Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

রণেশের সঙ্গে পিপুলের ঘনিষ্ঠতা

রণেশের সঙ্গে পিপুলের ঘনিষ্ঠতা বেড়ে উঠতে লাগল ছবি নিয়েই। ইস্কুল আর পড়ার ফাঁকে ফাঁকে সে রণেশের কাছে চলে আসে। ড্রয়িং শেখে, রঙের সঙ্গে রং মেশাতে শেখে, ক্যানভাসে তুলি চালাতে শেখে। রণেশ তাকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, খেলাধুলো করিস?

একটু-আধটু।

দুর বোকা! একটু-আধটু করলে হয় না। রীতিমতো শরীরচর্চা করতে হয়। আর্টিস্টের বেসিক স্বাস্থ্য হওয়া দরকার চমৎকার। স্বাস্থ্য ভালো হলে অনেকক্ষণ একনাগাড়ে কাজ করতে পারবি, হাতে বা ঘাড়ে যন্ত্রণা হবে না, পিঠ টনটন করবে না। আরও কথা আছে। শিল্প হল বসে বসে কাজ। ব্যায়ামট্যায়াম না করলে ব্লাড-সুগার হয়ে যেতে পারে। দেখিসনি দ্য ভিঞ্চি বা পিকাসোর কেমন স্বাস্থ্য ছিল। দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরি তো কুস্তিগীর ছিলেন। ভালো আর্টিস্ট হতে হলে কোনো ব্যায়ামগারে ভরতি হয়ে শরীরটাকে ঠিক কর।

আর্টিস্ট হওয়ার জন্য পিপুল সব কিছু করতে রাজি। রণেশের কথায় সে একটা ব্যায়ামাগারে ভরতি হয়ে গেল। অখন্ড মনোযোগে ব্যায়াম করতে লাগল।

মামাবাড়িতে শান্তি নেই, কিন্তু গোটা বাড়ি একদিকে আর দাদু দিদিমা ও পিপুল আর একদিকে হওয়ায় সম্পর্কটা কম। মাঝখানে একটা গোলযোগ হয়ে গেল। মামারা এক বাড়িতেই হাঁড়ি ভাগাভাগি করে নিল। আর সেই গন্ডগোলে দাদু আর দিদিমাও মূল সংসার থেকে বাদ পড়ে গেল। দিদিমা দোতলার দরদালানে উনুন পেতে আলাদা রান্নার ব্যবস্থা করে নিল। পিপুল যে রয়ে যেতে পারল, সেটাই বড়ো কথা।

পিপুল অখন্ড মনোযোগে পড়ে, একই মনোযোগে ব্যায়াম করে এবং ছবিও আঁকে। সে একটু একটু বুঝতে পারে, এ দুনিয়ায় তাকে ঠেকনো দেওয়ার মতো আপনজনের বড়োই অভাব। দাদু আর দিদিমা তাকে যক্ষীর মতো আগলে থাকে বটে, কিন্তু তাদের দিন ফুরিয়ে আসছে। বাবা মাতাল এবং কাকা আর কাকিমার সংসারে তার অবস্থান অনিশ্চিত। সুতরাং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে একটু বড়ো হতে হবে। বড়ো না হলে এ দুনিয়াটার সঙ্গে যুঝতে পারবে না সে।

ইস্কুলে তার অনেক বন্ধু জুটে গেল। পাড়ায় জুটল। অনেক মানুষের সঙ্গে তার চেনাজানা হল। যে লোকটা তাকে কালীমামার হাত থেকে প্রথম রক্ষা করতে এগিয়ে এসেছিল সেই গৌর মিত্তিরের সঙ্গে তার দারুণ ভাব হয়ে গেল। কারণ গৌর মিত্তিরের আখড়াতেই সে ব্যায়াম শেখে। বাঘা চেহারা, দারুণ দাপট, প্রবল অহংকার। পিপুলের বুকে একটা প্রবল থাবড়া কষিয়ে একদিন বলল, শুধু চেহারা বাগালেই হবে না, ওতে শরীর সর্বস্ব হয়ে পড়বি। শুধু শরীর-শরীর করে স্বার্থপর, ভীতু আর বোকা হয়ে যাবি। সঙ্গে সাহস, স্বার্থত্যাগ এসবও চাই।

পিপুল করুণ গলায় বলে, ওসবের জন্যও কি আখড়া আছে?

গৌর হাঃ হাঃ করে খুব হাসল। বলল, তুই বেশ ত্যাঁদড় আছিস তো। বোকা তো নোস দেখছি! ব্যায়ামবীরদের বড় একটা সেন্স অফ হিউমার থাকে না–তোর আছে। খুব খুশি হলুম রে।

পিপুলও খুশি হয়ে বলে, আমি ওরকম মোটেই হতে চাই না। আমি ছবি আঁকব বলেই ব্যায়াম করছি।

হ্যাঁ হ্যাঁ, ছবি আঁকাও খুব ভালো। গান গাইতে পারিস?

জানি না। কখনো গাইনি।

শুনতে ভালোবাসিস?

হ্যাঁ।

তাহলেই হবে। একখানা গা দেখি।

সন্ধ্যের পর ব্যায়ামাগার প্রায় ফাঁকা। শরৎকালে সন্ধ্যের পর একটু হিম পড়ছে। আদুড় গায়ে একটা তোয়ালে জড়িয়ে বেঞ্চের ওপর বসা গৌর মিত্তিরকে দেখলে বোম্বেটে বলে মনে হলেও লোকটা মোটেই ওরকম নয়। কিছুক্ষণ পিপুলকে অনুরোধ করেও যখন গাওয়াতে পারল না, তখন নিজেই খোলা গলায় একখানা রাগাশ্রয়ী শ্যামাসংগীত ধরে ফেলল গৌর মিত্তির। গাইতে গাইতে চোখ দিয়ে জলের ধারা নেমে এল।

পিপুল মুগ্ধ। বলল, আমাকে গান শেখাবেন?

শেখাব। তবে সব কিছু একসঙ্গে করতে যাস না–সব পন্ড হবে। কোনটা বেশি ভালো লাগে সেটা ভালো করে ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখিস। যেটা বেশি ভালো লাগবে সেটাতেই জান লড়িয়ে দিবি।

পিপুলের জীবন শুরু হল ছবি, গান, শরীরচর্চা দিয়ে। জীবনের স্বাদ সে এই প্রথম পাচ্ছে। ছুটছাট গন্ডগোল মামাবাড়িতে লেগেই আছে বটে, কিন্তু পিপুল আর গ্রাহ্য করে না।

দিদিমা একদিন বলল, হ্যাঁরে দাদা, তুই যে বেশ জোয়ানটি হয়ে উঠলি। এই তো ছোট্টটি এসে হাজির হয়েছিলি গুটিগুটি!

সে দিদিমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, খুব খাওয়াচ্ছ যে! পেটভরে এতকাল কী খেতে পেতুম?

আর একদিন আরও মজার একটা ঘটনা ঘটল। সন্ধ্যেবেলা ব্যায়ামাগার থেকে ফিরছিল পিপুল। বিকেলের আলো তখনও একটু আছে। বাড়ির সামনের পুকুরের ধারে কদম গাছের তলায় একজন লোক বিমর্ষ মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। পিপুল তাকে এক লহমায় চিনতে পারল। তার বাবা হরিশচন্দ্র। কিন্তু বিস্ময়ের কথা, তার বাবা তাকে একদম চিনতে পারল না। বরং তাকে দেখে বলল, তুমি ও বাড়িতে যাচ্ছ ভাই?

পিপুল বাবাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। প্রশ্ন শুনে হাঁ হয়ে গেল। বলল, হ্যাঁ তো, কিন্তু…

আমাকে চিনবে না। ও বাড়িতে একটি ছোটো ছেলে আছে, তার নাম পিপুল–একটু ডেকে দেবে তাকে?

পিপুল এত অবাক হল যে বলবার নয়। কিন্তু সে একটু বাজিয়ে নেওয়ার লোভও সামলাতে পারল না। বলল, আপনি পিপুলের কে হন?

হরিশচন্দ্রের চেহারা অনেক ভেঙে গেছে। দু-গাল গর্তে, চোখ ডেবে গেছে। জামাকাপড়ের অবস্থাও ভালো নয়। হরিশচন্দ্র যে কিছু একটা মতলবে এসেছে তাতে সন্দেহ নেই। হরিশচন্দ্র বলল, বিশেষ কিছু হই না–দেশের লোক আর কী!

পিপুল তার বাবার কথা খুব জিজ্ঞেস করে, আপনি কী তার বাবার কাছ থেকে আসছেন?

হ্যাঁ, ওরকমই।

আপনি কি তাকে নিয়ে যেতে চান?

হরিশচন্দ্র মলিন মুখে মাথা নেড়ে বলে, না। কোথায় নেব? আমার জায়গা নেই!

পিপুলকে কিছু বলতে চান?

হরিশচন্দ্র ইতস্তত করে বলে, একটা দুটো কথা ছিল। তা তাকে কি পাওয়া যাবে এখন?

যান না, ভিতরে চলে যান। সে দোতলায় থাকে।

হরিশচন্দ্রের সে সাহস হল না। জিব দিয়ে ঠোঁট চেটে বলল, ভিতরে আর যাব না, এখান দাঁড়িয়েই দুটো কথা কয়ে নেব। সময় লাগবে না।

বাবার প্রতি পিপুলের তেমন কোনো আকর্ষণ কোনো দিনই ছিল না। বাবার জন্যই তার মা আত্মহত্যা করেছে। এই বাবার জন্যই সে নিজেদের বাড়িতে শতেক লাঞ্ছনা সহ্য করেছে। এই বাবাই তাকে মামাবাড়িতে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছিল গয়নার লোভে। সুতরাং বাবার ওপর তার খুশি হওয়ার কারণ নেই।

সে বলল, কেন, ভিতরে যাবেন না কেন?

হরিশচন্দ্র থুতনি চুলকে বলল, না, আমার জামাকাপড় তো ভালো নয়। এ পোশাকে কী আর শ্বশুরবাড়ি যাওয়া যায়!

শ্বশুরবাড়ি কথাটা মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। পিপুল হেসে ফেলল, বলল, এটা আপনার শ্বশুরবাড়ি নাকি?

হরিশচন্দ্র জিব কেটে বলল, না, ঠিক তা নয়। অনেক দূর-সম্পর্কের একটা ব্যাপার ছিল তো, তাই।

পিপুল নাটকটা আর বাড়াতে দিল না। একটু হেসে বলল, এতগুলো মিথ্যে কথা কেন বলছ বাবা? আমিই পিপুল।

এবার হরিশচন্দ্রের সত্যিকারের হাঁ হওয়ার পালা। এমন হাঁ করে রইল যেন ভূত দেখেছে। অনেকক্ষণ কথাই কইতে পারল না। তারপর বেশ ঘাবড়ানো গলায় বলল, তুই! সত্যিই তুই নাকি!

আমিই।

বয়ঃসন্ধির বাড়টা একটু তাড়াতাড়ি ঘটে। সেটা খেয়াল ছিল না হরিশচন্দ্রের। তা ছাড়া রোগাভোগা সেই পিপুল তো আর নেই। দু-বেলা তার খাওয়া জোটে। সে ব্যায়াম করে, খেলে, গান গায়।

হরিশচন্দ্রের বিস্ময়টা কাটতে সময় লাগল। তারপর বলল, আমি তোর কাছেই এসেছি, একটু কথা আছে।

কী কথা?

ওদিকপানে চল। আড়াল হলে ভালো হয়।

অপেক্ষাকৃত একটু নির্জন জায়গায় এসে হরিশচন্দ্র ছেলের দিকে চেয়ে বলল, হ্যাঁরে, গয়নাগুলোর হদিস করতে পারলি?

কিসের গয়না?

দুর আহাম্মক! গয়নার জন্যই তো তোকে এখানে এনে হাজির করেছিলাম! তোর মায়ের গয়না-তোর দিদিমার কাছে গচ্ছিত আছে।

মায়ের গয়না? কেন? তুমি তা দিয়ে কী করবে?

হরিশচন্দ্র অতিশয় করুণ গলায় বলে, আমার চিকিৎসার জন্য টাকা চাই। ঘরে একটি পয়সাও নেই। বাড়িতে নানা গন্ডগোল, সেখানেও বেশিদিন থাকা যাবে না। বউ-বাচ্চা নিয়ে এখন কোথায় যাই বল!

এটা হরিশচন্দ্রের দ্বিতীয় ভুল। সে যে বিয়ে করেছে এবং বাচ্চাও হয়েছে এ খবর মামাবাড়িতে এখনও পৌঁছোয়নি। হরিশচন্দ্র না বললে পিপুল জানতেও পারত না।

পিপুল জিজ্ঞেস করে, তুমি আবার বিয়ে করেছ নাকি?

হরিশচন্দ্র ফের জিব কেটে ভারি অস্বস্তির সঙ্গে মুখটা নামিয়ে বলল, কী করব সবাই ধরে বেঁধে দিয়ে দিল। আমার মোটেও ইচ্ছে ছিল না।

কবে করলে?

তুই চলে এলি–তা বছর তিনেক হবে না?

চার বছর।

এই তিন বছর হল, বন্ধুবান্ধবরা ধরে পড়ায় বিয়েটা করতে হল।

পিপুল বড্ড রেগে গেল লোকটার ওপর। তার ইচ্ছে হল, ধাঁই করে লোকটার নাকে একটা ঘুষি বসিয়ে দেয়। কিন্তু বাপ বলে কথা, ইচ্ছেটা দমন করে সে বলল, তুমি আমার মায়ের গয়না চাইতে এসেছ কেন? ও গয়না তো তোমার নয়?

হরিশচন্দ্র একটু খিঁচিয়ে উঠে বলে, আমার নয় তো কার? বিয়ের সময়ে পঁচিশ ভরি গয়না কড়ার করে বিয়ে হয়েছিল। বউয়ের গয়নার হক তার স্বামীর!

তাহলে গিয়ে নিজেই চেয়ে নাও।

হরিশচন্দ্র মিইয়ে গিয়ে বলে, আমাকে দিতে চাইবে না।

দিদিমার কাছে শুনেছি, তুমি মায়ের কিছু গয়না বেচে দিয়েছ।

হরিশচন্দ্র মাথা নেড়ে বলে, ওরে না না, ওটা বাড়িয়ে বলেছে। আসলে অভাবের সংসারে কতরকম টানাটানি থাকে। তুই যখন ছোটো ছিলি, তখন বোধহয় দুধ জোটাতে না পেরে একদিন আংটি না কি যেন নিয়ে বন্ধক দিই। তা সে ফের ছাড়িয়েও এনেছি।

তোমার হাত থেকে গয়নাগুলো বাঁচাতে মা সেগুলো দিদিমার কাছে রেখে গিয়েছিল।

হরিশচন্দ্র সাগ্রহে বলে, হ্যাঁ, হ্যাঁ। স্বীকার করেছে তাহলে? তা কোথায় রেখেছে সেসব?

পিপুল মাথা নেড়ে বলে, তা আমি জানি না।

হরিশচন্দ্রের চোখ জুলজুল করছিল লোভে। বলল, চারদিকে নজর রেখেছিলি? নাকি আদরে-আহ্লাদে একেবারে ভোম্বল হয়ে আছিস?

আমার তো গয়নার খোঁজে দরকার নেই।

আহা, তোর দরকারের কথা ওঠে কীসে? আইনত ন্যায্যত গয়না হল আমার সম্পত্তি। তোর দিদিমাকে ইচ্ছে করলে আমি জেলে পাঠাতে পারি, তা জানিস?

পিপুল এই অদ্ভুত লোকটাকে হাঁ করে দেখছিল। তার দিদিমা এত অত্যাচার, প্রতিবাদ, গঞ্জনা সয়ে তাকে আগলে রেখেছিল বলে সে আজও বেঁচে আছে। সেই দিদিমাকে এ লোকটা জেল খাটাতে চায়!

সে এবার নাবালক থেকে সাবালক হয়ে বেশ ধমকের গলায় বলল, দিদিমা তোমার গুরুজন না?

এঃ গুরুজন! গুন্ডা লাগিয়ে যখন আমাকে মার দিয়েছিল তখন গুরুজন কোথায় ছিল বাবা!

দিদিমা মোটেই গুন্ডা লাগায়নি।

সব শেয়ালের এক রা। এদের হাড়ে হাড়ে চিনি কিনা। এখন শোনো, আমি সামনের শুক্কুরবার আবার আসব। চারদিক আঁতিপাঁতি করে দেখে রাখবি। আর দিদিমার সঙ্গে নানা কথাবার্তার ফাঁকে সুলুকসন্ধান জেনে নিবি। বোকা হয়ে থাকিস না, বুঝলি?

ও গয়না আমি বড়ো হলে আমাকে দেবে দিদিমা।

হরিশচন্দ্র একগাল হেসে বলে, ওরে আমিও তো সেটাই চাই। আমার কাছে থাকলে তোরই থাকল। দিদিমা বুড়ো মানুষ, কবে মরেটরে যায়। তার আগেই ওগুলো হাত করা দরকার। যদি সন্ধানটাও জানতে পারিস, তাহলে আমি লোক লাগিয়ে হলেও ঠিক জিনিসটা উদ্ধার করব।

চুরি করবে?

কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে হয় রে। যেমন কুকুর তেমনি মুগুর। অন্যের জিনিস গাপ করে বসে আছে, চোর তো তোর দিদিমাই। আমার জিনিস আমি ফেরত নিলে কী চুরি করা হয়।

পিপুল খুব রেগে যাচ্ছিল। বলল, তুমি খুব খারাপ লোক।

খারাপ লোক! কেন, খারাপটা কী দেখলি শুনি? আজ আমার অবস্থা পড়ে গেছে, সবাই অচ্ছেদা করে বলে তুইও করবি? তুই না আমার ছেলে?

পিপুল মাথা নেড়ে বলে, তুমি খারাপ লোক। সবাই বলে তুমি আমার মাকে খুন করেছ। তুমি মদ খেয়ে মাতলামি করো।

হরিশচন্দ্র আগের হরিশচন্দ্র হলে এবং পিপুল চার বছর আগেকার পিপুল হলে এই সময়ে পিপুলের গালে চড়-থাপ্পড় পড়তে পারত। কিন্তু হরিশচন্দ্রের শরীর জীর্ণ-শীর্ণ, দুর্বল। সে ধান্ধাবাজ ও লোভী। সেইজন্য এতটা উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু ঘটনাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আর তার নেই। সে ছেলের সঙ্গে এঁটে উঠবে না এটা আন্দাজ করেই নিজের রাগ সামলে নিয়ে মিঠে গলায় বলল, তুই তো দেখিসনি, তোর কালীমামা লোক জুটিয়ে নিয়ে গিয়ে কী মারটাই না মেরেছিল আমাকে। সর্বাঙ্গে হাজারটা ক্ষত। বাঁ চোখটা ভগবানের দয়ায় বেঁচে গিয়েছিল, নইলে কানা হয়ে যাওয়ার কথা। তোর বাপকে মারল, আর তুই ওদের পক্ষ নিয়েই কথা বলছিস! আমি ভালো বাবা না হতে পারি, কিন্তু বাবা তো!

তাতে কী হল? তুমি তো আমার খোঁজও নাওনি?

কেন, আমি শ্রীপদকে পাঠাইনি চিঠি দিয়ে তোকে নিয়ে যেতে? তোর দিদিমাই তো তোকে আটকে রেখেছিল।

দিদিমা তো ভালোই করেছিল। শ্রীরামপুরে গিয়ে কী হত? সবাই মিলে মারধর করে, খেতে-পরতে দেয় না, সব সময়ে গালাগাল করে।

ছেলেপুলেকে শাসন সবাই করে–ওটা ধরতে নেই।

গত চার বছরে তুমি তো আর আমার খোঁজ নাওনি!

হরিশচন্দ্র মৃদু মৃদু হেসে বলল, খোঁজ নিইনি কে বলল? এখানে আমার মেলা চর আছে। তারা ঠিক খবর দিত। তবে নিজে আসতাম না অপমানের ভয়ে। তা ছাড়া তোকে নিয়ে গিয়ে সৎমার হাতে ফেলতেও ইচ্ছে যায়নি। এ মাগীও বড্ড বদরাগী। তা তুই কি রেগে আছিস আমার ওপর বাবা?

পিপুলের চোখে জল আসছিল। বাবাকে সে ভালোবাসে না তেমন, তবু এই ভাঙাচোরা লোকটাকে দেখে তার কষ্ট হয়। মিথ্যেবাদী, পাজি, নিষ্ঠুর, মমতাহীন, মাতাল, স্বার্থপর এ লোকটা তার বাবা না হলে সে হয়তো খুশি হত। কিন্তু এ লোকটাকে একেবারে মুছেও তো সে ফেলতে পারেনি।

পিপুল বলল, বাবা বাড়ি যাও। মায়ের গয়না দিদিমা লুকিয়ে রেখেছে, কেউ তা খুঁজে বের করতে পারবে না।

হরিশচন্দ্র এবার তেরিয়া হয়ে বলে, এঃ, লুকিয়ে রাখলেই হল? দেশে আইন নেই? পুলিশ নেই?

পিপুল বলল, অত সব আমি জানি না। গয়না দিদিমা তোমাকে দেবে না।

তাহলে তুই আমার সঙ্গে চল!

কেন যাব?

তুই গেলে ওই বুড়ি নরম হয়ে পড়বে। নাতির মায়া বড় মায়া। সুড়সুড় করে গয়না বের করে দেবে তখন।

আমি শ্রীরামপুর যাব না।

আহা, বেশিদিনের জন্য বলছি না। সাতটা দিন একটু থেকে আসবি চল, তার মধ্যেই আমি বুড়িকে পটিয়ে মাল বের করে নেব।

পিপুল মাথা নেড়ে বলল, না বাবা, তুমি বাড়ি যাও। আমি তোমার সঙ্গে যাব না, দিদিমার কাছেই থাকব।

আজ বুঝি আমার চেয়েও দিদিমা তোর আপন হল! আমি যে ওদিকে না খেয়ে মরছি!

তুমি তো চাকরি কর।

সে চাকরি কবে চলে গেছে।

কালীমামা তোমাকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছিল না?

সেসব কবে ফুঁকে দিয়েছি। পাঁচ হাজারের অর্ধেকই তো গুন্ডাটা কেড়ে নিল। ক-টা টাকাই বা পেয়েছিলাম। দে বাবা এ যাত্রাটা উদ্ধার করে।

আমি তো গয়নার খবর জানি না–আমি পারব না।

হরিশচন্দ্র খুবই হতাশ হল। গয়নাগুলোই ছিল তার শেষ আশাভরসা। সে উবু হয়ে বসে পড়ল মাটিতে। কিছুক্ষণ ঝিম ধরে থেকে কাহিল গলায় বলল, তাহলে একটা কাজ করবি বাবা?

কী কাজ?

তোর দিদিমাকে গিয়ে বল গে, আমার অবস্থা এখন-তখন। দু-শোটা টাকা চাই। না, দাঁড়া –দু-শো নয়, চাইলে একটু বেশিই চাইতে হয়, কষাকষি করে ওই দু-শোই দেবে–তুই পাঁচ-শো চাস।

শোনো বাবা, তুমি আবার এসেছ শুনলে এবার কিন্তু মামারা তোমাকে ছাড়বে না। সবাই খুব রেগে আছে তোমার ওপর।

হরিশচন্দ্র কেমন ক্যাবলাকান্তের মতো ছেলের দিকে চেয়েছিল। কথাটা যেন বুঝতে পারল না। বলল, টাকাটা এনে দিলেই চলে যাব। তোর দিদিমার অনেক টাকা। দিদিমা যদি না দিতে চায়, দাদুকে বলিস। শ্বশুরটা খুব কেপ্পন ছিল বলে তার কাছে চাইতে ইচ্ছে যায় না। তবে শাশুড়িটা খুব খারাপ ছিল না। শালা-সম্বন্ধীরা ছিল এক নম্বরের খচ্চর। যা বাবা, ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে আয়। নাহলে বেঘোরে মারা পড়ব।

পিপুল শেষ অবধি গিয়েছিল দিদিমার কাছে। সব কথা খুলে বলেছিল।

দিদিমার মনটা বড়ো নরম। জামাইয়ের অবস্থা শুনে চোখ দুটো ছলছল করতে থাকে। বলে, কিছু চাইছে বোধহয়?

প্রথমে দু-শো টাকা চেয়েছিল। পরে বলল, পাঁচ-শো। বলল, কষাকষি করে ওই দু-শোই দেবে।

দিদিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তার চরিত্র ভালো নয়, আবার বিয়ে করে আর একটা মেয়ের সর্বনাশ করেছে। সংসারে টান পড়ায় এসে হাজির হয়েছে। টাকা কিছু দিতে পারি, তবে ভয় হয় টাকা নিয়ে গিয়ে মদ গিলে পড়ে থাকবে হয়তো।

তাহলে বলে দিই যে হবে না!

না, একেবারে শুধু হাতে ফেরানোর দরকার নেই। পঞ্চাশটা টাকা দিচ্ছি, দিয়ে আয় গে, বলিস যেন মদটদ না-খায়।

পিপুল অবাক হয়ে বলল, দেবে?

যদি কষ্ট পায়।

বাবাকে আমি চিনি দিদিমা, টাকা পেলেই মদ খাবে।

তা কপালে কষ্ট লেখা থাকলে আর কী করা যাবে! যা দিয়ে আয়।

পিপুল পঞ্চাশটা টাকা এনে দিলে। হরিশচন্দ্র পাওনাগন্ডা বুঝে নেওয়ার মতো স্বাভাবিক ভাবেই টাকাটা পকেটে রাখল। যেন হকের টাকা। বলল, এ বাজারে পঞ্চাশে কিছু হয়? তোর দিদিমার নজরটা বড়ো ছোটো। আমি আজ যাচ্ছি–ফের আসব সামনের হপ্তায়। এর মধ্যে গয়নাগুলোর একটা খোঁজখবর করে রাখিস।

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *