Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ফুলমণি-উপাখ্যান || Sunil Gangopadhyay

ফুলমণি-উপাখ্যান || Sunil Gangopadhyay

কাঁচা ভাত-ঘুম

দুপুরবেলার কাঁচা ভাত-ঘুমটা ভাঙিয়ে দিল চন্দনদা।

দিনটা চমৎকার। সকাল থেকেই রিমঝিম ঘন ঘন রে।

বাজারে ইলিশ মাছ সস্তা। এমন দিনে মাকে বলা যায়। বলা যায় খিচুড়ি, খিচুড়ি! পৃথিবীতে আর কোনও খাবার নেই, যার স্বাদ বৃষ্টির দিনে বেশি ভাল হয়ে যায়, খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজার মতো। খাওয়ার পর বাথরুমে না গিয়ে আমি আঁচালাম বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির জলে। সারা গায়ে বৃষ্টির গন্ধ হয়ে গেল।

এরপর একখানা বই বুকে নিয়ে ঘুম না দেওয়ার কোনও মানে হয় না। যত আকর্ষণীয় প্রেমের গল্প বা গোয়েন্দা গল্পই হোক, বিছানায় গা এলিয়ে দেবার পর দু’চার পাতার বেশি পড়া যায় না, চোখ জুড়িয়ে আসে। খিচুড়ির ঘুমের চরিত্রই আলাদা। এই ঘুম আসে খুব মৃদুভাবে। প্রথমে একটা নাচের ছন্দ শোনা যায়। মনে হয় যেন সুরলোকের নাচ-গানের আওয়াজ টের পাওয়া যাচ্ছে অবচেতনে। তারপর কোথা থেকে একটা নরম মখমলের চাদর উড়ে এসে ঢেকে দেয় শরীর। কেউ যেন কোমল আঙুল বুলিয়ে দেয় দু’চোখের পাতায়। ছোট ছোট স্বপ্ন ঝিলিক দেয়। তারপর বিছানা, খাট-ফাট সুষ্ঠু সব কিছুই ভাসতে থাকে শূন্যে।

আহা, এই রকম দিনেও এত লোককে অফিসে, স্কুলে কলেজে যেতে হয়। তারা কী দুঃখী! রাস্তায় গোড়ালি-ডোবা জলে ছপছপিয়ে যাও, তারপর বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। এরই মধ্যে কোনও গাড়ি বা ট্যাক্সি তোমার গায়ে কাদা ছিটিয়ে চলে যাবে। হঠাৎ মনে হবে, কোনও কাক এসে বুঝিমাথায় একটা ঠোক্কোর মারল, আসলে সেটা পাশের মানুষের ছাতার শিকের খোঁচা। বাইরে ফিনফিনে হাওয়া অথচ বাসের মধ্যে গরম আর ঘাম। অধিকাংশ অফিসেই জানলা দেখা যায় না, জানলা থাকলেও আকাশ দেখা যায় না, দিনেরবেলাতেও আলো জ্বলে। বেচারা চাকরিজীবীরা কী হতভাগ্য।

আমি বাল্যকালে কোনও পাপকরিনি। স্কুলে পড়ার সময় খামোকা ক্লাসের অন্য বন্ধুদের বঞ্চিত করে ফার্স্ট-সেকেন্ড হবার চেষ্টা করিনি কক্ষনও। কলেজে লেকচারাররা যখন শেলি-কীটসের কবিতা কাটা-ছেঁড়া করতেন, তখন দিব্যি আড্ডা মারতাম কফি হাউজে, অর্থনীতির কূটকচালি নিয়ে মাথা ঘামাইনি কোনও দিন, ইতিহাসের বই সামনে খুলে হাত মকসো করতাম প্রেমপত্র লেখায়। এই সব সুকৃতির ফলে চাকরির বাজারে আমার দাম কানাকড়ি, স্বেচ্ছায় দাসত্ব খোঁজার জন্য হন্যে হতে হয়নি আমাকে। আমি বেঁচে গেছি। শহরের রাস্তায় যখন মাইনে বাড়াবার মিছিল দেখি, আমার মজা লাগে। আমাকে ওই গড্ডলিকা প্রবাহে কোনও দিনও যোগ দিতে হবে না। আমার কিছুনা-কিছু খুচরো পয়সা রোজ জুটে যায়, তাই-ই যথেষ্ট।

এমন চমৎকার, মোহময় একটা দিনে যারা চাকরি করছে করুক, আমি খিচুড়ি-ইলিশ মাছ দিয়ে আত্মাকে পরম সন্তুষ্ট করে, বিছানায় শুয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে চলে গিয়েছিলাম ঘুমের দেশে।

আধ ঘণ্টাও ঘুমোইনি, এর মধ্যে মূর্তিমান উপদ্রবের মতো চন্দনদার আবির্ভাব। হাঁটু দিয়ে আমার পিঠে একটা গোঁত্তা মেরে জলদগম্ভীর স্বরে ধমক দিয়ে বলল, এই নীলু, ওঠ! ওঠ!

আমি চোখ মেলে প্রথমে চন্দনদাকে চিনতেই পারলাম না। এমনিতেই তার বেশ বড় সড় চেহারা, তার ওপরে আবার একটা খয়েরি রেইন কোট পরে আছে, মনে হয় যেন একটা দৈত্য।

আমি ভয় পাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করলাম, কে? কে?

চন্দনদা বলল, দুপুরবেলা ষাঁড়ের মতো ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোচ্ছিস, তোর লজ্জা করেনা? পুরুষ মানুষ কখনও দুপুরে ঘুমোয়?

দিবানিদ্রার ব্যাপারে নারী জাতিরই কেন একচেটিয়া অধিকার থাকবে, তা আমার বোধগম্য হয় না। কাঁচা ঘুম ভাঙলে মাথায় অনেক কিছু ঢোকেও না।

চন্দনদার গলার আওয়াজ ও ভাষা চিনতে পেরে আমি বললাম, খিচুড়ি খাবে? এখনও আছে অনেকটা।

চন্দনদা একটা চেয়ার টেনে বসে বলল, কী আবোল তাবোল বকছিস! আমি হঠাৎ এই অসময়ে খিচুড়ি খেতে যাব কেন?

দু’হাতে চোখ কচলে বাস্তব জগতে ফিরে এলাম।

চন্দনদাকে বেশকয়েক মাস বাদে দেখলাম, ওঁদের বাড়িতেও আমি যাইনি অনেক দিন। এর আগে দু’একটা ঘটনার জন্য চন্দনদা আমার ওপর খানিকটা বিরূপ হয়েছিল। একবার মারবেও বলেছিল। কিন্তু সে-সব তো চুকেবুকে গেছে। এর মধ্যে আমি তো আর কোনও গণ্ডগোল করিনি, ওদের পারিবারিক ব্যাপারেও নাক গলাইনি, তাহলে হঠাৎ এই বৃষ্টির দিনের প্রাকবিকেলে চন্দনদা আমাকে হাঁটুর গোঁত্তা লাগাতে এল কেন? অজান্তে কিছু দোষ করে ফেলেছি নাকি?

চন্দনদা গাল চুলকোতে চুলকোতে বলল, ছি ছি ছি, কোনও কাজকম্ম নেই, দুপুরে পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিস। যুব শক্তির কী অপচয়! এই জন্যই তো দেশটা গোল্লায় যাচ্ছে। আর কিছু কাজ না থাকে তো রাস্তার গাছগুলোতে জল দিলেও তো পারিস। তাতে শহরটা সবুজ হবে।

এই বৃষ্টির মধ্যে রাস্তার গাছে পাগল ছাড়া কেউ জল দিতে যায়? গাছেরাই-বা কী ভাববে। চন্দনদাকে এ-কথা বলে লাভ নেই, যা মেজাজ দেখছি, আবার বকুনি খেতে হবে।

ভেতরের পকেট থেকে চন্দনদা একটা চুরুট বার করে ঠোঁটে গুঁজল, তারপর তাকিয়ে রইল আমার দিকে।

আমি বললাম, দেশলাই দেব?

চোখ কটমট করে চন্দনদা বলল, আমার দেশলাই লাগে? উজবুক! জানিস না?

ও হ্যাঁ, ভুলে গিয়েছিলাম। কয়েক বছর ধরে চন্দনদা ধুমপান ত্যাগ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সিগারেট বর্জন করেছে ঠিকই, কিন্তু মুখে একটা চুরুট না রাখলে চলে না। সন্ধের সময় সেটা ধরায়।

প্রতি দিন একটা চুরুট খাওয়া চাই।

এবার রেইন কোটের পকেট থেকে বার করল একটা চৌকো প্যাকেট। দেখে মনে হয় মিষ্টির বাক্স। সেটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এই নে, ছোটপাহাড়ি থেকে তোদের জন্য সন্দেশ এনেছি।

এ আবার কী ব্যাপার। প্রথমে হাঁটুর গুতো, তারপর সন্দেশ? একেই বলে হট অ্যান্ড কোল্ড ট্রিটমেন্ট। চন্দনদার সবকিছুই অদ্ভুত।

প্যাকেটটা টেবিলের ওপর রাখতে যাচ্ছিলাম, চন্দনদা বলল, খুলে দেখলি না? খা একটা! এ-রকম সন্দেশ কলকাতায় পাবিনা।

পরে খাব চন্দনদা।

না, এখনই খা। এত দূর থেকে আনলাম।

মুখে যার টাটকা ইলিশ মাছ ভাজার স্বাদ লেগে আছে, তাকে মিষ্টি খেতে বলা অত্যাচারের মতো নয়?

প্যাকেটের বাঁধন খুলে দেখা গেল তার মধ্যে চকোলেট রঙের দশ-বারোটা ছোট ছোট সন্দেশ রয়েছে। একটা তুলে মুখে দিতেই হল। পোড়া পোড়া ক্ষীরের স্বাদ। মন্দ না। আমি সন্দেশ-রসিক নই, তবু মনে হল, এটা অন্য ধরনের।

বললাম, চমৎকার। ছোটপাহাড়িতে এত ভাল মিষ্টি পাওয়া যায়।

তোর জন্য দু’রকম সন্দেশ এনেছি নীলু!

রক্ষে করো চন্দনদা, আমি আর খেতে পারব না। একটাই যথেষ্ট।

তোকে দুটো সন্দেশ খেতে বলিনি ইডিয়েট। বললাম না, দু’রকম। একটা হচ্ছে এই সন্দেশ মানে মিষ্টি। আর একটা সন্দেশ হচ্ছে খবর। খুবই সুখবর! তুই একটা চাকরি পেয়েছিস!

অ্যাঁ?

কথাটা কানে গেল না তোর? তুই একটা চাকরি পেয়েছিস! চাকরি, চাকরি!

চাকরি?

অমন ভেটকি মাছের মতো তাকিয়ে রইলি কেন? অন্য যে-কোনও ছেলে এই খবর শুনে লাফিয়ে উঠত!

আমার এমন ক্ষতি করতে কে বলল তোমাকে চন্দনদা?

ক্ষতি? প্রিপস্টারাস! এমন অদ্ভুত কথা জীবনে শুনিনি! দেশে লক্ষ লক্ষ বেকার, কেউ কোনও চান্স পায় না, আর তোকে একটা প্লেটে করে সাজিয়ে…।

আমি তো বেকার নই। আমি কি অ্যাপ্লিকেশন করেছি কোথাও? যে চাকরি চায় অথচ পায় না, সে তো বেকার। আর যে চাকরি খোঁজেই না, চাকরির যার দরকার নেই, তাকে কি বেকার বলা যায়?

তুই বেকার নোস?

ডিকশিনারি দেখো।

আমার সঙ্গে চ্যাংড়ামি হচ্ছে নীলু! ওঠ, জামা পর!

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। যারা ভাল ভাল চাকরি করে, কিংবা ব্যবসায় সার্থক, যারা কর্মবীর, তাদের কিছুতেই বোঝানো যায় না আমার যুক্তিটা। সবাইকেই কি চাকরি করতে হবে, কোনও না-কোনও কাজের জোয়াল ঘাড়ে নিতে হবে? তাহলে কদমতলায় বসে বাঁশি বাজাবে কে? কে ছবি আঁকবে? যাত্রাদলে নতুন ছেলে আসবে কী করে? এসবও যারা পারে না, স্রেফ বাউণ্ডুলেপনা করার জন্যও তো কিছু মানুষ দরকার। যে-জাতের মধ্যে বাউণ্ডুলে কিংবা ভবঘুরে নেই, সেজাতের কখনও উন্নতি হতে পারে?

আমি হাত জোড় করে বললাম, আমাকে ছেড়ে দাও চন্দনদা। আমার এমন সর্বনাশ কোরো না।

চন্দনদা চোখ কপালে তুলে বলল, সর্বনাশ? দু’হাজার সাতশো টাকা মাইনে পাবি।

চুপ, চুপ, আস্তে। অত টাকার কথা মা শুনতে পেলে কান্নাকাটি করবে।

মাসিমাকে কষ্ট দিচ্ছিস। দাদার ঘাড়ে বসে খাচ্ছিস। তোর লজ্জা করেনা? সবাই বলে, চেনাশুনো সকলেরই মোটামুটি হিল্লে হয়ে গেল, শুধু নীলুটাই গাছদামড়া হয়ে রইল। লাফাংগার মতো ঘুরে বেড়ায়, হ্যাংলার মতো লোকের বাড়িতে ঠিক খাওয়ার সময় গিয়ে হাজির হয়।

বাজে কথা। নেমন্তন্ন না করলে আমি কারুর বাড়িতে যাই না। এমনকী নেমন্তন্ন করলেও সব বাড়িতে যাই না।

তুই এক দিন ভরপেট খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েও লালুদার সঙ্গে টলি ক্লাবে গিয়ে গোগ্রাসে গিলিসনি?

সেটা অন্য কথা। লালুদা আমাকে জোর করে খাইয়েছে। লালুদা আমাকে দিয়ে একটা কাজ করাতে চাইছিল।

লালুদাই বলেছে, দরকার হলে তোকে ঘাড় ধরে চাকরির জায়গা নিতে হবে।

আমাকে ইন্টারভিউ দিতে হবে না?

তা নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না।

আমি এবার মুচকি হাসলাম। চন্দনদা গোঁয়ার লোক, কাকুতি-মিনতি করে ছাড়া পাওয়া যাবেনা। ইন্টারভিউতে ফেল করা অতি সহজ। এমনকী যদি অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পেয়ে যাই …এর আগেও কেউ কেউ আমাকে দু’এক জায়গায় জোর করে কাজে ঢুকিয়েছে, সিঙ্গাপুর থেকে আমার এক মামা এসে তো উঠে পড়ে লেগেছিল। সবকটা চাকরি থেকেই আমি অবিলম্বে সগৌরবে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছি। চাকরির মালিকদের আমাকে ধন্যবাদ জানানো উচিত, আমিই একমাত্র, যে বরখাস্ত হলেও আন্দোলন করে না। নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরে আসে।

না-ধরানো চুরুটটা দু’বার টেনে চন্দনদা গলা নরম করে বলল, আচ্ছা নীলু, তুই কেন কাজ করতে চাস না বল তো? তোর ইচ্ছে করে না, নিজে রোজগার করবি, নিজের পায়ে দাঁড়াবি, লোকজনের মধ্যে মাথা উঁচু করে থাকবি?

মাথা উঁচু করেই তো আছি। তুমিই বলল, কার মাথা বেশি উঁচু, যে দান করে, না যে দান প্রত্যাখ্যান করে? এ-দেশে কত ভাল ভাল ছেলে মেয়ে রয়েছে পড়াশুনা শেষ করেও কোনও সুযোগ পায় না, তোমাদের মতো লোকেরা ভাবো, আহা বেচারারা…যুবশক্তির অপচয়…তাদের মধ্যে মাত্র কয়েক জনকে ডেকে, তোমরা ছিটেফোঁটা দায় বিলোও! যে-কোনও একটা চাকরি দিয়েই ভাবো তাদের ধন্য করে দিলে! আমি সেই সব ছেলে-মেয়ের পক্ষ থেকে এক জ্বলন্ত প্রতিবাদ। আমি দয়া চাই না। আমি দয়া চাই না। সারা জীবন আমি এই ধ্বজা উড়িয়ে যাব।

তোমাকে সে-সুযোগ দেওয়া হবে না শয়তান। শুধু বাজে কথার ফুলঝুরি। আমরা সবাই খেটে খেটে মরব, আর তুই শুধু মজা করবি! ইয়ার্কি! কালকেই তোকে ছোটপাহাড়িতে যেতে হবে!

ছোটপাহাড়িতে কেন?

সেখানেই তো তোর কাজের ব্যবস্থা হয়েছে।

সঙ্গে সঙ্গে সব কিছু বদলে গেল। অন্ধকার বাড়িতে পটাপট আলো জ্বলে ওঠার মতো খুশির ধাক্কা লাগল আমার সবকটা ইন্দ্রিয়তে। ছোটপাহাড়ি! সে যে অপূর্ব সুন্দর একস্থান। সব দিকে গোল হয়ে ঘিরে আছে সবুজ মখমলে ঢাকা পাহাড়। মাঝখানটাতেও এত গাছপালা যে, তার ফাঁকে ফাঁকে কিছু বাড়ি-ঘর থাকলেও চোখে পড়ে না। মনে হয় এক সবুজের রাজ্য। দিনে দুবার বাস যায়, তাছাড়া তেল-কালি-ধোঁয়ার কোনও উপদ্রব নেই। ছোটপাহাড়িতে একটা সরু পায়ে-চলা রাস্তার ধারে আমি যত বনতুলসীর ঝাড় দেখেছি, সে-রকম বুঝি পৃথিবীর আর কোথাও নেই। বিনা যত্নে, বিনা প্রয়োজনে এত অসংখ্য ফুল ফুটে আছে, এক-একটা ছোট ছোট ফুলের কত রকম রঙ! সেই সব ফুলের একটা স্নিগ্ধ টান আছে। ওই বনতুলসীর ঝাড়ের কাছে আবার যাবার জন্য আমি যে-কোনও মূল্য দিতে রাজি আছি।

ছোটপাহাড়িতে কী কাজ চন্দনদা?

সেইসব পরে বুঝিয়ে দেব। মোট কথা, তোকে যেতেই হবে।

যেতেই হবে, কী বলছ? ছোটপাহাড়িতে নিয়ে গিয়ে যদি তুমি আমাকে তোমার কোয়ার্টার ঝাঁট দিতে বলো, তোমার জন্য রান্না করে দিতে বলো, তোমার জুতো পালিশ করে দিতে বলো, সব রাজি আছি।

চন্দনদা এবার হকচকিয়ে গেল, আমার আকস্মিক মতি পরিবর্তনের কারণটা ধরতে পারল না। বুঝবে কী করে, চন্দনদা সেই বনতুলসীর জঙ্গলের দিকে বোধহয় কোনওদিন চেয়েও দেখেনি।

আমি তড়াক করে বিছানা থেকে নেমে বললাম, তুমি চা খাবে? এক্ষুনি চা আনছি। আরকী খাবে বলো, গরম গরম কচুরি? ডাবল ডিমের ওমলেট?

চন্দনদা বলল, এখন কিছু খাবনা। বৃষ্টি অনেকটা কমেছে, চল তোকে বেরোতে হবে।

তাড়াতাড়ি পাঞ্জাবি চাপিয়ে, টেবিলের ড্রয়ার থেকে আমার সঞ্চয় সাত টাকা আশি পয়সা পকেটে নিয়ে নেমে এলাম রাস্তায়। চন্দনদা কোম্পানির গাড়িতে এসেছে। চন্দনদাদের হেড অফিস কলকাতায়, মাঝে মাঝে চন্দনদাকে ছোটপাহাড়িতে গিয়েও থাকতে হয়।

খাঁকি পোশাকও মাথায় টুপি পরা ড্রাইভার তাড়াতাড়ি চন্দনদাকে দেখে নেমে এসে গাড়ির দরজা খুলে দিল। আমি যখন চাকরি করব, তখন কি আমাকেও… দু’হাজার সাতশো টাকার মাইনেতে কি গাড়ি দেয়?

চন্দনদার বাড়ির সামনে একটা লাল রঙের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। অর্থাৎ লালুদা এসেছে, নীপা বউদির বয়ফ্রেন্ড। আজকাল চন্দনদাও লালুদাকে সহ্য করে নিয়েছে। লালুদার অবাধ যাওয়া-আসা আটকাবার কোনও উপায় নেই!

লালুদা ছাড়াও রয়েছে তপনদা। তপনদা কলকাতার বাড়িওয়ালাদের ঝামেলা সহ্য করতে না পেরে পাকাপাকি বম্বে চলে গিয়েছিল, কোনও কাজে আবার এসেছে বোধহয়। তিন জনে ভিসিআর এ একটা ছবি দেখছিল নিবিষ্ট ভাবে, চন্দনদা ঘরে ঢুকেই বলল, এখন ও-সব বন্ধ করো।

লালুদা বলল, আর একটু দেখে নি, মেয়েটার ডেড বডি খুঁজে পাওয়া গেল কি না।

চন্দনদা বলল, এই জন্যই আমি বসবার ঘরে টিভি রাখা পছন্দ করি না। ইচ্ছে মত কথা বলার উপায় নেই।

নীপা বউদি ভিসিআর অফ করে দিয়ে হাসিমুখে বলল, তুমি সিনেমা দেখতে ভালবাসোনা বলে কি আর কেউ দেখতে পারবে না?

রান্না ঘরে টিভি লাগাও, ভিসিআর লাগাও, যত ইচ্ছে দেখো।

দেয়ালে গোপাল ঘোষের আঁকা একটা প্রকৃতি-দৃশ্যের ছবি। চন্দনদা ছবি ভালবাসে, প্রায়ই এ বাড়ির দেয়ালের ছবি বদলে যায়। ছবিটার কাছে গিয়ে চন্দনদা বলল, এ, ছবিটা বেঁকে রয়েছে। সেটুকুও তোমরা লক্ষ্য করো না?

নীপাবউদি বলল, জানলার পাশে কেউ ছবি রাখে? এ-দিকের দেয়ালটা আবার তোমার পছন্দ নয়।

নীপাবউদি আর চন্দনদার ঝগড়া বিখ্যাত। যে-কোনও ছুতোয় একবার শুরু হলে কখন যে থামবে তার ঠিক নেই। ওরা অবশ্য বলে, এটা ঝগড়া নয়, মতভেদ, তর্ক-বিতর্ক। কিন্তু সেই তর্ক-বিতর্কে আমাদের কান ঝালাপালা হয়ে যায়।

তপনদা আমার দিকে ভুরু নাচিয়ে বলল, কী রে নীলু, ধরা পড়ে গেলি শেষ পর্যন্ত।

এবাড়িতে মুমু আমার একমাত্র বন্ধু। তার সাড়াশব্দ নেই। আমি নীপাবউদিকে জিজ্ঞেস করলাম, মুমু কোথায়?

নীপাবউদি বলল, সাঁতারের ক্লাসে গেছে। আজকাল খুব সাঁতারের ঝোঁক হয়েছে।

আমি চমৎকৃত হলাম। গানের ক্লাস, নাচের ক্লাস, ছবি আঁকার ক্লাস এ-সব শুনেছি। সাঁতারেরও ক্লাস? তা-ও এ-রকম বৃষ্টির দিনে। কোনও ঘরের মধ্যে হয় বোধহয়।

লালুদা আমার দিকে তাকিয়ে কান-এঁটো-করা হাসি দিয়ে বলল, আমরা সবাই তোমার জন্য খুব চিন্তিত ছিলাম নীলাদ্রি। আমাদের চেনাশুনো সকলেই কোনও না-কোনও কাজ করে, শুধু তুমিই বেকার বসেছিলে। চন্দন তোমার জন্য একটা কাজ জোগাড় করে এনেছে, এটা খুবই আনন্দের কথা। কিন্তু–।

লালুদা একটু থামতেই চন্দনদা ধমক দিয়ে বলল, এর মধ্যে আবার কিন্তু কী আছে?

লালুদা আমার দিকে আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে বলল, নীলকান্তর এত বড় বড় চুল মাথায়, এইভাবে কি চাকরিতে জয়েন করা চলে?

নীপাবউদি বলল, সত্যি, তুমি ক’মাস চুল কাটোনি!

লালুদা বলল, আহা বেকার ছেলে, পয়সা পাবে কোথায়? আমি সেলুনে নিয়ে গিয়ে ওর চুল কাটিয়ে আনছি!

চন্দনদা বলল, কোনও দরকার নেই। বড় চুল আছে তো কী হয়েছে।

লালুদা বলল, বড় চুল থাকলে ক্ষতি নেই বলছ? থাক তবে। কিন্তু –।

আবার কিন্তু?

আমি যত দিন দেখছি, নীলমণি শুধু পাজামা আর পাঞ্জাবি পরে থাকে। ওর কি প্যান্ট শার্ট আছে?

তপনদা মুচকি হেসে বলল, ভারতীয় সংবিধানে কোথাও লেখা আছে কি যে, পাজামা-পাঞ্জাবি পরে চাকরি করা যাবে না?

লালুদা বলল, সব কিছুর একটা ডেকোরাম আছে তো! বাড়িতে পাজামা পরা যায়, বেকার অবস্থায় বাইরে ঘোরাঘুরিও করলে ক্ষতি নেই, রাস্তায় ঘাটে পাঞ্জাবি-পাজামা পরা ছেলে-ছোকরা দেখলেই বুঝতে পারি বেকার। কিন্তু চাকরির জায়গায় ফিটফাট হয়ে না গেলে লোকে মানবে কেন?

চন্দনদা বলল, হ্যাঁ, প্যান্ট-শার্ট হলে ভাল হয়। কী রে, তোর প্যান্ট-শার্ট নেই?

লালুদা তাড়াতাড়ি বলল, আমি কিনে দেব। এক জোড়া করে প্যান্ট-শার্ট, শু-মোজা-টাই…এখনও নিউ মার্কেট খোলা আছে, চলো নীলরতন।

আমাকে নিয়ে একটা গিনিপিগের মতো যেন কাটাছেঁড়া চলছে। এবার মুখ খুলতেই হল। ভুরু তুলে বললাম, টাই-ও পরতে হবে? দু’ হাজার সাতশো টাকা মাইনে তো আজকাল ব্যাঙ্কের বেয়ারা দারোয়ানরাও পায়। তাই না নীপাবউদি? তারা কি টাই পরে?

চন্দনদা বলল, ওরে বাবা! এই যে সবাই বলে নীলু নাকি চাকরি করাটাই পছন্দ করে না। এখন দেখছি মাইনে নিয়ে দরাদরি শুরু করেছে।

আমি বললাম, দরাদরি না। ওই যে লালুদা বলল, ডেকোরামের কথা! সবঅফিসেই দেখেছি বড় সাহেব, মেজো সাহেবরা টাই পরে। যদি খুদে কেরানি আর বেয়ারারাও টাই পরতে শুরু করে, তাহলে ওই সব সাহেবরা চটে যাবেনা?

চন্দনদা বলল, টাই দরকার নেই। প্যান্ট শার্ট হলেই চলবে।

লালুদা বলল, তাহলে চলো নীলকণ্ঠ, ওগুলো কিনে ফেলা যাক।

আমি বললাম, প্যান্ট-শার্ট আমার আছে।

জুতো-মোজা?

চটি আছে।

না না, ট্রাউজার্সের সঙ্গে চটি একেবারেই চলবে না। শু, ভাল শু।

সমস্ত পৃথিবীটা আপনার টলি ক্লাব নয় লালুদা, যে প্যান্টের সঙ্গে শু পরতেই হবে। তাছাড়া আপনি আমার নামটাই মনে রাখতে পারেন না, আপনি আমার জামা-কাপড় কিনে দেবেন কোন অধিকারে?

তোমার নাম মনে রাখতে পারি না? তোমার ওই যে কী বলে, কী বলে, নীলধ্বজ নয়।

নীপাবউদি বলল, ওর নাম নীললোহিত! শুধু নীলু বলেই তো ডাকতে পারেন।

লালুদা বলল, বড্ড খটোমটো নাম। নীললোহিত! এ নামের মানে কী?

আমি জিজ্ঞেস করলাম, লালু মানে কী?

এইসময় দরজা ঠেলে একটা ঝড়ের মতো ঢুকল মুমু। একহাতে দোলাচ্ছে একটা এয়ারলাইনসের ব্যাগ, অন্য হাতে আইসক্রিমের কোন। মাত্র কয়েক মাস দেখিনি, তার মধ্যে যেন অনেকটা বড় হয়ে গেছে মুমু। ওর যে মাত্র তেরো বছর বয়েস, তা মনেই হয় না। একটা আগুনরঙের ফ্রক পরা, মাথার চুল ভিজে হিলবিলে হয়ে আছে।

অন্য কারুর দিকে নজর না দিয়ে সোজা চলে এল আমার কাছে। চোখ পাকিয়ে বলল, অ্যাই ব্লু, অ্যাতো দিন আসোনি কেন? কোথায় ডুব মেরেছিলে?

আমি বললাম, জনতার মধ্যে নির্বাসনে।

মুমু বলল, তার মানে?

আমি বললাম, স্কুলে বাংলার মিসকে জিজ্ঞেস করে মানেটা জেনে নিও।

মুমু খপ করে আমার কান ধরে মুলে দিয়ে বলল, ইয়ার্কি হচ্ছে! পাজি। আনরিলায়েবল লায়ার।

নীপাবউদি হা-হা করে বলে উঠল, কী হচ্ছে মুমু! নীলু তোর চেয়ে কত বড়, তোর কাকা হয়, তার কান ধরছিস যে!

মুমু বলল, তুমি জানো না মা, আমাকে এ লিটুল প্রিন্স-এর গল্পটা অর্ধেক বলে তারপর বলল, তোকে বইটা দিয়ে যাব, নিজে পড়িস, কালকেই দিয়ে যাব। তারপর থেকে হাওয়া! আর এদিকে আসার নাম নেই। মিথ্যুক একটা!

লালুদা বলল, আহা, বেকার ছেলে, বই কেনার পয়সা কোথায় পাবে! কী বই, নামটা লিখে দিস, আমি এনে দেব।

চন্দনদা মুমুকে কাছে টেনে নিয়ে বলল, জানিস মুমু, তোর নীলুকাকা এবার খুব জব্দ হবে। ওকে চাকরি দেওয়া হয়েছে। প্রথম চাকরি পাওয়ার কথাটা শুনে এমন ভাব করল, যেন ওকে হাতে-পায়ে শেকল বেঁধে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কোথাও।

আমি মুমুর দিকে ভুরুর ইঙ্গিত করে বললাম, মুমু, আমি ছোটপাহাড়ি যাচ্ছি। সেই ছোটপাহাড়ি, তোর মনে আছে?

মুমু খিল খিল করে হেসে উঠল।

আজ তপনদা বিশেষ কোনও কথা বলেনি। মুড নেই। অন্য সময় তপনদা কথা শুরু করলে অন্য কেউ পাত্তা পায় না। আজ মৃদু মৃদু হেসে সব শুনে যাচ্ছে। এবার উঠে দাঁড়িয়ে আমার মাথায় দুটো চাটি মেরে গেয়ে উঠল, জয়যাত্রায় যাও গো…এক মাসের বেশি টিকে থেকো গো।

.

০২.

উন্নতি শব্দটার অনেকরকম মানে হতে পারে। একজন স্কুল মাস্টারকে যদি থানার দারোগা করে দেওয়া হয় কিংবা এক জন সন্ন্যাসীকে ধরে এনে যদি বসিয়ে দেওয়া হয় রাইটার্স বিল্ডিংসের কোনও বড়বাবুর চেয়ারে, কিংবা একটা ফুলের বাগানে যদি তৈরি হয় দশতলা বাড়ি, এসবও উন্নতি নিশ্চয়ই আবার ঠোঁট বেঁকাতেও হয়। একটা নিরিবিলি জংলা মতো জায়গা, দু’চারখানা মাত্র বাড়ি আর সরু পায়ে চলা পথ ছাড়া আর কিছুই নেই, আছে শুধু শান্তি ও সৌন্দর্য। সেই জায়গাটায় যদি শুরু হয়ে যায় এক কর্মকাণ্ড, জঙ্গল সাফ করে তৈরি হয় কারখানা, হাসপাতাল, হোটেল, অফিসবাড়ি, তাহলে সেটাও খুব উন্নতির ব্যাপার, কত লোক চাকরি পাবে, কত মানুষের আশ্রয় জুটবে। খুবই আনন্দের কথা। তবু আগেকার জন্য দীর্ঘশ্বাসও থেকে যায়।

ছোটপাহাড়ি এখন বড় হতে চলেছে। কাছাকাছি এক জায়গায় পাওয়া গেছে লৌহ ধাতুপিণ্ড, তাই ছুটে আসছে ইস্পাত-বিশেষজ্ঞরা। এখানে এখন শহর হবে। বোধহয় এখন যেটা টাটানগর, সেটাও এক সময় ছোটপাহাড়ির মতোই ছিল। চন্দনদাদের কোম্পানিই এখানে অনেকগুলো ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট শুরু করে দিয়েছে, দারুণ উদ্যমে দ্রুত তৈরি হচ্ছে বড় বড় বাড়িঘর। সেই রকমই একটা নির্মীয়মাণ কারখানায় মিস্তিরি-মজুরদের কাজের ওপর নজরদাবির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আমাকে। অর্থাৎকুলির সর্দার। কাজটা আমার বেশ পছন্দের।

ছোটপাহাড়ি জায়গাটা বাংলা আর বিহারের সীমানায়। একটা ছোট্ট নদীর এ-পার আর ও-পার। এখানকার লোকরা হিন্দি-বাংলা দুটোই জানে। হিন্দি বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গিয়ে নিখুঁত বাংলা বলে। সাঁওতালরাও নিজেদের মধ্যে কথা বলে নিজেদের ভাষায়, আবার বাংলা যখন বলে, তাতেও যথেষ্ট সাবলীল। সুতরাং এখানে ভাষার ব্যাপারে আমার কোনও অসুবিধে নেই।

পাহাড়গুলোর পায়ের কাছে যে বিস্তীর্ণ বনতুলসীর ঝোপ, সে-দিকে এখনও হাত পড়েনি নগর নির্মাতাদের। আমি প্রতি দিন একবার সেখানে গিয়ে কিছুক্ষণ ঘুরি, বুক ভরে ঘ্রাণ নিই, চোখ ভরে ছবিটা রেখে দিই। ঠিক করে রেখেছি, বনতুলসীর ঝাড় কাটার কথা উঠলেই আমি এখান থেকে সরে পড়ব। ওদের প্রতি আমি অকৃতজ্ঞ হতে পারব না।

প্রথম দিন এসেই চন্দনদা বলেছিল, তুই আমার কোয়ার্টারে থাকতে পারিস নীলু, আবার নিজস্ব থাকার জায়গাও পেতে পারিস। আমার কোয়ার্টার যথেষ্ট বড়, তুই থাকলে কোনও অসুবিধে নেই, তবে স্বাবলম্বী হতে চাস যদি তাহলে আলাদা ব্যবস্থাও হতে পারে। তুই তো আবার দয়া-টয়া চাস না। প্রথম কয়েকটা দিন আমার এখানে খেয়ে নিবি, তারপর নিজেই রান্না-বান্নার ব্যবস্থা করবি।

বলাই বাহুল্য, সর্বক্ষণ চন্দনদার অভিভাবকত্বের তলায় থাকার চেয়ে আমার আলাদা থাকাই পছন্দ। আমার জন্য কোনও কোয়ার্টার এখনও তৈরি হয়নি, তবে বড় যে-গেস্ট হাউসটি আছে, তার একটি ঘর বরাদ্দ হল। এই গেস্ট হাউসটি যখন সবে মাত্র তৈরি হচ্ছিল, এক তলার একখানা বড় ঘর ছিল বাসযোগ্য, তখন আমি মুমুকে নিয়ে এসেছিলাম এখানে। রাত্তিরবেলা ঘরের মধ্যে সাপ ঢুকে পড়েছিল, সে কী কাণ্ড! সে-দিন দারুণ ভয় পেয়েছিলাম, আজ ভাবতে মজা লাগে।

তখন হরিলাল নামে যে চৌকিদারটি ছিল, সে এখনও আছে। আগের মতোই সে সন্ধের পর মহুয়ার নেশা করে বোম হয়ে থাকে, অতি সরল ও নির্মল মানুষ। আমাকে দেখেই যে সে চিনতে পারল, তাতে আমি একেবারে অভিভূত। আমার মতো একজন সামান্য মানুষকে সে দু’বছর আগে মাত্র একদিন থেকেই মনে রেখেছে।

আমার ঘরটা দোতলার এক কোণে। এই বাড়িটার খুব কাছেই একটা পাহাড়, মনে হয় যেন হাত বাড়ালেই ছোঁওয়া যাবে। মাঝখানে অবশ্য একটা জঙ্গলও আছে। রাত্তিরে সেখানে শেয়াল ডাকে। শিগগিরই এই জঙ্গলটা কাটা হবে, তখন শেয়ালগুলো যাবে কোথায়?

এখানে খাবার ব্যবস্থা হয়নি এখনও। দু’তলায় রয়েছে দুটো রান্নাঘর, ব্যবহার করতে পারে অতিথিরা, কিংবা বাইরে হোটেলেও খেয়ে আসতে পারে। অতিথি প্রায় থাকেইনা। সারা বাড়িটাই আমার এখন একার বলা যায়। সকালবেলায় চা, ডিম-টোষ্ট কিংবা পুরি-ভুজি হরিলালই বানিয়ে দেয় আমার জন্য। চন্দনদা এক হাজার টাকা অ্যাডভান্সের ব্যবস্থা করে দিয়েছে, এখন আমি ইচ্ছেকরলে প্রত্যেক দিন ডাবল ডিমের ওমলেট খেতে পারি। এখন আমি বড়লোক, সবসময় পকেটে খচমচ করে টাকা। এত টাকা নিয়ে মানুষ কী করে? ছোটপাহাড়িতে টাকা খরচ করার কোনও রাস্তাই নেই। না আছে সিনেমা থিয়েটার, না আছে ভাল রেস্তোরাঁ কিংবা ডিস্কো নাচের ব্যবস্থা।

আমাদের জন্য কিছু নেই, কিন্তু মজুর কামিনদের জন্য অনেক কিছুই আছে। মহুয়ার দোকান, চুল্লুর ঠেক, জুয়ার আড্ডা। ওদের পয়সা খলখলিয়ে চলে যায়। রাত্তিরবেলা ওরা নাচে, গায়, ফুর্তি করে, আর সন্ধের পর থেকে আমাদের কিছুই করার থাকে না। সময় কাটাবার জন্যই আমি রাত্তিরে নিজে রান্না শুরু করেছি, দিনেরবেলা হোটেলে খেয়ে নিই।

সকাল ন’টা থেকে ছ’টা পর্যন্ত আমার আপিস। একটা সুবিধে এই যে, গেস্টহাউসে দুটো বারোয়ারি সাইকেল আছে। এখানে তো আর ট্যাক্সি-বাস-রিক্সা পাওয়া যাবেনা, অফিসারদের নিজস্ব গাড়ি বা জিপ আছে, আমার মতো ক্লাস থ্রি স্টাফদের সাইকেলই সম্বল। আমার কাজের জায়গাটা প্রায় দেড় মাইল দূরে, তৈরি হচ্ছে একটা লম্বাটে দোতলা বাড়ি, সেটা হবে লেবরেটারি। গাঁথনি ও ছাদ ঢালাই হয়ে গেছে, এখন চলছে ভেতরের কাজ। এই সময়েই নাকি মিস্তিরি মজুরেরা কাজে ঢিলে দেয়, খুচখাচ করে সারা দিনে কী যে করে বোঝা যায় না।

সাইকেল চালিয়ে ঠিক নটার সময় আমি সেখানে হাজির হই। কাজটা খুব সোজা। প্রথমে একটা লম্বা খাতা দেখে মিস্তিরি-জোগাড়ে কামিনদের নাম হাঁকি। ব্যাস, তারপর আর করার কিছু নেই, শুধু কয়েক বার এক তলা দোতলায় চক্কর মারা ছাড়া। চন্দনদার স্পষ্ট নির্দেশ আছে, কুলি-মজুরদের কোনওক্রমেই বকাবকি করা চলবে না। বকলে ওদের মেজাজ খারাপ হয়ে যাবে, তখন নানা উপায়ে তারা ফাঁকি মারার ফিকির খুঁজবে। বরং তাদের সঙ্গে গল্পগুজব করলে তাদের মন ভাল থাকে, কাজে বেশি উৎসাহ পায়। ঠিক সাড়ে বারোটায় বাজিয়ে দিতে হবে ঘণ্টা, এরপর থেকে দু’ঘণ্টা টিফিনের ছুটি।

এই দু’ঘণ্টা ছুটির ব্যাপারটায় মিস্তিরি-মজুরেরা নিজেরাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। পুরো দিনের মজুরি পেয়েও দু’ঘণ্টা ছুটি। এ-রকম তারা আগে কখন দেখেনি। কিন্তু চন্দদার থিয়োরি হচ্ছে, অফিসের কেরানিবাবুরা যদি টিফিনের নামে দু’ঘণ্টা ঘুরে বেড়াতে পারে, তাহলে মিস্তিরি-মজুররা, যারা শারীরিক পরিশ্রম করে, তাদের টিফিনের ছুটির প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। একটানা ঘন্টার পর ঘণ্টা কাজ করলে কাজের গুণ নষ্ট হয়ে যায়। দু’ঘণ্টা টিফিনের মধ্যে আধ ঘণ্টা ওরা খাবার-দাবার খেয়ে নেবে, বাকি দেড় ঘণ্টা ঘুমোবে কিংবা গড়াবে। তারপর আবার ছ’টা পর্যন্ত কাজ।

এখন কাজ করছে সেই আঠারো জন নারী-পুরুষ। এরা আমাকে ছোটবাবু বলে ডাকতে শুরু করেছে। আমি ছোটপাহাড়ির ছোটবাবু। একমাত্র হেড মিস্তিরি ইরফান আলি গম্ভীর ধরনের মানুষ, যে আমাকে বাবু বলে না। তার হাতে একটা দামি ঘড়ি। আমি ঘড়িই পরিনা, সেই জন্য সে নিজেকে আমার তুলনায় উচ্চশ্রেণির মানুষ মনে করে।

ছুটির পর আমি সাইকেল চালিয়ে পাহাড়ের দিকে চলে যাই। এক-এক দিন ভোরবেলাতেও চলে আসি। ছোট্ট নদীটা পাথরে পাথরে ধাক্কা খেয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে, ছলোচ্ছল শব্দ করে। আমি জলে পা ডুবিয়ে বসি। এই সময় নিজেকে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাতি বলে মনে হয়। জলের ওপর ঝুঁকে পড়া গাছপালা আর নদীর সঙ্গে অনায়াসে কথা বলতে পারি।

আমার চাকরির এই সময়টাই সব চেয়ে উপভোগ্য। দূরগ্রামের আদিবাসীরা এ-দিক দিয়ে যাবার সময় এক ঝলক তাকায়, আমার প্রতি তারা কোনও কৌতূহল প্রকাশ করে না।

এখান থেকে কলকাতায় যেতে খানিকটা বাসে আর বাকিটা ট্রেনে, সাড়ে ছ’ঘণ্টার বেশি লাগে । তবু মনে হয় যেন কলকাতা কয়েক লক্ষ মাইল দূরে। এখানে এখনও যান্ত্রিক শব্দের তেমন উৎপাত নেই, আর সন্ধের পর যে-নিস্তব্ধতা তা যেন সভ্যতার আগেকার কালের।

আমি কলকাতাকে খুবই ভালবাসি, কিন্তু একটানা বেশি দিন থাকতে পারি না। মাঝে মাঝে বিচ্ছেদ না হলে প্রেম জমে না।

কলকাতায় থাকার সময় পাহাড়-নদী-জঙ্গলের জন্য মনটা হু-হু করে। আবার অনেকদিন কোনও নিরালা-নিরিবিলি জায়গায় কাটাবার পর আবার কলকাতা মন টানে। এক সঙ্গে দুটি মেয়ের সঙ্গে প্রেম করা খুব বিপজ্জনক, কিন্তু প্রকৃতি ও নগরী, এই দুজনের সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে প্রেম চালিয়ে যাওয়া সত্যিকারের আনন্দের।

রাত্তিরবেলা দূর থেকে শোনা যায় মাদলের ধ্বনি। কোনও আদিবাসী গ্রামে উৎসব চলে। আমাদের কামিন-মজুররা সবাই স্থানীয়, অনেকে প্রত্যেক দিন নিজেদের গ্রামে ফিরে যায়, আবার অনেকে এখানেই ঝুপড়ি বানিয়েছে, সেখানেও তারা নাচ-গান করে প্রায়ই।

একদিন রাত আটটার সময় চন্দনদার বাংলোর পাশ দিয়ে ফিরছি, দেখলাম অনেক আলো জ্বলছে, কয়েকজন লোকের গলার আওয়াজ, বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে তিন-চারটে গাড়ি পার্টি চলছে, আমার নেমন্তন্ন হয়নি।

চন্দনদা প্রথম দিনই আমাকে আলাদা থাকার ইঙ্গিত কেন দিয়েছিলেন, তা এর মধ্যেই বুঝে গেছি। আমার স্বাধীনতার জন্য নয়, নিজের পদমর্যাদার কারণে। চন্দনদা ক্লাস ওয়ান অফিসার, এখানকার বড় সাহেব, তার বাড়িতে আমার মতো এক জন ক্লাস থ্রি স্টাফের থাকাটা মানায় না। চন্দনদার বাড়িতে তার কাছাকাছি তুল্য অফিসার এবং বড় বড় কন্ট্রাকটররা প্রায়ই আসবে, সেখানে আমার মতো এক জনকে ঘুর ঘুর করতে দেখলে তারা অবাক হবে, চন্দনদাও আমার পরিচয় দিতে লজ্জা পাবে। চাকরি না করে আমি যদি বেকার হতাম, তাহলে কোনও অসুবিধে ছিল না, চন্দনদা অনায়াসে বলতে পারত, এ আমার এক জন ভাই, ক’দিনের জন্য বেড়াতে এসেছে। কিন্তু ক্লাস থ্রি স্টাফ কখনও ক্লাস ওয়ান অফিসারের ভাই হতে পারে না।

আমার ঠিক ওপরের বস চন্দনদা নয়, মহিম সরকার। তিনি কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ার। আরও দুটো বড় বড় বাড়ি তৈরি হচ্ছে, মহিমবাবু সেখানেই ব্যস্ত থাকেন, আমার জায়গাটায় বিশেষ আসেন না। হঠাৎ কখনও একটা চক্কর দিয়ে যান। আমাকে তিনি এ বাড়িটার একটা নীল নক্সা গছিয়ে দিয়েছেন, লিনটেন, প্যারাপেট, প্লামবিং, ফ্লোর পালিশ এই সব বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন, তা আমার মাথায় ঢকেনি। বোঝার দরকারটাই-বা কী, ও-সব তো মহিমবাবুর কাজ। আমার ওপর দায়িত্ব মজুররা কাজের সময় ফাঁকি মারছে কি না সেটা দেখা, কী কাজ করবে তা ওরাই জানে।

চন্দনদা আমাকে নেমন্তন্ন করেনা বটে, কিন্তু নিজে এক-একদিন সন্ধেবেলা আমার গেস্ট হাউসে এসে হাজির হয়। রান্নাঘরে উঁকি মেরে জিজ্ঞেস করে, কী করছিস রে, নীলু?

আমার মুখে চন্দনের ফোঁটার মতো ঘাম, গেঞ্জিটাও ভিজে গেছে। পাকা রাঁধুনির মতো গরম কড়াইতে তেল ঢেলে বললাম এই তো ডিমের ঝোল রাঁধছি। এরপর ভাত চড়াব।

চন্দনদা বলল, ডিমের ঝোল, বাঃ, বেশ ভাল জিনিস। ক’টা ডিম নিয়েছিস?

দুটো। তুমি একটা চেখে দেখবে নাকি?

কাল কী বেঁধেছিলি?

ডিম সেদ্ধ আর ডাল।

পরশু?

ডাল আর ডিমভাজা।

রোজ রোজ ডিম খাচ্ছিস, তোর পেট গরম হয়ে যাবে যে! এখানে মুরগি বেশ শস্তা, একেবারে ফ্রেস দিশি মুরগি, তুই মুরগির ঝোল রাঁধতে জানিস না?

রাঁধতে বেশ ভালই পারি চন্দনদা, কিন্তু একটা গোটা মুরগি রাঁধলে খাবে কে? যত ছোটই হোক, পুরো একটা মুরগি খাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এখানে ফ্রিজও নেই যে রেখে দেব।

বলিস কী, তোর সাতাশ বছর বয়স, একটা আস্ত মুরগি খেতে পারবিনা। আমরা তো ওই বয়েসে দু’তিনটে মুরগি উড়িয়ে দিতে পারতাম।

তোমাদের ছেলেবেলায় নানা রকম অসম্ভব কাজ করতে পারতে, তা জানি। কিন্তু আমার পক্ষে দু-তিন পিসই যথেষ্ট। বাজারে তো কাটা-পোনার মতো কয়েক পিস মুরগির মাংস কিনতে পাওয়া যায় না।

তার মানে, যারা একা থাকে, তারা মুরগির মাংস রান্না করে খেতে পারবে না? যারা বিবাহিত, কাচ্চা-বাচ্চাওয়ালা সংসারী লোক, তারাই শুধু মুরগি খাবে? এ তো ভারি অন্যায়, অবিচার। তাহলে তুই কী করবি, একটা বিয়ে করে ফেলবি নাকি?

বিয়ে করার চেয়ে ডিমের ঝোল খাওয়া অনেক সহজ নয়?

সেটা অবশ্য মন্দ বলিসনি। তাহলে?

চন্দনদা যেন এক গভীর সমস্যা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ল। আমি ডিমের ঝোল রেঁধে বেশি করে ভাত চাপালাম। আমার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পা দোলাতে দোলাতে চন্দনদা ঘুমিয়েই পড়ল এক সময়।

ডাইনিং রুমে দুটো প্লেট সাজিয়ে আমি ডেকে তুললাম চন্দনদাকে।

ঝোল দিয়ে ভাত মেখে এক গেরাস খেয়ে চন্দনদা বলল, তুই তো বেশ ভালই রান্না শিখেছিস নীলু। নীপার চেয়ে অনেক ভাল।

অর্ধেকটা খাবার পর হঠাৎ থেমে গিয়ে, আর্কিমিডিসের আবিষ্কারের ভঙ্গিতে চন্দনদা বলে উঠল, যাঃ, আর একটা উপায়ের কথা আমার এতক্ষণ মনেই পড়েনি। আমিই তো একটা মুরগি নিয়ে এলে পারি। তুই সেটা রান্না করবি। দুজনে মিলে একটা মুরগি শেষ করতে তো অসুবিধে নেই। তুই ওয়ান ফোর্থ, আমি না হয় থ্রি ফোর্থ খাব! তুই দিনের পর দিন মুরগি না খেয়ে থাকবি, তা তো ঠিক নয়।

তোমাকে আনতে হবে না, আমিই তোমাকে এক দিন মুরগি রেঁধে খাওয়াব।

কেন, আমাকে আনতে হবে না কেন? তুই ক’পয়সা মাইনে পাস যে আমাকে খাওয়াবি? প্রথম মাসের মাইনে পেয়েই অর্ধেকটা পাঠিয়ে দিবি মাসিমাকে। হরিলাল, হরিলাল!

ও কী, হরিলালকে ডাকছ কেন।

ওকে দিয়ে মুরগি আনাব।

এখন? আমাদের তো খাওয়া হয়ে গেল।

ধুৎ। মাছ-মাংস না থাকলে কি পুরো খাওয়া হয়? ডিম-টিমগুলো মনে হয় জলখাবার!

রক্ষে করো চন্দনদা। ভাত খাওয়া হয়ে গেছে, এখন আমি মুরগি রান্না করতেও পারব না, খেতেও পারব না। আর এক দিন হবে।

তোরা এত কম খাস বলে তোদর মনের জোরও কম। তাহলে কালই…ও হ্যাঁ, ভাল কথা, আর একটা খবর তোকে দেওয়া হয়নি। মুমু-নীপারা সবাই এখানে বেড়াতে আসতে চাইছে। এখন এত কাজের সময়।

কবে আসবে?

চব্বিশ তারিখ থেকে মুমুর কয়েক দিন ছুটি আছে। ওই লালুটাও বোধহয় আসবে ওদের সঙ্গে।

লালুদা আসবেই।

কেন, আসবেই কেন?

লালুদা এখানে এসে তোমার, আমার, নীপাবউদির নানা রকম উপকার করার সুযোগ ছাড়বেনা। পরোপকার করা যে ওর নেশা।

ও পুরুষদের জন্য কিছু করে না। শুধু মেয়েদের।

আমার জন্য যে জামা-জুতো কিনে দিতে চাইছিল?

নীপা সামনে ছিল বলে। নীপাকে ওর টাকার গরম দেখাতে চাইছিল। যাই হোক, লালুটা যদি এসে পড়ে, ওকে আমার বাংলোতে রাখবনা। এ গেস্ট হাউসে ব্যবস্থা করে দেব। তুই যেন তখন লালুকে রেঁধে খাওয়াতে যাসনি!

সে প্রশ্নই ওঠেনা। নীপাবউদি এলে আমি জোর করে প্রত্যেক দিন তোমার বাড়িতে খেতে যাব। তুমি না ডাকলেও যাব।

এই সময় দূরে দ্রিদিম দ্রিদিম করে মাদল বেজে উঠল।

খাওয়া থামিয়ে চুপ করে গেল চন্দনদা।

একটু বাদে বলল, এই আওয়াজটা শুনলে মনটা কেমন যেন হয়ে যায়। ছোটবেলায় আমরা দুমকায় থাকতাম, সেই সময়কার কথা মনে পড়ে।

আমি বললাম, যত রাত পর্যন্ত শোনা যায়, আমি জেগে থাকি।

চন্দনদা বলল, আমি যা কাজ করি, আমার পক্ষে রাত্তিরবেলা ওদের গান-বাজনার আসরে গিয়ে বসাটা আমার ঠিক মানায় না। তুই তো গেলেই পারিস, সন্ধেবেলা একা একা থাকিস।

এই কথাটা আমারও মনে হয়েছে। এক দিন অন্ধকারে ওই বাজনা লক্ষ্য করে যেতে হবে।

আমার আন্ডারে যে আঠারো জন কাজ করে তাদের মধ্যে রাজমিস্তিরিরা মুসলমান, জলের পাইপ বসাবার কাজ যারা করে তারা ওড়িশার হিন্দু আর জোগাড়েরা সাঁওতাল। এরা একসঙ্গে কাজ করে বটে, কিন্তু টিফিনের সময় আলাদা আলাদা বসে। তিনটে দলের তিন রকম খাবার। ঘুমোয় খানিকটা দূরত্ব রেখে।

এদের কারুর সঙ্গে আমার এখন তেমন ভাব হয়নি। ভাব জমাতে আমার দেরি লাগে। ওদের পাশ দিয়ে মাঝে মাঝে ঘুরে যাই, দুটো একটা কথা বলি, ওরাও দু-একটা উত্তর দেয়। রাজমিস্তিরি ও কলের মিস্তিরিরা এই ছোটপাহাড়িতেই ঝুপড়ি করে আছে, সাঁওতালরা নিজেদের গ্রামে ফিরে যায়। ওদের এক জনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমরা কোন গ্রামে থাকে? সে হাত তুলে দিগন্তের দিকে দেখিয়ে বলেছিল, সিই-ই খানে!

হয়তো ওদেরই গ্রামে মাদল বাজে। এখানে ওরা চুপচাপ কাজ করে যায় সারা দিন, সন্ধের পর গ্রামে যখন নাচ-গান করে, তখন ওদের চেহারা নিশ্চয়ই বদলে যায়।

সাঁওতালদের একটি মেয়ে ভারি অদ্ভুত। মেয়েটিকে আমি কখনও কথা বলতে শুনিনি। একটা শব্দও উচ্চারণ করে না। বোবা? সে সবসময় দূরে দূরে একা থাকে। টিফিনের সময় অন্যরা খাওয়ার পর যখন ঘুমোয়, তখনও সে শোয় না, খানিক দূরে হাঁটুতে থুতনিত ঠেকিয়ে বসে থাকে। খুবই রোগা চেহারা, মুখখানাও সুন্দর নয়। একটা শীর্ণ ভাব আছে বলেই চোখ দুটো জ্বল জ্বল করে। সবসময় এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে দূরের দিকে।

বোবারা কানেও শুনতে পায় না। এই মেয়েটিকে অন্যরা ফুলমণি ফুলমণি বলে ডাকে, এ তখন মুখ ফেরায়। মিস্তিরি কখন ইট আনতে হবে, কখন বালি, তা বলে দিলেও বোঝে। ওই রোগা চেহারা নিয়েও ফুলমণি মাথায় অনেকগুলো ইট নিয়ে উঠে যায় বাঁশের ভারা দিয়ে, সেকাজে ওর গাফিলতি নেই। কিন্তু টিফিনের সময় অন্য তিনটি সাঁওতাল মেয়ে কল কল করে হাসে, এ-ওর গায়ে গড়িয়ে পড়ে, কখনও দু-এক লাইন গানও গেয়ে ওঠে, সে-দিকে ফুলমণি ভ্রূক্ষেপও করে না। সে চেয়ে থাকে অন্য দিকে। অনেক সময় সে মাটিতে আঙুল দিয়ে আঁকিবুকি কাটে।

অনবরত চক্কর দেবার কোনও মানে হয় না, তাই মিস্তিরি-মজুররা যখন কাজ করে তখন আমি একটা চেয়ারে বসে বই পড়ি। আমার উপস্থিতিটাই যথেষ্ট। এদের ফাঁকি দিতেও দেখিনি কখনও। বাইরে ফট ফট করছে রোদ, কিন্তু গরম নেই তেমন। চুন-সুরকির গন্ধও আমার খারাপ লাগে না। চাকরিটা আমি উপভোগ করছি বলা যায়।

একদিন দুপুরবেলা মহিমবাবু এসে হাজির। বিকেলে দু’লরি সিমেন্ট আসবে, আমাকে বস্তাগুলো গুনে রাখতে হবে, এই নির্দেশ দিতে দিতে হঠাৎ থেমে গিয়ে তিনি বললেন, এ কী, আপনি বই পড়ছেন?

যেন বই পড়াটা একটা অত্যাশ্চর্য ব্যাপার! চাকরি করতে এসে দুপুরবেলা চোখের সামনে বই খুলে রাখা মহাপাপ!

মহিমবাবু এক দিন বিকেলে আমাকে চায়ের নেমন্তন্ন করেছিলেন। উনি গত দেড় বছর ধরে পাকাপাকি আছেন ছোটপাহাড়িতে। সস্ত্রীক, বাচ্চা-কাচ্চা নেই, ওঁদের কোয়ার্টারটা বেশ ভালই, আমাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শয়নকক্ষ, বাথরুম, রান্নাঘর পর্যন্ত দেখিয়েছিলেন। কিন্তু কোনও ঘরেই একটাও বই বা পত্র পত্রিকা চোখে পড়েনি।

যারা নিজেরা বই পড়ে না, তারা অপরের বই পড়াটাও যেন শারীরিকভাবে সহ্য করতে পারে না। মহিমবাবু এমন ভাবে আমার বইখানার দিকে তাকিয়ে রইলেন যেন ওঁর গা চুলকোচ্ছে।

প্রথম দু-এক দিনেই বুঝে গেছি যে, মহিমবাবু আমাকে পছন্দ করতে পারেননি। আমি পছন্দ বা অপছন্দ কোনওটারই যোগ্য নই। এখানে আমাকে উপরন্তু অপছন্দ করার কারণ, আমি বড়সাহেবের লোক। বড়সাহেব কলকাতা থেকে তার এক আত্মীয়কে এনে চাকরিতে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। মহিমবাবুর কোনও শালা বা ভাইপো নিশ্চয়ই বেকার বসে আছে, তিনি তার কথা ভেবে বসেছিলেন। আমি মনে মনে বলি, অপেক্ষা করুন। মহিমবাবু, ধৈর্য হারাবেন না, আপনার শালা কিংবা ভাইপো ঠিকই চাকরি পাবে।

সে-দিন মহিমবাবুকে খাতির দেখাবার জন্য আমি বইটা নামিয়ে রেখেছিলাম। দু-দিন পর উনি আবার এলেন দেড়টার সময়। এখনও টিফিন টাইম শেষ হয়নি, এখন আমি যা খুশি করতে পারি।

ওঁকে দেখে মিষ্টি হাসি দিয়ে বললাম, কী ভালো? বই পড়তে লাগলাম আবার। জর্জ সিমেনোর রহস্য কাহিনি, অতি পাষণ্ড ছাড়া এই বই শেষ না করে কেউ উঠতে পারে না। চন্দনদার বাড়িতে এ-সব বইয়ের প্রচুর স্টক আছে।

মহিমবাবু ভুরু কুঁচকে উঠে গেলেন দো-তলায়। খানিক বাদে আমার মনঃসংযোগ নষ্ট হল। ওপরে কীসের যেন একটা গোলমাল হচ্ছে। মহিমবাবু চেঁচিয়ে ডাকলেন, মি. নীললোহিত, মি. নীললোহিত, একবার ওপরে আসুন তো।

ক্লাস থ্রি-স্টাফেরা যেমন টাই পরেনা, তেমনি তারা মিস্টারও হয় না। আর নীললোহিত নামটার আগে মিস্টার কখনও মানায়? যাদের বাড়িতে একখানাও বই থাকে না, তাদের কাণ্ডজ্ঞান তো এ-রকম হবেই।

টিফিনের সময় ডাকাডাকি খুব অন্যায়। চন্দনদার নীতি-বিরোধী। মহিমবাবু কর্ম-প্রাণ পুরুষ। বিশ্রাম কাকে বলে জানেন না কিংবা ওপরওয়ালাদের তিনি বেশি বেশি কাজ দেখাতে চান। এখানে তো ওপরওয়ালা কেউ নেই!

উঠে এলাম ওপরে। মহিমবাবু যদি দো-তলা থেকে ডাকার সময় মিস্টার যোগ না করে শুধু আমার নাম ধরে ডাকতেন, তাহলে ওকে বেকায়দায় ফেলার কোনও ইচ্ছে আমার জাগত না। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে আমার মনে হল, মহিমবাবুকে ছোট্ট একটি লেংগি মারা দরকার। সহকর্মীদের সঙ্গে লেংগি মারামারি না করলে আর চাকরির সুখ কী?

মহিমবাবু বললেন, দেখুন দেখুন, আপনি নজর রাখেন না, নাকের ডগায় বই নিয়ে বসে থাকেন, এদিকে এরা কী করে?

আমি নিরীহ ভাবে বললাম, কী করেছে?

মহিমবাবু বললেন, ডিউটি আওয়ার্সে ফাঁকি! ওয়েস্টেজ অফ মেটিরিয়ালস।

হেড মিস্তিরি ইরফান আলি দাঁড়িয়ে আছে মহিমবাবুর পাশে। তার হাতের ঘড়িটা দেখে নিয়ে আমি বললাম, ডিউটি আওয়ার্স তো এখনও শুরু হয়নি।

কোম্পানির জিনিস নষ্ট করছে, সেটা দেখছেন না?

কী নষ্ট করেছে?

দেয়ালটার দিকে তাকান একবার। ওপরে কি একবারও আসেন না?

মহিমবাবু নিজেই দেয়ালটা আড়াল করে আছেন, দেখব কী করে? এবার কাছে গিয়ে দেখলাম, দেয়ালে আঁকা রয়েছে একটা ছবি। দোতলায় দেয়ালগুলো প্লাস্টার করা হয়েছে কয়েক দিন আগে, এখন হোয়াইট ওয়াশ করা হয়নি। দু-এক দিনের মধ্যে হবার কথা।

চুন গোলা দিয়ে কেউ একটা আঁকাবাঁকা ছবি এঁকেছে দেওয়ালে। একটা গাছ, একটা ছেলে, একটা কুকুর। কাঁচা হাতের কাজ। দুদিন বাদে যে-দেওয়াল চুনকাম হবে, সেখানে একটা ছবি এঁকে রাখলে ক্ষতি কী, পরে তো মুছেই যাবে।

আমি বললাম, টিফিনের আগেই আমি একবার ওপরে ঘুরে গেছি। তখন ছিল না। টিফিনের মধ্যেই কেউ এঁকেছে।

আমার কথা গ্রাহ্য না করে মহিমবাবু গলা তুলে জিজ্ঞেস করলেন, কে এ কাজ করেছে? কৌন কিয়া?

ইরফান আলি নিজস্ব দলটার দায়িত্ব নিয়ে বলল, হামলোগ নেহি দেখা!

কলের মিস্তিরিরা বলল, আমরা কিছু দেখি নাই। আমরা বারান্দায় ছিলাম।

সাঁওতালরা কোনও উত্তর না দিয়ে কয়েকজন চুপ করে রইল, কয়েক জন মিচকি মিচকি হাসতে লাগল।

এবার এগিয়ে এল এক নিঃশব্দ প্রতিমা। ফুলমণি। তার হাতে একটা ভিজে ন্যাতা।

মহিমবাবু এবার তার গলায় বিস্ময় আর রাগ এক সঙ্গে মিশিয়ে বললেন, তুম কিয়া? কহে কিয়া? অ্যাঁ? কাহে কিয়া?

আমি ফুলমণিকে নতুন চোখে দেখলাম। এই বোবা মেয়েটা ছবি আঁকে? আগে ওকে মনে হত বিষণ্ণতার প্রতিমূর্তি।

যে বাড়ি এখনও তৈরি হয়নি, রঙ করা হয়নি, তার দেয়ালে দু-চারটে ছবি-টবি থাকা তো দোষের কিছুনা। আমার ছবি আঁকার ক্ষমতা থাকলে আমিই আঁকতাম। শুধু বালি, বালি রঙের দেয়াল দেখার কী আছে?

আমি ভেবেছিলাম, নারী জাতির প্রতি সমবোধে মহিমবাবু গলার আওয়াজটা অদ্ভুত একটু নরম করবেন। তা নয়, খুব রোগা এক অবলাকে দেখে তিনি আরও গর্জন করে বলতে লাগলেন, মুছে দেও, আভি মুছে দেও!

যদি একটি মুখরা মেয়ে হত, তাহলেও অন্য কথা ছিল। কিন্তু এক জন বোবা, তার প্রতি এ-রকম একতরফা বাক্য ব্যবহার আমার পছন্দ হল না।

আমি হাত তুলে বললাম, দাঁড়াও, ওটা মুছতে হবে না।

মহিমবাবু আমার ওপরওয়ালা। তিনি হকচকিয়ে গিয়ে বললেন, অ্যাঁ? কী বললেন?

আমি এই বাড়িটার ইনচার্জ। আমার মতামত না দিয়ে মহিমবাবু এখানে কোনও হুকুম দিতে পারেন না। আমার গলায় যথোচিত গাম্ভীর্য এনে আমি অন্যদের দিকে তাকিয়ে বললাম, যত দিন না চুনকাম হয়, তত দিন তোমরা যে-কোনও দেওয়ালে যা ইচ্ছে ছবি আঁকতে পারো। টিফিন টাইমে!

তারপর মহিমবাবুর দিকে তাকিয়ে খুব বিনীত ভাবে বললাম, এটাই চন্দনদার নির্দেশ। চন্দনদা খুব ছবি ভালবাসেন। উনি নিজে এক সময় দারুণ ছবি আঁকতেন, জানেন না?

Pages: 1 2 3 4 5
Pages ( 1 of 5 ): 1 23 ... 5পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress