পথের কাঁটা – ০২
২
বৈকালে প্রায় সাড়ে তিনটার সময় ব্যোমকেশ বাহির হইয়া গিয়াছিল। কি কাজে গিয়াছিল, জানি না। যখন ফিরিল, তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে; আমি তাহার জন্য প্রতীক্ষা করিতেছিলাম, চায়ের সরঞ্জামও তৈয়ার ছিল, সে আসিতেই ভৃত্য টেবিলের উপর চা-জলখাবার দিয়া গেল। আমরা নিঃশব্দে জলযোগ সমাধা করিলাম। এমন অভ্যাস হইয়া গিয়াছিল, ঐ কার্যটা একত্র না করিলে মনঃপূত হইত না।
একটা চুরুট ধরাইয়া, চেয়ারে ঠেসান দিয়া বসিয়া ব্যোমকেশ প্রথম কথা কহিল; বলিল–“আশুবাবু লোকটিকে তোমার কেমন মনে হয়?”
ইষৎ বিস্মিতভাবে বলিলাম–“কেন বল দেখি? আমার তো ভাল লোক বলেই মনে হয়–নিরীহ ভালমানুষ গোছের–”
ব্যোমকেশ বলিল–“আর নৈতিক চরিত্র?”
আমি বলিলাম–“মাতাল ভাইপোর উপর যে রকম চটা, তাতে নৈতিক চরিত্র তো ভাল বলেই মনে হয়। তার ওপর বয়স্ক লোক। বিয়ে করেননি, যৌবনে যদি কিছু উচ্ছৃঙ্খলতা করে থাকেন তো অন্য কথা; কিন্তু এখন আর ওঁর সে সব করবার বয়স নেই।”
ব্যোমকেশ মুচকি হাসিয়া বলিল–“বয়স না থাকতে পারে, কিন্তু একটি স্ত্রীলোক আছে। জোড়াসাঁকোর যে গানের মজলিসে আশুবাবু নিত্য গানবাজনা করে থাকেন, সেটি ঐ স্ত্রীলোকের বাড়ি। স্ত্রীলোকের বাড়ি বললে বোধ হয় ঠিক বলা হয় না, কারণ, বাড়ির ভাড়া আশুবাবুই দিয়ে থাকেন এবং গানের মজলিস বললেও বোধ হয় ভুল বলা হয়, যেহেতু দু’টি প্রাণীর বৈঠককে কোন মতেই মজলিস বলা চলে না।”
“বল কি হে! বুড়োর প্রাণে তো রস আছে দেখছি।”
“শুধু তাই নয়, গত বারো তের বছর ধরে আশুবাবু এই নাগরিকাটির ভরণ-পোষণ করে আসছেন, সুতরাং তাঁর একনিষ্ঠতা সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ থাকতে পারে না। আবার অন্য পক্ষেও একনিষ্ঠতার অভাব নেই, আশুবাবু ছাড়া অন্য কোনও সঙ্গীত-পিপাসুর সেখানে প্রবেশাধিকার নেই; দরজায় কড়া পাহাড়া।”
উৎসুক হইয়া বলিলাম–“তাই না কি? সঙ্গীত-পিপাসু সেজে ঢোকবার মতলব করেছিলে বুঝি? নাগরিকাটির দর্শন পেলে? কি রকম দেখতে শুনতে?”
ব্যোমকেশ বলিল–“একবার চকিতের ন্যায় দেখা পেয়েছিলুম। কিন্তু রূপবর্ণনা করে তোমার মত কুমার-ব্রহ্মচারীর চিত্তচাঞ্চল্য ঘটাতে চাই না। এক কথায়, অপূর্ব রূপসী। বয়স ছাব্বিশ সাতাশ, কিন্তু দেখে মনে হয়, বড় জোর উনিশ কুড়ি। আশুবাবুর রুচির প্রশংসা না করে থাকা যায় না।”
আমি হাসিয়া বলিলাম–“তা তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু তুমি হঠাৎ আশুবাবুর গুপ্ত জীবন সম্বন্ধে এত কৌতূহলী হয়ে উঠলে কেন?”
ব্যোমকেশ বলিল–“অপরিমিত কৌতুহল আমার একটা দুর্বলতা। তা ছাড়া, আশুবাবুর উইলের ওয়ারিস সম্বন্ধে মনে একটা খটকা লেগেছিল–”
“ইনিই তাহলে আশুবাবুর উত্তরাধিকারিণী?”
“সেই রকমই অনুমান হচ্ছে। সেখানে একটি ভদ্রলোকের দেখা পেলুম; ফিটফাট বাবু, বয়েস পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ, দ্রুতবেগে এসে দারোয়ানের হাতে একখানা চিঠি গুঁজে দিয়ে দ্রুতবেগে চলে গেলেন। কিন্তু ও কথা যাক্। বিষয়টা মুখরোচক বটে, কিন্তু লাভজনক নয়।”
ব্যোমকেশ উঠিয়া ঘরময় পায়চারি করিতে লাগিল।
বুঝিলাম, অবান্তর আলোচনায় আকৃষ্ট হইয়া পাছে তাহার মন প্রকৃত অনুসন্ধানের পথ হইতে বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়ে, পাছে আশুবাবুর জীবনের গোপন ইতিহাস তাঁহার উপস্থিত বিপদ ও বিপন্মুক্তির সমস্যা অপেক্ষা বড় হইয়া উঠে, এই ভয়ে ব্যোমকেশও আলোচনাটা আর বাড়িতে দিল না। এমনিভাবেই যে মানুষে মন নিজের অজ্ঞাতসারে গৌণবস্তুকে মুখ্যবস্তু অপেক্ষা প্রধান করিয়া তুলিয়া শেষে লক্ষ্যভ্রষ্ট হইয়া পড়ে, তাহা আমারও অজ্ঞাত ছিল না। আমি তাই জিজ্ঞাসা করিলাম–“ঘড়িটা থেকে কিছু পেলে?”
ব্যোমকেশ আমার সম্মুখে দাঁড়াইয়া মৃদুহাস্যে বলিল–“ঘড়ি থেকে তিনটি তত্ত্ব লাভ করেছি। এক–গ্রামোফোন পিনটি সাধারণ এডিসন্-মার্কা পিন, দুই–তার ওজন দু’ রতি তিন–আশুবাবুর ঘড়িটা একেবারে গেছে, আর মেরামত হবে না।”
আমি বলিলাম–“তার মানে দরকারী তথ্য কিছুই পাওনি।”
ব্যোমকেশ চেয়ার টানিয়া বসিয়া বলিল–“তা বলতে পারি না। প্রথমত বুঝতে পেরেছি যে, পিন ছোঁড়বার সময় হত্যাকারী আর হত ব্যক্তির মধ্যে ব্যবধান সাত আট গজের বেশি হবে না। একটা গ্রামোফোন পিন এত হাল্কা জিনিস যে, সাত আট গজের বেশি দূর থেকে ছুঁড়লে অমন অব্যর্থ-লক্ষ্য হতে পারে না। অথচ হত্যাকারীর টিপ কি রকম অভ্রান্ত, তা তো দেখছ। প্রত্যেকবার তীর একেবারে মর্মস্থানে গিয়ে ঢুকেছে।”
আমি বিস্মিত অবিশ্বাসের সুরে বলিলাম–“সাত আট গজ দূর থেকে মেরেছে, তবু কেউ ধরতে পারলে না?”
ব্যোমকেশ বলিল–“সেইটেই হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রধান প্রহেলিকা। ভেবে দেখ, খুন করবার পর লোকটা হয়তো দর্শকদের মধ্যেই ছিল, হয়তো নিজের হাতে তুলে মৃতদেহ স্থানান্তরিত করেছে; কিন্তু তবু কেউ বুঝতে পারলে না, কি করে সে এমনভাবে আত্মগোপন করলে?”
আমি অনেকক্ষণ চিন্তা করিয়া কহিলাম–“আচ্ছা, এমন তো হতে পারে, হত্যাকারী পকেটের ভিতর এমন একটা যন্ত্র নিয়া বেড়ায়–যা থেকে গ্রামোফোন পিন ছোঁড়া যায়। তারপর তার শিকারের সামনে এসে পকেট থেকেই যন্ত্রটা ফায়ার করে। পকেটে হাত দিয়ে অনেকেই রাস্তায় চলে, সুতরাং কারু সন্দেহ হয় না।”
ব্যোমকেশ বলিল–“তা যদি হত, তাহলে ফুটপাথের ওপরেই তো কাজ সারতে পারত। রাস্তায় নামতে হয় কেন? তা ছাড়া, এমন কোন যন্ত্র আমার জানা নেই–যা নিঃশব্দে ছোঁড়া যায় অথচ তার নিক্ষিপ্ত গুলি একটা মানুষের শরীর ফুটো করে হৃৎপিণ্ডে গিয়ে পৌঁছতে পারে। তাতে কতখানি শক্তির দরকার, ভেবে দেখেছ?”
আমি নিরুত্তর হইয়া রহিলাম। ব্যোমকেশ হাঁটুর উপর কনুই রাখিয়া ও করতলে চিবুক ন্যস্ত করিয়া বহুক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল; শেষে বলিল–“বুঝতে পারছি, এর একটা খুব সহজ সমাধান হাতের কাছেই রয়েছে, কিন্তু কিছুতেই ধরতে পারছি না। যতবার ধরবার চেষ্টা করছি, পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।”
রাত্রিকালে এ বিষয়ে আর কোনও কথা হইল না। নিদ্রার পূর্ব পর্যন্ত ব্যোমকেশ অন্যমনস্ক ও বিমনা হইয়া রহিল। সমস্যার যে উত্তরটা হাতের কাছে থাকিয়াও তাহার যুক্তির ফাঁদে ধরা দিতেছে না, তাহারই পশ্চাতে তাহার মন যে ব্যাধের মত ছুটিয়াছে, তাহা বুঝিয়া আমিও তাহার একাগ্র অনুধাবনে বাধা দিলাম না।
পরদিন সকালে চিন্তাক্রান্ত মুখেই সে শয্যা ছাড়িয়া উঠিল এবং তাড়াতাড়ি মুখহাত ধুইয়া এক পেয়ালা চা গলাধঃকরণ করিয়া বাহির হইয়া গেল। ঘণ্টা তিনেক পরে যখন ফিরিল, তখন জিজ্ঞাসা করিলাম–“কোথায় গিছলে?”
ব্যোমকেশ জুতার ফিতা খুলিতে খুলিতে অন্যমনে বলিল–“উকিলের বাড়ি।” তাহাকে উন্মনা দেখিয়া আমি আর প্রশ্ন করিলাম না।
অপরাহ্নের দিকে তাহাকে কিছু প্রফুল্ল দেখিলাম। সমস্ত দুপুর সে নিজের ঘরে দ্বার বন্ধ করিয়া কাজ করিতেছিল; একবার টেলিফোনে কাহার সহিত কথা কহিল, শুনিতে পাইলাম। প্রায় সাড়ে চারটের দসময় সে দরজা খুলিয়া গলা বাড়াইয়া বলিল–“ওহে, কাল কি ঠিক হয়েছিল, ভুলে গেলে? ‘পথের কাঁটা’র প্রত্যক্ষ প্রমাণ দেবার সময় যে উপস্থিত।”
সত্যই ‘পথের কাঁটা’র কথা একেবারে ভুলিয়া গিয়াছিলাম। ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল–“এস, এস, তোমার একটু সাজসজ্জা করে দিই। এমনি গেলে তো চলবে না।”
আমি তাহার ঘরে প্রবেশ করিয়া বলিলাম–“চলবে না কেন?”
ব্যোমকেশ একটা কাঠের কবাট-যুক্ত আলমারি খুলিয়া তাহার ভিতর হইতে একটা টিনের বাস্ক বাহির করিল। বাক্স হইতে ক্রেপ, কাঁচি, স্পিরিট-গাম ইত্যাদি বাছিয়া লইয়া বুরুশ দিয়া আমার মুখে স্পিরিট-গাম লাগাইতে লাগাইতে বলিল–“অজিত বন্দ্যো যে ব্যোমকেশ বক্সীর বন্ধু, এ খবর অনেক মহাত্মাই জানেন কিনা, তাই একটু সতর্কতা।”
মিনিট পনের পরে আমার অঙ্গসজ্জা শেষ করিয়া যখন ব্যোমকেশ ছাড়িয়া দিল, তখন আয়নার সম্মুখে দিয়া দেখি,–কি সর্বনাশ! এ তো অজিত বন্দ্যো নয়, এ যে সম্পূর্ণ আলাদা লোক। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি ও ছুঁচো্লো গোঁফ যে অজিত বন্দ্যোর কস্মিনকালেও ছিল না। বয়সও প্রায় দশ বছর বাড়িয়া গিয়াছে। রং বেশ একটু ময়লা। আমি ভীত হইয়া বলিলাম–“এই বেশে রাস্তায় বেরুতে হবে। যদি পুলিসে ধরে?”
ব্যোমকেশ সহাস্যে বলিল–“মা ভৈঃ! পুলিসের বাবার সাধ্য নেই তোমাকে চিনতে পারে। বিশ্বাস হয় না, নীচের তলায় কোনও চেনা ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা কয়ে দেখ। জিজ্ঞাসা কর–অজিতবাবু কোথায় থাকেন?”
আমি আরও ভয় পাইয়া বলিলাম–“না, না, তার দরকার নেই, আমি এমনই যাচ্ছি।”
বাহির হইবার অস্ময় ব্যোমকেশ বলিল–“কি করতে হবে, তোমার তো জানাই আছে–শুধু ফেরবার সময় একটু সাবধানে এস, পেছু নিতে পারে।”
“সে সম্ভাবনাও আছে না কি?”
“অসম্ভব নয়। আমি বাড়িতেই রইলুম, যত শীগ্গীর পার, ফিরে এস।”
পথে বাহির হইয়া প্রথমটা ভারী অস্বস্তি বোধ হইতে লাগিল। ক্রমে যখন দেখিলাম, আমাকে ছদ্মবেশ কাহারও দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছে না তখন অনেকটা নিশ্চিন্ত হইলাম, একটু সাহসও হইল। মোড়ের একটা দোকানে আমি নিয়মিত পান খাইতাম, খোট্টা পানওয়ালা আমাকে দেখিলেই সেলাম করিত, সেখানে গিয়া সদর্পে পান চাহিলাম। লোকটা নির্বিকারচিত্তে পান দিয়া পয়সা কুড়াইয়া লইল, আমার পানে ভাল করিয়া দৃক্পাতও করিল না।
পাঁচটা বাজিয়া গিয়াছিল, সুতরাং আর বিলম্ব করা যুক্তিযুক্ত নয় বুঝিয়া ট্রামে চড়িলাম। এস্প্ল্যানেডে নামিয়া বেড়াইতে বেড়াইতে সঙ্কেতস্থানে উপস্থিত হইলাম। মনের অবস্থা যদিও ঠিক অভিসারিকার মত নহে, তবু বেশ একটু কৌতুক ও উত্তেজনা অনুভব করিতে লাগিলাম।
কৌতুক কিন্তু বেশিক্ষণ স্থায়ী হইল না। যে পথে জনস্রোত জলস্রোতের মতই ছুটিয়া চলিয়াছে, সেখানে স্থাণুর মত দাঁড়াইয়া থাকা সহজ ব্যাপার নহে, দুই চারিটা কনুই-এর গুঁতা নির্বিকারভাবে হজম করিলাম। অকারণে সঙ-এর মত ল্যাম্পপোস্ট ধরিয়া দাঁড়াইয়া থাকায় অন্য বিপদও আছে। চৌমাথার উপর একটা সার্জেণ্ট দাঁড়াইয়াছিল, সে সপ্রশ্নভাবে আমার দিকে দুই তিনবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল, এখনই হয়তো আসিয়া জিজ্ঞাসা করিবে, কেন দাঁড়াইয়া আছ? কি করি, ফুটপাথের ধারেই হোয়াইটওয়ে লেড্স’র দোকানের একটা প্রকাণ্ড কাচ-ঢাকা জানলায় নানাবিধ বিলাতি পণ্য সাজান ছিল, সেই দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাইয়া রহিলাম। মনে ভাবিলাম পাড়াগেঁয়ে ভূত মনে করে ক্ষতি নাই, গাঁটকাটা ভাবিয়া হাতে হাতকড়া না পরায়!
ঘড়িতে দেখিলাম, পাঁচটা পঞ্চাশ। কোনক্রমে আর দশটা মিনিট কাটাইতে পারিলে বাঁচা যায়। অধীরভাবে অপেক্ষা করিতে লাগিলাম, মনটা নিজের পাঞ্জাবির পকেটের মধ্যে পড়িয়া রহিল। দুই একবার পকেটে হাত দিয়াও দেখিলাম, কিন্তু সেখানে নূতন কিছুই হাতে ঠেকিল না।
অবশেষে ছয়টা বাজিতেই একটা আরামের নিশ্বাস ফেলিয়া ল্যাম্পপোস্ট পরিত্যাগ করিলাম। পকেট দু’টা ভাল করিয়া পরীক্ষা করিলাম, চিঠিপত্র কিছুই নাই। নিরাশার সঙ্গে সঙ্গে একটা স-মৎসর আনন্দও হইতে লাগিল, যাক্, ব্যোমকেশের অনুমান যে অভ্রান্ত নহে, তাহার একটা দৃষ্টান্ত পাওয়া গিয়াছে। এইবার তাহাকে বেশ একটু খোঁচা দিতে হইবে। এইরূপ নানা কথা ভাবিতে ভাবিতে এস্প্ল্যানেডের ড্রাম-ডিপোতে আসিয়া পৌঁছিলাম।
“ছবি লিবেন, বাবু!”
কানের অত্যন্ত নিকটে শব্দ শুনিয়া চমকিয়া ফিরিয়া দেখি, লুঙ্গি-পরা নীচ শ্রেণীর একজন মুসলমান একখানা খাম আমার হাতে গুঁজিয়া দিতেছে। বিস্মিতভাবে খুলিতেই একখানা কুৎসিত ছবি বাহির হইয়া পড়িল। এরূপ ছবির ব্যবসা কলিকাতার রাস্তাঘাটে চলে জানিতাম; তাই ঘৃণাভরে সেটা ফেরত দিতে গিয়া দেখি লোকটা নাই। সম্মুখে, পশ্চাতে, চারিদিকে চক্ষু ফিরাইলাম; কিন্তু ভিড়ের মধ্যে লুঙ্গি-পরা লোকটাকে কোথাও দেখিতে পাইলাম না।
অবাক্ হইয়া কি করিব ভাবিতেছি, এমন সময় একটা ছোট্ট হাসির শব্দে চমক ভাঙিয়া দেখিলাম, একজন বৃদ্ধ গোছের ফিরিঙ্গি ভদ্রলোক আমার পাশে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন। আমার দিকে না তাকাইয়াই তিনি পরিষ্কার বাঙলায় একান্ত পরিচিত কণ্ঠে বলিলেন–“চিঠি তো পেয়ে গেছ, দেখছি, এবার বাড়ি যাও। একটু ঘরে যেও। এখান থেকে ট্রামে বৌবাজারের মোড় পর্যন্ত যেও, সেখান থেকে বাসে করে হাওড়ার মোড় পর্যন্ত, তারপর ট্যাক্সিতে করে বাড়ি যাবে।”
সার্কুলার রোডের ট্রাম আসিয়া সম্মুখে দাঁড়াইয়াছিল, সাহেব তাহাতে উঠিয়া বসিলেন।
আমি সমস্ত শহর মাড়াইয়া যখন বাড়ি ফিরিলাম, তখন ব্যোমকেশ আরাম-কেদারার উপর লম্বা হইয়া পড়িয়া সিগার টানিতেছে। আমি তাহার সম্মুখে চেয়ার টানিয়া বসিয়া বলিলাম–“সাহেব কখন এলে?”
ব্যোমকেশ ধূম উদ্গীরণ করিয়া বলিল–“মিনিট কুড়ি।”
আমি বলিলাম–“আমার পেছু নিয়েছিলে কেন?”
ব্যোমকেশ উঠিয়া বসিয়া বলিল–“যে কারণে নিয়েছিলুম, তা সফল হল না, এক মিনিট দেরি হয়ে গেল। –তুমি যখন ল্যাম্পপোস্ট ধরে দাঁড়িয়েছিলে, আমি তখন ঠিক তোমার পাঁচ হাত দূরে লেড্ল’র দোকানের ভিতর জানলার সামনে দাঁড়িয়ে সিল্কের মোজা পছন্দ করছিলুম। ‘পথের কাটা’র ব্যাপারী বোধ হয় কিছু সন্দেহ করে থাকবে, বিশেষত তুমি যে-রকম ছটফট করছিলে আর দু’মিনিট অন্তর পকেটে হাত দিচ্ছিলে, তাতে সন্দেহ হবারই কথা। তাই সে তখন চিঠিখানা দিলে না। তুমি চলে যাবার পর আমিও দোকান থেকে বেরিয়েছি, মিনিট দুই-তিন দেরি হয়েছিল–তারি মধ্যে লোকটা কাজ হাসিল করে বেরিয়ে গেল। আমি যখন পৌছলুম, তখন তুমি খাম হাতে করে ইয়ের মত দাঁড়িয়ে আছ। –কি করে খাম পেলে?”
কি করিয়া পাইলাম, তাহা বিবৃত করিলে পর ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল–“লোকটাকে ভাল করে দেখেছিলে? কিছু মনে আছে?”
আমি চিন্তা করিয়া বলিলাম–“না। শুধু মনে হচ্ছে, তার নাকের পাশে একটা মস্ত আঁচিল ছিল। ব্যোমকেশ হতাশভাবে মাথা নাড়িয়া বলিল–“সেটা আসল নয়–নকল। তোমার গোঁফ-দাড়ির মত। যাক, এখন চিঠিখানা দেখি, তুমি ইতিমধ্যে বাথরুমে গিয়ে তোমার দাড়ি-গোঁফ ধুয়ে এস।”
মুখের রোমবাহুল্য বর্জন করিয়া স্নান সারিয়া যখন ফিরিলাম, তখন ব্যোমকেশের মুখ দেখিয়া একেবারে অবাক্ হইয়া গেলাম। দুই হাত পিছনে দিয়া সে দ্রুতপদে ঘরে পায়চারি করিতেছে, তাহার মুখে চোখে এমন একটা প্রদীপ্ত উল্লাসের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়া উঠিয়াছে যে, তাহা দেখিয়া আমার বুকের ভিতরটা লাফাইয়া উঠিল। আমি সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিলাম–“চিঠিতে কি দেখলে? কিছু পেয়েছ না কি?”
ব্যোমকেশ উচ্ছ্বসিত আনন্দবেগে আমার পিঠ চাপড়াইয়া বলিল–“শুধু একটা কথা অজিত, একটা ছোট্ট কথা। কিন্তু এখন তোমাকে কিছু বলব না। হাওড়ার ব্রিজ কখনও খোলা অবস্থায় দেখেছ? আমার মনের অবস্থা হয়েছিল ঠিক সেই রকম, দুই দিক্ থেকে পথে এসেছে, কিন্তু মাঝখানটিতে একটুখানি ফাঁক, একটা পনটুন খোলা। আজ সেই ফাঁকটুকু জোড়া লেগে গেছে।”
“কি করে জোড়া লাগল? চিঠিতে কি আছে?”
“তুমিই পড়ে দেখ।” বলিয়া ব্যোমকেশ খোলা কাগজখানা আমার হাতে দিল।
খামের মধ্যে কুৎসিত ছবিটা ছাড়া আর একখানা কাগজ ছিল, তাহা দেখিয়াছিলাম, কিন্তু পড়িবার সুযোগ হয় নাই। এখন দেখিলাম, পরিষ্কার অক্ষরে লেখা রহিয়াছে–
“আপনার পথের কাঁটা কে? তাহার নাম ও ঠিকানা কি? আপনি কি চান, পরিষ্কার করিয়া লিখুন। কোনো কথা লুকাইবেন না। নিজের নাম স্বাক্ষর করিবার দরকার নাই। লিখিত পত্র খামে ভরিয়া আগামী রবিবার ১০ই মার্চ রাত্রি বারোটার সময় খিদিরপুর রেস্কোর্সের পাশের রাস্তা দিয়া পশ্চিম দিকে যাইবেন। একটি লোক বাইসিক্ল চড়িয়া আপনার সম্মুখ দিক্ হইতে আসিবে, তাহার চোখে মোটর-গগ্ল দেখিলেই চিনিতে পারিবেন। তাহাকে দেখিবামাত্র আপনার পত্র হাতে লইয়া পাশের দিকে হাত বাড়াইয়া থাকিবেন। বাইসিক্ল আরোহী আপনার হাত হইতে চিঠি লইয়া যাইবে। অতঃপর যথাসময়ে আপনি সংবাদ পাইবেন।
“পদব্রজে একাকী আসিবেন। সঙ্গী থাকিলে দেখা পাইবেন না।”
দুই তিনবার সাবধানে পড়িলাম। খুব অসাধরণ বটে এবং যৎপরোনাস্তি রোমাণ্টিক–তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু ইহাতে ব্যোমকেশের অসম্বৃত আনন্দের কোনও হেতু খুঁজিয়া পাইলাম না। জিজ্ঞাসা করিলাম–“কি ব্যাপার বল দেখি! আমি তো এমন কিছু দেখছি না–”
“কিছু দেখতে পেলে না?”
“অবশ্য তুমি কা লযা অনুমান করেছিলে, তা বর্ণে বর্ণে মিলে গেছে, তাতে সন্দেহ নেই। লোকটার আত্মগোপন করবার চেষ্টার মধ্যে হয়তো কোন বদ মতলব থাকতে পারে। কিন্তু তা ছাড়া আর তো আমি কিছু দেখছি না।”
“হায় অন্ধ! অতবড় জিনিসটা দেখতে পেলে না?” ব্যোমকেশ হঠাৎ থামিয়া গেল, বাহিরে সিঁড়িতে পদশব্দ হইল। ব্যোমকেশ ক্ষণকাল একাগ্রমনে শুনিয়া বলিল–“আশুবাবু। এসব কথা ওঁকে বলবার দরকার নেই–” বলিয়া চিঠিখানা আমার হাত হইতে লইয়া পকেটে পুরিল। আশুবাবু ঘরে প্রবেশ করিলে তাঁহার চেহারা দেখিয়া একেবারে স্তম্ভিত হইয়া গেলাম। মাথার চুল অবিন্যস্ত, জামা-কাপড়ের পারিপাট্য নাই, গালের মাংস ঝুলিয়া গিয়াছে, চোখের কোলে কালি, যেন অক্স্মাৎ কোন মর্মান্তিক আঘাত পাইয়া একেবারে ভাঙিয়া পড়িয়াছেন। কাল সদ্য মৃত্যুর মুখ হইতে রক্ষা পাইবার পরও তাঁহাকে এত অবসন্ন ম্রিয়মাণ দেখি নাই। তিনি একখানা চেয়ারে অত্যন্ত ক্লান্তভাবে বসিয়া পড়িয়া বলিলেন–“একটা দুঃসংবাদ পেয়ে আপনাকে খবর দিতে এসেছি, ব্যোমকেশবাবু। আমার উকিল বিলাস মল্লিক পালিয়েছে।”
ব্যোমকেশ গম্ভীর অথচ সদয় কণ্ঠে কহিল,–“সে পালাবে আমি জানতুম। সেই সঙ্গে আপনার জোড়াসাঁকোর বন্ধুটিও গেছেন, বোধহয় খবর পেয়েছেন।”
আশুবাবু হতবুদ্ধির মত কিছুক্ষণ তাকাইয়া থাকিয়া বলিলেন,–“আপনি–আপনি সব জানেন?”
ব্যোমকেশ শান্ত স্বরে কহিল,–“সমস্ত। কাল আমি জোড়াসাঁকোয় গিয়েছিলুম, বিলাস মল্লিককেও দেখেছি। বিলাস মল্লিকের সঙ্গে ঐ স্ত্রীলোকটির অনেক দিন থেকে ভিতরে ভিতরে ষড়যন্ত্র চলছিল–আপনি কিছুই জানতেন না। আপনার উইল তৈরী করবার পরই বিলাস উকীল আপনার উত্তারাধিকারিণীকে দেখতে যান। প্রথমটা বোধ হয় কৌতুহলবশে গিয়েছিল, তারপর ক্রমে–যা হয়ে থাকে। ওরা এত দিন সুযোগ অভাবেই কিছু করতে পারছিল না। আশুবাবু, আপনি দুঃখিত হবেন না, এ আপনার ভালই হল,–অসৎ স্ত্রীলোক এবং কপট বন্ধুর ষড়যন্ত্র থেকে আপনি মুক্তি পেলেন। আর আপনাস্র জীবনের কোনও ভয় নেই–এখন আপনি নির্ভয়ে রাস্তার মাঝখান দিয়ে হেঁটে যেতে পারেন।”
আশুবাবু শঙ্কাব্যাকুল দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিলেন,–“তার মানে?”
ব্যোমকেশ বলিল,–“তার মানে, আপনি যা মনে মনে সন্দেহ করছেন অথচ বিশ্বাস করতে পারছেন না, তাই ঠিক। ওরাই দু’জনে আপনাকে হত্যা করবার মতলব করেছিল; তবে নিজের হাতে নয়। এই কলিকাতা শহরেই একজন লোক আছে–যাকে কেউ চেনে না, কেউ চোখে দেখেনি–অথচ যার নিষ্ঠুর অস্ত্র পাঁচ জন নিরীহ নিরপরাধ লোককে পৃথিবী থেকে নিঃশব্দে সরিয়ে দিলে। আপনাকেও সরাতো, শুধু পরমায়ু ছিল বলেই আপনি বেঁচে গেলেন।”
আশুবাবু বহুক্ষণ দুই হাতে মুখে ঢাকিয়া বসিয়া রহিলেন, শেষ মর্মন্তুদ দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া ধীরে ধীরে বলিলেন,–“বুড়ো বয়সে স্বকৃত পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছি, কাউকে দোষ দেবার নেই!–আটত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত আমি নিষ্কলঙ্ক জীবন যাপন করেছিলাম, তারপর হঠাৎ পদস্খলন হয়ে গেল। একদিন দেওঘরে তপোবন দেখতে গিয়েছিলাম, সেখানে একটু অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে দেখে একেবারে আত্মহারা হয়ে গেলাম। বিবাহে আমার চিরদিন অরুচি, কিন্তু তাকে বিবাহ করবার জন্যে একেবারে পাগল হয়ে গেলাম। শেষে একদিন জানতে পারলাম, সে বেশ্যার মেয়ে। বিবাহ হল না, কিন্ত উতাকে ছাড়তেও পারলাম না। কলকাতায় এনে বাড়ী ভাড়া করে রাখলাম। সেই থেকে এই বারো তের বছর তাকে স্ত্রীর মতই দেখে এসেছি। তাকে সমস্ত সম্পত্তি লিখে দিয়েছিলুম, সে তো আপনি জানেন। ভাবতাম, সেপ আমাকে স্বামীর মত ভালবাসে–কোনও দিন সন্দেহ হয়নি। বুঝতে পারিনি যে, পাপের রক্তে যার জন্ম, সে কখনও সাধ্বী হতে পারে না!–যাক, বুড়ো বয়সে যে শিক্ষা পেলাম, হয়তো পরজন্মে কাজে লাগবে” কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া ভগ্নস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন,–“ওরা–তারা কোথায় গিয়েছে, আপনি জানেন কি?”
ব্যোমকেশ বলিল,–“না। আর সে জেনেও কোন লাভ নেই। নিয়তি তাদের যে পথে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, সে পথে আপনি যেতে পারবেন না। আশুবাবু, আপনার অপরাধ সমাজের কাছে হয়তো নিন্দিত হবে, কিন্তু আমি আপনাকে চিরকাল শ্রদ্ধ করব জানবেন। মনের দিক থেকে আপনি খাঁটি আছেন, কাদা ঘেঁটেও আপনি নির্মল থাকতে পেরেছেন, এইটেই আপনার সব চেয়ে বড় প্রশংসার কথা। এখন আপনার খুবই আঘাত লেগেছে, এ রকম বিশ্বাসঘাতকতায় কার না লাগে? কিন্তু ক্রমে বুঝবেন, এর চেয়ে ইষ্ট আপনার আর কিছু হতে পারত না।”
আশুবাবু আবেগপূর্ণ স্বরে কহিলেন,–“ব্যোমকেশবাবু, আপনি আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট, কিন্তু আপনার কাছে আমি যে সান্ত্বনা পেলাম, এ আমি কোথাও প্রত্যাশা করিনি। নিজের লজ্জাকর পাপের ফল যে ভোগ করে, তাকে কেউ সহানুভূতি দেখায় না, তাই তার প্রায়শ্চিত্ত এত ভয়ঙ্কর। আপনার সহানুভূতি পেয়ে আমার অর্ধেক বোধা হাল্কা হয়ে গেছে। আর বেশী কি বল্ব, চিরদিনের জন্য আপনার কাছে ঋণী হয়ে রইলাম।”
আশুবাবু বিদায় লইবার পর তাহার অদ্ভুত ট্র্যাজেডির ছায়ায় মনটা আচ্ছন্ন হইয়া রহিল। শয়নের পূর্বে ব্যোমকেশকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলাম,–“আশুবাবুকে খুন করবার চেষ্টার পেছনে যে বিলাশ উকীল আর ঐ স্ত্রীলোকটা আছে, এ কথা তুমি কবে জান্লে?”
ব্যোমকেশ কড়িকাঠ হইতে চক্ষু নামাইয়া বলিল,–“কাল বিকেলে।”
“তবে পালাবার আগে তাদের ধরলে না কেন?”
“ধরলে কোন লাভ হত না, তাদের অপরাধ কোনও আদালতে প্রমাণ হত না।”
“কিন্তু তাদের কাছ থেকে আসল হত্যাকারী গ্রামোফোন পিনের আসামীর সন্ধান পাওয়া যেতে পারত।”
ব্যোমকেশ মুখ টিপিয়া হাসিয়া বলিল,–“তা যদি সম্ভব হত, তাহলে আমি নিজে তাদের তাড়াবার চেষ্টা করতুম না।”
তুমি তাদের তাড়িয়েছ?”
“হ্যাঁ। আশুবাবু দৈবক্রমে বেঁচে যাওয়াতে তারা উড়ু উড়ু করছিলই, আমি জা সকালে বিলাস উকীলের বাড়ি গিয়ে ইশারা ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলুম যে আমি অনেক কথাই জানি, যদি এই বেলা সরে না পড়েন তো হাতে দড়ি পড়বে। বিলাস উকীল বুদ্ধিমান লোক, সন্ধ্যার গাড়ীতেই বামাল সমেত নিরুদ্দেশ হলেন।”
“কিন্তু ওদের তাড়িয়ে তোমার লাভ কি হল?”
ব্যোমকেশ একটা হাই তুলে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল,–“লাভ এমন কিছু নয়, কেবল দুষ্টের দমন করা গেল। বিলাস উকীল শুধু-হাতে নিরুদ্দেশ হবার লোক নন, মক্কেলের টাকাকড়ি যা তাঁর কাছে ছিল, সমস্তই সঙ্গে নিয়েছিলেন এবং এতক্ষণে বোধ করি, বর্ধমানের পুলিস তাঁকে হাজতে পুরেছে–আগে থাকতেই তারা খবর জানত কি না! যা হোক, বিলাসচন্দ্রের দু’বচ্ছর সাজা কেউ ঠেকাতে পারবে না। যদিও ফাঁসীই তার উচিত শাস্তি, তবু তা যখন উপস্থিত দেওয়া যাচ্ছে না, তখন দু’বচ্ছরই বা মন্দ কি?”