পঞ্চম পুরুষ (Pancham Purus) : 08
এষার মধ্যে একটা বালিকাসুলভ চঞ্চলতা এসেছে। ভোরে উঠে পড়েছে, বাড়ির সবাই জাগবার অনেক আগেই। চুপচাপ জামাকাপড় বদলে নিয়েছে। দু মিনিট দাঁড়িয়ে ভেবেছে এরকম দরজা খোলা রেখে বেরিয়ে যাওয়া ঠিক হবে কিনা। তারপরেই শম্ভাজীকে মনে পড়ে গেল, রাত ডিউটি যখন, সকাল আটটা পর্যন্ত নিশ্চয়ই থাকবে। সন্তর্পণে সদর-দরজা ভেজিয়ে দিয়ে সে মেন গেটে গিয়ে শম্ভাজীর সঙ্গে কথা বলে নিল। একটু যেন নজর রাখে।
খোলা রাস্তা। দুপাশে গাছ, মসৃণ ধূলিহীন পথ। হাঁটবার জন্যেই এসব পথের সৃষ্টি। কে যেন বলেছিলেন তাঁর প্রিয় হবি হাঁটা। ঠিকই বলেছিলেন। হাঁটা একটা নেশা হওয়ারই যোগ্য। তুমি হাঁটছো, তোমার দু পাশ থেকে ভোরের হাওয়া এসে তোমায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে, একটু একটু শীতালো হাওয়া, হাওয়ার সঙ্গে নাম-না-জানা গাছপালা, পাখি, আকাশ, এসবের গন্ধ জড়িয়ে থাকবেই। তুমি ধরতে চাইবে, পারবে না, গন্ধটা তোমায় চমকে দিয়ে, প্রশ্ন জাগিয়ে দিয়েই পালিয়ে যাবে। এই হাওয়া আর এই অবকাশ ভরা পদক্ষেপের অনুষঙ্গে কোথা থেকে এলোমেলো চিন্তারা উড়ে এসে পড়বে। হিল কার্ট রোড, বোল্ডার সাজানো। একটু দূরেই পাইন, পাইন ফারের ফাঁকে ফাঁকে পর্বতরেখা, ম্যাল রোড মুসৌরি, একদিকে পাহাড়, আর একদিকে ঢালু খাদে হোটেল, বাড়ি, দেওদার। কার্ট রোড দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে টমাস হার্ডির টেসের কথা কেন মনে পড়েছিল? এখন সেইটা আবার মনে পড়ল—গ্রহ দুরকম আছে, একরকম—সুস্থ, একরকম রুগ্ন, আমাদের গ্রহটা কিরকম? রুগ্ন। কিশোরী টেস তার বালক ভাইকে বলছে। কেন এটা মনে এলো এষা জানে না আবার মুসৌরি অনুষঙ্গে গিরীন্দ্রশেখরের পুরাণ-প্রবেশ-এর কথা মনে এলো, কীভাবে ভগীরথের গঙ্গা-আনয়নের মিথকে ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন! এইভাবে যদি প্রাচীন ভারতবর্ষের একটা পূর্ণ চেহারা দাঁড় করাতে পারা যায়। ইস্স এই রাস্তা দিয়ে বাজীরাওয়ের ঘোড়া গিয়েছে কি না কে জানে, তখন হয়ত ছিল শুধু পাহাড়ি রাস্তা। এমন সমতল নয়।
বাঁক ফিরতেই একরাশ আলো এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আলোকের এই ঝরনাধারায় ধুইয়ে দাও। এটা পুর্ব দিক। গাছ নেই। চওড়া পথ। আশে পাশে দোকান, একটা মনোহারি দোকানের করোগেটেড ঝাঁপ গড়গড় করতে করতে উঠে গেল। বিরাট দোকান, এখান থেকেই নিশ্চয় নীলমের বাড়ির অর্ধেক জিনিস যায়। বাস চলে গেল অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে। এষা দোকানে ঢুকল, তারপর ধীর লয়ে ফিরল।
ওরা সকলেই লিভিং রুমে জড়ো হয়েছে। এষা ঢুকতে পুপু বলল—‘ওই তো মাসী এসে গেছে।’
অরিত্র মুখ কালো করে বলল—‘কাউকে না বলে কয়ে অচেনা জায়গায় এমন বেরোতে হয়? যদি পথ হারাতে? যদি কোনও বিপদে পড়তে?’
নীলম বলল—‘এষা, তোমার কী শরীরে ক্লান্তি নেই। এই গরমে এতটা পাড়ি দিয়ে কাল অত রাতে এলে। আজ আলো না ফুটতেই বেড়াতে বেরিয়েছো!’
এষা হাত থেকে আইসক্রিমের বাক্স নামাল , হেসে বলল—‘জেটে তো আর আসি নি। যে জেট ল্যাগ হবে। পথের কষ্ট কাল রাত্তিরের ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লম্বা ড্রাইভে একদম দূর হয়ে গেছে বিশ্বাস করো। যেটুকু ঘুমিয়েছি, সলিড। আর নীলম, তিনটে দিন হলেই একটা জায়গা পুরনো হয়ে যায়। প্রথম দিনেই তার স্বাদ নিতে হয় তাই।’
—‘তিন দিনেই পুরনো? হায় কপাল।’ নীলম মন্তব্য করল। —‘চেনা হয়ে গেলেই সেই অচেনা-অচেনা রোমাঞ্চের ঠিকানা উধাও হয়ে যায়।’
অরিত্রর মুখের মেঘ সরে গেছে, একটু চেঁচিয়ে বলল—‘এষা তুমি ভোরের চাটা মিস করলে, নীলম ওকে গুজরাতি মশলা চা বানিয়ে দাও। আমাদেরও দিও। আর ব্রেকফাস্ট দেবে টেবিল ভর্তি করে। এষা তুমি যদি এতোই ফিট থাকো, তাহলে আমি অফিস গিয়েই গাড়িটা ফিরিয়ে দেবো। নীলমের সঙ্গে গিয়ে পুনার খানিকটা অন্তত দেখে এসো। নতুন থাকতে থাকতে।’
পুপু বলল—‘হ্যাঁ মাসী, নতুন থাকতে থাকতে।’
অরিত্র উঠে স্টিরিও চালিয়ে দিল।
‘ও মেরে জোহরা জবী তুঝে মালুম নহী।
তু হ্যয়ে অব ভি হাসিন ম্যয় হুঁ নওজওয়াঁ।’
ঠিক মনে হচ্ছে এষার মাথায় কাঁধে চৈত্ৰশেষের কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ি ঝরে পড়েছে রেড রোডে। পেভমেন্ট ভর্তি হয়ে আছে স্খলিত ফুলে ফুলে। সেই ফুল কিছু কুড়িয়ে কিছু এড়িয়ে করুণ রঙিন পথ ধরে চলে যাচ্ছে এষা।
হে আমার প্রিয়তমা, জানো না তুমি জানো না, এখনও তুমি তেমনই রূপসী, আর আমি যে এখনও নওজোয়ান। অরিত্রর মনে হল অষ্টমীর রাতে সন্ধিপুজোর সময়ে সামান্য সিদ্ধি খেয়ে ওরা যে আরতি নৃত্যটা করে সেটা এখন, এখানেই নাচতে পারলে ওর মনের মধ্যে যে বিপুল আনন্দ রোমাঞ্চ যৌবন আকাঙ্ক্ষা জমাট হয়ে রয়েছে সেটা মুক্তি পেতো।
পার্বতী মন্দিরে উঠতে উঠতে একটা ধাপে বসে পড়ল নীলম, বলল—‘বলো কিরকম লাগছে।’
এষার পায়ের অনেক নিচে বিছিয়ে পড়ে রয়েছে পুনে শহর। নদীর সর্পিল রেখা, ব্রিজ, বাগান, রাস্তায় আর নদীতে তফাৎ করা যায় না রোদ চকচক করলে। এষা বলল—‘অপূর্ব।’
‘সত্যি?’
‘সত্য বই মিথ্যা বলিব না।’
‘কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে পড়লে।’
দাঁড়িয়ে পড়তে বাধা কি? যদি মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে না এসে থাকি।’
‘তবে তোমার সাক্ষ্যটা পুরোপুরিই নেওয়া যাক।’
‘তুমি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছো, না?’
‘কেন, তুমি হওনি?’
হয়েছি। যা রোদ! সকালবেলায় বোঝা যায়নি সূর্যের এতো দাপট হবে। কি যে সাক্ষ্য নেবার কথা বললে!’
নীলম বলল—‘ভয়ে বলি না নির্ভয়ে বলি। এষা একটু বিভ্রান্ত চোখে তাকিয়ে বলল—‘অবশ্যই নির্ভয়ে।’
‘আগে বলো আমাদের কি রকম দেখছো?’
‘চমৎকার!’ এষা দ্বিধাহীন গলায় বলল, ‘অজন্তা দেখবো বলে এসেছি। কিন্তু তোমাদের বিশেষ করে পুপুকে না দেখলে জীবনে সত্যিকার দ্রষ্টব্য জিনিস কিছু না দেখা থেকে যেত নীলম।’
নীলম বলল—‘এষা, সত্যি করে বলল শুধু অজন্তা দেখবার জন্যই এসেছ! এটা কি সম্ভব! অজন্তা দেখবার আরও সহজ পথ আছে। এই পথটাকেই বাছলে কেন?’
এষা বলল—‘দেখো নীলম, আমার অবচেতন মনে কি ছিল তা তো বলতে পারব না। কিন্তু সচেতনভাবে তুমি আর অরি দেখাতে পারবে বলেই এসেছি। আমি তো মেমসাহেব নই। আমার একলা ঘোরার অভিজ্ঞতা খুব ভালো নয়।’
একটু ইতস্তত করে নীলম বলল—‘কোনও দুঃখ কোনও রাগ নিয়ে আসো নি?’
এষা হঠাৎ হেসে ফেলল, নীলমের চুল উড়ছে। কানের পাশে সেগুলো গুঁজে দিতে দিতে বলল—‘রাগ-অনুরাগ কোনটাই বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই, বিশ্বাস করো। থাকলে কি আসতে পারতুম? তুমি পারতে? বলো না?’
‘কিছু মনে করো না এষা, এতো হারিয়েছি, এমন অনিশ্চিত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছি যে আমি সহজেই ভয় পেয়ে যাই। তোমার রাগ-অনুরাগ যদি অবশিষ্ট না-ও থাকে, অরির কিন্তু যোল আনা রয়েছে।’
‘থাকলে, শীতল জল নিক্ষেপ করে নিবিয়ে দেবার চেষ্টা করব কথা দিচ্ছি।
‘তাছাড়া তোমার যদি রাগ থেকে থাকে দোষ তো দেওয়া যায় না। যা ঘটেছে তোমার ওপর চূড়ান্ত অন্যায় করেই ঘটেছে, এ তো নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখে আমাকে স্বীকার করতেই হবে।’
এষা বলল—‘ভাবের ঘরে চুরি করা যায় না নীলম। হৃদয়ের ব্যাপারে উচিত অনুচিত মেনে চলা নৈতিক দিক থেকে ঠিক হতে পারে। কিন্তু সত্য হয় না, বাস্তবও হয় না। তাছাড়া যা হয়েছে ভালো হয়েছে নীলম। অরির যা স্বভাব। ও আমাকে চিরকাল দেবী টেবী বানিয়ে রেখে দিত , পেছনে চালচিত্র, হাতে চাঁদমালা ঝুলিয়ে। তার চেয়ে এ অনেক স্বাভাবিক হয়েছে। বেঁচে গেছি। দুজনেই।’
কথাটা নীলমকে কোথাও খুব গভীর ভাবে আঘাত করল। সে কি শুধুই রক্তমাংসের নারী? যাকে দিয়ে অরিত্রর প্রয়োজন মেটে, সংসার যাত্রা নির্বাহ হয়? আর এষা চির-গরিয়সী?
এভাবে কথাগুলো বলা যায় না। এমনিতেই কেন এসেছে প্রশ্ন করে সে আতিথ্যের নিয়মই ভঙ্গ করেছে একরকম। অরি জানতে পারলে তুলকালাম করবে। কিন্তু বুকের মধ্যের কষ্ট, জ্বালা যে কিছুতেই যায় না। বলল—‘ব্যক্তিগত প্রশ্ন করছি, কিছু মনে করো না। ডিভোর্স করলে কেন? ভদ্রলোক শুনেছি সব দিক দিয়েই খুব সুপাত্র ছিলেন। খালি বয়সটাই একটু বেশি ছিল, নয়?’
এষা জবাব দিল না। নীলম তখনও জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়েই আছে দেখে হেসে বলল—‘ভয় নেই অরির জন্য করিনি।’
‘আহা আমি কি তাই বলেছি, তাহলে?’
‘সব কথা কি বলা যায়?’
ভদ্রতার সীমা লঙ্ঘিত হয়ে যাচ্ছে এবং এষা তার সম্পর্কে খুব খারাপ ধারণা করবে বুঝেও নীলম ছাড়ল না। নিজের ব্যক্তিগত সমস্যার অনেকটাই সে এষাকে বলে ফেলেছে আবেগের মুখে। এষারও উচিত তার নিজস্ব গোপনতা ভঙ্গ করে তার জবাব দেওয়া।
‘তুমি তো মিডল ইস্টে ছিলে?’
‘হ্যাঁ, পাঁচ বছর। বাহ্রিন।’
‘তারপর?’
‘তারপর কলকাতায় ফিরলুম।’
‘কে কে ছিলেন ওখানে?’
‘শ্বশুর শাশুড়ি। উনি। আর কেউ না।’
বেশ তো ছোট সংসার। শ্বশুর-শাশুড়ি খারাপ ছিলেন। খারাপ ব্যবহার করতেন?
এষা নিশ্বাস ফেলে বলল—‘খারাপ ছিলেন না, নীলম। খালি শ্বশুরমশাই আমাকে মাইনে করা সেবিকার মতো ব্যবহার করতেন, আর শাশুড়ি ব্যবহার করতেন খাস পরিচারিকার মতো।’
শ্বশুর-শাশুড়িকে সেবা করতে বাধ্য হওয়াটাই তাহলে তোমার সঙ্কটের কারণ!’
না, তা নয়, নীলম। শ্বশুর ভীষণ ভালোবাসতেন, এক গ্লাস জল খেতেও তাঁর এষা-মার দরকার হত। ধরো জলের কুঁজো-টা ওঁর নিজের ঘরেই রয়েছে। হাত বাড়ালেই পাওয়া যাবে, আর আমি ধরো তখন বাথরুমে স্নান করছি। যতক্ষণ না আমি এসে জল গড়িয়ে দোব, ততক্ষণ উনি খাবেনই না। আর শাশুড়ি? ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমায় আত্মীয় স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশীর কুৎসা শুনতে হত। তাদের অনেককে আমি চিনিও না। তাঁর সঙ্গে আমায় প্রতিটি বাংলা এবং কিছু হিন্দি ফিলম দেখতে যেতে হত। টি ভি সিরিয়ালও। সেসবও করতুম। কিন্তু নীলম মানুষ হয়ে জন্মালে সবারই একটু নিজস্ব সময়ের, নিজস্ব কাজের দরকার হয়, সেটা তাঁরা কিছুতেই দিতে চাইতেন না। আমার সমস্ত সময়টা, জীবনটা তাঁদের তিনজনের মধ্যে বাঁটোয়ারা করে দিতে হত। রাতের ঘুমটাও তো একেবারেই আমার নিজস্ব ছিল না। যখন তখন সেটাতে টান পড়ত। একরকম জোর করে শেষ পরীক্ষাটা পাশ করলুম। চুপিচুপি অ্যাপ্লিকেশন পাঠিয়ে কলেজের চাকরিটা যোগাড় করলুম। ওঁরা সেটা মেনে নিতে পারলেন না।’
‘ব্যাপারটা খুব অনাধুনিক শোনাচ্ছে এষা।’
—‘শোনাক। বউয়ের বাপের বাড়ি থেকে নির্দিষ্ট পণের টাকার পরও হাজার হাজার টাকার দাবীতে শ্বশুর-শাশুড়ি-স্বামী সবাই মিলে বউকে খুন করার ঘটনাও অনাধুনিক, একেবারে মধ্যযুগীয় শোনায়। শোনায় না? তবু তো ঘটে। অনেক বাবা-মাই ছেলের বিয়ে দ্যান একটি উচ্চশ্রেণীর পরিচারিকা বা সেবিকা পাবার জন্যে। বাবা-মার সেবা করবার জন্য ছেলে বউ আনছে এ ধারণা তো আমাদের শাশ্বত কালের নীলম। সেবা করাটা বড় কথা নয়, সেটা জীবনযাপনের আনুষঙ্গিক। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে তুমি কাজের লোক খোঁজো, নার্স খোঁজো সেই উদ্দেশ্যে ছেলের বউ খুঁজবে? ব্যাপারটা একটু ভেবে দ্যাখো নীলম! তারপর পান-জর্দা খেতে খেতে সেই হাসি, আর বামুনের মেয়ের সঙ্গে কায়েতের ছেলের ভাবের গল্প শোনা! উঃ আমার যে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হত।’
‘আপত্তি করতে পারতিস!’
‘ওরে বাবা, যতই কেন তুমি উচ্চশিক্ষিত এবং বয়ঃপ্রাপ্ত হও না, নিজের মতামত, নিজের রুচির কথা প্রকাশ করা বড়দের কাছে অত্যন্ত গর্হিত ব্যাপার ছিল। যেটুকু চেষ্টা করেছি, তাতেই দাম্ভিক রুক্ষভাষিণী বলে বদনাম হয়েছিল। পাশের বাড়ির বউটির সঙ্গে কথায় কথায় আমার তুলনা হত। সে অবশ্য শাশুড়ির নিন্দে করবার জন্যেই শুধু আমার সঙ্গে ভাব করেছিল। এবং শ্বশুর-শাশুড়ির হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্যে নিজের ছেলেমেয়েদুটিকে নিঃশর্তে তাঁদের হাতে ছেড়ে দিয়েছিল।’
‘ছেলেমেয়ে হলে বেঁচে যেতে এষা।’
‘আরও বেশি করে মরতুম নীলম। তোমার পুপুর মতো এমন আপনাতে আপনি বিকশিত হবার সুযোগ দিতে তো পারতুম না। যন্ত্রণা বাড়ত। হাজার চেষ্টা করলেও কেউ কেউ নিজের রুচি, শিক্ষা, ব্যক্তিত্ব দমন করতে পারে না যে।’
‘এমন অদ্ভুত বিয়ে বাড়ি থেকে দিলেন কেন?’
‘কিছু অদ্ভুত তো নয়! বাইরে থেকে কি এসব বোঝা যায়? শাশুড়ি গ্র্যাজুয়েট ছিলেন। শ্বশুরমশাই অবসরপ্রাপ্ত জজ। তাতে কি হল? একটি মাত্র ছেলে। সে-ও এক যন্ত্রণা। ছেলের ঠিক কতটা ভাগ বউয়ের, কতটা বাবা-মার এই তৌল একটা নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল বাড়িতে।’
—‘তা ছেলে কি বেশির ভাগটাই বাবা-মার ছিলেন? নীলমের গলায় প্রচ্ছন্ন পরিহাস।’
‘নাঃ।’ এষা ছোট্ট করে বলল।
‘তবে? তিনিও কি তোমাকে দেবীর মতো ব্যবহার করতেন?’
—‘না। তিনি আমাকে ঠিক বাথরুমের মতো ব্যবহার করতেন।’ বলে ফেলেই এষা বিবর্ণ হয়ে গেল। তার চোখে-মুখে যন্ত্রণার ছাপ এতো স্পষ্ট, গভীর লজ্জা, দুঃখ, অনপনেয় অপমান তাকে এই মুহূর্তে এমন ভাবে বয়স্ক করে দিয়েছে যে নীলম মুখ নিচু করে ফেলল। এভাবে এষাকে জেরা করা তার উচিত হয়নি বুঝতে পেরে নিজেও ভীষণ দুঃখিত বোধ করল নীলম। কিন্তু সে তো শুধুমাত্র মেয়েলি কৌতূহলের বশে প্রশ্নগুলো করেনি, তার জানা দরকার ছিল এষার অবস্থিতি বিন্দু ঠিক কোনখানে, অরিত্রর সঙ্গে তার সম্পর্ক কি হতে পারে? আগে থেকে জানা থাকলে, অনেক বিপদই তো এড়ানো সম্ভব! জীবন-মরণের প্রশ্ন তার। বুঝতে পারলে এষা ক্ষমা করবে। এষা, আমাকে মাপ করো। আমি আগেও তোমার কষ্টের কারণ হয়েছি। ভীষণ কষ্ট। এখনও তোমাকে খুব যন্ত্রণা দিয়েছি। আহা এষা, মুখখানা কালো হয়ে গেছে। তুমি কি এখন তোমার শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে রুচিবিরুদ্ধ বাধ্যতামূলক সঙ্গদানের ক্লান্তিকর স্মৃতিতে ফিরে গেছো, নাকি স্বামীর সঙ্গে অনভিপ্রেত সহবাসে! এভাবে তোমাকে দুঃস্বপ্নে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আমায় মাপ করো। তুমি বোধহয় ছোট পাখি, কিন্তু ছোট হলেও আকাশে সাঁতার কাটতে না পারলে মরে যাও। এষা আমি তোমাকে খানিকটা বুঝেছি। এবং আকাশচারিণী বলেই তোমার কাছ থেকে বারবার ক্ষমা চাইবার সাহস আমার হয়।
ডেকান জিমখানার কাছে একটা ছোট পরিচ্ছন্ন রেস্তোরাঁয় দুজনে দুপুরের খাওয়া সারল। দুজনেই চুপচাপ। দুজনেই বিষণ্ণ। বাড়িতে নেমে দরজার তালা খুলল নীলম, এষা অন্যমনস্ক দাঁড়িয়ে আছে। নীলম জানে না। এষার হতাশা ডিপ্রেশন, কী ভয়ানক জিনিস। যতবারই আসে তার সঙ্গে মোকাবিলা করতে এষার প্রাণ কণ্ঠাগত হয়, শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত খরচ হয়ে যায়। অথচ সে এ জিনিস জয় করবেই। প্রাণপণে বলে, আমি অন্ধকারে বদ্ধমূল, আলোর দিকে উঠছি, অন্ধকার যতই গাঢ়, কঠিন, দুর্ভেদ্য হয়, তার জেদও ততই বেড়ে যায়। আলো আলো, শেষ পর্যন্ত সে আলোয় পৌঁছবেই। নীলম জানে না। কিন্তু নীলম এখন দেখছে তার সুদৃশ্য পোর্টিকোয় এক বজ্রাহত গাছ। পাতা নেই, ডালপালা খসে গেছে, শুধু একটি ঘোর কৃষ্ণবর্ণ গুড়ি, তার গাঁটে গাঁটে শাখা-পল্লবের প্রত্ন চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নীলমের চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়ছে। হাত বাড়িয়ে বলল—‘এসো, কই এসো, আমি আর কোনদিন অতীতের কথা তুলব না।’
এষার আকাশে মেঘের পরে মেঘ জমেছে। এ রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিক মেঘ নয়। এ বুঝি সুধীন্দ্রনাথের সংবর্ত। প্রাণপণে সেই মেঘজাল দুহাতে সরাতে থাকে এষা, কোথায় সূর্য, কোথায় তুমি, কদর্মপাত্রে তুমি তোমার দক্ষিণ মুখ বারবার ঢেকো না। তত্ত্বং পূষণ অপাবৃণু, জ্যোতির্ধর্মায় দৃষ্টয়ে।