পঞ্চম পুরুষ (Pancham Purus) : 06
ফোন বাজছে ঝিঁঝির শব্দে। দুপুরের প্রহরা অনেকক্ষণ শেষ হয়ে গেছে। কাজকর্ম শেষ, খাওয়া-দাওয়া শেষ। খাবার হজম শেষ। ঢুলু ঢুলু চোখে গজল শোনা শেষ। অরিত্র অফিসে। পুপু কলেজে। রোজকার মতো। ঠিক রোজকার মতো। তিনমাস আগেকার মতো। বাড়ি ছন্দে ফিরে এসেছে। তাল কেটে গিয়েছিল, এখন আবার বিলম্বিত একতাল। কী শান্তি! নীলম ব্লাউস কাটছে। টেবিলের ওপর কাঁচি, ফিতে, দর্জির চক খড়ি। ঘোর চকোলেট রং-এর ব্লাউস। পিঠে, হাতায় স্ক্যালপ থাকবে। ইস্ত্রিটা ঈষৎ গরম, সামনে প্রস্তুত। না হলে স্ক্যালপ ভালো হবে না। ফোন বাজছে।
‘থানে থেকে করছি। হঠাৎ টেলিগ্রামে তলব কেন?’
নীলম সাবধানে বলল—‘এমনি, দুটো দিন কাটিয়ে যাও না।’
‘কোথায়? তোমাদের বাড়িতে?
‘আমাদের কুঁড়েঘরে আর জায়গা কোথায়? আহা, নিজের আস্তানা যেন নেই।’
‘কুঁড়েঘরে তো থাকতে না ভাবী। কোনকাল থেকে বলছি, ‘সুপার সীল’-এর হাতে ছেড়ে দাও। রাজপ্রাসাদ বানিয়ে ছেড়ে দেবো। পেয়েব্ল হোয়েনেব্ল। পে করারই দরকার হত না। চৌধুরী সাবের ইগো-স্যাটিসফ্যাকশনের জন্যেই⋯।’
‘তুমি আমাদের নিজের খরচায় রাজপ্রাসাদ বানিয়ে দেবে, তারপর ইনকাম ট্যাক্স ধরলে কি বলবো?’
‘আরে ভাবী! চৌধুরী সাব একটা অতবড় মালটিন্যাশন্যালের পি আর ও। তার ব্যাকগ্রাউন্ডে কত বাড়ি জমি-জমা সম্পত্তি থাকতে পারে। সেসবের খোঁজ কি তুমি রাখো? ওসব পেটি ব্যাপার সীলের হাতে ছেড়ে দেবে। তা কি ব্যাপার বলো!’
‘এমনি ইচ্ছে হতে নেই? অরি সেরে উঠল একটা অতবড় অ্যাকসিডেন্ট থেকে। সেলিব্রেট করাও তো দরকার!’
‘অরি চৌধুরী সেরে উঠলে সেলিব্রেট করতে আমাকে ডাকছে নাকি আজকাল! নিউজ অফ দি ইয়ার!’
‘এসো না প্লীজ। ভাবছি কটা দিন ছুটি নিয়ে সবাই মহাবলেশ্বর কি মাথেরন ঘুরে আসব। কিংবা গোয়া।’
‘মাথেরন যেতে হলে, তোমারাই এখানে চলে এস। আর মাথেরন, গোয়া, মহাবলেশ্বর, মুডের মিল পাচ্ছি না তো ম্যাডাম। দুটো পাহাড় আর একটা সমুদ্র, একটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা চলছে মনে হচ্ছে যেন।’
‘হোক গে মনে, যা মন চাইবে, তাই করব।’
‘আপাতত কি মন আমাকে চাইছে?’ গলার স্বর গাঢ়।
নীলম বলল—‘তাই তো তাই। তোমার সঙ্গে তো আর কথায় পারব না।’ বিক্রমের পেছনে নীলম, হু-হু হাওয়ায় শূন্যে উড়ছে স্কুটার। বাজার তো প্রতিদিন আছেই ভাবী। চলো আমরা আনন্দ বাজার করি আজ।
‘বিশে মার্চের ডেট লাইন কেন?’
‘বহুদিন বাদে আমাদের এক পুরনো বান্ধবী আসছে, অনেকদিন পর। সকলে মিলে খুব হই-চই করা যাবে।’
‘বান্ধবী কি সখী আঁধারে একেলা ঘরে?’
‘তাই তো মনে হচ্ছে। চলে এসো সীমাকে নিয়ে।’
‘আমি সীমাকে নিয়ে গেলে তোমাদের ‘একাকিনী’র জুড়ি মিলবে কি করে?’
‘মিলবে। মিলবে। ওসব তোমাকে ভাবতে হবে না। খালি এসে আমাকে’—নীলমের মুখ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল—‘বাঁচাও’, সাধু করে বলল—‘উদ্ধার করো।’
‘দেখা যাক, আসতে পারি কি না।’
‘আহা ভারি তো ব্যবসা। যে কোনও ডামির হাতে কদিনের জন্যে তাস ফেলে এলে আর ক কৌটো ব্ল্যাক মানি কম হবে?’
‘খবর্দার ভাবী, ব্ল্যাক মানি তুলে খোঁটা দিলে যাচ্ছি না।’
‘আচ্ছা, আচ্ছা। তুষারশুভ্র তোমার টাকা। হলো তো? রাখছি এখন।’
‘আহা। আহা। আর একটু কথা বললে কি অশুদ্ধ হয়ে যাবে? গলাটা যে তেমনি আছে। তেমনি পাখির শিসের মতো। শুনি একটু। আহ্ রোমাঞ্চ হচ্ছে।’
নীলম ফোনটা রেখে দিল। কপালে ঘাম ফুটছে। গলাটা যে তেমনি আছে। বিক্রম সুদ্ধু তাহলে জানিয়ে দিচ্ছে আজ নীলমকে ঘিরে কত পরিবর্তন। গলাটাই শুধু তেমনি আছে। পুরনো নীলম নেই। কিচ্ছু অবশিষ্ট নেই। আকৃতিতে, প্রকৃতিতে। তা-ই যদি না থাকবে, তাহলে বিক্রমের ফোন ধরতে অত কেন হাত কাঁপছিল? ভয়ে? গোপনে কিছু করবার ভয়ে? এখনও? না রোমাঞ্চে? বিক্রমের কণ্ঠ শুনলে, বিক্রমকে মানসচোখে দেখলেই স্মৃতিতে দুধ উথলোয়। ভীষণ, প্রবল, শক্তিমান, আকাঙক্ষাময় এক পুরুষ, দৃঢ়, মাংসল ঠোঁট, ভীষণ রকমের বাঙ্ময়, তার গানও গান নয়, সে-ও এক মাংসল আকাঙক্ষার প্রকাশ।
“লুৎফ্ উসকে বদনকা কুছ নহ্ পুছো,
কেয়া জানীয়ে, জান হ্যায়, কেহ, তন হ্যায়”—ওই তনুর স্পর্শে কী যে বর্ণনাতীত সুখ: সেকি প্রাণের? সে কি দেহের?
একটা মেয়ের মধ্যে কতগুলো মেয়ে বাস করে? ম্যাজিশিয়ানের টুপির মধ্যে থেকে খরগোশের মতো, কিংবা হাতের ফাঁক থেকে সাদা সাদা লক্কা পায়রার মতো ভিন্ন ভিন্ন ইঙ্গিতে তাদের আবির্ভাব! অরিত্র সকালে বিকেলে এক নীলমকে পায়। বিক্রমের ফোনে যে সাড়া দেয় সে সর্বৈব ভিন্ন নীলম। পুপু কাকে মা ডাকে? এষার আসার সম্ভাবনায় কোন নীলম বেরিয়ে এসেছে? মহানামই বা সেদিন মাঝরাত্তিরে কোন নীলমকে ডাক দিয়ে গেলেন? এছাড়াও আছে বিজয়া-সম্মিলনী কমিটির প্রেসিডেন্ট নীলম যোশী চৌধুরী। মণ্ডল, শা, বিজয়স্বামী আয়েঙ্গার, নন্দন খাদেলকরদের নীলম ভাবী। নীলম হঠাৎ উঠে আয়নার সামনে চলে গেল। এই বাড়িতে ফার্নিচার সবই মালটি-পারপাস, ড্রেসিং টেবল বলতে কিছু নেই। অরির শোবার ঘরে একটা লম্বা আয়না আছে। পুপুর ঘরে গোল আয়না। পাশের টেবিলের ড্রয়ারে কিছু নিত্যব্যবহার্য প্রসাধান দ্রব্য থাকে। বাকি সব পুপুর খাটবাক্সে। আয়নাটাই এ বাড়িতে একমাত্র জিনিস যেটা নীলম খুব যত্ন নিয়ে পরিষ্কার করে না। এই লম্বা আয়নাটা। একটা লেসের ঢাকনা দিয়ে ঢাকাও থাকে। মহানামই বলতেন—অবিকল জেন মরিস। এরকম মিল আমি আর দেখিনি। জেন মরিস ছিলেন দান্তে গেব্রিয়েলের বন্ধুপত্নী এবং তাঁর স্ত্রীর মতোই তাঁর অনেক ছবির মডেল। মিসেস রসেটি কি সুন্দর অল্প বয়সেই মারা যান, নীলমও কেন অল্প বয়সে মারা গেল না! অল্প বয়সে মারা গেলে সে মেয়ে চিরকাল রোমাঞ্চ, ভালোবাসা, আকাঙক্ষার পাত্রী হয়ে থাকে। তার খুব আশা ছিল অপারেশন টেবিলেই সে শেষ হয়ে যাবে। শরীরে রক্ত ছিল না। রক্তও খুব বিরল গ্রুপের, বোতল বোতল লেগেছিল। দুটো টেবিল বোঝাই হয়ে গেছিল রক্তের আর স্যালাইনের খালি বোতলে। অর্ধচেতনার মধ্যে খালি ভেসে থাকত পুপুর মুখটা। পুপুর তাহলে কি হবে , প্রত্যেক মায়ের ইচ্ছামৃত্যুর সামনে কি এই একটা পুতুলের বাধা থাকবেই? পুপু! পুপে! তুই কেন এলি? তুই কার? তুই কি আমার অপরাধ? অথচ তুই-ই যেন আমার সমস্ত অপরাধের ক্ষমা। কে বলেছে ক্ষমা নেই। সেই যে অরিত্র পড়ে শোনাত কে এক কবি বলছেন—‘অথচ ক্ষমাই আছে। ক্ষমাই আছে। কোনখানে তার কোনও খেদ জমা নেই।’ পুপুকে বুকে করে তেমন দীনভাবে ক্ষমা চাইতে পারলে কি বিধাতাপুরুষ ক্ষমা করবেন না? মানুষ ফিরিয়ে দেয়, ‘ক্ষমিতে পারিলাম না’ বলে আক্ষেপ করে, ঈশ্বর ক্ষমা করেন। হে পিতা, ইহারা জানে না কি করিতেছে, ইহাদের ক্ষমা করো। না, না। নীলম নিজে নিজেই হঠাৎ চমকে উঠল। মানুষই ক্ষমা করে বরং। ঈশ্বর করেন না। যে যৌবন নিয়ে অমন খেলা খেলেছিল, সে যৌবন তো মানুষ কাড়েনি। কেড়ে নিয়েছেন তিনিই। মানুষকে কতকগুলো অমূল্য সম্পদ দিয়ে তিনি পাঠান। স্বাস্থ্য, সৌন্দর্য, বুদ্ধি, প্রতিভা। পাঠিয়ে দিয়ে নিজে দীর্ঘ প্রবাসে চলে যান। পরিচালনা করবার জন্য, পরামর্শ দেবার জন্য বসে থাকেন না। একদিন হঠাৎ এসে শুধু হিসেবটা বুঝে নেবেন। নীলম যোশী, তোমার সম্পদ নিয়ে তুমি কি করেছ? নীলম কি তার কুঞ্চিত কেশকলাপ যাতে প্রকৃতি ভেতরে ভেতরে গুঁড়ি গুঁড়ি পাউডার মাখাচ্ছে। এই গুলবাহার ত্বক যা প্রতিমুহূর্তে অতিপ্রসারে ফেটে যাবে বলে মনে হয়, এই চল্লিশ আটত্রিশ আটচল্লিশ ভাইট্যাল স্ট্যটিসটিক্স্ নিয়ে তাঁর সামনে দাঁড়াতে পারবে? বলতে পারবে?—হে প্রভু, দেখো তোমার দেওয়া সম্পদ নিয়ে আমি এই করেছি। না না। তার চেয়ে ভালো নিজেকে পেছনে রেখে পুপুকে এগিয়ে দেওয়া। যশোধরা যেমন রাহুলকে এগিয়ে দিয়েছিলেন। কৃষ্ণবর্ণ, বিশালচক্ষু, নতনাসিক, জিজ্ঞাসু অথচ স্থির ওই নচিকেতাস্বভাব মেয়ে। ওকে এগিয়ে দিয়ে নীলম বলবে—এই যে এই করেছি।—আপনি যা দিয়ে ছিলেন বিধাতা। দেখুন তো, তা বহুগুণে বেড়েছে কি না? তখন যদি পুপু তার সার্ত্র, ইয়েট্স, উপনিষদসংগ্রহ, গোরা এবং রিলিজন অফ ম্যান নিয়ে দাঁড়ায়, হাতে লম্বা টি-স্কেল, বিধাতাপুরুষ কি জিজ্ঞাসা করবেন না—কই নীলম, তোমাকে যা দিয়েছিলুম তা তো সুদসুদ্ধু বাড়েনি, তুমি তো অন্যের সম্পদবৃদ্ধির হিসেব আমাকে দিতে এসেছ! বিশ্বসুদ্ধ লোক বলে—পুপ তার বাবা-মার কিচ্ছু পায়নি। ওর বাবার মনোহারী চঞ্চলতা, ওর মায়ের ভুবনশ্রী রূপ, কিচ্ছু না। ও অন্যরকম। খালি দশ মাস গর্ভে ধারণ করার যন্ত্রণা, জন্ম দেওয়ার কষ্টটুকু নীলমের পরিপূর্ণ জানা।
ড্রয়ার খুলে নীলম চিরুনি, ব্রাশ বার করল। চুল আঁচড়াচ্ছে। জট ছাড়িয়ে এবার ব্রাশ করছে। যতই ব্রাশ করছে ততই ফুলে উঠছে, ফুলে ফুলে উঠছে অবিকল জোয়ারের নদীর মতো। ছড়িয়ে যাচ্ছে, বুঝি মহাকালীর কেশরাশি। একেবারে বেলুনের ওপরকার মতো টানটান, তেলতেল চামড়া। কোনও পাউডার, কোনও মেক-আপ লাগে না, সব ঝরে ঝরে পড়ে যায়। তৈলাক্ত সেই গোগালাপী মুখের স্থূল কিন্তু ঢেউতোলা ওষ্ঠাধরে গাঢ় করে লিপস্টিক মাখছে। নীলম। খুব যত্নে। এমন টকটকে লাল যে তার পেছনে দাঁতগুলো যেন তাদের শুভ্রতার মর্যাদা হারিয়ে ফেলছে। আই লাইনার, ম্যাসকারা, আই শ্যাডো গোল্ডেন গ্রে। হাউসকোট ছেড়ে নীলম ঘোর লাল রঙের ঢাকাই যা বিক্রম বাংলাদেশ থেকে ১৫২৬ ৲ দাম দিয়ে কিনে এনে দিয়েছিল দশ বছর আগে সেই শাড়ি পরল। বিক্রম বলত খুনখারাপি রং ভাবী, সব লাল হো যায়গা। কোমরে রুপোর চাবি, হাতময় সরু সরু সোনার চুড়ি, গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে মোহরের হার, কণ্ঠে চিকচিকে কণ্ঠী, কানে পেখম ধরা ময়ূর। অরিত্র চৌধুরীর ব্যাঙ্ক ব্যালান্সের অনেকটাই এখন নীলমের হাতে গলায়। আয়নাটা খবরের কাগজের টুকরো ভিজিয়ে ভালো করে পরিষ্কার করল নীলম। একি! এ কে! দেবীরা তো মানুষের আয়তন হন না! সাধারণ মানবীর চেয়ে অনেক বড় হয় দেবীপ্রতিমা। দুর্গা, লক্ষ্মী, জগদ্ধাত্রী। কে কবে বলেছে সৌন্দর্যের মাপকাঠি এই ওই। নীলম যোশী চৌধুরী তুই দুঃখ করিস না। মেনে নিবি না কখনো কারো সিদ্ধান্ত। নিজে পরীক্ষা করে দেখ। এখনও ইচ্ছে করলে তুই বিশ্ব জয় করতে পারিস। অরিত্র জয় করতে পারিস, মহানাম জয় করতে পারিস, বিক্রম জয় তো একেবারেই হাতের পাঁচ।
কোন জয়টা যে আশু প্রয়োজন, কোনটা যে অত্যন্ত জরুরি অনেক ভেবেও নীলম ঠিক করতে পারল না। এক বিভোর দিবাস্বপ্নে তার সারা দুপুর বেহুঁশ হয়ে কেটে গেল। কখনও সে শুম্ভ-নিশুম্ভের যুদ্ধ দেখে ঠোঁটের ওপর বিচিত্র হাসি ফুটিয়ে, কখনও ট্রয়ের প্রাসাদের ওপর থেকে আকিল্লীসের শৌর্য দেখে, হেক্টরের শৌর্য দেখে, আর ভাবে এ সবই আমার জন্য। আবার কখনও কুরু-পাণ্ডব সেনার মাঝখান দিয়ে গরবিণী হেঁটে যায়। কুরু-পাণ্ডবের মধ্যে কে যে অরিত্র আর কে যে মহানাম সে স্থির করতে পারে না কিছুতেই। খালি কানে জয়ধ্বনি ভেসে আসে দূর দূরান্তর থেকে। কিংবা বহু পুরুষের কান্না তাকে চেয়ে। গর্জন কিম্বা কান্না দুটোই তার দিবাস্বপ্ন তৈরি করে, অথচ তার মন দুটোকেই প্রত্যাখ্যান করে। কিছুতেই যেন সে তার বাঞ্ছিত প্রতিক্রিয়াটি পুরুষমানসে তৈরি করতে পারছে না, পারছে না। না পেরে ক্লান্ত হয়ে সে শুয়ে পড়ে, ভাবে ক্লিওপেট্রার সেই ক্ষুদ্রকায় বিষধরকেই সে অবশেষে বরণ করবে কি না।
বিকেলের সামান্য পরে গোধূলি লগ্নে, বাড়ি ফিরে তাকে এইভাবেই ঘুমন্ত দেখল অরিত্র। বাইরের দরজা খোলা। ভেজানো ছিল। একটু ঠেলা দিতেই খুলে গেল। অবাক হয়ে অরি ভেতরে ঢুকে দাঁড়িয়ে ছিল খানিকটা। নীলম কি দরজা খুলে রেখে পেছনের দিকে গেছে কোনও কাজে! যত অল্প সময়ের জন্যই হোক এরকম করা ঠিক নয়। অরি না হয়ে অন্য কেউও তো এ সময়ে ঢুকে পড়তে পারত। শম্ভাজী রাতে ডিউটি দেয়। আর একটু পর থেকে শুরু হবে তার পাহারার ঘণ্টা। এখন বাইরের গেট অরক্ষিত। খানিকটা অপেক্ষা করে অবশেষে দরজা বন্ধ করে দিল অরি। জুতো খুলল রয়ে বসে, তারপর অনেক দিনের অনভ্যাসের টনটনে পা নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকল। ঢুকেই ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। এইভাবে নীলম সেজেগুজে শোয়া! চুল ছড়িয়ে রয়েছে বালিশে। পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর। এয়োতি নারী যেন সেজেগুজে চলে যাচ্ছে। চিতায় ওঠবার আগে এই। ইচ্ছামৃত্যু। নীলমের মনে এই ছিল? অরিত্রর গলা দিয়ে স্বর ফুটছে না। ডাক্তারকে ডাকবে বলে ফোন তুলল। রেখে দিল। বিশুষ্ক গলা। তারপর প্রাণপণে সাহস সঞ্চয় করে হাত রাখল নীলমের কপালে। জীবন্ত কপাল, উষ্ণ, মধুর, মমতাময়, মৃত্যুর সুদূরতা, মৃত্যুর বৈরাগ্য তো নেই! ‘নীলম! নীলম।’
ভীষণ চমকে দুহাতে চোখ কচলে উঠে বসল নীলম। অরিত্রকে সামনে দেখে অবাক হয়ে বলল—‘তুমি এভাবে দাঁড়িয়ে?’
অরিত্র বলল—‘বা রে, আমিই তো তোমাকে ওই প্রশ্ন করব। কি ব্যাপার? এভাবে শুয়ে?’
নীলম অবাক বিহ্বল চোখে নিজের শাড়ি দেখল, চুড়ি দেখল, চোখের কাজল সামান্য ধেবড়ে হাতে লেগেছে দেখল হাত ঘুরিয়ে, যেন সে স্বপ্নে সেজেছিল, বলল—‘অরি, আমি সুখস্বপ্ন দেখছিলুম, যেন আমাদের হিন্দু ম্যারেজ হচ্ছে, আগুন জ্বেলে, সপ্তপদীর আলপনা এঁকে, তুমি বরবেশে এসেছ। কলকাদার জোড়, নকশি শাল, কপালে চন্দন।’
রেজিস্ট্রি করে বিয়ে হয়েছিল ওদের। অনুষ্ঠান-অলঙ্কারপ্রিয় কল্পনাপ্রবণ নীলম যোশীর সারা জীবনের দুঃখ যে এটা।
অরিত্র তাই মমতাস্নিগ্ধ গলায় বলল—‘নীলম, তোমাকে যে কি সুন্দর দেখাচ্ছে তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। ঠিক বিয়ের কনেরই মতো। বাস্তবিক। দাও আমাকে চা-টা দাও।’
নীলম ঠিক তেমনভাবে বসে রইল, যেমন ভাবে বসেছিল। ঘুমভাঙা চোখে। সাজসজ্জার ছটা নিয়ে। আয়নায় পার্শ্বমুখের ছায়া পড়েছে। খাজুরাহোর কোনও কিন্নরী মূর্তি। ভারতবর্ষে এক মহেঞ্জোদভোর যুগেই তন্বীতা নারীশরীরের গুণ বলে বিবেচিত হত। ব্রোঞ্জের নটীমূর্তিটিকে যদি প্রামাণ্য বলে ধরা হয়। তারপর তো সবই শ্রোণিভারাদলসগমনা, পর্যাপ্তপুষ্পস্তবকাবনাম্রা। রূপসীর আদর্শ তো এদেশে একটু পৃথুলাই। নীলম দেখতে দেখতে সমস্ত ভুলে যাচ্ছে। এতদিনের যত দুঃখ, যত ভয়, যত পাপবোধ। পশ্চিমের জানলা দিয়ে হু হু করে গোধূলি ঢুকছে। সব ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তারপর হঠাৎ সামনে বসা অরির চোখের চশমায় তার ছায়া পড়েছে দেখতে পেল নীলম। অরি কেমন করে গোধূলি লগ্নের আহ্বান শুনতে পারে! তারা মেঘে ঢেকেছে, অরির চশমা পাল্টে গেছে, খুবই সহজে তাই বিদায় জানায়। জনমের মতো হায়, হয়ে গেল হারা। ডাক শুনতে ভুলে গেছে অরিত্র চৌধুরী। এই সমস্ত বাসকসজ্জা একটা মায়া, একটা করুণা, গোধূলি ভর্তি ঘর ছেড়ে অরিত্র বাইরে চলে যাচ্ছে। ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগারেট।
‘নীলম, চা দাও, চা আনো, পটভর্তি করে আনো, ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে, ভীষণ।’
ভয়মুক্তির সোয়াস্তিতে শুকিয়ে যাওয়া গলায় পানীয় ঢালতে অরিত্র নীলমকে ভীষণ তাড়া দিতে থাকে। নীলম বুঝতে পারে ট্রয়ের প্রাসাদে হেলেনের স্বেচ্ছাবিহার মেনে নিয়ে বিপুলসংখ্যায় ফিরে যাচ্ছে গ্রীক সেনা। ফিরে যাচ্ছে আগামেমনন, ফিরে যাচ্ছে ইউলিসিস, মেনেলাউস। এলফিনস্টোন রোড দিয়ে হোলকার ব্রিজ পেরিয়ে ডেকান কলেজ পেরিয়ে আহ্মদনগর রোড ধরবে, চলে যাবে আহ্মদনগর কিংবা লোহাগাঁওয়ের দিকে।