পথের দাবী : ১২
কয়েক পদ অগ্রসর হইয়াই অপূর্ব সৌজন্য প্রকাশ করিয়া কহিল, আপনার এই অসুস্থ দুর্বল শরীর নিয়ে আর পথ হেঁটে কাজ নেই। এই ত সোজা রাস্তা বড় রাস্তায় গিয়ে পড়েচে,—আমি অনায়াসে যেতে পারবো।
ডাক্তার চলিতে চলিতেই একটু হাসিয়া বলিলেন, অনায়াসে এলেই কি অনায়াসে যেতে পারা যায় অপূর্ববাবু? তখন সন্ধ্যাবেলা যে পথটা সোজাই ছিল, এখন, এত রাত্রে জেরবাদীপাঠান আর বেকার কাফ্রিতে মিলে হয়ত তাকে রীতিমত বাঁকিয়ে রেখেচে। চলুন, আর দাঁড়াবেন না।
অপূর্ব ইঙ্গিতটা বুঝিতে পারিয়াও জিজ্ঞাসা করিল, কি করে এরা? মারামারি?
তাহার সঙ্গী পুনশ্চ হাসিয়া বলিলেন, করে বৈ কি! মদের খরচটা তারা পরের ঘাড়ে চাপাবার কাজে ও-অনুষ্ঠানটুকু বোধ করি ঠিক বাদ দিয়ে উঠতে পারে না। এই যেমন সোনার ঘড়িটা আপনার। অপরের পকেটে চালান যাবার সময়ে আপত্তি হবারই সম্ভাবনা। তার পরের ব্যাপারটাও অত্যন্ত স্বাভাবিক। ঠিক না?
অপূর্ব সভয়ে ঘাড় নাড়িয়া কহিল, ঠিক বটে, কিন্তু এ যে আমার বাবার ঘড়ি!
ডাক্তার বলিলেন, এই ত তারা বুঝতে চায় না! কিন্তু, আজ না বুঝলে চলবে না।
অর্থাৎ?
অর্থাৎ, আজ এর বদলে কারুরই মদ খাবার সুবিধে হবে না।
অপূর্ব ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া সন্দিগ্ধকণ্ঠে কহিল, বরঞ্চ চলুন, কোন পথ দিয়ে ঘুরে যাওয়া যাক।
ডাক্তার তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া হাসিয়া উঠিলেন। অনেকটা মেয়েদের মত স্নিগ্ধ সকৌতুক হাসি। কহিলেন, ঘুরে? এই দুপুর রাতে? না না, তার আবশ্যক নেই, চলুন—এই বলিয়া সেই শীর্ণ হাতখানি দিয়া অপূর্বর ডান হাতটি টানিয়া লইয়া একটা চাপ দিতেই অপূর্বর অনেক দিনের অনেক জিম্নাস্টিক, অনেক ক্রিকেট-হকিখেলা হাতের ভিতরের হাড়গুলা পর্যন্ত যেন মড়মড় করিয়া উঠিল।
অপূর্ব হাত ছাড়াইয়া লইয়া বলিল, চলুন, বুঝেচি। এই বলিয়া সে নিজেও একটু হাসিবার চেষ্টা করিয়া কহিল, কাকাবাবু সেদিন আপনার কথাতেই রহস্য করে আমাকে বলেছিলেন, সাধে কি বাবাজী মহাপুরুষের সংবর্ধনায় এত লোকজনের আয়োজন করতে হয়? আমাদের গুহ্য কেতাবে লেখা আছে, কৃপা করলে তিনি পাঁচ-সাত-দশজন পুলিশের ভবলীলা শুধু চড় মেরেই সাঙ্গ করে দিতে পারেন! কাকাবাবুর মুখের ভঙ্গীতে সেদিন আমরা খুব হেসেছিলাম, কিন্তু এখন মনে হচ্চে অত হাসা ঠিক সঙ্গত হয়নি—আপনি পারলেও বা পারতে পারেন।
ডাক্তারের মুখের ভাব পরিবর্তিত হইল, কহিলেন, কাকাবাবুর ওটা অতিশয়োক্তি। কিন্তু আমরা কে কে?
অপূর্ব কহিল, আমি এবং তাঁরই দু’চার জন কর্মচারী।
ওঃ—এঁরা! এই বলিয়া তিনি একটা নিঃশ্বাস ফেলিলেন। অপূর্ব ইহার অর্থ বুঝিল; এবং কিছুক্ষণ অবধি কোন কথা যেন তাহার মুখে আসিল না। সোজা পথটা আজ সোজাই ছিল, কারণ, যে জন্যই হউক, পথিকের টাকাকড়ি কাড়িয়া লইবার আজ কেহ তথায় উপস্থিত ছিল না। নির্জন গলিটা নিঃশব্দে পার হইয়া তাহারা বড় রাস্তার কাছাকাছি পৌঁছিলে অপূর্ব সহসা বলিয়া উঠিল, এবার বোধ হয় আমি নির্ভয়ে যেতে পারবো। ধন্যবাদ।
প্রত্যুত্তরে ডাক্তার স্বল্পালোকিত সম্মুখের প্রশস্ত রাজপথের বহুদূর পর্যন্ত দৃষ্টি প্রসারিত করিয়া ধীরে ধীরে কহিলেন, পারবেন বোধ হয়।
অপূর্ব নমস্কার করিয়া বিদায় গ্রহণ করিতে গিয়া ভিতরের কৌতূহল কোনমতেই আর সংবরণ করিতে পারিল না, বলিয়া ফেলিল, আচ্ছা, সব্য—
না না, সব্য নয়, সব্য নয়,—ডাক্তারবাবু।
অপূর্ব ঈষৎ লজ্জিত হইয়া কহিল, আচ্ছা ডাক্তারবাবু, আমাদের সৌভাগ্য যে পথে কেউ ছিল না, কিন্তু ধরুন তারা দলে বেশী থাকলেও কি সত্য সত্যই কোন ভয় ছিল না?
ডাক্তার কহিলেন, দলে তারা দু’দশ জনের বেশী কোন দিনই থাকে না।
অপূর্ব বলিল, দু’দশ জন! অর্থাৎ, দু’জন থাকলেও ভয় ছিল না, দশজন থাকলেও না?
ডাক্তার মুচকিয়া হাসিয়া বলিলেন, না।
বড় রাস্তার মোড়ের উপর আসিয়া অপূর্ব জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা, বাস্তবিকই কি আপনার পিস্তলের লক্ষ্য কিছুতেই ভুল হয় না?
ডাক্তার তেমনি সহাস্যে ঘাড় নাড়িয়া উত্তর দিলেন, না। কিন্তু কেন বলুন ত? আমার সঙ্গে ত পিস্তল নেই।
অপূর্ব বলিল, ওটা না নিয়েই বেরিয়েছিলেন,—আশ্চর্য! অন্ধকার গভীর রাত্রি ঝাঁঝাঁ করিতেছে, সে জনহীন দীর্ঘপথের প্রতি চাহিয়া কহিল, পথে না আছে লোক, না আছে একটা পুলিশ; আলো ত না থাকার মধ্যেই—আচ্ছা ডাক্তারবাবু, আমার বাসাটা প্রায় ক্রোশখানেক হবে, না?
ডাক্তার বলিলেন, তা হবে বৈ কি।
অপূর্ব কহিল, আচ্ছা, নমস্কার, আপনাকে অনেক কষ্ট দিলাম। এই বলিয়া সে চলিতে উদ্যত হইয়া কহিল, আচ্ছা, এমন ত হতে পারে, সে ব্যাটারা আজ আর কোন রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে?
ডাক্তার সায় দিয়া কহিলেন, বিচিত্র নয়।
অপূর্ব কহিল, নয়ই ত! আছেই!—আচ্ছা, নমস্কার! কিন্তু মজা দেখেছেন, যেখানে আসল দরকার সেখানে পুলিশের ছায়াটি পর্যন্ত দেখবার জো নেই। এই হল তাঁদের কর্তব্যজ্ঞান! আর এর জন্যই আমরা ট্যাক্স জুগিয়ে মরি। সমস্ত বন্ধ করে দেওয়া উচিত, কি বলেন?
তাতে আর সন্দেহ কি! বলিয়া ডাক্তার হাসিয়া ফেলিলেন। কহিলেন, চলুন, কথা কইতে কইতে আর খানিকটে আপনার সঙ্গে এগিয়ে যাই।
অপূর্ব লজ্জায় একেবারে ম্লান হইয়া গেল। একমুহূর্ত মাটির দিকে চাহিয়া আস্তে আস্তে বলিল, আমি বড্ড ভীতু লোক ডাক্তারবাবু, আমার কিচ্ছু সাহস নেই। আর কেউ হলে অনায়াসে যেতে পারতো, এত রাত্রে আপনাকে কষ্ট দিত না।
তাহার এই বিনয়-নম্র নিরভিমান সত্য-কথায় ডাক্তার নিজের হাসির জন্য নিজেও যেন লজ্জা পাইলেন। সস্নেহে তাহার কাঁধের উপর একটা হাত রাখিয়া কহিলেন, সঙ্গে যাবার জন্যেই আমি এসেচি অপূর্ববাবু, নইলে প্রেসিডেন্ট আমাকে এ জিনিসটা হাতে গুঁজে দিতেন না। এই বলিয়া তিনি বাঁ হাতের মোটা কালো লাঠিটা দেখাইলেন।
অপূর্ব চকিত হইয়া কহিল, সুমিত্রা? তিনি কি আপনাকেও আদেশ করতে পারেন?
ডাক্তার হাসিলেন, বলিলেন, পারেন বৈ কি।
অপূর্ব বলিল, কিন্তু তিনি ত অন্য লোকও সঙ্গে দিতে পারতেন?
ডাক্তার কহিলেন, তার মানে সবাইকে দল বেঁধে পাঠানো। তার চেয়ে এই ব্যবস্থাই সোজা হয়েছে অপূর্ববাবু।
চলিতে চলিতে কথা হইতেছিল। ডাক্তার কহিলেন, সুমিত্রা আমাদের দলের কর্ত্রী, তাঁকে সকল দিক চেয়ে দেখে কাজ করতে হয়। যেখানে ছুরি-ছোরা খুন-জখম লেগেই আছে সেখানে যাকে-তাকে ত পাঠানো যায় না। আমি উপস্থিত না থাকলে আজ আপনাকে থাকতে হতো,—তিনি কোনমতেই আসতে দিতেন না।
এই অন্ধকার জনহীন পথে ছুরি-ছোরার কথায় অপূর্বর সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়া গেল। আস্তে আস্তে কহিল, কিন্তু এই পথেই যে আপনাকে একাকী ফিরতে হবে!
ডাক্তার বলিলেন, তা হবে।
অপূর্ব আর প্রশ্ন করিল না। তাহাদের নিভৃত আলাপের গুঞ্জনশব্দ পাছে অবাঞ্ছিত কাহাকেও আকৃষ্ট করিয়া আনে এ খেয়াল তাহার মনের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। সে তাহার চক্ষু কর্ণ ও মনকে একই কালে রাস্তার দক্ষিণে বামে ও সম্মুখে একান্ত নিবিষ্ট করিয়া নিঃশব্দ দ্রুতপথে পথ চলিতে লাগিল। মিনিট-পনের এইভাবে চলিয়া শহরের প্রথম পুলিশ-স্টেশনটা ডানহাতে রাখিয়া লোকালয়ে প্রবেশ করিয়া অপূর্ব আবার কথা কহিল, বলিল, ডাক্তারবাবু, আমার বাসা ত বেশী দূরে নয়, আজ রাত্রিটা ওখানে থাকলে ক্ষতি কি?
ডাক্তার তাহার মনের কথা অনুমান করিয়া সহাস্যে কহিলেন, ক্ষতি ত অনেক জিনিসেই হয় না অপূর্ববাবু, কিন্তু বিনা প্রয়োজনেও কোন কাজ করা আমাদের বারণ। শুধু কেবল প্রয়োজন নেই বলেই আমাকে ফিরে যেতে হবে।
আপনারা কি অপ্রয়োজনে জগতে কিছুই করেন না?
করা বারণ। আমি তাহলে বিদায় হই অপূর্ববাবু?
অপূর্ব কটাক্ষে পশ্চাতের সমস্ত অন্ধকার পথটার প্রতি চাহিয়া এই লোকটিকে একাকী ফিরিয়া যাইতে কল্পনা করিয়া আর একবার কণ্টকিত হইয়া উঠিল। কহিল, ডাক্তারবাবু, মানুষের মর্যাদা রক্ষা করাও কি আপনাদের বারণ?
ডাক্তার আশ্চর্য হইয়া প্রশ্ন করিলেন, হঠাৎ এ কথা কেন?
অপূর্ব ক্ষুণ্ণ অভিমানের সুরে বলিল, তা ছাড়া আর কি বলুন? আমি ভীতু লোক, দলবদ্ধ গুণ্ডাদের মধ্যে দিয়ে একলা যেতে পারিনে,—আমাকে নিরাপদে পৌঁছে দিয়ে সেই বিপদের ভেতর দিয়ে আপনি যদি আজ একাকী ফিরে যান, আর কি আমি মুখ দেখাতে পারবো?
ডাক্তার চক্ষের নিমিষে তাহার দুই হাত সস্নেহে ধরিয়া ফেলিয়া কহিলেন, আচ্ছা চলুন তবে আজ রাত্রির মত আপনার বাসাতে গিয়েই অতিথি হই গে। কিন্তু এ-সব হাঙ্গামা কি সহজে নিতে আছে ভাই !
কথাটা অপূর্ব ঠিক বুঝিল না, কিন্তু কয়েক পদ অগ্রসর হইতেই হাতের মধ্যে কেমনতর একপ্রকার টান অনুভব করিয়া ফিরিয়া চাহিয়াই কহিল, আপনার জুতোয় বোধ করি লাগছে ডাক্তারবাবু, আপনি খোঁড়াচ্চেন!
ডাক্তার মৃদু হাসিয়া বলিলেন, ও কিছু না। লোকালয়ে আমার পা-দুটো কেমন আপনিই খুঁড়িয়ে চলে। গিরীশ মহাপাত্রের চলন মনে পড়ে?
অপূর্ব থমকিয়া দাঁড়াইল। কহিল, আপনাকে যেতে হবে না, ডাক্তারবাবু।
ডাক্তার তেমনি মৃদু হাসিয়া বলিলেন, কিন্তু আপনার মর্যাদা?
অপূর্ব বলিল, আপনার কাছে আবার মর্যাদা কি? পায়ের ধূলোর যোগ্যও ত নই। আপনি ছাড়া পৃথিবীতে কি আর কারও এতবড় সাহস আছে!
এই ডাক্তার-ব্যক্তিটির জীবন-ইতিহাসের সহিত অপূর্বর প্রত্যক্ষ পরিচয় কিছুই ছিল না। থাকিলে সে এই অত্যন্ত ক্ষুদ্র ব্যাপার লইয়া এতখানি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করিতে লজ্জায় মরিয়া যাইত। সমুদ্রের কাছে গোষ্পদের ন্যায় এই পথটুকুতে একাকী হাঁটা এই লোকটির কাছে কি! পুলিশের লোকে যাহাকে সব্যসাচী বলিয়া জানে, দশ-বারোজন দুর্বৃত্তে মিলিয়া তাহার পথরোধ করিবে কি করিয়া?
ডাক্তার মুখ ফিরাইয়া হাসি গোপন করিয়া শেষে ভাল মানুষটির মত কহিলেন, আচ্ছা, তার চেয়ে চলুন না কেন দুজনেই আবার একসঙ্গে ফিরে যাই? আমাকে একলা যদি বা কেউ আক্রমণ করতে সাহস করে আপনি কাছে থাকলে ত সে সম্ভাবনা থাকবে না!
অপূর্ব অনিশ্চিতকন্ঠে বলিল, আবার ফিরে যাবো?
ডাক্তার বলিলেন, দোষ কি? আমার একলা যাবার বিপদের শঙ্কাও থাকবে না।
থাকবো কোথায়?
আমার কাছে।
আফিস হইতে ফিরিয়া আজ অপূর্বর খাওয়া হয় নাই, তাহার অত্যন্ত ক্ষুধাবোধ হইতেছিল, একটু লজ্জিত হইয়া কহিল, দেখুন, আমার কিন্তু এখনো খাওয়া হয়নি,—আচ্ছা, তা না হয় আজ—
ডাক্তার হাসিমুখে বলিলেন, চলুন না, ভাগ্য পরীক্ষা করে আজ দেখাই যাক। কিন্তু একটা কথা, তেওয়ারী বেচারা বড় চিন্তিত হয়ে থাকবে।
তেওয়ারীর উল্লেখে অপূর্বর মনের মধ্যে হঠাৎ একটা হিংস্র প্রতিশোধের বাসনা প্রবল হইয়া উঠিল, রাগ করিয়া বলিল, মরুক গে ব্যাটা ভেবে,—চলুন যাই। এই বলিয়া সে একরকম জোর করিয়াই তাঁহাকে বাধা দিয়া সেই আলো-আঁধারের জনশূন্য-পথে উভয়ে হাঁটিতে হাঁটিতে আবার ফিরিয়া চলিল। এবার কিন্তু ভয়ের কথা তাহার মনেই হইল না। পুলিশ থানা পার হইয়া সহসা একসময়ে সে প্রশ্ন করিয়া বসিল, আচ্ছা ডাক্তারবাবু, আপনি কি এ্যানার্কিস্ট?
ডাক্তার অন্ধকারে তাহার মুখের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনার কাকাবাবু কি বলেন?
অপূর্ব কহিল, তিনি বলেন সব্যসাচী একজন ভয়ানক এ্যানার্কিস্ট।
আমি যে সব্যসাচী এ-সম্বন্ধে আপনার কোন সন্দেহ নেই?
না।
এ্যানার্কিস্ট বলতে আপনি কি বুঝেন?
অপূর্ব এ প্রশ্নের হঠাৎ জবাব দিতে পারিল না। একটু ভাবিয়া কহিল, অর্থাৎ কিনা রাজদ্রোহী—যিনি রাজার শত্রু।
ডাক্তার বলিলেন, আমাদের রাজা এদেশে থাকেন না, থাকেন বিলাতে। লোকে বলে অতিশয় ভদ্রলোক। আমি তাঁকে কখনো চোখে দেখিনি, তিনিও আমার কখনো লেশমাত্র ক্ষতি করেন নি। তাঁর প্রতি বৈরীভাব আসবে আমার কোথা থেকে অপূর্ববাবু!
অপূর্ব কহিল, যাদের আসে, তাদেরই বা কি করে আসে বলুন! তাদেরও ত তিনি কোন অনিষ্ট করেন নি!
ডাক্তার সবেগে মাথা নাড়িয়া কহিলেন, তাই, আপনি যা বলছেন এদেশে তা নেই একেবারে মিছে কথা!
তাঁহার কণ্ঠস্বরের প্রবলতায় ও অস্বীকার করিবার তীব্রতায় অপূর্ব চমকিয়া গেল। অবিশ্বাস করিবার সাহস তাহার হইল না। অথচ, দেশে কিছু যে একটা আছেই, ছেলেবেলা তাহারও গায়ে যে ইহার আঁচ লাগিয়া গেছে, এবং ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বাবা না থাকিলে কোথাকার জল যে কোথায় গিয়া গড়াইতে পারিত, ইহা সে বড়-বয়সে পদে পদে অনুভব করিয়াছে। একটু ভাবিয়া কহিল, রাজা না হোন রাজকর্মচারীদের বিরুদ্ধে যে একটা ষড়যন্ত্র ছিল এ কথা ত মিথ্যা নয় ডাক্তারবাবু?
ডাক্তার অনেকক্ষণ কোন উত্তর দিলেন না, তারপরে ধীরে ধীরে বলিলেন, কর্মচারীরা রাজার ভৃত্য, মাইনে পায়, হুকুম পালন করে। একজন যায় আর একজন আসে। এটা সহজ এবং মোটা কথা। কিন্তু এই সহজকে জটিল এবং মোটাকে নিরর্থক সূক্ষ্ম করে মানুষে যখন দেখতে চায়, তখনই তার সবচেয়ে বড় ভুল হয়। সেইজন্যে তাদের আঘাত করাকেই রাজশক্তির মূলে আঘাত করা বলে আত্মবঞ্চনা করে। এতবড় মারাত্মক ব্যর্থতা আর নেই।
অপূর্ব একটু চুপ করিয়া কহিল, কিন্তু এই ব্যর্থ কাজ করবার লোক কি ভারতবর্ষে নেই?
ডাক্তার শান্তভাবে কহিলেন, হয়ত থাকতেও পারে।
কিন্তু অপূর্ব সহসা আগ্রহান্বিত হইয়া উঠিল, জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা ডাক্তারবাবু, এঁরা সব আজকাল কোথায় থাকেন এবং কি করেন?
তাহার ঔৎসুক্য ও ব্যগ্রতায় ডাক্তার শুধু মুচকিয়া হাসিলেন।
অপূর্ব কহিল, হাসলেন যে?
ডাক্তার তেমনি হাসিমুখে বলিলেন, আপনার সেই কাকাবাবুটি উপস্থিত থাকলে কিন্তু বুঝতেন। আপনার বিশ্বাস আমি একজন এ্যানার্কিস্টদের পাণ্ডা। তার মুখ থেকে কি এর জবাব আশা করতে আছে অপূর্ববাবু?
নিজের বুদ্ধিহীনতার এই সুস্পষ্ট ইঙ্গিতে অপূর্ব অপ্রতিভ হইল, মনে মনে একটু রাগও করিল, কহিল, আশা করা সম্পূর্ণই অনুচিত হতো আজ যদি না আমাকে দলভুক্ত করে নিতেন। মেম্বরদের এটুকু জানবার অধিকার আছে, এ বোধ করি আপনি অস্বীকার করেন না। এ ত ছেলেখেলা নয়, ভীষণ দায়িত্ব আছে যে!
আছেই ত। বলিয়া ডাক্তারবাবু হাসিলেন। এই সুমিষ্ট হাসি ও নিরাতঙ্ক সহজ উক্তি ঠিক ব্যঙ্গোক্তির মতই অপূর্বর কানে বাজিল। বিদ্রোহী দলের বাঁধানো খাতায় যাহার নাম লেখা হইল তাহার প্রশ্নের এই উত্তর? এর বেশি জানিবার তাহার প্রয়োজন নাই! মনে মনে ভীত ও ক্রুদ্ধ হইয়া এই লোকটিকে আজ সে ভুল বুঝিল, কিন্তু এই ভুল সংশোধন করিয়া পরবর্তীকালে বহুবারই তাহাকে দেখিতে হইয়াছে কোন অবস্থায় কোন কারণেই ইঁহার মুখের হাসি উদ্বেগে এবং গলার স্বর উত্তেজনায় চঞ্চল হইয়া উঠে না।
নিঃশব্দ গাম্ভীর্যে ডাক্তারের এই সামান্য সংক্ষিপ্ত জবাবটাকে সে প্রতিঘাত করিতে চাহিয়া নিরুত্তরে পথ চলিতে লাগিল, কিন্তু অধিকক্ষণ থাকিতে পারিল না,—ওই ছোট্ট কথাটুকুর নিদারুণ তীক্ষ্ণতা তীরের ফলাটুকুর মতই যেন তাহার বুকে বিঁধিতে লাগিল। তিক্তকণ্ঠে কহিল, দলের খাতায় তাড়াতাড়ি নাম লিখে নিলেই ত হয় না, তার ফলাফল বুঝিয়েও দিতে হয়।
কিন্তু সে কি তাঁরা দেননি?
অপূর্ব কহিল, কিছুই না। পথের-দাবী না পথের-দাবী! দাবীর বহর যে এত, তা কে জানতো? আর আপনিও ত ছিলেন, নাম লেখবার পূর্বে আপনারও ত জানা উচিত ছিল আমার যথার্থ মতামত কি!
ডাক্তার একটু লজ্জিত হইয়া বলিলেন, মেয়েরা একটা ব্যাপার করেছেন, তাঁরাই জানেন কাকে মেম্বর করবেন এবং কাকে করবেন না। আমি হঠাৎ জুটে গেছি মাত্র। বাস্তবিকই আমি এঁদের সভার বিশেষ কিছু জানিনে অপূর্ববাবু!
অপূর্ব বুঝিল ইহাও পরিহাস। উৎকণ্ঠায় ও আশঙ্কায় সমস্ত জিনিসটাই তাহার অত্যন্ত বিশ্রী লাগিতেছিল, আপনাকে সে আর সংবরণ করিতে পারিল না, জ্বলিয়া উঠিয়া কহিল, কেন ছলনা করচেন ডাক্তারবাবু, সুমিত্রাকেই প্রেসিডেন্ট করুন, আর যাকেই যা করুন, দল আপনার এবং আপনিই এর সব, তাতে লেশমাত্র সন্দেহ নেই। পুলিশের চোখে ধূলো দিতে পারবেন কিন্তু আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবেন না, এ আপনি নিশ্চয় জানবেন।
তাহার কথা শুনিয়া এইবার এই শীর্ণদেহ রহস্যপ্রিয় লোকটি অকৃত্রিম বিস্ময়ে দুই চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া কহিলেন, আমার দল মানে এ্যানার্কিস্টের দল ত? আপনি মিথ্যে শঙ্কিত হয়ে উঠেছেন অপূর্ববাবু, আপনার আগাগোড়া ভুল হয়েছে। তাদের হল জীবন-মৃত্যুর খেলা, তারা আপনার মত ভীতু লোককে দলে নেবে কেন? তারা কি পাগল?
অপূর্ব লজ্জায় এতটুকু হইয়া গেল, কিন্তু তাহার বুকের উপর হইতে গুরুভার পাষাণ নামিয়া গেল। ডাক্তার কহিলেন, পথের-দাবী নাম দিয়ে সুমিত্রা এই ছোট্ট দলটির প্রতিষ্ঠা করেচেন। জীবন-যাত্রায় মানুষের পথ চলবার অধিকার যে কত বড় এবং কত পবিত্র এই মস্ত সত্যটাই মানুষে যেন ভুলে গেছে। আপনারা, অর্থাৎ দলের সভ্য যাঁরা, তাঁরা নিজেদের সমস্ত জীবন দিয়ে এই কথাটাই মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিতে চান। সুমিত্রা অনুরোধ করলেন আমি যে কয়দিন এখানে আছি তাঁর দলটিকে যেন গড়ে দিয়ে যাই। আমি রাজী হয়েছি,—এ ছাড়া আপনাদের সঙ্গে আমার কোন সম্বন্ধ নেই।
আপনারা হলেন সমাজ-সংস্কারক, কিন্তু আমার সমাজ সংস্কার করে বেড়াবার সময়ও নেই, ধৈর্যও নেই। হয়ত, কিছুদিন আছি, হয়ত, কালই চলে যেতে পারি; সারাজীবনে আর কখনো দেখাও না হতে পারে। বেঁচে আছি কি নেই, এটুকু খবরও হয়ত আপনাদের কানে পৌঁছবে না।
কথাগুলি শান্ত, ধীর,—উচ্ছ্বাস বা আবেগের বাষ্পও নাই। এই ব্যক্তি যেই হউক, কিন্তু সব্যসাচীর যে বিবরণ অপূর্ব কাকাবাবুর মুখে শুনিয়াছে, সেই-সব দপ্ করিয়া মনে পড়িয়া তাহার বুকের কোথায় যেন খোঁচার মত বিঁধিল। কিন্তু তখনি মনে হইল, সে ত পাষাণ,—তাহার জন্য আবার বেদনাবোধ কি? ক্ষণকাল পরে জিজ্ঞাসা করিল, ডাক্তারবাবু, সুমিত্রা কে? আপনি তাঁকে জানলেন কি করে?
প্রত্যুত্তরে ডাক্তার শুধু একটুখানি হাসিলেন। উত্তর না পাইয়া অপূর্ব নিজেই বুঝিল এরূপ কৌতূহল সঙ্গত হয় নাই। এই অল্পকালের মধ্যেই সে এই রহস্যময় বিচিত্র সমাজের আচরণের বিশিষ্টতা লক্ষ্য করিতেছিল, তাই সে ভারতীর সম্বন্ধেও তাহার প্রবল কৌতূহলও সংবরণ করিয়া মৌন হইয়া রহিল।
মিনিট পাঁচ-ছয় এইভাবে নিঃশব্দে কাটিলে ডাক্তার প্রথমে কথা কহিলেন, বলিলেন, আপনার কল্যাণেই বোধ হয় রাস্তা আজ একেবারে নিরাপদ। এমন প্রায় ঘটে না, কিন্তু কি ভাবচেন বলুন ত?
অপূর্ব বলিল, ভাবচি ত অনেক-কিছু, কিন্তু সে যাক। আচ্ছা, আপনি বললেন মানুষের নির্বিঘ্নে পথ চলবার অধিকার। এই যেমন আমরা নির্বিঘ্নে পথ চলচি,—এমনি?
ডাক্তার সহাস্যে কহিলেন, এমনিই কিছু একটা হবে বোধ হয়।
অপূর্ব কহিল, ওই যে মেয়েটি স্বামী পরিত্যাগ করে পথের-দাবীর সভ্য হতে এসেছেন, ওটাও ঠিক বুঝলাম না।
ডাক্তার কহিলেন, আমিও যে ঠিক বুঝেছি তা বলতে পারিনে। ও-সব ব্যাপার সুমিত্রাই বোঝেন ভাল।
অপূর্ব প্রশ্ন করিল, তাঁর বোধ হয় স্বামী নেই?
ডাক্তার চুপ করিয়া রহিলেন। অপূর্বকে লজ্জা ও ক্ষোভের সহিত পুনরায় স্মরণ করিতে হইল তাহার অহেতুক ঔৎসুক্যের তিনি জবাব দিলেন না। এবং এই কথা অলক্ষ্যে যাচাই করিতে সে সঙ্গীর মুখের দিকে কটাক্ষে চাহিয়া কিন্তু একেবারে বিস্মিত হইয়া গেল। তাহার মনে হইল, এই আশ্চর্য মানুষটির অপরিজ্ঞাত জীবনের একটা নিভৃত দিক যেন সে হঠাৎ দেখিতে পাইল। সে ঠিক কি—তাহা বলা কঠিন, কিন্তু এখন পর্যন্ত যাহা কিছু জানিয়াছে সে তাহার অতীত, যেন কোন্ বহুদূরাঞ্চলে তাঁহার চিন্তা সরিয়া গেছে, কাছাকাছি কোথাও আর নাই। অনতিদূরবর্তী ল্যাম্পপোস্ট হইতে কিছুক্ষণ হইতেই একটা ক্ষীণ আলোক ইঁহার মুখের উপরে পড়িয়াছিল, পাশ দিয়া যাইবার সময় অপূর্ব স্পষ্ট দেখিতে পাইল এই ভয়ঙ্কর-সতর্ক লোকটির চোখের উপরে একটা ঝাপসা জাল ভাসিয়া বেড়াইতেছে—এই মুহূর্তের জন্য যেন তিনি সমস্ত ভুলিয়া মনে মনে কি একটা খুঁজিয়া বেড়াইতেছেন।
অপূর্ব দ্বিতীয় প্রশ্ন করে নাই, নীরবে পথ চলিতেছিল, কিন্তু মিনিট-দু’য়ের বেশী হইবে না, অকস্মাৎ, অকারণেই হাসিয়া উঠিয়া ডাক্তার বলিলেন, দেখুন অপূর্ববাবু, আপনাকে আমি সত্যই বলচি, মেয়েদের এই-সব প্রণয়ঘটিত মান-অভিমানের ব্যাপার আমি কিছুই বুঝিনে। বোঝবার চেষ্টা করতে গেলেও নিরর্থক ভারী সময় নষ্ট হয়। কোথায় পাই এত সময়?
অপূর্বর প্রশ্নের ইহা উত্তর নয়, সে চুপ করিয়া রহিল। ডাক্তার কহিলেন, ভারী মুশকিল, এঁদের বাদ দিয়ে কাজও চলে না, নিলেও গণ্ডগোল বাধে।
এ মন্তব্যও অসংবদ্ধ। অপূর্ব নিরুত্তরেই রহিল।
কি হল? কথা কন না যে বড়?
অপূর্ব কহিল, কি বলব বলুন!
ডাক্তার কহিলেন, যা ইচ্ছে। দেখুন অপূর্ববাবু, এই ভারতীটি বড় ভাল মেয়ে। যেমন বুদ্ধিমতী, তেমনি কর্মঠ এবং তেমনি ভদ্র।
ইহাও বাজে। কিন্তু প্রত্যুত্তরে এ প্রশ্ন সে ইচ্ছা করিয়াই করিল না যে, আপনি তাহাকে কতদিন হইতে জানিলেন এবং কি করিয়া জানিলেন। শুধু বলিল, হাঁ। কিন্তু শ্রোতার যদি এদিকে কিছুমাত্র খেয়াল থাকিত ত অপূর্বর মুখ হইতে এই এক অক্ষরের জবাবে অত্যন্ত বিস্মিত হইয়া যাইতেন। কিন্তু তিনি যে বিমনা হইয়াই আলাপ করিতেছিলেন, অপূর্বকে তাহা আর নূতন করিয়া বুঝিতে হইল না। বক্তা বোধ করি তাঁহার শেষ-কথারই সূত্র ধরিয়া কহিলেন, আপনাদের প্রসঙ্গেই কথা কইতে তিনি আপনার সম্বন্ধে বলছিলেন, আপনি নাকি ভয়ানক হিন্দু,—একেবারে গোঁড়া। ভারতী বলছিলেন, এতবড় ভয়ঙ্কর হিঁদু বামুনেরও তিনি জাত মেরে দিয়েছেন।
অপূর্ব বলিল, তা হবে। এই একান্ত অন্যমনস্ক লোকটির সহিত তর্ক করিতে তাহার ইচ্ছাই হইল না। বড় রাস্তা প্রায় শেষ হইয়া আসিল, গলির মোড়ে সামনাসামনি আলো-দুইটা সম্মুখেই দেখা দিল, আর মিনিট-দশেকের মধ্যেই গন্তব্যস্থানে পৌঁছানো যাইবে, এমনি সময়ে ডাক্তার তাঁহার ঘুমন্ত মনটাকে যেন অকস্মাৎ ঝাড়া দিয়া একেবারে সজাগ করিয়া দিলেন, কহিলেন, অপূর্ববাবু!
অপূর্ব তাঁহার কণ্ঠস্বরের তীক্ষ্ণতায় নিজেও সচেতন হইয়া উঠিল, কহিল, বলুন।
ডাক্তার বলিলেন, এদেশে আমি থাকা পর্যন্ত কাজ নেই, কিন্তু চলে গেলে আপনি নিঃসঙ্কোচে সুমিত্রাকে সাহায্য করবেন। এমন মানুষ আপনি পৃথিবী ঘুরে বেড়ালেও কখনো পাবেন না। এঁর পথের-দাবী যেন অনাদরে অবহেলায় না মারা পড়ে। এতবড় একটা আইডিয়া কি কেবল এই ক’টি মেয়েমানুষেই সার্থক করে তুলতে পারবে! আপনার একনিষ্ঠ সেবার একান্ত প্রয়োজন।
এই ব্যক্তির ধারণায় সে যে সত্যই এতবড় লোক অপূর্ব তাহা প্রত্যয় করিল না। কহিল, এতবড় একটা আইডিয়াকে তবে আপনিই বা ফেলে যেতে চাচ্চেন কেন?
ডাক্তার কহিলেন, অপূর্ববাবু, যেখানে ফেলে যাওয়াই মঙ্গল, সেখানে আঁকড়ে থাকাতেই অকল্যাণ। আমার সাহায্যে আপনাদের কাজ নেই,—আপনারা নিজেরাই এটা গড়ে তুলুন, হয়ত বা এর ভেতর দিয়েই দেশের সব চেয়ে বড় কাজ হবে।
অপূর্ব কহিল, নবতারার ব্যাপারটা ত আমি বিশ্বাস করতে পারিনে ডাক্তারবাবু!
ডাক্তার বলিলেন, কিন্তু সুমিত্রাকে বিশ্বাস করবেন। বিশ্বাসের এতবড় উঁচু জায়গা আর কোথাও পাবেন না, অপূর্ববাবু। একটুখানি থামিয়া কহিলেন, আপনাকে ত আমি পূর্বেই বলেচি, মেয়েদের ব্যাপার আমি বুঝতে পারিনে; কিন্তু সুমিত্রা যখন বলেন, জীবনযাত্রায় মানবের পথ চলবার বাধাবন্ধহীন স্বাধীন অধিকার, তখন এ দাবীকে ত কোন যুক্তি দিয়েই ঠেকিয়া রাখতে পারিনে। শুধু ত মনোহরের নয়, বহুলোকের নির্দিষ্ট পথে চলায় নবতারার জীবনটা নির্বিঘ্নে হতো, এ আমি বুঝি, এবং যে পথটা সে নিজে বেছে নিলে সে পথটাও নিরাপদ নয়, কিন্তু নিজে বিপদের মাঝখানে ডুবে থেকে আমিই বা তাকে বিচার করবো কি দিয়ে বলুন ! সুমিত্রা বলেন, এ জীবনটা নির্বিঘ্নে কাটাতে পারাটাই কি মানুষের চরম কল্যাণ? মানুষের চিন্তা এবং প্রবৃত্তিই তার কর্মকে নিয়ন্ত্রিত করে, কিন্তু পরের নির্ধারিত চিন্তা ও প্রবৃত্তিকে দিয়ে সে যখন তার নিজের স্বাধীন চিন্তার মুখ চেপে ধরে তখন তার চেয়ে বড় আত্মহত্যা মানুষের ত আর হতেই পারে না।
এ কথার ত কোন জবাব আমি খুঁজে পাইনে অপূর্ববাবু।
অপূর্ব বলিল, কিন্তু সবাই যদি নিজের চিন্তার মত—
ডাক্তার বাধা দিয়া কহিলেন, অর্থাৎ সবাই যদি নিজের খেয়াল মত কাজ করতে চায়?—বলিয়াই একটু মুচকিয়া হাসিয়া কহিলেন, তাহলে কি কাণ্ড হয় আপনি সুমিত্রাকে একবার জিজ্ঞাসা করবেন।
অপূর্ব তাহার প্রশ্নের ভুলটা বুঝিতে পারিয়া সলজ্জে সংশোধন করিতে যাইতেছিল, কিন্তু সময় হইল না। ডাক্তার পুনশ্চ বাধা দিয়া কহিলেন, কিন্তু তর্ক আর চলবে না, অপূর্ববাবু, আমরা এসে পড়েচি। আর একদিন না হয় এ আলোচনার শেষ করা যাবে।
অপূর্ব সুমুখে চাহিয়া দেখিল, সেই লাল রঙের বিদ্যালয়-গৃহ, এবং তাহার দ্বিতলে ভারতীর ঘর হইতে তখনও আলো দেখা যাইতেছে।
ডাক্তার ডাকিলেন, ভারতী ।
ভারতী জানালায় মুখ বাহির করিয়া ব্যগ্রস্বরে কহিল, বিজয়ের সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছে ডাক্তারবাবু? আপনাকে সে ডাকতে গিয়েছে।
ডাক্তার হাসিয়া বলিলেন, তোমাদের প্রেসিডেন্টের আদেশ ত? কিন্তু কোন হুকুমই এত রাত্রে ও-পথে কাউকে পাঠাতে পারবে না। কিন্তু কাকে ফিরিয়ে এনেছি দেখেচ?
ভারতী ঠাওর করিয়া দেখিয়া অন্ধকারেও চিনিতে পারিল। কহিল, ভাল করেন নি।
আপনি কিন্তু শীঘ্র যান, নরহরি মদ খেয়ে তার হৈমর মাথায় কুড়ুল মেরেচে,—বাঁচে কিনা সন্দেহ। সুমিত্রাদিদি সেখানেই গেছেন।
ডাক্তার কহিলেন, ভালই ত করেচে। মরে ত সে মরুক না। কিন্তু আমার অতিথি?
ভারতী বলিল, মেয়েদের প্রতি আপনার অসীম অনুগ্রহ। এটা কিন্তু হৈম না হয়ে নরহরি হলে আপনি এতক্ষণ ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়তেন।
ডাক্তার কহিলেন, না হয় ঊর্ধ্বশ্বাসেই দৌড়চ্চি। কিন্তু অতিথি?
আমি যাচ্চি, বলিয়া ভারতী আলো হাতে পরক্ষণেই নীচে আসিয়া দ্বার খুলিয়া দাঁড়াইল, কহিল, বাস্তবিক আর দেরি করবেন না ডাক্তারবাবু, যান। কিন্তু খ্রীষ্টানের আতিথ্য কি উনি স্বীকার করবেন?
ডাক্তার মনে মনে একটু বিপদগ্রস্ত হইয়া কহিলেন, এঁকে ফেলে আমি যাই কি করে ভারতী? হাসপাতালে পাঠাবার ব্যবস্থা করনি কেন?
ভারতী রাগ করিয়া কহিল, যা করতে হয় করুন গে ডাক্তারবাবু, আপনার পায়ে পড়ি আর দেরি করবেন না। আমার অনেক অভ্যাস আছে, ওঁকে আমি সামলাতে পারবো। আপনি দয়া করে একটু শীঘ্র যান।
অপূর্ব এতক্ষণ চুপ করিয়াই ছিল। কিন্তু, তাহার জন্য একটা লোক মারা পড়িবে ইহা ত কোন মতেই হইতে পারে না। সে কি একটা বলিতে গেল, কিন্তু তাহার পূর্বেই ডাক্তার দ্রুতবেগে অন্ধকারে অদৃশ্য হইয়া গেলেন।