Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

পনেরো


একটা পুরনো বাড়ির ভাঙা ভাঙা ঘর। রাত গভীর। মোহন মদে চুর। একপাশে গুম মেরে বসে আছে। গুপীদাও অল্পবিস্তর খেয়েছে। মুখটা টকটকে লাল। সোফিয়া টগবগ করছে। যত রাত বাড়ছে ততই তার জেল্লা বাড়ছে।

মোহন গুপীকে বলছে—তুমি কি আমাকে চরিত্রহীন ভাবো?

গুপী—ঠিক উলটো ভাবি। তোমার মতো চরিত্রবান ছেলে এপাড়ায় ক’জন আছে! তুমি শেয়াল নও, তুমি বাঘ। সোফিয়ার বয়েস আমার অর্ধেক। আমি ওর বাপের বয়সি। দুটো জীবন অ্যায়সি মিলে গেছে। সোফিয়া তোমাকে ভালোবাসে, তা আমি জানি; কিন্তু তুমি জানো, সোফিয়া গুপী ঢ্যামনার বউ। এই অবস্থায় হিন্দি ছবি হলে কী হত? সোফিয়া আর তুমি আমাকে হাপিস করে ম্যানহোলে ফেলে আসতে। কই তা তো তুমি করোনি মোহন। তোমার কোমরে তো সবসময় মেশিন থাকে। ছোট্ট একটা দানা, ছোট্ট একটু শব্দ। একটা কুত্তার মৃত্যু, একটা লেংটি খতম। তার বদলে তুমি কী করলে! এই শালাকে গুপীদা বলে সম্মান করলে, আগলে রাখলে। তা না হলে এই গুপীদা কবে খতম হয়ে যেত। তুমি এই খাতির কী সোফিয়ার জন্যে করো? না। গুপীর একটা অতীত আছে। পড়তি জমিদার বংশের মুকখু ছেলে। যৌবনে দু’হাতে উড়িয়েছি। সোফিয়াকে ওর দাদুর কাছ থেকে ছিনিয়ে এনে গোটা ভারতে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরেছি। আমি জানি, তুমি আমাকে ভালোবাস, কেন বাস মোহন?

মোহন— তুমি একটা মানুষ, সেন্ট পারসেন্ট খাঁটি মানুষ। তুমি আমার মায়ের কথারই উজ্জ্বল উদাহরণ। আমার মা কে বলো তো গুপীদা?

গুপী— তোমার মা তো তোমার চার বছর বয়সেই চলে গেছেন।

মোহন— গর্ভধারিণী নয় গো। আমার জীবনদায়িনী, শক্তিদায়িনী মা সারদা, ওই যে তাঁর ছবি। ওই মা বলেছিলেন, শোন মোহন, যখন যেমন তখন তেমন, যার কাছে যেমন তার কাছে তেমন, যেখানে যেমন, সেখানে তেমন। তুমি কেঁচোর মতো বড়োলোকি চাল নিয়ে গর্তে ঢুকে মরতে চাওনি। তুমিই হলে একালের জ্যান্ত স্লোগান—লড়াই, লড়াই, লড়াই চাই।

রয়াল এনফিল্ড মোটর বাইকের বিকট শব্দে মোহনের গলা চাপা পড়ে গেল। সোফিয়া উৎকণ্ঠায় টানটান—

—সেই শুয়োরের বাচ্চা। মোহনদা, আসছে সে।

ষোলো


অন্ধকার রাত। সামনে অমাবস্যা। কালো ঘুটঘুটে নির্মেঘ আকাশ। তারার ঝাঁক ফুল ভোল্টেজে ধক ধক করে জ্বলছে। সেই অন্ধকারে বিশাল মোটর সাইকেল থেকে নামছে কালোয়ারের ছেলে সূরয। সবাই বলে কালা সূরয, গেরোন লাগা সূর্য। দুটো ‘ম’ নিয়ে পড়ে আছে। পাতি সাপ্লাই দেয় মালকোঁচা মারা সেকেলে বাপ। শিবের ভক্ত। বাড়িটাই শিবমন্দির। কালা সূরয চোরাই অস্ত্রের ব্যাবসা করে। বম্বের মাফিয়াদের সঙ্গে কানেকশান। কালা সূরয গুপীর বাড়িতে ঢুকছে। কাঁধে একটা বড়ো ব্যাগ। সূরয সামনের দরজা দিয়ে ঢুকছে। মোহন আর গুপী সুট করে বেরিয়ে গেল পেছনের দরজা দিয়ে। মোহন পাশের একটা গলিতে মোটরসাইকেল রেখেছিল। মোহন বেরিয়ে যাওয়ার সময় সোফিয়াকে বলেছিল—শিকারটাকে আচ্ছাসে খেলাও। আজকের রাতই ওর শেষ রাত হবে। অন্ধকার গলি ধরে মোহন ছুটছে ‘রতন স্টুডিয়ো’—র দিকে।

এদিকে সূরয ঢুকছে। বড়ি চমকিলি রাত।

—মেরি দুলাড়ি। বুঢঢাটা কোথায়? গন্ধী মাল।

সোফিয়া যেন কতই প্রেমিকা। মায়া মেশানো গলা তার—সেটাকে আউট করে দিয়েছি।

—তাহলে?

—তাহলে আবার কী! তুমি আমার, আমি তোমার। পুজোর সময় চম্পট। সোজা বোম্বাই। তুমি আমাকে ‘সিল্কি স্মিতা’ করে দেবে। লাখ লাখ টাকা, গাড়ি, বাড়ি, হিরের গয়না।

সূরয খুব খুশি—এই তো, এই তো লাইনে এসেছ। তোমার যা ফিগার মাইরি। একটু মেকআপ মেরে নামিয়ে দিলে সব আউট। রাস্তা ঝাড়ু দেবে। খালি একটু নাচাগানা শিখতে হবে।

—আরে ইয়ার সে তো আমি জানি। বিলকুল জানি।

—তাহলে আমাদের ডানকুনির বাগানে এই শনিবার।

—হয়ে যাক। আমার সিল্কের শাড়ি আছে, নকলি সোনার গয়না আছে।

—আরে আসলি পরবে, আসলি। আমার নাম সূরয, তুমি আমার চন্দা।

ওদিকে রতন স্টুডিয়োর সামনে মোহন। ডাকছে—এই রতন, রতনা।

স্টুডিয়োর রোলিং—শাটার অর্ধেক নামানো। তলা দিয়ে গলে বেরোতে বেরোতে রতন বলছে,

—গুরু! তুমি এত রাতে!

—শিকার পড়েছে। তোর পোলারাইজটা নিয়ে শিগগির আয়। একটুও দেরি চলবে না।

—এক সেকেন্ড, মালটা লোড করে নি।

—ফ্লপ করে না যেন।

—না রে বাবা, জার্মানির এক নম্বর মাল। শিয়োর শট। অন্ধকারে শেয়ালের চোখ।

এদের দুজনকে রেখে আবার আমরা সোফিয়ার ঘরে যাই। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দু’হাত তুলে খোঁপা ঠিক করতে করতে সোফিয়া সূরযকে বলছে—কেমন দেখছ?

লোভে সূরযের চোখ দুটো জ্বলছে। সূরয সোফিয়ার ঘাড়ে ঠোঁট ঠেকিয়ে বলছে—

পাগল হয়ে যাব। শিউজির ষাঁড় আমি।

—ষাঁড় নয়, ভাদ্দর মাসের কুকুর।

—যাঃ, নিজেকে কুকুর বলতে ইচ্ছে করে!

—আগে আলোটা নেবাও।

আলো নিবল। মোহন আর রতন নিঃশব্দে পেছনের খিড়কি দিয়ে ঢুকছে। ডানপাশে একটা উঁচু মতো জায়গায় বসে আছে গুপী। বিড়ির আগুন বড়ো হচ্ছে, ছোটো হচ্ছে।

মোহন গুপীকে ফিসফিস করে—বিড়ি ফেলে দাও। হাওয়া ওইদিকে বইছে। গন্ধ যাবে। সব ঠিক আছে তো!

গুপী বিড়ি ফেলে দিয়ে চাপা গলায় বললে, এইমাত্র আলো নিবেছে।

মোহন আর রতন নিঃশব্দে বেড়ালের মতো ভেতরে চলে গেল। গুপী বাইরেই বসে রইল। অন্ধকারে দুটো সিল্যুয়েটের নড়াচড়া। মোহন রতনের কানে কানে জিজ্ঞেস করলে—শাটারের শব্দ হবে না তো?

—না। ক্যামেরাটা কম্পিউটারাইজড।

—সাবাস বিজ্ঞান।

সূরয ইতিমধ্যে অন্ধকারে বেশ কিছুদূর এগিয়েছে। সেমিফাইনাল থেকে ফাইনাল যাবে, এমন সময় দপ করে আলো জ্বলে উঠল, সূরয চমকে উঠেছে। ঠিক দরজার সামনে দীর্ঘকায় মোহন, পাশে রতন পালোয়ান।

মোহন বরফ শীতল গলায় বললে,—সূরযবাবু, ইঁদুরকলে পড়েছ। বেশি রং নেবার চেষ্টা করো না। এই যে দেখছ যন্তরটা, পোলারাইজড ক্যামেরা। এর ভেতর আছে তোমার মৃত্যুবাণ।

সূরয চাদর জড়ানো অবস্থায় ঘরের এক কোণে উজবুকের মতো দাঁড়িয়ে আছে। কাঁপা কাঁপা গলায় বললে—মোহনবাবু, আপনি এই সময় এখানে?

মোহনেরও সেই একই প্রশ্ন—সূরযবাবু, আপনি এইসময় এখানে? ব্যাগে কত মাল আছে?

—কেন মোহনবাবু?

—আজ রাতে পঁচিশ হাজার ক্যাশ। এরপরে মাসে মাসে এক লাখ।

—আমার সঙ্গে দিল্লাগি করছেন?

—তাহলে এই তিরিশখানা ছবি আপনার বাবার কাছে, বউয়ের কাছে, আপনার শ্বশুর, শাশুড়ির কাছে পাঠিয়ে দিই।

—আপনার মতো লোক আমাকে ব্ল্যাকমেল করছেন।

—ওসব ঢঙের কথা খুব হয়েছে, যা বলছি তাই কর। তা না হলে আমি যা বলেছি তাই হবে।

—এতে তো সোফিয়ার ভি ক্ষোতি হোবে।

—সেজন্যে তো আমি আছি।

—দেখুন, মোহনবাবু, আমাকে ভয় দেখিয়ে কোনো কাম হোবে না, বোরোং আপনার ক্ষোতি হোবে।

—আমার যে ক্ষতি করতে পারে সে এখনও জন্মায়নি রে শালা। এইবার আমি তোর কী হালত করি দ্যাখ।

মোহন রতনের দিকে ফিরে বললে—এই তোর কাছে লাইটার আছে?

—আছে।

—একটা কাজ কর। এই শালার গন্ধী শার্ট, ট্রাউজার, জাঙ্গিয়া—সব বাইরের বাগানে একটা খোলা জায়গায় নিয়ে গিয়ে লাইটার মেরে দে। ছাই করে দিয়ে চলে আয়।

সূরয একটা হুংকার ছাড়ল—রতন, তুমি মোহন নও।

মোহন বললে—রতন, তুই আমার ছাতার তলায় আছিস। তোর টিকি কেউ ছুঁতে পারবে না।

—জানি গুরু, রতন তিনবার মরতে মরতে বেঁচেছে। আমি মরতে ভয় পাই না। সূরযবাবু আজ তুমি নাঙ্গা হয়ে বাড়ি ফিরবে। কেমন লাগবে। তোমার ছেলে দেখবে, মেয়ে দেখবে।

মোহন বললে—তোমার ওপর আরও একটু কাজ হবে। কপালে একটা উল্কি করে দেবো। জীবনে উঠবে না, আর শব্দটা এতই অশ্লীল যে নিজের মুণ্ডু নিজেকেই না কাটতে হয়।

মোহন কথা বলতে বলতে ক্রমশই ভয়ংকর হয়ে উঠছে। এ মোহন সেই মোহন, যে সবকিছু গুঁড়িয়ে দিতে পারে। দু’হাত তুলে অদ্ভুত একটা গলায় বললে—আজ, চতুর্দশী। ওর সভ্যতার খোলস পুড়িয়ে ছাই করে ঘাড় ধরে রাস্তার চৌমাথায় নিয়ে গিয়ে ল্যাম্প—পোস্টে বেঁধে রাখ। ভাবছে, ওই চাদরটা লজ্জা নিবারণ করবে। ওটাও খুলে নেওয়া হবে টান মেরে। সূর্যকুমার! সামনের ইলেকশানে বিধানের পার্টি না কী টিকিট দিচ্ছে তোমাকে? ভেতরের খবরটা বলে দি—পার্টির ভেতরের কোঁদলে বিধান আউট হয়ে যাচ্ছে। এই ছবিগুলো পার্টিরও কাজে লাগবে। রতনে রতন চেনে। দুই মালই আউট। খামে ভরব আর ভেজে দোব।

সূরয—আমার কাছে এখন অত টাকা নেই।

মোহন—কত আছে?

সূরয—দশ, পনেরো হবে। দুটো বিলিতির বোতল আছে।

মোহন—রতনা, ব্যাগটা সার্চ কর।

সূরয বাধা দেবার চেষ্টা করতেই মোহন মারল এক ঝটকা। সূরয পিংপিং বলের মতো ঠিকরে গেল। মোহন হাসছে—

—বেটার অবস্থা দ্যাখ রতন! বেহালার মতো করুণ!

রতন—বেহালা! জায়গা না বাজনা!

মোহন—বাজনা রে বাজনা। আজ পর্যন্ত বেহালায় করুণ সুর ছাড়া কিছু বাজতে শুনেছিস। বেহালা হল ভারতীয় নারী। কান্নার জন্যেই তার জন্ম।

রতন ব্যাগ থেকে প্লাস্টিকে মোড়া ছোটো একটা পুরিয়া বের করে মোহনকে দেখাল—

মোহনদা, মালটা কী?

মোহন—একবার থানায় ফোন কর। বুঝতে পারবে মালটা কী! নারকোটিক্স। দেশের যুবশক্তিকে গোল্লায় পাঠাবার সাদা গুঁড়ো। ভালো মাল পেয়েছিস রতন। ওইতেই বছর দশেক ঘানি ঘোরাবে। মামাদের আদরে ভাগনে ভালোই থাকবে। জরিমানাও হবে যথেষ্ট।

সূরয—উলটোটাও হতে পারে মোহনবাবু। মালটা এখন তোমার হাতে। আমি অস্বীকার করব। পুলিশ তোমাকেও চেনে। আমার চেয়ে ভালো চেনে।

মোহন—চেনা কাকে বলে, জানো তুমি সূরয। দু’রকম চেনা আছে রে মর্কট। প্রকৃত চেনা আর ওপর ওপর চেনা। তবু তোমাকে যাতে চিনতে ভুল না হয়, সে ব্যবস্থা আমি করব কালাচাঁদ। রতন তোর ব্যাগ থেকে একটুকরো কাগজ আর ডটপেনটা বের কর। সূরযবাবু এইবার আমি একটা জিনিস বের করি।

মোহন কোমরের কাছ থেকে একটা রিভালবার বের করল, দু’পা পেছিয়ে গিয়ে একটা টুলে বসল। নলে একটা ফুঁ মেরে সূরযের দিকে তাক করে বললে—যা বলছি, ওই কাগজটায় লেখ—আমি সূরয সিং, আমার নাম মহাবীর সিং। ঠিকানা, ছ’নম্বর নবকৃষ্ণ নন্দী লেন। আমি হেরোইনের চোরা চালানদার। আমার এই ব্যাগ থেকে মোহনলাল যে প্যাকেটটা বের করেছে তার মালিক আমি। হয়েছে লেখা?

সূরয—আমি বাংলা লিখতে জানি না।

মোহন—একটি থাপ্পড়ে তোমার বদন ঘুরিয়ে দেবো রাসকেল। যা বলছি লেখ—শালা, বরাহনন্দন।

সূরয—তুমি আমায় গুলি করতে পারবে না। গুলির শব্দে লোক ছুটে আসবে। আমি মরে গেলে তোমাকে পুলিশে ধরবে। তোমার ফাঁসি হবে। এটা হিন্দি সিনেমা নয় মোহনলালবাবু!

মোহন সিলিং ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে রতনকে বললে—

ওর গায়ের চাদরটা খুলে নিয়ে পাকিয়ে পাখার হুকে বাঁধ। একটা ফাঁস তৈরি কর। বহুত ভ্যানতাড়া হয়েছে। চল, ঝুলিয়ে দিয়ে থানায় যাই। একটা এফ আই আর করে আসি। সোফিয়াকে রেপ করছিল, আমরা দেখে ফেলায়, ব্যাটা পেটাইয়ের ভয়ে ঝুলে পড়েছে।

সূরয বললে—কেন অত ঝামেলা করছ মোহনলাল। তোমার অনেক ক্ষমতা, অনেক খুন করেছ তুমি, সব আমি জানি। তবু আমি তোমাকে খুব পছন্দ করি। আমি জানি, তুমি ইচ্ছে করলে আমাকে ছারপোকার মতো টিপে মেরে ফেলতে পারো। আমার অনেক পাপ। এখানে আসা আমার উচিত হয়নি। আমার অন্যায় হয়েছে। এইবার তোমার যা ইচ্ছে হয় আমাকে করো। তোমার কাছে সারেন্ডার করলে তুমি অপরাধীকে ক্ষমা করো, তা আমি জানি। আমি এমন কাজ আর কখনও করব না মোহনলাল। আজ থেকে তোমার সঙ্গে আমার কোনো শত্রুতা রইল না। আজ থেকে আমি তোমার বন্ধু। তুমি আমাকে ভালো হওয়ার সুযোগ দাও।

মোহন—সত্যিই তুমি আমার বন্ধু হতে চাও?

সূরয—জরুর! আমার জবানের দাম আছে।

মোহন—তাহলে বলো, এই সাদা গুঁড়োর পেছনে কে কে আছে?

সূরয—আমি তোমাকে বলব, তবে আজ নয়। আমাকে আরও একটু জানতে হবে। আমি ছুটকোগুলোকে জানি, আসল রাজা কে জানতে পারিনি। তোমার মতো আমিও জানতে চাই, খতম করে দিতে চাই। আমার ব্যাগে পঁচিশ হাজার আছে, সোফিয়াকে দিয়ে দাও। আজ থেকে সোফিয়া আমার বন্ধু। ছবিগুলো তোমার কাছেই থাক, তাতে তোমার কাছে আমার টিকি বাঁধা থাকবে। আমি তোমার দুশমন না দোস্ত, আগে প্রমাণ করি। তুমি মনে রেখো, ওই ছবিতে সোফিয়া ভি আছে। এইবার তুমি আমার লজ্জা ফেরত দাও।

মোহন—রতন। ওর জামা, প্যান্ট ফেরত দে।

রতন—গুরু। তুমি বিশ্বাস করে বিপদে পড়বে!

সূরয তার ব্যক্তিত্ব ক্রমশই ফিরে পাচ্ছে। যতই হোক, সূরযেরও পাওয়ার আছে। টাকা আছে। নেতাদের টাকা খাওয়ায়। একগাদা গুন্ডা পোষে। ব্যঙ্গের গলায় রতনকে বললে—

—আরে এই ফোটোওয়ালা, রাজায় রাজায় কথা হচ্ছে দোস্ত। তুমি একটু চুপ থাকো। এ তোমার অন্ধকারে তসবির খ্যাঁচা নয়। এ ইস্যুটা অনেক বড়ো, ইন্টারন্যাশনাল।

সতেরো


ক্লান্ত মোহনলাল মাধুরীদের বাড়ির সামনে বাইক থেকে যখন নামল, তখন গভীর রাত। হাওয়া ঘুরে গেছে। তারাদের স্থান পরিবর্তন হয়েছে। হেডলাইটের আলোয় ফাঁকা রাস্তা একঝলক দেখা গেল। মাধুরীদের বাড়ির ভেতর থেকে সেতারের মিহি আলাপ ভেসে আসছে। মোহন অন্ধকারে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপরে আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে, তিন ধাপ সিঁড়ি ভেঙে কলিংবেল টিপল। সেতার আর বেল একসঙ্গে বাজছে। সেতার থেমে গেল। দরজা খুলল মাধুরী।

মাধুরী—এ কী! এত রাতে তুমি কোথা থেকে এলে?

মোহন—তোকে বড়ো দেখতে ইচ্ছে হল।

মাধুরী—দেখে তো মনে হচ্ছে একেবারে বিধ্বস্ত।

মোহন—সারাজীবন ছ্যাঁচড়ামি করতে করতে আমি ছিবড়ে হয়ে গেলুম। কিছু খেতে দিবি রে!

মাধুরী—তুমি হাত—মুখ ধোবে তো।

মোহন—আরে ধুস। আমি এই বারান্দায় আমার বেতের চেয়ারটায় বসছি। তুই কুড়িয়েবাড়িয়ে যা পাস নিয়ে আয়। পেটে আগুন জ্বলছে।

মাধুরী—ও শোনো, ভাগ্যিস মনে পড়ল—একটা উটকো ছেলে এসে তোমার নামে একটা চিঠি দিয়ে গেছে।

মোহন—এখানে?

মাধুরী—হ্যাঁ, এখানে।

মোহন—তার মানে সকলেই জেনে গেছে, এইটেই আমার বাড়ি। যাব্বাবা! যার কোনো চালচুলো নেই, দালান—কোঠা ফেলে দিয়ে যার শ্মশানে বৈঠকখানা, পাবলিক তার মাথার ওপর ছাত তৈরি করে দিলে! দে, দে, চিঠিটা দে। নিশ্চয় জরুরি। তুই খুলে দেখিসনি?

মাধুরী—তোমার চিঠি, তোমার অনুমতি ছাড়া পড়বো কেন?

মোহন—সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে?

মাধুরী—পড়বে না! রাত কত হল বলো তো!

মোহন—তুই কেন জেগে আছিস?

মাধুরী—যদি বলি তোমার জন্যে!

মোহন—শোন, তুই আর আমাকে দুর্বল করে দিস না। যা, চিঠিটা নিয়ে আয়।

মাধুরী—এই বারান্দাতেই থাকবে? ভেতরে আমার ঘরে আসবে না?

মোহন—তুই একটা আইবুড়ো মেয়ে, আমি একটা আইবুড়ো ছেলে। এই গভীর রাত, সবাই ঘুমুচ্ছে, রাস্তায় দাঁড়িয়েই কথা বলা উচিত ছিল। বারান্দা পর্যন্ত এসেছি, এইটাই তো যথেষ্ট দুঃসাহস।

মাধুরী—যাকে দেখে পাড়ার সমস্ত লোক কাঁপে, সে নিজে এত ভীতু! তুমি যখনই কলিং বেল বাজিয়েছো, জেনে রাখো, বিছানা না ছাড়লেও সবাই জেগে আছে।

মোহন—শোন বাঘকে সবাই ভয় পায়; কিন্তু তুই যদি বাঘের সামনে ভটাস করে একটা ছাতা খুলিস, বাঘ ভয়ে পালাবে। আমি মানুষকে মেরে চৌপাট করে দিতে ভয় পাই না; কিন্তু মেয়েদের প্রেমকে ভয় পাই। ওর চেয়ে ভয়ংকর ফাঁস পৃথিবীতে আর কিছু নেই।

মাধুরী—যে এত ভালো গান গায়, তার ভেতরে প্রেম নেই, এ—কথা কেউ বিশ্বাস করবে!

মোহন করুণ গলায়—ভীষণ খিদে পেয়েছে রে।

মাধুরী ভেতরে চলে গেল। বারান্দার আলো—আঁধারিতে বসে আছে মোহন। হুকে হুকে ঝুলছে অর্কিডের টব। মোহনের পাশে একটা সেন্টার টেবল, অ্যাশট্রে। কে একজন সামনের পথ দিয়ে যেতে যেতে কাশছে।

মোহন জিজ্ঞেস করলে—কে যায়?

পথিক জড়ানো গলায়—কে কয়?

মোহন গলা শুনে চিনতে পেরেছে—আরে হারুদা।

হারু জড়ানো গলায় বললে—এই তো রতনে রতন চেনে, ভাল্লুকে চেনে শাঁকালু। এত রাতে এই ঠেকে কী করছ বাওয়া! এটা কী তোমার কাফেটেরিয়া?

মোহন গলা নকল করে—বিরিয়ানি খাচ্ছি বাওয়া।

হারু—যার যেমন বরাত! তুমি খাচ্ছ বিরিয়ানি, আমি খাচ্ছি বিড়ি।

মোহন—কতটা চড়িয়েছ?

হারু—রোজ যা চড়াই।

মোহন—মাতাল হয়ে গেছ, বাড়ি যাও।

হারু—বাড়ি, বাড়ি, বাড়ি।

হারু সুন্দর সুরেলা গলায় গান ধরল—ভালোবাসা মোরে ভিকিরি করেছে, তোমারে করেছে বাড়িউলী। ঢুকলেই মুড়ো ঝ্যাঁটা, সারারাত চুলোচুলি।

মোহন—হারুদা, বাড়ি যাও প্লিজ।

হারু—দ্যাখ মাইরি। ইংরিজি বলে অত খাতির করিসনি। বলো—এই শালা হারু বাড়ি যা। হ্যাঁগা, তুমি কে?

মোহন—তোমার মতোই এক পথহারা পথিক।

হারু—তা পথে নেমে এসো ভাই, গলা জড়াজড়ি করে গান গাই।

হারু গান গাইতে গাইতে অন্ধকার থেকে আরও অন্ধকারে চলে গেল। মাধুরী সেন্টার টেবিলে প্লেট, চামচ রাখছে। সামান্য টুং টাং শব্দ। মোহন মাধুরীকে দেখছে। মায়া আসছে, ভালোবাসা জাগছে। শক্ত, উন্মত্ত পৃথিবী ক্রমশ নরম হচ্ছে। মাধুরীকে স্পর্শ করার, আদর করার বাসনা হচ্ছে। কোথাও, কোনোখানে নতুন একটা জীবন শুরু করার ইচ্ছে।

মাধুরী বললে—এই নাও সেই চিঠি।

মোহন—তুই পড়। আমি ততক্ষণ খাই।

মাধুরী আলোর দিকে সরে গিয়ে চিঠি পড়ছে,

‘মোহনদা, আমি খোকন। কাদের বক্স লেনের সাত নম্বর বাড়ির চিলেকোঠায় লুকিয়ে আছি। এ পাড়ায় মেয়েটার নাম ডলি। তুমি কাল দুপুরে একবার যদি আসো। তোমাকে সব কথা বলে হালকা হতে চাই। দয়া করে আশ্রয় দিয়েছে দেবীর মতো এই মেয়েটি। তুমি অবশ্যই আসবে। খোকন।’

মাধুরী বললে—খোকনের চিঠি। বেঁচে আছে। যাক বাবা।

মোহন বললে—কতদিন বাঁচবে! যাক, কাল যা হয় হবে। কী রেঁধেছিস মাধুরী! আগের জন্মে সিয়োর তুই দ্রৌপদী ছিলিস।

মাধুরী—খিধের মুখে সবই ভালো।

মোহন—তুই সব তুলে নিয়ে যা। এইখানটায় আমি একটু আরাম করি।

মোহন বেতের চেয়ারে শরীরটাকে সামনে ঠেলে দিয়ে ঘাড়টাকে বাঁদিকে হেলিয়ে তার সেই বিচিত্র ভঙ্গিতে নিমেষে চলে গেল ঘুমের জগতে। স্বপ্ন দেখছে। সেই একই স্বপ্ন। রোজ আসে। বিরাট এক বটগাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছেন তার মা। পেছনে একটা নৌকো ঢেউয়ের দোলায় দুলছে।

মোহন—মা, তুমি কখন এলে?

মা—দেখতে এলুম, তুই কেমন পিকনিক করছিস?

মোহন—এই দেখ না মা, উনুন ধরছে না, বারে বারে নিবে যাচ্ছে।

মা—দাঁড়া, ওটা তোর কাজ নয়। আমি সূর্যের কাছ থেকে আগুন আনি।

মোহন—সে তো অনেক দূরে মা, তুমি কাছে গেলে ছাই হয়ে যাবে।

মা—আমি তো ছাই হয়েই গেছি।

ঘাট থেকে নৌকো খুলে গেল। মা ভেসে যাচ্ছেন মাঝ—নদীর দিকে।

মোহন চিৎকার করে বলছে—মা, আমাকে নিয়ে যাও। এ জীবন আমার ভালো লাগছে না।

মা দূর থেকে বলছেন—তোর এখনও সময় হয়নি। অনেক বাকি। পথটা দেখে রাখ, সময় হলে চলে আসিস চিনে চিনে।

নদী, ঢেউ, দিগন্ত, জনপ্রাণীহীন বিস্তার। বাস্তবে মোহন অন্যকে কাঁদায়, স্বপ্নে সে নিজে কাঁদে।

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress