছে লেখা চিঠিগুলো নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে আরেক বেস্টসেলিং বই ‘Letters to Milena‘।
কাফকার শেষ প্রেমিকার নাম ছিলো ডোরা ডিয়ামান্ট। ১৯২৩ সালে কাফকার জীবনপ্রদীপ যখন একটু একটু করে নিভে আসছে তখন তার সাথে পরিচয় হয়। মৃত্যু যখন ঠিক দরজায় কড়া নাড়ছে ঠিক তখন দুজন মিলে পরিকল্পনা করলেন তারা প্যালেস্টাইন যাবেন, সুখের সংসার শুরু করবেন। রেস্টুরেন্ট খুলে ডোরা রান্না করবেন আর কাফকা হবেন ওয়েটার। সুন্দর ছিমছাম আর নির্ভেজাল বাকী জীবনটা দুজন একসাথে কাটিয়ে দিবেন।
কিন্তু সেই সুযোগটুকু আর কাফকা পেলেন না। কোনো এক অদ্ভুত কারণে নিজের লেখার একটা বড় অংশ নিজেই পুড়িয়ে দিলেন। বাকী যা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো তা বন্ধু ম্যাক্স ব্রডকে পুড়িয়ে দেওয়ার অনুরোধ করে গেলেন।
১৯২৪ সালের ৩ জুন কাফকা চিরতরে ধরাধাম ত্যাগ করেন। কিন্তু সবেমাত্র তার লেখার অনুবাদ শুরু হয়েছে।
‘দ্য ট্র্যায়ালে’ জোসেফ কে নামক এক ব্যক্তিকে একদিন ভোরে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু তার অপরাধ কী এটিই তাকে জানতে দেওয়া হয়নি। তাকে বন্দী করা হয়নি, তবে তার বিচার চলতে থাকে। এই উপন্যাসে কাফকা তুলে ধরেছেন বিচারব্যবস্থা আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতার এক অনবদ্য ছবি।
কাফকার নামে রচিত হয়েছে শত-সহস্র বই। পৃথিবীর সীমানায় তাকে বেঁধে রাখতে না পারলেও কাফকাকে কাগজের কারাগারে চিরতরে তাকে বন্দী করে রেখে দিয়েছেন পৃথিবীজোড়া সাহিত্যবোদ্ধারা।
কাফকার পরিবার ছিলো মধ্যবিত্ত এবং আশকেনাজি নামক এক সম্প্রদায়ের ইহুদি। ফ্রানৎস কাফকার বাবা বাবা হারমান কাফকা ( ১৮৫২ – ১৯৩১ ) শুরুর দিকে সেনাবাহিনীর সৈনিক ছিলেন, এরপর সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি কিছুদিন ভ্রাম্যমাণ সেলসম্যান এর কাজ করেন। এই কাজও তিনি বেশিদিন করলেন না সব ছেড়ে দিয়ে তিনি স্যুভেনির , ফ্যান্সি জিনিসপত্র আর কাপড়চোপড়ের দোকান চালু করেন প্রাগের ওল্ড টাউন স্কোয়ারে। সেই দোকানের কর্মচারীর সংখ্যা ছিল ১৫ জন, অর্থাৎ যথেষ্ট বড় দোকানই ছিলো। তার ব্যবসার নিজস্ব লোগোও ছিলো। ব্যবসার লোগো ছিল দাঁড়কাক (চেক ভাষায় Kavka)
কাফকার মা ছিলেন ইয়ুলি কাফকা (১৮৫৬-১৯৩৪), তিনি ছিলেন এক ধনাঢ্য প্রতিষ্ঠিত রিটেল ব্যবসায়ীর মেয়ে। শিক্ষা-দিক্ষায় তিনি তার স্বামীর উপরে ছিলেন। ফ্রানৎস কাফকার বাবা-মা বাসায় কথা বলতেন ইদ্দিশ (হিব্রু বর্ণমালায় লেখা আকেনাজি ইহুদি মূল থেকে তৈরি হওয়া, গোঁড়া ইহুদিদের ব্যবহৃত হিব্রু ও সেমেটিক সংমিশ্রণের এক জার্মান ভাষার রূপ) ঘেঁষা এক জার্মান ভাষায়। কিন্তু ‘ শিক্ষিত জার্মান ’ ভাষা তখন যেহেতু ছিল সমাজে ও চাকরিতে উপরে ওঠার জন্য জরুরি , তাঁরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের ‘শিক্ষিত জার্মান ভাষা’ শিখতেই অনুপ্রাণিত করতেন।
ফ্রানৎস কাফকারা ছিলেন মোট ছয় ভাই বোন , তাদের মধ্যে ফ্রানৎস কাফকা সবার বড়। ফ্রানৎসের বয়স ৬ হওয়ার আগেই তার অন্য দুই ভাই গেয়র্গ ও হেইনরিখ একদম শিশু বয়সেই মারা যায়। এরপর জন্ম নেন ফ্রানৎসের তিন বোন : গ্যাব্রিয়েল ( ১৮৮৯-১৯৪১ ) ; ভ্যালেরি ( ১৮৯০-১৯৪২ ) ; ওটলি (১৮৯২-১৯৪৩)। এই ওটলি ছিলেন কাফকার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ।
তিন বোনের মৃত্যুর সাল দেখে হয়তো অনুমান করতেই পারছেন, তারা ফ্যাসিস্ট হিটলারের নাৎসি বাহিনীর হলোকাস্টের শিকার।
কাফকার পরিবার শুরুর দিকে থাকতেন একটা ছোট, ঠাসাঠাসি অ্যাপার্টমেন্টে। তাদের বাসায় এক কাজের মেয়ে থাকত, এজন্য হয়তো কাফকার গল্প ও উপন্যাসে কাজের মেয়ের কথা ঘুরেফিরে আসে।
কাফকার ঘর প্রায়ই থাকত অনেক ঠান্ডা, প্রাগ শহর তখনো বিদ্যুৎ এর ছোঁয়া পায় নি, সুতরাং হিটিং সিস্টেম এর কথাই আসে না। ঘর গরম করার জন্য সেই মধ্যযুগীয় কয়লা চিমনিরই ব্যবহার করতে হতো। ১৯১৩ সালের দিকে কাফকারা একটি বড় অ্যাপার্টমেন্ট এ উঠেন। ততোদিনে কাফকার ২ বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। অবশ্য এর মাঝে কাফকাদের বহুবার বাসা বদল হয়েছে।
কাফকার বাবা-মা দুজনেই দোকানের কাজ নিয়ে প্রচন্ড ব্যাস্ত থাকতেন। কাফকার মা তার দিনের দশ-বারো ঘন্টাই কাটাতেন দোকানের কাজ করে। কাফকার সময় কাটতো তার বোন ও কাজের মেয়েটির সঙ্গে। কাফকা ও তার তিন বোন সকলেই কাজের মেয়েটির হাতে মানুষ হয়েছে। বাবা মায়ের সঙ্গ তাদের ভাই বোনেরা কেউই খুব একটা পায়নি।
কাফকা সিনাগগে যেতে পছন্দ করতেন না। সিনাগগ হচ্ছে ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়। বছরে চার বার কাফকাকে তার বাবার সাথে সিনাগগে যেতে হতো, সবগুলোই ছিলো ধর্মীয় উৎসব। সিনাগগে যেতে না চাইলেও তার বাবার ভয়ে তাকে যেতে হতো। কাফকার বাবা ছিলেন প্রচন্ড রকমের রাগী ও বদমেজাজি মানুষ।
১৮৯৩ সালে কাফকা এলিমে এলিমেন্টারি স্কুল ছেড়ে কাফকা প্রাগের ওল্ড টাউন স্কোয়ারের ওপর অবস্থিত কিল্কি প্যালেসে (এটারই নীচুতলায় ছিল তাঁর বাবার দোকান) কড়া শাসনের ও ক্ল্যাসিক্যাল শিক্ষাদান রীতিতে চালানো জার্মান মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হন।
এই স্কুলের পড়াশোনার মাধ্যম ছিলো জার্মান। কিন্তু কাফকা কেবল চেক ভাষা লিখতে ও পড়তে পারতেন তখন। তার চেক ভাষার দক্ষতার জন্য তিনি সকলের কাছে প্রশংসিত হতেন। কিন্তু কাফকা নিজেকে চেক ভাষায় সাবলীল মনে করতেন না।
কাফকা ১৯০১ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করে প্রাগ শহরের কার্ল-ফার্দিনান্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি প্রথমে পড়াশোনা শুরু করেন রসায়ন বিষয়ে, কিন্তু মাত্র দু’সপ্তাহ যেতেই কাফকা বিষয় পরিবর্তন করে আইনের ছাত্র বনে যায়। কাফকা হয়তো বুঝেছিলেন ওসব রস- কষের প্যাচ হয়তো তার মাথায় ঢুকবে না। আইন শাস্ত্র যে কাফকা পছন্দ করতেন তাও নয়। তবে আইনে ভর্তি হওয়ার কাফকার বাবা খুশি হয়েছিলেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। আইনে পড়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যত গড়া সহজ।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সাথে সাথেই কাফকার বেশ কজন বন্ধু জুটে যায় তার মধ্যে ছিলেন সাংবাদিক ফেলিক্স ভেল, লেখক অস্কার বাউম, ফ্রানৎস ভেরফেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বছরের পড়া শেষ হতেই কাফকার সঙ্গে পরিচয় হয় ম্যাক্স ব্রডের, যে ছিলেন কাফকার সবচেয়ে কাছের, এবং বতমানে কাফকার জগৎবিখ্যাত হওয়ার পেছনে পুরো কৃতিত্ব ব্রডেরই।
তাঁর প্রিয় বন্ধু ম্যাক্স ব্রড ও ছিলেন আইনের ছাত্র। ম্যাক্স ব্রডই প্রথম খেয়াল করেন খুব কম কথা বলা, লাজুক ধরণের এই ছেলেটির মেধা ও প্রজ্ঞা অত্যন্ত গভীর ও অগাধ।
ফ্রানৎস কাফকা ১৯০৬ সালের ১৮ জুলাই আইনশাস্ত্রে ডক্টরেট ডিগ্রি পান এবং এর পরে এক বছর আদালতে বাধ্যতামূলক বেতনহীন ক্লার্কের চাকরি করতে শুরু করেন। পড়াশোনার ক্ষেত্রে কাফকার কখনোই আইন পছন্দের বিষয় ছিলো না। কাফকার প্রিয় বিষয় ছিলো দর্শন ও ধর্ম। তবে কাফকার কোনও ধর্মের প্রতিই খুব একটা টান অনুভব করতেন না।
কাফকা তার কর্মজীবনে শুধুমাত্র দুটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছিলেন এবং মাঝখানে বড় ধরণের কোনো ব্যবসা করার ও উদ্যোগ তিনি নিয়েছিলেন।
কাফকার প্রথম চাকরিটি ছিলো ইতালিয়ান একটি বীমা কোম্পানিতে। কোম্পানির নাম ছিল Assicurazioni Generali, এই কোম্পানিতে তিনি ১৯০৭ সাল থেকে ১৯০৮ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন, সবমিলিয়ে ছয়-সাত মাসের বেশি হবে না।
এই ইতালিয়ান কোম্পানিতে কাজ করার সময় কাফকা তার জীবনের অসুখী সময়গুলো কাটান। সকাল আটটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত তাকে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হতো। দীর্ঘ পরিশ্রমে তার মন-মানসিকতা থাকত সবসময় বিষন্ন তার উপর বেতন ছিল অতি সামান্য। এই চাকরি করতে গিয়ে কাফকা লেখা-লেখি করার সামান্য সময়টুকু ও পেতেন না। কাফকা তার রূপান্তর উপন্যাসের গ্রেগর সামসা চরিত্রটি কাফকার এই সময়কার পরিস্থিতিতে নিজেকে কল্পনা করেই লিখেছিলেন হয়তো। ১৯০৮ সালের জুলাই মাসের শুরুর দিকে কাফকা নিজের চাকরির ইস্তফা দেন।
ইতালিয়ান কোম্পানির চাকরি থেকে পদত্যাগ করার ঠিক দু’সপ্তাহ পর কাফকা সরকারি বীমা প্রতিষ্ঠান Workers ‘ Accident Insurane Institute for the Kingdom of Bohemia তে যোগ দেন। এই অফিসে কাফকার দায়িত্ব ছিল, মিল বা কারখানার শ্রমিকেরা কাজ করতে গিয়ে আহত হলে , সেসব দুর্ঘটনার তদন্ত করা ও ক্ষতিপূরণের অঙ্ক নির্ধারণ করা। তখনকার দিনে মেশিনে কাটা পড়ে হাতের আঙুল হারানো কিংবা অন্য কোনো অঙ্গের ক্ষতি হওয়া ছিল বেশ নৈমিত্তিক ঘটনা।
তবে কাফকার বাবা ছেলের এই চাকরি মোটেও পছন্দ করতেন না। তিনি তার ছেলের এই চাকরিকে Brotberuf বা ‘ রুটির চাকরি ‘ বলে খোঁটা দিতেন। কাফকা তার কাজের বেলায় ছিলেন সবসময় খুঁতখুঁতে, সৃজনশীল ও যত্নশীল, আর তাই খুব দ্রুত তার পদন্নোতি হয়। ১৯১৫ সালের দিকে কাফকার বেতন ছিল প্রায় ছয় হাজার ক্রাউন এখন অর্থের মূল্য অনুযায়ী সাত-আট লক্ষ টাকা। সাত-আট লক্ষ টাকার বেতন কে কোনোভাবেই ছোট চাকরি বলা যায় না। যেখানে কাফকার অন্য সহকর্মীরা মাসে মাত্র ৯০০-১০০০ ক্রাউন বেতন পেতেন।
১৯১৮ সালের শুরুর দিকে কাফকার বাবা পাঁচ লক্ষ ক্রাউন দিয়ে একটি নতুন অ্যাপাটমেন্ট কেনেন। যার মূল্য আজকের দিনের দশ মিলিয়ন ডলারে কাছাকাছি। চাকরিতে পদোন্নতি হওয়ার পর কাফকার কাজ ছিলো বীমা কোম্পানির ক্ষতিপূরণ দাবির যথার্থতা নির্ণয় করা, রিপোর্ট লেখা, ব্যবসায়ীদের আবেদন নিষ্পত্তি করা ইত্যাদি। এই বিশাল প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক প্রতিবেদন ( Annual Report ) তৈরি করার মতো বড় কাজটিও কাফকা করেছেন অনেক বছর। কাফকার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তার বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরির ও সম্পাদনার কাজে তার দক্ষতার বিশেষ প্রশংসা করতেন।
কাফকার চাকরি দুপুর দুটোর মধ্যেই শেষ হয়ে যেত। এজন্য সাহিত্য চর্চা করার জন্য কাফকা যথেষ্ট পরিমান সময় পেতেন। সাহিত্য চর্চার সময় কাফকা কিছু উদ্ভট পদ্ধতি অবলম্বন করতেন। এর মধ্যে একটি হলো লেখালেখির সময় প্রকৃতির ডাক দিলে লেখায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে, আর তাই তিনি রুমের দরজা বন্ধ করে পুরোপুরি নগ্ন হয়ে লিখতে বসতেন, যেন লেখালেখির সময় বাহিরে না যেতে পারেন।
কাফকা যখন চাকরি করেন তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। তখন প্রাগের সকল যুবকদের বাধ্যতামূলক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হতো। তবে কাফকা কে বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হয়নি। তখন অফিসের ঊর্ধ্বতনেরা কাফকাকে এ প্রতিষ্ঠানের জন্য ‘জরুরি প্রয়োজনীয় ব্যক্তি’ বলে ঘোষণা করেন।
শুধু যুদ্ধই নয়, কাফকা প্রায় সময়ই অসুস্থ থাকতেন, তার জন্য তার অফিস তাঁকে দীর্ঘ দিনের ছুটিও দিত। শেষে কাফকা যখন শারিরীক অসুস্থতার জন্য আর চাকরি করতে পারছিলেন না তখন বীমা কোম্পানি তাকে পূর্ণ পেনশন দিয়ে চাকরি থেকে ইস্তফা দেয়, অথচ কাফকা সেই কোম্পানিতে চাকরি করেছিলেন মাত্র কয়েক বছর।
কাফকা তাঁর দু’টি চাকরি ছাড়া একবার ব্যবসা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। সেটিও ১৯১১ সাল তার বোন এলির স্বামী সাথে। তারা প্রাগে একটি মিল কারখানা খোলা মনস্থির করেন, এই ব্যবসার পূঁজি ছিল কাফকার বোনকে বিয়ে করার যৌতুকের টাকা।
কাফকা পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত পাল্টান এই ভেবে যে ব্যবসা করলে তার সাহিত্য চর্চায় ব্যাঘাত ঘটবে।
অফিস তাকে যুদ্ধ করার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিলেও। কাফকা যুদ্ধের স্বাদ কেমন তা চোখে দেখতে ১৯১৭ সালে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার আগ্রহ দেখান, কিন্তু তত দিনে যক্ষ্মার কারণে ডাক্তারি দৃষ্টিকোণ থেকেই সেনাবাহিনী তাকে নিতে অপারগতা জানিয়ে দেয়।
ফানৎস কাফকার বাবা ‘হারমান কাফকা’
সবসময় ছিলেন নিষ্ঠুর, অনুভূতিশূন্য এক পিতা। তিনি সারাজীবন কাফকা কে আতঙ্কের মধ্যে রেখেছিলেন। কাফকার রূপান্তর উপন্যাসের পোকার মতোই তিনি তাকে কোনো সম্মান বা ভালোবাসা কোনেটাই দেননি। সবসময় ছেলেকে তিনি হুমকি ধমকি দিতেন। তুমি অপদার্থ তোমার দ্বারা কিচ্ছু হবে। এসব কথা শুনে কাফকা বড় হয়েছেন একজন আত্মবিশ্বাসহীন মানুষ হিসেবে।
১৯১৯ সালের নভেম্বরে কাফকা তার বাবার উদ্দেশ্যে ১০০ পাতার একটি দীর্ঘ চিঠি লেখেন। এই চিঠিটি বতমানে কাফকা প্রধান আত্মজীবনী মূলক রচনা। এই চিঠি লিখেছিলেন বাবার সঙ্গে তার সম্পর্কের দফারফা করতে। কিন্তু কাফকার মা ও বোন তাকে সেই চিঠি পাঠাতে নিষেধ করায় আর পাঠান নি।
এই চিঠিতে কাফকা লিখেছেন তার রাগী বদমেজাজি বাবার রূপ, তিনি কিভাবে তাকে তাড়া করতেন, কিভাবে তাকে হুমকি ধমকি দিয়ে বলতেন, ‘আমি তোমাকে মাছের মতো করে টুকরো টুকরো করবো’।
একবার রাতে কাফকা কান্না করায় তার বাবা তাকে বিছানা থেকে তুলে বাড়ির পেছনের বারান্দায় সারা রাত দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন। বাহিরে ছিলো তখন কনকনে ঠান্ডা। সেদিন কাফকার মনে হয়েছিল বাবার কাছে তিনি অতি তুচ্ছ জিনিস।
কাফকার সাথেই যে তিনি শুধু খারাপ ব্যবহার করতেন তা নয়। কাফকার বাবা তার দোকানের কর্মচারীদের সাথেও জুলুম করতেন। এজন্য কয়েকজন চাকরি থেকে ইস্তফাও দিয়েছিল।
বাবা কে কাফকা মনে করত দৈত্য। তার পাশে নিজেকে দাঁড় করালে নিজেকে মনে হতো কোন জীবন্ত কঙ্কাল। বাবাকে অনুকরণ করতে ব্যর্থ হয়ে কাফকা তাঁর অক্ষমতার জন্য নিজেকেই দোষী ভাবতে শুরু করলেন; তার নিজের সারাংশ “তোমার জন্য , বাবা , আমি আমার আত্মবিশ্বাস হারিয়েছি , বিনিময়ে পেয়েছি এক সীমাহীন অপরাধবোধ।”
ফ্রানৎস কাফকা তার জীবনের শেষ দিকে যখন কপর্দকশূন্য মেয়ে ইউলি ওরিৎসেককে বিয়ে করতে চাইলেন, তখন তার বাবা ক্ষেপে গেলেন। কাফকার ভাষায়, তার বাবা তাকে বললেন: ‘মেয়েটা খুব সম্ভব তার ব্লাউজ একটুখানি উঠিয়েছে, প্রাগের ইহুদি মেয়েগুলো যেভাবে ওঠায় আর কি, আর তুমি? তুমি মজে গেলে, ঠিক করলে ঐ মুহূর্তেই তাকে বিয়ে করবে। তোমাকে আমি একবারেই বুঝি না। তুমি বড় হয়েছ, শহরে থাকছ, কিন্তু তোমার চলার পথে দেখা হওয়া প্রথম মেয়েটাকে বিয়ে করা ছাড়া অন্য কিছুর কথা ভাবতে পারছ না।
অন্য কোনো ‘রাস্তা’ কি তোমার নেই? এইসব জায়গায় যেতে যদি তোমার ভয় লাগে , আমি তোমাকে সাথে নিয়ে যাব। অর্থাৎ তার বাবা তাকে পতিতালয়ে যাওয়ার কথা বলছেন। অথচ কাফকা এটিকে পৃথিবীর সবচেয়ে নোংরা জায়গা বলে ভাবতেন।
কাফকা কোন বিষয়ে পড়াশোনা করবেন এই ব্যাপারে তার বাবা তাকে স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। কিন্তু কাফকার কাছে এই স্বাধীনতা ছিল অর্থহীন। যে অপরাধবোধ ও হীনমন্যতা তার বাবা তার মনে ঢুকিয়ে দিয়েছিলো তাতে তিনি পড়াশোনা করে আনন্দ পেতেন না।
কাফকার আত্মবিশ্বাস ছিলো একদম তলানীতে প্রতিবার পরীক্ষার আগে ভাবতেন তিনি পাশ করতে পারবেন না। তবুও তিনি পাশ করে গেছেন কখনও ফেল করেন নি।
বাবার মানসিক চাপ থেকে নিস্তার পেতেই কাফকা সাহিত্যে ডুব দিয়েছিলেন। তবে সব জায়গায় ঘুরেফিরে তার বাবা চলে আসত। কর্তৃত্বপরায়ণ বাবার মূর্তি কাফকার অন্যতম বিখ্যাত দুটো গল্পের মধ্যে দেখা যায় একটি ‘রায়’ আরেকটি হলো ‘রূপান্তর’।
প্রথম গল্পে দেখা যায় ছেলে বিয়ে করে স্বাধীন হতে চাইলে তার বুড়ো বাবা তাকে তার বিয়ের পাত্রী নিয়ে ওভাবেই খোঁটা দেন, যেভাবে হারমান তার ছেলেকে দিয়েছিলেন, যখন কাফকা ইউলি ওরিৎসেককে বিয়ে করতে চাইছিল। সেই গল্পে পরে এই বাবা ছেলেকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন।
দ্বিতীয় গল্পটিতে ছেলে পোকা হয়ে গেলে বাবাই একসময় তার গায়ে একটা আপেল ছুড়ে মেরে তার মৃত্যু নিশ্চিত করেন।
ফ্রানৎস কাফকার মা ‘ইয়ুলি কাফকা’
কাফকার বাবার তুলনায় তার মা খুব শান্ত ও লাজুক এক মহিলা ছিলেন। কাফকার মা কে দেখা যায় তার স্বামীর সহকারী হিসেবে। তিনি তার সন্তানদের সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠ তবুও বাবার অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা করতে তিনি ব্যর্থ।
কাফকার চিঠি দেখে বুঝা যায় তার মায়ের ভূমিকা ছিলো একজন অসহায় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে। অসহায় কারণ তিনি পিষ্ট দু’দিকেরই চাপে। একদিকে তাঁর স্বামী, অন্যদিকে তার সাহায্যের জন্য তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকা তাঁর চার সন্তান।
কাফকা তাঁর বাবাকে এক চিঠিতে লিখেছিলেনঃ- আমরা তাকে ( মাকে ) সমানে হাতুড়ির বাড়ি মেরে যাচ্ছি, তোমার দিক থেকে তুমি, আমাদের দিক থেকে আমরা।
কাফকার দুটি গল্প – ‘ রায় ’ ও ‘রূপান্তরে’ও তার মায়ের চরিত্রটি পাওয়া যায়। রায় গল্পে মা মৃত। আর ‘ রূপান্তর ’ গল্পে তিনি তাঁর ‘ দুর্ভাগা ছেলের প্রতি মমতায় ভরা, কিন্তু ছেলের বিপদে জ্ঞান হারিয়ে ফেলা ছাড়া তার আর কোনো ভূমিকা নেই।
এছাড়াও কাফকার ডায়েরিতে ইয়ুলি কাফকাকে দেখা যায় ছেলের অদ্ভুত ব্যাপার-স্যাপারগুলো নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করছেন, ছেলের বিরক্তি শুধুই বাড়াচ্ছেন আর তাকে বুঝতে পুরো ব্যর্থ হচ্ছেন। কাফকা ডায়েরিতে নালিশ জানাচ্ছেন যে তাঁর মা তাঁকে সাধারণ আর দশটা যুবকের মতোই ভাবেন , তাই ‘ ঘ্যানঘ্যান ‘ করেন তাঁর ছেলে কেন বিয়ে- থা করে সংসারী হচ্ছে না?
কাফকার ব্যক্তিগত জীবন, প্রেম ও যৌনতা
কাফকার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ম্যাক্স ব্রডের ভাষায় কাফকা জীবনভর অবিরাম মেয়েদের পেছনে ছুটেছেন, তবে আর তার মধ্যে সব সময় কাজ করত ‘বিছানায় ব্যর্থ হওয়ার ভয়। ‘
কাফকা অনেকবার পতিতা সংসর্গ করেছেন, এমনকি পর্নোগ্রাফিতেও তার আগ্রহ ছিল।
কাফকার জীবনে প্রেম এসেছে মোট ছয় বার। প্রত্যেকটি প্রেমই একেকবার একেক রূপে এসেছে। তবে কাফকা বিয়ে করাকে জীবনের মুখ্যতম ব্যাপার বলে ভাবতেন।
কাফকার প্রথম প্রেমিকার নাম ছিলো ফেলিসা ব্রাউন। ১৯১৩ সালে মাঝামাঝিতে বন্ধু ম্যাক্স ব্রডের বাসায় তার দেখা হয়েছিল। ফেলিসা বয়সে কাফকা চেয়ে চার বছরের ছোট ছিল। সে বুদ্ধিদীপ্ত, অল্পবিস্তর পড়ালেখা করা , অনাকর্ষণীয় চেহারার, ভালো চাকরি করা বার্লিন শহরের মেয়ে ছিল। কাফকা তাকে ভক্তি করতেন, কিন্তু তার প্রতি কামনা বাসনা বোধ করতেন না।
ফেলিস যখন কাফকার সঙ্গে বিয়ে নিয়ে কথা বলেন কাফকা ভয় পেয়ে যান। তিনি আবার সাহিত্যে মননিবেশ করেন এবং বাবার দোকানের দেখাশোনায় সময় দেয়া শুরু করেন।
ফেলিস কাফকার খামখেয়ালি ও অবিশ্বস্ততার ওপর খুব বিরক্ত ছিলেন। তবুও ১৯১৪ সালের বারোই জুলাই তাদের বাগদান অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু ফেলিস তা ভেঙে দেয়। এরপর আবার তাদের যোগাযোগ শুরু হয় নতুন করে সম্পর্ক হয় আবার বাগদানের অনুষ্ঠান হয়। ১৯১৭ সালের জুলাই মাসে, সেটিও ভেস্তে যায়। এবার ভেঙে যাওয়ার কারণ ছিলো কাফকা গোপনে ফেলিসের বান্ধবী গ্রেটে ব্লখের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। গ্রেটে অবশ্য ইহুদি ধর্মাবলম্বী ছিল। কাফকার বন্ধু ম্যাক্স ব্রড দাবী করেন যে গ্রেটের গর্ভে কাফকার একটি পুত্র সন্তান হয় তা কাফকা জানতেন না। কাফকা গবেষকরা অবশ্য তা অস্বীকার করেন। তারা মনে করেন গ্রেটের সাথে কাফকার অতটা গভীর সম্পর্ক কখনোই হয়নি।
১৯২০ সালে অসুস্থ অবস্থায় থাকতেই কাফকা প্রেমে পড়েন চেক সাংবাদিক ও লেখক, সুন্দরী মিলেনা জেসেস্কার। মিলেনা জেনেস্কা Image source: Art though মিলেনার সঙ্গে সম্পর্ক চলার সময়েই কাফকা প্রাগের এক গরীব অশিক্ষিত হোটেল পরিচারিকা ইউলি ওরিৎসেকের প্রেমে পড়েন। ১৯১৯ সালের এক ছুটিতে তাদের পরিচয় হয়। ইউলির সম্পর্কে খুব একটা জানা যায় নি।
তাদের দুজনের মধ্যে বিয়ের জন্য বাগদান ও হয়, দুজনে একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নেন এবং বিয়ের তারিখও ঠিক করেন। ইউলির সামাজিক অবস্থান ও জায়োনিস্ট আন্দোলনের ( ইহুদিদের স্বাধীন আবাসভূমি ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ) প্রতি সমর্থনের কারণে কাফকার বাবা খেপে যান। এ ঘটনা থেকেই জন্ম হয় কাফকার বিখ্যাত বাবাকে লেখা ১০০ পৃষ্ঠার চিঠির।
একসময় ইউলিকে ছেড়ে মিলেনার দিকেই কাফকা বেশি ঝুঁকে পড়েন এবং ইউলির সঙ্গে সম্পর্ক শেষ করেন। কাফকার শেষ প্রেমিকার নাম ডোরা ডিয়ামান্ট। ১৯২৩ সালের আগস্টে মৃত্যুর মাস দশেক আগে ডোরার সঙ্গে কাফকার পরিচয় হয় এক অবকাশযাপন কেন্দ্রে। ডোরার বয়স তখন পঁচিশ , কাফকার তখন চল্লিশ বছর বয়স। কাফকার চেয়ে পনেরো বছরের ছোট ছিল সে।
মনে করা হয় ডোরা কাফকাকে জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টুকু উপহার দেন। ১৯২৪ সালে কাফকার মৃত্যুর সময় ডোরা তার পাশে ছিলেন। কাফকার লেখার কোনও কোনও অংশ এমন ধারণারও জন্ম দিয়েছে যে তিনি সম্ভবত সমকামী ছিলেন।
ফানৎস কাফকার ১৯১৭ সালের আগস্টে স্বরযন্ত্রের ক্ষয়রোগ ( যক্ষ্মা ) ধরা পড়ে। ১৯১৮ সালের অক্টোবরে তিনি স্প্যানিশ ফ্লুতেও আক্রান্ত হয়েছিলেন। সেবার প্রায় মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছিলেন। স্প্যানিশ ফ্লুতে সেবার আড়াই লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল জার্মানতে। টানা কয়েক সপ্তাহ তার জ্বরের মধ্যে কেটেছিল, কখনো কখনো ১০৬ ডিগ্রি জ্বর থাকত। এই সময়টার বেশিরভাগ সময়ই কাফকা অজ্ঞান থাকতেন।
১৯১৭ সালের আগস্টের পর কাফকা তার বাবা- মায়ের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে আসেন, এরপর বোন ওলার কাছে, গ্রামে , গিয়ে থাকেন আট মাস। আবার ফিরে মায়ের কাছে, এরপর প্রাগ ও আধা – স্বাস্থ্যনিবাস ধরণের নানা হোটেলের মধ্যে বারবার আসা- যাওয়া। তারপর সত্যিকারের ডাক্তারি স্বাস্থ্যনিবাস হয়ে বার্লিনে ডোরা ডিয়ামান্টের সঙ্গে কয়েক মাস।
এরপর ১৯২৪ সালের মার্চে তিনি খুব অসুস্থ অবস্থায় বার্লিন থেকে প্রাগে ফিরে আসেন। এখানে পরিবারের সবাই , বিশেষ করে তাঁর প্রিয়তম ছোট বোন ওলা, তার দেখভাল করেন । ১০ এপ্রিল কাফকাকে নেওয়া হয় ভিয়েনার কাছে কিয়েরলিংয়ে ডক্টর হফমানের স্যানাটোরিয়ামে।
এই স্যানাটোরিয়ামেই ১৯২৪ – এর ৩ জুন কাফকা মৃত্যুবরণ করেন। না খেতে পারাই ছিল তার মৃত্যুর কারণ। গলার অবস্থা ক্ষয়রোগে এতই খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে তিনি দীর্ঘদিন কোনোকিছু গলা দিয়ে নামাতে পারেননি, আর অন্য কোনোভাবে শরীরে খাবার ঢোকানোর পদ্ধতিও তখনও আবিষ্কার হয়নি।
স্যানাটোরিয়ামে ভর্তি থাকা অবস্থায় কাফকা তার বন্ধু ম্যাক্স ব্রডকে চিঠিতে লিখেছিলেন।
প্রিয় বন্ধু ম্যাক্স,
এবার হয়তো যক্ষ্মা আমার পিছু ছাড়ছে না । তাই তেমনভাবে লেখালেখিও আর করা হয়ে উঠছে না। তাই তোমার কাছে লেখা চিঠিতে আমার লেখাগুলোর ব্যাপারে কিছু বলতে চাই। আমার প্রকাশিত পাঁচটি বই আর ছোটগল্পগুলো হয়তো কালের স্রোতে হারিয়ে যাবে। জোর করে এর নতুন সংস্করণ বের করার দরকার নেই। যদি হারিয়ে না যায় হয়তো তাতে আমার করার কিছুই থাকবে না। আর আমার অপ্রকাশিত লেখাগুলোর ব্যাপারে বলছি, সবগুলো পাণ্ডুলিপি আর নোটবুক তুমি পুড়িয়ে দিও। যদি পারো আমার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চিঠিগুলো সংগ্রহ করে পুড়িয়ে দিও। পুড়িয়ে দেওয়ার আগে কেউ সেগুলো যেন পড়ে না দেখে সে ব্যাপারে আমার বিশেষ অনুরোধ রইলো। তবে তুমি সে অনুরোধের বাইরে। চিঠি পাওয়ার সাথে সাথেই হাতের কাছে থাকা আমার লেখার সবকয়টি পাতা পুড়িয়ে দিও। এই ব্যাপারে এটাই হয়তো তোমার কাছে আমার শেষ অনুরোধ।
ইতি
ফ্রানৎস কাফকা
ম্যাক্স ব্রড কথা রাখেনি। ভাগ্যিস ব্রড কথা রাখেননি। শুধু তাই নয় ব্রড কাফকার পুরনো লেখা গুলো নতুন করে ছাপানোর জন্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেরিয়েছেন।
কাফকা তার ছোট জীবনের প্রায় সবটাই প্রাগে কাটিয়েছেন।এগারোই জুন তাকে সমাধিস্থ করা হল প্রাগের জেলিস্কেহো রেলস্টেশনের পাশে নতুন ইহুদি কবরস্থানে। প্রায় একশো লোক জড়ো হয়েছিল তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়। বন্ধু ম্যাক্স ব্রড সেখানে মৃত্যুর গাথা পাঠ করেছিলেন। আর যখন শবাধারটি কবরে নামানো হচ্ছিল, ডোরা নিজেকে কবরের মধ্যে বারবার ছুড়ে ফেলতে চাইছিলেন।
বেঁচে থাকতে ফ্রানৎস কাফকা তার বাবা মায়ের কাছ থেকে মুক্তি পান নি, এমনকি মৃত্যুতেও না ; তারা আছেন তাঁর সঙ্গে একই কবরে, একই কবরফলকের নীচে।