পঞ্চম পুরুষ (Pancham Purus) : 07
বইয়ের বন্ধন থেকে, শ্রবণ-মনন-নিদিধ্যাসনের বন্ধন থেকে এখন বেশ কিছুদিনের জন্য এক্কেবারে ছুটি। অভ্যাসের বাইরের অডিওভিশুয়াল এখন অন্তত কিছুদিন। ট্রেন ঝপাং করে রাত্রের নিস্তব্ধতার সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে চোখের ওপরের আলোটা নিবিয়ে দিয়ে মাঝের বাঙ্কে ঢুকে পড়ল এষা। কোমর অবধি পাতলা চাদর। পায়ের কাছে জানলার ফোকর দিয়ে হু হু করে হাওয়া আসছে। পায়ের পাতা শিরশির করছে। কেমন একটা পুলক ছড়িয়ে যাচ্ছে। গায়ের চামড়া থেকে শিরশিরানিটা উঠছে পাতলা ছাপা শাড়ির কিনার বেয়ে সব পোশাকে পরিচ্ছদে, বাকি শরীরে। রক্তে সুদ্ধু। ভারি আরাম! আহ।
প্রথম দিনের দুপুরবেলাটা খুব অসুবিধে হয়নি। রোদ চশমা পরে কিছুক্ষণ বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ জড়িয়ে এসেছিল। সীটের গায়ে হেলান দিয়ে মুখে লিটল ম্যাগাজিন চাপা দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেওয়া গেছে। সন্ধে হতে থাকলেই, আলো জ্বালবার সময় হলে, ট্রেনময় গুনগুন আরম্ভ হয়, কুড়মুড় করে বাদামভাজা, ছোলাভাজা, ডালমুট, চানাচুর চিবোচ্ছে, এদিকে ওদিকে একটা বাচ্চা এতক্ষণ খেলে বেড়াচ্ছিল বেশ, এষার কাছ থেকেও বার দুই ঘুরে গেছে। এখন হঠাৎ তারস্বরে চিৎকার করছে—‘গোটা করে দাও।’ তার ললিপপ তার ছেলেমানুষ-মা লোভ সামলাতে না পেরে একটু চেটে চুটে দিয়েছে। ব্যাস। আর যায় কোথায়। তার লবঙ্কুস ভাঙা হয়ে গেছে। তাকে গোটা করে দিতে হবে। অপ্রস্তুত মা অন্য ললিপপ দিচ্ছে, লাল নীল সবুজ কতরকম রঙ। ভবি কিন্তু ভোলবার নয়। তার ওই বিবর্ণ হলুদ চাটা ললিপপটাই চাই। এবং গোটা অবস্থায়। মির্যাকল-সাধনে অক্ষম মা বাবার অনুনয় ক্রমশ বিরক্ত বকুনিতে পরিণত হচ্ছে। চাপা গলায় চেঁচাচ্ছে বাবা। ট্রেনের গলার সঙ্গে গলা মিলিয়ে বিভিন্ন দল গল্প করছে চারদিকে, এক ভদ্রলোকের ভারী গলা মাঝে মাঝে অন্যগুলোকে ছাপিয়ে উঠছে। ‘আগে গীতাঞ্জলিতে বরাবর ঠাণ্ডাজল সাপ্লাই দিত।’
হাইতোলা সন্ধের আলস্য সর্বাঙ্গে চাদরের মতো জড়িয়ে চতুর্দিকের গুঞ্জনের মধ্যে লুপ্ত হয়ে বসে থাকা। কোলে পত্রিকা খোলা, এত কম আলো, পড়তে গেলে চোখে লাগে, ছবিগুলোই দেখা হচ্ছে শুধু। সামনের ভদ্রমহিলা জিজ্ঞাসা করলেন—‘কিধর যানা হ্যায় আপকা?’
—‘কল্যাণ।’
—‘বাস? কলিয়ান তক?’
বেশি কথা বাড়াতে ইচ্ছে করে না। ভদ্রমহিলা বেশ জমজমাট। প্রত্যেকটা জংশনে তাঁর সঙ্গে কেউ না কেউ দেখা করতে আসে। হাতে টিফিনবাক্স। কোনটাতে নাস্তা, কোনটাতে খানা। এষার দেওয়া কড়া-পাকের সন্দেশ নিয়েছিলেন দুপুরে। উনি পুরি ভাজি আচার এষাকে ভাগ করে দিতে চাইলেন। এষা আটার এইসব পুরি খেতে পারে না, যথাসম্ভব বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যাত করে পিকুর পলিথিন মোড়কে দেওয়া পাতলা সাদা রুটি আলুচচ্চড়ির সঙ্গে খেল। এসব ব্যাপারে পিকুর তুলনা হয় না। বন্ধু কি মা বোঝা দায়। দ্বিতীয় দিনের জন্যেও সরু চিঁড়ে, মিষ্টি, কাটা লেবু, বিচি ছাড়িয়ে দিয়ে দিয়েছে। সারা সন্ধে এষা আড়চোখে সহযাত্রীদের দিকে তাকাচ্ছে। কখন ঘুমোয় এরা কে জানে। রাত বারোটা অবধি হয়ত আড্ডা দেয়, টিভি দেখে, অনেকের অভ্যেস হয়ত মাঝরাতের পর খাওয়া। অবশেষে মাঝের ভদ্রলোক উঠে পড়তেই, ওপাশের ভদ্রলোকও বাথরুমের দিকে চলে গেলেন। এষা উঠে দাঁড়িয়ে ছোট্ট করে আড়মোড়া ভাঙল। আহ, রাতের মতো আরাম। ঘুম যিনি সৃষ্টি করেছেন তাঁর মতো প্রজ্ঞাবান, করুণাময় আর কেউ থাকতে পারে না। শুয়ে শুয়ে পায়ের দিকে দেখা যায় খোলা মাঠে অগণিত তারার আকাশ, তলায় ছোট্ট ছোট্ট বাক্সভর্তি ফোঁটা ফোঁটা মানুষ কণা। তারারা অত উজ্জ্বল, কিন্তু কোত্থাও যায় না, বিধিনির্দিষ্ট চক্রপথে ঘুরে ঘুরে মরে, কণা কণা মানুষ অথচ প্রবল প্রাণচাঞ্চল্যে ঘুরে বেড়ায়। নিজের ইচ্ছেমতো। আমি সেই মানুষ। কখনও থেমে থাকব না। এমনি করে চলতে চলতে শেষ হবো। মৃত্যু কি আকাশের মতো? ওইরকম একরঙা? গম্ভীর? যাকে স্বাধীন ইচ্ছার ব্যবহার বলে আত্মতুষ্ট থাকছি তাও আবার বিধিনির্দিষ্ট নয় তো? পৃথিবীর চক্রাবর্তনগুলোও তো সাদা চোখে দেখা যায় না!
গাড়ি ছুটছে আজ তপ্ত খোলার মতো মাঠ ঘাটের মধ্য দিয়ে। জানলা কষে বন্ধ। প্রথমে কাচ বন্ধ হয়েছিল শুধু। তারপর খড়খড়ি। বাইরে লু বইছে। কামরায় গাড়ি ভরা অন্ধকারের মধ্যে মানুষগুলোর কুকুরের মতো জিভ বার করে হাঁপানোর অবস্থা। সামনে বসা অল্পবয়সী আগরওয়াল ছেলেটি দিল্লিবোর্ডের পরীক্ষা দিয়ে বম্বে যাচ্ছে মামার বাড়ি। রুমাল ভিজিয়ে মুখে চাপা দিয়েছে। ভিজে রুমালের ফাঁক দিয়ে এষার দিকে তাকিয়ে হাসল। অর্থাৎ তুমিও এমন করো, আরাম পাবে। ছোট-বড় কারো কাছ থেকেই কিছু শিখতে আপত্তি নেই। এষা ব্যাগ থেকে পুঁচকে তোয়ালে বার করল, ঠাণ্ডা জলে ভিজিয়ে নিয়ে মুখে চাপা দিয়ে হাসছে ও-ও। দ্যাখো, কেমন গুরুমারা বিদ্যে। তুমি রুমাল, তো আমি তোয়ালে, চট করে শুকোবে না।
কোল্ড ড্রিঙ্কস ছাড়া কিচ্ছু খাচ্ছে না ছেলেটা। অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলে মোড়া ভেজিটেরিয়ান মীল একটা নিয়েছিল এষা। কিছু খেতে পারল না। পোলাওয়ে, ডালে, আলুর তরকারিতে, আচারে সবটাই একতাল পিণ্ড হয়ে আছে যেন। আগরওয়ালের মতো ঠাণ্ডা আর ফল খেয়ে কাটালেই ভালো ছিল। খাবার ছিলও সঙ্গে। পিকু বলেছিল—‘সরু পাটনাই চিঁড়ে, একটু জল দিয়ে ভিজিয়ে লেবু চিনি দিয়ে খেয়ে নিবি। পেট ঠাণ্ডা থাকবে।’ বলেছিল, বলেছিল। খাওয়ার জনা ছুটন্ত ট্রেনে অত কসরৎ করতে ইচ্ছে করে না এষার। এখন ট্রেনের দেওয়া গরম পিণ্ড হাতে বোকার মতো নাড়াচাড়া করতে করতে মনে হচ্ছে পিকূটার অভিজ্ঞতা, ব্যবহারিক জ্ঞান দুটোই বেশি। কাজে লাগালে মন্দ হত না। দুবন্ধুতে যখন একত্রে শহরতলিতে বাড়ি করার কথা চিন্তা করছিল তখন পিকু হেসে বলেছিল—‘আমি তোর ঘর সামলাবো, তুই আমার বাইরেটা সামলে দিস। কিন্তু যদি বিয়ে করিস?’
এষা গম্ভীর হয়ে বলেছিল—‘ওয়ান্স ইজ এনাফ। কিন্তু তুইও তো সেটা করতে পারিস।’
পিকু আর এক কাঠি বাড়া, গম্ভীর হয়ে বলেছিল—‘ওয়ান্স ইজ এনাফ।’
দুজনেই হেসে ফেলেছিল। এষাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে পিকু বলেছিল
—‘তুমি নিয়ে চলো আমাকে লোকোত্তরে
তোমাকে বন্ধু আমি লোকায়তে বাঁধি।’
গাড়ি নাগপুরে পৌঁছলে বড় বড় কমলালেবু সস্তায় কিনে ফেলল আগরওয়াল। এতক্ষণের বাকহীনতা ত্যাগ করে বলল—‘কমলা বহোত আচ্ছা হ্যায় জিজি, টেস্ট করকে দেখিয়ে না।’
এষাকে কিনিয়ে দিল এক ডজন। নাগপুরী লেবু খেতে খেতে চল্লো দুজন। কোথায় লাগে দার্জিলিঙের কমলা। অথচ কলকাতায় ধারণা নাগপুরী লেবু জাতে নিকৃষ্ট। অর্থাৎ নাগপুরীরা নিজেদের জন্য ভালো জিনিসটা রেখে দেয়, নিচুমানের জিনিসটা বাইরে পাঠায়। পশ্চিমমঙ্গে আমরা ঠিক উল্টো করি, সুন্দরবনের চিংড়িমাছ, মধু, হুগলি, বর্ধমানের ভালো চাল, দার্জিলিং-এর শ্রেষ্ঠ চা সব বিদেশী মুদ্রার লোভে বিক্রি হয়ে যায়। নিজেদের খাবার জন্যে নিকৃষ্টতম, অনেকসময়ে অখাদ্য জিনিস রেখে দিই আমরা। নিজেদের অপমান করতে আমাদের জুড়ি নেই।
ওয়ার্ধা পেরোতে না পেরোতেই দুধারে চষা, কাজলা মাটি। দেখতে দেখতে চোখ জুড়িয়ে যায়। বড় বড় কালো পাথরের চাঁই বিশুষ্ক নদীখাতে সাজিয়ে রেখেছে সহ্যাদ্রি। এষা অবাক হয়ে দেখে অবিকল এক পাল ছোট বড় হাতি জলকেলি করে উঠে আসছে। কি অদ্ভুত খেয়াল প্রকৃতির! কোনও জাতকের কাহিনী যেন ভাস্কর্যে খাড়া করে রেখেছে পথের ধারে। ছদ্দন্ত জাতকে বোধিসত্ত্ব ষড়দন্ত হস্তীরাজ হয়ে জন্মেছিলেন। ওই তো সেই মহিমময় গজরাজ। পাশে পিকু নেই। আনন্দ আর বিস্ময়ের ভাগ কাউকে না দিতে পারলে তৃপ্তি হয় না। জানলা দিয়ে যতক্ষণ দেখা যায় ফিরে ফিরে তবু দৃশ্যটা দেখতেই থাকে এষা। সুব্রত আগরওয়াল বুঝতে পেরেছে কিছু একটা বিশেষ দ্রষ্টব্য আছে, কিন্তু ও জানলার পাশে বসে নেই। এষার উল্টো দিকের সীটে জানলা থেকে সবচেয়ে দূরে বসে আছে, হাজার মুখ বাড়িয়েও ও কিছুই দেখতে পেলো না। খাতটা বেশ নিচে। শেষকালে থাকতে না পেরে বলেই ফেলল—‘কুছ অজীব চীজ হ্যায় জিজি?’ এষা হেসে বলল—‘অজীব কুছ নহী ভাইয়া, পাত্থর হ্যায়।’
—“বাস?’
‘বাস।’ ছদ্দন্ত জাতকের হস্তীযূথের গল্প, সহ্যাদ্রির বোল্ডারে তার ভাস্কর্যের গল্প ছুটন্ত ট্রেনে একপ্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে আগরওয়াল ছেলেকে সে কি করে বলে!
ট্রেন একটার পর একটা টানেল পেরোচ্ছে। যেই অন্ধকারে প্রবেশ করছে অমনি অরির সঙ্গে দেখা হওয়ার ভয়ানক মুহূর্তের কথা মনে করে অন্ধকারকেই বরণ করছে এষা। আলোয় বেরিয়ে এলেই আবার ভয় কেটে যাচ্ছে। কত রকমই তো দেখা হল জীবনে। ভয় কিসের? কে যেন ট্রেনের ছন্দে বলতে থাকে অভী ভব, অভী ভব। অমনি এষা আপাদমস্তক শান্ত হয়ে যায়। আবার মনে হয় কেন তার করতে গেল অরিত্রকে? জলগাঁও হয়ে বাসে গেলেই হত। কিংবা কোনও ট্রাভেল এজেন্টকে ধরলেও হত। ওরা এক এক দিনে এক এক জায়গা দেখায়। এরকম ভ্রমণে মন ভরে না কখনও না। এষা তাই নিশ্চিন্ততার আশ্বাস সত্ত্বেও ট্রাভেল এজেন্টদের এড়িয়ে যায়। অরিত্রকে কেন এজেন্ট করতে গেল? চিঠির পর চিঠিতে অরিত্র শুধু লেখে—‘এষা, বন্ধুত্ব বড় দামী। বন্ধুত্বই শেষ কথা। আমরা কি বন্ধু হতেও পারি না। নিছক বন্ধু। নিরবধি কাল, আর বিপুলা পৃথিবী, তুলনায় জীবন পরিধি জীবনকাল যে বড্ডই ছোট। বন্ধুতা প্রত্যাখ্যানের রুদ্রতা তোমাকে মানায় না।’
লেট যাচ্ছে ট্রেন। অত রাতে পৌঁছে কাউকে দেখতে না পেলে কি করবে? সোজা বোম্বে চলে যাবে। অতিরিক্ত টাকা গুণাগার দিয়ে বেঙ্গল লজে একটা দুটো দিন কাটিয়ে তারপর ঠিক করা যাবে সব। নাঃ, ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস পৌঁছতে আরও রাত হবে। দূর যা হয় হবে। ঝাঁকানি খেতে খেতে অবতরণের জন্য প্রস্তুত হতে টয়লেটের দিকে চলল এষা। সুব্রত আগরওয়াল মুখ তুলে হাসল। মিসেস জৈন বিশাল শরীর সরিয়ে জায়গা করে দিলেন। মনমদ, নাসিক রোড, ইগৎপুরী⋯।
বহুক্ষণের প্রত্যাশিত ট্রেন কলিয়ান পৌঁছোচ্ছে। ঘস্ ঘস্ ঘস্ ট্রেনের শব্দ ক্রমশই মন্থর, ক্রমশই ভারী। ট্রেনের কামরার সঙ্গে এষার পা এঁটে যাচ্ছে। স্বপ্নে হাঁটার মতো এগিয়েও সে এগোতে পারছে না। হালকা সুটকেস হঠাৎ হাতে তুলে নিল সুব্রত পেছন থেকে এগিয়ে এসে। এষার কাঁধে শুধু ব্যাগ। কামরার দরজার ফ্রেমে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। জনবহুল প্ল্যাটফর্ম। লেটে পৌঁছেছে গীতাঞ্জলি, পুরো প্ল্যাটফর্ম ব্যস্ত, সচল, সরব হয়ে উঠেছে। কোথায় অরিত্র? সে যদি খুব বদলে গিয়ে থাকে চিনবে কি করে তাকে? আঠার বছরের ব্যবধান। জীবন পাল্টে গেছে, মানুষের বহিরঙ্গ পাল্টে গেছে, পরিবেশ পাল্টে গেছে, কোন ভরসায় এমন অনির্দিষ্টের বুকে ঝাঁপ দেওয়া? তেমন কিছু লম্বা নয় প্ল্যাটফর্ম। অপরিচিত আদলের মুখ, মুখভঙ্গি থেকে চেনা মুখ, চেনা ভঙ্গি খুঁজে বার করতে পারছে না এষা। মন্থর পায়ে সে শুধু হেঁটেই যাচ্ছে, হেঁটেই যাচ্ছে, হাতে ফাইবারের সুটকেস, কাঁধে ব্যাগ, এষা হাঁটছে।
দূর থেকে, বহু দূর থেকে কিন্তু দেখতে পেয়েছে অরিত্র। কামরার দরজায় যখন এষা দূরতম নক্ষত্রের কাছে একটি উজ্জ্বল হলুদ বিন্দু, তখন থেকেই। আশ্চর্য হয়ে, একেবারে স্তব্ধ স্থাণু হয়ে দেখছে অরিত্র। এষা আসছে, অথচ আঠার বছর পার হয়নি। ঠিক সেই জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে আছে এষা যেখান থেকে বিদায় নিয়েছিল। কফি হাউসের ওপর তলার ডান উইঙের সেই কোণ। ঠিক সেইখান থেকেই এগোচ্ছে এষা। কাঁধ ছাড়িয়ে বিষণ্ণ চুল। অন্তরালে সূর্যঅলা পাতলা একটুকরো সজল নীলচে মেঘ। চলার ছন্দে অরিত্রর সমস্ত ধ্যানের ভুবন টালমাটাল দুলছে।
তুমি আসো যুগান্তর হতে নারীচেতনার মর্মমূল থেকে যাদুঘুম ভেঙে উঠে, সময়ের অনীকিনী স্তব্ধ করে ইশারায় ঐশ্বরিক অধরসম্পুটে।
আসো পারমাণবিক ঝটিকার ভয়াবহ ভবিতব্যতায়
তুমুল বিদ্রোহে আসো কোটি কোটি ভাইরাসের সংক্রামের মতো, রক্তকণা, অণুচক্রিকায়।
অনড় অচল অরিত্রর কাছাকাছি যখন এষা পৌঁছল তখন আবিষ্টের মতো, সম্মোহিতের মতো অরিত্র নাতি উচ্চকণ্ঠে এই-ই বলছিল। এই স্তাবকের পাশ দিয়ে রেলকর্মী, কুলী, যাত্রী আসছে, যাচ্ছে। কারো ভ্রূক্ষেপ নেই। অরিত্ররও নেই। সম্মোহিত সেই স্তব শুনতে শুনতে জলভারাক্রান্ত মেঘ যেমন অগ্নিবর্ষী হয়ে ওঠে মাঝে মাঝে, এষার হৃদয়ের মধ্যেও তেমনি ছোট ছোট বিদ্যুৎ ঝিলিক দিতে লাগল। চিৎকার করে সে বলতে চাইল—মিথ্যে কথা। আমি তো নয়। তুমি, তুমি, তুমিই এমনি করে আসতে, অনাকাঙ্ক্ষিত ভাইরাসের মতো, অনাকাঙ্ক্ষিত কিন্তু অমোঘ। সংক্রামক। রক্তস্রোতে নেশা ধরিয়ে, তুমুল বিদ্রোহে। রুক্ষ চুল শত শঙ্খচূড় শাবকের মতো মাথায় ফণা তুলেছে, কপাল অদৃশ্য, ধারাল কুকরির মতো নাক, ফালা ফালা চোখ। কখনও মদির, মেদুর, বসন্তে, বিপ্লবে। চারমিনারের ধোঁয়ার মতো অনর্গল শব্দ স্রোত, সাইক্লোনিক ঝড়, পাহাড়ি নদীর ঢল, হাইওয়েতে ছুটে চলা দূরপাল্লা বাসের মতো ধাবমান, গর্জমান, কখনও টুপটাপ ধরে আসা বৃষ্টি, টুং টাং কোলভরা শিউলি, বকুল, অশ্রান্ত, অভ্রান্ত, এবং আবারও, শতবার অমোঘ।
আপার সার্কুলার রোড ধরে চলতে চলতে গাড়িটা বিবেকানন্দ রোডে বাঁক নিয়ে কর্নওয়ালিস স্ট্রীটে ঢুকেছিল। সম্পূর্ণ অন্যমনস্ক বলে খেয়াল হয়নি, কিন্তু বাঁদিকে দাশগুপ্ত, ইনটারন্যাশন্যাল, আর চক্রবর্তী চ্যাটার্জি, সারি সারি বইয়ের দোকান, ফুটপাথ, রেলিং ভর্তি ছাত্র-ছাত্রীর টাটকা আপাতত ক্লান্তিভরা মুখ, পোর্টফোলিও হাতে কালো-চশমা অবধারিত অধ্যাপক, গবেষক, এর পরেও কলেজ স্ট্রীট পাড়া চিনতে না পারলে⋯ ঠিক পাঁচ বছর। মাত্রই পাঁচ বছর পর স্বদেশ। অথচ সেই পাঁচ বছর একটা যুগ। কতকিছু সম্পূর্ণ ভোলবার কঠোর প্রতিজ্ঞার পাঁচ বছর। খুব দূর কোথাও থেকে নয় অবশ্য, মাত্রই পৃথিবীর টাঁকশাল মধ্যপ্রাচ্য থেকে। প্রতিবার দেশে ফেরার টাকাকড়ি, ছুটিছাটা সবই খুঁটিয়ে পাওয়া যায়। তাইতে গালফ কানট্রির যেখানে যেখানে ঢোকা যায়, তাছাড়াও ভারতকে সামান্য টপকে বর্মামুলুক, সিঙ্গাপুর, হংকং, জাপান ঘুরে ঘুরে কাটে। দেশে ফেরবার নাম করে না। সে সব দিনে এষা যা বলবে, এষা যা করবে তাইই হবার কথা। স্বামী এষার থেকে দিনক্ষণ মিলিয়ে ঠিক সতের বছর তিনমাস সাড়ে পাঁচ দিনের বড়।
শফার গোবিন্দলালকে বলল—‘একটু দাঁড়াও না গোবিন্দদা, একবার নামব।’
অন্য কোথাও গাড়ি রাখার অসুবিধে, ও কলুটোলায় ঢুকল। এষা পেছু ফিরে বইপাড়ার দিকে চলল। চারদিকে পুরনো বইয়ের ঝাঁঝ, নতুন বইয়ের বৃষ্টিভেজা মাটির মতো সোঁদা সোঁদা গন্ধ। স্টলে স্টলে মোটা মোটা নোট বই, কাগজ, ম্যাপ, ফুল, পাখি, যন্ত্রযান, মহামানব।
‘কি চাই। দিদি কি চাই!’
‘একবার বলেই দেখুন না, কি বই!’
অত্যুৎসাহী এক ছোকরা স্টলদার টুল এগিয়ে দিতে দিতে বলল—‘ফিফ্থ্ পেপার ইংরেজির সমস্ত নোটস বেরিয়ে গেছে দিদি। কমপ্লিট ইন ওয়ান ভল্যুম।’
কেন যে ওরা এষাকে দেখে ইংরেজি ফিফ্থ্ পেপারের নোট্স্ কিনতে আসা ছাত্রী বা দিদিমণি মনে হল কে জানে। তখন তার সারা গায়ে বিদেশ-বিদেশ বিলাস-বিলাস গন্ধ। এ গন্ধ ছাত্রী বা অধ্যাপিকাদের গায়ে থাকে না। ত্বকের যা জেল্লা, তা-ও সদ্য বিদেশ ফেরৎদের অঙ্গেই মেলে। যারা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শীতাতপনিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে, দূষিত পানীয় জলের সঙ্গে বহুদিন মোলাকাত করেনি, ভেজালহীন খাদ্য ও প্রসাধন দ্রব্য ব্যবহার করবার দীর্ঘ সুযোগ পেয়েছে।
ছেলেটিকে নিরস্ত করে বঙ্কিম চাটুজ্জে স্ট্রীটে ঢুকল সে। কেন কে জানে। একলা একলা তো কেউ কফি হাউসে যায় না। হাঁটবার উপযুক্ত রাস্তাও এটা নয়। ইউনিভার্সিটি ইনস্টিট্যুটের সামনে দিয়ে, মহাবোধি সোসাইটি ঘুরে, কলেজ স্কোয়্যারের ও প্রান্ত দিয়ে কলুটোলা ঢুকলেই হবে। কলেজ স্কোয়্যারটাকে মন্দিরের মতো প্রদক্ষিণ করা তো হবে। আলমা মেটারের অংশ তো বটে। হঠাৎ তার একদা প্রিয় পরিচ্ছন্ন বইয়ের দোকানের শো কেসের দিকে চোখের দৃষ্টি চুম্বকের আকর্ষণে লৌহখণ্ডের মতো ছুটে গেল। পাতলা ডবল ডিমাই সাইজের একটা বই। ওপরে খুব দুর্বোধ্য নারী মুখ, পিকাসো আর যামিনী রায় পাঞ্চ করেছে। বইয়ের নাম ‘প্রেষার জন্য’, মন্ত্রচালিতের মতো দোকানটাতে ঢুকে পড়ল এষা। সাড়ে এগার টাকা খরচ করে বইটা কিনে ফেলল। বইয়ের জন্য বেশ খরচ করা হয়েছে, যদিও মাত্র দু ফর্মার বই। কাগজের মান খুব ভালো। কবিতার সঙ্গে শুধু সরু মোটা রেখায় আঁকা ধোঁয়াটে ধোঁয়াটে সব ছবি।
বইটা নিয়ে গাড়িতে ফিরে এলো এষা। দ্রুত। কেন যেন মনে হল এখানে ঘোরাফেরা করা আর একদম নিরাপদ নয়। এ এক জঙ্গল। আদিম, বন্য, শ্বাপদসঙ্কুল। যে কোনও সময়ে, যে কোনও জায়গা থেকে লাফিয়ে নামতে পারে রক্তলোলুপ, হিংস্র শাপদ। প্রেষারা তাহলে এখনও বেঁচে আছে? বেঁচে থাকে? কিন্তু কোথায় যাবে? অনন্ত সময় কোনও অবিমিশ্র নিরালায় মেয়েদের একলা একলা বসে থাকার দিন কি এখনও কোনও দেশে এসেছে? একটু ভাবতে হল। অবশেষে গোবিন্দকে বলল—‘একটু ভিক্টোরিয়ায় নিয়ে যাবে?’
রিয়ার-ভিউ মিররে দেখল ওর ভুরু কুঁচকে গেছে।
‘ভিক্টোরিয়ায়? একা, বউদি?’
‘তুমি একটু কাছাকাছি থাকবে। বড্ড যেতে ইচ্ছে করছে।’
‘দাদার সঙ্গে গেলে হত না?’
‘তখন বিকেল ফুরিয়ে যাবে গোবিন্দ। একটু নিয়ে চলো প্লীজ।’
গোবিন্দ নির্ঘাত ভাবল তার দাদাবাবু ছিটেল মেয়ে বিয়ে করেছে। কিন্তু দেখা গেল গোবিন্দ ঠিকই বলেছিল। ভিক্টোরিয়ায় এষা বসতে পারল না। প্রথমত অসম্ভব ভিড় এবং নোংরা। দ্বিতীয়ত কৌতূহল। প্রায় প্রতিটি লোক একবার করে বই হাতে মহিলাটিকে নিরীক্ষণ করে যেতে লাগল। অনেকেই নানারকম মন্তব্য করছে। তার দু চারটে গোবিন্দর সঙ্গে তার সম্পর্ক সম্বন্ধে গভীর গবেষণামূলক। বসে থাকা গেল না। গোবিন্দ খুব গম্ভীর মুখে তাকে বাড়ি পৌঁছে দিল।
এসেছে সে কথা জানান দিয়ে দুজোড়া ভ্রূকুটির দিকে পেছন ফিরে এষা নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করল। কোলে গভীর বারান্দা। চেয়ার টেনে সেইখানে বসল। বহুতলের দশতলায়। যেন আকাশে হেলান দিয়ে। এখন ছটার কাছাকাছি, তবু আলো আছে। সেই আলোয় নাম পড়ল ত্রিলোকেশ গৌরব। না ঠিকই ধরেছে! এ প্রেষা সেই প্রেষাই। উৎসর্গ পত্রে ধারাল তরোয়ালের খোঁচা—প্রেষার জন্য, ‘প্রেষার জন্য, প্রেষার জন্য।’ হঠাৎ এষার মনে হল তার বুকের ঠিক মধ্যিখানে ওই তরোয়ালটার তীক্ষ্ণ অগ্রভাগ ঢুকে গেছে। তার সূচীমুখ একেবারে হৃৎপিণ্ডে আমূল বিদ্ধ। ঝকঝকে বাঁটটুকু শুধু উঠে আছে। ভলকে ভলকে রক্ত বেরোচ্ছে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে। এষার শরীরে তাহলে এতো রক্ত ছিল? এষার বুকে তাহলে এতো যন্ত্রণা ছিল? এখনও আছে? থাকে? কোলেস্টেরলের মতো রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করে গরহজম আবেগের কুচি? উপুড় হয়ে সে পড়ে থাকে বহুক্ষণ, আস্তে আস্তে রক্তের নদী থেকে মুখ তোলে। তরোয়ালটার সোনালি হাতলে মুষ্টিবদ্ধ হাত, প্রাণপণে তুলে ফেলে একটা অতিকায় রাক্ষুসে কাঁটা ওপড়ানোর মতো করে, তারপর ক্লান্ত হাতে যতদূর সম্ভব দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। দূরে। পড়ন্ত আলোর ধূলিকণার মতো অক্ষর ভাসে:
‘তুমি আসো যুগান্তর হতে নারী চেতনার মর্মমূল থেকে যাদু ঘুম ভেঙে উঠে⋯’ বিকেলের আলোয় ঝিম ধরেছে। এষার চারপাশে যেন উজ্জ্বল স্বচ্ছ স্ফটিকের আবরণ যা তাকে একই সঙ্গে পৃথিবী থেকে ভিন্ন এবং অভিন্ন করে রেখেছে। দেখতে পাচ্ছে সব। কিন্তু সবই জলের মধ্যে প্রতিবিম্বের মতো। যে কোনও মুহূর্তে লোষ্ট্রাঘাতে টুকরো টুকরো হয়ে হারিয়ে যেতে পারে সব। সে যেন মহাকাশযাত্রীর ভ্যাকুয়াম স্যুটের মধ্যে প্রশে করছে। নির্ভার। ভাসমান। লক্ষ লক্ষ জ্যোতিষ্কে ভরা ভয়ঙ্কর আকাশ। অয়নমণ্ডল। সৌরলোক থেকে সারাক্ষণ অবাঞ্ছিত, বিপজ্জনক রশ্মিসমূহ এসে বিঁধছে, বিস্ফোরিত হচ্ছে। কিন্তু তবু রক্তে কিসের নেশা? তবু কেন এই ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক বাতাবরণে রক্তে ঝিম ধরে!
স্পেস রকেটে যাই ফোকটে
ক্লোজ্ড্ অর্বিট একদম ফিট
হাই সেন্টার কই মনিটর
করো নেক্সট মুভ আরে বেওকুফ
খালি বক বক টক্কা টরে টক
টরে টক্কা টক বক বক বক
আ-র ল্যান্ডিং ট্রিলি লিংলিং
রিং ভেনাসের? নাকি হাইতির
ডালাসের? একি সাইকি?
নিদারুণ ক্লান্তিতে বইটা বন্ধ করে দিল এষা। চেনা এই ইডিয়ম, এই মর্স কোড।এই অর্থবহ ফাজলামি, ফাজলামির তলায় বৈদ্যুতিক ইঙ্গিত এষার চেনা। এইসব বাকপ্রতিমা এখন তার হৃদয়ে বিবমিষা জাগায়। অনুষঙ্গে। অতীতেক্ষণে।
নিশ্বাস ফেলে অরিত্রর দিকে তাকাল এষা। সিংহের কেশরের মতো সেই অবিন্যস্ত চুল এখন শাসনে এসেছে। চুল পেকে যাবার আগে একটা বিবর্ণ মরচে রঙ ধরে, সেই রঙ এখন চুলে। উজ্জ্বল, ভাবালু চোখের মণি চশমার কাচের আড়ালে। ধারাল গালের কাঠামো স্ফীত হয়েছে। অরিত্র যেন আগের মতো লম্বা নেই। খাটো হয়ে গেছে। এষা হেসে বলল—‘কাকে দেখছি? কবি ত্রিলোকেশ গৌরব? না এগজিকিউটিভ অরিত্র চৌধুরী?’
অরিত্র কথা বলতে পারছে না। মনে মনে যা বলছে মুখে তা বলা যাচ্ছে না। আস্তে আস্তে শুধু বলল— ‘কবিরা কখনও পুরোপুরি মরে না। এষা, তুমি শেষ পর্যন্ত তাহলে এলে? আমার কাছে?’
এষা মুখ তুলে বলল—‘এলাম। শুধু তোমার কাছে কেন? নীলম কেমন আছে? মেয়ে কত বড়?’ আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করল এষা নীলম নামটা কত সহজে উচ্চারণ করতে পেরে গেল সে। আর পারবার পরই বুকটা কিরকম হালকা হয়ে গেল, চলার গতি বাড়িয়ে দিল এষা। বলল— ‘তোমাকে ছুট করিয়ে খুব কষ্ট দিলাম। ওকি ওরকম পা টেনে টেনে হাঁটছ কেন?’
অরিত্র বলল— ‘একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল। ঠিক হয়ে এসেছে। ও কিছু না।’ বলল না, জীবন যেতে বসেছিল, যে জীবন নীলমের সে জীবন গেলে এষার কিছু আসত যেত কিনা কে জানে!
গতি কমিয়ে দিল এষা। আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। অরিত্র বলল—‘আগের গাড়িটা আমরা মিস করলুম। বড্ড লেট করেছে আজ গীতাঞ্জলি। লাস্ট ট্রেন ধরতে হবে। মিডনাইটে পৌঁছবে। টিকিট কেটে আনি, তুমি দাঁড়াও।’
ভীষণ ভিড়। সিদ্ধেশ্বর এক্সপ্রেস উপছে পড়ছে। এইটেই আজ কোলাপুর যাবার শেষ ট্রেন। এষার জন্য কোনমতে জায়গা করে দরজার কাছ ঘেঁষে দাঁড়াল অরিত্র। ট্রেন ছুটছে, এষা শুনতে পাচ্ছে অরিত্র সহযাত্রীর সঙ্গে ভাব জমিয়েছে—‘ওহ নো। শী ইজ নট মাই ওয়াইফ। বাট আ গ্রেট ফ্রেন্ড। আই কুড ইজিলি লে ডাউন মাই লাইফ ফর হার।⋯ইয়েস⋯দ্যাটস রাইট। উই আর মীটিং আফটার এইটিন ইয়ার্স। ক্যান য়ু ইম্যাজিন ইট?’ মহারাষ্ট্রীয় ভদ্রলোক আড়চোখে এষার দিকে তাকালেন। এষা ভাবল অরিত্র কি কিছু খেয়েছে?
অন্ধকারে আস্তে আস্তে পাহাড়ে উঠছে ট্রেন। বাতাস ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে, নির্মল হয়ে যাচ্ছে। ছুটন্ত পথের পাশে আলোর মালা ছুটে যাচ্ছে।
পাটিল অরিত্রর হাত থেকে সুটকেশটা নিল। চোখে প্রশ্ন। অরিত্র বলল—‘গীতাঞ্জলি সাঙ্ঘাতিক লেট। বড্ড দেরি হয়ে গেল। তুমি বাড়ি যাও।’ পাটিলের খুব ইচ্ছে বাড়ি চলে যায়। কিন্তু সাবকে এভাবে একা দায়িত্বে দিয়ে মাঝরাত্তিরে চলে যাওয়া ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছে না। অরিত্র বলল—‘চলো তোমায় নামিয়ে দোব।’
পুনে শহরের ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা নীল-নীল রাত বেয়ে অরিত্রর গাড়ি চলে। ড্রাইভারের আসনে অনেক দিন পরে অরিত্র। তার মনে হচ্ছে গাড়ি নয়, সে নৌকার দাঁড় বাইছে। এই বেয়ে চলা যেন কখনো না ফুরোয়। কী অদ্ভুত মায়াময়, শিরশিরে, সুগন্ধ রাত। যেন মর্তলোকের নয়। স্বর্গেরও নয়। এ কোনও মধ্যভূমি। যেখানে কিন্নর অথবা যক্ষ অথবা, গন্ধর্বরা থাকে। বাতাসের সঙ্গে মিশে তারা আপন খেয়ালে ঘোরাফেরা করছে এই রহস্যময় মাঝরাতে। সহসা গাড়ির হেডলাইটের রূঢ় আলোয় তারা দৃশ্য হতেই পারে। যে কবিতা সে অনেক অনেক দিন আগে হারিয়ে ফেলেছে সে-ই যেন তার সামনে, পাশে, পেছনে বসে তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে। অনিঃশেষ তার রাজকীয় মহিমা। এখনও, এখনও। এই ক্লান্ত মধ্যযামেও।
এষা ভাবছে এইভাবে কতদিন পাশাপাশি ট্রামে বাসে ট্যাকসিতে চলন্ত যানের ছন্দে দেহছন্দ বেঁধে নেওয়া। বন্ধনহীন গ্রন্থি। সর্বনেশে দিক ভোলানো হাওয়ায় ভাঁটির টানে সাগর। গায়ে নোনা বাতাস। সমুদ্রের নুন কপালে, গালে, আঙুলের ফাঁকে, দুই হাতে গতির উল্লাস। ব্রেকারের চড়াই উৎরাই ডিঙিয়ে গভীর স্বচ্ছ নীল জল, চোরা স্রোতের টানে ঘাট থেকে আঘাটায়, রক্ষাকালীর সূচীমুখ জিভের মতো অন্তরীপ, নির্জন দ্বীপুঞ্জের অনাবিষ্কৃত কুমারী অরণ্য। জাগ্রত আগ্নেয়গিরিমালার ক্রেটার থেকে ক্রেটারে উৎক্ষেপ।
যথাকালে এই দুঃসাহসের কাহিনী খানবাড়ির কানে উঠল। ঘৃণায় মূৰ্ছিত হয়ে পড়লেন বাড়ির অধিষ্ঠাত্রী দেবী। তিরস্কার, অবরোধ। তুলোর বাক্সর মধ্যে আঙুরকে শুইয়ে রাখা হয় খুব সম্ভব যত্নের জন্য। মানুষকেও এভাবে রাখলে তার প্রতিরোধক্ষমতা কমে যাবার সম্ভাবনা থেকে যায়, কেউ সে কথা ভাবে না। কিন্তু জানলা বন্ধ করে দিলেও ঝড় যখন আসবার তখন ঠিকই আসে। জানলার খড়খড়িগুলো তুলে দিয়ে, গর্জন করে ঢুকে পড়ে কর্ণরন্ধ্রে। এই ঝড় সমস্ত গতানুগতিকতার মুখে পাথর খসিয়ে জীবনের মোড় ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে তবে বিদায় নেয়।
বন্ধুরা বলছে—‘সাবধান এষা। অরিত্র চৌধুরীর ঈশ্বরী কিন্তু তুমি একা নও। আগেও ছিল, পরেও থাকবে। আন্ডার-গ্র্যাজুয়েট থেকে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট থেকে রিসার্চস্কলার, অরিত্র চৌধুরী ওরফে ত্রিলোকেশ গৌরবের ইতিহাস একই রকম।’
অরিত্র দ্রুত হাঁটছে, হাওয়ায় চুল উড়ছে, চোখের কোণ সরু হয়ে গেছে, বলছে—‘কী চমৎকার কোঁকড়া চুল নীলম মেয়েটার। কী পরমাশ্চর্য কার্ভ ঠোঁটে। আমি এরকম আর দেখিনি। দেখেছ এষা?’
এষা বলছে—‘তুমি আমাকে কবে বিয়ে করবে অরি?
‘হঠাৎ? দুম করে?’
‘কেন বিনামেঘে বজ্রপাত হল?’
—‘হাউ ইউ টক এষা? জানো না তুমি আমার হৃদযন্ত্র?’
—‘জানি অরি। আমি তোমার ফুসফুস, পাকস্থলী, প্লীহা, যকৃৎ, বোধহয় আপাতত তোমার অন্ত্র, ক্ষুদ্র এবং বৃহৎ।’
—‘ছি এষা ছি। তুমি কি আমার ঘর দেখে আসোনি? আজ চার বছর ধরে দেখ না? জাঠতুত, খুড়তুত, পিসতুত, সিঁড়ির তলার ঘরে কোনক্রমে দিনপাত, দেখো নি? চাকরি করতে হলে আমি মরে যাবো।’
‘বেশ তো চালিয়ে যাও তোমার লেখা। তুমি যতদিন না প্রতিষ্ঠিত হবে, আমি করব চাকরি।’
‘তুমি চাকরি করবে? দশটা পাঁচটা? দিদিমণি? কালো ব্যাগ? বেঁটে ছাতা?’ কবি গৌরব ভয়ার্ত চোখে তার ঈশ্বরীর দিকে চেয়ে রইল।
এষা বলল—‘কি রকমের কবি তুমি। সত্যকে ভয় পাও, বাস্তবকে ঘৃণা করো? তুমি এসকেপিস্ট। এসকেপ দিয়ে আর কবিতা হবে না।’
—‘আমি এসকেপিস্ট নই এষা। এ পোয়েট উইথ এ মিশন। আমাকে খারিজ করে যুগের বাবার সাধ্য নেই! কবিতা এক ধরনের সাইকিয়াট্রি। যুগমানসের মগজের মধ্যে ঢুকে মন্ত্রশক্তি দিয়ে তাকে সম্মোহিত করে নির্জ্ঞান থেকে সজ্ঞান স্তরে নিয়ে আসে তার সমস্ত পাপবোধ, পুণ্যের জন্য যন্ত্রণা, এ কবির দায়িত্ব অনেক। সে দায়িত্ব নিয়ে ধোপদুরস্ত ফিটবাবু হয়ে অফিস যাওয়া চলে না।’
‘আসল কথা বলো অরিত্র। মিথ্যে বলছ কেন! আসলে তোমার লক্ষ্য বস্তু বদলে গেছে।
‘তুমি কি নীলুম যোশীর কথা বলছ? আহা এষা, তোমাকে কোনদিনও বোঝাতে পারব না তুমি তামার টাটে ভোরের প্রথম শিশিরে ভেজা বিল্বপত্র। টোট্যালি আনপলিউটেড,’ কবির কণ্ঠ আর্দ্র, ‘তোমার চুলে জড়িয়ে আছে কত অজানা সমুদ্রের শৈবাল যারা কোনদিন সূর্যের মুখ দেখবে না, শুক্তির অভ্যন্তরের মতো তুমি অসূর্যম্পশ্যা অপাপবিদ্ধা। আর নীলম বালবিধবার বাগানের গন্ধরাজ। তার সমস্ত দেহমনের শুদ্ধি দিয়ে গড়া প্যাশন।’
‘তাই আমাকে অশুদ্ধ করলে?’ চোখ দিয়ে চলকে পড়ছে আগুন। ত্রিলোকেশের চোখে মেঘ, গলায় গুরু গুরু গর্জন—‘এষা, তুমি অশুদ্ধ হওনি, তোমাকে আমি ছুঁই নি, আমার কবিতা ছুঁয়েছে, আমি সজ্ঞানে চাইনি, আমার কবিতা চেয়েছিল। আর কবিতার মতো শুদ্ধ আর কিছুই হতে পারে না।’
‘কবিতার জন্য কত নারী লাগে অরি?’ চেয়ার ঠেলে উঠে গেল এষা। বিদ্যুতের মতো পার হয়ে যাচ্ছে অলিন্দ। স্পষ্ট তানের মতো দ্রুত লয়ে টপকে গেল সিঁড়ি। চলে গেছে। চিরকালের মতো চলে গেছে।
এষার সেই প্রথম করোনারি থ্রম্বসিস। নিঃশব্দ চিৎকারে মুখ গহ্বরের সেই একান্ত বিস্ফারণ। নিজের টুঁটি নিজে টিপে ধরা। দাবানল! দাবানল! সমস্ত স্নায়ুগ্রন্থি আগুনের ভাঁটি। জ্বলে যায়, সব জ্বলে যায়।
দাদা কাগজে বিজ্ঞাপন দিলেন। বিজ্ঞাপনের উত্তর থেকে সে নিজেই পাত্র বেছে নিল। দিনক্ষণ মিলিয়ে সতের বছর তিন মাস সাড়ে পাঁচ দিনের বড়। রাশভারি। দায়িত্ববান। স্থিরবুদ্ধি।
অরিত্র বলল—‘তুমি তাহলে বইটা দেখেছিলে?’
এষা বলল-‘টা কেন? আর?’
‘এই প্রথম। ওই শেষ।’
‘তাহলে তোমার ভবিষ্যদ্বাণী ঠিক নয়? যুগ তোমাকে নিল না? অরিত্র? তোমাকে তাহলে চাকরি করতে হল? দশটা পাঁচটা। র্যাশন ব্যাগ, ঝুল ঝাড়া, বেবি ফুড?’
বিষণ্ণ চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে অরিত্র বলল— ‘কবিরা কখনও পুরোপুরি মরে না এষা। দে মিয়ারলি গো আনডারগ্রাউন্ড, লাইক সীড্স ইন উইন্টার। তুমি চলে গেলে কেন এষা? তৎক্ষণাৎ? কেন অত তাড়া করলে? না হলে হয়ত বুঝতে পারতে কবিরাও মানুষ। মানুষই ভুল করে। বইটা আমাকে ভর করেছিল এষা। তোমাকে দেবার জন্য পাগলের মতো খোঁজাখুঁজি করেছি। গেলে তো গেলে একেবারে বাহ্রিন?
এষার সিঁথিতে সিঁদুর নেই। বাহ্রিনের প্রসঙ্গ তাড়াতাড়ি চাপা দিতে অরিত্র বলল—‘তা সে যাই হোক, পেয়ে তো ছিলে ঠিক! খুশি হওনি? এষা-প্রেষা! তোমারই জন্য ওই বই।’
এষা মনে মনে বলছিল—‘হায় অরিত্র, তুমি কি জানো না? আমার জন্য কখনই ও বই ছিল না। আমিই ছিলুম ওর জন্য। আমার অলিন্দ নিলয়ের সব রক্ত, ফুসফুসভরা অক্সিজেনের গতায়াত, আমার পিটুইটারি, থাইরয়েড, অ্যাড্রিন্যালের সমস্ত পিচ্ছিল, সম্ভাবনাময় নিঃসরণ, মস্তিষ্কের কোষে কোষে মগজ নামক রহস্যময় পদার্থের চলাফেরা, নার্ভাস সিসটেমের সমস্ত রিফ্লেক্স নিঃশেষে হজম করে পুষ্ট হয়েছিল ওই অতিকায় ব্যাকটিরিয়া। আমি টুকরো টুকরো করে ছিঁড়েছি ওর পাতা। মলাট দুটো দুমড়ে, মুচড়ে দাঁত দিয়ে চিবিয়ে দিয়েছি। ছুরি দিয়ে ফালা ফালা করে চিরে দিয়েছি রঙিন পিকাসো মুখ যাতে শব্দের সঙ্গে শব্দের অণ্বয়াভাস চিরকালের মতো আদ্যন্ত মুছে যায়।
বীথিকাপথে সবুজ-সবুজ আলোয় রাতপোকা ঘুরছে। নিদ্রামগ্ন প্রিয়লকরনগর। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাই রাত্রে ঘটে থাকে। বিশ্ব যখন নিদ্রামগ্ন। ঘটে বড় বড় অসুখ, মৃত্যু, জন্ম, মিলন। লোকচেতনার আড়ালে অরিত্র চৌধুরীর জীবনে একটা মস্ত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। ব্লক বি। শম্ভাজী আলো-জ্বলা সেট হাট করে খুলে দিয়েছে। আওয়াজে পুপুর ঘরের জানলার পর্দা সরে গেছে। দরজা খোলার শব্দ। পোর্টিকোয় মাথার ওপরে ফ্রস্টেড বালব একটা গোল, তার আলো পুপুর সুগোল মাথার ওপর দুধ ঢেলে দিয়েছে। পুপুর চার পাশ ঘিরে সাধুসন্তদের মতো আলোর ছটা।
—‘বাবা বাবা। তোমরা কত দেরী করলে? মা ভাবতে ভাবতে কান্নাকাটি করছে দেখো এখন।’
ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা মিষ্টি গলার স্বর। অনেকটা বয়ঃসন্ধির কিশোরকণ্ঠের মতো। এষাই আগে গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে গেল। অরিত্র বুট খুলছে। পুপুর হাত ধরে এষা বলল—‘আমার জন্যে তোমার বাবাকে অনেক কষ্ট করতে হল। এতটা দূর জানলে আমি এমন আবদার কখনই করতুম না। ভিটি চলে যেতুম। একটা দিন বম্বে কাটিয়ে ডেকান কুইনে চলে আসতুম।’
পুপু বলল—‘তুমি আগে ভেতরে চলো মাসি। বাবার অ্যাকসিডেন্টের পর থেকে আমার মা ভীষণ শেকি হয়ে গেছে। এমনিতেও খুব সুপারস্টিশাস। মা এষা এষা করে কাঁদছিল।’
নীলম সত্যি-সত্যি এখন অন্তত কাঁদছিল না। কিন্তু ওর মুখে গাঢ় কালি। সোফায় বসেছিল মৃতের মতো। এষা দাঁড়িয়ে রইল। নীলম না উঠলে, না ডাকলে সে যেন এগোতে পারে না কিছুতেই। নীলমের গণ্ডির মধ্যে পা বাড়াতে ভীষণ যন্ত্রণা। অগ্নিবলয়ের মধ্যে দুর্ভেদ্য নীলম বসে আছে। আঁচে দুজনেরই মুখ ঝলসে যাচ্ছে।
অরিত্র এষার সুটকেস হাতে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে দেখে বহু চেষ্টায় নীলম উঠে দাঁড়াল। বিবর্ণ মুখে অরির দিকে ফিরে বলল— ‘আমি ভেবেছিলুম আবার তোমার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে।’
অরি বলল-‘ধুত। অ্যাকসিডেন্ট ইজ অ্যাকসিডেন্ট। একবারই হয় জীবনে। গীতাঞ্জলি বীভৎস লেট করেছে। সিদ্ধেশ্বরটা পাওয়া গেল তাই। নইলে আজ রাত্রে ফেরা হত কি না সন্দেহ।’
—‘তাহলে মায়ের একটা সাঙ্ঘাতিক কিছু হয়ে যেত বাবা।’ পুপু বলল।
এষা বলল—‘নীলম, আয় কেমন আছিস?’ তারপর হঠাৎ দু হাত বাড়িয়ে নীলমকে জড়িয়ে ধরল। কী খুশবু নীলমের কোঁকড়া চুলে। বেপথুমান আত্মসমর্পণের গন্ধ। এষার বুকে ঠিক পাখির বুকের মতো চিকন উষ্ণতা। নিবিড়, মধুর। দুজনে দুজনের কাছে দুঃখ, ভয়, সন্দেহ সব জমা রাখল। রেখে, এক নিঃশব্দ অঙ্গীকার একত্রে উচ্চারণ করে অরিত্রর দিকে ফিরল।