Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ফাটল || Sanjib Chattopadhyay

ফাটল || Sanjib Chattopadhyay

ফাটল

আর একটু পরেই সেশানস কোর্টের রায় বেরোবে। জজসায়েব কিছুক্ষণের জন্যে এজলাস ছেড়ে উঠে গেছেন। পাশে কোথাও কোনও ঘরে গিয়ে বসেছেন জুরিদের সঙ্গে পরামর্শে। কোর্টের নিয়মকানুন, আদব-কায়দা আমি বিশেষ কিছু বুঝি না, বুঝতে চাইও না। যেদিন মামলা ওঠে সেদিন পুলিশের কয়েদি-গাড়িতে তুলে আমাকে আদালতে নিয়ে আসে। নিয়ে এসে বসিয়ে দেয় কাঠগড়ায়। কাঠগড়ায় ঢোকার সময় খুলে দেয় হ্যান্ডকাফ। খটাস করে শব্দ হয় একটা! মুক্তির শব্দ! এই শব্দটা বেশ ভালো লাগে আমার। হাত দুটো ভারমুক্ত হয়ে হালকা লাগে পাখির ডানার মতো। আমি বসে থাকি চুপচাপ। শুনতে থাকি দু-পক্ষের উকিল আমার জীবন নিয়ে কথার খেলা খেলছেন। আমার হাসি পায়, ঘুম পায়, ক্লান্তি লাগে, বিরক্তি ধরে যায়। আমি তো প্রথম দিনেই কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে স্বীকার করে নিয়েছি, আইনের চোখে অবশ্যই আমি অপরাধী, নিজের বিবেকের চোখে আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ। আমি খুন করেছি। খুন করব বলেই করেছি। যাকে খুন করেছি, তাকে মানুষের মতো দেখতে হলেও সে পশু ছিল। নর-পশু। আইনের চোখ যেহেতু মানুষের ভিতরটা দেখে না, সেইহেতু আমি দোষী, আমি খুনি। আইন মোতাবেক যে সাজা আমার প্রাপ্য, সেই সাজা আপনি আমাকে দিন ধর্মাবতার। অকারণ সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি আপনার কাজ সারুন—এই আমার প্রার্থনা।

জানুয়ারির কত তারিখ ছিল সেদিন? পনেরো কি ষোলো হবে। শহরের সব কাগজেই খবরটা প্রকাশিত হয়েছিল। কোনও কাগজে ছোট করে, কোনও কাগজে ফলাও করে। তারিখটা আমি ভুলে গেছি। ঘটনাটাও প্রায় ভুলে এসেছি। এখন যেন মনে হয় স্বপ্ন। আমি অন্ধকারে বিশাল বড় একটা পাথর তুলে দু-হাতে শরীরের সমস্ত জোর একত্র করে ছুড়ছি। তিনটে শয়তানের একটা পড়ে গেল, আর দুটো অন্ধকারে নিমেষে মিলিয়ে গেল। আমি পড়ে থাকা শয়তানটাকে কষে একটা লাথি মারলুম। মারার সময় মনে হল পশুটা মরে গেছে। জামা-কাপড়ের কী বাহার! চেক চেক হাওয়াই শার্ট। ডোরা কাটা ট্রাউজার। কেয়ারি করা চুল। মাথাটা অবশ্য ঘেঁতো হয়ে গিয়েছিল। আমি ঘৃণায় থু-থু করে তিনবার থুথু ছিটিয়ে দিলুম। বড় তৃপ্তি পেয়েছিলুম সে রাতে। মানুষ মারার আনন্দে বিভোর; অন্ধকারে দু-পা এগিয়ে গিয়ে আমার মেয়ে রূপাকে পথের ধুলো থেকে টেনে তুলে দাঁড় করালুম। শয়তান তিনটে তার শাড়িটা প্রায় খুলে ফেলেছিল। ব্লাউজটা টেনে ছিঁড়ে ফেলেছে। রূপা তখনও কাঁপছে। ডানপাশের গালে লম্বালম্বি একটা ক্ষতচিহ্ন। কথা বলার শক্তি নেই। আমি কোনওরকমে তার গায়ে শাড়িটা জড়িয়ে দিলুম। তখন বেশ রাত। বারোটা তো হবেই।

থানায় পুলিশ আমাকে ধমকেছিল। কেন আপনি মেয়েকে নিয়ে অত রাতে ওই জায়গা দিয়ে যাচ্ছিলেন। দোষ তো মশায় আপনার। আমি অবশ্য পুলিশের কথায় কিছু মনে করিনি; আর সেই আমার পুলিশের সঙ্গে প্রথম মুখোমুখি। জানাই ছিল পুলিশ এইরকম বোকা বোকা কথা বলাতেই অভ্যস্থ। আমি বলেছিলুম, ‘ব্যাপারটা এখন তিরস্কারের বাইরে চলে গেছে। ঘটনা ঘটেই গেছে। যখন, তখন আপনাদের কাজ হবে অ্যাকশান নেওয়া।’ ওসি অনিচ্ছার গলায় বলেছিলেন, ‘ডায়েরি একটা করে যেতে পারেন। তবে না করাই ভালো। ধরা কেউ পড়বে না। আর যদি ধরাও পড়ে, সাক্ষী মিলবে না। আর যদি সাক্ষী মেলে আপনার মেয়েকে কোর্টে যেতে হবে। কেসটা কাগজে উঠবে। লোক জানাজানি হয়ে যাবে। তখন লজ্জার একশেষ। রাস্তায় বেরোলেই লোক পিছু নেবে। সুযোগ নেবে। কী দরকার মশাই। গাড়ি দিচ্ছি, বাড়ি চলে যান।’

রূপা আমার গায়ে গা লাগিয়ে বসেছিল। তার কথা ফিরে এসেছে। শরীরের কাঁপুনিও কমে। গেছে। রূপা আমার কানে কানে বললে, ‘বাবা, চলো আমরা বাড়ি যাই।’ মুহূর্তের জন্যে মন দুর্বল হল আমার। কোনও অপরাধ করেছি কি না জানি না, ছেলেটা মরেছে কি না জানি না তা-ও। ভেবেছিলুম অকপটে বলে যাব আমি কী করেছি, বলা আর হল না। পুলিশের জিপে চড়ে বাড়ি ফিরে এলুম। সারারাত ঘুমোতে পারলুম না। ধরা দিতে গিয়েছিলুম পুলিশকে। তখন সাহস ছিল, পরে ভয় এসেছিল। কেবলই মনে হচ্ছিল, আমি এক হত্যাকারী। একবারও মনে এল না, যাকে মেরেছি সে দল বেঁধে এসেছিল আমার মেয়ের ওপর যৌন-অপরাধ করতে। আমার খুবই অবাক লেগেছিল, বাড়ির কেউই আমার কাজের প্রশংসা করল না! বরং বলেছিল আমি একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি। সবাই আমার দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতেই তাকাচ্ছিল, লোকে যেভাবে একজন খুনির দিকে তাকায়। সব দরজা-জানলা বন্ধ করে দিয়েছিল। গোটা পরিবার অপরাধীর মতো বসে। রইল আত্মগোপন করে। সকলেই কথা বলছিল ফিশফিশ করে। প্রয়োজনের কথা ছাড়া কেউই একটাও বাড়তি কথা বলছিল না। আমাকে ঘিরে সবাই বসেছিল খাটে। বাইরে গাড়ির শব্দ হলেই সকলে ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছিল। খুন করার অভ্যাস না থাকলে মানুষের এই রকমই হয়। আমাদের পাড়ায় এমন তিন-চারজন ছিল যারা একাধিক খুন করে বুক ফুলিয়ে বেড়াত। আমার পাঞ্জাবি আর পাজামায় রক্তের দাগ লেগেছিল, দাগ লেগেছিল চটিতে। যত বলি রূপার রক্ত, কেউ-ই বিশ্বাস করে না। আমার ছেলে কলেজে পড়ত। আমার চেয়েও বোঝে বেশি। সে মাঝরাতে, পাঞ্জাবি-পাজামা সব একটা বালতিতে ভরে কেরোসিন তেল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিলে। তার জ্ঞান ছিল না, চারপাশ বন্ধ ছোট্ট একটা ফ্ল্যাটে কাপড়-জামায় আগুন ধরালে কী হতে পারে।

ধোঁয়ায় সব অন্ধকার। কেরোসিনের তীব্র গন্ধ। সঙ্গে সঙ্গে জল ঢেলে আগুন নেবার আগেই পাশের ফ্ল্যাটের সবাই ছুটে এল, ‘বিমানবাবু’। আমরা ভয়ে তালগোল পাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। দরজায় ঘন ঘন ধাক্কা। শেষে আমার স্ত্রীকে দরজা খুলতেই হল। বেরোবার পথ না পেয়ে ঘরের মধ্যে সমস্ত ধোঁয়া ঘুরপাক খাচ্ছিল। দরজা খোলামাত্রই গলগল করে ছুটে গেল বাইরের দিকে। খোলা দরজার সামনে সাত-আটজন হতবাক প্রতিবেশী। তাঁরা একই সঙ্গে ঢুকে পড়লেন ঘরে। সকলেরই উৎকণ্ঠিত প্রশ্ন, কোথায় আগুন, কোথায় আগুন।

মিথ্যা কথা বলার অভ্যাস না থাকলে মানুষ কীরকম বোকা বনে যায় সেইদিন বুঝেছিলুম। প্রশ্নটিকেই আমরা উত্তর হিসেবে চালাতে লাগলুম—আগুন! কোথায় আগুন! উপকারী মানুষ কত আন্তরিক হয়! সাত-আটজন ছড়িয়ে পড়ল ভেতরে। একজন এগিয়ে গেল বাথরুমের দিকে। বালতি তখনও ধোঁয়া ছাড়ছে। সে চিৎকার করে উঠল—’একী! কী পোড়াচ্ছিলেন বালতিতে? জামা কাপড়!’

রাত তখন প্রায় তিনটে। সাত-আট জোড়া অপরাধ অনুসন্ধানকারীর সন্দিগ্ধ চোখের সামনে আমরা। কে একজন একালের ভাষায় বললে—’ডালমে কুছ কালা।’ সঙ্গে সঙ্গে যারা প্রতিবেশীর উপকারে ছুটে এসেছিল, তারা হয়ে গেল পুলিশের লোক। একজন কড়া গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘বলুন, কী সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপাট করছিলেন?’ আমরা চারটে প্রাণী মাথা খাঁটিয়েও বিশ্বাসযোগ্য কোনও উত্তর দিতে পারলুম না। নীরবে মাথা নীচু করে রইলুম। আর একজন বললেন, ‘ইনফর্ম পুলিশ।’ আমার স্ত্রী তখন মাথা খাঁটিয়ে একটা উত্তর বের করেছে। ‘জামাকাপড়ে এমন একটা নোরা লেগেছিল, পোড়ানো ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না।’ সকলে হেসে উঠল—’তা এই মাঝরাতে! কী এমন নোংরা মশাই!’

মানুষ মানুষের সর্বনাশের জন্যে কত কষ্ট করতে পারে! একদল রয়ে গেল আমাদের পাহারায়, যাতে আমরা বালতিটাকে লোপাট করে দিতে না পারি। আর আর-এক দল চলে গেল পুলিশে খবর দিতে। বাকি রাতটা আমরা বসে রইলুম ঘেরাও হয়ে। প্রশ্নের পর প্রশ্ন আসতে লাগল। আমাদের দিকে। এক সময় আমি বিরক্ত হয়ে বলেছিলুম—’আপনারা তো পুলিশ ডাকছেনই, যা বলার পুলিশকেই বলব।’

সবাই একটু আশ্বস্ত হলেন, যাক, বলার তাহলে আছে কিছু।

এর পর সবই সরলরেখায় ঘটে গিয়েছিল। পুলিশ এল। তার আগে শেষ রাতে পথের ধার থেকে যুবকের মৃতদেহ উদ্ধার। যুবকটি এই শহরেরই বড় এক ব্যবসায়ীর সন্তান। থানায় খবর চালাচালি হয়ে গেল। আধাপোড়া পাজামা, পাঞ্জাবি সহ বালতি চলে গেল পুলিশ-হেফাজতে। আমার দু-পাটি চপ্পল। থানায় আমার স্বীকারোক্তি। রূপার ডাক্তারি পরীক্ষা। আমি পড়ে গেলুম ইঁদুরকলে। আমাকে ফাঁসাবার জন্যে সাক্ষীসাবুদের অভাব হল না। কারণ আমি ছিলুম এক নিরীহ মানুষ। আমার কোনও দল নেই। আমি কোনও রাজনৈতিক দলের আশ্রিত নয়। আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিলে কারওর কোনও বিপদ নেই। আমার পক্ষে কোনও সাক্ষীই পাওয়া গেল না। প্রমাণই করা গেল না, অন্ধকারে তিনটে ছেলে রূপাকে রেপ করতে এসেছিল! ডাক্তারি পরীক্ষায় রূপার শরীরে বলপ্রয়োগের কোনও চিহ্নই পাওয়া গেল না। গালের ক্ষত যে-কোনও কারণেই। হতে পারে। ছেঁড়া ব্লাউজ! নিজেই নিজের ব্লাউজ ছেঁড়া যায়।

অসহায় আমি কাঠগড়ায় বসে বসে কত কী শুনে গেলুম। যে ছেলেটিকে আমি মেরেছিলুম সে ছিল এক ব্যবসায়ীর সন্তান। অঢেল টাকার মালিক। রাস্তায় শিকার ধরা ছিল তার হবি। তার পিতাটি অর্থের জোরে ভোগ আর রোগ দুটোরই মালিক। তিনি আমার বিরুদ্ধে তাঁর সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। আমার হয়ে লড়ছিলেন নড়বড়ে এক অ্যাডভোকেট। বয়সে নবীন। তিনি আমাকে খালাস করিয়ে আনার জন্যে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। ছেলেটি আদর্শবাদী। আমার মুখে সব শুনে বলেছিলেন, আপনি ঠিক করেছিলেন। নরখাদক বাঘ মারলে মানুষকে যদি পুরস্কার দেওয়া হয়, আপনাকেও পুরস্কার দেওয়া উচিত, সাজা নয়। কিন্তু কী করা যাবে? আইন হল আইন।

আদালতে বসে আমার মেয়ের সম্পর্কে কত কী শুনলুম। নিজের সম্পর্কেও। আমার মেয়ের চরিত্র! সে না-কি ছেলেধরা! সত্যি সত্যিই সাক্ষীর কাঠগড়ায় পুলিশ তিনটে লপেটা মার্কা। ছেলেকে একের পর এক তুলে দিল। প্রত্যেকেই তাদের কাছে লেখা আমার মেয়ের দু-দশটা প্রেমপত্র আদালতে দাখিল করে গেল। সেই সব চিঠি আদালতে পড়া হল জোরে জোরে। আমাকে শুনতে হল। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আমার মেয়েকে স্বীকার করতে হল, চিঠিগুলো তারই লেখা।

সরকার পক্ষের আইনজ্ঞ প্রমাণ করতে চাইলেন, আমি আমার মেয়েকে দিয়ে দেহব্যবসা চালাতুম, তা না হলে কেমন করে আমার জীবনযাত্রার মান আমার উপার্জনের চেয়ে বেশি হয়! কী করে আমি সাড়ে তিন লাখ টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কিনি! কেনার পরেও কী করে আমার অত টাকা ব্যাংক ব্যালেন্স থাকে। আদালতে বসেই আমি জানলুম, আমার স্ত্রী থিয়েটারে অভিনয় করত। তার অনেক প্রেমিক ছিল! এমনকী এ-ও প্রমাণ করার চেষ্টা হল রূপা আমার মেয়েই নয়। তার পিতা আমার কর্মস্থলের এক প্রাক্তন বড়কর্তা! স্ত্রীকে ভেট হিসেবে ব্যবহার না করলে একটা। লোকের তিন বছরে চারটে প্রোমশান হয় কী করে?

কিছুতেই প্রমাণ করা সম্ভব হল না, ঘটনার দিন রাতে আমি আমার এক বন্ধুর বাড়িতে ভোজ খেতে গিয়েছিলুম। কারণ আমার সেই বন্ধু ভোরের বিমানে সপরিবারে আমেরিকা চলে গেল। তার বৃদ্ধা মা সরাসরি আমাকে চিনতে অস্বীকার করলেন। আমার বন্ধু আমেরিকা থেকে আমার উকিলের একটা চিঠিরও জবাব দিলেন না। সরকার পক্ষের উকিল নাটকীয় কায়দায় হাত-পা নেড়ে প্রমাণ করে দিলেন, আমি অসৎ উদ্দেশ্যে ওই সময় ওই অঞ্চলে আমার মেয়েকে নিয়ে ঘুরছিলুম। ছেলেটি ছিল আমার মেয়ের প্রেমিক। সে সেদিন আমাকে ধরবে বলে দাঁড়িয়েছিল। পরপর তিনজন সাক্ষী দিয়ে গেল, ছেলেটি সত্যিই আমার মেয়ের প্রেমিক। ওরা দুজনে সিনেমায় যেত। রেস্তোরাঁয় মিলিত হত। এক রেস্তোরাঁর মালিক এসে আমার মেয়েকে শনাক্ত করে। হলফনামা দিয়ে গেল। প্রমাণ হয়ে গেল, আমার মেয়েকে বাঁচাবার জন্যে আমি খুন করিনি বরং প্রেমিকাকে বাঁচাতে এসে আমার হাতে খুন হল ছেলেটি।

আমার উকিল শেষে প্রশ্ন করলেন, খুনের যে হাতিয়ার ওই পাথর, ওই পাথর আমার মতো চেহারার এক প্রবীণ মানুষের পক্ষে কোনওরকমে তোলা সম্ভব হলেও ছোড়া সম্ভব কি না? তা। ছাড়া ঘটনাস্থলে যেসব সঙ্গীসাথী উপস্থিত ছিলেন বলে দাবি করছেন, তারা ইচ্ছে করলেই প্রবীণ মানুষটিকে একযোগে জাপটে ধরে মেরে ফেলতে পারত। অতএব পুলিশের যুক্তি ধোপে টেকে না। দ্বিতীয় পয়েন্ট, ঘটনা যে থানায় ঘটেছে সেই থানায় অপরাধী নাকি গিয়েছিলেন স্বীকারোক্তি করতে। এটা একজন নিরীহ মানুষকে জড়িয়ে দেবার জন্যে সর্বৈব মিথ্যা কথা, বানানো কথা। কোথায় সেই ডায়েরি! অপরাধী পরে যে স্বীকারোক্তি করেছেন, পুলিশ তা আদায় করেছে জোর করে। মারধোর করে।

কমিশন বসল। সেই কমিশনের সামনে আমাকে বলা হল পাথরটি তুলতে। আমি তুলতে পারলুম না। বিশাল এক সুদেহী এলেন, তিনি যদিও তুললেন, ছুঁড়তে পারলেন না। পাথরটাকে ওজন করা হল। শেষে সিদ্ধান্ত হল, ওই পাথর আমার মতো ক্ষমতার একজন মানুষের পক্ষে ভোলা। অসম্ভব। এরপর আমার উকিল প্রশ্ন তুললেন পাথরটা এল কোথা থেকে? ওই অঞ্চলে ওইরকম পাথর আর দ্বিতীয় নেই। একটি মাত্র পাথর অপরাধীর জন্যে রাখা ছিল। আর সে দৈত্যের শক্তি ধার করে পাথরটা ছুড়বে—গল্পেও এমন অবাস্তব ভাবা যায় না।

জজসায়েব ফিরে এসেছেন এজলাসে। আদালতকক্ষ নিস্তব্ধ। তিনি সকলের দিকে একবার তাকালেন। আমার দিকেও মনে হয় তাকালেন একবার। তারপর পড়তে শুরু করলেন তাঁর দীর্ঘ। রায়। কিছুটা পড়ে একেবারে চলে গেলেন শেষে। পুলিশের কাজের নিন্দা করে বললেন, অপরাধীর অপরাধ প্রমাণে ব্যর্থ পুলিশ। যাকে অপরাধী বলা হচ্ছে, সে নির্দোষ। সে নিরীহ। যুবকটি খুন হয়েছে অবশ্যই, তবে খুনি অন্য কেউ। আবার এমনও হতে পারে, এটি নিছক একটা পথ-দুর্ঘটনা। অতএব আসামি বেকসুর খালাস! ছাড়া আমি পেলুম ঠিকই, কিন্তু আমি এখন অন্য মানুষ। আমার পরিবারে ফাটল ধরে গেছে। রূপার একটা গোপন জীবন, আমার স্ত্রীর একটা গোপন জীবন, আর আমি! আইন প্রমাণ করতে পারলেও, মেয়েকে লাঞ্ছিত হতে দেখে আমার শরীরে সত্যই সেদিন দৈত্য ভর করেছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *