Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » পঞ্চম পুরুষ || Bani Basu » Page 9

পঞ্চম পুরুষ || Bani Basu

সেমিনারের প্রথমার্ধেই মহানামের বক্তৃতা ছিল। প্রশ্নোত্তরের সময় ধার্য ছিল মাত্র দশ মিনিট। তাতে কুলোয়নি। লাঞ্চের সময় তাই বেশ কিছু প্রশ্ন নিয়ে ঘিরে ধরেছিল ছাত্রদল। এইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে নিজেকে ছড়ানোর একটা আরাম পাওয়া যায়, সেটা মহানাম খুব উপভোগ করেন। বলছিলেন—‘না, না তোমরা ভুল করছো। এটা ভালোমন্দের প্রশ্ন নয়। একটা আর্ট-ফর্ম আরেকটা আর্ট-ফর্মের ওপর হামলা করবেই। বিশেষত একই শিল্পী যদি দুটো ফর্ম ব্যবহার করেন। চিত্রশিল্পীর সত্তা অ্যাসার্ট করেছে নিজেকে, হয়ত তাঁর অজ্ঞাতেই। নিখিলেশ যখন ‘ঘরে বাইরে’তে গ্রাম প্রধানদের সঙ্গে কথা বলছে তখন তাকে পরিচালক মডেল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। শালের ভাঁজগুলো পর্যন্ত থাকে থাকে সাজিয়ে দিয়েছেন, ওই দৃশ্যে নিখিলেশ একটু আড়ষ্টও, যেন স্টিল ছবির ধর্ম বজায় রাখতে। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’, ‘জলসাঘর’ এগুলো সব পেন্টারের ফিল্ম। এপিসোডিক ইন স্ট্রাকচার।

চন্দ্রশেখর এসে বলল একটি সুইডিশ ছাত্র গবেষণা করতে কিছুদিন এসে রয়েছে এখানে, সে যেন কি বলতে চায়। পেছন ফিরে মহানাম দেখলেন পাতলা সোনালি চুল, সাদাটে চোখের একটি ছেলে, খুব ব্যগ্র মুখে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। ও রায়ের ছবির সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে গবেষণা করছে। ওর প্রশ্ন চন্দ্রশেখর অনুবাদ করে দিল—‘ঘরে বাইরে’র লাস্ট সিকোয়েন্সে বিমলা আস্তে আস্তে বিধবার বেশে রূপান্তরিত হচ্ছে এটাকে পরিচালক যেন একটা চূড়ান্ত ট্রাজেডি বলে ফোকাস করেছেন, কেন, যেন উইডোহুড ইটসেলফ ইজ আ ট্রাজেডি, বিমলা নিখিলেশের সঙ্গে পারিবারিক ও সামাজিক কর্তব্যবোধের বন্ধনে বন্দী। প্রেমের বন্ধনে তো নয়। নিখিলেশের সঙ্গে তার সম্পর্ক অনেকটা গুরু-শিষ্যের। সন্দীপ সম্পূর্ণ ব্যর্থ হতে পারে, কিন্তু সন্দীপই তাকে শরীরে ও মনে জাগিয়ে দিয়ে গেছে, এরপর সে বৃহত্তর, ব্যাপকতর অভিজ্ঞতার জন্য প্রস্তুত হবে, এটাই বাস্তবসম্মত নয় কি?

মহানাম বললেন—‘আমাদের দেশের যে সামাজিক পটভূমিতে রায় ছবিটি করেছেন সেখানে বৈধব্য প্রত্যাহার করা যায় না। এবং তা অভিশাপ বলে গণ্য। একজন মহিলা যতই কেন আলোকপ্রাপ্ত হন না, এই সংস্কার এড়াবার সাধ্য বা এর থেকে পুরোপুরি মুক্ত থাকবার উপায় তাঁর নেই। সামাজিক-ধর্মীয় গণ্ডির যে বেষ্টনী, তাকে ছিন্ন করবার উপায়ও তাঁর সম্পূর্ণ অজানা। নিখিলেশের মতো উদারচিত্ত স্বামী বেঁচে থাকতে বিমলা যে স্বাধীনতা উপভোগ করত, তার সমস্তটাই এখন সে হারাল, ওই বৈধব্যটা তার পক্ষে চূড়ান্ত ট্রাজেডিই।

‘তাছাড়াও একটা জিনিস লক্ষ্য করোনি মনে হচ্ছে, —সেটা নিখিলেশ-বিমলা সম্পর্কের সূক্ষ্ম পরিবর্তন। প্রথমে যেটা ছিল ঐতিহ্য-নির্ভর স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, যার থেকে নিখিলেশ মুক্তি পেতে চেয়েছিল সন্দীপ এপিসোডের সময়ে এবং তারপর কিন্তু সেটা ব্যক্তিত্ব-সংঘাতের এবং প্রেমের ভূমিতে এসে দাঁড়াল। ইটস আ ট্রাজেডি অফ পার্সন্যালিটি অ্যান্ড লাভ, বিমলার যত না, নিখিলেশের তার চেয়েও বেশি। এই জিনিসই সে চেয়েছে। এই খোলা চোখে চেয়ে দেখা। জাগতিক ঘটনানিচয় এবং অন্যতর চরিত্রের পাশাপাশি নিজেদের স্থাপন করে তুলনা প্রতিতুলনার মধ্য দিয়ে নিজেদের স্বরূপ চিনে নেওয়া। ঘটল বস্তৃত তাই। কিন্তু মাঝখানের সন্দীপ-এপিসোডে বিমলার যে চ্যুতি তা নিখিলেশকে এমন বেদনা দিল যা ওর আগে কল্পনায় ছিল না। তাই ও আত্মহননের পথই বেছে নিল।

জোহান বলল—‘তাহলে তো বলব পুরোপুরি সংস্কারমুক্ত পুরুষ নিখিলেশ নন।’

‘ননই তো। সংস্কার যে আমরা আমাদের শোণিতে বহন করি, বুদ্ধি দিয়ে তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারি। কিন্তু আবেগের ভূমিতে এসে দাঁড়ালেই সংস্কার মাথা তোলে।’

জোহান বলল—‘নিখিলেশ তাহলে বিমলাকে একরকম শাস্তিই দিলেন।’

‘ভেরি ইনটেলিজেন্ট অফ য়ু। অফ কোর্স শাস্তিই দিলেন। কারণ বৈধব্যের প্রথার মধ্যে সামাজিক-ধর্মীয় শৃঙ্খল কত দৃঢ় তা তাঁর চেয়ে বেশি কেউ জানে না। তবে এই শাস্তি দেওয়া জিনিসটা তিনি কতদূর সচেতনভাবে করেছেন বলা শক্ত। নিখিলেশ আসলে ফিল্মটিতে সবচেয়ে জটিল চরিত্র। তার শেষ সিদ্ধান্তে ব্যর্থ প্রেমিক হিসেবে বিমলার ওপর প্রতিশোধ নেবার ইচ্ছে আছে, স্বামী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করবার জন্য ব্রাভাডো আছে, আবার জমিদার হিসেবে শান্তিরক্ষার দায়িত্ব কাঁধে নেবার আন্তরিক ইচ্ছা, তা-ও আছে।’

জোহানের দ্বিতীয় প্রশ্ন—‘অরণ্যের দিনরাত্রিতে’ রে আরও একটি উইডোড্‌ মেয়েকে দেখিয়েছেন, যার স্বামী অজ্ঞাতকারণে বিদেশে আত্মহত্যা করেছে এবং যে সেই স্বামীর আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে এখন বাস করছে। যে নির্জন অরণ্য অঞ্চলে ওরা থাকে সেখানে আগন্তুক চারটি বন্ধুর মধ্যে একজনকে সে আত্মনিবেদন করল, মেয়েটিকে গ্রহণ করতে ছেলেটির কি বাধা ছিল? সে তো আগেই মেয়েটির সম্পর্কে যথেষ্ট আগ্রহ দেখিয়েছে। তার ব্যবহার তো চূড়ান্ত অমানবিক। পরিচালক এখানে একটা মিলনদৃশ্য দেখালেন না কেন, গোদার হলে দেখাতেন।’

মহানাম হাসলেন—‘জোহান, আমাদের দেশের যা সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিত তার চার ভাগের তিন ভাগ মেনে নিয়েই তো আমাদের শিল্পকর্ম! নাহলে সেটা অবাস্তব হবে। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’তে দেখানো হয়েছে আমাদের দেশের উচ্চবর্ণের মেয়েদের শারীরিক পবিত্রতা চট করে নষ্ট করা যায় না। পাশাপাশি যেমন আদিবাসী মেয়েটির ক্ষেত্রে করা গেছে।’

‘মেয়েটি নিজে চাইলেও না।’

‘না, সে নিজে চাইলেও না। দ্বিতীয়ত ওই ছেলেটি মোটেই মেয়েটিকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিল না, যতই ফ্লার্ট করুক। ওই পরিস্থিতিতে মেয়েটিকে গ্রহণ করবার কতকগুলো ফলাফল আছে, ছেলেটি সে বিষয়ে বেশ সচেতন, তাছাড়াও আছে তার সহজাত ইনহিবিশন!’

‘কেন, উইডো বলে?’

মহানাম একটু থতমত খেয়ে গেলেন।

জোহান বলল—‘তাহলে নাইনটিন হানড্রেড অ্যান্ড ফাইভ থেকে আরম্ভ করে তার পঞ্চাশ, ষাট বছর পর পর্যন্তও উইডোহুড সম্পর্কে ইন্ডিয়ার সমাজ আর একটুও প্রগতিশীল হয়নি, বলুন! এই ছেলেটি তো স্বার্থপর, দায়িত্ব নেবার ব্যাপারে অক্ষম, এবং যৌন অক্ষমতাও তার অন্তর্গত।’

মহানাম বললেন—‘তাই। কিন্তু ও যদি ওই মুহূর্তের কাছে আত্মসমর্পণ করত তাহলে আমরা ওকে আরও স্বার্থপর বলতাম।’

‘আশ্চর্য!’ জোহান মন্তব্য করল, খসখস করে কলম চলতে লাগল ওর নোটবইয়ের পাতার ওপর। ভগবান জানেন ও ভারতের সমাজকে কোন কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে।

মহানাম চন্দ্রশেখরের দিকে ফিরে বললেন—‘সামাজিক অবস্থার তফাতে দৃষ্টিভঙ্গির কি দুর্লঙ্ঘ্য তফাত হয়, দেখেছো শেখর! সেইজন্যেই ‘দেবী’ অত ভালো ছবি হওয়া সত্ত্বেও ওরা একেবারেই গ্রহণ করতে পারেনি। আর্ট-উপভোগেই বাধা সৃষ্টি করেছে দীর্ঘ দিনের মানসিক অভ্যাস। তাছাড়াও, শেখর, আমার মনে হয়—মানুষে মানুষে সম্পর্কের কতকগুলো চিরন্তন মূল্যমান আছে সেখানেও আমাদের কিছু ন্যূনতা থেকে গেছে। বিশেষত মেয়েদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে।

‘চিরন্তন মূল্যবোধ? ঠিক বুঝলাম না।’ চন্দ্রশেখর বলল।

‘ধরো, পীড়িতের প্রতি সহজ মমত্ববোধ একটা ইটারন্যাল ভ্যালু তো?’

‘‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র ওই বঞ্চিত বধূটিকে কিন্তু আমরা মমত্ববোধ দিয়ে দেখিনি। শী হ্যাজ বীন ট্রীটেড অ্যাজ অ্যান একসেনট্রিক অ্যান্ড নট আ প্যাথেটিক ফিগার।’

‘আর একটু বুঝিয়ে বলুন।’

‘‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ কি? অ্যান এক্সকার্শন ইনটু দা আনফ্যামিলিয়ার, দা বিজার। চার বন্ধু একঘেঁয়েমি কাটাতে নির্জন অরণ্য-অঞ্চলে এসেছে। অপরিচিত প্রকৃতি, মানুষজন, রীতি-নীতি, শুধু অপরিচিতই নয়, অদ্ভুত, গা-ছমছমে। ওই উইডোড বধূটিকে এই গা-ছমছমে পরিবেশের অংশ বলে দেখিয়ে তার প্রতি আমরা সুগভীর অন্যায় করেছি। বুঝতে পারছ? স্বাভাবিক ভালোবাসার জন্য তার আকাঙ্ক্ষাটাকে আমরা উৎকট অসুখ বলে উপস্থাপিত করছি। দ্যাটস হোয়াই জোহান অ্যাজ আ হিউম্যান বীয়িং ফীল্‌স্‌ রিভোল্টেড।’

অডিটোরিয়াম থেকে বেরোতে বেরোতে মহানাম ভাবলেন—কস্তুরী মাসীর চোদ্দ বছর বয়সে বিয়ে হয়, পনের বছরে বিধবা হন। তখন তাঁর বাবার চৈতন্যোদয় হয়। মেয়ের পড়াশুনো, বিদেশ-যাওয়া এবং আত্মীয়-স্বজনের সহানুভূতি ও সম্পত্তির জন্য শ্বশুরবাড়ির আগ্রাসী ভালোবাসা থেকে বাঁচানো এই সমস্ত দায় তিনি নিখুঁত ভাবে পালন করেছিলেন। মাসী বলতেন—‘সবার তো আর এ ভাগ্য হয় না।’ মানুষের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির প্রাথমিক পাঠ মাসির কাছেই। সেই মাসি যখন পঞ্চান্ন বছর বয়সে হঠাৎ স্ট্রোক হয়ে মারা গেলেন! কোনও প্রস্তুতি না, কিচ্ছু না। মাসির আর যাই থাক হার্ট এবং ব্রেনে কোনও গোলমাল ছিল না।

দুপুরে নার্সিং-হোম থেকে এলেন, হাত ধুচ্ছেন বেসিনে, কনুই পর্যন্ত সাবান আর অ্যান্টিসেপটিক। এপ্রনটা অদূরে দেয়ালের হুক থেকে ঝুলছে। যজ্ঞেশ্বর শরবৎ নিয়ে এলো গজগজ করতে করতে। শশা, ডিমসেদ্ধ। কয়েক দানা ডালিম আর ঠাণ্ডা দুধ—এই মাসির দ্বিপ্রহরিক আহার। আজ শরবৎ খেতে চেয়েছেন, অর্থাৎ আর কিছু খাবেন না। তাই যজ্ঞেশ্বরের রাগ।

‘খেয়ে কে কবে বড়লোক হয় বল তো?’ হাসতে হাসতে মাসি বলছেন। সোফায় বসেছেন শরবৎ হাতে করে। অন্যদিকে মহানাম, বই হাতে। হঠাৎ শরবতের গ্লাসটা হাত থেকে ঝনঝন করে পড়ে গেল। চমকে তাকাতে মাসি বললেন—‘হাতটা হঠাৎ কেমন অবশ হয়ে গেল রে!’ যজ্ঞেশ্বর গজগজ করতে করতে বলছে—‘আমি আর এক গ্লাস টপ করে করে দিচ্ছি। তুমি যেন আবার ঘুমিও না মা।’ মাসির ঘুমটিও ছিল সাধা। খেয়ে নিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে ঠিক কুড়ি মিনিট চোখ বুজে স্তব্ধ হয়ে থাকবেন। বিশ্রাম নেবার সমস্ত নিয়মই মাসির জানা ছিল। ঘণ্টাখানেক পার হয়ে গেল দেখে মহানাম ডাকলেন—‘কস্তুরী দেবী, আপনার কিন্তু খাবার সময় হয়ে গেল।’ মাসি উঠল না, — ‘মাসি, উঠতে হয় যে এবার!’ মাসি উঠল না। একটু ঠেলা দিলেন মহানাম, কস্তুরী কাত হয়ে পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন মহানাম। সত্যিই যাবার সময় হয়ে গিয়েছিল।

কিছু কি মনে হয়েছিল? কে যেন নেই? কি যেন নেই? এই ছিল, এই নেই। একটা শূন্যতা! মাসির সঙ্গে কতটুকু দেখা হত? হোস্টেল জীবন শেষ করে বাড়ি এসে বসার পর? রাত দশটা, সকাল সাতটা আর দুপুর একটা থেকে দুটো। রাতে কিছুক্ষণ গল্প হত। ইদানীং ওই সময়টা মহানাম পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। শূন্যতাবোধ যদি থেকেও থাকে পরবর্তী ঘূর্ণাবর্তে সব তলিয়ে যায়। মাসির দূর সম্পর্কের আত্মীয়স্বজনরা সব উইলের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন। দুঁদে সলিসিটর মাসির বাবার সময়কার, বললেন—‘কেন হাঙ্গামা করছ বাবারা! সুবিধে হবে কি! ক্যাশ টাকা সব কস্তুরী মিত্রর স্বোপার্জিত, অনেকদিন মহানাম রায়ের অ্যাকাউন্টে চলে গেছে। বসতবাড়িটি আবার কস্তুরীর বাবার স্বোপার্জিত, একমাত্র সন্তানকে বিনাশর্তে দিয়ে গেছেন। কিছুতেই হাত দিতে পারবে না।’

তারপরই অক্সফোর্ড ট্রিনিটি কলেজ, প্রোফেসর ডেকার, বন্ধুবান্ধবী। শূন্যতা বোঝবার সময় নেই। চতুর্থ বছরে প্রবাস থেকে ফিরে এলেন। পুরো ইয়োরোপ দেখার পর। সেই যজ্ঞেশ্বর, সেই সাদা কালো ছকের মার্বলের মেঝে। বিশাল বিশাল আয়না-ওলা দেয়াল-আলমারি পঙ্খের দেয়াল, ঝাড়বাতি। ঝাড়বাতি জ্বেলে জমাট আসর।

অনেক ছাত্র-ছাত্রী আসছে। এষার আসার কথা না। সে নেহাতই নবীন, আন্ডার-গ্র্যাজুয়েট ক্লাসের ছাত্রী। কিন্তু সে নিজের অধিকার কারো থেকে কম মনে করে না। উদ্ভট উদ্ভট কথা বলে মহানাম পার পান না। ‘সিল্‌ক্‌-মসৃণ’ বা ‘হাতুড়ি-মুখর’ কেন গুরুচণ্ডালি হবে না, ‘হরিণের মতো দ্রুত ঠ্যাঙের তুরুকে’ ‘এক মাইল শান্তি কল্যাণ’ কেন রসভঙ্গ বলে বিবেচিত হবে না। ‘একজোটে কাজ করে মানুষেরা যেরকম ভোটের ব্যালটে’, কি রকম তুলনা?’ ‘প্রকৃতির বুদোয়ারে’ কি না লিখলে চলত না? এইসব প্রশ্ন সে এমন মুখ করে জিজ্ঞেস করে যেন উত্তরটার ওপর তার জীবনমরণ নির্ভর করছে।

কবিতা যে স্বকীয় উচ্চারণের সঠিক পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য উন্মত্ত হয়ে উঠেছে, তার মধ্যে সূক্ষ্ম ব্যঙ্গ প্রবেশ করছে আস্তে আস্তে, গুরু-গাম্ভীর্যের পাশাপাশি চটুলতার ধাক্কা দিয়ে সে যে ঝিমন্ত শ্রোতাকে জাগাবার কাজে ব্যস্ত, এবং স্বভাষার অভিধান ভাবপ্রকাশে যথেষ্ট নয় মনে করে সে তার জানা সমস্ত ভাষা থেকে যে ক্রমশ শব্দ আহরণ করবেই—এই সমস্ত কথা মহানামকে সময় খরচ করে বোঝাতেই হয়। কথা দিতে হয় তিনি তাকে বিশ্বসাহিত্য পড়তে সাহায্য করবেন। না হলে এষা ভীষণ বিমর্ষ হয়ে যায়।

হঠাৎ মহানাম জিজ্ঞেস করেন—‘তোমার বন্ধু সেই ছেলেটি। সে কেমন আছে!’

‘ভালো আছে?’

‘দ্যাটস আ মিথ। মোটেই ভালো নেই। র‍্যাগেড ফিলসফার, চুল আঁচড়ায় না, জামা-টামা ইস্ত্রি করে না, ও তো সালফারের পেশেন্ট!’

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress