প্রাকার পরিখা – 02
ছয়
মশারির ভেতরে শুয়ে ডাক্তার স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলো ঝিঁঝি-পুরুষরা ডানা কাঁপিয়ে বলে চলেছে, জবাব নাই ঝিঁঝিঝিঁঝি জবাব নাই ঝিঁঝিঝিঁঝি জবাব নাই ঝিঁঝিঝিঁঝি জবাব নাই ঝিঁঝিঝিঁঝি জবাব নাই ঝিঁঝিঝিঁঝি জবাব নাই ঝিঁঝিঝিঁঝি জবাব নাই ঝিঁঝিঝিঁঝি জবাব নাই ঝিঁঝিঝিঁঝি জবাব নাই….
১৭৮৯ সাল থেকেই তো যুবকেরা, যখন মানুষ যুবক থাকে, সেই বয়সে, প্রতিষ্ঠানকে বদলাবার জন্যে মতাদর্শের আশ্রয় নিয়ে খুনোখুনি করবেই, তুমি কোন বদলকারীর দলে তাতে কিচ্ছু এসে যায় না । তুমিও তোমার শত্রুর আদলে গড়ে উঠবে । তোমার প্রজন্ম চলে যাবে, তারপর আরেক প্রজন্ম এসে বদলাবার চেষ্টা করবে । অথচ দুই পক্ষই জানে যে প্রথিবীর একটা বালও তুমি ওপড়াতে পারবে না ।
বিপ্লব হলো একধরণের বৃত্ত, সুতো দিয়ে তৈরি ।
বিপ্লব হলো শাঁখের করাত, দুদিকেই কাটে ।
চিন্তার কুয়াশায়, ডাক্তার ঘুমিয়ে পড়লো বুকে দুই হাত রেখে, যেমনটা লেনিনের দেহকে মলম মাখিয়ে শুইয়ে রাখা হয়েছে, যাতে রুশ দেশের মানুষ, তাঁর পেল্লাই মূর্তিগুলো উপড়ে ফেলে দিলেও, তাঁকে না ভুলে যায়।
মানসী ঈশ্বরে বিশ্বাস করে ; বন্দুকের নলের ক্ষমতায় বিশ্বাস করে ; একই সঙ্গে দুজন পুরুষকে ভালোবাসায় আর বিশ্বাস করে, এককালে দুজনের সঙ্গে একই দিনে সেক্স করায় বিশ্বাস করতো ।
সাত
ফুলশয্যার বিছানায়, ডাক্তারের ডাক, ওকে, শুরু করা যাক ।
কাজ হয়ে গেলে স্বামী পাশ ফিরে শোবার তোড়জোড় করছে দেখে মানসী বলল, দাঁড়াও, এক্ষুনি ঘুমোতে চললে কেন । পিঁড়িতে বসে তো অনেক সংস্কৃত মন্ত্র আউড়ে ছিলে পুরুতের কথামতো ; তারপর আমার শরীরের পিঁড়িতে বসে দেহের মন্তর ভাঁজলে । এবার আমার মন্তর ভাঁজার পালা, তোমার দেহের পিঁড়িতে বসে । তোমার হয়ে গেলেই হলো ? আমারও তো হওয়া দরকার, নাকি ?
ঠিক আছে, বোসো, বলো কী মন্তর বলতে চাও ।
বসি আগে ; একি ফসকে যাচ্ছে কেন ? মন ভরে গেল আর ব্যাস, তোমার মন অন্য দিকে চলে গেল।
আমি ফসকাচ্ছি নাকি ? পিঁড়িতে তো তুমি বসে আছো ।
দাঁড়াও, যুত করে বসি, হ্যাঁ, এইবার, আমার চোখে চোখ রেখে দ্যাখো ।
সক্রিয় হও, নয়তো ফসকাবে ।
এখানে যে ফিসফিসিনি-গুজগুজুনি ছাত্র-রাজনীতি করো, তা বিদেশে গিয়ে করা চলবে না, ফিরে এসে যে দলের ঝাণ্ডা চাও দেশে এসে ওড়াবে, ওদেশে নয় ।
ফসকে যাচ্ছে, বক্তৃতা দিতে গিয়ে ভুলে যাচ্ছ, এখন সক্রিয় হও , পরে না হয় বক্তৃতা দিও । মনে করো দিকিনি যে তুমি ঘোড়ায় চেপে বেড়াতে যাচ্ছ আর ঘোড়াটা দুলকি চালে হাঁটছে ।
ইশশ…দুলকি চাল চাই ওনার, এই নাও রাজধানী এক্সপ্রেসের চাল । কী ? হল তো ?
কই ! হয়নি । ওপর থেকে নামো, আমি ট্রাই করি ।
না, ওপরে বসে কথাগুলো বললে তোমার মনে থাকবে, নয়তো বিদেশে গিয়ে ভুলে মেরে দেবে কী কী বলেছি, ওদেশে মেমগুলো আদেখলা ।
বলো, হেল্প করব ?
না, আমার গায়ে যথেষ্ট জোর আছে, তুমি পিঁড়ি হয়ে চুপ করে থাকো । টগবগ টগবগ, টগবগ টগবগ, টগবগ টগবগ, টগবগ টগবগ, কী ? এখন কেমন । এবার ঘোড়াকে ছোটাচ্ছি কিন্তু, রেডি স্টেডি গো । আমার সঙ্গে ইয়ার্কি, না ? স্হির থাকো, নট নড়ন-চড়ন ।
রইলাম ।
মারো জোয়ান হেঁইও, জোরসে মারো হেঁইও, সাবাশ জোয়ান হেঁইও, মানসী জড়িয়ে ধরে ডাক্তারকে ।
ডাক্তার বলে ওঠে, কী হলো, ও মাঝি তোর হাল শক্ত করে ধর ।
ঠিক আছে, আবার মর্নিং শো ।
অ্যাজ ইউ প্লিজ ।
বিদেশে ঠিক মতন পড়াশুনা কোরো, রাজনীতি করার লোভে কোনো মেয়ের পাল্লায় পোড়ো না যেন, শেষে রোগবালাই হবে, আমি সামলাতে পারব না । রাজনীতি করতে হয় তো কার্ল মার্কসের কবরে গিয়ে প্রার্থনা কোরো যে মেডিকাল পরীক্ষায় যেন ভালো রেজাল্ট হয়, দেশে বউটা একা পড়ে আছে, দেশে ফিরে প্রয়োজন হলে ফিসফাস-রাজনীতি বা দলীয় রাজনীতি যা হয় করব ।
যাই তো আগে ; সত্যি ওখানে গিয়ে ফলাফল ভালো করতেই হবে, নয়তো বাবার রেখে যাওয়া টাকা নয়ছয় করা হবে, মা তা সহ্য করতে পারবেন না ।
প্রেমপত্র লিখো না ; প্রেমপত্র পেয়ে-পেয়ে ঘেন্না ধরে গেছে । সাদামাটা কথা লিখবে, ফোন করবে।
পিঁড়ির কাজ সমাধা করে ফেলেছ ? কাঁপছো দেখছি ! আর কিছু বলার আছে ?
যাওয়া না পর্যন্ত প্রতিরাতে একবার আমি পিঁড়ি হব, একবার তুমি পিঁড়ি হবে ।
একবার কেন ?
একবার হল কথার কথা ।
ভার্জিনিটি যাচাই করে, একে আরেকের কৌমার্যের সিল ভেঙে, হবু ডাক্তার চলে গেলো লণ্ডনের রয়াল কলেজ অফ রেডিওজিতে ডাক্তারি পড়তে ।
কোর্স পুরো করে ফেরার আগেই লণ্ডনে বসে শুনলো, স্ত্রী মানসী একাকীত্ব কাটাবার, আর শাশুড়ির উঠতে-বসতে উপদেশ এড়াবার জন্য চাকরি নিয়ে চলে গেছে পাটনা । শুনে, ডাক্তারের মনে হল, মানসীর কথা না শুনে, একটা বাচ্চা পয়দা করে বা বউকে প্রেগনেন্ট করে বিদেশে গেলে, বউয়ের একাকীত্বের নিদান দিয়ে যেতে পারা যেতো। বউ একা কী করে প্রেগনেনসি সামলাবে, ওর অবর্তমানে বাচ্চা হলে, কোলের শিশুকে কে সামলাবে, মাকে কে দেখবে, কচি বয়সের দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত হয়ে মানসীর কথামত বাচ্চা মুলতুবি রাখার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গিয়েছিলো ।
শাশুড়ির সঙ্গে সংঘর্ষ হবারই ছিল, দুজনেই বড্ডো বেশি কথা-কইয়ে ।
ডাক্তার কলকাতায় ফিরলো, মানসী কলকাতায় ফিরলো না, করকরে মাইনের এমন অভ্যাস হয়ে গিয়েছে, বলেছিলো মানসী, তুমিই এসো যখন মন কেমন করবে, শরীর ছোঁকছোঁক করবে । দেড় বছরের মাথায় মা মারা গেলেন, তবুও মানসীর ফেরার ইচ্ছা হল না, বললো, এই তো বেশ চলছে, তুমি তো সপ্তাহে একদিন আসছ, আমিও বড়ো ছুটি পড়লে যাচ্ছি , কারোর তো অসুবিধা হচ্ছে না । মানসীকে ডাক্তার বলে ফেলেছিলো যে সপ্তাহে একদিন এসে মন ভরে না, রোজ দুবেলা সেক্স করার ইচ্ছে হয় ।
মানসী বলেছিলো, ডাক্তারের থুতনি ধরে, যে ওরও অমন ইচ্ছে হয়, কিন্তু কি আর করা যাবে, উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে এমন মাইনের চাকরি পাওয়া যায় না, অফিস কোয়ার্টার দিয়েছে, চাইলে নানা রকম লোন দ্যায়, কতো সুবিধা । ডাক্তার যে রাতটা থাকতো, যতবার পারতো সেক্স করতো দুজনে । সপ্তাহ-শেষে, প্লেনে সন্ধ্যায় পোঁছে পরের রাতে ট্রেনে যাতায়াত, ক্লান্ত দেহে আনন্দ নেবার মতন আহ্লাদ ভরপুর থাকত না ।
একটা রাত আর দিনের জন্য ঢুঁ মারতো, লুকিয়ে, যাতে কেউ না ওকে দেখে ফ্যালে । ইনটারভিউ দেবার সময়ে টেবিলের ওদিকে বসে থাকা তিন মাঝবয়সী সাক্ষাৎকার-গ্রহণকারীর মুখ দেখেই মানসী আঁচ করে ফেলেছিল যে এরা যেভাবে তাকাচ্ছে, টেবিলের তলা দিয়ে নিজেদের বিরাট বিরাট অ্যানাকোণ্ডা সাপকে ওর দিকে পাঠিয়ে সাপটে জড়িয়ে ধরার জন্য লড়ে মরছে । চাকরিটা পেতে হলে বিয়ে হয়ে গেছে বলা চলবে না, চাকরির দরখাস্ততেও জায়গাটায় তাই টিক দেননি, এর আগের ইনটারভিউয়ের অভিজ্ঞতা থেকে । অ্যানাকোণ্ডা তিনটে ওর গলা জড়িয়ে ধরে দমবন্ধ করে বলিয়ে নিল যে, না, বিয়ে করিনি এখনও । অফিসের সকলে জানে মানসী বর্মণ অবিবাহিত । বর লুকিয়ে এসে জমানো ফোঁটাগুলো ফেলে লুকিয়ে চলে যায়, তা কেউ জানে না।
মানসী যখন প্রেগন্যান্ট হলো, তখন অফিসের ননীগোপাল বসু আর তাঁর মুসলমান স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে রটিয়ে দিতে হল যে ননীবাবুর স্ত্রীর জরায়ুর সমস্যার কারণে মানসী ওনাদের বাচ্চার সারোগেট মা হতে রাজি হয়েছে । প্রেগন্যান্ট হয়েছে শুনে আনন্দে আটখানা আর কাজে অন্যমনস্ক ডক্টর ঘোষ তার হাসপাতালে এক বিপর্যয় ঘটিয়ে বসলো, আর মানসীর নির্দেশমতো কলকাতার বাড়িতে তালা ঝুলিয়ে, মানসীর অফিসের চাপরাসি রাজনৈতিক কর্মী রসিক পাসোয়ানের সঙ্গে পাটনা স্টেশানে যোগাযোগ করে ডাক্তার পালালো ওয়ারিস আলি গঞ্জের দাতব্য চিকিৎসালয়ে । রসিক পাসোয়ান লোকটা মানসীর অফিসেরই চতুর্থ শ্রেণির কর্মী, গরমকালেও মাথায় সর্ষের তেল চুপচুপে, অফিসের দেয়া পোশাকেও কলার তেলে চিটচিটে, মুখময় পানিবসন্তের শ্রীছাঁদ, ডান হাতের তর্জনী অর্ধেক কাটা । পরে জেনেছিলো ডাক্তার ঘোষ, আঙুল সে নিজেই অফিসের মেশিনে কাটিয়ে ফেলেছিল, অফিসের কাছ থেকে বীমার টাকা পাবার জন্য, যা ও ক্রান্তির কাজে লাগিয়েছিল ।
আট
রায়পুর থেকে নারায়ণপুর যাবার বাসে ইতুকে তুলে দিয়ে অমিত বলে দিয়েছিল, বাস থেকে নেমে সোজা গিয়ে রামকৃষ্ণ মিশনের গেটের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকবি ; সুশান্ত জেঠুর দেয়া তোর মোবাইল থেকে, একটা ছেলেকে ফোন করে দিয়েছি । তুই মিশনের গেটের কাছে পোঁছে এই নম্বরে একটা মিস কল দিবি । নারায়নপুরে নেটওয়র্ক ততো ভালো কাজ করে না । ছেলেটা রেসপণ্ডড করে বলবে, ওর নাম বীরবল মাড়িয়া । হিরো হণ্ডার কালো রঙের স্পেলণ্ডার মোটর সাইকেলে আসবে । ও তোকে নমস্তে ইতুদিদি বললে, কোনো কথা না বলে পিলিয়নে বসে পড়িস । ও তোকে যেখানে পৌঁছে দেবে, সেখানে তোর সঙ্গে আমার পরিচিতদের দেখা হবে, হয়তো তোর পরিচিতও থাকতে পারে কেউ । চিন্তা করিসনি, মনে রাখিস, যেখানে ঢুকতে যাচ্ছিস সেটাকে প্রশাসনের লোকেরা বলে জংলি পাকিস্তান ।
বাস ডিপোয় ইতুর কান্না পায়নি, নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল । কেঁদে ফেলেছিল অমিত, রুমাল দিয়ে চোখ পুঁছে নিচ্ছিল যাত্রীদের এড়িয়ে । বলেছিল, আর দেখা হবে না জানি, তোকে শেষবার দেখে নিচ্ছি । উত্তরে ইতু বলেছিল, আমি আমার অতীতকে কলকাতা বিমানবন্দরে প্লেনে ওঠার সময়ে কাট অফ করে দিয়েছি, তুইও তাই করে ফ্যাল । সবাইকে ভুলে গিয়ে যা করবার কর, বাবা-মায়ের সঙ্গে থাক, থেকেও তাদের ভুলে থাক । গেট রিড অফ অল মেমরিজ ।
ডেনিমের ট্রাউজার আর ঢিলেঢালা টপ পরেছিল ইতু, পায়ে জগিং করর কেডস, কাঁধে ওর রাকস্যাক। রায়পুরে দুবোতল মিনারেল ওয়াটার আর বিস্কিটের প্যাকেট নিয়ে নিয়েছে ।
যে বাসটায় চেপেছিল, সেটার নাম, ইতুর অবাক লাগল শুনে, নৌকরওয়ালা বাস । কন্ডাক্টার টিকিট দিল না কাউকে, স্কুলের অ্যাটেন্ডেসন্স রেজিস্টার হাতে প্রত্যেক যাত্রীর কাছে গিয়ে তাদের নামের সামনে ছককাটা ঘরে সই নিয়ে নিলো । মাসের শেষে টাকা নেবে, উপস্হিতি অনুযায়ী । প্যাসেনজারদের পোস্টিং হয়েছে নতুন জেলা সদর নারায়ণপুরে ; তাদের পরিবারকে নিয়ে যায়নি, নারায়ণপুরে ভালো স্কুল কলেজ, সিনেমা হল, মালটিপলেক্স কিছুই গড়ে ওঠেনি এখনও । ইতুকে কণ্ডাক্টর বলল, দিতে হবে না ।
বাস থেকে নেমে হাতে টানা রিকশোয় চেপে নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছে বীরবল মাড়িয়াকে মিসড কল দিয়ে অর্জুন গাছের তলায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল ইতু ।
নমস্তে ইতু দিদি, শুনে, কালো মোটর সদাইকেলের পিলিয়নে বসে, ইতুর নাকে ছেলেটির যৌবনগ্রন্হির ঝাপটের উগ্র গন্ধ এসে লাগতে প্রায় বমি পেয়ে গেল ; উফ ফেরোমন । মুখে কাঁধের থলেটা চাপা দিয়ে সামলালো। কিছুটা যাবার পর বুঝতে পারলো যে এক হাতে ছেলেটির পেট ধরে থাকতে হবে, আর এক হাতে মোটর সাইকেলে হ্যাণ্ডেল, নয়তো সড়কের যা অবস্হা, নির্ঘাত ছিটকে পড়বে কোনো পাথরে চাকা পড়লেই । ঘামে ভেজা পেটে হাত রেখে ধরতে, ছেলেটি বলল, হ্যাঁ, ঠিক করে বসুন, রাস্তা ভালো নয়, এই তো সবে দুটো ব্লক নিয়ে নারায়ণপুর জেলা তৈরি হয়েছে । ইতুর মনে পড়ল, অমিত এই ভাবেই ওর স্কুটারে পেট ধরে বসেছিল, আর নাভিতে আঙুল দিয়ে সুড়সুড়ি দিয়েছিল ।
যুবকটির পেট, বর্ষায় ভেড়ার লোমের মতন, বেশ ভিজে, উনিশ-কুড়ি বছর বয়স হবে, গায়ের রঙ মুখের গড়ন দেখে আদিবাসি বলেই মনে হয় । ইতু জিগ্যেস করল, দান্তেশ্বরীর মন্দির পড়বে কি রাস্তায় ।
— না দিদি, দান্তেশ্বরী হলো বস্তারের দেবী । নারায়ণপুরে অবুঝমাড়িয়াদের দেবী হলো কাকসার । বৈগারা রাসনাভাকে পুজো করে, আর গোঁড়রা পুজো করে মেঘনাদকে ।
মেঘনাদ ! মাইকেলের ? ইতু নিজেকে নিঃশব্দে বলল ।
যুবকটি বলল, জানেন, এখানে কেউ আসে না, বেশ দূরে দূরে প্রায় দুশো তিরিশটা গ্রাম আছে, চার কিলোমিটার জঙ্গলে ছড়িয়ে, তিরিশ হাজারের বেশি মানুষ, বেশির ভাগই মাড়িয়া আর গোঁড়, যাদের খোঁজখবর সরকার নেয় না । কেন বলুন তো ? হোল ইনডিয়ায় শুধু এইটুকু এলাকার কোনো সার্ভে আজ পর্যন্ত হয়নি । নারায়ণপুর, বিজাপুর আর বস্তার, এই তিন জেলার জঙ্গল এলাকা হলো অবুঝমাড় ।
ও আচ্ছা, শুকনো ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে বলল ইতু ।
জানেন, অবুঝমাড়কে ঘিরে রেখেছে কেন্দ্রিয় রিজার্ভ পুলিশ বল আর ক্রান্তিকারিরা ।
ইতু নিজেকে প্রশ্ন করল, এখানে কেন আসতে চাইলুম ? বাড়িতে কি ভালো ছিলুম না ? আমি তো অলটারনেটিভ মেডিসিন পড়েছি, অমিতের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে কোথাও সংসার পাততে পারতুম, বস্তিতেই থাকতুম না হয়, অমিত কিছু কাজ তো করতো, অন্তত আমার ডিসপেনসারিতে হেলপার হয়ে ? যাকগে, এবার নিজের জন্যে কিছু করব, ক্রান্তিকারিদের চিকিৎসা তো করতে পারব, জঙ্গলে এতো পরিচিত গাছগাছড়া রয়েছে।
বীরবল মাড়িয়া বলল, কিছুক্ষণ থেমে, শ্বাস নিয়ে, অবুঝমাড় এমন ভুতাহা জায়গা যে ক্রান্তিকারিদের শরীরকেও অদৃশ্য ডাইনরা আক্রমণ করে, যতই বন্দুক কামান থাক, কিছুদিনের মধ্যে রোগে ভুগে ভুগে হাড্ডির চামগাদড় হয়ে যায় । আপনি দেখুন কতোদিন এখানে টিকতে পারেন । জল তো নোংরা, টিকতে হলে সালফি খেয়ে চালাতে হবে ।
সালফি ?
হ্যাঁ, সালফি হল তাড়ির মতন দেখতে একরকমের মদ । তালগাছ বা খেজুর গাছের মতন দেখতে হয় গাছগুলো, যেমন করে চেঁচে নিয়ে তালের বা খেজুরের রস বের করে, তেমনি করে সালফি বের করতে হয় ।
ছায়ায় আধঘণ্টা জিরিয়ে কয়েক ঢোঁক জল খাবার পর, মোটর সাইকেলটা চালাঘরের কাছে রেখে, বীরবল বলল, চলুন আরেকটু এগিয়ে দিই ।
মিনিট পনেরো হাঁটার পর, দুটো নীচু চালাঘরের মতন একটা জায়গায় পৌঁছোলো ইতু আর বিরবল । উলঙ্গ কিশোর-কিশোরীরা খেলা করছে, রুক্ষ চুল, দেখেই বোঝা যায় বহুদিন, বা হয়তো কখনো স্নান করেনি। শহরে এই বয়সের মেয়েরা কুঁচকি আর বুক ঢাকা পোষাক পরে ; এদের কুঁচকির চুলও দেখা দেয়া আরম্ভ হয়েছে, বুকও উঠে এসেছে, এই বয়সে ইতু বডিস আর জাঙিয়া পরা আরম্ভ করেছিল ।
কয়েকজন শিড়িঙ্গে শিথিল-দাবনা পুরুষ বসে আছে, তারাও প্রায় উলঙ্গ, কৌপিনগোছের ন্যাকড়ায় লিঙ্গ ঢাকা। বীরবল বলল, ওরা এগ্রামের নয়, কুরসুনার গিয়ে সালফি খেয়ে এখানে মৌতাত নিচ্ছে । এই অবস্হায় ওরা ভেতরে গেলে ক্রান্তিকারিরা ধরে ফেললে ফাইন করবে ।
মানুষ যদি এরকমই থাকতে চায়, তাহলে তাতে পৃথিবীর কোনো ক্ষতি ছিল না, নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলছিল ইতু । এই লোকগুলো এখনও বিস্মিত হবার ক্ষমতা রাখে, জীবনকে যথেচ্ছ উপভোগ করতে চায়, পোশাকের পরোয়া নেই, এখনও এরা কলাকৌশলের জাঁতিকলে আটকে পড়েনি, এখনও ভড়ংশূন্য, সরল, স্বাভাবিক ; প্রযুক্তির প্রগতিতে এসে যায় না কিছু । সভ্যতা যতো বুড়ো হয়েছে ততো বিমূর্ত আর অবাস্তব হয়ে গেছে শহরের মানুষ, শিকড় থেকে ওপড়ানো, প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন, যেমন আমি নিজে । মেট্রপলিসের মানুষ আর জৈবিক হৃদয়ের প্রাণী রইলো না, তার আবেগের স্বাভাবিকতা আর আন্তরিকতা উবে গেছে । বোধহয় এটাই মানুষের নৃবৈজ্ঞানিক ভবিতব্য । সভ্যতা যতো সভ্যতর হয়ে চলেছে ততোই আমরা হয়ে চলেছি জটিল, খারাপ, অনৈতিক, ভয়াবহ ।
এই লোকগুলোর আনন্দের পরিভাষা তো এরাই তৈরি করবে, নাকি আমি বা ক্রান্তিকারিরা বাইরে থেকে এসে তাকে বোঝাবো কীসে তাদের আনন্দ । সভ্যতা মানুষের যৌবনকে ক্ষইয়ে দিচ্ছে, মানুষ আসলে ভঙ্গুর, ঠুনকো, নশ্বর, তার শরীর অসুস্হ হবেই, ঋতুদের প্রকোপ সামলে চলতে হবে তাকে, সভ্য থাকার কাঁচামাল ফুরিয়ে যাচ্ছে, না-খেয়ে আধপেটা-খেয়ে থাকতে হচ্ছে, তার ওপর আবার সন্ত্রাসের আতঙ্ক । কে জানে, আমার কাছে এসব প্রশ্নের উত্তর নেই । দেখি, কী হয় । অন্যদের সুখে-আনন্দে-সুস্হতায় যদি জীবন কাজে লাগাতে পারি তাহলেই যথেষ্ট , তাহলে অমিতকে ভুলে যেতে পারবো।
গ্রামটার পর পথ ক্রমে ওপর দিকে ওঠা আরম্ভ হলো । দুপাশে চেনা-অচেনা নানা রকমের গাছ, ছায়ায় হাঁটতে ভালো লাগছিল ইতুর । তখনই বীরবল বলল, দিদি, আমাকে এখান থেকে ফিরে যেতে হবে, সন্ধ্যা হয়ে এলো । আপনি প্রথমে যে গ্রাম পাবেন, সেখানে অপেক্ষা করবেন, কেউ আপনাকে নিতে আসবে । কিংবা এই সরু পাহাড়ি বনপথ ধরে যদি এগিয়ে যান, একটা বড়ো গ্রাম পাবেন, সেখানে অপেক্ষা করবেন । অন্ধকার হয়ে গেলে কোনো গাছে হাত দেবেন না ; সন্ধ্যার পরে গাছ আর গাছের ডালপালারা সাপ হয়ে যায়, সবুজ, কালো, হলদে, মোটা, রোগা, চিত্তিদার, নানারকম । আপনাকে সাবধানে হাঁটতে হবে । টর্চ এনে থাকলে জ্বালাবেন না, সাপেরা আলোয় বিরক্ত হয় ।
— সে কী, তুমি যাবে না ? ইতু বুঝতে পারলো যে ও এই ছেলেটির ওপর নির্ভর করছিল এতক্ষণ, ওর কল্পকাহিনি খাচ্ছিল । এবার থেকে ও একা । কারোর ঘাড়ে চাপার জন্যে তো বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েনি ।
–না, আমি ফিরে যাই, এখানে কেউ আপনার কোনো ক্ষতি করবে না । মাড়িয়া-গোঁড়রা জানেই না কাকে ক্ষতি করা বলে । জঙ্গলের ভেতরে শহরের মানুষ পাবেন না ; যদি পান তো নিজেকে দূরে-দূরে রাখবেন ।
ইতু হাত তুলে, ফির মিলুঙ্গি জানিয়ে, এগোলো বনের পথে । বীরবল চলে গেলে, জুতো আর জিনস খুলে, প্যান্টিটা ফেলে দিয়ে, পেচ্ছাপ করে নিলো । ওহ কতক্ষণ চেপে রেখেছিলুম, বলল হলুদ ফুলের চুমকি বসানো ঘন সবুজ ঝোপকে, যে ঝোপটা হয়তো কোনো ভবঘুরে পাখির গু থেকে বৃষ্টির ছাটে দুহাত মেলে জন্মেছিল । টপ খুলে বডিসও ফেলে দিল । সেই ক্লাস এইট থেকে অভ্যাস, বাইরে থেকে বাড়িতে নিজের ঘরে ঢুকে আগে এই দুটো খুলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া ।
বাঁদিকের বুকটা তুলে দেখলো, দ্বিতীয়বার উত্তেজিত হয়ে দাঁত বসিয়ে দিয়েছিল অমিত, তাই ঘামের দরুণ জ্বালা করছিল । একটা ঘৃতকুমারী পাতা ভেঙে, তার শাঁস কুঁচকিতে আর বুকে, গোলাপি জায়গায় লাগিয়ে নিলো।
বনের ভেতরে সম্পূর্ণ উলঙ্গ দাঁড়িয়ে অবর্ণনীয় ভালোলাগা পেয়ে বসল ইতুকে । দুহাত ওপরে তুলে চেঁচিয়ে উঠল, আমি ইতুউউউউউ, আমি ইতান, পৃথিবীর মাটিতে সম্পূর্ণ স্বাধীন । দুদিকে দুহাত মেলে আবার চেঁচালো, আমি ইতুউউউউউ…আমি আদি মানবিইইইই…আমি ইতু…আমি ইতু…আমি ইতুউউউউ….।
শুকনো পাতার ওপর থেকে পোশাক তুলতে গিয়ে ইতু দেখলো, একটা কাঠবেড়ালি নতজানু হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে । ইতু, নগ্ন, শুকনো পাতার ওপরে উবু হয়ে বসে কাঠবিড়ালিটাকে বলল, সেতু বাঁধতে এসে থাকলে ভুল করছিস, সব সেতু ভেঙে চলে এসেছি । কাঠবিড়ালিটা পালিয়ে গেল, পোশাক আর জুতো পরে নিলো, কাঁধে ঝোলা, এগোলো বনপথে ।
ঘণ্টাখানেক চলার পর, সন্ধ্যা নেমে আসায়, অজানা এক গাছের গুঁড়ির কাছে, ছায়ায়, জুতো খুলে, বসে পড়েছিল ইতু, বুকের ভেতরে বাজতে-থাকা ভীতির দামামা দূর থেকে কানের ভেতরে ঢুকে আসছিল । ওপর থেকে কয়েকটা ফুল ঝরঝর করে ঝরে পড়তে চমকে উঠেছিল, তারপর টের পেলো যে এটা মহুয়ার গাছ ; তাইতো অমন গন্ধ বেরুচ্ছিল । মহুয়া ফুলের গন্ধে যদি ভাল্লুক আসে, তাহলে ? কোথায় যেতে হবে সুস্পষ্ট বলে দেয়নি অমিত, ওকে ওর ক্রান্তিকারি মা-বাপ যেমনটা বুঝিয়েছিল, ও সেটাই বলেছে, বলেছিল হাঁটতে থেকো যতোটা পারো, পরিচিত কাউকে ঠিকই পেয়ে যাবে । তন্দ্রা এসে গিয়েছিল ইতুর, গাছে ঠেসান দিয়ে ঢুলতে লাগল। সারাদিনের রোদের আমেজে বুঁদ গাছের পাতাগুলো অবসাদে ঝিমিয়ে ।
ঘুম ভাঙতে, দেখল অন্ধকার, আজকে বোধহয় চাঁদ ওঠার রাত নয় । জুতো পরে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে অন্ধকারে গাছে ডান হাত ঠেকতেই মনে হলো সাপের গায়ে হাত দিয়ে ফেলেছে, নরম মাংসল, যেন ভিজে-ভিজে, তাড়াতাড়ি হাত সরিয়ে নিলো । কী করবে ? গাছগুলো রাতে সাপের আকার নিয়ে নিচ্ছে ! বিশ্বাস করি না, অথচ বিশ্বাস করে ফেলছি, ভয়ে । এককালে অমিতকে ভিতু বলে কতো ডাঁট-ফটকার দিয়েছি । কেউ এলে তাকে দেখতেও তো পাবো না জঙ্গলের অন্ধকারে । হয়তো বিভ্রম, মনে করে, বাঁ হাত বাড়িয়ে গাছ অনুমান করে হাত বাড়াতে, ঠাণ্ডা সাপের গায়ে হাত ঠেকল, নরম । সাপের ভয়ে ইতুর বুকের ভেতরের ইঁদুরগুলো দাপাদাপি আরম্ভ করে দিয়েছিল । ইতু বুঝতে পারছিল ওর অস্তিত্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে আতঙ্ক, সাপের আকার পাওয়া গাছগাছালির আতঙ্ক ।
হঠাৎ ইতুর চোখের ওপর সরু নিয়নের আলোর মতন রশ্মি পড়তে, চোখ ধাঁধিয়ে গেল, বুকের দামামা আরও জোরে বাজা আরম্ভ হলো । কোনো ময়ালের চোখ নয়তো ? আরও তিনটে টর্চ জ্বলতে, ইতু আবছা দেখলো, ওর চারপাশে জলপাই রঙের উর্দিতে চারজন যুবক আর একজন যুবতী । সকলের কাঁধে বন্দুক বা রাইফেল, কে জানে কী, দেখেনি তো কখনও । আমাকেও ঝোলাতে হবে নাকি ! এই উদ্দেশ্যে তো আসিনি, আদিবাসীদের চিকিৎসা করতে এসেছি ।
—ডক্টর ঘোষ ? ওয়েলকাম । একজন যুবক বলল ।
ইতুর মুখ দিয়ে বেরোলো, থ্যাঙ্কস, ম্যায় বহুত ডরি হুই থি ।
যুবতী বলল, জানতি হুঁ, আপ সো গয়ে থে দেখকর আপকো নিন্দ সে নহিঁ জগায়া । আপ জব অপনা নাম লেকর চিল্লায়েঁ, তভি সে হমলোগ আপকে সাথ হ্যাঁয় ।
ওর উলঙ্গ চিৎকার এরা দেখেছে তাহলে ! দেখুকগে, কীই বা এসে যায় ।
যুবতী বলল, ওর নাম সোনারি, বলল, আপ হম লোগোঁকে বিচ মেঁ রহিয়ে, ইতুকে ঘিরে ওরা হাঁটা আরম্ভ করল, অন্ধকারে, টর্চ না জ্বেলে । বনপথের সহযাত্রীদের ঘেরাটোপে বোধহয় আরও ঘণ্টা দেড়েক হেঁটেছিল ইতু ।
তখনই অন্ধকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে কয়েকবার হুইসিল বেজে থেমে গেল ।
আচমকা গুলি চলার শব্দ আরম্ভ হতে, ইতুকে টেনে শুকনো পাতার ওপর নামিয়ে, ওরা ইতুর দেহ ঘিরে শুয়ে পড়ল । ইতু অনুমান করল দুদিক থেকে গুলি চলছে, অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না । ওর মুখ মাটির দিকে, জিভেতে ভয়ার্ত আহ্লাদের স্বাদ । শুকনো পাতার ছোঁয়াচে গন্ধে, বাড়ি থেকে পালাবার পর, প্রথম যখন অমিত ওর ক্লিনিকে এসেছিল, ঠিক ওর শরীরের সন্মোহক গন্ধ ।
অসংখ্য গুলি ওদের দিকে এসে ঝাঁঝরা করে দিল সবাইকে, ইতুকেও । কুণ্ডলীপাকানো ময়াল সাপের মতন পড়ে রইলো ইতুর আর ওর ক্রান্তিকারি রক্ষীদের মৃতদেহগুলো ।
নয়
হাসপাতালে, এম আর আই স্ক্যান করার জন্য একজন বয়স্ক রোগিকে শুইয়ে টেকনিশিয়ানকে নির্দেশ দিচ্ছিলো ডক্টর ঘোষ, তখনই বুড়ো ওয়ার্ডবয় গোপাল নস্কর পাশের ঘরে নিয়ে যাবার বদলে একটা খালি অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে ঢোকে, আর এম আর আই মেশিনের ম্যাগনেটিক ফিল্ডের প্রচণ্ড আকর্ষণে সিলিণ্ডারসুদ্দু ওয়ার্ড বয়টা রোগীকে নিয়ে বাজপাখির ছোঁমারার মতন করে সেঁদিয়ে গেলো মেশিনের ভেতরে ; রোগি তক্ষুনি মারা যায় । ভ্যাবাচাকা খেয়ে টেকনিশিয়ানটা পালালো ।
মেশিনের কোয়েঞ্চিং সুইচ অফ করে ম্যাগনেটিক ফিল্ড ডিঅ্যাকটিভেট করার বদলে রোগি আর ওয়ার্ড বয়কে বের করার চেষ্টা করে ডক্টর ঘোষ, কিছুই হচ্ছে না দেখে হিলিয়াম গ্যাস বের করে দিয়ে ম্যাগনেটিক ফিল্ড অকার্যকর করার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না, সুইচও নেভাতে পারে না । অনিচ্ছাকৃত মৃত্যু ঘটানোর জন্য গ্রেপ্তার হয়ে একদিন হাজতে থাকার পর, পাটনায় পালিয়ে গিয়ে, মানসীর পরামর্শে, রসিক পাসোয়ানের সাহায্যে, গা ঢাকা দেয় ওয়ারিস আলি গঞ্জ । এককালে ছাত্র-রাজনীতি করিয়ে ডাক্তার উন্নীত হয়ে গেল ক্রান্তিকারির রাজনীতিতে, যে রাস্তায় যাবার গোপন ইচ্ছে অনেককাল ধরেই ছিল ।
না পালালেই হতো, পরে মনে হয়েছে ডাক্তারের , হয়তো অতিবুদ্ধিমতী সুন্দরী মানসী ওইভাবেই তাকে নিজের আয়ত্বে নিয়ে নিলো। টেকনিশিয়ান প্রশান্ত সরখেল গ্রেপ্তার হয়েছিল, পুলিস হাজতে ছিল চোদ্দো দিন, মেশিনটা ডিফেকটিভ ছিল বলে হাসপাতালের কর্মী ইউনিয়ান দাবি করে পালটা মামলা করার ফলে কেস ঝুলে আছে সেই থেকে । ডাক্তারও না হয় ঝুলেই রইতো, মানসীকে বাধ্য করতো কলকাতায় ট্রান্সফার নিয়ে সঙ্গে থাকতে । ভয় ছিল যে পুলিশ শেষে বাড়িতে ঢুঁ মারলে বিপ্লবের বইপত্র দেখে অন্য মামলায় ফাঁসিয়ে দিতে পারত, হয়তো আগে থেকেই নজর রেখে থাকবে, তার চেয়ে কাগজপত্র জ্বালিয়ে গা ঢাকা দেয়াই উচিত, ভেবেছিল ডাক্তার ।
মানসীর বাচ্চাটা নির্দিষ্ট দিনের আগেই, জটিলতার কারণে, হাসপাতালে মারা গেল, জানিয়েছিল মানসী, যা আজও বিশ্বাস করে না ডাক্তার, হয়তো কোথাও কারোর জিম্মায় দিয়ে রেখেছে, যাতে বাচ্চার ঝক্কি পোয়াতে না হয় ।
অফিসের কর্মীরা সুযোগ খুঁজছিল ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে সংঘর্ষের, মানসীকে মেটারনিটি লিভ না দেয়ায়, যেহেতু অফিসের রেকর্ডে মানসীর বিয়ে হয়নি, অফিসের অনুমতি না নিয়ে সারোগেট মাদার হতে রাজি হয়েছে, আর যেহেতু বাচ্চাটা তার নয়, হরতাল চলল বেশ কয়েকদিন ।
হরতালের সুযোগ নিয়ে নারী-নারকটিক গ্যাঙের সদস্যরা নানা জায়গায় ম্যাটাডর ভ্যান হাঁকালো কিসিম কিসিম কচি-আধপাকা-পাকা যুবতীদের দেহরঙ্গের খেলা খেলতে, কখনও বা গঙ্গার বুকে পালতোলা নৌকোর ছইয়ের ফুল্লকুসুমিত জোছনায় ।
অতনু চক্রবর্তীকে, যে কিনা অফিসে মানসীর পরের ব্যাচের, সে যখন অফিসের কাজে ট্যুরে মিজোরাম যাচ্ছিল, তাকে একটা পছন্দের পারফিউম আনতে বলেছিল মানসী বর্মণ । হরতালের তাঁবুতে মানসীর বাড়ি যাবার পথনির্দেশ যোগাড় করে, পৌঁছে অতনু কলিং বেল টিপতে, কয়েক সেকেণ্ডে ফাঁক হয় চেনবাঁধা দরোজা । টাঙাইল শাড়িতে মানসী বর্মণ, উদাসীন বহিরাবয়ব, সর্বোতোমুখী পরিব্রাজক চাউনি, নিঃশব্দ উলুধ্বনির বলয়ে ঘেরা উচ্চারণ উন্মুখ শরীর । দরোজা খুলে মানসী, ‘আরে আপনি ; চিনতে পারিনি প্রথমটা, অনেকদিন দেখিনি তো, আসুন না ভেতরে আসুন না, বারমহল আর খাসমহল আমার এই দুঘরের ফ্ল্যাট । ওপরের ফ্ল্যাটে আগরওয়াল সায়েব থাকেন, বড় ছ্যাঁচড়া, তাই চেন লাগিয়ে রাখি ।’
অতনু আঁচ করেছিল অনেক লোকজন থাকবে মানসী বর্মণের বাসায়, তার সমর্থনে হরতাল হচ্ছে যখন, থাকবে ধর্মঘটের রেশ, একাধজন নেতা সাঙ্গপাঙ্গ সুদ্দু । পুরো ঘরটা আসবাব কার্পেট কিউরিওতে ঠাসা, সামলে চলাফেরার পরিসর । কোনও অজানা প্রতিপক্ষের দুঃখ ছেয়ে আছে যেন ।
মানসী : ( সোফায় বসতে বসতে ) আসুন না, ওখানটায় বসুন, জানলা দিয়ে ফুরফুরে হাওয়া আসে । ধ্যাৎ, আপনি আপনি বলতে পারছি না। তোমাকে তুমিই বলছি । তুমি তো বেশ ছোটো আমার চেয়ে, তাই না ? ( ঘাম না থাকা সত্ত্বেও আঁচল দিয়ে কপাল পুঁছে ) তুমি তো কোথাও যাও না, কারোর সঙ্গে মেশো না বলে বদনাম। উন্নাসিক, না । কৌতূহল হল বুঝি । ইউনিয়ন এমন পাকিয়ে ফেলেছে ব্যপারটা…
অতনু : ( মানসীর পাশে ধপ করে বসে, পকেট থেকে পারফিউম বের করে এগিয়ে দ্যায়; মানসী হাতে নিয়ে দ্যাখে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ) পুরো ঘটনাটা কেমন যেন অবিশ্বাস্য । ননীদার বিয়ে তো রূপকথার গল্প, তারপর আপনার এই দুঃসাহসী কাজ ।
মানসী : ( মৃদু হাসি ঠোঁটে খেলিয়ে, মাথা নাড়িয়ে আলগা খোঁপার ঢল পড়ে যেতে দ্যায় কাঁধে-পিঠে ) ও বাবা, বেশ গুছিয়ে কথা বলতে জানো । ( পারফিউমের ঢাকনি খুলে বাতাসে স্প্রে করে ) আর কী হবে এসবে ! আমার গা থেকেই এখন মৃগনাভির গন্ধ বেরোয় ( ডান হাতের তর্জনী রাখে বুকের ওপর ) ।
অতনু : ( ঝুঁকে পড়ে প্রায় বুকের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে শোঁকে ) হ্যাঁ, সত্যি তালশাঁসের মতন গন্ধ ।
মানসী : ( অতনু কাছাকাছি চলে আসায় বুক ঢিপঢিপ লুকোতে, অতনুর চুলে আঙুল বুলিয়ে ) দুর বোকা। তালশাঁসে কি মৃগনাভির গন্ধ হয় । মাস্ক পারফিউমের নাম শোনোনি ?
অতনু : ( আচমকা উদাসীন ) কে জানে , গন্ধটা পেলে টের পাবো । কিন্তু আপনি এত বড়ো ঝুঁকি নিলেন যে ? কিছু যদি হয় ? যদি কমপ্লিকেশন হয় ।
মানসী : ( খরস্রোতা ভঙ্গীতে ) কীইইই বা হবে । বরের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি না হলে আমার ছেলেমেয়ে ক্লাস ফোর-ফাইভে পড়ত এখন । ( চিন্তিত ভ্রুযুগল ) ।
অতনু : ( মুখ ফসকে অথচ মানসীর দৃষ্টির গভীরে তাকিয়ে ) ছাড়লেন কেন ? সবাই বলে আপনিই তালাক দিয়েছেন ।
মানসী : ( গম্ভীর ) হ্যাঁ, আমিই ছেড়েছিলুম ( ক্ষুব্ধ ) হিজড়ে ছিল লোকটা ।
অতনু : ( বিস্মিত ) হিজড়ে ? হিজড়েরা বিয়ে করে নাকি ?
মানসী : ( পরাজিত হাসি ) সে হিজড়ে হতে যাবে কেন ? ছোটোবেলায় অসুখ-বিসুখ হয়েছিল কিছু, তাইতে অ্যালিগোস্পারমিয়া হয় । ডাক্তার দেখায়নি । অ্যাজোস্পারমিয়া হয়ে গিয়েছিল । ( উষ্মা ফুটে ওঠে ) অমন বর থাকাও যা, না থাকাও তা । পোকাই নেই তো ডিম ফোটাবে কী করে ?
অতনু : তাতে কী হয়েছে ? এখন যেমন করলেন, তখনও চুপিচুপি কারোর স্পার্ম নিয়ে নিতেন ।
মানসী ( অবাক ) কী বলছ কি তুমি ! এখন ব্যাপারটা আলাদা । বর থাকতে ওসব করে কখনও কোনো বউ ? ঢি ঢি পড়ে যেত । কেলেংকারির একশেষ । বরও মেনে নেবে কেন ? এখন যা করেছি তাতে কত গর্ব বলো ইউনিয়ানের । টাইমস অফ ইনডিয়াতে বাংলা অ্যাকাডেমির জীবনময় দত্ত আমাকে নিয়ে ফিচার লিখেছেন, তা জানো ?
অতনু : ছাড়াছাড়ির পর আবার বিয়ে করতে পারতেন ।
মানসী : কুমারী মেয়েরাই বসে রয়েছে, বিয়ে হয় না, ডিভোর্সিকে কে বিয়ে করবে ?
অতনু : কেন ? আমি !
মানসী : ( অতনুর চোখে চোখ রেখে কিছুক্ষণ হতবাক ) তুমি ? পাগল নাকি ? ভেবেচিন্তে বলছ ? আগে বলোনি তো কখনও ! ভালো করে কথাই বলতে না । বেশি পড়াশুনা করেছ বলে একটা ভয়-ভয় ভাবও ছিল । তোমার মা কেন মেনে নেবেন ?
অতনু : ভেবেচিন্তে বলছি না । আবেগেও বলছি না । মাও মেনে নেবে না জানি । কিছুকাল আগে হলে আমিও মেনে নিতুম না । কীই বা এসে যায় তাতেও ! কিছুই মানামানির দরকার হয় না মানুষের মতন থাকতে গেলে । জানেন প্রেম মায়া মমতা ভালোবাসা শ্রদ্ধা লোভ সবকিছুই ক্ষণস্হায়ী । মুহূর্তটা ধরুন, ফুরিয়ে গেলে ছেড়ে দিন ।
মানসী : ( বিস্ময় আর শ্রদ্ধা ) কত কথা বলতে পারো, সত্যি ।
অতনু : ( উঠে দাঁড়ায় । দরোজার দিকে এগোয় ) কথায় আর কাজে মিল ঘটে গেলে মানুষ আর মানুষ থাকে না ।
মানসী ( উঠে দাঁড়ায় । অতনুর হাত নিজের দুহাতে নিয়ে ) আবার এসো, অ্যাঁ, আসবে তো ? চা কফি কিচ্ছু খাওয়ালুম না তোমায় ।
অতনু : ( ম্লান হাসে । মাস ছয়েক আগে হলে মানসীর স্পর্শে বজ্রপাত ঘটে যেত তার স্নায়ুকেন্দ্রে )
অতনু চক্রবর্তী চলে যাবার পর তার দেহের গন্ধ ঘরের ভেতরে উড়ে বেড়াচ্ছিল । মানসী বর্মণ টের পেলো তার অরগ্যাজমের অনুভূতি আরম্ভ হয়েছে । দৌড়ে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো, চোখ বুজে স্বামীর মুখ মনে আনার চেষ্টা করা সত্ত্বেও অতনুর মুখ ভেসে উঠতে লাগল । দেহ কেঁপে উঠল কয়েকবার, সত্যি অরগ্যাজম ঘটে গেল, জীবনে প্রথমবার, কেবল একজন পুরুষের দেহের গন্ধের প্রতিক্রিয়ায়, তা কি এই জন্য যে লোকটা দুশ্চরিত্র বলে প্রচারিত, আর মানসী তার লাম্পট্যের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণে আক্রান্ত হলো । প্রেগনেন্ট তো ছিলই, অতনুকে শোবার ঘরে ডাক দিয়ে তার সঙ্গে একবার শুয়ে দেখা যেত হয়তো । শুলে, ফিসফিসিয়ে জীবনের প্রকৃত অবস্হা বলা যেত ওকে, বিশ্বাস করতে অসুবিধা হতো না বলেই মনে হয়, তরল চরিত্রের যুবকদের কাছে বিশ্বাস জিনিসটা তেমন গুরুত্ব রাখে না । অফিসের শ্যামলী কর্মকার বলে, যৌনতা বাদ দিলে লম্পটদের চরিত্র আদারওয়াইজ ভালো হয় ।
ভ্রুণটা নির্দিষ্ট সময়ের আগে ভূমিষ্ঠ হলে, আর নষ্ট বলে প্রচারিত হবার পর, মানসী ডেকে পাঠালো অতনু চক্রবর্তীকে ।
সন্ধ্যাবেলা মানসী বর্মণের ফ্ল্যাটের কলিং বেল বাজিয়ে মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে অপেক্ষার পর ফিরে যাবে কিনা ভাবছিল অতনু, দরোজা খুলতেই ধুপকাঠির গন্ধ আর মানসী, রোগাটে, চুলে ববছাঁট, ফ্রিলদেয়া হলুদ ব্লাউজ, তাঁতের ফিকে হলুদ শাড়ি । কই, দুঃখকষ্টের ছাপ, অফিসের বন্ধুরা বলেছিল, পেল না অতনু, চেহারায়, ঘরের আসবাবে ।
আরে, অতনু !
আমি ভাবলুম, এখনও ওপরতলার আগরওয়ালের নেকনজর এড়াতে খুলতে চাইছেন না ।
ও ব্যাটা বিদেয় হয়েছে এই বিলডিং থেকে । পুজো করছিলুম, তাই দেরি হল ।
পুজো ? আপনি পুজো করেন বুঝি ? জানতুম না ।
কেন ? ঠাকুর দেবতা মানো না ? বোসো না, দাঁড়িয়ে রইলে কেন ?
মা মারা যাবার পর ঠাকুর দেবতাদের তোরঙ্গে বন্দি করে রেখেছি । একদিন গিয়ে গঙ্গা ব্রিজ থেকে বিসর্জন দেবো ।
ছিঃ, অমন বলে না । কত বিপজ্জনক চাকরি, কখন কী হয় তার ঠিক আছে । ভগবানে বিশ্বাস রাখতে হয় ।
এসব কী এখানে ?
মানসীর ড্রইংরুমে সেন্টার টেবিলের ওপর রাখা ছিল তুলো, সাইকেল রিকশার ভেঁপুর মতন লাগানো রবারের হর্ন কাচের গোল বালবে, স্টেনলেস স্টিলের বাটিতে কয়েক চামচ দুধ, গোলাপি হাতলের ডিম্বাকার আয়না । মানসী বর্মণের দপ করে রং পালটানো মুখশ্রী দেখে অতনু টের পেল প্রশ্নটা করা উচিত হয়নি । শাড়ির আঁচল সরায় মানসী । দুই বৃন্তকে ঘিরে ব্লাউজে ছড়িয়ে-পড়া দুধের ভিজে ছোপ দেখে অতনু নির্বাক । দেখিয়ে, মানসীর মনে হল, এর আগে অতনু এসে গন্ধের টোপ ফেলে চলে গিয়েছিল, তার পাল্টা টোপ ভিজে বুকের গন্ধ ।
কী করি, ডাক্তার বলেছে পাম্প করে বের করে দিতে, নইলে ক্যানসার হতে পারে, বলল মানসী । নিজেকে নিঃশব্দে বলল, আমার বর যদি এখন আসতো তাহলে তাকেই বলতুম মুখ দিয়ে টেনে বের করে দাও ।
রোজ পাম্প করতে হয় ?
দু-বেলা । দাঁড়াও চা বসাই । আগের বার না খেয়েই চলে গিসলে । টোস্ট খাবে ? চানাচুর ?
মানসী রান্নাঘরে ঢুকতেই, অতনু টুক করে খেয়ে ফেলল বাটির দুধ । ঠাণ্ডা কিন্তু মিষ্টি । সোঁদা আচ্ছন্ন করা গন্ধ, সারা শরীর জুড়ে শিহরণ খেলে যায় ।
অনভিপ্রেত আকস্মিকতায় থ, ও, মানসী, ‘পাগল., না মাথা খারাপ, ওঃ সত্যি, ওফ, কোন জগতের জীব তুমি ?’ ভেতরের ঘরে চলে যায় মানসী, আর বুঝতে পারে যে সেই অনুভূতিটা আবার ছড়িয়ে পড়ছে দেহে, কেঁপে কেঁপে অরগ্যাজম হয়ে গেল । বিছানায় শুয়ে পড়ল মানসী, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে নাকি নিজের ওপর, কিংবা অন্য ধরণের প্রেমে পড়ে চলেছে, স্বামী তো রয়েছেই, তার সঙ্গে সময়-সুযোগ পেলেই সঙ্গম করে নিয়েছে, এই যুবক এসে কি ঘটিয়ে চলেছে ! গায়নাককে কি জিগ্যেস করবে ? নাঃ, গায়নাক কী ভাববে ! যেমন চলছে চলুক, পরে আবার ঘটলে দেখা যাবে ।
অসীম পোদ্দার অতনুদের লম্পট পিকনিকে নৌকো থেকে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করার আগে একটা ঢাউস ব্যাগ রেখে গেছে মানসীর কাছে, বলেছিল, এটা প্লিজ আপনার কাছে রাখুন, আমি বাইরে যাবো কিছুদিনের জন্য, বন্ধুদের তো জানেনই কাউকে বিশ্বাস করা যায় না ।
ব্যাগে তালা দেয়া ছিল না, বলে কৌতূহল মেটাতে মানসী একদিন জিপ খুলে দেখেছিল, একটা ডায়রিতে পেছনের দিকে পাতার পর পাতা মানসী বর্মণকে প্রেমপত্র লিখে গেছে অসীম পোদ্দার, আর সামনে দিকে লাল কালিতে পাতার পর পাতা লিখে রেখেছে ওঁ রামকৃষ্ণায় নমোঃ, পোর্টম্যাণ্টো ব্যাগের ভেতরে ডায়েরির সঙ্গে ঠেসে-ঠেসে ভরা দোমড়ানো-মোচড়ানো অজস্র টাকা । নিশ্চয়ই অফিস থেকে চুরি করে রেখেছিল, সুযোগ পেয়ে গছিয়ে গেছে মানসীকে, আত্মহত্যা করার আগে । ব্যাগটা আপাতত অতনুর হাতে ধরিয়ে দেয়া যাক, ওর তো কেউ নেই বাড়িতে, মা মারা গিয়ে অব্দি ঝাড়া হাত-পা । মানসী নিজেকে বোঝালো যে অপ্রত্যাশিত অরগ্যাজমের আনন্দ দেবার জন্য অতনুকে তার দাম হিসাবে দিচ্ছি ব্যাগটা ; তারপর তো চুপচাপ বরের কাছে চলে যাব, যা করার করবে অতনু, খরচ করুক বা বিলি করুক ।
অতনুকে বসিয়ে রেখে, সেজে নেয় মানসী, লালপাড় গরদ, কপালে বিশাল লাল টিপ, হাতে টাকাঠাসা আর আসীম পোদ্দারের ডায়েরি রাখা ব্যাগটা এনে রাখে অতনুর পায়ের কাছে, ‘তালশাঁসের গন্ধ পাচ্ছ না’ জানতে চায় ।
না, চারিদিকে কেমন দুধ-দুধ গন্ধ । বাচ্চাটা নষ্ট হল আপনার মনখারাপ হয়নি ?
এখন জানি আমার পেটে বাচ্চা হতে পারে । তোমার কথা বল । অনেক কানাঘুষো শুনি ।
যা শোনেন সবই সত্যি ।
সত্যি ?
বোঝা গেল অমন সরাসরি সত্যি কথা আশা করেনি মানসী, তাই অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়, ‘আমার এই ব্যাগটা তোমার কাছে রেখে দিও, অ্যাঁ, কিছু দরকারি কাগজপত্র আছে । আমি কিছুদিনের জন্য ওরসলিগঞ্জ যাচ্ছি।
ওয়ারিস আলি গঞ্জ ? ও তো মারাত্মক জায়গা, মুসহররা থাকে, সৎযুগ মানঝি, ঝাড়ুদার, কেয়ারটেকার রাঘবের পেছন-পেছন চাবি নিয়ে ঘুরত, ও তো ওখানকার । ইঁদুর পুড়িয়ে খায় ।
ইঁদুর পুড়িয়ে তো অনেক দেশেই খায়, চীনে আর থাইল্যাণ্ডের ভালো রেসিপি আছে ইঁদুর রান্নার, লোকে থাই ফুড বলতে অজ্ঞান, দেখেছো তো । ওতে আবার খারাপ কিসের ? আসলে ওরা একেবারে একঘরে হয়ে গেছে উঁচু জাতের লোকগুলোর চাপে । কুচ্ছিত অবস্হা ।
ওরা তো বিয়ে করে আর ছাড়ে । করেই না অনেক সময়ে, এমনিই থাকে । সৎযুগ মানঝির কতগুলো ছেলেমেয়ে ও নিজেই জানে না । কিন্তু আপনি অমন একটা জায়গায় যাচ্ছেনই বা কেন ?
আমার এক নিকটাত্মীয় ওখানকার গান্ধি আশ্রমে মুসহরদের উন্নতির জন্য কাজ করেন ।
তাই বুঝি ?
হ্যাঁ । দ্বারভাঙা কালী বাড়ি যাচ্ছি, তুমি যাবে ?
চলুন । ব্যাগটা তুলে নিল অতনু । ভাগ্যিস মোটর সাইকেল আনেনি । মোটর সাইকেলে মানসী কি বসতে চাইতো পেছনে । চাইতো না বোধহয় । মেয়েরা জানে যে ব্রেক কষলেই যে মহিলা পিলিয়নে বসে তার বুক চালকের পিঠে ধাক্কা খাবে ।
রিকশয় ঠেসাঠেসি, দুধের গন্ধ পায় অতনু । রাস্তায় এত গর্ত যে ছিটকে পড়তে হবে শক্ত করে ধরে না থাকলে । রাজেন্দ্রনগর, মেছুয়াটুলি, মাখানিয়াকুঁয়া হয়ে অশোক রাজপথে পড়ে । বাঁদিকে গলিতে ঢুকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারভাঙ্গা বিলডিং, এর ভেতরে গঙ্গার তীরে মন্দির । দ্বারভাঙ্গা বিলডিঙে ঢোকার মুখে পথের দুপাশে চর্মরোগ যৌনরোগের হাসপাতাল-বিভাগ । খুঁটিতে বাঁধা গোরু-মোষ ।
ছাত্র ইউনিয়ানের নির্বাচনের সময়ে যে পাম গাছটায় বেঁধে অরবিন্দ অবস্হির মাথায় লোমনাশক লাগানো হয়েছিল, অতনু দেখল, গাছটা এখনও তেমনি ঠায় একা দাঁড়িয়ে, অরবিন্দ অবস্হির স্মৃতি নিয়ে ।
অন্ধকারে প্রাচীন মন্দির, কালচে ধরেছে দেয়ালে, পায়রা চামচিকে অবাধ, ফুল-পচা বেলপাতা শুকনো রেড়ির তেলের গন্ধ । মন্দিরে ঢোকার মুখে অতিগরিব ভিকিরি আর গরিব জুতোরক্ষক । জলভেজা পাথরের ঠাণ্ডা মেঝে । সিঁদুরমাখা হাড়িকাঠ, কখনও ছাগবলি হতো । পাকাদাড়ি আদুলগা বুড়োদের প্রায়ান্ধকার জটলা । ঝোঁপতোলা ঘোমটায় বউ ।
‘খুব জাগ্রত এই মন্দিরের ঘণ্টা, আপনা থেকে বাজে, রাত্তির আটটায়’, জানায় মানসী । অতনু উত্তর দেয় না । ও তখন দেখছিল, নিরন্তর পরিপূর্ণতায় উপচে-পড়া নর্দমা, কুলুঙ্গির মধ্যে শ্যাওলাপোশাক দেবতাদের দুর্বল ভঙ্গি, নিরীহমুখ দেবী-দেবতা, দালানে শুয়ে নিজের কুঁই কুঁই উপলব্ধিকে প্রকাশে মশগুল কুকুর । ‘খুব জাগ্রত, মাথায় জবাফুল রাখার পর যদি পড়ে না যায়, তাহলে মনস্কামনা পূর্ণ হয়’, মানসী বোঝাল ।
আপনার ফুল পড়ে যায়, না থাকে ? জিগ্যেস করল অতনু ।
পড়ে যাবে কেন ! থাকে । একবারও পড়েনি আজ অব্দি ।
নিজেকে নিজে অতনু বলছিল, বাচ্চাটার স্বাস্হ্যের জন্য কি মানত করেছিল মানসী বর্মণ ? কে জানে । জিগ্যেস করা ঠিক হবে না ।
অন্ধকারে প্রদীপ জ্বালিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, একদা দ্বারভাঙ্গা মহারাজের, এখন কারোরই নয়, কালী প্রতিমা। বোধহয় দুধে-চিনিতে চান করানো হয় তাই মাথার ওপরে আটকে থাকে ফুল । দর্শনার্থীরা একের পর এক ফুল চাপিয়ে, পুরুতকে টাকা দিয়ে, মনস্কামনা পুরো করার আগাম মিটিয়ে চলে যাচ্ছে । মানসী ব্লাউজ থেকে টাকা বের করে পুরুতকে দিল, হাত জোড় করে দেখে নিল প্রতিমার মাথার ওপর ফুল রয়েছে, পড়েনি, তার মানে ওনার বর ডাক্তার ঘোষ বহাল তবিয়তে আছেন, পুলিশ পেছু নেয়নি ।
তুমি চাও না কিছু । দেখ না । হয়তো ঝট করে বড়ো অফিসার হয়ে যাবে ।
একটা করকরে নতুন নোট দিল অতনু, পুরুত ফুল চাপালো হাসি মুখে, তক্ষুনি পড়ে গেল ফুলটা । মানসী গম্ভীর, পুরুত গম্ভীর। অতনু আবার একটা করকরে নতুন নোট দিল, পুরুত ঠিক মতন জায়গা বেছে ফুল রাখল যাতে না পড়ে, বেশ কিছুক্ষণ প্রতিমার মাথার চিনিমাখানো মুকুটে ফুল রেখে সরিয়ে নিল হাত, পড়ে গেল ফুলটা। দর্শকদের গুঞ্জন আরম্ভ হয়ে গেছে অতনুকে ঘিরে । তিন বার চড়ানো যায় জানাল এক ভক্তিমতী বউ । অতনু আবার দিল নতুন নোট, প্যাকেট থেকে বের করে । পুরুতের হাত থরথর । ফুল পড়ে গেল । ভিড় জমতে থাকে অতনুকে ঘিরে । মানসীর কাঁপতে-থাকা হাত ধরে বাইরে আসে অতনু, জুতো পরে যে যার, হাঁটে গলিপথ ধরে দু-জনে চুপচাপ।
প্রাঞ্জল রাজপথে পোঁছে যে যার বাড়ি যাওয়াই, কোনও কথা না বলে, উচিত মনে করে । নভেলটি বুক ডিপোর বহুতল বাড়িটার কাছে রিকশায় তুলে দিল মানসীকে । রিকশয় চাপার আগে অব্দি, অতনুর পাশে দাঁড়িয়ে কাঁপছিল মানসী, নিয়ন্ত্রণহীন, এমনকি হ্যালোজেন আলোয় আবছা বেজে উঠছিল পায়ের মল ।
মানসী আক্রান্ত হয়েছিল অরগ্যাজমে, মন্দিরের ভেতরেই ওর শরীরে আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল ঢেউ, অতনুর পাশে দাঁড়িয়ে ঘটে গেল কেঁপে কেঁপে । অতনু নির্ঘাত ভাবছে কালী প্রতিমা ফুল নিলেন না বলে মানসীর অমন প্রতিক্রিয়া ; অতনুর সঙ্গে থাকলেই কেন এমন ঘটছে, দুশ্চিন্তায় মানসী, মন্দিরের মতন জায়গাতেও ঘটে গেল। গায়নাক দেখাবে, নাকি স্বামীকে বলবে ? কী করেই বা স্বামীকে বলবে যে একজন পরপুরুষের চৌম্বকক্ষেত্র মানসীকে পরপর যৌন আকর্ষনে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে !
অতনু টের পায়নি মানসীর কাঁপুনির উৎস, ও বোধ করছিল এক গোপন আনন্দ, কালী প্রতিমাকে পরাজিত করার আনন্দ, মানসীর দৈববিশ্বাস টলিয়ে দেবার আহ্লাদ । ওর আনন্দ দেখে ছুটন্ত ট্রাকগুলোর চক্ষুস্হির । মানসী অমনভাবে না কাঁপলে, কী এক অচেনা থরথর, বাড়ি অব্দি পৌঁছে দিয়ে আসার প্রস্তাব দিত অতনু ।
মোটর সাইকেলের পিলিয়নে বসে অফিসের সহকর্মী অরিন্দম মুখোপাধ্যায়, যে হিউমান রিসোর্সে কাজ করে, অতনুর সঙ্গে অফিস ফেরতা ওর বাড়িতে এসেছিল দিনকতক পরে, দুচার ফুঁক চরস খাবার গোপন সদিচ্ছা নিয়ে । পাকানো সিগারেট তামাকে মিশেল দিয়ে টেনে ঘণ্টা দুয়েক এমন একনাগাড় হেসেছিল অরিন্দম যে, অতনুর মনে হচ্ছিল, আগে একবার অপ্রকৃতিস্হ অরিন্দমের আবার বুঝি ঘটল মগজের বেগড়বাঁই, ফের ফিরে যাবে মানসিক চিকিৎসালয়ে ।
পাশবালিশ টেনে, আয়েস করে ফুঁক মেরে অরিন্দম বলল, জানেন তো মানসী বর্মণ রিজাইন করে চলে গেছে ওরসলিগঞ্জের গান্ধি আশ্রমে কাজ করার জন্যে ?
চলে গেছে ? কবে ? জানি না তো !
আপনি তো এমন বলছেন যেন আপনার অনুমতি নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল ।
হ্যাঁ, খবরটা শুনে ভেতরে ভেতরে খারাপ লাগল । কবে গেছে ?
গত মাসের পনেরো তারিখে ; উনি বলেছিলেন, জানাজানি না করতে ।
ওয়ারিস আলি গঞ্জ তো মারাত্মক জায়গা । মুসহররা থাকে । বিনোদ মিশ্রর নকশালদের গড় । একজন সুন্দরী আধুনিকা থাকবেন কী করে সেখানে গিয়ে ? ওরকম একটা জায়গায় গান্ধি আশ্রম করেটাই বা কী ?
আশ্রম পরিচালক ওনার স্বামী ।
স্বামী ? মানসী তো ডিভোর্সি ?
সব বানানো গল্প । লোক দেখানো । ওনার স্বামী এম বি বি এস ডাক্তার । ডাক্তারি করেন আর নিচু জাতের লোকেদের মধ্যে বিপ্লবের প্রচার । বাচ্চাটাও ওনারই । আর, গান্ধি আশ্রম বলে কিছুই নেই ওখানে । আছে ডাক্তারখানা । শুনেছি যে মাওবাদী কমিউনিস্ট সেন্টারের ক্রান্তিকারী কিষাণ সমিতির অফিস ওটা ।
আপনি কী করে এতসব জানলেন ?
উনি চলে যাবার পর জানতে পারলুম রসিক পাসওয়ানকে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে ।
অতনুর মন খারাপ হয়ে গেল শুনে ।
মানসী বর্মণের জন্য মনকেমন করে অতনুর ; অন্যের স্ত্রীর জন্য মনকেমন । জানা তো ছিল না, যে অন্যের স্ত্রী, কেন জানায়নি মানসী, কেন বুকের দুধ দেখিয়েছিল, কেন তালশাঁসের গন্ধ শুঁকিয়েছিল, কেন কালী মন্দিরে নিয়ে গিয়েছিল রিকশয় পাশে বসিয়ে, কেন তাহলে ব্যাগটা রাখতে দিয়েছিল, ওটা নিয়ে আমি কী করব, মনের গভীরে ফুঁপিয়ে ওঠে ও, অতনু ।
অফিসের কর্মীদের মাঝে খবর নেয়াদেয়া হয়, মুসহর ছেলেমেয়েদের অক্ষরজ্ঞান দিতে দেখা গেছে মানসী বর্মণকে, গয়া নওয়াদা অওরঙ্গাবাদ জেহানাবাদের গ্রামে, বন্দুকধারী যুবকেরা থাকে ওর পাহারায় ।
বছরখানেক পরে অফিসে একদিন কি হ্যাঙ্গাম, পাগলা ঘণ্টি । বিপদ আপদ ডাকাতি সামলাবার জন্য অফিসে নানা জায়গায় অ্যালার্ম ঘন্টির বোতাম লুকানো আছে । কাচের ঢাকনি ভেঙে বোতাম টিপলে সারা অট্টালিকা জুড়ে বাজতে থাকে পাগলা ঘণ্টি । ন-মাসে ছ-মাসে একবার করে মহড়া হয় । বহুক্ষণ বাজছিল বলে টের পাওয়া গেল আজকেরটা রিহার্সাল নয়, আসল । বাইরে বেরোবার আর ঢোকবার শাটার গেট দরোজা সব বন্ধ হয়ে গেল দ্রুত, তাক করে বসে গেল বন্দুকধারীরা পুরো বিল্ডিঙের বিভিন্ন ফ্লোরে, সুট-টাই পরা কর্তাদের হন-হন গট-গট, চেয়ার থেকে মুণ্ডু বার করে হাফ-কেরানি আর কেরানিদের কচাল । ঘণ্টাখানেক পরে অলক্লিয়ার ঘণ্টি বাজলে জানা যায় ব্যাপারটা । একজন অফিসার, যিনি জোড়াতালি দেয়া নোট পাস করেন এক এক করে, তিনি বাজিয়েছিলেন ।
ছেঁড়া জোড়াতালি নোটের কেরানিদের খাঁচার পেছনে ওই অফিসারের কেবিন, যিনি অ্যালার্ম বেল বাজিয়েছিলেন । পাবলিক আর নোটের দালালরা ছেঁড়াপচা নোটের লট দ্যায় কাউন্টারের কেরানিকে, সে নিজের খাতায়-কমপিউটারে এনট্রি করে অফিসারকে দেয় । তক্ষুনি বদলযোগ্য হলে অফিসার নোটের ওপর সই তারিখ দিয়ে পাঠায় হাফ-কেরানির কাউন্টারে । সেখানে টোকেন দেখিয়ে নতুন নোট নিয়ে যায় পাবলিক বা নোটের দালালরা ।
আপন মনে জোড়াতালি নোট পাস করছিলেন অফিসার । আচমকা একটা নোট হাতে নিয়ে তিনি স্তম্ভিত । নোটটা তিনি নিজেই বছরখানেক আগে ছাপ তারিখ সই দিয়ে পাস করেছিলেন । এটা তো শ্রেডারে শ্রেড হয়ে কাগজের মন্ড হয়ে যাবার কথা । বাজারে গেল কী ভাবে ! তার মানে নিয়ম মেনে নষ্ট করার প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি, মাঝ পথেই মেরে দিয়েছে কেউ; কিন্তু প্রক্রিয়াটা তো এমন যে, কোনো একজনের পক্ষে একাজ করা সম্ভব নয় ; নিশ্চয়ই একটা দল কাজ করছে, বাতিল নোট পাঠিয়ে দিচ্ছে বাইরে সার্কুলেশানে । কবে থেকে চলছে, কত নোট বাজারে বেরিয়ে গেছে, তার মানে তার তো কোনো হিসাব নেই । এক বছর আগের নোট, তার মাঝে কত এরকম নোট চলে গেছে সার্কুলেশানে । যে লোকটা নোটটা দিয়েছে, ধরতে হবে তাকেই । ভয়ে গলা শুকিয়ে যায় অফিসারের, কপালে বিনবিনিয়ে ঘাম । পেপারওয়েট তুলে সজোরে কাচঢাকা অ্যালার্মবেলের কোটরে মেরে বাজিয়ে দিলেন পাগলা ঘণ্টি । খদ্দেরটা নজর রেখেছিল, অফিসার নোটটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আলোয় পরখ করছেন দেখেই সে ব্যাটা হাওয়া ।
পুলিশে খবর দেয়া হল । ওই নোটটা যে কর্মীশেকলের মাঝ দিয়ে একের পর এক গেছে, তাদের নামঠিকানা যোগাড় করে ঢুঁ মারতে লাগল পুলিশ । কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হল । অতনু নিজেকে বলল, মানসী বর্মণ নিশ্চয়ই এই র্যাকেটের অংশ নয়, কিন্তু একটা ঢাউস ব্যাগ হুট করে দিয়ে উধাও হয়ে গেলো কেন! !
বাড়ি পৌঁছে খাটের তলা থেকে মানসী বর্মণের দেয়া ব্যাগটা টেনে, ধুলো ঝেড়ে, জিপ খুলতেই অতনু হতবাক, থ । ঠিক যা অনুমান করেছিল । অগোছালো নোটে ঠাসা, ছেঁড়াকাটা নোটের সঙ্গে বদলে নেয়া হয়েছে বা পিলফারেজ করা হয়েছে । ভেতরে অসীম পোদ্দারের ডায়রি, পাতার পর পাতা মানসী বর্মণকে লেখা প্রেমপত্র, যৌনরোগ বা যৌনস্বেচ্ছাচার থেকে পাওয়া রোগ আর সারবে না জানিয়েছে শেষ প্রেমপত্রে । ভাগ্যিস মানসী বর্মণ চলে গেছে, নয়তো এই নোটগুলো ওর বাড়িতে যদি পুলিশ পেতো কী কেলেঙ্কারি হতো !
ভোরবেলা, বাড়িতে দরোজায় তালা ঝুলিয়ে, ওয়ারিস আলি গঞ্জ যাবার বাস ধরার জন্য বেরিয়ে পড়ে অতনু, এক হাতে টাকাঠাসা ঢাউস ব্যাগ, কাঁধে ঝোলানো থলেতে এক সেট জামা কাপড় ।
ওয়ারিস আলি গঞ্জে বাস স্ট্যাণ্ডে বাঙ্গালি ডাক্টার গরিবোঁকা মাস্টারনি কোথায় থাকেন জিগ্যেস করতে একটা রিকশঅলা জানায় চলুন বাবু, আমি পৌঁছে দিচ্ছি, ওনারা তো দেওয়ি-দেওতা ।
রিকশ থেকে অতনু নামলে রিকশঅলাটা বলল, ওই যে ডাগডরবাবু, রোগি দেখছেন ।
এত রোগি ? এতো ছোটোখাটো জনসভার মতন, সবাই মাটিতে বসে ওনার কথা শুনছে, বলে ফেলল অতনু ।
জি হাঁ, দূর দূর থেকে আসে, ওষুধ দেন, টাকা-পয়সা নেন না ।
অতনু ঘরের ভেতরে ঢুকতেই ডাক্তার ওর হাতের ব্যাগ আর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, নিশ্চয়ই অতনু চক্রবর্তী, যিনি আমার দুধের বাটি থেকে চুমুক মেরে আমার স্ত্রীর গেলে-রাখা দুধ খেয়েছিলেন ?
আপ্যায়নে স্তম্ভিত অতনু, কী বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে রইল । কেমন স্ত্রী ? এই কথাগুলোও নিজের স্বামীকে বলেছে । শহুরে মানুষ দেখে একজন রোগি ভেতর থেকে একটা মোড়া এনে দিতে অতনু দেখল, ডাক্তারও মোড়ায় বসে আছে, টাক পড়া আরম্ভ হয়েছে, ফর্সা দোহারা চেহারা, টেবিলের ওপর নানা ওষুধের স্ট্রিপ ।
অতনু মোড়ায় বসার পর ডাক্তারের বলা পরের কথায় হতবাক হয়ে গেল, ডাক্তার বলল, মানসী চলে এলো দুটো কারণে, প্রথমত বুকের বইতে থাকা দুধ, আর দ্বিতীয়ত আপনার উপস্হিতিতে ওর তিনবার অটোম্যাটিক অরগ্যাজম হয়ে গিয়েছিল; বুক থেকে দুধ গালতে গালতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল, এখানে আসার পর আমিই আমার স্ত্রীর দুধ পান করার সুযোগ পেলুম, রাইট ফ্রম সোর্স । আপনি এসে ভালো করলেন, আমরা তো অনুমান করেছিলাম যে আপনি আরও আগেই আসবেন ।
ডাক্তার বলা বজায় রাখলো, মানসী বলেছে আমায় যে আপনি ওর নতুন প্রেমিক আর ও-ও আপনার উপস্হিতির প্রতি এমনই আকর্ষিত হয়ে পড়েছিল যে চলে আসতে বাধ্য হল । মানসী রোঁদে বেরিয়েছে, ঘণ্টা দুয়েকে এসে পড়বে । আপনি ততক্ষণ ভেতরে গিয়ে স্নানটান করে নিন, লুঙ্গি-পায়জামা কিছু এনেছেন, না এনে থাকলে আমারই একটা পরে নিন, ভেতরে বারান্দায় তারে ঝুলছে । ওইটা টাকার ব্যাগ তো ? ভালোই করেছেন এনে, বেশ কয়েকজন রোগির যৎসামান্য দামি ওষুধ দরকার, অন্য কাজেও লাগবে । অসীম পোদ্দারের প্রেমিকের ডায়েরিটাও ওতে আছে? থাকুক কখনও সময় হলে পড়ব । মানসী তো ফুলশয্যার রাতে ক্লাস এইট থেকে টুয়েলভ পর্যন্ত যে তিনশো প্রেমপত্র পেয়েছিল সেগুলো পড়ার সুযোগ হয়নি আমার । অনেক কথা বলে ফেললাম । বাংলা বলার সুযোগ পেয়ে ছাড়তে চাইছিলাম না । যান যান, আপনি ভেতরে যান ।
দশ
মলয় রায়চৌধুরী ডাক্তার ঘোষকে প্রথমে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন জঙ্গলমহলে আদিবাসিদের কুঁড়হা পরবের দিন, গা ঢাকা দেবার আর আদিবাসী রোগীদের সেবা করার জন্য, সেখানে মাওবাদীদের জমায়েতে ভিড়ে গিয়ে তাদের নির্দেশ মতো যাতে কাজ করতে পারে । সেখান থেকে চলে যেতে হলো ওয়ারিস আলি গঞ্জে, গান্ধি আশ্রমের নাম করে পার্টির কাজ করার জন্য, রোগীদের মধ্যে বিপ্লবের কথা প্রচারের জন্য । মানসী বর্মণ আর ডাক্তার দুজনে ভালোই ছিল ওয়ারিস আলি গঞ্জে, কিন্তু মলয় রায়চৌধুরী সেখানে পাঠিয়ে দিলেন অতনু চক্রবর্তীকে, আর ডাক্তারের জীবন ওলোট-পালোট হয়ে গেল । চৈত্রসংক্রান্তির দিন জঙ্গলমহলের আদিবাসিরা মুড়ি বা ছোলার ছাতু আর আম দিয়ে কুঁড়হা উৎসব করে । আগে এই পরব কুরমি আর আদিবাসীরা করতো, ক্রমশ ঝাড়গ্রাম, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, উত্তর দিনাজপুর, ঝাড়খণ্ড রাজ্য, বিহার, উড়িষ্যা রাজ্যের জনজাতির মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে । কুরমি সম্প্রদায়ের মানুষরা সেই দিন সকালে গোবর গুলে ঘরের সব ঘরগুলোয় আর উঠোনে ন্যাতা দেন যাতে বাড়ি শুদ্ধ হয়ে ওঠে । মহিলারা বাড়ির দোরগোড়ায়, উঠোনে, তুলসীমঞ্চে, হরিমঞ্চে আলপনা দেন । বাড়ির কর্তা বা বড়ো বউ যিনি উপোসি থাকেন, তিনি চান করে কচি শালপাতার থালাতে আম, মুড়ি বা ছোলার ছাতু আর মহুয়া রেখে পূর্বপুরুষের আত্মার উদ্দেশ্যে তুলসীমঞ্চে প্রার্থনা করেন । পুজোর আগে যাবতীয় সমিধ বাড়িতে জড়ো করে রাখতে হয় । পয়লা মাঘ হলো আখান যাত্রা । অনেকে মানত করে পাঁঠা কিংবা মোরগ বলি দেন । পুজোর মাংস গ্রামের সবাইকে ভাগ করে দেয়া হয় । কুরমিরা মহুয়াকে নারী আর আমকে পুরুষ হিসাবে অনন্তকাল থেকে মান্যতা দিয়ে এসেছে । তারা বলে ‘আম ডাকে বান’ আর ‘মহুল ডাকে খরা’ । যে বছর আম বেশি হয় সে বছর প্রচুর বৃষ্টি পড়ার কথা । যে বছর মহুয়া বেশি হয় সে বছর বৃষ্টি কম হবার কথা । এখন আমও বেশি হয় না, মহুয়াও বেশি হয় না । বৃষ্টি আর খরা নিজের ইচ্ছেমতন আসে ।
ডাক্তার কুরমিদের কুঁড়হা উৎসব মনে রেখেছে, মহুয়ার মদ প্রথমবার খেয়ে বাঁধনছেঁড়া মাতলামো করেছিলো ।
ডাক্তারের মনে আছে পালামৌয়ের নরসিংহপুর পাথরা গ্রামের কথা, সেখানে গিয়েছিলো মলয় রায়চৌধুরীর প্ররোচনায়, দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত গ্রামে, খরা, প্রচণ্ড গরম, জল নেই, খাবার নেই, মানুষেরা যে গাছের পাতা আর আমের আঁটি খেয়ে বাঁচার চেষ্টা করে তা কলকাতায় ছাত্র-রাজনীতি করার সময়ে ভাবতেও পারেনি । সরকার খিচুড়ি বিলি করতো, যার জন্যে ছেলে বুড়ো বউ সবাই হাতের তলায় হাত পেতে খিচুড়ি নিয়ে খেতো, ব্যাস এক হাতা, তার চেয়ে বেশি খিচুড়ি যোগাতে পারতো না সরকার । গ্রামের ডিসপেনসারিতে কোনো ওষুধ ছিল না, সেখানেই শুতো ডাক্তার । অবিচারের বিরুদ্ধে ক্ষেপে গেলো ডাক্তার । মানসীকেও নিজের বিশ্বাসে চুবিয়ে ফেলতে সময় লাগলো না ।
তারপর থেকে ডাক্তার কেবল একবেলা খায়, রাতে খায় না কিচ্ছু ।
১৯২৯ সালে লেখা মহেন্দ্রনাথ দত্তের ‘কলিকাতার পুরাতন কাহিনী’ বইয়ের কথাগুলো মনে পড়ে গেল ডাক্তার ঘোষের । উনি লিখেছিলেন, “তখনকার দিনে অধিকাংশ লোক ভাত খাইত । সহরে লোকেরা দিনে আড়াই পোয়া চালের ভাত, রাত্রে আধসের চাল ও তদোপযুক্ত তরকারি । অনেক লোকের বাযিতে গোরু ছিল এইজন্য দুধও পাওয়া যাইত। না হইলে গয়লাদের বাড়ি হইতে দুধ আসিত, সেও সস্তা । কলকাতার দক্ষিণদেশ বা বর্ধমান হইতে আমাদের বাটীতে যখন লোকজন আসিত, তাহারা অধিক পরিমাণে আহার করিত । দুপুরবেলা তিন পোয়া হইতে এক সের চালের ভাত খাইত এবং রাত্রে কিছু কম ।”
আজ, কেন ওনার মনে হচ্ছে যে অবিচারের বিরোধিতা করতে গিয়ে অবিচারের আশ্রয় নেয়া ছাড়া উপায় ছিল না । আজ কেন মনে হচ্ছে মানসীকে ভুল পথে এনে মানসীকে ছাড়তে না পেরে নিজের ভেতরে নিজেই হারিয়ে গেছেন ।
মনে পড়ে যাচ্ছে, মেক্সিকো অলিম্পিকে মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ প্রতিযোগীদের ব্ল্যাক পাওয়ার স্যালিউট ।
মনে পড়ে যাচ্ছে ভিয়েৎনামে ন্যাশানাল লিবারেশান ফ্রন্টের টেট আক্রমণ-প্রণালী ।
মনে পড়ে যাচ্ছে চেকোসলোভাকিয়ার প্রাগ বসন্তকাল ।
মনে পড়ে যাচ্ছে প্যারিসের পথে-পথে ১৯৬৮ সালের মে মাসে ছাত্রদের উথ্থান ।
মনে পড়ে যাচ্ছে ১৯৬৪ সালে কলকাতায় হাংরি আন্দোলনকারীদের হাতে হাতকড়া কোমরে দড়ি পরিয়ে রাস্তায় হাঁটানো।
মনে পড়ে যাচ্ছে ১৯৭১ সালের আগস্টে বরানগরে শয়ে-শয়ে যুবহত্যা, ঠেলায় গাদাগাদি চাপিয়ে গঙ্গায় ।
মনে পড়ে যাচ্ছে লাতিন আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, প্যালেসটাইন, ভিয়েৎনাম ।
মনে পড়ে যাচ্ছে ঈশ্বরের মৃত্যু ।
মানসী এখনও ঈশ্বরে বিশ্বাস ছাড়তে পারেনি, জানে অতনু ওর মায়ের দেবী-দেবতাকে থলেতে ভরে গঙ্গার জলে ফেলে দিয়েছিল ।
এগারো
কী করছ কী ? নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, আঃ, ছাড়ো ।
মনে করুন আপনি আমাকে জন্ম দিচ্ছেন, তাই কষ্ট হচ্ছে, মনে করুন, মনে করুন, সেই সময়ের যন্ত্রণা, আপনি কি মনে করেন আমার জন্মাবার কোনো যন্ত্রণা হয়নি, কষ্ট হয়নি ?
আর ইউ ম্যাড ? কী করছ কী, নামো নামো, আমি তোমার মা, কী করছ কী, অমিত, এত জোরে জড়িয়ে ধোরো না, ছাড়ো ছাড়ো, মুখ সরাও, দাঁতও মাজো না কখনও, নোংরা জানোয়ার কোথাকার ।
জানি আপনি আমার মা, কিন্তু জানি না আমার বাবা কে, অতনু না ডাক্তার ঘোষ ? দুজনের সঙ্গেই তো শুতেন এক সময়, তাই না ? এখন না হয় আমার সঙ্গেই শুলেন ।
ছাড়ো, ওফ, ছাড়ো, লুম্পেন একটা ।
কেন ছাড়বো, ওনাদের দুজনকে তো আপনার দুধ খাইয়ে ছিলেন, যা আমার প্রাপ্য ছিল ।
কী করছ কী ?
আপনার দুধ খেতে চেষ্টা করছি ।
দুধ থাকে নাকি এই বয়সে, ইউ ইডিয়ট, নেমে পড়ো, ছাড়ো, ছাড়ো, কখন আমার বিছানায় চলে এসেছো! আরে কী করছ কী !
দুধ নেই জানি, তার বদলে আপনার ঘামই খাচ্ছি, গন্ধ খাচ্ছি, আপনার সঙ্গে আমার সম্পর্ককে গড়ে তুলতে চাইছি । মিষ্টি দুধের বদলে নোনতা ঘাম, আপনার শরীরের জোনাকিদের মুখে পুরে নিজেকে আগুনে পুড়িয়ে নিতে চাইছি ।
পাগল নাকি ? বন্ধ করো, ওফ, নাম, নাম আমার ওপর থেকে, নাম, তোকে এখানে আনাই উচিত হয়নি। মুখের ওপর থেকে মুখ সরা ।
মারুন চড় । যাক তুইতোকারিতে তো এলেন, এতদিন ছিলাম আপনার সঙ্গে, যেই নিশ্বাস বন্ধ হতে লেগেছে তখন বুঝতে পারলেন যে তুইতোকারি করতে হবে ।
অমিত, তুমি জানোয়ারের কাজ বন্ধ করো, ছাড়ো আমায়, ছাড়ো ।
ছাড়ব না ।
কী করছ, ইউ স্কাউন্ড্রেল, কী করার চেষ্টা করছ ?
আপনার তৃতীয় প্রেমিক হবার চেষ্টা করছি । মুখ বন্ধ রাখুন । নিন প্রেম, নিন প্রেম, ক্রান্তি, ক্রান্তি, ক্রান্তি…. ।
কষ্ট হচ্ছে, কষ্ট হচ্ছে, ব্যথা করছে । বয়স হয়ে গেছে, এই বয়সে হয় না ওসব, গেট ডাউন, ইউ স্কাউণ্ড্রেল কী চাই তোমার ?
আপনাকে চাই । জানতে চাই, আমার বাবা কে ?
তুমি অতনুর ছেলে নও , তুমি ডাক্তারের ছেলে ।
হ্যাঁ, কাঁদুন, আমি চাই কষ্ট হোক, নিজের কাছে অপমানিত বোধ করুন, নিজের সম্পর্কে আপনার ঘেন্না ধরে যাক, যেমন আমার নিজের জীবনে ঘেন্না ধরে গেছে । যা চাই তা্-ই তো নেবার জন্য আপনার বুকের ওপর চেপেছিলুম । বালিশের তলায় কী খুঁজছেন ? সায়লেন্সার-লাগানো রিভলভার ? আমার দেয়া টাকায় কিনেছিলেন, এখন আমায় মারবার জন্য চালাতে চান, তাই না ? সেটা আমি আগেই সরিয়ে রেখেছি, জানি আপনার কাছে আপনি ছাড়া আর কারোর কোনো দাম নেই । ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন, শুনেছি, ডাক্তার ঘোষ বলেছেন আমায়, দেখুন ঈশ্বর এখন আপনাকে বাঁচাতে আসছে না । বন্দুকও আপনাকে বাঁচাতে আসছে না । চুলোয় যাক আপনার ক্রান্তি, এটা আমার বদলা নেবার ক্রান্তি । আপনি চেঁচাতেও পারবেন না, জানি, আপনার ক্রান্তিকারিরা জড়ো হলে লজ্জায় বেঁচে থাকতে পারবেন না ।
কী করলে কী তুমি, ছি ছি ছি ছি ।
ওই ছিছি নিয়ে আমি এতকাল বেঁচে ছিলুম, এবারে আপনি আমার সারা জীবনে জড়ো করা ছিছিক্কার নিয়ে বাঁচুন । খাট থেকে উঠবেন না, চুপ করে শুয়ে থাকুন, নয়তো মরবেন, এই দেখুন সায়লেন্সার লাগানো আপনার ক্রান্তির যন্তর, আমারই দেয়া টাকায় কেনা ।
মানসী বর্মণের তেরপলের বাইরে বেরিয়ে অমিত দেখল দূরে অন্ধকারে কনকদুর্গা দাঁড়িয়ে ; যন্তরটা মানসী বর্মণের তেরপলের কাছে ফেলে দিলো ।
বারো
কনকদুর্গা বললো, আই অ্যাম প্রেগন্যান্ট উইথ ইওর চাইল্ড, বাট আই ডোন্ট ওয়ান্ট হিম টো গ্রো আপ এ কিলার লাইক মি, উই আর গোইং টু পাটনা, টু গেট লস্ট ইন দি ক্রাউড ।
অমিত বলল, ঠিক আছে, ইংরিজি ঝাড়িসনি , ভাল্লাগে না শুনতে, মুখস্ত করতে করতে জান হালকান হয়ে গেছে এই ক্রান্তিকারি ঢকোসলাবাজিতে, টাকার বাণ্ডিলটা রেখে নিয়েছি ; অতনু চক্রবর্তীকে মাথায় নল ঠেকিয়ে উড়িয়ে দিয়েছি । মানসী বর্মণ বেঁচে থাকুক ক্রান্তি করার জন্য, সারা জীবন ভুগুক ছেলেকে অন্যের বাড়িতে ফেলে আসার পাপে, এবার ঘেন্নায় মরে যাবে কেঁদে-কেঁদে, পাগল হয়ে গেলে ভালো হয় । জানাজানি হবার আগে অনেক দূরে চলে যেতে হবে, পাটনায় চলে যাবো, ওখানকার গরিবদের বস্তিগুলো সব আমার জানা ।
হ্যাঁ, ঝিয়ের কাজ করে চালাবো যতোদিন পারি, তুইও পারলে সাইকেল রিকশা চালিয়ে রোজগার করিস । আমি তোর চেয়ে পনেরো বছরের বড়ো ; পনেরো বছর বয়সে বিয়ে হলে তোর বয়সের ছেলে হতো। কোথাও কেউ জিগ্যেস করলে আমি বলবো তুই আমার ছেলে । তুইও তাদের সামনে মা বলে ডাকবি ।
কতোবার যে জীবনে নকল মায়ের পাল্লায় পড়তে হবে কে জানে ।
চল, পালাবার শর্টকাট আমি জানি ।