পুলিশ – 2
‘মাছের মধ্যে ইলিশ।
আর মানুষের মধ্যে পুলিশ।’
এই অবিস্মরণীয় পঙ্ক্তি দুটি যে মহাজন (মতান্তরে মহাকবি) রচনা করেছিলেন তিনি খুব প্রাচীন ব্যক্তি নন।
ইলিশের প্রাচীনত্ব নিয়ে একটু আধটু আলোচনা চালানো যেতে পারে। তেমন তেমন দিগ্গজ পণ্ডিত এ সুযোগ পেলে চর্যাপদ থেকে মঙ্গলকাব্য, কৃত্তিবাস-কাশীরাম-আলাওল, এমনকী যে বৈষ্ণবকাব্য (আমিষগন্ধ নাহি তায়)—তার মধ্যে ইলিশ কিংবা ইলিশের আভাস খুঁজে হদ্দ হয়ে যেতেন।
সেদিক থেকে পুলিশ অনেক আধুনিক। সেপাই-শান্ত্রী-লেঠেল-বরকন্দাজ, পাইক-কোতোয়াল চিরকালই ছিল, কিন্তু পুলিশ এল ইংরেজদের হাত ধরে মাত্র আড়াইশো বছর আগে।
পুলিশ এসেই জনমানসে তার অবস্থান পাকা করে নিয়েছিল। তার কী খাতির, কী রমরমা। গ্রাম্য কবিয়াল তাকে রাজার আসনে, তার চেয়েও বেশি শ্রীকৃষ্ণের আসনে, ভগবানের আসনে বাসয়ে গান বেঁধেছিল,
লাল পাগড়ি মাথে
তুমি রাজা হলে মথুরাতে।
সেই লাল পাগড়ির গৌরব, তার জলুস অনেকদিন বিদায় নিয়েছে, তার জায়গা নিয়েছে টুপি, প্রয়োজনবোধে হেলমেট। লাল পাগড়ি এখনও রয়ে গেছে পুরনো সাদাকালো বাংলা সিনেমায় আর হেমেন্দ্রকুমার রায়ের মাণিক-জয়ন্ত-সুন্দরবাবুর রোমাঞ্চকর কাহিনীমালায়।
লাল পাগড়িওয়ালা পুলিশকে মানুষ যেমন ভয় করেছে এখনকার টুপিওলা পুলিশকেও মানুষ তেমনিই ভয় পায়। ঠিক ভয় পাওয়া নয় ব্যাপারটা, পুলিশকে মানুষ এড়িয়ে যেতে চায়। সাধারণ মানুষের মনের মধ্যে থেকে পুলিশ সম্পর্কে এই আতঙ্কের ভাব হাজারো জনসংযোগ সভা কিংবা বন্ধুত্বমূলক ফুটবল প্রতিযোগিতা করে কিঞ্চিৎ কমানো যেতে পারে কিন্তু সম্পূর্ণ দূর করা অসম্ভব।
কোন এক অজ্ঞাত কারণে কবিদের সঙ্গে পুলিশের সম্পর্ক কেন যেন একটু স্নেহ ভালবাসার। শুধুমাত্র উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মচারীদের মধ্যেই নয় সবরকম পুলিশের মধ্যে কবির সংখ্যা খুব বেশি। সেপাই হোক বা দারোগা, সব থানাতেই একজন করে থানাকবি আছে। লালবাজারে বা ভবানীভবনে তো পুলিশকবির ছড়াছড়ি। প্রত্যেক থানাতে একটি করে দেয়াল পত্রিকা এবং বছরে একটি করে কবিসম্মেলনের আয়োজন করলে খুব ভাল হয়।
কবি তুষার রায় একদা এক চমৎকার কবিতায় পুলিশকে অনুরোধ করেছিলেন,
‘ওরে, ও ভাই পুলিশ
আমাকে দেখে টুপিটা তোর
একটুখানি খুলিস।’
পুলিশের সঙ্গে সত্যিকারের দহরম-মহরম ছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের। তাঁর সেই বিখ্যাত কবিতা, ‘সারাদিন আমাদের পিছু পিছু ঘুরেছে পুলিশ।’ তিনিই লক্ষ করেছিলেন যে কুচকাওয়াজের শেষে পুলিশেও গাইল রবীন্দ্রসংগীত। (বহু পুরনো স্মৃতি থেকে এসব উদ্ধৃতি। ভুল হলে পাঠক নিজগুণে সংশোধন করে নেবেন।)
এবার আমি পুলিশের একটা দুঃখের কথা বলি। বছর দশেক আগে হাওড়ার এক যুবক ডি এস পি আমাকে বলেছিলেন, ‘দেখুন সাধারণ লোকে আমাদের মানুষের মধ্যে গণ্য করে না।’
আমি বললাম, ‘মানে?’
তিনি বললেন, ‘আজকেই দুপুরে অফিসের কাজে একটা বাড়িতে গিয়েছিলাম। ইউনিফর্ম পরা ছিল, আমার সঙ্গে সেই পাড়ারই এক ভদ্রলোক ছিলেন। বাড়ির দরজায় গিয়ে বেল বাজাতে কাজের মেয়েটি দরজা খুলে আমাদের দাঁড় করিয়ে রেখে বাড়ির মধ্যে গিয়ে ঘোষণা করলে, ‘বাইরে একজন ভদ্রলোক আর একজন পুলিশ এসেছে।’
অবশেষে পুলিশ ঘটিত একটি নাবালকসুলভ কাহিনী। নাবালকসুলভ হলেও এর মধ্যে যে তত্ত্বকথা আছে সে খুব জটিল।
একটি আবাসিক বিদ্যালয়ে প্রায় সব ছাত্রই খ্রিস্টান বাড়ির।
রবিবারের ছুটির দিনে ছেলেরা স্কুলের মাঠে খেলছে। একটি সরল প্রকৃতির ছেলে, ভোলা, সে বললে, ‘সবদিন রবিবার হলে কী ভাল হত। কাজ করতে হত না, পড়াশুনো করতে হত না।’
তার বন্ধু কালু, এক পাদরির ভাগ্নে, সে বলল, ‘তা হবে কী করে? রবিবার হল সাবাথ (Sabbath), প্রেয়ার আর খেলার দিন। আজকে কাজ করলে, পড়াশুনো করলে পাপ হয়। সেসব করতে হয় অন্যদিন। আজকে কাজ করলে যিশু রাগ করবে। স্বর্গে যেতে পারবে না।’
ভোলার মুখ কালো হয়ে গেল, তার বাবা পুলিশে কাজ করে। সে বলল, ‘কিন্তু আমার বাবা যে পুলিশে কাজ করে। রবিবারে ডিউটি থাকে।’
কালু বুদ্ধিমান ছেলে। একটু ভেবে সে বলল, ‘তাতে কী হয়েছে। তোর বাবার তো আর স্বর্গে যেতে হচ্ছে না। স্বর্গে তো পুলিশ লাগে না।’