প্রিয়তমাসু
সম্প্রতি পত্রিকান্তরে আমার দুই পুরনো বন্ধুর তথা বিখ্যাত কবির জায়াদ্বয় তাঁদের নিজ নিজ পতিদেবতা সম্পর্কে কিছু কিছু কথা সরলভাবে বলেছেন। এই সাক্ষাৎকারের কথা আগেই কানে এসেছিল এবং কিঞ্চিৎ চিন্তিত ছিলাম মহীয়সী মহিলাদ্বয় কী বলবেন বা বলতে পারেন এই ভেবে। সুখের বিষয় সাক্ষাৎকার দুটি প্রকাশিত হবার পর আমাদের বুক থেকে পাষাণভার নেমে গেছে। না, ভদ্রমহিলারা কবি স্বামীদের মুখরক্ষা করেছেন, মারাত্মক কিছু বলেননি। বরং স্বীকার করা ভাল, পড়ে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয়েছে যে স্বামী ও সংসার নিয়ে তাঁদের বিশেষ কোনও গর্হিত অভিযোগ নেই, তাঁরা মোটামুটি সন্তুষ্ট।
কিন্তু যদি বিপরীত হয় ! যদি কোনও দুঃসাহসী সম্পাদক বা সম্পাদিকা বিখ্যাত ব্যক্তিদের অনুরোধ করেন তাঁদের স্ত্রী-সংসার ইত্যাদি বিষয়ে অকপটে বলতে, তা হলে কী হত ? খ্যাতনামা ভদ্রলোকেরা কি দু’-চারটি রোমহর্ষক কিংবা বিপজ্জনক উক্তি তাঁদের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলতেন না ?
হয়তো বলতেন, হয়তো বলতেন না। কিন্তু এই ভূমিকা বা অবতরণিকার সুযোগে কাণ্ডজ্ঞানের অনতিবিখ্যাত, হতভাগ্য লেখক তাঁর স্ত্রীর আচরণ সম্পর্কে আপামর পাঠক-পাঠিকাকে সাম্প্রতিক একটি ঘটনা জানাতে চান।
(এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পরদিন যদি কোনও কারণে আমার মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা, বাঁ হাতে প্লাস্টার করা দেখেন, দয়া করে জানবেন বাথরুমে পা পিছলে পড়ে গিয়ে আমার ওই অবস্থা হয়েছে। তিনি মোটেই দায়ি নন।)
গত পরশুদিন সন্ধ্যাবেলা অফিস থেকে বাড়ি ফিরে সামান্য বিশ্রাম করে ডাক্তারি নির্দেশানুযায়ী যথারীতি সান্ধ্যভ্রমণে বেরিয়েছি। হেঁটে যখন বাড়ি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের অপর প্রান্তে পৌঁছেছি, তেড়ে বৃষ্টি এল, সঙ্গে জোর বাতাস। কাছাকাছি কোথাও মাথা বাঁচানোর সামান্য আশ্রয় নেই। বেশ জোরে হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে বাড়ি আসার পথে একটি বিদ্যুৎ অথবা টেলিফোন অথবা জল সরবরাহ অথবা পাতাল রেল অথবা ওরিয়েন্টাল গ্যাস অথবা সড়ক বিভাগের প্রাচীন গর্তে পড়ে যাই এবং কোনওরকমে আত্মরক্ষা করে সারা গায়ে জলকাদা মেখে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাড়ি ফিরি।
আমার স্ত্রীর অবশ্যই উচিত ছিল আমাকে দেখে ‘আহা, উহু’ করা, আমার কাছে জানতে চাওয়া কী করে কোথায় আমার এই পরিণতি হল, তারপর শুকনো তোয়ালে দিয়ে আমার মাথা মুছে দেওয়া, শুকনো লুঙ্গি-গেঞ্জি এগিয়ে দেওয়া এবং নিতান্ত এককাপ ধূমায়িত আদা-চা-আমার জন্যে তৈরি করে আনা।
হা কপাল ! তার বদলে ভদ্রমহিলা আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই খেপে গেলেন, ‘তুমি এই জল-কাদা নিয়ে ঘরের মধ্যে এলে ? তুমি ও রকম এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছ কেন ? এ-ঘরের জলকাদা কে মুছবে ?’ তারপর আমার হতভম্ব পরাস্ত চেহারা, নিরুত্তর মুখ দেখে কেমন একটু নরম হয়ে গেলেন, বললেন, ‘তুমি কি কোনওকালে মানুষ হবে না, এ রকম চিরটাকাল ধরে করে যাবে ? সব সময় জলকাদা নিয়ে ঘরে ঢুকবে ?’
চিরকাল মানে কতকাল ? সবসময় মানে কত সময় ? আমার এই মুহূর্তে মনে পড়ছে শেষবার বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি এসেছিলাম সাত বছর আগে উনিশশো ছিয়াত্তর সালে। সেটাও গিয়েছিলাম কলেজ স্ট্রিটে জুতোর দোকানে। আগের দিন স্ত্রী একজোড়া চটি কিনেছিলেন সেখান থেকে, অনেক দেখেশুনেই কিনেছিলেন কিন্তু বাড়ি এসে দেখা যায় এক সাইজ ছোট হয়েছে। সেটা সকালবেলায় পালটিয়ে এক সাইজ বড় নিয়ে এসেছিলাম, কিন্তু সন্ধ্যাবেলায় স্ত্রী বললেন, ‘আগের সাইজটাই বোধ হয় ঠিক ছিল, এটা কেমন বড় বড় ঠেকছে।’ সেই দ্বিতীয় জোড়াটা পালটিয়ে প্রথম জোড়াটা পুনরুদ্ধার করতে গিয়েছিলাম। পুনঃ পুনঃ জুতো পালটানোর প্রক্রিয়াটি স্বভাবতই সম্মানজনক নয়। তদুপরি সেদিনও রাস্তার জলকাদা ঘরে বয়ে নিয়ে আসার জন্যে আজকের মতোই অভ্যর্থনা পেয়েছিলাম।
কিন্তু এসব নিয়ে দুঃখ করে লাভ নেই। আমার স্ত্রী তো আমাকে মারতেও পারতেন। ভেজা নতুন জুতো জোড়া তাঁর হাতেই ছিল কিংবা ইচ্ছে হলে পুরনো কিছু দিয়েও প্রহার করতে পারতেন। তা তিনি করেননি বরং ফেরত আনা আগের জুতোজোড়া পায়ে দিয়ে অনেকক্ষণ হেঁটে হেঁটে দেখলেন, ছোট হল, বড় হল, না ঠিক হল !
আতলান্তিক তীরের এক শহরে শুধুমাত্র পুরুষ মদ্যপায়ীদের একটা দশাসই পাবের দেয়ালে অনেককাল আগে একটা আবেদন দেখেছিলাম। সুরা-রসিকদের প্রতি পাব-মালিকের অনুরোধ, ইংরেজিতে একটি ছড়া, কাঁচা বাংলায় যার অনুবাদ এ রকম হতে পারে—
‘বাড়ি ফিরেই সেই তো আজও
বৌয়ের হাতে খাবেন মার,
বরং সখা, থাকুন না কেন,
থাকুন কিছুক্ষণটা আর।’
বলা বাহুল্য, এই নোটিশের গুণেই হোক কিংবা অন্য কারণেই হোক, সেই পাবে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিড় বাড়ত, ভিড় কিছুতেই ভাঙতে চাইত না।
সে যাই হোক, বিলেতে কিন্তু আজকাল মেমসাহেবরা খুব বেশি মারধোর, খারাপ ব্যবহার করেন না স্বামী দেবতাদের সঙ্গে। কারণ আর কিছুই নয়, অধিকাংশ স্বামীই পালানোর জন্যে প্রস্তুত। এখন আর নতুন সাহেব বর জোগাড় করা খুব সহজ নয়। আগে বউরাই পালাত, আজকাল নাকি সাহেব স্বামীদেরই পালানোর দিকে বেশি ঝোঁক।
তবে আমাদের দেশে ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। স্বামীরা পালাবে কোথায়, পালিয়ে কোথায় যাবে ! ভাল করে খোজ নিলে দেখা যাবে এক হাজার বউ পালানোর ঘটনার বিনিময়ে একটি মাত্র বর পালানোর নজির হয়তো পাওয়া যাবে।
তবে একটা গল্প শুনেছিলাম, কে একজন মধ্যবয়স্কা অনূঢ়া মহিলা সহসা বিয়ে করার জন্যে উৎসাহী হয়ে খবরের কাগজে ‘স্বামী চাই’ বলে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন, কয়েক হাজার চিঠি পেয়েছিলেন তিনি, কিন্তু একটিও কোনও পুরুষমানুষের কাছ থেকে নয়। হাজার হাজার বিবাহিতা মহিলা তাঁদের স্বামীর ফটো পাঠিয়ে, গুণগান করে পত্র দিয়েছিলেন, একটিই অনুরোধ ‘তুমি আমার স্বামীকে নাও।’
এরই বিপরীত দিকে আমার এক বান্ধবী একবার তাঁর স্বামীকে অনুরোধ করেছিলেন, তুমি কাগজে কাগজে বিজ্ঞাপন দাও, ‘বিবাহযোগ্যা স্ত্রী আছে’, এই বলে।
কে এক নাক উঁচু চিরকুমার কোনও অভিজ্ঞতা বিনাই একদা বলেছিলেন, ‘বিবাহ একটি রোমাঞ্চকর কাহিনী যার প্রথম পরিচ্ছেদ শুরু হয় নায়কের মৃত্যু দিয়ে।’ আমার অবশ্য কুড়ি বছরের অভিজ্ঞতা কিন্তু এত বড় কথা বলার সাহস আমার নেই। তবে আমি নিপীড়িত, নির্যাতিত স্বামীদের একটি স্তোকবাক্য উপহার দিতে পারি রাশিয়ান কাহিনী থেকে ধার নিয়ে, ‘হে ভদ্রলোক, আপনার ছেলেটি আপনাকে যত বড় হিরো ভাবছে, আপনি হয়তো সত্যিই তা নন, কিন্তু আপনার স্ত্রীরত্নটি আপনাকে যত বড় বোকা ভাবছেন আপনি তাও নন।’
আর তা ছাড়া সদাসর্বদা স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করলে ক্ষতিই হবে এমন কোনও কথা নেই। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অভিধানকারকে তাঁর অভিধান রচনার জন্যে ভূয়সী প্রশংসা করে একজন জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘এই আশ্চর্য অভিধান, এত বিচিত্র সব শব্দ আপনি কী করে সংগ্রহ করেছেন ?’ অভিধানকার মৃদু হেসে বলেছিলেন, ‘বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে।’ এই উত্তরে প্রশ্নকারীর বিমূঢ় মুখশ্রী দেখে অভিধান রচয়িতা ব্যাখ্যা করেছিলেন, ‘সারা দিনরাত পঁচিশ বছর ধরে ঝগড়া করে, কথার পিঠে কথার পর কথা সাজিয়ে সাজিয়ে এত শব্দ আমার আয়ত্তে আসে।’
তবু ঝগড়াঝাঁটি হোক কিংবা যাই হোক, বেশি দিন বিয়ে হয়ে গেলেই যে পত্নীর প্রতি ভালবাসা থাকে না তা নয়। আমার এক প্রৌঢ় সহকর্মী প্রায় প্রতিদিনই সকালবেলায় বাড়িতে ঝগড়া করে এসে অফিসে আমার কাছে খিটমিট করে স্ত্রীর বিষয়ে রাগারাগি করতেন। সেই ভদ্রমহিলা একবার দিন কয়েকের জন্যে স্বামীকে রেখে কী একটা বিয়ে-টিয়ে উপলক্ষে কলকাতার বাইরে গেছেন। দিনটা বোধ হয় ছিল শুক্রবার। শনি-রবিবার ছুটির পরে ভদ্রলোক সোমবার অফিসে এলেন। প্রৌঢ় বয়সের বিরহ, ভদ্রলোক কেমন যেন চুপসে গেছেন। আমি জিজ্ঞাসা করি, ‘কী হল মিস্টার ধরচৌধুরী ?’ দেখলাম মিস্টার ধরচৌধুরী শুধু চুপসেই যাননি, তাঁর মুখ দিয়ে স্বর বেরচ্ছে না ভাল করে, জড়িয়ে জড়িয়ে বললেন, ‘আর বলবেন না, আজ আড়াই দিন খাওয়া-দাওয়া প্রায় বন্ধ।’ আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘সেকী, মিসেস ধরচৌধুরী সামান্য চোখের আড়াল হতে আপনি খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছেন !’ মিস্টার ধরচৌধুরী বললেন, ‘উপায় নেই। মিসেস যাওয়ার সময় ভুল করে তাঁর নিজের জিনিসপত্রের ভিতরে আমার বাঁধানো দাঁতজোড়া নিয়ে চলে গেছেন’, বলে দন্তহীন মাড়ি কিড়মিড় করার চেষ্টা করলেন।