প্রজাপতি – ০৬
শিখা বেরিয়ে গেল, চারদিকটা অসম্ভব চুপচাপ নিঝুম মনে হতে লাগলো, কেবল মাঝে-মাঝে হঠাৎ এক একটা পাখি ডেকে উঠছিল, যে ডাক শুনে, আমার যেন কেমন মনে হল, ওরা আমার বিষয়ে বলাবলি করছে—আবার সেই ভূতুড়ে ব্যাপার, যা শুনলে লোকের মার খাওয়া ছাড়া কোন রাস্তা নেই, কিন্তু এইরকম অবস্থাটাকে আমি জানি, এইরকম নিঝুম চুপচাপ, পাখির ডেকে ওঠা, কেননা, আমার অনশনের শেষে, অনেকগুলো দিন ঠিক যেন এভাবেই কেটে ছিল, সেই সব দিনগুলোর কথাই আমার মনে পড়ছে। আমার শরীরের শক্তি ফিরে আসতে কিছুদিন দেরী হয়েছিল, কিন্তু আমার ভিতরে কীরকম একটা গোলমাল হয়ে গিয়েছিল। যেদিন অনশন শেষ হয়েছিল—ক’দিনই বা, ছ’দিন তো মাত্র, লোকেরা তার থেকে কত বেশী দিন করে, নাম-করা নাম-করা লোকেরা, তাদেরই আবার কত কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি শোনা যায়, অদ্ভুত কাণ্ড সব—কিন্তু সে তুলনায় ক’দিনই বা অনশন করেছিলাম! স্ট্রাইক সাকসেসফুল, খুব ঢোল পিটিয়ে আমাদের মাথায় করা হল, বাড়ি ফিরে এলাম। শিখার কথা আমার মনে ছিল, কিন্তু তার জন্যে যে মনের মধ্যে খুব একটা ছটফটানি আকুলিবিকুলি ভাব, তা মোটেই ছিল না, মনে হয়েছিল আমি কী রকম একটা অন্য লোক হয়ে গেছি। আমার মনে আছে, আমি মনে মনে বলেছিলাম, ‘শিখা, আমি সারাজীবন তোমার কথা চিন্তা করব, তোমাকে আমি পাই না পাই, সেটা বড় কথা না, তোমাকে আমি মনের মধ্যে রেখে দেব।’ সত্যি মনের মধ্যে রাখা যায়, পরে সেটা একটা ন্যাকামি মনে হয়েছিল। তবে আমার এই রকমই মনে হয়েছিল, কারুর সঙ্গে বিশেষ কথাবাতা বলতে ইচ্ছা করতো না, আর সে সময়েই আমার প্রথম মনে হয়েছিল, ‘আমি কেন এই পৃথিবীতে। অনশনের কথা তো কয়েকদিন বাদে একেবারে যেন ভুলেই গিয়েছিলাম, সমস্ত ব্যাপারটা একটা কোন ব্যাপার বলেই মনে হচ্ছিল না, তখনো গভনিং বডিকে মেরে ঠাণ্ডা করার কথাই আমার ঠিক মনে হচ্ছিল, কেননা, সেই লোকগুলোর জন্যে না খেয়ে এত কাণ্ড করার কোন অর্থই হয় না, তবু আমার ভিতরটা কেমন ভার হয়ে উঠেছিল। আছে না একরকম, আমার মনে হয় পৃথিবীতে সব মানুষেরই বোধহয় এরকম কখনো কখনো হয়, কী যেন তার হয়েছে, সে কিছুই জানে না, বুঝতে পারে না, নিজেকে নিয়ে সে কী করবে! সে কেনই বা পৃথিবীতে এল—কারণ, এই যে আমি এসেছি—পরে এ ব্যাপারটাকে প্রায় খচরামি বলে মনে হয়েছে আমার, কেন আমি এসেছি, কেন গরুর বাচ্চা হয়, কাকের বাচ্চা হয়, এসব কথার কোন ঠিক অর্থই হয় না, কিসে কী হলে মানুষ জন্মায় বা গরুর বাচ্চা হয়, একথা সবাই জানে, তা-ই সেও কেন পৃথিবীতে এল, সেও তা জানে, যার জবাব ধাইয়ের চেয়েও বাবা মা-ই ঠিক বলতে পারে। আমার ঠিক তা মনে হয়নি, আমার মনে হয়েছিল, আমার খিদে পেলে আমি খাই, আমার কিছু করতে ইচ্ছা হলে আমি করি—না, এটাও ঠিক না, আমার যা করতে ইচ্ছা হয় তা-ই আমি কী করে করব, আমি যদি মনে করি কারখানার ম্যানেজার চোপরার মাইনে মজুরদের মতই করে দেব, আর মজুরদের মাইনে চোপরার মত, তাহলে কেউ শুনবে না; একমাত্র ঠ্যাঙনি খাব, তাহলে আলাদা কথা। সেই রকম ইচ্ছার কথাই বলছি, আমি নিজের ইচ্ছায় পৃথিবীতে আসিনি।
এ কথাটাও এক ধরনের ইয়ারকির মত লাগছে, কিন্তু এ কথা আমার তখন মনে হয়েছিল। তখন যদি আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করতো, বা এখনো করে, তাহলেও আমি এই কথাই বলব, আমার একদম আসবার ইচ্ছা ছিল না। এই যে আমি সুখেন-সুখেন্দু,—বাবা কি বিচ্ছিরি নাম,যেন শুনলেই গা ঘুলিয়ে ওঠে, আমি কিনা সুখেন্দু, আমি কী জন্যে পৃথিবীতে এসেছি, আমার কী-ই বা করবার আছে, আমি বুঝতে পারছি না নিজেকে নিয়ে কী করব। বাবা হবার ইচ্ছা নেই, কেশব বা পূর্ণেন্দু হতে চাই না, আর ওই যে সব কী বলে, বড় বড় মানুষদের—ওই আর কি, জ্ঞানী গুণী মনীষী, তা হবার কথা বিশ্বাস করতে পারতাম না, ওটা অনেকটা যেন ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি’-এর মতন, পড়াই সার, কাজে না,—“হ্যা রে সুখেন, তুই বড় হয়ে কী হবি? ‘স্যার, বিদ্যাসাগরের মতন হব। ‘ভাল, খুব ভাল। ছেলেবেলায় ইস্কুলে এরকম সব কথার খেলা হত—এখন মনে হলে যেমন মনে হয়, স্সাহ্, যেমন স্যার তেমনি ছাত্তর। আর সে সময়টা, অনশনের পরের সেই দিনগুলোতে, তখন আমি সুখেন গুণ্ডা হইনি, তখন যা ছিলাম, সেটাও আমার ইচ্ছা ছিল না, তার চেয়ে মজার কথা, এখন যা হয়েছি, তাও আমি ইচ্ছে করে হইনি, কী রকম বলতে বলতে হতে হতে হয়ে গেলাম। কলেজে দলাদলি করতে গিয়ে, সাতটা মাথা ফাটাবার পরেই সবাই বলতে আরম্ভ করেছিল, গুণ্ডা গুণ্ডা, যে কারণে শহরের মাস্তানরাও আমাকে খাতির-টাতির দেখাচ্ছিল, তারপরে একদিন দেখলাম, আমি গুণ্ডাই হয়েছি। কিন্তু আমি ইচ্ছা করে হতে চাইনি, আমি যে কী হতে চেয়েছিলাম, তা জানতাম না, আর অনশনের পরে, সেই দিনগুলোতে, ক’দিন আর, মাস দুয়েকের মত হবে, আমার সেই সব কথা মনে হয়েছিল, “কী হবে আমার, আমাকে নিয়ে কী করব’, আর এরকম মনে হতেই, হঠাৎই মনে হয়েছিল, ‘আমি কেন এই পৃথিবীতে! আমি ইচ্ছা করে আসিনি।
কথাগুলো ভাবতে যে কেবল রাগই হচ্ছিল, তা না, রাগের থেকে বেশী, আমি যেন কেমন চোখে-কানে পথ না দেখতে পাওয়া দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম, একটা বিচ্ছিরি কষ্ট হয়েছিল, এমন কি এ কথাও মনে হচ্ছিল, কোন আত্মা-টাত্মা আমার পিছনে লেগেছে বোধহয়, না হলে, এমন অসম্ভব আজগুবি কথা আমার মাথায় আসছে কেন, আমি ইচ্ছা করে পৃথিবীতে আসিনি, অথচ স্সাহ্, বেঁচে থাকাটা আমারই দায়। আরে, একি ইতরামি! কার ইতরামি এসব! ন্যাকামি মনে হচ্ছে না একরকমের? তখন আমার মনে হয়েছিল, গলায় দড়ি দিই, কিন্তু সেটা দিতে পারছিলাম না বলেই তো গোলমাল লাগছিল, কারণ আমি ইচ্ছা করে মরতেও পারছিলাম না।
যখন আমার এরকম সব কথাবাত মনে হচ্ছিল, মনে আছে, সেই সময়ে মেজদার একটা বড় চাকরির চেষ্টা চলছিল। বাবাই করছিল সব, বড় চাকরি মানে, মস্ত বড়, এখনই ও দেড় হাজার টাকা মাইনে পায়, এখান থেকে মাইল ছয়েক দূরে একটা ফ্যাক্টরিতে—ডিপার্টমেন্টাল হেড এখন, মেলাই ক্যাশের ছড়াছড়ি। তখন ও চাকরিট পেয়েও গিয়েছিল। পাবেই জানা কথা, অমন যার এলেমদার ফাদার, আহ্ কী শাহেনশা বাপ ছেলে, ঠিক রাত্রের অন্ধকারে বাদুড়ের মত পাকা ফলটি গিয়ে খুঁজে বের করেছিল, কেন না, আমি তো জানি, দিল্লি থেকে ভায়া কলকাতা এ্যাপয়েন্টমেন্ট আনতে হয়েছিল অনেক ভাল ভাল ছেলেকে লেঙ্গি মেরে। মেজদা—পূর্ণেন্দু, তখন ভীষণ ব্যস্ত, এ বেলা কলকাতা যায়, ওবেলাই সেই ছ’ মাইল দূরের ফ্যাক্টরি কোয়াটারে যায়, ছুটোছুটি দৌড়াদৌড়ি, আর বাবার সঙ্গে কেবলই কনফারেন্স, বাপ-ব্যাটায় কী চুপি চুপি কথা—অথচ ওই মেজদাকেই দেখেছি, তার মাস কয়েক আগেই, ওদের দলের হয়ে বাবার অফিসে হামলা করেছিল, বাবার বিরুদ্ধে অফিসের গরীব স্টাফের হয়ে লড়াই করেছিল—সেই মেজদাকেই দেখেছিলাম, কী ভাব দুজনে, গুজুর গুজুর, ফুসুর ফুসুর, চাকরি তো না, যেন একটা কনসপিরেসি চলেছে। তা করুক গে, কিন্তু ও সে সময়েও, যখন আমি বাড়িতেই বেশীর ভাগ সময় থাকতাম আর ওইসব বিচ্ছিরি চিন্তাগুলো কুরে কুরে খাচ্ছিল, তখনো আমাকে টোপ ফেলতো, ওদের দলে যাবার জন্যে। বড়দাও একই চার ফেলে যাচ্ছিল, ও তো তখন উড়ছিল বলতে গেলে, মস্ত বড় নেতা দারুণ খাতির, শহরের ইয়ং লীডার। আমার মনের কথা তো ওরা বুঝতেই পারছিল না সেখানে কী হচ্ছে, আমি বলতেও পারছিলাম না, কারণ ওসব কথা আবার বলা যায় নাকি, আর বললেই বা সবাই ভাববে কী, আরো পেছনে লাগতো। তা-ই কেশব আর পূর্ণেন্দু, দুজনে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া চালিয়েই যাচ্ছিল আর আমাকে, সময় পেলেই, দুজনে আলাদা আলাদা দলে টানবার চেষ্টা করছিল। কেবল শুলদাকেই দেখেছিলাম, কেমন করে যেন চেয়ে থাকতো। এমনিতে তো শুলাদাকে খুব বোকা বোকা লাগে দেখতে, কিন্তু চোখ দুটো কেমন যেন, মনে হত সব সময়েই একটা কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছে। তখনো কয়েক মাস বাকী ছিল ফাইনাল পরীক্ষার, যে-পরীক্ষায় দু’বার গাববা মেরেছিলাম, তখন সেটা থার্ড টাইমের হাঁকোর। বই-টই নিয়ে বসতাম, মাস্টারমশাইরা পড়াতে আসতো, ‘ড্যু ইউ ফলো মী?’ ‘হ্যাঁ স্যার।’ ‘ভেরি গুড! সেই একই খেলা চলছিল, তবে আমি যেন তখন খানিকটা অভ্যাসমত জবাব দিতাম, ‘হ্যাঁ স্যার।’ জিজ্ঞেস করলে, হ্যাঁ ছাড়া, কোনদিন না বলতে তো শিখিনি, তবে মাস্টারমশাইরাও বুঝেছিল, ছোঁড়ার একটা কিছু গোলমাল হয়েছে, যে জন্যে প্রায়ই জিজ্ঞেসা করতো, ‘তোমার শরীর-টরীর খারাপ নাকি।’ তখন আবার একটা খাতিরের ব্যাপারও ছিল তো, সদ্য হাঙার স্ট্রাইক করে জিতেছি। তার চেয়েও বড় কথা, ফাদারকে যেন কেমন একটু অন্যরকম লাগতো, মাঝে মাঝে আমাকে এসে জিজ্ঞেস করতো, শরীর খারাপ নাকি। সারাদিন বাড়ি বসে কেন, একটু ঘুরে-টুরে এলে তো হয়। পড়াশুনো হচ্ছে তো! সেই বারো-তের বছরের ভয় পাওয়ার মতন না হলেও, প্রায় সেরকমভাবেই আমি জবাব দিতাম, ‘কিছু হয়নি। সব ঠিক আছে। বাইরে যেতে ভাল লাগে না।’ ফাদারের যেন কেমন একটা ভুরু খোঁচানো চাউনি হয়ে যেত, অনেকক্ষণ আমার দিকে চেয়ে থাকতো, সব থেকে খারাপ লাগতো, যখন দেখতাম, ‘কী, চুপচাপ বসে কী করছ’ এই বলে আমার সামনে বসে থাকতো। পনর মিনিট, আধঘণ্টা কেটে যেত, তাতে দুজনেরই যে অস্বস্তি, দুজনেই যেন বুঝতে পারতাম, অথচ কেউ কাউকে কিছু বলতে পারতাম না, আমার উঠে যেতে ইচ্ছা করলেও, উঠে যেতে পারতাম না। ফাদার যে কেন বসে থাকতো ছাই, বুঝতে পারতাম না, কোন কোন দিন হঠাৎ হঠাৎ বলতো, তোমার দাদাদের যা হোক জীবনের একটা গতি হয়ে যাচ্ছে। রাজনীতি-টাজনীতি বুঝি না, আমি বুঝি প্রতিষ্ঠা, লাইফে এস্টাব্লিসড হতে হবে। পিকু অবিশ্যি চাকরি করলো না, রাজনীতি করতে গিয়ে যদি কোনদিন মার খেয়ে না মরে, তবে যাই হোক, সে মন্দ কিছু করছে না। শুনেছি, কাছেই কোথায় নাকি একটা মস্ত দীঘিসহ বিঘে দশেক জমি ইতিমধ্যেই কিনেছে, খুব ভাল কথা। আরো শুনেছি, গোটা কয়েক সাইকেল-রিকশাও নাকি ইতিমধ্যে কিনে ফেলেছে, তা দল-টল করে যদি এসব করা যায়—কী কবে করছে তা জানি না, শুনি নাকি ওর খুব ক্ষমতা, তা ভাল। তারপরে নিকুও মন্দ না, থার্ড ডিভিশনে পাশই করুক, রাজনীতিই করুক, অনেক স্কলার ওরকম ভাল চাকরি আজ পাবে না। আর আমার মনে হয়, তোমার। মেজদা এত বোকা না, এই চাকরি থেকে দল তার কাছে বড় হয়ে উঠবে। কথায় বলে, “চাচা আপন প্রাণ বাঁচা।” আপনি না খেতে পেলে, শংকরাকে ডেকে লাভ নেই; আগে নিজেরটা নিজের সুখসুবিধে ইত্যাদি, তারপরে আর সব, তা সে রাজনীতিই হোক আর যা-ই হোক, সবাই তা-ই করে, কিছু টাকা-পয়সা চাঁদা বা একটু মিটিঙ-টিটিঙ করা, তা করুকগে না, মুখে যাই বলা যাক কাজে তো আর করতে যাচ্ছে না। আগে চাই নিজের প্রতিষ্ঠা। নেহাত তারাই বেশী চেঁচামেচি করবে, যাদের কোন গতি হচ্ছে না, যাদের এ্যামবিশন ফুলফিল হচ্ছে না, এতদিনের চাকরি-জীবনে সেটা আমি বুঝেছি, বহুলোক নিয়ে আমি এতকাল কাজ করেছি, অনেক দেখেছি, নিকুও সেসব ভালই বোঝে। যাই হোক, তারও একটা গতি হয়ে গেল, এখন বাকী রইলে তুমি.। স্সাহ্, ভারর ভ্যারর ভ্যারর, কী মাইরি, ঠিক মনে হত, কোথাকার স্যার এলেন, লেকচার দিয়ে যাচ্ছেন। ওসব কথা আমাকে কেন, কেশব বা পূর্ণেন্দু সম্পর্কে ফাদার যেসব কথা বলতো, সেসব যদি ওদের সামনে বলতো, তাহলে ওরা ফায়ার হয়ে যেত। দুজনেই চেঁচিয়ে উঠতো, বাবা, আপনি ভুল বলছেন, আপনি আমাদের ব্যাপারটা বুঝবেন না। তা-ই কখনো হয়, ওদের ব্যাপপার কখনো বোঝা যায়? বাবার চাকরিটা তো মস্ত বড় ছিল, মস্ত চাকরি মানেই, মস্ত কাজ, মস্ত মানুষ, বাকী যা সব ঘুষ, ত্যালানি, চুরি-চোট্টামি, সেসব ব্যাপপার কেউ কি বুঝতে পারতো? কেশব কোথায়—আমরা দেশকে গড়তে চাই, বুঝলি নিকু, কিন্তু তোদের মত দুশমনদের ঠাণ্ডা না করে তা হবে না ‘—এই বলতো আর নিকু অমনি তেড়ে উঠতো, ‘আরে তোদের কাছে গড়া আর গ্যাঁড়া একই কথা, জানি। তোদের ওই কুরুবংশ শেষ করে, আমরা নতুন দেশ তৈরী করব, জনসাধারণকে ধোঁকা দিয়ে বেশী দিন চলে না।’
পিকু বলতো, ‘তুই বলছিস একথা, আর তোর মত ধোঁকাবাজদের জনসাধারণ বিশ্বাস করবে? এ হাসতো, ও-ও হাসতো, হাসি তো না—দাঁত কিরিমিরি করার শব্দ ওসব। তারপরে, এ ওকে ধোঁকাবাজ, এ একে ধোঁকাবাজ বলে গালাগাল, তর্কবিতর্ক, সব শেষে, যে যার তালে বেরিয়ে যেত। এখন ঘরে গিয়ে দেখ, দুজনেরই সাজানো-গোছানো কী আরামের ঘর। আলমারিতে খুঁজলে, দুজনের ঘরেই ভাল ভাল জিনিস পাবে, মানে বাবা যাকে এস্টাব্লিসড বলে—তা-ই, কিন্তু ওসব কথা ওদের কাছে হিদুর গো-মাংস, ওরা লড়ে চলেছে।
সমস্ত ব্যাপারটাই আমার কাছে এমন জঘন্য চালাকি মনে হত, ওরা তিন বাপ-ব্যাটাই সমান, আমাকেও ওরা ধোঁকা দিতে চায়। ফাদারের ওসব বক্বক্ করার কোন দরকার ছিল না আমার কাছে, তার ভালই জানা ছিল, ‘এস্টাব্লিসড ওই গালভারি কথাটার অর্থ কী, আর ওদেরও দরকার ছিল না, আমাকে নিয়ে দলে টানাটানি করবার। একজন গ্যাঁড়াবাজ আর একজন ধোঁকাবাজ, এটা তো শুলাদা পর্যন্ত বুঝতো। দুজনেরই গোছ-গোছানি সুখের জীবন, আবার দুজনেই শহরের দুই দলের নেতা হয়ে উঠেছিল—কী করে তা কোনদিন বুঝিনি, বুঝবও না—যেন ওদের জীবনের দুটো দিক—ব্যবসা চাকরি চুরি ঘুষ একদিকে, আর একদিকে দল, আর দলের সময় মনে হত, সেটাই যেন ওদের জীবনমরণ, এ ওকে খায়, ও একে খায়—তা খাকগে না, আমাকে কেন। আমার যা খুশি তা-ই হব, তাতে ওদের কী, খচ্চর।
যাই হোক, সে-সময়টা অনশনের পরের দিনগুলোতে যখন সেই সব উদ্ভট ভাবনা-চিন্তা আমাকে কী রকম কবে ফেলেছিল, যে-যাই বলতো, কারুর সঙ্গে ভাল করে কথা বলতে পারতাম না, এমন কি, বড়দা মেজদা ঠাট্টা করে এমন কথাও বলতো, কীরে টুকু, দেখিস সাধু-টাধু হয়ে যাবি নাকি? তখনো চুপ করে থাকতাম, যেন আমি একটা হারিয়ে যাওয়া ছাগল বাচ্চা, আর ভাবতাম, ‘কী হচ্ছে এটা, ওরা সব কেমন মজায় আছে, আর আমার মাথায় যত সব বাজে পোকা ঢুকে বসে আছে। সত্যি কথা বলতে কি, মনে হয়েছিল, আমাকে যেন কারা সব, মরবার দিকে তাড়িয়ে নিয়ে চলেছিল, অথচ মরতে পারছিলাম না, অথচ বেঁচে থাকা কী জন্য তাও বুঝতে পারছিলাম না। কারণ কোন কিছুতেই কোন ইচ্ছা হত না আমার—লোকে শুনলে বলতো, সব কিছু জেনে তক্ষকটি হয়ে বসে আছি—কিন্তু তাও তো সত্যি না। এরকম একটা অবস্থা। এইটাই কেবল আশ্চর্য, সেই সময়ে সেই যে একটা ভয়ের গুরগুরানি, সেটা আমাকে একদিনও পেয়ে বসেনি, একদিনও টের পাইনি।
এখন আমার সেইরকম মনে হচ্ছে। সেই সময়ের অবস্থাটা যেন চেপে ধরছে। এখন, শিখা চলে গেছে ঘর থেকে, আমি মেঝে থেকে উঠে দাঁড়িয়েছি, চারদিক যেন বড় নিঝুম। চুপচাপ, দু-একটা পাখীর হঠাৎ হঠাৎ ডাক, এ সময়ে সেই ভাবটাই চেপে ধরছে। আমাকে নিয়ে কী করব। কিছুই বুঝতে পারছি না। একটা কথা এখন অবিশ্যি বুঝতে পারছি, যা করব না মনে করি, তা-ই করি। যা চাই না, তাই চাই, এ সময়ে স্সাহ্, ‘তুই একটা ভূত এ কথা আমার বলতে ইচ্ছা করে,কিন্তু আমি তো সত্যি শিখাকে ওরকম করতে চাইনি, তবু করলাম, হয়তো ওকে একেবারে খুন করতেই ইচ্ছা করছিল, আর ব্যাপারটা তো আজই প্রথম না, এরকম আরো অনেকবারই হয়েছে, অথচ কোনবারেই ভেবেচিন্তে কিছু করিনি। যেন এই জন্যেই, এই না জানা, না বোঝা থেকে এই অবস্থাটা আমার দেখা দেয়, এখন আমি কী করব—মানে, নিজেকে নিয়ে আমি কী করব!
অথচ আবার, সেই অনশনের পরে যখন মনের সেই অবস্থা যাচ্ছিল, তা প্রায় মাস দেড়েক কেটে গিয়েছিল তখন, হঠাৎ একদিন শিখা আমাদের বাড়িতে এসেছিল—ঠিক যেন অনেকদিন, মেঘলা মেঘলা অন্ধকার, সাঁতা, ভিজে, তারপরে হঠাৎ রোদ ওঠে, তেমনি করেই এসেছিল। সেই প্রথম ও আমাদের বাড়িতে এসেছিল, আর সুখেনদা, আপনার জন্যই এলাম। কেশবদা, পূর্ণেন্দুদা, ওঁদের মুখে প্রায়ই শুনি, আপনি নাকি বাড়ি থেকে বিশেষ বেরোন-টেরোন না, খালি চুপচাপ থাকেন আর পরীক্ষার পড়া পড়ে যাচ্ছেন; তা-ই এলাম।’
বড়দা, মেজদা ওদের বাড়িতে যায় সে-ই যে প্রথম জেনেছিলাম, তা না, আগেই শুনেছিলাম ওর দাদাদের কাছে, দাদারা যায়। প্রথমটা তো আমি কী রকম লাজুক—আহা হা, দেখিস, কিন্তু সত্যি লাজুক লাজুক হয়ে উঠেছিলাম শিখার সামনে, কী কথা বলব, বুঝতে পারছিলাম না, তবে হলফ করে বলতে পারি, নিজের মুখ দেখতে পাইনি বটে, একেবারে যেন ঝলমলিয়ে উঠেছিলাম, সন্দেহ নেই। ভিতরটা যে ঝলমলিয়ে উঠেছিল, সেটা তো বুঝতে পেরেছিলাম, তাতেই মনে হয়েছিল সে কথা, কারণ বললামই তো, অনেক দিনের মেঘলার পরে হঠাৎ রোদ উঠলে যেরকম মনে হয়, ঠিক সেরকম মনে হয়েছিল ওকে দেখে। ও এসে ঘরে বসেছিল, কী যে সব কথা বলেছিল, এখন একটু মনে করতেও পারি না। হয়তো ‘খুব পড়ছেন বা শরীর ভাল আছে তো, তার জবাবে আমি হয়তো কিছু বলেছিলাম, কিন্তু আমার মনের মধ্যে অনশনের সেই সন্ধ্যারাত্রের কথা ভেসে উঠেছিল, আহ্, সত্যি, কেন যে ওকে এত ভাল লেগেছিল, সেই দিনও লাগছিল, সেই প্রথম দিন যখন এসেছিল, আর আমি যেন সেই দিশেহারা কষ্টের থেকে ছুটে বেরিয়ে এসেছিলাম। জানি না, কেন আমার মনে হযেছিল, শিখা যেন অনশনের সেই সন্ধ্যারাত্রে, আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরেছিল, মনে হয়েছিল অনশনের পর থেকে ও যেন রোজই আশা করতো, আমি ওদের বাড়ি যাব, কেননা ও বলেছিল, ‘আমি রোজই ভাবি, সবাই একবার করে আমাদের বাড়িতে ঘুরে গেল, সুখেনদা তো এল না। কী জানি বাবা, কোন দোষ-টোষ করে ফেললাম না তো। তার মানে, যারা অনশন করেছিল, তারা সবাই ওদের বাড়িতে একবার করে—দশ বারও হতে পারে, ঘুরে এসেছিল। আমি ওকে কী সব যেন বলেছিলাম, না—মানে ভাল লাগে না এইরকম সব কথাই হবে হয়তো। ওর মধ্যে একটা যেন কী ছিল যতবার আমার চোখের দিকে তাকাচ্ছিল, ততবারই আমার ভিতরটা কী রকম করে উঠছিল। সেইসব কথা আমার মনে হয়েছিল, ওর বুকের মধ্যে আমার মুখটা ডুবিয়ে দিই। মনে হতেই আমি ওব দিকে তাকিয়েছিলাম, ওর বুকের দিকে। একটা বাসন্তী রঙের জামা, মোস্ট অর্ডিনারি, তাতে আমার জামার হাতায় ফুল আঁকা, আর একটা লাল লাল ভাবের—ঠিক লাল, না, টকটকে লাল না, লাল ভাবের শাড়ি পরে এসেছিল। আমি ওর ডানা দুটোর দিকে, নতুন চিকচিকে লতার মতন রঙের ডানা, গলা কাঁধের দিকে তাকিয়েছিলাম, আর বুকের দিকে তাকিয়ে, মনটা কী রকম করে উঠেছিল—যা তার আগে কোনদিন মনে হয়নি। তার আগে তো অনেক মেয়ের সঙ্গেই মিশেছি, হাত মুখ দিয়েছি, কিন্তু ওর সামনে সেগুলো মনে করতে গিয়ে কেমন যেন একটা বিঘনি বিঘনি ভাবই লেগেছিল, এমন কি বিচ্ছিরি গন্ধের কথা পর্যন্ত মনে পড়ে গিয়েছিল, সেগুলো যেন সত্যি মাংসপিণ্ডই।
আমি জানি না, শিখাকে জিজ্ঞেস করা সত্ত্বেও কোনদিন বলেনি, আমার মনের কথা ও কখনো বুঝেছিল কিনা—তাই আবার কখনো বলে নাকি, গর্দভ—মেয়েরা কি ওসব কখনো কিছু বোঝে নাকি—মাইয়াছেলে না! তবু, কেন জানি না আমার মনে হয়েছিল, শিখা যেন আমার মনের কথা বুঝে ফেলেছিল, এমন কি এত যে চোখ দুটোকে সামলাতে গিয়েও তাকিয়ে ফেলছিলাম, সেটাও হয়তো ধরা পড়ে গিয়েছিল। ও এসেছিল বিকালের দিকে, ফেরবার সময় সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল, নিজেই বলেছিল, ‘যাবেন নাকি আমাদের বাড়ি অবধি।’
গিয়েছিলাম, গিয়ে দেখেছিলাম, ওদের বাড়িতে ভিড়, অনেকেই সেখানে ছিল, কলেজের কয়েকজন ছেলে, বিশেষ করে মেজদাদের দল। মেজদা, আর শিখার দাদা মেজদার চেলা। আমি বসিনি, সবাই আমাকে বসতে বলেছিল, এমন কি মেজদাও—আর থাকলে হয়তো শিখাকে আরো খানিকক্ষণ দেখতে পেতাম, কিন্তু আমার মনের অবস্থা সেরকম ছিল না যে, সকলের মাঝখানে বসে বসে গাঁজাবো, আর শিখাকে দেখব। চলে আসবার সময় শিখা আমার সঙ্গে ঘরের বাইরে এসেছিল, আর একটু থাকবার জন্যে বলেছিল, আমি বলেছিলাম, ‘সময় পেলে তুমি আবার এসো।’
ওদের বাড়ি থেকে রাস্তা দিয়ে ফেরবার সময় আমি কোনদিকেই তাকাইনি। কারুর সঙ্গে কথাও বলিনি। মফস্বল শহরের রাস্তার আলো কেমন, সকলেই জানে। গাধাও না, ঘোড়াও না, যেগুলোকে খচ্চর শহর বললেই ভাল হয়, আলোগুলোও তেমনি, যে জন্যে মনে হয়েছিল, আমি যেন অন্ধকারের মধ্য দিয়ে ফিরে এসেছিলাম। আমার আশেপাশে সবই ছায়া, কেউই মানুষ না, আর, আবার সেইরকম ভাবনা ফিরে এসেছিল মনের মধ্যে, সেই দিশেহারা কষ্টের ভাবটা। অথচ আশ্চর্য এই, আমি যে খুব সাংঘাতিকভাবে শিখার জন্যে অপেক্ষা করেছিলাম, তাও বলতে পারি না। কারণ বোধহয় মনের সেই অবস্থায়, শিখার একটা ঝলকানি লেগেছিল বটে, আবার আমি সেই ভাবনার মধ্যেই তলিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু শিখা আবার এসেছিল, তিন দিন পরে, কলেজ থেকে ফেরার পথে। শুলাদাটা আবার কী এক আশ্চর্য জীব। সে হঠাৎ শিখাকে ভীষণ খাতির
তাদের কোনদিন ঠিক ওভাবে খাতির দেখায়নি। তিন দিন পরে যেদিন এসেছিল, সেদিন আমি আর ওদের বাড়ি যাইনি। সেদিন শিখা বেশীক্ষণ ছিল না। ঠিক তার দু দিন পরেই শিখা আবার এসেছিল, একেবারে ভর দুপুরে, ঘরে আমি একলা বসেছিলাম, পিছন ফিরে—সামনে বই খোলা, কিন্তু পড়ছিলাম না। হঠাৎ চেয়ারের পিছনে একটা চাপ লাগতে, পিছন ফিরে দেখেছিলাম, শিখা আমার মাথার ওপর দিয়ে উঁকি দিয়ে টেবিলের ওপর দেখবার চেষ্টা করছে, আমি কী পড়ছি।
আমি এমন চমকে উঠেছিলাম যে, আমার বুকের ভিতরটা ধ্বক করে উঠেছিল, ঠিক মনে হয়েছিল একটা প্রেতাত্মা-টাত্মা কিছু এসেছে বুঝি, আর শিখা বলেছিল, ‘খুব চমকে গেছেন, না?’
কিছু না বলে তখনো তাকিয়েছিলাম, তারপর হেসে বলেছিলাম, ‘হ্যাঁ।’
‘শুলাদা বললে কিনা, আপনি একলা ঘবে রয়েছেন। তাই পা টিপে টিপে এসে দেখছিলাম, কী করছেন। খুব পড়ছেন, না?’
কথার জবাব দেব কি, তখন আমার গায়ের মধ্যে কী রকম করছিল, ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারি না। কেবল, এটা বুঝতে পারছিলাম, শিখার গায়ের কাপড়টা আমার মাথায় ঠেকছিল আর আমার ভিতরটা কী রকম করছিল, অনেকটা ভয়ের মত, তা-ই আমি মুখটা ফিরিয়ে নিয়েছিলাম, ওর দিকে তাকিয়ে থাকিনি। পাশে আর একটা চেয়ার ছিল, শিখা ঘুরে সেদিকে গিয়েছিল, কিন্তু বসেনি। আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, আরো অনেকটা কাছে। জিজ্ঞেস করেছিল, ‘রাগ করলেন সুখেনদা?’
রাগ? আমি ওর দিকে ফিরে, তাড়াতাড়ি বলেছিলাম, না তো।’
‘তবে?’
তবে? তবে মানে কী? আমি ওর মুখের দিকে চোখ তুলতে গিয়ে, ওর বুকটা দেখেছিলাম, চেয়ারের হাতলের কাছে ওর তলপেটটা ছিল, সেখানে শাড়ির কুঁচির কয়েকটা ভাঁজ। তার একটু ওপরেই ওর সেই কচি কচি রঙের পেটের একটুখানি–ঠিক এখনকার মত, কোমর থেকে পেটের এতটা দেখা যাবার মতন জামা আগে পরতো না, তারপরে বুক, তারপরে কষ্ঠা আর গলার মাঝখানে ছোট্ট একটা গর্ত, গলা, চিবুক, মুখ, ওর চোখদুটো আমার মুখের ওপরে চেয়েছিল একটু অবাক অবাক ভাবে। কিছু খুঁজে দেখার মত, জিজ্ঞেস করার মতন! কিসের একটা হালকা গন্ধও লাগছিল, ওর গায়ের বা চুলের বা জামাকাপড়ের, যারই হোক, আমি যেন ডুবে যেতে চাইছিলাম শিখার বুকের মধ্যে, সেই অনশনের সন্ধ্যারাত্রের মত। শিখা আবার জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কী হয়েছে সুখেনদা?’
আমি ঘাড় নেড়ে জানিয়েছিলাম, কিছু না। আর আমি যেন একটা লগবগানো মগডালের মতন, ওর বুকের কাছে ঝুঁকে পড়েছিলাম, ওর কোমরের পিছনে হাত রেখেছিলাম। আর মাইরি, আশ্চর্য, আমার যেন কী রকম নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। অথচ ভাল লাগছিল—আবার একটা কী রকম কষ্ট, স্সাহ্, চিরদিন এরকম একটা ভুতুড়ে ব্যাপার আমার মধ্যে ঘটেই চলেছে। আর কারুর কাছে তো এরকম আজগুবি কিছু শুনিনি। আর মাথায় তো চুল ছিল, তবু কী করে এরকম হয় কে জানে, আমি ওর বুকের তলার নরম দিকটা টের পাচ্ছিলাম। কিন্তু মুখটা বুকের দিকে ছিল না, পাশ ফেরানো ছিল, থাকলেও সেদিকে যে আমি কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম, তাও না, একবার এ কথাও মনে হয়নি, যেটা মনে হওয়াই সব থেকে আগে উচিত ছিল, শিখা রাগ করবে কিনা। শিখা যে কী করছিল, কেমন ওর মুখটা দেখতে হয়েছিল, কিছুই জানি না। আর তা একবারও আমার মনে আসেনি। আমি যেন ওর সেই মুখটাই দেখতে পাচ্ছিলাম, যে-মুখটা অনশনের সেই রাত্রে চোখ বুজেও বার বার ভেসে উঠেছিল। তারপরে, কতক্ষণ পরে আমি জানি না, ওর একটা হাত আমার কাঁধের উপর রেখেছিল। তখন আমি সেই অবস্থাতেই মুখ তুলে ওর মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম, আর আমার ঠিক মনে হয়েছিল, সেই যে, সেই যে, সেই যে, সেই তাঁবাটে চাঁদের আলোয় ওর মুখটা যেমন দেখেছিলাম। কেমন যেন একটা, চোখ সেই কান পর্যন্ত টানা। অথচ চোখের ভিতরে সাদাটা নেই, সবটাই কালো চিকচিকে, মুখের রঙটা যেন কেমন, আর চারদিকে অন্ধকার। আর ও আমাকে ছুয়ে আছে; সেইসব ভাবনা আর শরীরের ভাবগুলো জেগে ওঠায় আমি সত্যি সত্যি ওর বুকের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। আমি পাশ ফিরে দু’হাত দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরেছিলাম, কোমরের ওপরে পিঠের কাছে—আর ওকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কষ্ট করে নিচু হতে হয়েছিল, যাতে আমি যেমন করে চাই ও তাই দিতে পারে। আমার কাঁধে রাখা ওর হাতটা আমার ঘাড়ে রেখেছিল। রোঁয়াগুলোসুদ্ধ শিউরে উঠেছিল। মনে করতে পারি না, তখন ওকে একবার নাম ধরে ডেকেছিলাম কিনা। আর একটা হাত ও চেয়ারের হাতলে রেখেছিল। সেখান থেকে তুলে, আমার পাঁজরের কাছে রেখেছিল—যেন সেই দিনই নতুন না, যেন কতই সহজ-স্বাভাবিক, কোনরকম লাফানি-ঝাঁপানি নেই। বরং সেইকী বলে একটা মায়া-মায়া, মমতা-মমতা ভাব, অথচ তার আগে যতগুলো ছুঁড়িকে গায়ে হাত দিতে গেছি সে সবের ভাবভঙ্গিই আলাদা। যেমন চাউনি, স্সাহ্ তেমনি হাসি, তেমনি ছটফটানি—হাত দিতেও দেবে, আবার ছাড়িয়েও দেবে। ‘ও কি, না, ছি সুখেনদা’ এমনি বলবে হাসবে, সেই অনেকটা ছেউটি ছুঁড়িদের কথা বলছিলাম না!
অনেকটা সেইরকমেরই, তার চেয়েও যেন একটা বদ গন্ধ বেরুনে ব্যাপারের মতন, ‘হি হি হি, ভাগ আবার একটু; আবার, বেশ মজা, না? পালাব কিন্তু, হি, হি হি, আর না হয়তো, পাশাপাশি কাছাকাছি লাগালাগি ছোঁয়াছুয়ি সবই হচ্ছে, তবু যেন কে কার ঝাড়ে বাঁশ কাটছে, চালিয়ে যাও গায়ে গায়ে। সে সবের মধ্যে যেমন, কেমন একটা নোঙড়া ইতরামির গন্ধ থাকে, সেরকম কিছুই মনে হয়নি। কী বলব, ঠিক বলতে গেলে, শিখা যেন একটা রোগা ছেলেকেই, সেই অনশনে না-খাওয়া আমাকেই বুকের কাছে থাকতে দিয়েছিল, গায়ে হাত রেখেছিল। কারুর সঙ্গে ওকে মেলাতে পারিনি, কারুর সঙ্গে ওর মিল ছিল না, এমন কি, ওঁর যে ওভাবে ঝুঁকে পড়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছিল, তার জন্যে একটা কথাও বলেনি, তখন আমি, হাতটাও ওর বুকের কাছে নিয়ে এসেছিলাম, যেন আমার সবটাকে নিয়ে, আমার পুরো শরীরটাকে নিয়ে ওর বুকের মধ্যে মিশিয়ে যেতে চাইছিলাম, ডুবে যেতে চাইছিলাম। আমি মুখ তুলে ওর দিকে চেয়েছিলাম, আর ঠিক যা ভেবেছিলাম, তাই, যেরকম মুখ ভেবেছিলাম, ঠিক সেরকম মুখই দেখেছিলাম। ঠিক সেইরকম চোখ, যে-চোখ দিয়ে ও আমার দিকেই তাকিয়েছিল, অথচ একটা কথাও জিজ্ঞেস করেনি, আজও জানি না, কেন জিজ্ঞেস করেনি, কেন কোনরকম আপত্তি করেনি, যেন ও জানতো, এরকম হবে বা সেটা এমন একটা কিছু ব্যাপার না, যে কী জানি, হয়তো ওর ওইরকম ইচ্ছা করেছিল। আমি ওকে টেনেছিলাম, আমার দিকে নিচু করে টানতে গিয়ে, ও প্রায় পড়েই গিয়েছিল, হয়তো লেগেও ছিল, কিন্তু তার জন্যে ওর মুখে কোন কষ্টের ছাপ পড়েনি, যেমন করে আমার দিকে তাকিয়েছিল, তেমনি তাকিয়েই ছিল, যেন আমি যা করব, তাতে ও কোনরকম আটকাবে না, মেরে ফেললেও না। আমার শরীরের ওপর ওর অনেকখানি ভার পড়েছিল, ওর নিঃশ্বাস পড়ছিল আমার মুখে। জানি না কেন, নিশ্বাসটা যেন মিষ্টি ফলের গন্ধের মতন মনে হয়েছিল, ওর নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছিল, আর আমার কাঁধ আর গলার কাছে, ওর বুক চেপেছিল, আমি ওকে চুমো খেয়েছিলাম। তখন চুমো খাওয়াটা আমার কাছে একটা সহজ ব্যাপার, কেননা, তার আগে অনেকবারই খেয়েছি, তবু মনে হয়েছিল, সেরকম চুমো জীবনে কখনো খাইনি এত সুন্দর একরকম থাকে না, একেবারে নিখুঁত করে আঁকার মত ঠোঁট—না না, রঙ মাখা না, শিখা রঙ মেখে আসেনি, অথচ লাল লাল আর নিখুঁত—মানে যেন অনেকটা ধারালো মতন, আর পাতলা মতন, আর পাতলা সরু মোটেও না, একটু ফোলা ফোলা, অদ্ভুত-সুন্দর। আমি ওর সেই ঠোঁটে আমার ঠোঁট চেপে দিয়েছিলাম, তারপরে মোটেই জোরে-টোরে না, চুমো খেয়েছিলাম—কিন্তু ও হাত দিয়ে মেছেনি, তখন কেবল একবার উঠে সোজা হয়ে দাঁড়াতে চেয়েছিল, আর ঘরের খোলা দরজাটার দিকে তাকিয়েছিল। আমিও খোলা দরজার দিকে তাকিয়েছিলাম, জানি না, তার আগেই শুলাদা দেখে গেছে কি না, আমি উঠে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করেছিলাম, ও ঠিক সেখানেই, সেভাবেই দাঁড়িয়েছিল, ভেবেছিলাম, তখন কিছু বলবে, কিন্তু কিছুই বলেনি, কেবল আমার দিকে তাকিয়েছিল। আমি আবার ওকে দু হাত দিয়ে বুকের কাছে চেপে ধরেছিলাম, তখন লক্ষ্য করেছিলাম, ও আমার থেকে প্রায় ছ ইঞ্চি বেটে, কম না, প্রায় পাঁচ ফুট উঁচু। শুধু ধরেই রেখেছিলাম, বুকের কাছে, খুব জোরে চেপে ধরে রেখেছিলাম অনেকক্ষণ। কতক্ষণ, এখন মনে নেই, তারপর এক সময়ে আমি ডেকেছিলাম ওর নাম ধরে, আর ও বলেছিল, ‘দিলাম তো আপনার পড়া মাটি করে।’
তারপরে যে কেউ ওরকম কথা বলতে পারে, কোনদিন ভাবিনি, যেন ব্যাপারটা তেমন কিছুই না, অথচ ও মোটে ছটফটও করেনি, ভাবটা অনেকটা, বেশ তো, এসব না হয় হল, পড়াটা তো মাটি হল এইরকম। আমি আবার বলেছিলাম, ‘আমি পড়ছিলাম না।’ ও বলেছিল, ‘আপনার পরীক্ষার তো আর বেশী দেরী নেই।’ ‘পড়তে ভাল লাগে না।’ ও হেসেছিল। এখন আমার এভাবে বলতে ইচ্ছা করে, “দেন ইট স্টার্টেড।’
ওর সঙ্গে আমার, সেই শুরু, দেন ইট স্টার্টেড, যেমন আমাদের শহরের বাসের সহিসেরা ড্রাইভারকে চেঁচিয়ে বলে, ‘ইস্টাট’, সেইরকম, আর আমি যেন কেমন একটা শাস্ত আর গম্ভীরভাবের হয়ে উঠেছিলাম, ভাল ছেলেরা ভালবাসায় পড়লে যেরকম তাদের অবস্থায় হয়, সেইরকম—মানে, আমার প্রেম হয়েছে, আমার জীবনের চেহারাটা অন্যরকম হয়ে যাবে এবার। সেইদিন ও অনেকক্ষণ ছিল, শুলাদা ওকে চা আর খাবার খাইয়েছিল, আমি ওর সঙ্গে ওদের বাড়ি গিয়েছিলাম, দেখেছিলাম, কেশব বসে আছে, আরো দু তিনজনকে নিয়ে, শিখার এক দাদাও ছিল, যে দাদা ওর দলের, বেলাদিও ছিল। আমাকে দেখবার আগেই, কেশব, আমার বড়দা বলে উঠেছিল, “কোথায় গেছলে শিখা, আমরা তো তোমার খোঁজে থানায় লোক পাঠাব ভেবেছিলাম। শিখা বলেছিল, আপনাদের বাড়িতেই সুখেনদার সঙ্গে গল্প করছিলাম। ততক্ষণে আমি ঘরে ঢুকে পড়েছিলাম, কিন্তু আমার একটুও ভাল লাগেনি। মনের ভিতরে যে একটা বেশ—কী বলব, তরতরানো আমেজ ছিল, অনেকটা জলভরা গেলাসের মতন, সেই ভাবটা কেমন একটা ছানা কেটে যাওয়া ভাব হয়েছিল। তবু আমি একটুখানি বসেছিলাম, কী দু-একটা কথাবার্তা বলেছিলাম, বড়দা ওদের দলের ছাত্রদের নিয়ে কী একটা কনফারেন্সের কথা বলাবলি করছিল, আমাকেও ওদের দলে চলে আসতে বলেছিল, আর একমাত্র শিখাই বলেছিল, ‘উহ্, আপনাদের দল ছাড়া কথা নেই কেশবদা।’ আমি উঠে এসেছিলাম, শিখা আমাকে সেইদিনই প্রথম তুমি বলে ডেকেছিল, আরো খানিকক্ষণ থাকতে বলেছিল, থাকিনি।
সেই থেকে শুরু হয়েছিল, কিন্তু সেই থেকেই গোলমাল, সেই ভুতুড়ে ব্যাপার, যতই শিখার সঙ্গে আমার দুধের জ্বলে জমছিল, ততই সেই ছানা কেটে যাওয়াও বাড়ছিল। যে ব্যাপারটা একটু আগেই হয়ে গেল, একটা রাগ, ঘেন্না, যেন আমাকে ছিঁড়ে খেতে আরম্ভ করেছিল, অথচ শিখাকে ছেড়েও যেতে পারছিলাম না। তারপরেই তো আস্তে আস্তে আমার খেল শুরু হয়েছিল, পড়াশুনো চুলোয়, পরীক্ষার হলে হাই বেঞ্চের ওপর একটা ছুরি গেঁথে রেখে, বই খুলে আমি লিখতে বসেছিলাম। তার আগের দিনের পরীক্ষাতে টুকতে গিয়ে একটা ছেলের খাতা কেড়ে নিয়েছিল বলে, ছেলেটা কলেজ থেকে বেরিয়ে সোজা চলে গিয়েছিল রেল লাইনে, একেবারে চলন্ত গাড়ির তলায় মাথা পেতে দিয়েছিল। এই স্লাদের যে কী বলতে ইচ্ছা করে-না, ওকে আবার ধরেছিল যশোদাবাবু—ধরবেই তো, ও তো অন্য দলের ছেলে ছিল, আমি টুকছি জেনেও, আমার কাছে এগোননি। কিন্তু ছেলেটা মরতে গিয়েছিল কী করতে, বুঝি না, যশোদাবাবুকে ধরে পেদিয়ে দিলেই তো হত, সে সাহস ছিল না, মাথাখানিকে ছেতরে দিয়ে, তিন-চার টুকরো লাস হয়ে উল্লুকটা চলে গিয়েছিল মুদাফরাসদের কাঁধে চেপে। আমি তো জানতাম, আমার দ্বারা পাশ করা হবে না, আর ঠিক করেছিলাম, ওটাই শেষ বছর, আর পরীক্ষা-টরীক্ষা দিতে পারব না, তাই ছোরা নিয়ে গিয়েছিলাম, দলের স্যার না থাকল, বে-দলের স্যারকে ব্যাপারটা জানিয়ে দিতে হবে তো। আর স্সাহ্। সেদিন ইনভিজিলেন্টে এসেছিল সেই স্যারটি, যার চাকরি বহালের জন্যে হাঙার স্ট্রাইক করেছিলাম। সে স্যার তো আমার মেজদার দলের, আর সেই কয়েক মাসের মধ্যেই, আমাদের জোড় খাওয়া, সেই যাকে বলে ঐক্য, ভেঙে গিয়েছিল, আবার মারামারি কামড়াকামড়ি শুরু হয়ে গিয়েছিল, তাই অনসসনই কর, আর যা-ই কর, স্যারটি কোন কথাই শুনতে রাজী ছিল না। তা ছাড়া মাল সেদিকে বেশ দড়, চাকরিতে বহাল হয়েই, আগে টেক্কা মেরেছিল প্রিন্সিপালকে, তারপরে একেবারে গভনিং বড়ির পেয়ারের লোক হয়ে উঠেছিল। আমাকে এসেই জিজ্ঞেস করেছিল, ছুরিটা এভাবে এখানে গাঁথা কেন ‘ বলেছিলাম, পেন্সিল-টেন্সিল কাটতে হবে কিনা, তাই ‘ স্সাহ্, একেবারে বাঘের মতন তাকিয়েছিল আমার দিকে—আমিও তার চেয়ে কিছু কম না, জানতাম ও আমাকে রেয়াত করবে না, তবু আমি বই খুলেই বসেছিলাম, ও আমাকে ওয়ানিং দিয়েছিল, কিন্তু কাছে ঘেঁষেনি, বলেছিল আমার খাতা বাতিল করে দেবে। তবু আমি শুনিনি, চালিয়েই যাচ্ছিলাম, শেষ পর্যন্ত ভাইসকে ডেকে আনা হয়েছিল, আমার খাতা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, মেজদাদের দলের ছেলেরা খুশি হয়েছিল, আমি বাইরে এসে প্রথমে ঠিক করেছিলাম, ছুরিটা একেবারে শুকনো নিয়ে ফিরব না। কিন্তু বন্ধুরা সবাই বারণ করেছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম, সেই আমার শেষ পরীক্ষা, বাবার মুখটা মনে পড়ছিল, আর ভিতরটা জ্বলে যাচ্ছিল, একটা কিছু না করতে পারলে শান্তি পাচ্ছিলাম না। আর ঠিক তখুনি সেই স্যারটি ক্লাস থেকে একবার বেরিয়ে আসছিল, আমি ডেকে বলেছিলাম, ‘এই, এই যে দ্যাখ, এই দ্যাখ’ বলে প্যান্টের বোতাম খুলে দেখিয়েছিলাম। মাইরি, লোকটা ভাবতেই পারেনি, ওরকম একটা কাণ্ড কেউ করতে পারে, প্রথমটা থতমত খেয়ে গিয়েছিল, আর পাগলের মত ক্ষেপে গিয়ে বলেছিল, ‘আই উইল সী ইউ রাসকেল।’ আমি বলেছিলাম, ‘আরে যা যা, পেঁদিয়ে খাল খিচে দেব।’ স্যারটি দৌড়ুতে দৌড়ুতে প্রিন্সিপালের ঘরের দিকে গিয়েছিল, আমিও বন্ধুবান্ধব নিয়ে হাওয়া।
রাস্তায় গিয়ে খুব হাসাহাসি করেছিলাম বটে, কিন্তু এটাও ঠিক, ভিতরে ভিতরে কেমন একটা অস্বস্তিও যেন হয়েছিল, যেমন হয়-না, একটা খচখচানি মতন, অথচ লোকটার মুখ মনে করে হাসিও ঠিকই পাচ্ছিল, তবু কেমন যেন একটা খচখচ করছিল। আমি সেখান থেকে সোজা শিখাদের বাড়ি চলে গিয়েছিলাম, সব কথা শুনে ও খুব ভয় পেয়েছিল, আমিও ওকে নিয়ে সেদিন তেমন মেতে উঠতে পারিনি। সন্ধ্যাবেলা বাড়িতে ঢুকতেই ফাদার তো একেবারে গর্জন করে উঠেছিল, হাতের কাছে কী একটা ছিল—প্লাস্টিকের কলমদানি না কী যেন, সেটাই ছুড়ে মেরে বলেছিল, ‘বেরিয়ে যাও বাড়ি থেকে।’
একটু বোধহয় লেগেছিল, কপালে, মাথা নিচু করে ঘরে গিয়ে ঢুকেছিলাম, ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। বাবা সেখানে এসেও বন্ধ দরজার ওপর জোরে ধাক্কা মেরেছিল, আর বারে বারে চেচাচ্ছিল, ‘বেরিয়ে যা বলছি, বেরিয়ে যা, কুলাঙ্গর ছোটলোক ইতর। আমি কিন্তু ঘরের মধ্যে চুপ করে দাঁড়িয়েই ছিলাম, যেন কিছুই শুনতে পাচ্ছিলাম না, বুঝতে পারছিলাম না, অথচ হাতটাতগুলো কীরকম শক্ত হয়ে উঠেছিল, দাঁতে দাঁত চেপে বসেছিল—হ্যাঁ রাগই, কিন্তু কার ওপরে তা যেন বুঝতে পারছিলাম না। দাদারা বাড়ি ছিল না, বাবা তেমনি চেঁচিয়ে যাচ্ছিল, ‘আমি দরজা ভেঙে ফেলব বলছি, টেলিফোন করে পুলিশ ডাকব এখনি, হারামজাদা, গুণ্ডা, লম্পট, তুই কি মানুষের বাচ্চা, তুই— এ সময়ে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল, বাবা মাকে নিয়ে শুয়ে আছে। বাবা চেঁচিয়েই যাচ্ছিল, ‘তুই একটা কুকুর। এ বাড়ির ছেলেদের নামে যা কেউ কোনদিন বলতে পারেনি, তোর জন্যে তাও শুনতে হচ্ছে। বেরিয়ে যা, যা বলছি, বেরো?
আস্তে আস্তে মুঠো করা হাতটা আমি খুলেছিলাম, দরজার কাছে গিয়ে, খিল খুলে দিয়েছিলাম। খুলে দিতেই বাবা কিল চড় মারতে আরম্ভ করেছিল, আর আমি বারান্দা পেরিয়ে উঠোনের দিকে নেমে যাচ্ছিলাম, শুলাদা ঠাকুর ঝি—ঝিয়ের মেয়েটা তার কয়েকদিন আগেই ডাক্তারের কাছ থেকে পেট খসিয়ে এসেছিল, টাকা পয়সা মেজদাই দিয়েছিল, বিটার মেজাজ তাই ভাল ছিল, ভয় কেটে গিয়েছিল—আহা, মেজদার শাশুড়ি গো—ওরা সবাই দাঁড়িয়ে দেখছিল, কারুর সামনে আসবার সাহস ছিল না। আমি ছুটিনি, দৌড়ইনি, যেমন হেঁটে যেতে হয়, তেমনি বারান্দা দিয়ে উঠোনে নেমে গিয়েছিলাম, বাবা সমানে মারতে মারতে চলেছিল, অথচ আমার যেন লাগছিল না, যেন আমার ভিতরে এমন একটা গোলমাল চলছিল, মারধোরগুলো মোটেই কিছু মনে হচ্ছিল না। আমি যখন বাগানের কাছে, তখন বাবার একবার হোঁচট লেগেছিল, সেখানে যুঁইয়ের ঝাড় ছিল, আর দরজা অবধি আসতে আসতে, বাবা যেন হাঁপিয়ে পড়েছিল। দরজার বাইরে আর বাবা আসেনি, মনে হয়েছিল, বাবা তখন ওই সেই যাকে বলে বায়ু ত্যাগ করেছিল একবার, আর সেখান থেকেই বলেছিল, আর যেন এ বাড়িতে তোর মুখ দেখতে না হয়। বাবা বলছিল, আমি শুনছিলাম, কিন্তু কী যে ঠিক ঘটছিল কিছুই বুঝতে পারিনি, হেঁটেই চলেছিলাম, আর কিছু দূর যাবার পর দেখেছিলাম, আবার শিখাদের বাড়ির দিকেই যাচ্ছি। কিন্তু যেতে ইচ্ছা করেনি, কারণ আমি জানতাম, তখন ওদের বাড়িতে আড্ডা চলেছে, তাই আবার ফিরেছিলাম, যেখানে আমার দলের বন্ধুরা আড্ডা দেয়, চা খায়-—দল মানে, রাজনীতির না, এমনি, যারা আমার ভক্ত। সেরকম একটা জায়গায় গিয়ে শুটকার দেখা পেয়েছিলাম,—শুটকা, আশ্চর্য, ব্যাটার একটা সুন্দর নামও আছে—মুগ্ময় গুপ্ত, উহ্ রে স্সাহ্, মইরা যামু। শুটকাই আমাকে প্রথম বলেছিল, আমার মুখে লাল লাল দাগ, সত্যি, এত জোর ছিল ফাদারের হাতে। সেইদিন প্রথম আমি মদ খেয়েছিলাম, এ ব্যাপারে শুটকাই আমার গুরু, ওই আমাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল একটা জায়গায়—যে জায়গাটার নাম তার আগেও আমি শুনেছি, হলধরের জুয়ার আড্ডায়, আর এও শুনেছিলাম, হলধর আসলে কেশবের মাইনে করা লোক, মানে আমার বড়দার। তবে কেশব সেখানে যায়-টায় না, আড্ডাটাকে সবদিক থেকে রক্ষা করা—এই আর কি, পুলিশ-টুলিশের হাত থেকে, ও শুধু মাসে মাসে নিজের হিসাবের টাকাটা নিয়েই খালাস, বাকী যা কিছু সবই হলধরের। শুটকা একটা ঘরে আমাকে সেখানেই নিয়ে গিয়েছিল, তবে কোন জুয়ার ঘরে না, অন্য একটা ঘরে, আর বলেছিল, ‘গুরু, একটু মাল খা। পেটে একটু মাল পড়লে দেখবি সব ঠিক আছে।’
আমার একবারও মনে হয়নি, দারুণ কিছু একটা পাপ করছি, আর খেয়ে বেশ ভালই লেগেছিল। কোথায় কীভাবে যে রাতটা কেটে গিয়েছিল, ভাল করে মনে করতেই পারিনি। শুটকাটা একটা ম্যানেজার লোক, সেখান থেকে রিক্সায় করে কোথায় যে নিয়ে গিয়েছিল, পাশের আর একটা শহরে, আমাদের শহরের বাইরে—যেখানে একটা বাড়িতে রাত কেটেছিল—না, বেশ্যাবাড়ি না, বাড়িটা আসলে রামকৃষ্ণ বলে একটা লোকের, যার কাজ হচ্ছে, রেলের ওয়াগন ভেঙে চুরি করা। ওদের একটা দলও আছে, আর এখন এও জানি, রামকৃষ্ণের সঙ্গে—হ্যাঁ, একে বলে নাম, রামকৃষ্ণ ওয়াগন ব্রেকার, যার সঙ্গে কেশবের ভাল লেনদেনই আছে। কেশব ওসব চোরাই মাল রামকৃষ্ণের কাছ থেকে কেনে, বেঁচে অন্য জায়গায়, অন্যভাবে, কিন্তু ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে, শত হলেও একটা দলের নেতা তো, একটা ইজ্জত আছে, তার পক্ষে খোলাখুলি কিছুই করা চলে না। কিন্তু শুটকার ওপর আমার একটু রাগ হয়েছিল, ও খালি আমার বাবার নামটা সব জায়গায় বলছিল, আমি অমুকের ছেলে, না হয়তো অমুকের ভাই। তাতে খাতির করেছিল সবাই, তবে আমার ভাল লাগেনি, রাগ হচ্ছিল, বলেছিলাম, পরিচয় পড়বার কী আছে।
সেই প্রথম রামকেষ্টর সঙ্গে আমার ভাব, প্রায় চারদিন ছিলাম ওর ওখানেই, অবিশ্যি কোনদিন ওয়াগন ভাঙতে যাইনি, এদিক ওদিক নানান জায়গায় ঘুরেছি। তার মধ্যে শুটকা রোজই এসে জানাতো, আমাকে খুব খোঁজাখুঁজি চলেছে, কেশব পূর্ণেন্দু তো খুঁজছিলই, শুলাদাও শহরের সব জায়গায় সব বাড়িতে বাড়িতে খোঁজ করেছিল, কারণ ফাদার নিজেই নাকি সবাইকে খোঁজ করতে বলেছিল, এমন কি শিখাও খোঁজাখুঁজি করেছে, শুটকাকে জিজ্ঞেস করেছে, সে জানে কিনা, কোথায় আছি, শুটকা বলেনি, তবে শুটকাই আমাকে বাড়ি ফিরে যেতে বলেছিল বারে বারে, আমি শুনিনি। তারপরে একদিন শুটকার সঙ্গে শুলাদা একেবারে রামকেষ্টর বাড়ি এসে হাজির হয়েছিল, আর এই এক ধরনের লোক আছে পৃথিবীতে, শুলাদীদের মতন, কিছুতেই এদের হাত থেকে ছাড়া পাওয়া যায় না। তা ছাড়া আমারও একটা কেমন ছিল, ওকে আমি এড়িয়ে যেতে পারতাম না। ও যেন অন্যরকম কিছু, ওই কালো কুচকুচে রঙ, গলায় কণ্ঠী, গরুর মতন ড্যাবা ড্যাবা চোখ, আর ওগো হ্যাগো করে কথা বলা—ওকে আমার মানুষ বলে গণ্য করতে ইচ্ছা করে না, অথচ ওর সঙ্গে ঠিক যেন পেরেও উঠি না। আমার মনে হয় শুলাদা আমার মাকে মনে মনে ভালবাসতো—মানে পুরুষেরা যেরকম মেয়েদের ভালবাসে, সেইরকমই, তবে তার মধ্যে একটা অন্যরকম ভাব ভক্তি ছেদাটেদা মেশানো, তার ওপরে চাকর-বাকর হলে যা হয়, চিরদিন মাথা নিচু করেই ছিল, মাকে ঠাকরুণ বলে ডাকতো, আর মায়ের কথার জন্যে এক পায়ে খাড়া থাকতো, মা ওকে শূল বলে ডাকতো।
শুলাদাই আমাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। বাবা নাকি একদম “চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল, তখন তো রিটায়ার করে গেছে, সারাদিনই বাড়িতে, সবাইকেই খালি এক কথা নাকি জিজ্ঞেস করছিল, টুকুর কোন খোঁজ পাওয়া গেল? আমি মাথা নিচু করেই গিয়েছিলাম, কারুর সঙ্গে কোন কথা হয়নি, ফাদার যেন জানতেই পারেনি আমি বাড়ি ফিরে গিয়েছি, দেখা-সাক্ষাতও ছিল না। কিন্তু আহ্, এখনকার ফাদার আর সে ফাদার নেই, লোকটা যে বাড়িতে আছে তা পর্যন্ত জানা যায় না। লোকটার একটা কী গোলমাল হয়ে গেছে, সারাদিন চুপচাপ, রাত্রেও ঘুমায় না, ঘর অন্ধকার করে বসে থাকে। দাদাদের কারুর সঙ্গেই কথা বলে না, অথচ আশ্চর্য এই, আমার সঙ্গে মাঝে মধ্যে দু-একটা কথা হয়—তবে দিনের বেলা না, রাত্রে, যখন আমি মাল খেয়ে ফিরি। সত্যি ভাবা যায় না, আমি মাল খেয়ে ফিরলেও বাবা একদম চুপচাপ, আর তাতেই তো গোলমাল হয়ে গিয়েছিল একদিন।
আমি নিজেই কি জানতাম নাকি, দুম করে ফাদারের ঘরে ঢুকে যাব ওই অবস্থায়। কিন্তু ওই কী একটা পোকা একদিন মাথায় ঢুকেছিল, ওরকম চুপচাপ থাকা আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। আর পেটে রস পড়লে, মাথার মধ্যে এমন গোলমাল হয়ে যায়, কী করতে কী করে বসব, কিছুই জানি না। একদিন রাত প্রায় এগারোটায়, ফাদারের অন্ধকার ঘরে ঢুকে পড়েছিলাম, সুইচে হাত দিয়ে আলো জ্বালিয়ে দিয়েছিলাম। দিতেই দেখেছিলাম বাবা একটা চেয়ারে চুপ করে বসে আছে, আর আলো দেখেই এমন চমকে উঠেছিল, যেন আচমকা কেউ মেরেছে, এমনিভাবে নিচু গলায় প্রায় ডুকরে উঠেছিল, ‘কে? আহ্, নেভাও, বাতি নেভাও তাড়াতাড়ি।
এমনভাবে বলেছিল, না জানি কী ঘটেছে, যে জন্যে সঙ্গে সঙ্গে আলো অফ করে দিয়েছিলাম। খানিকক্ষণ পর্যন্ত একদম চুপচাপ, যেন আলোটা জ্বলে উঠে কী সব গোলমাল করে দিয়েছিল, সেটা ঠাণ্ডা হতে একটু সময় লেগেছিল। আমি তো ভেবেছিলাম, ফাদার উঠবে, একটি লাথি মারবে, কিক যাকে বলে। কিন্তু সেসব কিছুই হয়নি—কী বিচ্ছিরি অন্ধকার, মনে হয়েছিল, পৃথিবীতে এক ফোঁটা আলো নেই, সব অন্ধকারে ডুবে গেছে আর সেই অন্ধকারে, বাবার গলা শোনা গিয়েছিল, ‘কী চাই।’
আমি বলেছিলাম, ‘কী করছেন অন্ধকারে বসে বসে।’
‘সে খোঁজে তোমার দরকার নেই।’
কিন্তু কী আশ্চর্য, আমার বাতিটা জ্বালতে ইচ্ছা করছিল, মানে অনেকটা বলতে গেলে, ফাদারের পেছনে লাগবার জন্যেই দেখতে ইচ্ছা করছিল, ফাদার কী রকম করে ওঠে আর কেমন করে ওঠে, সেটাও জানতে ইচ্ছা করেছিল। আমি বলেছিলাম, ‘আমি আলোটা আবার জ্বালবো।’
‘না, বারণ করছি আলো জ্বালবে না।’ মোটেই ধমকের সুরে বলেনি বরং অনেকটা মিনতি বলতে যেরকম বোঝায় সেইভাবেই মোটা গলায় বলছিল আর যেন অনেক দূর থেকে বলছিল। আর সেই প্রথম যে কথা, আমি কাউকে বলিনি, সেই কথাই আমার মনে এসেছিল, কারণ সেখানে একটু সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতেই, আমার মনে হয়েছিল, ঠিক বুঝছি না, কিছুই ভাল লাগছে না, কেন আমি আছি, কেনই বা জন্মেছিলাম। তাই বলেছিলাম, ‘আপনার ওপর আমার সব থেকে বেশী রাগ।
‘রাগ?’
‘হ্যাঁ।’
‘কেন?’
‘কেন আমাকে এনেছিলেন।’
‘এনেছিলাম?’
“হ্যাঁ, কেন জন্ম দিয়েছিলেন।’
‘ফজিলামি করো না, যাও। ‘ফাজলামি না, আমি জানতে চাই কেন এনেছিলেন। আপনি কি জানতেন, আমি আসব, আমি, এই আমি!’.
‘তা কেউই জানতে পারে না।’
আমি প্রায় জেদ করে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম, যেন অনেকদিনের একটা চেপে রাখা রাগ হঠাৎ একেবারে খেকিয়ে বেরিয়ে এসেছিল, ‘জানতে পারেন না তো এনেছিলেন কেন। আপনি তো এনে খালাস, এখন আম কী করব।’
‘তুমি—’
ফাদার চুপ করেছিল খানিকক্ষণ, কোন কথাই বলেনি, যেন এমন একটা ধাঁধা দিয়েছিলাম তা সলভ করার উপায় ছিল না। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে, একটু পরে ফাদার বলেছিল, ‘আমি কেন জন্মেছি, তাও আমি জানতাম না।’
‘সে কথা আপনার বাবা জানতো।’
‘না, বাবাও জানতো না। সে কথা কেউ বলতে পারে না।’
‘বলতে পারবে না, অথচ আনতে পারবে, আর তারপরে?’
‘তারপরে—তারপরে—যার যার নিজের ব্যাপার।’
‘সে মরুক বাঁচুক কষ্ট পাক বা যা খুশি তাই হোক—’
আমাকে থামিয়ে দিয়ে ফাদার বলেছিল, ‘হ্যাঁ। তুমি এখন যাও।’
‘না, আমি আলোটা জ্বালব, আপনাকে দেখব।’
‘না না, বারণ করছি—’
ঠিক সে সময়েই শুলাদা এসে আমার হাত ধরেছিল, ‘ছোটখোকা, চলে এস’ বলে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকে, প্রায়ই আমি বাবার অন্ধকার ঘরে ঢুকে পড়ি। খুট করে লাও জ্বালিয়ে দিই, বাবা চমকে চোখে হাত চাপা দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘আহ্, নেভাও নেভাও।’ আমি খানিকটা মজা পাই, আমার অবাক লাগে, লোকটা কী করে ওরকম বসে বসে—অথচ মালও খায় না যে, ভোম হয়ে বসে থাকে, যেন বসে বসে কী ভাবে। কিছুই বুঝি না আমি, তার ওপরে রাগ ঝাল কিছুই নেই, এমন কি আমার তো অবাকই লাগে, আমাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেও বলে না। বাইরে যা-ই করি, খাই তো বাড়িতেই, তার জন্যে কোন টাকা পয়সা দিতে হয় না, থাকিও বাড়িতেই। ইচ্ছা করলে ফাদার তো আমাকে যে কোনদিন তাড়িয়ে দিতে পারে, টাকা পয়সা চাইতে পারে, কিন্তু কিছুই বলে না। এইসব ব্যাপারগুলো সব মিলিয়ে ফাদারের ওপর আমার কেমন একটা মায়া-মায়া ভাব আসে। টাকা পয়সা কারুর কাছেই চায় না, কেশব পূর্ণেন্দুর কাছেও না, তবে ওদের সঙ্গে এখন কথা একেবারেই বন্ধ, আমার সঙ্গেই যা দু-একটা কথা হয়, নেহাত পেছনে লাগি বলে। পেছনে লাগি বটে, তবু কী রকম একটা মনের মধ্যে হয়, ওই মায়া মমতা ধরনের। কী জানি সেটা কী, ফাদারকেও বুঝি না, নিজেকেও না।