এত হাঁপাচ্ছি কেন – Patak
এত হাঁপাচ্ছি কেন, বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে, যেন অনেকটা দৌড়েছি বা ভারী কোনও মালপত্র তোলাপাড়া করেছি। অথচ সত্যি তা করিনি। খুব খানিকটা পরিশ্রম করলে যেরকম লাগে, ঘন ঘন নিশ্বাস পড়া, হাঁপ লাগা, সেরকম লাগছে। নিশ্চয়ই ব্লাডপ্রেসার হয়নি। আমার মতো বয়সে যে কারুর ব্লাডপ্রেসার হয় না, তা নয়। বিপ্লবের তো হাইপ্রেসার।
এই আবার আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। বিপ্লব! তার মানে কী? ইংরেজিতে যাকে রেভলিউশন বলে, বিপ্লব শব্দের মানে তা-ই তো। এটা নাম হয় কী করে বুঝতে পারি না। একটা ছেলের–মানে মানুষের নাম, আর ইনভেরিয়েবলি বাঙালির নাম। আজকাল তো চারদিকেই বিপ্লবের ছড়াছড়ি। বিপ্লব মুখার্জি, বিপ্লব গুহ, বিপ্লব সেন, আশে-পাশে, চেনা অচেনা প্রচুর বিপ্লব। এ বিপলাও বাবু, আপকা কিতাব লে যাইয়ে। এরকম উচ্চারণও আমি, অবাঙালি পিওনের মুখে একদিন শুনতে পেয়েছি। আমার কানে, বিপলাওশব্দটা এমন খট করে ঠেকেছিল যে, পিওনটা ঠাট্টা করছে কি না ভেবে, তার মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম। না, ঠাট্টা করেনি, আর বিপ্লবের কানে যে কথাটা একেবারেই ঠেকেনি, সেটা ওর মুখ দেখেই বুঝেছিলাম। বিপ্লবী বললে, তবু একরকম শোনায়, তাও নাম হয় না। অনেক নামেরই হয়তো মানে হয় না বা নাম হয় না, যেমন মিলন। মিলনও ঘটে, বিপ্লবও ঘটে। শব্দগুলো শুনতে ভাল লাগে বলেই বোধহয় রাখে। কিংবা অন্য আরও কিছুও হতে পারে। হতে পারে নয়, তা-ই, আর সেজন্যেই এরকম নাম শুনলে আমার মাথায় পোকা বিজবিজ করে ওঠে। বিপ্লবকে, আমার বন্ধু বিপ্লব মজুমদারকে প্রথম আলাপের দিনই আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, আচ্ছা, এ নামের মানে কী?
বিপ্লব বলেছিল, কী জানি, নাম একটা রেখেছে, রাখতে হয়, তা-ই।
ওর মুখ দেখে, আমার কেমন মনে হয়েছিল, যতটা কিছু নয় ভাবের মুখ করে বলছে, ব্যাপারটা ঠিক তা না। বিপ্লব অবিশ্যি খুব গম্ভীর ছেলে, ভাবটা সবসময়েই একটা গভীর চিন্তায় ডুবে আছে, মোটা লেন্সের চশমায় চোখ দুটো সবসময়েই যেন অন্য কিছু দেখছে, এরকম একটা ভাব। ও আবার সবসময়েই প্রায় রাজনীতি নিয়ে থাকে তো। সে হিসাবে ও বিপ্লবীও বটে। আমাদের নেতা, আমাদের ছাত্রদের কিংবা আমার মতো, যে নিজেকে ছাত্র ছাড়া কিছু ভাবতে পারে না, অথচ নিয়মিত পড়াশোনা করা বা রেগুলার ক্লাস অ্যাটেন্ড করা কোনওটাই ঠিকমতো হয়ে ওঠে না। বিপ্লব বলতে পারে খুব ভাল। অ্যাজিটেশন না, বেশ যুক্তি দিয়ে ভেবে-চিন্তে বলতে পারে। ও খুব ভাবে, পড়াশুনো করে। কপালের ওপর চুল পড়ে থাকে, গোঁফ-দাড়ি প্রায়ই কামানো হয় না, ভুরু দুটো কুঁচকে থাকে, আর এমনিতে কথা কম বলে। কিন্তু ও যে ভাবে, নাম রাখতে হয়, তাই রেখেছে বলেছিল, ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমার ঠিক তা মনে হয়নি। আমার যেন মনে হয়েছিল, খুব সাধারণভাবে অনেক বেশি একটা অসাধারণ কিছু বলছে। তাই আমি বলেছিলাম কিন্তু এটা তো একটা নামই হয় না।
ও আমার দিকে না তাকিয়ে ঘাড়টা নেড়ে একটা তাচ্ছিল্যের ভাবে নীচের ঠোঁটটা উলটে দিয়েছিল। যেন ব্যাপারটা সেখানেই নিষ্পত্তি করে দিতে চেয়েছিল। আর সত্যিই তো, ব্যাপারটা তো খুবই সাধারণ। এ নিয়ে এত বলাবলিরই বা কী আছে। কিন্তু আমার মধ্যে কেমন একটা খপিসের ভাব আছে। কাউকে জব্দ করার সুযোগ পেলে যদি বুঝতে পারি কারুর কোনও বিষয়ে একটা দুর্বলতা আছে, তা হলে তার ওপরে মাছির মতো ভ্যান ভ্যান করি। তাড়া-খাওয়া মাছির মতো, বারে বারেই ঘুরে ফিরে, সেই একটা জিনিসের ওপরে এসে বসা। মাছিটাকে ঠিক জেদি মনে হয় না বা ক্ষুধার্ত। বরং যেন মনে হয় মজা পাচ্ছে, মজা পেয়ে ভ্যান ভ্যান করছে। হয়তো এভাবেই আমাকে কোনওদিন বিষ-মাখা মিষ্টির মধ্যে পড়ে মরতে হবে। কেন যে এরকম একটা ভাব আসে, বুঝতে পারি না। আমার যেন মনে হয়েছিল বিপ্লব প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যেতে চাইছে। এ কথা মনে হওয়াতেই, আমি আবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোর কখনও মনে হয়নি, এটা কোনও নাম হতে পারে না।
না।
কেন?
একটা নাম জন্মের পর থেকে শুনে আসছি, এর আবার কী মানে হবে।
বড় হয়ে মনে হয়নি?
অত ভেবে দেখিনি।
কে রেখেছিল নামটা?
শুনেছি বাবা রেখেছিল। ছাড় দেখি বাজে কথা, একটা সিগারেট দে।
আবার প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যেতে চাইছিল। ভিতরে ভিতরে ওর বোধহয় রাগও হচ্ছিল। ওকে আমি একটা সিগারেট দিয়েছিলাম। কিন্তু আমার ভিতরে সেই খপিস, একটা মজা পাচ্ছিলাম যেন ওর এড়িয়ে যাওয়া দেখে। এই মজা পাওয়ার সঙ্গে, কেন যেন মনে হচ্ছিল আমার দাঁতগুলো অনেক দিন মাজা হয়নি। জিভে ছাতলা পড়ে আছে। যে কারণে, একটা বিশ্রী ভাব লাগছিল। এই সব ব্যাপারগুলি আমি ঠিক বুঝতে পারি না। দাঁত জিভ সব তো পরিষ্কারই ছিল। আবার বলেছিলাম, নামটা বদলে ফ্যাল।
বিপ্লব জোরে হেসে উঠেছিল। বলেছিল, কী যে ফাজলামি করিস।
আমার কাছ থেকে উঠে চলে গিয়েছিল। গেলে কী হবে, তারপর থেকে আমি প্রায়ই ভ্যান ভ্যান করতাম। ওর সঙ্গে কথা বললেই, একবার করে নামের বিষয়টা তুলতাম। ও বলত, কত লোকের যে বিপ্লব নাম রয়েছে।
তাদের সবাইকে নিয়েই বলছি।
অনেক দিন পর্যন্ত ব্যাপারটা ইয়ার্কি-ফাজলামি হিসাবেই ধরা হচ্ছিল। তারপরে একদিন বিপ্লব রেগে গিয়ে, আমার শার্টের কলার চেপে ধরেছিল, রাসকেল হোয়াট ডু ইউ থিঙ্ক? ইয়ার্কি? রোজ রোজ এক কথা, কিছু বলি না বলে না?
সেদিন ও আমাকে একটা ঘুষি মারতই। নেহাত অন্যান্য বন্ধুরা তাড়াতাড়ি ছুটে এসে ছাড়িয়ে দিয়েছিল তা-ই। আমার মধ্যে কিন্তু তখনও সেই মজার ভাবটা ছিল। কিন্তু তার মধ্যে একটি তিক্ত ঝাঁজ ছিল। ভিতরে ভিতরে, আমারও কেমন একটা রাগ হচ্ছিল। হয়তো বিপ্লবের সঙ্গে মারামারি করতে আমার লজ্জা করত, তাও আবার ওরকম একটা ব্যাপার নিয়ে। ওর সঙ্গে মারামারির কথা আমি কোনওদিন ভাবিনি। লেগে গেলে কী হত তা বলতে পারি না। তারপরে বন্ধুরা যখন কারণটা শুনেছিল তখন ওরা যেন ব্যাপারটা বিশ্বাসই করতে পারেনি। এরকম একটা বিষয় নিয়ে যে হাওয়া এত গরম হয়ে উঠতে পারে, কেউ ভাবেনি। এই ব্যাপার! সত্যি বলতে কী সবাই-ই প্রায় হেসে উঠেছিল। যে হাসি বিপ্লবকে আরও খেপিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, না না, হোয়াট ইজ দি। দেখা হলে, কথা হলেই, এক কথা। এটা সিম্পলি পেছনে লাগা। আই ও টলারেট দিজ থিংস।
ওর মতো সিরিয়াস ধরনের ছেলে, এমনভাবে ইংরেজি বাংলায় মিশিয়ে চিৎকার করছিল, তাতে ওকে আমার আরও অসহায় মনে হচ্ছিল। ও যে এত বুদ্ধিমান, এত বোঝে, জানে, যে কারণে সবাই ওকে বিশেষ কী বলা যায়, সমীহই করে-রেসপেক্ট তা মনে হচ্ছিল না। বন্ধুরা ব্যাপারটাকে তেমন আমল দেয়নি, ফাজলামি মনে করে হেসে উড়িয়েই দিতে চেয়েছিল। কেউ কেউ আমাকে গালাগাল দিয়েছিল, দু-একজন মনে মনে সত্যি সত্যি রেগে গিয়েছিল। আমি বলেছিলাম, আচ্ছা ঠিক আছে, আর কোনওদিন বলব না।
একজন বন্ধু আমার দিকে চেয়ে, হেসে বলেছিল তুই সত্যি খচ্চর, ভিটভিটে খচ্চর।
ভিটভিটে-টা কী তা জানি না মিটমিটে জানি। কথাটা সেদিন নতুন শিখেছিলাম। যাই হোক বিপ্লব আর আমার সঙ্গে সেদিন কথা বলেনি। আমিই যেচে ওর সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তারপর কয়েক দিন বাদেই ওর সঙ্গে ওদের বাড়ি গিয়েছিলাম। ওর বাবার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। ভদ্রলোকের নাম বীরেন্দ্রনাথ মজুমদার। সরকারি অফিসের ইউ ডি সি। ইউ ডি সি, একে ইংরেজি, তায় সংক্ষিপ্ত শব্দের আদ্য অক্ষরে শুনলে মনে হয় একটা দারুণ কিছু ব্যাপার। আপার ডিভিশন ক্লার্ক আসলে। একতলা সেকেলে পুরনো ভাড়াটে বাড়ি। যে অঞ্চলের বাড়ি সেদিকে ভাড়াও কম। চোখের সামনেই দেখেছিলাম প্রায় গোটা-সাতেক ছেলেমেয়ে। বীরেন্দ্রনাথের সন্তানবৃন্দ। কোন দেবীর কৃপায় যেন আমাদের দেশের ছেলেমেয়ে হয়? আহ্, মনে করতে পারছি না কিছুতেই। কী যেন নামটা দুর্গা না চণ্ডী, লক্ষ্মী না সরস্বতীনা না, ও সব নয়। যাক গে, একটা কিছু হবেই, সেই দেবীর কী অসীম কৃপা বিপ্লবের বাবা মায়ের ওপর। সাতের পরেও আনাচে কানাচে আরও ছিল কিনা, জানি না। থাকলে আরও কৃপা বলতে হবে।
একটা ঘরে গিয়ে বসেছিলাম। বিপ্লবের বাবা সেই ঘরে এসেছিলেন। একটা জ্যালজেলে ধুতি কোঁচা দিয়ে পরা, ভিতরে আন্ডারওয়্যার ছিল না, ফল একটি প্রৌঢ়-হ্যাঁ বছর পঞ্চাশ-বাহান্ন নিশ্চয়ই হবে, তাহার নিম্নের ইত্যাদিসমূহ দৃষ্ট হইল, এই রকম বলতে ইচ্ছা করে। আহা, এই যৌবনের আর সেদিন নাই, ইহার আবরু রক্ষা করিয়া কী হইবে। মনে মনে এরকম একটা ভাবও আসে। আমি বিপ্লবের বাবাকে প্রণাম করেছিলাম। পা বাড়িয়ে প্রণাম নিয়েছিলেন ভদ্রলোক। তারপরে বসো বসো। বেশ বেশ।…তুমিও বুঝি বিপ্লবের সঙ্গে রাজনীতি কর? বেশ বেশ এ তো করতেই হবে। তোমরাই তো অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবে।…দু-এক কথার পরেই বীরেন্দ্রনাথ এ সব কথা বলেছিলেন। দেখেছিলাম ভদ্রলোকের কয়েকদিনের দাড়ি না কাটা মুখে রীতিমতো বিক্ষোভের ছাপ। চোখদুটোও যেন জ্বলজ্বল করছিল। বিপ্লব ওর বাবাকে কী বলেছিল আমার সম্বন্ধে কে জানে, কিংবা বিপ্লবের সঙ্গে দেখে হয়তো ধরেই নিয়েছিলেন, আমিও ওঁর ছেলের দলের ছেলে। যত কথা বলেছিলেন সবই ছিল উপদেশ এবং উপদেশগুলোর সব কথাই বর্তমান যুবকদের কর্তব্য বিষয়ে। কেন এত উপদেশ-টুপদেশ দিচ্ছিলেন জানি না, নিশ্চয়ই মাথা খারাপ লোক নয়। আবার তার মধ্যেই হাই তুলে মুখের সামনে তুড়ি দিয়ে জয় মা তারা বলেছিলেন এবং পেটে দুবার হাত দিয়ে বলেছিলেন, বেশ বেশ, তোমরা বসো, পেটটা বিশেষ ভাল যাচ্ছে না, একবার পাইখানায় যেতে হবে।
বলে বেরিয়ে গিয়েছিলেন, আর আমার বলতে ইচ্ছা করছিল, বেশ বেশ আপনার সব খোলসা হোক।.সত্যি আমি যেন ভদ্রলোককে ঠিক স্বাভাবিক মনে করতে পারছিলাম না। অবিশ্যি, বহু লোককেই ওরকম কথা বলতে শুনেছি বিশেষ করে যারা বাবা-টাবা হয়ে গিয়েছে, যারা উপদেশ নির্দেশ ছাড়া কথাই বলতে পারে না। কেন এই করবে সেই করবে, এই করা উচিত, সেই করা উচিত কেন এ কথাগুলো এরা বলে বুঝতে পারি না। বলতেই হবে তাই না? যেন এভাবে কথা বলবার এদের একটা বিশেষ অধিকার আছে। বলতে পেরে খুব খুশি। ওদের যে কে উপদেশ দেয়, কার কথা শুনে মেনে চলে কে জানে। ওদের কথা শুনেই বা কে চলছে, তাও তো জানি না। যেন একজন বলে যাচ্ছে, আর একজন শুনে যাচ্ছে, ফল কী হবে, ভাববার দরকার নেই। বলা আর শোনা তো। বলুন বলুন, বলে যান, এদিকে ঢোকাচ্ছি আর বের করছি।
অথচ বিপ্লব নিজেই আমাকে বলেছিল, বাড়িতে ওর বাবা, ওর ওপরে খঙ্গহস্ত হয়ে আছেন ও নিজে টাকা পয়সা রোজগার করতে পারছে না বলে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছিলেন, ওর মাকে খাওয়া বন্ধ করে দিতে বলেছিলেন। এ সব ব্যাপারে, বিপ্লব মিথ্যে কথা বলবার ছেলে নয়। সেদিন কিন্তু ওর বাবার কথাবার্তা শুনে মনে হয়েছিল ওর বাবা একটা বীরেন্দ্র যোদ্ধা। আর সেদিন, আমার আর একটা কথা মনে হয়েছিল। বিপ্লব নাম যে কেন রাখা হয়েছিল সেটা যেন আমি বুঝতে পেরেছিলাম। ওর বাবার মনের মধ্যে এত বিপ্লব ঠাসা যে, করতে পারি না পারি, ছেলের নামই বিপ্লব রেখে দেব। মানে এটা একটা ইচ্ছা, একটা সাধ, একটা দেশাত্মবোধ, একটা-একটা ভয়ংকর ব্যাপার বিপ্লব, কী দারুণ শোনায়। নিকুচি করেছে অর্থ আর মানের, এই নামই রাখতে হবে। যেন একটা বাঘের মতো বেড়ালকে গর্জে ওঠা, তোর নাগাল পাই না পাই, তোর ইয়ের নাগাল পাব। কিন্তু পিতৃদেব, সে গুড়ে বালি, এবম্বিধ ব্যাঘ্রের জন্য, মার্জার বিষ্ঠা ত্যাগ করিয়াই মাটি চাপা দিয়া দেয়। আপনার ইচ্ছাও সেইরূপ, বীরেন্দ্রনাথদের বিপ্লব এরকম মাটি চাপাই পড়ে।
কিন্তু এ সব কথা আমি বিপ্লবকে কোনওদিন বলিনি। বললে নির্ঘাৎ হাতাহাতি হয়ে যেত। কী দরকারই বা আমার। নেহাত বন্ধু, ডাকাডাকি করে কথা বলতে হয় আর বলতে গেলেই কানে খট খট করে বাজে। এরকম কত নাম আছে, কত কথা আছে, কত ব্যাপার আছে, যা অর্থহীন, অস্বাভাবিক, উদ্ভট কিন্তু মানুষের অভ্যাসের মধ্যে মিশে গিয়ে সব যেন স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। বরং অস্বাভাবিক বলতে গেলে সবাই আমাকেই গালাগাল দেবে, নয়তো বুন্ধু বলবে। লোকেরা যখন মানছে, তুমিও মান, এইরকম আর কী। তার ওপরে যদিকী বলে ওটা–দেশপ্রেমের ফোয়ারায় কিছু বুড়বুড়ি কাটে, তা হলে তো কথাই নেই। যেমন আমার বাবার এক বড়লোক পার্টনারের নাম শুনেছিলাম, গান্ধীকুমার গাঙ্গুলি। বোঝাই যাচ্ছে, ব্যবসায়ীটি গান্ধীজির অসহযোগের যুগে, আঁতুড়-ঘর আলোকিত করেছিলেন। নিশ্চয় বিপ্লবের বাবার মতোই মনের ভাব থেকে এরকম নাম রাখা হয়েছিল। কিন্তু বাবা গান্ধীকুমার গাঙ্গুলি, কে জানিত, তুমি একজনের পদবিকে নাম করিয়া ভবিষ্যতে একজন সাকসেসফুল ব্যবসায়ী হইবে।
.যাক গে এ সব কথা, তবে এখনও বিপ্লবকে নাম ধরে ডাকলে, ওর চোখের কোণে একটু সন্দেহ ঝিলিক দিয়ে ওঠে। ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে, ঠাট্টা করছি কি না সেটা দেখে নেয়। কিন্তু আমি ভাবছিলাম, বিপ্লবের এই বয়সেই ব্লাডপ্রেসার হয়েছে। আমার কি হয়েছে নাকি। একবার বিপ্লবের খুব কষ্ট দেখেছিলাম, যেন ও কিছুতেই নিশ্বাস নিতে পারছিল না। আমারও সেইরকম হচ্ছে। যেন বুকের ভেতরে নিশ্বাস নেবার মতো আর একটু জায়গা নেই। খুব হাঁপিয়ে পড়লে যেরকম হয় তার চেয়ে খারাপ এ অবস্থাটা। অথচ কেন, আমি বুঝতে পারছি না। মিনিট দশ-পনেরো আগের কথা আমি কিছুই মনে করতে পারছি না। মনে করতে পারছি না বা মনে করতে চাইছি না, জানি না। হয়তো মনে করতে চাইছি না কিছুতেই, এত জোর দিয়ে চাইছি না, সেই জন্যই হয়তো মনে করতে পারছি না। কিংবা হ্যাঁ ব্যাপারটা এইরকম মনে হচ্ছে, যেন একটা ঝলকের মতো চোখের সামনে দিয়ে কী একটা চলে গেল, কিছুই বোঝা গেল না। কী একটা ঘটে গেল কিছুই দেখা গেল না। সেইরকমই মনে হচ্ছে। যেন আমার ভাবনা চিন্তাগুলো সব কালো আর মোটা পরদা জড়িয়ে ঢাকা দিয়ে দিয়েছে। আমার চোখের অবস্থাও যেন সেইরকম আমি ভাল করে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। তার ওপরে রোদটা এত চড়া, যেন আমি একটা গরগর গর্জনও শুনতে পাচ্ছি।
আশ্চর্য ব্যাপার, নিজেকেই ঠোঁট বাঁকিয়ে বিদ্রূপ না করে পারছি না। একি পদ্য লেখা নাকি, রোদের গর্জন শুনছি। কিন্তু আমার সেইরকমই মনে হচ্ছে। আমি কোনওদিকে যেন তাকাতে পারছি না। সানগ্লাসটাও সঙ্গে নেই। সেটা যে কোথায় আছে, তাও মনে পড়ছে না। চোখ খুলে তাকাতে পারছি না, মনে হচ্ছে যেন চোখ ফেটে রক্ত পড়বে এমন একটা ভাব। রাস্তায় কি একটা ট্যাক্সিও নেই? লোক চলাচল প্রায় নেই বললেই চলে। এতবড় একটা রাস্তা ঠিক যেন মরুভূমির মতো লাগছে। মরুভূমিই। এমনিতেই কলকাতার এ সব পাড়া একটু নিরিবিলি। সমস্ত বাড়িগুলোর দরজা-জানলা বন্ধ। দোকানপাট প্রায় নেই বললেই চলে। থাকলেও এখন বন্ধ কে-ই বা বিক্রি করবে কে-ই বা কিনবে। রাস্তা ফুটপাত সমস্তই ফাঁকা, হলদে খোঁচা খোঁচা ধারালো দাঁতের মতো রোদ যেন কামড়ে ধরে আছে। কিংবা হয়তো লোকজন চলাফেরা করছে আমি দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু একটা ট্যাক্সির শব্দ নেই, শব্দ হলেও তো শুনতে পেতাম। প্রাইভেট গাড়ির শব্দও নেই। কাছেই একটা গাছ দেখা যাচ্ছে, মনে হচ্ছে, ওখানে দু-একজন আছে, বোধহয় বাস-স্ট্যান্ড। না, ওখানে আমি যাব না, ও সব লোকের কাছাকাছি আমার যেতে ইচ্ছা করছে না। আমি বাসেও চড়ব না। তার চেয়ে, হাঁটতে হাঁটতে দেখি, একটা ট্যাক্সি পাওয়া যায় কি না।
কিন্তু এত টায়ার্ড লাগছে কেন। হাঁপানি হয়ে গেল না তো আমার। এখন তো দেখছি, আমার দাঁতের মাড়িও যেন ব্যথা করছে। মাড়িতে আবার ঠাণ্ডা লাগল কখন। জিভ দিয়ে, মাড়ি চেটে চেটে দেখলাম, না ফোলেনি। অথচ দাঁতের গোড়াগুলো যেন ব্যথা করছে। আমার দাঁত খুব খারাপ নয়, কিন্তু এখন কেমন যেন একটা দুর্গন্ধ পাচ্ছি। অপরের মুখ থেকে এক-এক সময় যেমন পাই, বমি উঠে আসার মতো দুর্গন্ধ, অনেকটা সেইরকমের। যে কারণে আমার মনে হয়, একটা যক্ষ্মা রুগী মেয়েকেও ঠোঁটে ঠোঁট দিয়ে চুমো খেতে পারি, তার সামনে বসে কথা বলতে পারি, কিন্তু একটা পাইয়োরিয়া রুগীকে তা পারব না। যক্ষ্মার থেকেও পাইয়োরিয়া আমার খারাপ লাগে। রত্না, ত্রিদিবের বোনটা, ওহ্, সে একটা সময় গিয়েছে মেয়েটার সঙ্গে। প্রথম প্রথম প্রেম হয়েছিল, মুখের দিকে তাকিয়ে মরেই যেতাম। সত্যিই, মুখটা এত সুন্দর, বড় বড় চোখ, টিকোলো নাক, ঠোঁট দুটোও এমনিতেই রং না মেখে টকটকে লাল দেখাত, দেখতে দেখতে মরেই যেতাম। ভাবতাম, ওই মুখে দুহাত ধরে যেদিন চুমো খাব সেদিন জীবন সার্থক। কল্পনায়, কতই খেতাম, খেতাম খেতাম, খেতেই থাকতাম আর ভাবতাম, যেদিন খাব, খাব খাব খেতেই থাকব। তখনও রত্না কাছাকাছি এসে কথা বললে, একটা হালকা দুর্গন্ধ পেতাম, কিন্তু বিশ্বাসই করতে পারতাম না, ওর কোথাও থেকে সেই দুর্গন্ধটা আসছে। তারপরে যেদিন সময় আর সুযোগ এসেছিল, ওদের বাড়িতেই, সন্ধ্যার অন্ধকারে ছাদে, প্রথম মুখ দিয়েই, ওয়া! এখনও ভাবলে গা ঘুলোয়। আমি একটা শব্দ করে মুখটা সরিয়ে নিয়ে এসেছিলাম। ও বলেছিল, কী হল! তুমি আজ দাঁত মাজনি?মেজেছি তো? কখনও না, দেখি আবার? বলে আমি আবার নাকটা ওর মুখের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম, ওয়াক্! সে যেন তাজা চেহারার বেশ্যার শরীরে চোরাই সিফিলিসের ঘা দেখার মতো। দেখিনি অবিশ্যি কোনওদিন, শুনেছি। ও সব জায়গায় দু-একবার যা গিয়েছি, সাবধান না হয়ে যাইনি। জানি, চোখে কিছুই দেখা যাবে না, গন্ধেও কিছু মালুম দেবে না। রত্নার সঙ্গে সেখানেই, সেইদিন সন্ধ্যায় ছাদেই ইতি হয়ে গিয়েছিল। রাতারাতি নয়, সন্ধ্যাসন্ধিতেই প্রেম মাথায় উঠে গিয়েছিল। শুধু ঘৃণা হয়নি, প্রচণ্ড রাগও হয়েছিল মেয়েটার ওপর। মনে হয়েছিল, আমাকে ঠকিয়েছে শুয়োরের বাচ্ছিটা। আরও অনেক সব মারাত্মক গালাগাল দিয়েছিলাম মনে মনে। বলেছিলাম, দাঁতগুলো সব তুলে ফেলে নকল দাঁত লাগিয়ে নিও। তোমার মাড়ি ভরতি ঘা আর পুঁজ। রত্না আমার ওপর খুব চটেছিল, প্রথমটা যেন জানে না নিজের দাঁতের দশা, এরকম একটা ভাব করেছিল, তারপরে ভীষণ চটে গিয়ে অভদ্র ঘোটলোক, মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে জান না, মিশতে জান না, এমনি সব কথা বলেছিল। তা বলুক গিয়ে, ওরকম ঠোঁটের সামনে এসে চুমো ফিরে গেলে, আমিও গালাগাল দিতাম। কোনও কোনও বাড়িতে বা অফিসে বা দোকানে গেলেও, আমি এরকমই একটা দুর্গন্ধ পাই। অনেক সময়, টেলিফোনের রিসিভারের সামনে মুখ নিয়ে কথা বলতে গেলেও যেন গন্ধটা পাই, আর তখন ঘৃণায় মুখ সরিয়ে নিয়ে কথা বলি।
সেই গন্ধটাই যেন আমি আমার মুখে পাচ্ছি এখন। রত্নাকে যেমন জিজ্ঞেস করেছিলাম, সেরকম নিজেকেই জিজ্ঞেস করি, দাঁত মেজেছিলাম তো আমি? মেজেছিলাম বলেই তো মনে পড়ে। কিংবা, এটা হয়তো দাঁতের গন্ধ নয়, টনসিলের। আমার আবার টনসিল আছে। সেটা যখন ব্যথা হয়, ফোলে তারপরে ফাটে তখন পুঁজের মতোই কিছু বেরোয়, দুর্গন্ধটা এইরকমই। টনসিলের জন্যই এরকম হচ্ছে নাকি। কয়েকবার ঢোক গিলোম, জিভটাকে টাকরায় ঠেকিয়ে বোঝবার চেষ্টা করলাম। টনসিল পেকেছে বলে মনে হল না। কী জানি, দাঁতের গোড়াগুলোতে এত ব্যথা কেন, আর এরকম দুর্গন্ধই বা পাচ্ছি কেন কে জানে। জিভটাও তো মোটা ছালা পড়া ভাব লাগছে।
কী হল শরীরটার মধ্যে। আমি কি অসুস্থ নাকি। কিন্তু কই, জ্বরজারি কিছু তো হয়নি। অথচ দেখছি, হাতের ডানা দুটোতে ব্যথা ব্যথা করছে। আঙুলগুলো যেন সোজা করতে পারব না, গাঁটে গাঁটে এরকম একটা ব্যথা লাগছে। টনটনে ব্যথা। আঙুলগুলোকে মুঠি পাকিয়ে খুলতে লাগলাম, যদি একটু আরাম হয়। কিন্তু না, একটুও আরাম হচ্ছে না। একই রকম ব্যথা। কেন, আমি কি দুহাত দিয়ে কারুর সঙ্গে পাঞ্জা কষেছি নাকি। পাঞ্জা কষলে এরকম হতে পারে। একবার আমার হয়েছিল। তবে, সেটা এক হাতে হয়েছিল। ফ্রি-স্টাইল পাঞ্জা, টেবিল বা কোনও কিছুর ওপর কনুইয়ের ভর রেখে, পিছনে হাত দিয়ে নয়, সামনাসামনি, হাতে হাত দিয়ে, আঙুলের ফাঁকে আঙুল গলিয়ে, পাঞ্জাটা মুচড়ে দেওয়া হয়েছিল রঞ্জনের সঙ্গে। ও আমার থেকেও রোগা-পটকা। আমি বলেছিলাম, দুকাপ কফি বাজি। ও বলেছিল ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ। এক বোতল বিয়র? ওর একটু বেশি বাড়াবাড়ি বরাবরই। স্কুল-ফাইনাল পাশ করবার আগেই বিয়র খেতে আরম্ভ করেছিল। এখন তো দেশি চোলাই আর গাঁজা পর্যন্ত উঠেছে। ওর বাবা দিল্লিতে একটা মস্ত বড় চাকরি করে। বছরে প্রায় তিন-চার মাস, খেপে খেপে, ফরেনে যায়। সেন্ট্রালের মিনিস্টারদের সঙ্গে প্রায়ই ছবিটবি বেরোয়। রঞ্জন সেই ছবির দিকে তাকিয়ে, চোখ মেরে বলে, হেল্লো ড্যাড়, ডুয়িং ওয়েল?
বলবার সময় ওর ঠোঁট বেঁকে যায়, একটা বিদ্রূপ আর ঘৃণার ভাব, তারপরে কাগজটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলে, চালিয়ে যাও বাবা। আমাদের বলে, লোকটা খুব সাদা ঘোড়ায় চাপে। এটা একটা খুব চলতি কথা, সাদা ঘোড়ায় চাপা মানে, শ্বেতাঙ্গিনী সঙ্গ। আর রঞ্জনের মা, কলকাতায়, চুলে বয়েজ কাট দিয়ে, স্লিভলেস পেটকাটা জামা গায়ে দিয়ে, রংচঙে শাড়ি পরে, বেশ কাটাচ্ছে। আমার নিয়মিত যাতায়াত নেই ওদের বাড়িতে। কয়েকবার হঠাৎ গিয়েছি তখনই দেখেছি ওর মাকে। বেশ কেমন একটা পুতুল পুতুল চেহারা, যেমন রং করা পুতুল হয়, ফোলানো ফোলানো লাল লাল ঠোঁট, আঁকা চোখ ভুরু। আস্তে আস্তে চোখের পাতা তুলে চায়, ঠোঁটের কোণে টিপে টিপে হাসে, সবাইকে হাত ধরে কাছে টেনে বসায়–মানে রঞ্জনের বন্ধুদের। মা তো! কিন্তু সবাই, রঞ্জনের অনেক বন্ধুরাই জানে, ওর মা আমাদের বয়সি ছেলে ছাড়া কারুর সঙ্গে মেশে না। যেমন মিহির, মিহিরের সঙ্গে ওর মার খুব বন্ধুত্ব। রঞ্জনের মায়ের সঙ্গে মিহিরের কাহিনী, মিহির আমাকে নিজেই বলেছে। তাতেই অনুমান করতে পেরেছি সামনে যেরকম থাকে ওর মা, আধ-বোজা চোখে ঢুলুঢুলু তাকানো, ঠোঁটের কোণ টিপে মিটি মিটি হাসি, ওটা সবটাই, অনেকটা মাকড়ির শিকারের মতো। মাকড়ি যেমন মাকড়সাটাকে আস্তে আস্তে ধরে, জড়ায়, তারপরে ধীরে ধীরে দাঁড়া দিয়ে চেপে ধরে গিলতে থাকে, প্রথম ভাবটা আসলে সেইরকম। এসো। বসো। কী খাবে?যেও খনি, তাড়া কীসের? ওরকম কথা বলে, আর আস্তে বড় বড় চোখের পাতা, একটু একটু করে অনেকটা খুলতে থাকে। চিড়িয়াখানায় কুমিরের চোখই ওরকম দেখেছি। ড্রিংকসও অফার করে রঞ্জনের মা। কিন্তু তারপরে, বন্ধ ঘরে, চেহারা আলাদা। নীতিশই ভাল বলে। রঞ্জনের মায়ের আর এক প্রেমিক-প্রেমিক! ইচ্ছে করছে, এখুনি বমি করে ফেলি। নীতিশ বলে, সত্যি, এত যত্ন করে!
কথাটা শুনে, আমার কানের মধ্যে কেমন ঝাঝা করছিল, অপিচ এ কর্ণ কোনও বাক্যেই ঝাঝা করিবার নহে, তবু করেছিল। কেন, তা আমি জানি না। অনেক খারাপ কথা, লোকে যাকে খারাপ বলে, কারণ লোকেদের নাকি সত্যি খারাপ বোধ আছে, যে কারণে লোকেরা যা বলছে, যা করছে, সবই ভাল, সেরকম খারাপ অনেক কথাতেই, আমার কিছু যায় আসে না। আসলে, সবাই তো খুব ভাল ভাল কথাই বলছে, ভাল ভাল ভাল ভাল, আর আমার যেন অনেকটা সেই, টাকা মাটি মাটি টাকা, সব একাকার হয়ে গিয়েছে, মানে সব টাকা হয়ে গিয়েছে। টাকা তো খারাপ, যে কারণে বলে, অর্থই অনর্থ, টাকাকে যেন মাটি জ্ঞান করি, সবাই তো তাই ভাল কথায় মাটি মাটি করছে, আর টাকাটা কোন লকারে রাখছে বাছাধনেরা, সেটা তাদের তলপেটের ঘুনসির চাবিটি ছাড়া, কোনও ঠাকুর জানতে পারছে না।
কিন্তু এ কথা যাক, আমি নীতিশের কথা শুনতে পারিনি, নিজের থেকে শুনতেও চাইনি, আমার কোথায় একটা গোলমাল হয়ে যায়, যে কারণে, বন্ধুরা আমাকে টিটকারি দেয়। দিতেই পারে, যেহেতু কত কথাই তো আমরা বলাবলি করি, মেয়েদের শরীরের তলা-ওপর নিয়ে বিশদ আলোচনা, অভিজ্ঞতা, ব্যাখ্যা ইত্যাদি অনেক কিছুই, তবু আমি শুনতে চাইনি। আমার ভাল লাগে না, কী হয়, তা আমি বোঝাতে পারি না। সেটা যে একটা খারাপ লাগা কিছু, যেমন অনেক কিছুই খারাপ লাগে, তা না। তার চেয়ে অন্যরকম কিছু একটা হয় আমার মধ্যে–সেটা কোনওরকম ঘৃণা বা ভয় কিনা, বুঝতে পারি না। রঞ্জনের মায়ের সঙ্গে, মিহিরের কাহিনীও আমি শুনতে চাইনি, ভাল লাগেনি, তথাপি, মিহিরের বেলায় আমার কেমন যেন মনে হচ্ছিল, খাপছাড়াভাবে শোনবার একটা ইচ্ছাও হয়েছিল। আমি আমার, এ ধরনের মনোভাবের কোনও অর্থ বুঝি না, এই না না করে, জোরে ঘণ্টা বাজছে, অথচ কোথায় যেন হ্যাঁ হ্যাঁ করে টিক টিক করে চলছে। এরকম কথা শুনলে, আমার কোনও বন্ধুই বিশ্বাস করবে না, যা তা খিস্তি করে উঠবে, ঘুঘু বা শালা বা খচ্চর ইত্যাদি কোনও গালাগালই না, আর বেশি কিছু বলবে, আর সত্যি বলতে কী এরকম মনের অবস্থায়, আমার নিজেকেই ন্যাকা বা উল্লুক বলতে ইচ্ছা করে। মিহিরের কথা শোনবার সময় আমার সেই রকমই হয়েছিল। আর ওর কথা শুনে আমার মনে হয়েছিল, মাঝ বয়সি পুরুষেরা যেমন ছোট ছেলেদের ধরে নিজের কাজ কাজ। এইরূপ কর্মকে যদি কাজ বলে, তবে অন্যান্য কর্মকে কী বলিতে হইবেবরং নিজের হানিটি মিটিয়ে নেয় রঞ্জনের মাও যেন সেই রকমের। অনেকটা হোমোদের মতে, হোমোসেসুয়াল যাদের বলে, রঞ্জনের মায়ের ব্যাপারটা সেই রকম আমার মনে হয়েছিল। একটি ছোকরাকে বেশ খাইয়ে দাইয়ে, আদর আপ্যায়ন করে, বেশ কৌশল করিয়া আপন অঙ্গ সেবায় প্ররোচিত ও রত করিয়া থাকে। এরকম ক্ষেত্রে, যতই মাথায় বয়েজকাট চুল থাকুক, রং-টং মাখা থাকুক, বগলের এ বয়সে যে রকম ভাঁজ পড়ে আর অস্বাভাবিক রংয়ের থ্যাতলানো মাংসের মতো মনে হয়, এবং তার অঙ্গের বহু স্থলেই ওই প্রকার অবস্থা প্রাপ্ত হইয়াছে সন্দেহ নাই, এই রূপ দেখিয়ে আর হেসে, ছেলের বয়সি ছেলেদের চোখে নেশা ধরানো যায় না। অবিশ্যি যদি কোনও ছেলে নেহাত হাভাতে না হয়, মেয়ে তা সে যেমন তোক হলেই হল বা যে সব ছেলে–আমাদের বন্ধু অনাথের মতো ছেলে যদি হয়, ছিপছিপে ফরসা পবিত্র মুখ অনাথ, মোটা কাচের চশমা চোখে, ফাঁপানো চুলগুলোও সিঁথি কাটা সুন্দর, কথা বলে মিনমিন করে, ভাবসাব বেশ গম্ভীর, উহ্ ও একটা টেরর! আমাদের কোনও বন্ধুই একটু বেশি গা বা উরত ঘেঁষাঘেষি করে ওর সঙ্গে বসতে পারে না। ওর সঙ্গে এক বিছানায় রাত্রিবাস, সে তত ভয়ংকর ব্যাপার। অনাথের সে আর এক রূপ, সত্যি অনাথ, কেঁদেকেটে হাতে পায়ে ধরে, রীতিমতো একটা ঘটনা করে ছেড়ে দেবে। এ সব নিশ্চয়ই খুব ছেলেবেলা থেকে হোমোবুড়োদের শিকার হয়ে হয়ে এখন শিকার হওয়াতেই অনাথের সুখ। সেই রকম কোনও ছেলে যদি, রঞ্জনের মায়ের বয়সি মহিলা না হলে প্রেমের-প্রেম! তার নেশা না ধরে, তাদের কথা আলাদা। তাদের কাছে তরুণী তন্বী যৌবন যুবতী, ও সব কোনও ব্যাপারই নয়। আমাদের এক আত্মীয়ের কথা জানি, এখন তাঁর বয়স প্রায় চল্লিশ–তাঁর মাসির বয়স পঞ্চান্ন-ষাটের কাছাকাছি নিশ্চয় কিন্তু বোন পো-টি চিরদিন মাসিমার খাট আঁকড়ে ধরে পড়ে রইলেন অথচ যাকে বলে সত্যি সুন্দরী আর শিক্ষিতা মেয়ের সঙ্গে তার বিয়েও দেওয়া হয়েছিল, অপিচ সেই ব্যয়রাম ঘুচিবার নহে, তাই সেই শিক্ষিতা সুন্দরীকে অন্যত্র নিজের ব্যবস্থা দেখতে হয়েছে। তা তিনি দেখুন গিয়ে, কিন্তু
যাক গে, মিহির অবিশ্যি আমাকে বলেছিল, ও স্রেফ টাকার জন্যে রঞ্জনের মায়ের প্রেমিক হয়ে আছে। প্রায়ই নাকি বেশ কিছু টাকা পেটানো যাচ্ছেটাকা–সেই জন্যেই কী জানি, আমি ঠিক যেন বিশ্বাস করতে পারি না, কিন্তু রঞ্জনের মা আমাকে, মনে মনে, কেমন যেন ডিসটার্ব করে। আমার ভাল লাগেনি এ সব কথা শুনতে যদিচ নীতিশের কথা বাদ, ও অনেকটা সত্যিকারের হাভাতের মতোই, মিহিরের কথা শোনবার একটা কী রকম কৌতূহল ছিল আমার, অনিচ্ছায়, তবুও এবং আমার ভাল না লাগা বা মনে মনে যে এক ধরনের অস্বস্তি–তার চেয়ে বেশি, একটা অশান্তি, এ সবের মধ্যেই, সেই কৌতূহলের ব্যাপারটার কোনও যোগাযোগ ছিল নাকি। জানি না। তবে এ বিষয়ে রঞ্জনের মনের কথাটা জানবার ইচ্ছা হয়, কিন্তু কোনওদিনই আমি জিজ্ঞেস করতে পারিনি, যদিচ রঞ্জনের দিকে তাকালে, একটা জিজ্ঞাসা বোধহয় আমার চোখে ফুটে ওঠে। আমার সেই চোখের দিকে, রঞ্জন কি আমার জিজ্ঞাসাটা পড়তে পারে। কেন না, আমার সেই চোখের দিকে তাকালেই, রঞ্জনের চোখের পাতা দুটো কেমন কুঁচকে যায়, আর রাগে ঘৃণায় যেমন চোখ জ্বলে ওঠে, সেই রকম জ্বলে ওঠে। তাতে, বরাবরই মনে হয়েছে, ওর সঙ্গে আমার কোথায় একটা ভিতরে ভিতরে ঠাণ্ডা যুদ্ধ চলছে। যে যুদ্ধের কী পরিণাম, জানি না। যেদিন ওর সঙ্গে আমার ফ্রিস্টাইল পাঞ্জা হয়েছিল, চলতি কথায় ওটাকে হাত্তা লড়া বলে, সেদিন আসলে কথায় কথায় এমনি একটা বাজি হয়েছিল। হাতে হাত দিয়ে, ওর চোখের দিকে তাকাতেই হঠাৎ সেই জিজ্ঞাসাটা যেন আমার চোখে জেগে উঠেছিল। রঞ্জনের চোখেও, রাগ আর ঘৃণা জ্বলে উঠেছিল। আমি শক্ত হবার জন্যে ঠোঁটে ঠোঁট টিপেছিলাম, আর রঞ্জন মুখটা ভয়ংকর করে জিজ্ঞেস করেছিল, হাসছিস? আমি পাঞ্জার মধ্যেই অবাক হয়েছিলাম বলেছিলাম, না তো।ও আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি, কিন্তু হাসির কথা জিজ্ঞেস করেছিল কেন। আমার কি ঠোঁটটা বাঁকা দেখাচ্ছিল। দেখাতেও পারে অসম্ভব না, তবে আমার হাতটা যেন ও মড়মড় করে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চাইছিল। রোগা রোগা শরীরে, সেই কী বলে, ওর যেন দধীচির হাড়। উহ্, ইম্পসিব! রঞ্জনের চোখে রাগ আর ঘৃণা, ও আমার ঠিক চোখের তারায় তারায় তাকিয়েছিল, ওর সাঁড়াশির মতো হাত থেকে যেন একটা তীব্র যন্ত্রণা, কলকল করে নেমে এসে, আমার হাতটাকে অবশ করে দিচ্ছিল। আমি প্রাণপণ করে, দাঁতে দাঁত চেপে প্রায় চোখ বুজে হাত সোজা রাখবার চেষ্টা করছিলাম। ওর মতো আমার রাগ হয়নি, ও যেন একটা ভয়ংকর প্রতিশোধ নেবার মতো শেষ পর্যন্ত আমার হাতটাকে বেঁকিয়ে, কনুই সুদ্ধ মুচড়ে দিয়েছিল। যন্ত্রণায় আমার গলা দিয়ে শব্দ বেরিয়ে আসতে চাইছিল, তবু আমি কোনও শব্দ করিনি। যে সব বন্ধুরা দাঁড়িয়ে দেখছিল, তারাই বলে উঠেছিল, রঞ্জন ছেড়ে দে, ও হেরে গেছে। তথাপি যেন রঞ্জনের ছাড়বার ইচ্ছা ছিল না, ও আমার হেরে যাওয়া যন্ত্রণাকাতর মুখটার দিকে কেমন একটা সন্দেহের চোখে তাকিয়েছিল। আমার মুখটা যে তখন কী বিশ্রী দেখতে হয়েছিল, তা আমিই জানি। রঞ্জন ঝটকা দিয়ে, এক টানে ওর হাতটা ছাড়িয়ে নিয়েছিল, ভেবেছিল ও হাত নরম করলেই যদি আমি আবার শক্ত করে চেপে ধরি। রঞ্জন ওর হাতটা রুমাল দিয়ে মুছে নিয়েছিল বা মাসেজ করেছিল, লেগেছিল তো ঠিকই, আর যেন গর গর করে বলেছিল, চল বিয়ার খাওয়াবি।অনাথ তাড়াতাড়ি আমার দিকে এগিয়ে এসে, হাতটা ধরতে চাইছিল, মাসেজ করে দেবে বলে, কিন্তু আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল ভাগ শালা বানচোত! শুনে সবাই হেসে উঠেছিল, আর অনাথ ওর সেই পবিত্র মুখটি নিয়েই মোটা কাচের আড়ালে, যেন অনেকটা স্নেহশীলা মায়ের মতো আমার দিকে তাকিয়েছিল, বলেছিল দিস ইজ সিম্পলি বুর্জোয়া এন্টারটেনমেন্ট। এ ধরনের বাজি…।ওর কথা শেষ হবার আগেই, নীতিশ বলেছিল, লাও, অনাথিনী আবার কোথা থেকে বুর্জোয়া এন্টারটেনমেন্ট নিয়ে এল। বিপ্লব বলেছিল, একদিক অবিশ্যি ভেবে দেখতে গেলে…।আমি আর ওদের কথায় কান দিইনি আসছি বলে বাথরুম চলে গিয়েছিলাম, আর হাত দুটো বগলে চেপে আস্তে আস্তে চাপ দিয়েছিলাম, যন্ত্রণায় আমার প্রায় কান্না পাচ্ছিল। তারপর রঞ্জনকে বিয়র খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিলাম, আমিও খেয়েছিলাম, অনাথনীতিশ বিপ্লবও ছিল। রাত্রে, ঘরে ফিরে, আয়নার দিকে তাকিয়ে, রঞ্জনের মুখটা মনে করে, মনে মনে ফুঁসে উঠেছিলাম শুয়োরের বাচ্ছা! কিন্তু তারপরেই ভুরু কুঁচকে নিজের দিকে তাকিয়ে বলে উঠেছিলাম, তুই তো একটা কুত্তার বাচ্ছা!..অবিশ্যি, এই পাঞ্জা লড়ার জন্যে, রঞ্জনের সঙ্গে যে চোখে চোখে চেয়ে, ভিতরে ভিতরে একটা যেন ঠাণ্ডা যুদ্ধ চলছিল বলে আমার ধারণা, তার কোনও নিষ্পত্তি হয়নি।
কিন্তু এখন–এখন আমার হাতটা, আঙুলগুলো ঠিক সেই রকম ব্যথা করছে কেন। যেন আঙুলগুলো কিছুতেই সোজা করতে পারছি না, বগলে চেপে আস্তে আস্তে চাপ দিয়ে সোজা করে নেব নাকি। অসম্ভব। শীতের দিনের মতো, বুকের ওপর আড়াআড়ি হাত রেখে, বগলে হাতের তালু চাপা, এই দারুণ গরমে পারব না। বুকটাই জ্বলে যাবে।
কিন্তু কেন এত ব্যথা কীসের। হাতে দাঁতে সারা গায়ে। এত ব্যথা, অথচ কুস্তি তো লড়িনি। তার সঙ্গে, নিশ্বাসের কষ্ট, যেন ফুসফুঁসে হাওয়া নেওয়া যাচ্ছে না। এমনকী, পাঁজরার কাছে আর তলপেটে যেন ব্যথা করছে। সকাল থেকে কোনও ব্যথাই ছিল না। এটা কি হঠাৎ হল। কখন থেকে হল, কিছুই মনে পড়ছে না। এখন এই যে সময়টা, রাস্তায়, এই ভয়ংকর গরগর করা জ্বলন্ত রোদে, এই মুহূর্তটা ছাড়া, আমার যেন পিছনে কিছুই নেই। আমি যেন শুধুমাত্র এই মুহূর্তেই আছি, এর পরের মুহূর্তের কথাও আমি কিছুই জানি না, বুঝতে পারছি না, একটা ট্যাক্সি পাওয়ার কথা ছাড়া। পিছনের যা কিছু চিন্তা, সবই যেন বহু দিনের পুরনো, যেমন লোকে বলে, আগের জন্মের কথা, সেই রকম মনে হচ্ছে। দেখো বাবা, আবার জাতিস্মর না হয়ে যাই, এ দেশে আবার ওটা বড় হয়। কিন্তু আমি যেন এই মুহূর্তেই পৃথিবীতে, কলকাতার এই রাস্তাটায় এসে পড়লাম। এখন একটা ট্যাক্সি, তা যতক্ষণ না আসছে, তখন এই দারুণ রোদে, পিচ টগবগানো রাস্তা বা গরম তাওয়ার মতো ফুটপাতে আমি শুধু এই ব্যথাটাই বোধ করছি, এবং চোখে শুধু রোদ দেখছি, যে-রোদ আমার চোখে, আমার জামার ভিতর দিয়ে চামড়ায় ঢুকে জ্বালিয়ে দিচ্ছে।
কী আসছে একটা গোঁ গোঁ করে, ট্যাক্সি! না, গোঁ গোঁ করে, শুয়োরের গোঁয়ের মতো একটা লরি, তলতলে বুড়ো শরীরের চামড়ার মতো পিচের রাস্তা দিয়ে একটা চ্যাটচ্যাট শব্দ করে চলে গেল। একটা ট্যাক্সি, তা না হলে, আমাকে বোধ হয়–আচ্ছা, কোথা থেকে এলাম এখন। পাটা তুলতে পারলে, নিজের মুখেই একটা লাথি মারতাম। আমি ঠিক কিছুই মনে করতে পারছি না কেন। মুখে সেই দুর্গন্ধটা লাগছে। আমি গোটা মুখটাকে চুষে, গলার কাছ থেকে সব তুলে নিয়ে, ফুটপাতের ওপর ফেললাম, আর আমার ঝাপসা চোখেই যেন মনে হল, থুথুতে খানিকটা রক্তও রয়েছে। পাইয়োরিয়া! থাইসিসের কথা আমার মনে আসে না। কেন না, থাইসিসের রক্তে থুথুতে ওরকম দুর্গন্ধ আছে কি না, আমার জানা নেই। পাইয়োরিয়াতে আছে জানি, আর রত্নার অভিশাপে–হ্যাঁ ও আমাকে নিশ্চয় মনে মনে অনেক অভিশাপ দিয়েছে, এবং অন্য সময় বিশ্বাস করি বা না করি, এ ক্ষেত্রে আমার মনে হবে, সেই পাইয়োরিয়াওয়ালিটার অভিশাপেই আমারও হয়েছে। পাইয়োরিয়া থাকলে দাঁত দিয়ে অনেক সময়েই রক্ত বেরোয়, আর সেই রক্তটাই পচে বোধ হয় পুঁজ হয়। কিন্তু, আমি তো এরকম রক্ত পড়তে দেখিনি দাঁত দিয়ে। মাঝে মধ্যে একেবারেই যে পড়ে না, তা নয়, খুব কম।
আবার থুথু ফেললাম, কপালে হাত রেখে চোখ ঢাকা দিয়ে ভাল করে দেখতে চাইলাম, হ্যাঁ রক্ত খানিকটা আছে। আবার আর এক জায়গায় ফেললাম, তেমন টের পাওয়া গেল না, গলাটাকে কাঠ করে দিয়ে, চুষে চুষে আবার ফেললাম, আবার একটু দেখা গেল, তারপরে এক ফোঁটা থুথুও আর মুখে নেই, এখন যে ফেলে দেখব, বরং এই দারুণ জঘন্য রোদে, গলাটা কাঠ হয়ে গিয়ে, কষ্ট হতে লাগল। ভয় পেলাম যদি তৃষ্ণা লাগে, তা হলে, এই যে রাস্তা, দরজা জানলা বন্ধ বাড়ি, সব মিলিয়ে একটা ফার্নের্স, এখানে কোথাও এক ফোঁটা জল পাব না। তার চেয়ে একটা ট্যাক্সি যদি–এ পথে কি ট্যাক্সি নেই। বারণ আছে নাকি।
আমি ডান দিকের ভুরুর কাছে হাত দিলাম। কিছুক্ষণ থেকেই মনে হচ্ছিল যেন, ওখানে কী রকম টনটনে ব্যথা করছে। মাঝে মাঝে আবার দপ দপ করে উঠছিল। আমি ধরেই নিয়েছিলাম, আমার অর্ধেকটা মাথা রয়েছে, ব্যথাটা তারই। কিন্তু ব্যথাটা, ডান ভুরুর কোণ থেকে কোথাও নড়ছে না দেখে, হাত দিলাম। আর ঠিক মনে হল, বেশ একটা গোলগাল আবের মতো লাগছে। আমার আবার ভুরুর ওপরে আব হল কবে। নাকি ফোঁড়া হয়েছে। আঙুল দিয়ে টিপতেই আমার গলা দিয়ে শব্দ বেরিয়ে এল, আক।
সত্যি, অসহ্য যন্ত্রণা। এ নিশ্চয় আব নয় টিউমার জাতীয় যাকে বলে, যেগুলো অনেক সময় ক্যান্সারও হতে পারে। সে সব কিছুই নয়, বেশ বুঝতে পারছি, আমার কোনওরকম আঘাত লেগেছে, তাই ফুলে উঠেছে। এটা আবার কখন হল, কিছুই মনে করতে পারছি না। মুরদাবাদ আমাকে, মুরদাবাদ শালা। কিন্তু সত্যি, কখন কোথায় লাগল, আমার মনেই পড়ছে না। আমাকে মুরদাবাদ। আমাকে মুরদাবাদ! ঠিক শ্লোগানের মতো বলতে ইচ্ছে করছে আমার। হাত দিয়ে তো মনে হচ্ছে, এত ব্যথা যে, সদ্য সদ্যই লেগেছে, তাই ফুলে উঠেছে, জায়গাটা গরমও সেই রকম। কোথায় ঠুকে গেল, এই রাস্তার কোনও পোস্টেই নাকি। মনে পড়ছে না। এখন তো ড্রিংকও করিনি–মদিরা পান যাহাকে বলে, তবে এ কীসের খোয়ারি ভাঙতে হচ্ছে বুঝতে পারছি না।
আমাকে ধরে কেউ মারধোর করেনি তো। কীসের শব্দ হল। আর ঠুন ঠুন ঠুন ঠুন, একটা রিকশাওয়ালা। রিকশাওয়ালাটা মাথায় মুখে এমন করে গামছা বেঁধেছে, খালি ওর চোখ দুটোই দেখা যাচ্ছে। বোধহয় গামছাটা ভেজানো, আর সেই চোখ দিয়ে আমার দিকে দু-একবার দেখল। ভাড়া নেবার কোনও ইচ্ছাই ওর নেই, সেটা বোঝা গেল, আসলে আমার দিকে তাকাবার উদ্দেশ্য বোধহয় এই যে, পাছে আমি ওকে ডেকে ফেলি। এই ফাঁকা খালি রাস্তায় ভয়ংকর রোদে, ওকে যেন মোটেই হাঁপিয়ে পড়া মনে হচ্ছে না, বরং গামছা দিয়ে মাথা মুখ ঢাকা, শুধু চোখ দুটো বের করে রাখায় ওকে কেমন নিষ্ঠুর, আর মুখোশ আঁটা শয়তানের মতো দেখাচ্ছে। অথবা, ও যেন কেমন একটা রাগি আর সন্দেহের চোখে, আমার দিকে তাকিয়ে দেখে গেল। এই সময়ে, ফুটপাতের ধারে, আমার দু-তিন হাত দূরেই একটা কাক, কা কা করে ডেকে উঠল। বোধহয় কিছু একটা খাচ্ছিল, মরা ইঁদুর বা পচা কিছু। আমাকে দেখে, আমার দিকে তাকিয়ে ডেকে উঠল, ওড়বার জন্য প্রস্তুত হয়ে, ডাকতেই লাগল। ওই রিকশাওয়ালাটার মুখ, কালচে কালচে রিকশাটা, কাকের ডেকে ওঠা, সব মিলিয়ে আমার কেমন যেন অস্বস্তি হল। এরকম বেপরোয়া ভাব কেন রিকশাওয়ালাটার। আমি কিছুতেই রিকশায় উঠতাম না। অথচ এমন একটা ভাব যেন, ডাকলেও থামত না। আসলে ও যেন রিকশাওয়ালাই নয়, রিকশাওয়ালার ছদ্মবেশ মাত্র। তাতে আমার কী, ও যে-ই হোক। হ্যাঁ, ঠিকই, তবু একটা অস্বস্তি হল আমার। একটা ট্যাক্সি কোথাও কি।
কপালটা সত্যি ব্যথা করছে। সত্যি আমাকে কেউ ধরে মারেনি তো। কিছুই মনে করতে পারছি না। এরকমভাবে ভুরু ফুলে যাওয়া মার একবারই আমাকে পুলিশ মেরেছিল কয়েক বছর আগে। অমন বেধড়ক মার আমাকে কেউ কখনও মারেনি, অবিশ্যি আমাকে একলা নয়, আরও কয়েকজন আমার সঙ্গে ছিল, একশো চুয়াল্লিশ ধারা অমান্য করে, যখন আমাদের মিছিলটা এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন প্রথম উসকানিটা পুলিশের দিক থেকেই এসেছিল, কারণ, টিয়ারগ্যাস ছুঁড়েছিল ওরা। এসপ্লানেডের কাছাকাছি আসতেই, প্রথম কয়েকটা শব্দ হয়েছিল, আশেপাশের বড় বড় বাড়িগুলোর দেওয়ালে শব্দগুলো প্রতিধ্বনিত হয়েছিল। আর কে যেন আমাদের কাছাকাছি জায়গা থেকে চিৎকার করে উঠেছিল। ওরা ফায়ার করছে।তখন আমি এতটা বুঝতাম না, কোনটা রাইফেলের শব্দ, কোনটা টিয়ার গ্যাসের শব্দ, এখন যেমন বুঝি, এবং যদিচ প্রকাণ্ড বড় মিছিলটা সেন্ট্রাল অ্যাভিন্যু দিয়ে যখন এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন আমরা বেশ জোরের সঙ্গেই শ্লোগান দিচ্ছিলাম বা কখনও কখনও দিচ্ছিলাম না, দু-চারটে অন্যান্য কথাও বলছিলাম, কিংবা অন্যান্য ছেলেদের কথাও কানে ঢুকছিল, মাইরি বলছি, দু পিস পাঁউরুটি ছাড়া কিছু খাইনি।.বা, দে না একটা সিগারেট, এটা নিয়ে তিনটে তোর পাওনা হবে, পরে ফিরিয়ে দেব।…আমিও সিগারেট খাচ্ছিলাম মাঝে মাঝে, যেটা অনেকের অপছন্দ, মিছিলে সিগারেট খাওয়া বিশেষ ছাত্র মিছিলে, বিপ্লবের তো খুবই অপছন্দ, যদিচ এর কোনও অর্থ খুঁজে পাই না। যেন ভাবটা হচ্ছে, আমরা ছাত্র, আমরা তরুণ, আমাদের সকলের সামনে সিগারেট খেতে নেই, একটা ইয়ে–মানে ভব্যতা বলে কথা আছে তো। বাপের বয়সি কত লোকেরা রাস্তার চারপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে, আহা, ইহাকে বলে প্রচলিত মূল্যবোধ! যে মূল্যবোধের মুণ্ডু উহারা আমরা সকলেই চিবাইতেছি, পথে ঘাটে সর্বত্র, হোটেলে রেস্তোরাঁয়, সিনেমায়, অন্যান্য জায়গার কথা আর না-ই বললাম, তখন মিছিলে আমাদের প্রমাণ করতে হবে আমরা বড় সুবোধ বালক, থিগালে খেতে থিকিনি। মুখে দুধের গন্ধ, যেন আমরা যা, আমরা আর তা নই, এখন আমরা মিছিলে সামিল হয়েছি। কেন, এটা নিশ্চয়ই কোনওরকম অভিনয়ের ব্যাপার নয়, স্বাভাবিকভাবে আমরা যেরকম চলি ফিরি, সেরকম ভাবেই চললে ক্ষতি কী, তাতে আসল ব্যাপারটা নষ্ট হবার কিছু নেই। অবিশ্যি, ও সব কথা কেউ-ই মানে না, যারা সিগারেট খায়, আর সিগারেটের নেশা ধরলে, খায় ঠিকই। হয়ত, ছাতা হাতে একজন পিতৃপ্রতিম দর্শক তখন ফুটপাতে দাঁড়িয়ে, আমাদের মনে মনে গালাগাল দেয়, বজ্জাত বখাটে ছেলের দল, লেখাপড়ার নামে নেই, চললেন এখন পুলিশের সঙ্গে মারামারি করতে, আর বাপের পয়সার ছেরাদ্দ! এর নাম আন্দোলন, সিগারেট টানতে টানতে চলেছেন…।সিগারেট খেতে না দেখলে হয়তো পিতৃপ্রতিমের, আহা, পিতার মতন, ব্যক্তিটির এত কথা মনে হত না। অনেকটা বিপ্লবের বাবার মতোই বলতে হবে, এত যে বেশ বেশ, তোমরাই তো… ছোটান, তিনি দেখলেও এরকম কথাই। ভাবতেন। হয় উপদেশ না হয় নিষেধ, কিন্তু পিতৃপ্রতিম, আমরা আপনার ছেলে নেই, নিজের ছেলে হলে না হয় একটা কথা ছিল, আসলে, আপনার নিজের ছেলেটির কথাই মনে পড়ছে, এবং সমস্ত তরুণবৃন্দ আপনার সন্তানবৎ, অতএব সেই অনুভূতিবশত একটি গভীর দায়িত্ববোধের যাতনায় আপনার চিত্ত ব্যথিত হইতেছে, মরিয়া যাই! ইহাই কি আপনার বিশ্বাস। সেই ব্যথার চেহারাই বুঝি গোটা সমাজে আপনারা ফুটিয়ে তুলেছেন, আর আমরা সেই সমাজেরই ছেলেরা, সমাজের চেহারা দেখে, প্রকৃতই চমৎকৃত বোধ করিতেছি।….
যাই হোক, শ্লোগান ছাড়া, আমরা মাঝে মাঝে অন্যান্য কথাও বলছিলাম, সিগারেট খাচ্ছিলাম। একশো চুয়াল্লিশ ধারা ভেঙে, আমরা ময়দানে যাচ্ছিলাম, এবং আমাদের মনে কোনও সন্দেহ ছিল না যে, আমরা যাবই, যদিচ, একটা সন্দেহ, সকলের মধ্যেই কম বেশি ছিল, পুলিশ আমাদের বাধা দিতে পারে আর দিলে, সে বাধা আমরা মানব না। কোনও ভয়, আমাদের–আমার, মনে ছিল না, বেশ তরতরিয়ে যাচ্ছিলাম।
আমি যে কেন যাচ্ছিলাম, সেটা আমি যেন ঠিক জানতাম না। বন্ধুদের ভাষায় বলতে হয়, এ আবার আমার সেই, ফেরোজি, আমি কিছুই জানি না। কিন্তু সত্যি বলতে কী, বিপ্লবের মতো কি আমার মনে কোনও বিশ্বাস ছিল, যে সব নীতি বা তত্ত্বের কথা ওরা বলে, কিংবা রুদ্র যে সব কথা বলেও আবার বিপ্লবেরও বড় নেতা, রুদ্রনারায়ণ, আমার তো ওকে কেমন চালাক আর চালবাজ বলে মনে হয়, ও আবার বিপ্লবের মতো ঠিক গম্ভীরভাবে চিবিয়ে চিবিয়ে ভারী ভারী কথা বলে না, ও অনেকটা–কী বলব যেন একটা বিশেষ রোল অভিনয় করছে। হয়তো আমরা সবাই তাই করছি, এক এক সময় আমার তাই মনে হয়, কিন্তু সেটা জেনেশুনে করছি বলে মনে হয় না। নিজের ব্যবহারে, কথাবার্তায়, আচরণে, নিজেরই এক এক সময় এমন অদ্ভুত লাগে, তখন এই কথা মনে হয়। রুদ্র তা না, ও যেন একটা রোমাঞ্চকর উপন্যাসের রোমান্টিক নায়কের মতে, কপালের ওপর ঝাপানো চুল, তার ছায়া পড়ে চোখের ওপরে, জ্বলজ্বলে খুশি-চতুর বেড়ালের মতো, খুশি আর চতুর অন্য কোনও জীব আমি দেখিনি, হয়তো তাদের মতোও হতে পারে, সেইরকম খুশি জ্বলজ্বলে চোখের ওপরে ছায়া। আর ফরসা মুখটা সত্যি বেশ চোখা চোখা, রোখারোখা ভাব তো এমনিতেই আছে। দারুণ কথা বলতে পারে, ভীষণ তাড়াতাড়ি, কিন্তু প্রত্যেকটা কথার মধ্যেই যেন, কখনও চড়া, কখনও নরম সুর, ঝলকে ওঠে রাগে, আবার কষ্টে, কেমন দুঃখী দুঃখী ভাব, আর এমন সব কথা বলে, যেগুলো খুব ভাবনা চিন্তা না থাকলে বলা যায় না, যাকে বলে প্রকৃত রাজনৈতিক জ্ঞানসম্পন্ন, সেইরকম ছেলেই ওকে বলতে হয় বোধহয়, আর খুব পড়াশুনো আছে বলে মনে হয়। ওকে বোধ হয়, আমি ঈর্ষা করি না, এখন মনে হয় করতাম, কারণ ওর মতো ছেলেকে ঈর্ষা করবার অনেক কারণ থাকতে পারে আমার মতো ছেলের। রুদ্রর কোনও গুণই–চেহারায় জ্ঞানে, আমার ছিল না, সেজন্যে ওকে মনে মনে ঈর্ষা করাটা আমার পক্ষে কোনও আশ্চর্যের ব্যাপার ছিল না। যে কারণে ওকে চালাক চালবাজ ভাবতাম, কিন্তু এখন আর সে মনটা আমার নেই, আমার মনের মধ্যে এখন ও একটা গোলমাল লাগিয়ে দিয়েছে, যে কারণে আমি ঠিক করেছি ওর সঙ্গে আমি একটা বোঝাপড়া করব এবং আজ এখন সেই কথাটা আরও বেশি করে আমার মনে হচ্ছে, ওর সঙ্গে আমার একটা বোঝাপড়ার দরকার।
আমি সেই কয়েক বছর আগের কথাই বলছি, সেই মিছিলের সময়ের কথা, ওরা যেমন কতগুলো বিশ্বাসের কথা বলত, সবকিছুর পিছনেই একটা কজ–গ্রেট কজ, পেট্রোয়টিক, রেভ্যুলুশনারি, শিক্ষাক্ষেত্রের বিষয় পেরিয়ে অন্য কোনও রাজনৈতিক কারণের প্রতিবাদেও, আমরা গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ব, লড়ব, সত্যি কথা বলতে কী, আমি ওদের মতো ওরকম ভেবে যে ঝাঁপিয়ে পড়তাম, তা নয়। নিজেকে ফাঁকি দিয়ে তো কোনও লাভ নেই, আমার কাছে ব্যাপারগুলো কোনও দিনই ওভাবে আসেনি, আমার ভাবনা চিন্তাগুলো ঠিক ওরকম ছিল না বা নেইও। কিন্তু ঝাঁপিয়ে পড়তে পারলে, আমি ছাড়ি। যে কোনও কারণেই হোক, ঝাঁপিয়ে পড়তে আমি রাজি, কেন না, বেশ বুঝতে পারি, আমার ভিতরে একটা রাগের আগ্নেয়গিরি যেন রয়েছে, একটা ঘৃণার কী বলব, প্রকাণ্ড সমুদ্রের মতো ঘৃণা যেন আমার মধ্যে রয়েছে, আমার মনে হয়, না, ছাড়ব কেন, ঝাঁপিয়ে পড়ব, ভেঙে চুরে মেরে তছনছ করে দেব। তা ছাড়া আমি আর কী করতে পারি, এরকম মনে হয় আমার। একমাত্র এটাই তো করার থাকে শেষ পর্যন্ত, এবং এক এক সময় মনে হয়; যারা নিজেদের মনে করে, তারা শিক্ষাক্ষেত্রের কর্তৃপক্ষ-শাসক, হ্যাঁ ভাইস চ্যান্সেলরদের ইউনিভার্সিটির উপযুক্ত শাসক বলে উল্লেখ করতে দেখেছি আমি খবরের কাগজে, এইসব শাসক, রাষ্ট্রের শাসক পরিবারের শাসক-পিতৃদেব বা আর কেউ, এক এক সময় মনে হয়, সবাই মিলে আমাকে যেন এদিকেই ঠেলে দেয়। আমি বিপ্লবদের মতো অতশত বুঝি না। যেমন বিপ্লব ভাবে, ও নেতৃত্ব করছে, ও একটা কারণের জন্য লড়ছে, ও একটা খুব সিগনিফিকেন্ট ফিগার একজন বিশিষ্ট ছেলে, আমি একটা উল্লুক, সেরকম কখনওই ঠিক ভাবতে পারি না। আমি কে, কীসেতেই বা আছি, আমাকে দিয়ে কার কী-ই বা প্রয়োজন। আমাকে না হলেও সব কিছুই চলে যাবে, হয়ে যাবে, চলে যাচ্ছে এবং হয়েও যাচ্ছে। আমাকে কোনও কিছুতেই কারুর দরকার নেই, আমাকে বাদ দিয়ে পৃথিবীর সবকিছু চলছে, চলেও যাবে। অথচ, বক্তিমে আর বাণীগুলো বিশ্বাস করলে মনে হবে, আমাকে ছাড়া চলবে না। এই যেমন বলে না, তোমরাই জাতির ভবিষ্যৎ ইত্যাদি, শুনলে এমন হাসি পায় মনে হয় যে বলছে, তার জিভটা জিভছোলা দিয়ে ছুলে দিয়ে আসি, তাতে যদি আসল কথাটা বেরোয়। ওরা যখন এরকম করে বলে তখন বোধহয় নিজেদের মুখগুলো দেখতে পায় না। এদের উচিত, যখনই কিছু বলবে, সামনে একটা আয়না রেখে দেওয়া। আমরা ভবিষ্যৎ, ওরা বর্তমানের যা কিছু, সব নিজেরা তাংড়ে নেব, এটা যে ওদের নিজেদের চালচলনে যাকে বলে জীবনধারণে, সবকিছুতে ফুটে উঠছে সবসময়ে, সবখানে এ বোধগুলো পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু আমাদের মানুষ করার জন্য, কাপড় গুটিয়ে লেগেছে, যেভাবে পারে, ওদের নিজেদের মতে, ওদের ভাবনার ছাঁচে আমাদের মানুষ করে ছাড়বে। আহা, হে পিতৃ পিতামহকুল, আপনারা সকল কিছুর ধারক এবং বাহক, আপনারা কর্তা, নেতা, আপনারা আমাদিগকে শাসন করিবেন, আমরা এখন শুধু শাসিত হইব। আপনারা কৃষ্টি শিল্প সাহিত্য কাব্য সকল কিছুর সমঝদার বিবেচক, উহাতে আমরা কেহ কিছু নাই। শিক্ষার ক্ষেত্রে, আপনাদিগের জ্ঞান তুলনারহিত, আপনারা যেভাবে আমাদিগকে শিক্ষিত হইতে হুকুম করিবেন, বাধ্য করিবেন, আমাদিগকে তদ্রূপ করিতে হইবে। অহো, কী অসীম কৃপা! ঈশ্বরানুভূতি আপনাদের হৃদয়গত, অতএব বাণী বিতরণ এবং আমরা আপনাদের সম্মুখে নিতান্ত অজ্ঞান পাপাত্মা ছাড়া কিছুই নহি। আপনারা নৈবেদ্যের মস্তকোপরি কলাটি কলাটি অবিশ্যিই ঊর্ধ্বমুখী দণ্ডায়মান, নিম্নের কুচো নৈবেদ্যরা আপনাদের দিকে চাহিয়া রহিয়াছেন, আর নৈবেদ্যের থালার বাহিরে, মৃত্তিকায় যে সব অগণিত পিপড়া সকল ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, আমরা তদ্রূপ দৃষ্ট হইতেছি। কিন্তু আপনাদের সকল কেচ্ছা কাহিনী আপনারা কিছুতেই গোপন রাখিতে পারিতেছেন না। সংবাদপত্রে পড়িতেছি, কখনও কখনও, সমাজের অভ্যন্তরে, তাজা রক্তের ভিতর দিয়া সিফিলিসের রক্তের মতো আপনাদের চেহারাগুলি রক্তবর্ণ চাকা চাকা হইয়া ফুটিয়া উঠিতেছে। আপনারা কেহই অপরিচিত নহেন, আপনাদের হাতে প্রচুর শক্তি সঞ্চিত রহিয়াছে, দল-বল এবং অর্থ-বল। তাই আপনাদের অর্থপিপাসা লালসা নহে, গুণীর গুণমূল্য। হর্মতলে আপনাদের রমণীরমণ, মদ্যপান করিয়া র্যালা, তাহা ঋষিদিগের সোমরস পানতুল্য, ফেরেববাজি দুর্নীতিমানের মহকীর্তি। অদ্য দ্বিপ্রহরে যিনি, তাবত অধিবাসীদের জন্য নির্দেশ পালনের বিজ্ঞাপনটি সহি করিয়া গেলেন রাত্রিশেষে সুরম্য হোটেলের বেয়ারাগণ তাহার বমনলাঞ্ছিত শরীরটি কোলা ব্যাঙ-এর মতো পাঁজাকোলা করিয়া গাড়িতে তুলিয়া দিল। আহা, প্রথম রাত্রে যাহার–মধ্যে ইনি–দ্বারা মত্তভাবে প্রহার করিয়াছিলেন এই গতরে আর তাহা সম্ভব কি না জানি না, সেই মুখখানি আগামীকল্য আর স্মরণ করিতে পারিবেন না।….
অহো অহো, চালাইয়া যান, চালাইয়া যান। আমাদের জন্য নিষেধের প্রাচীর তুলিতে থাকুন, পাপের ভয় দেখাইতে থাকুন, ভবিষ্যতের আশার আলো জ্বালিতে থাকুন, আর নিজেদের সবকিছু সামলাইতে থাকুন, তাহা হইলেই বৈতরিণী পার হইয়া যাইবেন। হুররা, হুররা–হুঁই হুইস ইহা হিড়িক নহে, আপনাদিগকে সাধুবাদ জানাইতেছি, চালাইয়া যান, আমাদের সত্য বৈ মিথ্যা বলিতে নিষেধ করুন, সবাইকে বিবেকানন্দ রবীন্দ্রনাথ হইতে বলুন– এরকম লক্ষ লক্ষ হইলে সামলাইতে পারিবেন তো? সে কথা আসে কোথা হইতে, বলিয়া যাইতে হইবে, অতএব চালাইয়া যান, রাজনীতি হইতে দূরে থাকিতে বলুন, ঔর সিনেমা থিয়েটার ছোড়কে, গার্লফ্রেন্ড কে সাথ মিলনা জুলনা ঘুমনা ছোড়কে, ঘর যাকে, মাকে পাস খানা খাকে, বহিনকে সাথ আঁখমিচোলি খেলকে, টাট্রিপিসাব বাগেরা ফিরকে হুঁশিয়ার, ঔর কুছু নহি, খাবার হো যায়ে গা, কিতাব লেকে পঢ়নে বৈঠ যাও, অ্যায়সা নির্দেশ দিজিয়ে।…জয়হিন্দ বন্দেমাতরম!
কিন্তু যাগ গে, আমি এত বড় বড় কথা বলতে চাই না, বড় বড় মানুষের কথা তো বড় বড়ই হয়। তাই মনের মধ্যে কথাগুলো পর্যন্ত কেমন বড় বড় ভাবে আসে। এক এক সময়, যে কোনও বড় ভাবের কথা হলেই, আমার মনে সাধুভাষা জেগে ওঠে, এমনকী যার নাম রাষ্ট্রভাষা, তাও। কিন্তু আমি যে কথা ভাবছিলাম, আমি কে, কীসেতেই বা আছি, যাদের যা করবার, তারা তা করে যাচ্ছে, আমাকে কোনও দরকারই নেই, যেন আমি কেউ নই, যে কারণে, এভাবে আমার বলতে ইচ্ছা করে, হেল! হ্যাঁঙ ধূর সসলা। এদেশে কী হচ্ছে আর কী না হচ্ছে, তাতে আমি একটা অচেনাযাকে বলে অজ্ঞাত প্রাণী ছাড়া কিছুই না, অথচ আমি রয়েছি, পুরোপুরিই রয়েছি, এ কথাটা নিজে কখনওই ভুলতে পারি না। কেউ মনে না করতে পারে, শুধু কথার কথা ছাড়া, যে, আমার কোনও রো–ভূমিকা কোথাও আছে, যে কোনও বিষয়েই, কিন্তু আমার নিজেকে সবসময় সবখানে বিধিয়ে রাখতে ইচ্ছা করে। অথচ তা পারি না, কেন না, ঝকঝকে নৈবেদ্যের থালার নীচে, সেই পিঁপড়ের মতো তুচ্ছতা সবসময়েই যেন আমার পিছনে এঁকে রাখা হয়েছে, আমি নিজেও এ কথাটা ভুলতে পারি না। জানি না, আমার মনে হয়, বিপ্লবদের মনেও কোথাও এরকম একটা ভাবনা যেন কাজ করে চলেছে, ওর নাম থেকে তো সেটা আরও বেশি করে মনে হয়। ওর বাবাও বোধহয় এরকম ভাবে, নিকুচি করেছে মানে থাক বা না থাক…। তবু এ কথাও ঠিক, বিপ্লব নিজেকে অন্যরকম ভাবে, মিহিরও তাই, যা-ই করুক রঞ্জনের মায়ের সঙ্গে বা আর অন্য কিছু, খুব সাহসী ছেলে, আর ভীষণ সিরিয়াও বটে, কিন্তু আমি নিজেকে ঠিক সেরকম ভাবতে পারি না, যে কারণে আমি একটা তুচ্ছ–ইনসিগনিফিকেন্ট, এরকম একটা চিন্তা, যা আমি বুঝিয়ে বলতে পারি না, অথচ আমার ভিতরে সেটা ফোঁস ফোঁস করতে থাকে। আমার অজান্তেই, সেটা আমাকেই বিধিয়ে রাখে, আর ঠিক এই জন্যেই কিনা জানি না, একটা দাঁতে দাঁত পেষা রাগ, একটা ঘৃণা যেন আমার মধ্যে থৈ থৈ করছে, এবং যে কোনও সময়েই, ভারী গম্ভীর বুলডগ মার্কা ভদ্রলোক দেখলেই ঠোঁটের কোণে আলগা করে সিগারেট ধরে বাঁ হাতে কাঠি জ্বালিয়ে ভক্ করে ধোঁয়া ছাড়ি, আহ বুলডগের মুখখানি দেখিয়া তখন একমাত্র বাথরুমে যাইতে ইচ্ছা করে, যেন এইমাত্র পৃথিবীর, আপন সন্তানদিগের রসাতল গমন প্রত্যক্ষ করিয়া ক্রোধে আত্মহারা হইয়া ত্বরিতে গমন করিলেন। সত্যি কথা বলতে কী আমার বাবার কাছেই বা আমি কে। পুত্র! ঠিক আছে, সম্ভবত সে বিষয়ে আপাতত কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু আমি ওঁর কীসেতে আছি, উনিই বা আমার কীসেতে আছেন। উনি আমাকে খাওয়ান, পরান, বেশ ভালভাবেই–কেন না, বড়লোক বলতে যা বোঝায় পিতা তাহাই। কী জঘন্য রকমের টাকা করেছেন ভদ্রলোক, আর কী-কী বীভৎস রকমের ব্যস্ত, ভয়ংকর রকমের উদ্বিগ্ন, নার্ভাস টেনশনসবই টাকার জন্য যেন গেল, এই গেল ভাব, যেন কেউ থাবা দিয়ে নিয়ে নেবে, মাঝপথে ছিনিয়ে নেবে, আমি তো যেন বরাবর এই রকমই দেখে এলাম। একটা মস্তবড় চাকরি করেন, সকাল থেকে রাত্রি অবধি, ক্ষমতা প্রচুর, হয়তো বিস্তর ক্যাশ আমদানির ব্যবস্থাও আছে, কিন্তু ওঁর জীবন, কাজ কোনও কিছুর সঙ্গেই আমার কোনও যোগাযোগ নেই, নিয়ম অনুযায়ী থাকতেও নেই, আমি যাহাই করি তোমাকে দেখিতে হইবে না, তুমি তোমার কর্ম করিয়া যাও–এইরকম ভাব। এবং তিনি আমার প্রতি কর্তব্যে কোথাও একটু শৈথিল্য প্রদর্শন করেন নাই, যতটা ভালভাবে সম্ভব হস্টেলে রেখে, খাইয়ে পরিয়ে, অনেক খরচ-খরচা করে, যাকে বলে মানুষ করবার চেষ্টা করছেন। আমার আরও পাঁচটা ভাই থাকলে তাদেরও করতেন। দিদির বিয়ে হয়ে গিয়েছে, খুব ভাল বিয়ে দিয়েছেন, প্রচুর টাকা খরচ করেছেন। দিদিও গুটিচারেক প্রেম, একটা বিয়েন খসিয়ে বিস্তর মালপত্র নগদ টাকাসহ একটি থলথলে গেজেটেড অফিসারের সাত পাক ঘুরে খুশি হয়ে বিদায় নিয়েছে। দিদি মানে, আমার থেকে বছর দুয়েকের বড়, বাবার মতো দেখতে বাবা তো দেখতে বেশ সুপুরুষ মানে সুন্দর। এককালে বেশ ভালই ছিলেন দেখতে, সেই চেহারাটা আমার এখনও মনে আছে, এখন যেমন বাবার মুখটা আমার মনেই পড়ে না, ভদ্রলোক দেখতে যে কেমন সেটা প্রায় অস্পষ্ট ঝাপসা হয়ে গিয়েছে আমার কাছে, কেবল একটা ফরসা কপালে কতগুলো রেখা, যে রেখাগুলোতে কেবল যেন দুশ্চিন্তা আঁকা, আর দুটো চোখ যে চোখে একটা হন্যে ভাব, একটা ভয়–যেন একটা উদ্বেগ তাতে একটা লোকের সুন্দর মুখ যে কী রকম বদলে যেতে পারে, বাবা তার প্রমাণ। হয়তো ওঁর চাকরি বা দাম্পত্য জীবন ইত্যাদি কোনও কিছুতে একটা ভীষণ গোলমাল আছে। কিংবা জানি না, এ বয়েসে কোথাও প্রেম করে মরেছেন কি না–তবে যতদূর মনে হয়, চাকরির ব্যাপারেই একটা কিছু গোলমাল, বা সেটা গোলমালই নয় চাকরিটাই এই রকম, যার পিছনে সর্বস্ব দিয়ে তিনি কী হারাইতে ছিলেন, তিনি জানিতেন না, কিন্তু আমি যেন একটু একটু জানতাম, অথবা সে হারানোটা ওঁর কাছে কিছুই না, ওটা কোনও হারানোই নয়, তার বদলে উনি যা পাচ্ছিলেন, পাচ্ছেন, সেটাই হয়তো অনেক বড়। এ কথাগুলো ভেবে, মাঝে মাঝে বাবার ওপর রাগ হত এক সময়ে, কিন্তু কে কার ঝাড়ে বাঁশ কাটে, ওঁর স্ত্রী বা কন্যা বা পুত্রের বিষয়ে, উনি যা ভাল বুঝবেন করবেন, আর স্ত্রীকন্যা পুত্রেরা নিজের নিজের মতো চলুক।
আমি সে কথাই ভাবি, ওঁর কাছেও আমি এক ছেলে মাত্র, যাকে খরচ করে, খাইয়ে পরিয়ে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করতে হচ্ছে, আর আমি খেয়ে পরে, ন্যাকা-পড়া যা করছি সে তো আমি জানিই, মানুষও কেমন হচ্ছি, তাওকী বলে ওটাকে–হ্যাঁ আমার অন্তর্যামীই জানেন। এছাড়া আর আমি ওঁর কীসেতে আছি। কিছুতেই নেই, উনিও তা চান না বা ভাবেন না, আমি একটা তুচ্ছ ছেলে মাত্র, যার সঙ্গে ওঁর একটা কর্তব্যের সম্পর্ক মাত্র, ওঁর কোনও সুখ-দুঃখের ভাগ আমাকে কখনও কিছু দেননি, খোকা দেখ, এ বিষয়টা আমাকে বড় ভাবিয়ে তুলেছে, কী করা যায় এ রকম কিছু কোনও দিন বলেননি, আমার তো বলবার কিছুই নেই, থাকতেও পারে না, একমাত্র টাকা-পয়সা বা কোনও রকম সুবিধা অসুবিধা, তার জন্য ওঁকে কিছু বলবার দরকার হয় না। উনি একজন ভদ্রলোক, নিজের ব্যাপার নিয়ে জড়িয়ে আছেন, ঘটনাচক্রে আমি ওঁর ছেলে–কথাটা যেন কেমন শোনাচ্ছে কিন্তু এটা তো একটা ঘটনাই, হাজার হাজার ঘটনার মধ্যে, একটা ঘটনা, আমাকে উনি এই ধরাধামে আনয়ন করিয়াছেন। কত সহজ, যেন টপ করে একটি ফুচকা মুখে ফেলে দিলেন, অথবা একটি ঢেকুর তুললেন, বমন বা উদগার জাতীয় ব্যাপারই তো সেটা। হে মহারাজ, অপরাধী জানিল না, কী বা তার অপরাধ, কী কারণে ধরাধামে আবির্ভাব তার, পিতা আনয়ন করিলেন, এখন কেহ কাহারও নহি, কর্তব্যের একটি সেতু ব্যাতিরেকে। হ্যাঁ জানি, হয়তো অনেক কিছু টাকা-পয়সা সম্পত্তি তিনি আমার জন্যে রেখে যাবেন এবং সেটা ভোগ করবার সময়ে বাবার কথা যে সন্তানেরা কত ভাবে, তা আমার মতো খারাপ ছাড়া, ভাল ছেলেদের বেলায়ও তো দেখছি। সুতরাং সেটা কোনও কথা নয়, আসলে আমি ওঁর কিছুতেই নেই, মূলে আমি কোনও একটা ফ্যাকটার নই। তারপরে, দিদি অর্পিতার সুন্দর নাম, চরিত্রের সঙ্গেও খুব মিল, একটা তলতলে তরল পদার্থের মতো, অর্পণ করেই আছে–অর্পিতাসমর্পিতা নাম রাখলে কেমন হত। এখনও আমি ভুলতে পারি না সুশীলদার কথা, সামান্য কেরানি বটে, বাবার অফিসের অধস্তন কর্মচারী, তার সঙ্গে কে তোকে প্রেম করতে বলেছিল, কে তোকে হৃদয় সমর্পণ করে, পেরেম করে ওর মাথাটা খেতে বলেছিল। লোকটাকে চাকরি ছাড়তে হল, এমনই অপরাধ যে, শেষ পর্যন্ত কলকাতা পর্যন্ত ছেড়ে যেতে হল, অ্যাাঁ এত বড় সাহস, সে অর্পিতার প্রেমিক হয়েছে। তাও পাণিপ্রার্থনা করিবার সাহস করে নাই, নিতান্ত অর্পিতার হামসানি মেটাতেই লোকটিকে প্রেমিক হতে হয়েছিল। মনে মনে হয়তো একটু আশাও করেছিল নিশ্চয়ই অর্পিতাই সে আশা দিয়েছিল, আমি তো নিজের চোখেই সব দেখেছি। তারপরে নীলকান্তবাবু, অধ্যাপক মানুষ, দিদিটি আমার তাকেও জজিয়েছে কিন্তু একজন মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে কখনও অর্পিতার বিয়ে হতে পারে, অ্যারিস্টোক্রাসি, গ্র্যাঞ্জার বলে একটা কথা আছে। সত্যি, আমারই দিদি, কত রূপেই দেখলাম ওকে, শেষ পর্যন্ত একটা মার খেয়েছিল সেই টমটম মার্কা রমেনের কাছে, ফিল্মের হিরো হবার স্বপ্ন দেখত সে গাড়লটা, সারাদিন সেজেও থাকত সেই রকম। তার কাছে দিদিটি আমার একেবারে চিত্তির। ছোট ছোট তাড়াতাড়ি নার্সিং হোমে, জলদি জলদি ইভাকুয়েট কর, না খসালে উপায় নেই। বেচারি সুশীলদা, বেচারি মাস্টারমশাই, রমেনকেও বেচারিই বলতে হবে, কারণ তারপরেও অর্পিতা আবার একজনের কাছে অর্পণ করেছিল, কিন্তু বেশি দিন চালাতে পারেনি, গেজেটেড অফিসারটি এসে পড়েছিল। গেজেটেড অফিসার! আহ, যে ভাবে ঢাকঢোল বাজিয়ে গাড়িতে করে নিয়ে গিয়েছিল অর্পিতাকে, একটি সুন্দরী কুমারী কন্যাকে বিবাহ করিয়া, বর চলিল বীরদর্পে। সঙ্গে প্রচুর খাট, আলমারি, ড্রেসিং টেবল, ফ্রিজ, সোনার তো কথাই নেই। পুরুষরা বোধহয় কিছু বুঝতে পারে না, ওই যে কী সব সতীত্ব টতীত্ব বলে, সেটা কি শরীরের মধ্যে শরীর দিয়ে বোঝা যায়। যায় না নিশ্চয়ই। আমি তো কোনওদিন বুঝতে পারিনি। বেশ্যার সঙ্গেও যেরকম মনে হয়েছে, রিনাকে বা অদিতিকে বা বেবিকে বা লতিকাকে বা লতিকার দিদি মল্লিকাযার বয়স আমার থেকে করে সাত-আট বছর বেশি, কাউকেই তো আমি আলাদা করে কিছু বুঝতে পারিনি। একমাত্র রত্নার সঙ্গেই কিছু হয়ে ওঠেনি, দাঁতের গোলমালে সব পয়মাল হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু বেশ্যা ছাড়া, আর সকলেই তো আমার কাছে সতীই ছিল, মানে, আর কাহারও সঙ্গে এই সকল ললনারা শয়ন রমণ কিছু করে নাই, যা করেছে তা নিতান্তই অঙ্গ সেবা, এবং শুধু আমার সঙ্গেই যা করবার করেছে। ছেলেদের কি বোঝা যায় নাকি, মেয়েরা কি বুঝতে পারে, ছেলেরা অন্য কোনও মেয়ের সঙ্গে মিশলে। মিশলে! তার মানে কী, মিললে বোধহয়। আমার মনে হয়, এ সব কিছুই বোঝা যায় না। আচ্ছা, যদি এমন কোনও ওষুধ আবিষ্কার করা হয়, যেটা ব্যবহার করলে, কেউ আগে কোথাও কিছু করেছে কি না জানাজানি হয়ে যাবে, তা হলে কেমন হত। কিছুই হত না, এমনিতেই ছাড়াছাড়ি খেয়োখেয়ি, তার ওপরে মারদাঙ্গা লেগে যেত। দোহাই বাবা, কোনও বৈজ্ঞানিক যেন সমাজের এমন অকল্যাণ না করে। কী দরকার বাবা, বেশ তো নিজেদের মধ্যে সবই জানাজানি আছে, মনে মনে সবাই সবকিছু বোঝে, আমাকে ওরা বোঝে, আমিও ওদের বুঝি, পাসি ভাসিয়া যাউক, সতীত্ব দেহের ভিতরে বিরাজ করিতে থাকুক।
সেই কথাই ভাবছি, দিদির সঙ্গে আমার কিছু নেই, একটা ভাই মাত্র, আমার কিছুতে ও নেই, আমিও ওর কিছুতে নেই, এমন কখনও মনে হয় না, আমি ওর কাছে কিছু যাতে আমি মনে করতে পারি, আমাকে ওর দরকার এই ভেবে আমি নিজেকে তবু তুচ্ছের বেশি কিছু মনে করতে পারতাম। আর আমার মা–আহ্, কী অসহ্য রোদ–আর আমার মাআহ, পেভমেন্টটা যেন জ্বলছে, সাদা সিমেন্ট করা পেভমেন্ট পিচের রাস্তা, সবকিছু জ্বলছে কাঁপছে, আর এখন কেমন একটা ড্রাগনের আগুন ঝরানো নিশ্বাসের মতো এক একটা দমকা হাওয়া আসছে। মায়ের কথা আমি মনে করতে পারছি না, আমার সারা গায়ে একটা ব্যথা, হাতের ডানায় বুকে তলপেটের কাছে, হাতের আঙুলগুলোতে, যে কারণে এখনও আমি আঙুলগুলোকে সোজা করতে পারছি না, আর মাড়িতে দাঁতে ব্যথা, দাঁতের গোড়ায়, আর সেই দুর্গন্ধটা। আমি চোখে প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা, গলাটা শুকনো, একটা ট্যাক্সি আচ্ছা ট্যাক্সিওয়ালাদের কি আজ স্ট্রাইক আছে? মনে করতে পারছি না, এমন কিছু তো শুনিনি। কাছেপিঠে কোথাও একটা মানুষ নেই, কাকটাকে ছাড়িয়ে এসেছি, বাসের স্টপটা ছাড়িয়ে এসেছি, সেই রিকশাওয়ালাটাকে-যাকে আমার ছদ্মবেশী অন্য কেউ বলে মনে হয়েছে, তাকেও আর এখন দেখতে পাচ্ছি না। আমার এখন এ রাস্তাটাকে ভয় করছে। সত্যি সত্যি আমি পৃথিবীর কোনও জীবিতদের এলাকার মধ্যেই আছি তো! রাস্তার ওপরে সব বাড়িগুলোর প্রত্যেকটি দরজা জানলা বন্ধ, কোথাও কোনও সাড়াশব্দ নেই। হ্যাঁ, আর আমার মাতাকে আমি মনে করতে পারি না এখন, তবে বাবা দিদির মতো, মার কাছেও আমি কিছু না। সেই একটা ছেলে খায়, পরে, পড়ে, তার জন্যে কোনও ভয় বা দুশ্চিন্তা নেই, আমাকে দিয়ে তার কোনও দরকার নেই। মার নিজেরও বোধহয় মনে নেই, কবে আমাকে একদিন জন্ম দিয়েছিল, কবে আমাকে একদিন কোলে করে আদর করেছিল, কেন না, সে রকম ছোট থাকলে, সব বাচ্চারাই যেমন মায়ের কোলে চেপে আদর খেতে খেতে খুশি হয়ে হাসে, আর কেমন একটা, কী বলব–গর্বিত, হ্যাঁ গর্বিতভাব ফুটে ওঠে, যেন সে একটা কিছু আমি আর এখন সেরকম মনে করতে পারি না। একটা ফরেন লিপস্টিক, একটা শাড়ি, একটা জামা–যে সব আমার মায়ের চলতে ফিরতে সবসময় কাছে কাছে গায়ে গায়ে আছে, তার যা কদর, আমার তাও নেই, কেন না, আমি মাকে সাজাই না, সুন্দর করি না বা আমি মিস্টার লাহিড়ি, কিংবা নিরঞ্জন দেব, যারা মায়ের পুরুষ বন্ধু, তাদের কারুর মতোই বিশেষ কেউ না। মা! বললেই লোকে কী রকম গদগদ হয়ে ওঠে, অথচ মায়ের নির্যাতনও কম দেখিনি। আমাদের জুনিয়র প্রফেসর ছিলেন ভুজঙ্গবাবু। তাঁর মা এমনকী কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন ছেলে তাঁকে লাথি মেরে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। আমি শুনেছি, আমার ঠাকুরমাকে আমার মা বরাবর কাশীতে রেখে দিয়েছিল, কোনওদিন কলকাতায় আসতে দেয়নি এবং ঠাকুরমা কাশীতেই মরেছিল, অথচ ঠাকুরমা কলকাতায় আসার জন্য চিরদিন কান্নাকাটি করেছে, আসতে পারেনি, কারণ মা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিল, ঠাকুরমা যে বাড়িতে থাকবে, সে বাড়িতে মা থাকবে না। জানি না, এর মধ্যে কী গোলমাল ছিল, কেন ঠাকুরমাকে মরা পর্যন্ত কাশীতেই, যাকে বলে নির্বাসন দেওয়া হয়েছিল বা ভুজঙ্গবাবু কেন তাঁর মাকে পদাঘাতে বহিষ্কার করিয়াছিলেন। মা মা বলে লোকে এত গদগদ হয়, অথচ মাকালী ছাড়া বাছাধনদের ভয়ভক্তি কোনও মায়ের ওপর আছে বলে তো বিশেষ দেখতে পাই না। মাকে ভক্তি না করি বা না ভালবাসি, কিন্তু বাবা, আমরা এমন মানুষ যে, মা শুনলেই লোম খাড়া হয়ে ওঠে, মা মাগো! বলহরি হরি বোল্…
মাকে আমি মনে করতে পারছি না এখন, শুধু এই একটা কথা খেয়াল আছে, বিয়াল্লিশ বছরের এক নারী, মুখে তার নানা কারুকাজ, চক্ষে অঞ্জন, ওষ্ঠে রঞ্জন ইত্যাদি, কিন্তু সেই একই কথা, মা তার নিজেকে নিয়ে থাকে, আমাকে দিয়ে তার কোনও প্রয়োজন নেই, হ্যাঁ, ছেলে একজন, যদিচ নিজেকে বিশেষ কিছু ভাবতে পারি, সেরকম কিছুনই, আর মাও আমার কাছে তা-ই। তা-ই কী। আমি ঠিক জানি না বা বুঝি না, মোটের ওপর
আমি তুচ্ছ, আমি, কী বলব, একটা ইনসিগনিফিকান্ট ছেলে, কোনও কিছুতেই আমি নেই। কোনও মেয়ের কাছেও না, আমি অনেকের প্রেমিক, আমার পশ্চাদ্দেশে পদাঘাত করি, প্রেমিক! প্যান্টের বোতাম খুললে আর নারীর অন্তর্বাস সকল উন্মোচন করিলেই, প্রেমিক প্রেমিকা হওয়া যায় নাকি। তা হলে আমি প্রেমিক আর ওরা আমার প্রেমিকা। আহা, লহ হালুয়া লহ হালুয়া-আচ্ছা হালুয়া জিনিসটা কী, আর লে হালুয়া মানেই বা কী। সুজি রান্নাই যদি হালুয়া হয়, তার আবার নেওয়ানেয়ির কী আছে। যাক গে, কিছু মেয়ের সঙ্গে আমি শুয়েছি। শুয়েছি! শয়ন করিয়াছি, আহা কী শ্রুতিমধুর। এক কথাতেই বেবাক ফাঁস তারপরে আর যা বলো তাই-ই বলো, কোনও কিছুতেই কিছু যায় আসে না। কিন্তু আমি জানি, ওরা সব জাত প্রেমিকা, যেমন বলে, জাত গায়ক, জাত সাহিত্যিক, গান সাহিত্য ছাড়া তারা থাকতে পারে না, জাত প্রেমিকাও তেমনি। যেমন আমি একজন জাত প্রেমিক। প্রেম প্রেম প্রেম ছাড়া কি থাকা যায়। এ চলে যায় তো ও আসুক, ও যায় তো সে আসুক, আসতে থাকুক, যেতে থাকুক, লে লে বাবু ছে আনা। কিন্তু আমার জন্যে কোনও মেয়ে মরেও না বাঁচেও না, চাঁদের মতো অলখ টানে জোয়ারে ঢেউ কেউ কারুরই তুলতে পারে না, কোনও মেয়ের জন্য, আমি নিজেকে কখনও এমন ভাবতে পারি না, আমাকে না দেখতে পেলে ও থাকতে পারে না, আমি যখন ওর কাছে নেই, তখন ও আমার কথা ভাবে, আমি উহার দয়িত। দয়িতঅহো কী অপূর্ব, শ্রীকান্তবাবুর কথা আমার মনে পড়ছে, তিনি যখন আমাদের সংস্কৃত কাব্য পড়ান, তখন প্রেমের কথা কেমন টেনে টেনে, মধু রোস্বরে বলেন, যেন দারুণ দ্বিপ্রহরে বরফের কুচি ছড়ানো ব্লাডিমেরির পাত্তরে ঠোঁট ডুবিয়ে চুক চুক করে গলা ভেজানোর আরামের মতো, যেন উনি নিজেই সেই প্রেমের মধ্যে ডুবে যান, ভদ্রলোক ইচ্ছা করলে ভাল পাঠকতাও করতে পারতেন, ওঁর সেই পড়ানোর ভঙ্গিতে আমার মনে পড়ছে, হে স্বামি হে আমার পরম দয়িত–এমনটি আমি কোনও মেয়ের ব্যাপারেই নিজেকে ভাবতে পারিনি, আর এর পালটা ওদের কাউকেই আমি ভাবতে পারি না, কেন না, প্রেজেন্টেশন, এয়ার কনডিশনড হোটেল রেস্তোরাঁয় খাওয়া, সিনেমা দেখা, লুকিয়ে ক্যাবারেতে যাওয়া বাড়ি থেকে লুকিয়ে ক্যাবারেতে যাওয়া আর কটা মেয়ের পক্ষেই বা সম্ভব, কন্যা তো এদিকে অক্ষতযোনি থাকিয়া যাইতেছে, অহো, থাকিয়া যাউক ঈশ্বর করুন, এ সব ব্যাপারগুলো আমার একচেটিয়া নয়, আরও সকলেরই আছে এবং আমার থেকে আমার অনেক বন্ধুরা, অনেক ছেলেরা, অনেক বেশি মাত্রায় পুরুষ, রোমান্টিক, আমি সেই তুলনায় একটি জিরাফের বলদ। অথচ এই তেইশ বছর বয়সে, আমার অন্তরের মধ্যে যাতনা উপস্থিত হইয়া বারে বারে অনুরণিত হইতে থাকে, কেন ভালবাসিতে পারিলাম না, আমার বড় ভালবাসা পাইতে ইচ্ছা করে, কেহ যদি আমাকে প্রকৃতই ভালবাসিত, যাহার জন্য সবকিছু তুচ্ছ ভাবিতে পারিতাম, জীবনে মরণে যাহাকে লইয়া বিশ্বসংসারের সবকিছুকে জয় করিয়া লইয়াছি ভাবিতে পারিতাম, গলদঘর্ম হইয়া তাহার জন্য জগৎসংসারের এপার ওপার করিতে পারিতাম। হায়, তবে নিজেকে লইয়া গৌরব বোধ করিতে পারিতাম। হায়, রবীন্দ্রনাথের সেইসব প্রেম পবিত্র হৃদয় নায়িকাদের কাহারও সঙ্গে আমার কেন সাক্ষাৎ ঘটে না, শরৎচন্দ্রের বউদি দিদিরা কেহ আমাকে কেন একবার দেখা দেয় না, সীতা সাবিত্রীর দেশের সন্তান হইয়া, এমন অন্ধ হইয়া রহিলাম কিছুই দেখিতে পাইলাম না, বঙ্কিমচন্দ্রের নায়িকাদের কথা বাদই দিলাম, ভ্রমর কুন্দনন্দিনী রজনী কোথায় মিলিবে, যদি রূপান্তরে আদর্শ হিন্দু হোটেলের সেই পাচিকাকেও পাইতাম, বা চরিত্রহীনের মেসের ঝি সাবিত্রী, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নায়িকাদিগকে বড় সহজ বলিয়া বোধ হয় না, উহারা থাকুক, তারাশঙ্করের চিত্তের শক্তিতে শক্তিরূপিণী কোনও নায়িকাকেও যদি পাইতাম তবে তাহাদের পূজা করিয়া জীবন সার্থক করিতাম, কিন্তু তার বদলে আমি দেখছি ছাপা ভয়েলের ঢেউ রিনার উরুতে আর দাবনায়, আমি ওর দুই উরতের মাঝখানে মরে আছি, আমি দেখছি, বেবির সারা গায়ে কাপড়চোপড় নেই ও আমাকে এক মিনিটের টুইস্ট দেখাচ্ছে, আমি সেই আদিম বেশে ক্ষিপ্ত শরীরে কী বলব, অনেকটা জাদুকরের দ্বারা সম্মোহিতের মতো দুলছি, লতিকার নীচে আমার হাত, ও লাল মুখে জবজবে ঠোঁটে রোস্টেড-মুরগির ঠ্যাং চিবোচ্ছে…।
আমি কারুর কোনও কিছুতেই নেই আমি সবকিছুতেই একটা তুচ্ছ ব্যাপার, আমি বিপ্লবদের মতো ভাবতে পারি না, কিন্তু ওদের কাছে আমি কিছু। হ্যাঁ, ওর চোখের আগুন, আমার ভিতরের রাগকে এমনভাবে উসকে তোলে, দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকি আমি, ঘৃণা উথলে উথলে উঠতে থাকে, যেখানে যেভাবে হোক, আমি ঝাঁপিয়ে পড়তে রাজি, ভেঙে তছনছ করে দিতে চাই। শাসক–তারা যে কোনও বিষয়ের তোক আমি সবসময়ে তাদের সঙ্গে লড়ে যেতে রাজি আছি, কেবল নিষেধের বিজ্ঞাপন লটকনো, এগুলো ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলতে চাই, আমার চারপাশে যা কিছু আছে, যা কিছু চলছে, তার কোনওটাই আমার সহ্য হয় না, আর এ সবের যারা অভিভাবকত্ব করে তাদের চোখ মেরে একটা সিগারেট অফার করতে পারি, কিন্তু তখন যেন আমার কোনও গার্লফ্রেন্ড বগলদাবায় থাকে।… হ্যাঁ, ব্যথাটা, সেই কথা, আমরা তখন সেন্ট্রাল অ্যাভিনুর ওপর দিয়ে যাচ্ছিলাম, মেয়েরা সামনের দিকে ছিল, তার মধ্যে কেউ কেউ পেছিয়ে এসেছিল, পালাবার জন্য নয়, ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে কথা বলবার জন্য। শ্লোগান, গল্প সিগারেট খাওয়া অবিশ্যি দেওয়ালে সিনেমার বড় বড় পোস্টারগুলোর ন্যাংটা ছবিগুলোর দিকে চোখ পড়ছিল ঠিকই, আমার পাশ থেকে কে যেন বলেছিল, আজ ইভিনিং শো-টা মারতে হবে, বোম্বাই বাঁচিয়ে রেখেছে, কেন ব্রিজিতের যেটা চলছে, কাগজে পিকাসোর আঁকা সেই অদ্ভুত ছবিটাও বেরিয়েছে ব্রিজিত…। অন্যদিকে এবং সামনে পিছনে, চারদিকের বাড়িগুলো কাঁপিয়ে বাজছিল, মানব না, মানব না। ডক্টর করের লেকচার ছিল যথেষ্ট হয়েছে, দুবার তো গাব্ব মেরেছ বাবা, স্বৈরাচারীর স্বৈরাচার নিপাত যাক নিপাত যাক।মনে হয়েছিল, আমরা খুব স্বাভাবিক রয়েছি, হাসছি, কথা বলছি, যাকে বলে নির্ভয় আর আমাদের মুখগুলো বোধহয় জ্বলছিল, আর এসপ্লানেড-ধর্মতলার মোড়ের ডাইনে বাঁক নেবার পরেই, আমাদের থেমে যেতে হয়েছিল। শ্লোগান চলছিল, ঠাসাঠাসি লাগছিল, দুম করে শব্দ হয়েছিল। গুলি! গুলি ছুড়ছে ওরা। আমার তখন মনে হয়েছিল, নদীতে যখন বান আসে, কোনওদিন চোখে দেখিনি, আমার মনে হয়েছিল, ব্যাপারটা বোধহয় এইরকমই যে, নদীটা দু পাশ ছাপিয়ে সব ভাসিয়ে দিচ্ছে না, ভাসিয়ে দেবার জন্য ফুলছে, ফেঁপে উঠছে, এইবার ভেসে ছড়িয়ে যাবে, আমাদের অবস্থা যেন অনেকটা সেইরকম হয়ে উঠেছিল। কারা যেন চিৎকার করেছিল, গুলি না, টিয়ার গ্যাসিং করছে। বিপ্লবকে ছুটোছুটি করতে দেখেছিলাম, রুদ্রকেও কিন্তু ওর সঙ্গে আমার একটা বোঝাপড়া আছে, ওকে আমি ছাড়ব না, তবে, তখন রুদ্র ঠিক আজকের রুদ্র ছিল না, আজকের নাটুকে রুদ্র, শয়তান সানাফাবিচ–ওরা চিৎকার করছিল, কেউ নড়বে না। আবার শব্দ হয়েছিল পর পর কয়েক বার, অনেকেই মনে করেছিল, ফায়ারিং হচ্ছে, গুলি চলেছে, জল জল চিৎকার শোনা যাচ্ছিল, তারপরে হঠাৎ কোথায় একটা প্রচণ্ড জোরে শব্দ হয়েছিল, বোম্ বো কারা যেন বলেছিল, হঠাৎ বানের মতো সবাই ছড়িয়ে পড়তে আরম্ভ করেছিল, একটা গাড়ি আমাদের পাশ দিয়ে ছুটে গিয়েছিল, লাঠি হাতে পুলিশ নেমে পড়েছিল আমাদের চারদিকে, ওহ আচ্ছা, আমাদের মারতে নেমেছে ওরা।
আবার টিয়ার গ্যাস সেল ফেটেছিল, জানি না, কোথা থেকে আরও দুটো বোমের আওয়াজ হয়েছিল, আমার সঙ্গে একটা দল ময়দানের দিকে ছুটছিল, চোখ জ্বালা করছিল, ইউরিনালটার কাছে যেতে পারলে, চোখে জল দেওয়া যেত। হঠাৎ আমার ডানদিকে দেখেছিলাম, একটা ট্রাম ছুটছে, ওর সারা গায়ে আগুন–আগুন জ্বলছিল দাউ দাউ করে। কী আশ্চর্য, সে আগুন দেখতে আমার এত ভাল লেগেছিল, গন উইথ দ্য উইন্ড-এর আগুনের দৃশ্য কোন ছার আমি অমন আশ্চর্য, চলন্ত ছুটন্ত দাউ দাউ আগুন, কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী, হেই, পিকাসো কোথায়, দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী কোথায়, ব্রিজিতের দুই ডালে পা দেওয়া ফাঁকের মাঝখানে যে আগুন জ্বলছে, ট্রাম জ্বলা আগুনের তুলনা তার সঙ্গে চলত না, হেই, চিত্তপ্রসাদ, কর্মকার, আর্টিস্ট্রি হাউস আর আর্ট গ্যালারির স্বীয় অঙ্কিত চিত্রের প্রদর্শক শিল্পীরা, কোথায় কোথায়, কলিকাতার নীল আকাশের পটে এমন আশ্চর্য চলমান আগুনের দৃশ্য তোমরা দেখিলে না, হা নন্দলাল বসু, হা যামিনী রায়, এমন বিশাল আকাশ ব্যাপিয়া চলন্ত আগুনের শিখা আপনাদের দৃষ্টির অগোচরে রহিয়া গেল! কিন্তু কোথায় ছুটে চলেছিল সেই চলন্ত ট্রাম গাড়ি, ড্রাইভারের কি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল, তখনও সেই গাড়িটাকে সে চালিয়ে নিয়ে চলেছিল, অথবা, গাড়িটা চলন্ত অবস্থাতেই ড্রাইভার নেমে পড়েছিল, বুঝতে পারছিলাম না, গাড়িটা এগিয়ে চলেছিল, যেন গলে গলে পড়ছিল, টুকরো টুকরো হয়ে খসে পড়ছিল, যেন টুকরো টুকরো আগুনের গোলা খসে পড়ছিল, তার পাশে পাশে একটা পুলিশের গাড়ি চলছিল, ঢং ঢং ঢং ঘণ্টা বাজিয়ে কোনও দিক থেকে ফায়ারব্রিগেডের গাড়ি আসছিল, আমার চোখে পড়ছিল না, নিশ্চয় ট্রামের আগুন নেভাবার জন্যই আসছিল। আমার ইচ্ছা করছিল, ওই আগুনে গিয়ে আমি ঝাঁপিয়ে পড়ি, আমি জানি, বিপ্লব বা কানাই হ্যাঁ কানাইয়ের মতো ছেলে আমি দেখিনি, কোনও বন্ধুকে যদি শ্রদ্ধা করে থাকি জীবনে, কোনও মানুষকে যদি মনের ভিতর থেকে শ্রদ্ধা করে থাকি, সে হল কানাই, ও শুধু আমাদের অনেকের থেকে লেখাপড়াতেই ভাল নয়, ও কোনও কথাই অকারণ আবেগে বা উত্তেজনায় বলে না, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রুদ্রর সঙ্গে ওর মতভেদ হয়। আর কানাই এত সাদামাটা, ওর কোনও ঝলক নেই, ওর গলার স্বরে কোনওরকম মেকি সুর নেই, রুদ্রর মতো, আমি জানি ও অনেক বেশি জানে এবং বোঝে, কিন্তু রুদ্রর মতো নাটক করে না–রুদ্র, ওর সঙ্গে আমার একটা বোঝাপড়া করতে হবে–সব বিষয়েই কানাই অনেক ঠাণ্ডা শান্ত–ঠাণ্ডা শান্ত অথচ যেন কী বলে ওটাকে, অঙ্গারের মতো গনগনে আগুন, আমি বুঝতে পারছিলাম বিপ্লব আর কানাই ওরা দাঁতে দাঁত পিষে, রাগে অবাক হয়ে, সেই ট্রাম গাড়ির আগুন জ্বলা দেখছিল, আর বলাবলি করছিল, সর্বনাশ হয়ে গেল, পিছন থেকে কে ছুরি মারল, কে ট্রাম গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিল, কারা, কোন শুয়োরেরা?…
কিন্তু যারাই দিক, তারা যেন আমার আত্মার আত্মীয় বলে মনে হচ্ছিল, তারা ভুল করেছিল কিংবা তারা সত্যি সত্যি বিশ্বাসঘাতকের দল, তারা যারাই হোক, সেই আগুন দেখে, ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছা করছিল। তারা শুধু ট্রামটা জ্বালিয়েছিল কেন, তারা কেন চারদিকে, সমস্ত বাড়িগুলোতে আগুন লাগিয়ে দেয়নি, জ্বলুক, জ্বলুক, পুড়ুক ধ্বংস হোক, সমস্ত কিছু তছনছ হয়ে যাক, সমস্ত বর্তমানটা পুড়ে ছাই হয়ে যাক, তারপরে পুণ্য পবিত্র ভাগীরথীতে কত জল আছে দেখা যাইবে, যদি তাহাতেও সব ছাই ধুইয়া মুছিয়া পরিষ্কার না করা যায়, তাহা হইলে, বঙ্গোপসাগরের শরণাপন্ন হওয়া যাইবে। জ্বলুক জ্বলুক, আমার নিজেকে সত্যিই সেই পোকার মতো মনে হচ্ছিল, আগুন দেখলেই যাদের পাখা কাঁপে, তেমনি করে সেই আগুনে আমার ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছা করছিল। পুলিশ ততক্ষণে আমাদের চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলতে আরম্ভ করেছিল, ওরা আমাদের বন্ধুদের লাঠি দিয়ে মারতে আরম্ভ করেছিল, যাকে বলে আর্ত চিৎকার, তাই শোনা যাচ্ছিল, আর সে সময়েই কে যেন আমার কাছ থেকেই বলে উঠেছিল, নবীনা নবীনা। কই কই, কোথায়? উই যে, ওই বিল্ডিংয়ের চারতলা থেকে দূরবীন দিয়ে দেখছে। খচ্চরি একটা, ওর ঘাড়ের ওপর হাত দিয়ে ওই লোকটা কে?চেনা যাচ্ছে না।…।
নবীনা, ফিলমের নাম করা রোমান্টিক হিরোইন, আড়াই টাকা দিয়ে ওকে পরদায় দেখতে যাই আমরা। ও তখন আমাদের দেখছিল, আশ্চর্য, ও কী ভাবছিল, কে জানে, আর ঠিক সেই মুহূর্তেই সরস্বতী–আহ্, সরস্বতী সত্যিই রূপে সরস্বতী, গুণে অন্য পেরকারের গুণধরী, কিন্তু তখন ওকে দেখে আমার সত্যিই কষ্ট হচ্ছিল, আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, ও হঠাৎ কোথা থেকে এসে আমার হাত চেপে ধরেছিল, ওর মুখটা শাদা হয়ে গিয়েছিল, ঠোঁটে ঠোঁট টিপেছিল, অথচ কোনও মারের আঘাত ওর গায়ে দেখতে পাচ্ছিলাম না, কোনওরকমে আমাকে বলেছিল, এই শোনো, প্লিজ আমাকে বাঁচাও ভাই, আমি মরে যাচ্ছি, আমার এখুনি নার্সিংহোমে যাওয়া দরকার। বলতে বলতে, সরস্বতী আমার হাত ধরে প্রায় ঝুলে পড়েছিল, যেন টলে পড়ে যাবে, কিন্তু ভেবে পাচ্ছিলাম না, কী করে ওকে সেই সময়ে আমি নার্সিংহোমে পাঠাব, বা কেনই বা নার্সিংহোমে যেতে চাইছিল। তারপরে ওর টুকরো টুকরো কথার থেকে যা বুঝতে পেরেছিলাম, তা হল, সেদিন ভোর ছটাতেই নার্সিংহোমের ডাক্তার ওর ভিতরে ওষুধ দিয়ে প্লাগ পরিয়ে দিয়েছিল, সারাদিন রেস্টের পরে, বিকেল চারটে নাগাদ কুরেট করার কথা, কিন্তু ও হস্টেল থেকে বেরিয়ে এসেছিল, ভেবেছিল, ব্যাপারটা এমন কিছু নয়, একটু ব্যথামাত্র রয়েছে, আস্তে আস্তে হেঁটে মিছিলের সঙ্গে যেতে পারবে, তারপরে চৌরঙ্গির কাছ থেকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে নার্সিংহোমে চলে যাবে। অবস্থা যে ওরকম হয়ে উঠবে, ও নাকি ভাবতে পারেনি, তখন ওর অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছিল, কিন্তু আমি ভাবছিলাম, সরস্বতীর সেই প্রেমের ঠাকুরটি কে, যে দান করেছে, অথচ পাত্তা নেই। ও অবিশ্যি তখন আমাদের সিনিয়র গ্রুপের মেয়ে, উত্তরবঙ্গের কোনখান থেকে পড়তে এসেছিল, এখন তো কোন যদুবংশীর গলিতে নাকি থাকে, যেমন উঁকি মোটা হয়েছে, তেমনি একটা ভোঁদকা মোটা স্বামীর সঙ্গে গদ গদর করে ঘুরে বেড়ায়, চারভাঁজওয়ালা ঘাড়ে গলায় আবার মোটা সোনার হারশালা ওয়াক, ফরসা, রঙের মাথায় ঝাড়ু, ওই কি রূপে সরস্বতী।
যাক গে, তখন ও সেরকম ছিল না, আর আমি ব্যাপারটা একেবারে বুঝতে পারছিলাম না, তাও নয়, কুরেট করা কী, আগেই জানতাম এবং যে কাজটা আগের দিন রাত্রে হবার কথা ছিল, সেটা সেইদিন ভোরবেলাই করিয়েছিল সরস্বতী, আর চারটের সময় অপারেশন টেবিলে যাবার কথা ছিল, অথচ তখন আমি কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না, জিজ্ঞেস করবার ইচ্ছা থাকলেও, পারিনি, কার দান ওর কুমারী গর্ভে তখন মৃতপ্রায় হইয়া, যন্ত্রণায়, জরায়ুর অন্ধকারে ছটফট করিতেছিল, ছুঁড়ির কি মাথা খারাপ গা, ওমন করে কেউ বেরোয়, তবু আমি চারদিকে তাকাচ্ছিলাম, যদি একটা ট্যাক্সি বা প্রাইভেট গাড়ি কাছেপিঠে দেখা যায়। অসম্ভব। তখন পুলিশ আর আমরা আর পুলিশের গাড়ি ছাড়া, রাস্তায় কিছুই নেই, আর একজন বাঙালি সার্জেন্ট আমার কয়েক হাত দূরেই, লাঠি দিয়ে কাদের মারছিল, আর তার মধ্যেই চিৎকার করছিল, লোফারস, তোদের মুখে বড় বড় কথা, মেয়েদের এগিয়ে দিস্ তোরা।..
বোধহয় ওদের মতে, অন্তত ওরকম ক্ষেত্রে, লেডিজ ফাস্ট নয়, জেনানা আপ পহলে, আর সব বিষয়েই সত্যি? সত্যি, কখনও কখনও, কোনও কোনও সময় লেডিজ ফাস্ট, সেই-সেই-সেই সময়েও, যখন পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা নামক পুণ্য বাণীটিকে ভাষার সঙ্গে ক্রিয়ার দ্বারা ফলবতী করিয়া ভোলা হয়, অহো, লেডিজ ফাস্ট-পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা আর আমার ঘাড়ের ওপর প্লাগবদ্ধ সরস্বতাঁকে নামটি তোমার রেখেছিল, সব মিলিয়ে কী বিচিত্র এবং আসলে, আমার কয়েক হাত দূরে তখন পুলিশের সঙ্গে ছেলেদের হাতাহাতি ধ্বস্তাধ্বস্তি হচ্ছিল, যদিচ, ওদের হাতে লাঠি ছিল, ঢাল ছিল, আর আমরা, ঢাল তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দার, পরস্পর বচসা আর গালাগাল পালটা গালাগাল চলছিল, আমি বলেছিলাম, কিন্তু সরস্বতী কিছুই যে দেখতে পাচ্ছি না, তুমি বেরুলে কেন?
বুঝতে পারিনি। অর্থহীন কথা, কিছুই বুঝতে পারেনি সরস্বতী, যখন গর্ভধারণ কারণ ক্রিয়া করিয়াছিল, তৎকালেও বুঝিতে পারে নাই, কী গ্রহণ করিতেছে, কেবল অঙ্গাভ্যন্তরের পেশিসমূহের তরঙ্গায়িত সুখানুভূতিতেই মরিয়া যাইতেছিল, ই বিটিকে কী বইলব বলো দিকিনি, এবং চারদিকে তাকাতে গিয়ে আমি দেখেছিলাম, প্রায় মনুমেন্ট বরাবর, লাইনের ওপর জ্বলন্ত ট্রামটা দাঁড়িয়ে পুড়েছে, সেখানে দুটো ফায়ারব্রিগেডের গাড়ি, আসলে ড্রাইভার ওখানেই গাড়িটা নিয়ে যেতে চেয়েছিল বা সেইরকম নির্দেশ তাকে দেওয়া হয়েছিল, কারণ সেখানেই জল ছিল, আর ফায়ারব্রিগেডের গাড়ি থেকে, পাইপ জুড়ে, গাড়িটার আগুনে জল ছিটিয়ে দিচ্ছিল, অথচ সেই প্রলয় আগুন কিছুতেই নেভাতে পারছিল না। দুটো পাইপেও আগুনের সব দিকগুলো নাগাল পাচ্ছিল না। দুটো ক্যারেজ-এর ছাদই খসে ভেঙে পড়েছিল আর ঠিক সে সময়েই, পুলিশের দলটা আমাদের ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছিল সবাই ছুটোছুটি করলেও, সরস্বতীর জন্যে আমি পারছিলাম না, তবু ওকে টেনে নিয়ে সরে আসবার সময়েই, কী ভাবে একটা ধাক্কা লেগে সরস্বতী পড়ে গিয়েছিল, আর আমার মুখে একটা প্রচণ্ড ঘুষি, যাহ্, দাঁতগুলো বুঝি সব ঝরেই পড়ে গেল বলে আমার মনে হয়েছিল, আর মিহির আমার পায়ের কাছে ছিটকে পড়েছিল, ওর পরনে প্যান্ট ছিল না, টেরিক-এর শার্টটার বোতাম খোলা, তবে ভাগ্য ভাল, ও নেহাত বাইক পরে ছিল না, একটা আঁট ইজের মতো পরা ছিল ভিতরে তা নইলে–সেই সময়ে, বয়েজ কাট চুল, ঠোঁটে লিপস্টিক, হাত কাটা জামা, কুমিরের মতো চোখ শিকারি মহিলাটির কথা আমার মনে পড়েছিল, আর আমার সামনে একটা ইউনিফর্ম পরা মূর্তি দেখেই দাঁতে দাঁত পিষে ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিলাম–নিষেধ নিষেধ আর মার, কেন। কিন্তু তার আগেই ঠিক এখানে, এখন যেখানে ভুরুর ওপরে ফুলে আছে, ব্যথা করছে, ঠিক এখানেই ঠাস করে একটা লাঠি এসে পড়েছিল, চোখ আগের থেকেই জ্বালা করছিল, আমি যেন চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না, মাটিতে পড়ে গিয়েছিলাম মুখ থুবড়ে, তবু দাপাদাপি করছিলাম ওঠবার জন্যে, কিন্তু একটা লাঠি আমার পেটে খোঁচা দিয়ে চেপে রাখা হয়েছিল, যাতে না উঠতে পারি, এবং সেই অবস্থাতেই উপরোউপরি ঘাড়ে পিঠে কয়েক ঘা পড়েছিল, আর রাষ্ট্রভাষা শুনতে পেয়েছিলাম, স্সালা চুত্তিয়া কামিনা কাঁহিকা।
সেই মুহূর্তেই হঠাৎ একবার চোখে পড়েছিল, সরস্বতীর গোলাপি রঙের শাড়িটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে, যাক ওকে আর অপারেশন টেবিলে যেতে হল না, এই কথা আমার মনে হয়েছিল। কিংবা আসলে হয়তো অবস্থা আরও খারাপের দিকেই যাবে, কেন না, কতদিনের ব্যাপার সেটা আমার জানা ছিল না, এবং ও যে বমি করে ফেলেছিল, সেটাও আমি দেখতে পেয়েছিলাম। কোথা থেকে একটা গাড়ি ছুটে এসেছিল, একজন সার্জেন্ট আঙুল দিয়ে সরস্বতাঁকে দেখিয়েছিল, দুজন লোক সরস্বতাঁকে সেই গাড়িটাতে তুলে নিয়ে চলে গিয়েছিল। আমার পাশে, শোয়ানো অবস্থাতেই কাকে যেন পুলিশ মারছিল, কিন্তু আমার মতো কাতর অবস্থা তার ছিল না, সে থুথু ছিটিয়ে দিচ্ছিল, কার এত সাহস, ফিন সসলা থুকতা, তেরি–একেবারে নির্যস আর মোক্ষম একটি রাষ্ট্র ভাষা শুনেছিলাম। কোন মাতার সন্তানকে অমন কথা বলা হচ্ছিল, দেখবার জন্যে মুখটা ফেরাতে যেতেই, যাহ্, নিয়নটা বোধহয় নেভাতে ভুলে গিয়েছিল দেখেছিলাম, হিন্দি ছবির নায়ক নায়িকার নাম, নিভছে জ্বলছে জ্বলছে নিভছে, আর নায়কটি জানু পেতে দুই উরতের মাঝখানে, অহো কী দুঃখের দৃশ্য যাতনায় কাতর হইয়া নায়িকার কোথায় মুখ রাখিয়াছে দেখ, আর নায়িকাটি ব্যাকুল হইয়া এমন ঝোঁক দিয়াছে যে স্তনযুগল খসিয়া পড়িবার দাখিল হইয়াছে, নেহাত আইন বাঁচাইবার জন্য চুচুকবৃন্ত দুইটি আবৃত রাখিয়া, বাকি সমগ্র স্তন দর্শাইতেছে। মনে হইতেছিল, বাছা খা এইরূপ কথা শুনা যাইবে।
যদিচ আমি বুঝতে পারছিলাম না, এসপ্ল্যানেডের কোন বাড়ির দেওয়াল ওটা, কোনও বাড়িটাকেই চিনতে পারছিলাম না, চোখের ওপর, মুখের ওপর রোদ, ভুরুটা যেন চোখের ওপর এসে পড়েছিল। চোখ থেকে জল পড়ছিল। তবু থেকে থেকে সবই চোখে পড়ছিল, আর মাঝে মাঝে সিনেমার ট্রিক শটের মতো বড় বড় বাড়িগুলো যেন দুলছিল, ঠিক যেমন একটা দুলতে থাকা আয়নার মধ্য দিয়ে দেখা যায়, সেরকম দেখাচ্ছিল। কিন্তু কে তবু না থেমে থু থু দিয়ে যাচ্ছিল। একেবারে আমার মাথার দিকে, তাই দেখতে অসুবিধা হচ্ছিল, আমি মাথাটাকে যতটা সম্ভব উলটে দেখেছিলাম আর তৎক্ষণাৎ আমার গায়ের লোমগুলো সব খাড়া হয়ে উঠেছিল, কানাই! কানাইকে ওরা মারছিল, আর কানাই থু থু ছিটিয়ে দিচ্ছিল, কানাই! আমি ঘসটে ঘসটে কানাইয়ের দিকে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু নড়তেই এক ঘা এসে কাঁধে পড়েছিল, পেটে খোঁচা লেগেছিল, কানাই! বিপ্লবের নামটা ছাড়া, ওকে আমার ভাল লাগে, কিন্তু কানাইকে আমি রেসপেক্ট করি, ওকে ভালবাসবার সাহস আমার হয় না, ভালবাসবার কথা ভাবতে পারি না, কিন্তু ও সত্যি একটা সিগনিফিকেন্ট মানুষ। আমি দেখেছি ওর বাবা ওর সঙ্গে কী রকম করে কথা বলেন, তুই কি এখন কফি হাউসে যাবি? হ্যাঁ, তুমি যাবে? না না, আমি আবার ওখানে কী যাব, পালক বদলাতে হবে তো।ওটা তোমার ভুল, জান ওখানে বয়স্ক লোকেরাও আসেন।তা হোক, তাঁরা আমার মতো একজন প্রেসের কমপোজিটার নয়। তার জন্য বুঝি তুমি ছোট হয়ে গেলে। চলো না, আজ তো আবার তোমার ওভারটাইম আছে, এক কাপ কফি খেয়ে যাবে। থাক। শোন তোর মায়ের ওষুধটা। আমি নিয়ে যাব।তোর আবার টুইশানি রয়েছে। তারপরে নিয়ে যাব। আর শোনো বাবা, তোমাদের প্রেসের ম্যানেজারকে বললো, আমাদের ম্যাগাজিনটা কিন্তু পনেরো তারিখের মধ্যে ছাপিয়ে শেষ করে দিতে হবে। বলব। তোর লেখাটা পড়লাম, আমিই কম্পোজ করছি ওটা সত্যি ভাল লিখেছিস। কী যেন নাম দিয়েছিস লেখাটার– যৌবনের দায়িত্ব। হ্যাঁ, যৌবনের দায়িত্ব। তোদের তো কাল আবার কী সব আছে শুনেছিলাম। হ্যাঁ, ময়দানে র্যালি।হরিশ্চন্দ্র বাবুর কানাইয়ের বাবার নাম হরিশ্চন্দ্র, ছেলের নাম কানাই, আশ্চর্য, যেন খুবই একটা সরল সাধারণ ব্যাপার, যাকে বলে অ্যামবিসাস্নামের সৌন্দর্যে বা ধ্বনিতে, সে রকম কিছুই না, সরল সহজ ব্যাপার। হরিশ্চন্দ্রবাবুর চোখে দেখেছিলাম কেমন একটা উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা, খালি এইটুকু উচ্চারণ করতে শুনেছিলাম, দেখিস আবার–আর আমি যেন শুনতে পাচ্ছিলাম দেখিস আবার, একটা দুর্ঘটনা কিছু ঘটে না যেন, তোর বেঁচে থাকাতে আমার অনেক আশা… কানাই, কত প্রয়োজনীয়, কত ভালবাসার ছেলে, আর এমনকী কীভাবে ওর বাবা একজন সামান্য কমপোজিটর, ওর লেখার প্রশংসা করেছিল, তার মানে, ছেলেকে উনি মনে মনে শ্রদ্ধাও করেন, কানাইয়ের চোখ দুটো জ্বলজ্বলিয়ে উঠেছিল, অথচ বাবার প্রশংসায় একটা লজ্জা লজ্জা ভাব। তার মানে ওর বাবাকে ও মোটেই ছোট মনে করে না, তা হলে মুখের ভাব ওরকম করত না, ওর বাবার গলাটাও কী রকম মোটা অথচ খুব আস্তে আস্তে কথা বলেছিলেন যেন বিনীত একটা ভাব, বন্ধুর মতো, বড় বড় বক্তৃতাবাজ বাবাদের মতো না, অথচ কী রকম দরিদ্র, যেটা আমার বিপ্লবের মাকে দেখে মনে হয়েছিল, বিপ্লবের মাকে আমার খুব ভাল লেগেছিল খুব সহজ গরিব আটপৌরে মা। হ্যাঁ দিদি আপনার কর্তা… এরকম কথা বলা, রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে গল্প করা মধ্যবিত্ত গিন্নিদের মতো না, যাদের দেখলেই আমার মনে হয়, ওরা দুগাছা সোনার চুড়ি বাড়াবার জন্য যে কোনওরকম অন্যায় করতে পারে, সে রকম না আর ও সব দিলালি গল্প করার সময়ও বিপ্লবের মায়ের নেই, কেন না, বেশ বেশ এই তো চাই বাবাটির যৌবনের হুমড়ি খাওয়া সামলাতে সামলাতে আর সবাইকে দু বেলা বেঁধে খাওয়াতেই তাঁর সময় চলে যায়।
যাই হোক, কানাই, কানাইকে ওরা মারছিল ও থু থু দিচ্ছিল, যাকে আমার একটা ইন্ডিভিজুয়াল বলে মনে হয়, গরিব, কিন্তু মধ্যবিত্ত, রুদ্র বা আমাদের মতোই একদিক থেকে বলতে হবে, কিন্তু রুদ্র বা আমাদের মতো নয়। বিপ্লপদের মতো নয়, আমাদের সকলের মধ্যে ওর একটা ইন্ডিভিজুয়ালিটি আছে, আমরা কেউ কোনও দিনই যে কাজ করতে পারব না, ও তা করতে পারবে। এইরকম আমার একটা বিশ্বাস। তারপরে এক সময়ে আমার চুলের মুঠি ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে তুলেছিল, তখন দুম দুম শব্দগুলো দূর দূর থেকে আসছিল। ছেলেদের ভিড় অনেক হালকা হয়ে গিয়েছিল। পোড়া ট্রামটা থেকে ধোঁয়া উঠছিল তখনও, কালো পোড়া কাঠের মতো দেখাচ্ছিল সেটাকে, যা রক্ষা করতে পারেনি ছেলেরা আর পুলিশেরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল, ময়দানের দিকে এক দল ঘোড়সওয়ারও দৌডুচ্ছিল, ভাগ্যিস সেদিন কোনও সেরকম বিশেষ খেলা ছিল না, তা হলে, পুলিশের সঙ্গে মারামারিটা অন্য কারণে সেখানেই হয়ে যেত বা ছাত্র মিছিলের ডাকই হয়তো দেওয়া হত না, ময়দানের দিয়েই সকলের লক্ষ থাকত, কারণ যাকে বলে বিশেষভাবে প্রতীক্ষিত কোনও নতুন মুভি বা মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল-এর মতো ক্লাবের খেলা বা ক্রিকেটের মরশুমে বিশেষ বিশেষ খেলার দিনগুলো বড় গোলমেলে, তবে আমার কাছে সেই একই কথা, নিষেধ মানেই অমান্য। যেখানেই হোক ইউনিভার্সিটিতে, খেলার ময়দানে যেখানেই হোক। তারপরে অনেকের সঙ্গে, আমাকেও একটা কালো রঙের জালে ঘেরা গাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল, লক আপ-এর মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। সেখানে ঢুকেই মিহির ইজেরটা খুলে দেওয়ালে প্রস্রাব করেছিল, আর আমি পকেট থেকে একটা পেন্সিল বের করে দেওয়ালে লিখেছিলাম, এখানে প্রস্রাব করা নিষেধ, অমান্য করিলে দায়রায় সোপার্দ হইতে হইবে।
সন্ধ্যাবেলা একজন ইনস্পেক্টর এসে আমার নাম ধরে ডেকেছিল, তার আগেই অবিশ্যি আমার নাম ধাম লিখে নিয়েছিল, মিহির ওর নাম বলেছিল, ওদের কলেজের প্রিন্সিপালের নাম, আগে জানলে, আমিও সেরকম একটা কিছু বলতাম। হাজতের দরজা খুলে, একজন সেপাই এসে আমার হাত ধরেছিল, আমি হাতটা ছাড়িয়ে নিয়েছিলাম, তার জন্যে সেপাইটা আমার গায়ে থাপ্পড় মারবার আগেই, ইনস্পেক্টর থামিয়ে দিয়েছিল এবং আমাকে অফিসে নিয়ে গিয়ে একটা চেয়ারে বসতে দিয়েছিল। সমস্ত আসবাবপত্র, ফাইল, দেওয়াল সবখানেই যেন নিষেধের গন্ধ, নিষেধ নিষেধ নিষেধ, কী জন্য আমাকে একলা অফিসে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল, কিছুই বুঝতে পারিনি, আবার ফিরে যাব জানতাম কিন্তু আমার সামনে একজন অফিসার এসে বসেছিল, বাবার নামটা বলে জিজ্ঞেস করেছিল ওটা আমারই বাবার নাম কি না। আমি বলেছিলাম, নামটা তো আগেই আমি বলেছি।
অফিসার বলেছিল তা জানি, এরকম লোকের ছেলে হয়ে তুমি এ সব করতে এসেছ? ছি ছি ছি, তোমার ইনজুরি তো দেখছি মন্দ না, তুমি বাড়ি চলে যাও, সেখানে ডাক্তার ডেকে দেখালেই হবে। তোমার বাবার সঙ্গে আমার ফোনে কথা হয়েছে।
প্রথমটা আমি খুব হতাশ হয়ে পড়েছিলাম, মিহিরদের কাছে আর ফিরে যেতে পারব না ভেবে, তারপরেই মনে হয়েছিল, কেন, ওদের কথাতেই আমি চলে যাব কেন, আর বাবার ওপরে এমন রাগ হয়েছিল যেন ওঁর ইচ্ছেতে আমি বেরিয়েছিলাম, আবার ওঁর ইচ্ছেতেই বাড়ি ফিরে যেতে হবে, তার মানে ওরা সবাই মিলে বলতে চায়, আমরা যা বলছি, তাই করো। তাই করবে। যা বারণ করব, তা করবে না। যেন আমি একটা কিছু না, একটা তুচ্ছ কিছু, যা করবার বলবার নির্দেশ দেবার, সব ওরাই করবে। আমি বলেছিলাম, এখন আমি বাড়ি যেতে চাই না।
কোথায় যেতে চাও।
যেখানে ছিলাম, ওদের সকলের কাছে।
অফিসারের মুখটা শক্ত দেখাচ্ছিল, তবু আমার দিকে না তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে এমনভাবে হেসেছিল, যেন হাসিটা অফিসারের নয়, গোঁফের। বলেছিল, তুমি ইচ্ছে করলেই ঢুকতে পার না, বেরুতেও পার না। ডেপোমি না করে বাড়ি যাও।
তখনও কয়েক বছরের ছোট ছিলাম এখন হলে কী করতাম বলতে পারি না। রাগে আর ঘৃণায় আমি কথা বলতে পারছিলাম না, কিন্তু আমি একভাবেই বসে ছিলাম, আর অফিসারটা আবার ধমক দিয়ে উঠেছিল কী হল, বসে রইলে কেন, বাড়ি যাও। বলো তো কেউ গিয়ে তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসতে পারে।
দরকার নেই।
তবে যাও, বাড়ি গিয়ে বাবাকে একটা ফোন করতে বলবে যে, তুমি বাড়ি পৌঁছেছ।