Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » পঞ্চম পুরুষ || Bani Basu » Page 5

পঞ্চম পুরুষ || Bani Basu

প্রথম দিনের সেমিনার শেষে মহানাম দাঁড়িয়ে আছেন চন্দ্রশেখরের বাড়িতে তাঁর ঘরের সংলগ্ন ছোট্ট ব্যালকনিতে। ফট ফট করছে বিকেল। এখনও অনেকক্ষণ পর্যন্ত আলো থাকবে। শেখর আজ যায়নি। ওর কাজ ছিল। ছাত্রদের নিয়ে বয়ঃসন্ধির ছেলে-মেয়েদের কিছু একটা সার্ভে করছে। লো-ইনকাম-গ্রুপ। খুব সম্ভব ওল্ড পুনের দিকে কোনও স্কুলে গেছে। ইউনিভার্সিটিতে ফিরে ছাত্রদের নিয়ে রিপোর্ট তৈরি করবে, না বাড়ি ফিরে করবে বলে যায় নি। মহানাম এক পট কফি তৈরি করে খেয়েছেন। একটু ক্লান্ত লাগছিল, কফি খেয়ে চাঙ্গা হয়ে গেছেন। শেখর ফিরে এলে একটু হাঁটতে বেরোবেন। বাড়িটা ফেলে বেরোতে পারছেন না। যদিও তাঁর কাছে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে রেখেছে শেখর। সারা দিন বাড়িটা একদম একা ছিল। এখন আবার ফেলে বেরোনো ঠিক হবে না বোধহয়। এই বিল্ডিং ব্লকগুলোর পেছন দিকগুলো ছাড়া বিশেষ কিছু দেখা যায় না এই ব্যালকনিতে দাঁড়ালে। ফাঁক ফাঁক দিয়ে রাস্তার একটুকরো। রাস্তার ওপারে মাঠ আছে। ঘন বীথিকার ফলে মাঠের চেহারা উধাও। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে মহানাম ঘরের মধ্যে ফিরে এলেন। একটু অস্থির লাগছে। প্রিয়লকরনগরটা যাওয়া হচ্ছে না। প্রথম দিন মাঝরাত্রে ভূতের মতো গিয়ে হাজির হয়েছিলেন।

এই চেয়ারের পেছনটা ইচ্ছে মতো হেলানো যায়। একটু বেশি হেলিয়ে নিয়ে বসলেন মহানাম। মাথার পেছনে দুহাত। মহানামের ডাফ লেনের বাড়ি মাৰ্বল প্যালেসের নামান্তর। সাদা-কালো ফুল কাটা মেঝেতে সামান্য একটু ছ্যাতলা পড়েছে। পুরনো দিনের মেহগনী চেয়ারে বিশদ কারুকার্য, একটুও হেলান দিয়ে বসবার উপায় নেই সে চেয়ারে। সামনে মাৰ্বল-টপের টেবিল। মহানাম বলছেন—‘ব্যাপারটা কি জানো অরিত্র। আই হ্যাভ ট্রায়েড টু মেনি থিংস ইন ওয়ান লাইফ। ডাক্তারি পড়তে পড়তে সাহিত্য, সাহিত্য শেষ করতে না করতে জড়িয়ে গেলুম সিম্বলিক লজিক আর অ্যাপ্লায়েড ম্যাথমেটিকসে, এখন আবার হোমিওপ্যাথির নেশা। মেটিরিয়া মেডিকা ছাড়া কিচ্ছু মাথায় নেই। একেবারে ওয়ান-ট্র্যাক মাইন্ড। তোমাকে এখন বোদলেয়ার পড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। অ্যান্ড ফ্র্যাঙ্কলি স্পীকিং আই অ্যাম আফরেড অফ এষা।’

‘সে কি? কেন?’ এষা প্রায় উঠে পড়েছে চেয়ার থেকে। মহানাম হাসছেন—‘কবিতার ছাত্রীরা অনেক সময়ে এমন শক্ত শক্ত প্রশ্ন করে যে আমার মতো পল্লবগ্রাহী মাস্টারমশাইরা সেসবের উত্তর যোগাতে পারে না।’

অরিত্রর চোখ এখনও জিজ্ঞাসু। বুদ্ধিমান ছেলে। ব্যাখ্যাটা তার বিশ্বাস হয়নি। মহানামের মনের কোনও গোপন কথা মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। অরিত্রর চোখে সন্দেহ ঘনিয়ে আছে। কবিতার ছাত্ররা কি কূটপ্রশ্ন করতে পারে না।’

যজ্ঞেশ্বর লুচি, আলুর দম আর ইলিশমাছ ভাজা নিয়ে এসেছে। প্রত্যেকটারই রঙ সাদা। লুচি, আলুর দম ধবধবে সাদা। ইলিশমাছ ভাজার দরুন একটু সোনালি রং ধরেছে।

‘আমি আবার কিঞ্চিৎ ভোজন বিলাসীও?’ ছুরি-কাঁটা দিয়ে একটা লুচিকে চারখানা করতে করতে মহানাম বলছেন—‘এদিক দিয়ে আমি একেবারে প্রিমিটিভ।’

সবিস্ময়ে এষা বলছে—‘আপনি কি ইলিশমাছও ছুরি-কাঁটা দিয়ে খাবেন?’

‘ছুরি-কাঁটা নয়, শুধু কাঁটা দিয়ে’। মহানাম মাছভাজাটাকে কাঁটায় গেঁথে মুখে চালান করে দিয়েছেন—‘ওকি? তোমরা নিচ্ছো না?’

চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছে অরিত্র। এষা বলছে—‘আমি চা-ও খাই না। ইলিশ মাছও খাই না মহানামদা।’

‘এখনও দুগ্ধপোষ্য আছো না কি?’

‘শুধু দুগ্ধপোষ্য নয়। লুচি আলুর দম পোষ্যও আছি⋯। কিন্তু এতো সকালবেলায় এরকম হেভি ব্রেকফাস্ট করা আমার অভ্যাস নেই। অস্বস্তি হয়।’

‘যজ্ঞেশ্বর!’ মহানাম ডাকছেন—‘যজ্ঞেশ্বর!’ ধুতি শার্ট, কাঁধে ঝাড়ন, ঝাঁটা গোঁফ, পাকা চুল যজ্ঞেশ্বর এসে দাঁড়িয়েছে।

‘অরসিকেষু রসস্য নিবেদনম কদাচ করবি না। তোর বেগমবাহার লুচি আর মোগলাই আলুর দম নিয়ে যা শীগগিরই। এরা মনে করে খাওয়া-দাওয়ার সঙ্গে পড়াশোনার একটা ডাইরেক্ট শত্রুতা আছে। তা সে যে যা মনে করে করুক, আমি তোর রন্ধন-শিল্পের অবমাননা হতে দিচ্ছি না।’

যজ্ঞেশ্বর লুচির ট্রে তুলে নিচ্ছে আর এষা বলছে—‘বেগম বাহার লুচি? মোগলাই আলুর দম? কি ব্যাপার এগুলো মহানামদা!’

‘খেলে বুঝতে পারতে?’ দ্বিতীয় লুচিটা ছুরি-কাঁটা দিয়ে সযত্নে পাট করতে করতে মহানাম বলছেন—‘রুমালি রুটি হতে পারে। আর বেগমবাহার লুচি হতে পারে না? আবিষ্কর্তা শ্রীল শ্রীযুক্ত যজ্ঞেশ্বর মাল। প্রায় ট্রান্সপেরেন্ট। আলুর দমটা টেস্ট করলেই বুঝতে পা পিছলে আলুর দম এ নয়।’

ফেরবার সময়ে সেদিন ওরা কি আলোচনা করতে করতে ফিরছিল? মহানামের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। খুব সম্ভব অরিত্র বলেছিল—‘আসলে লোকটা কিছু জানে না। ফরাসী নাকি মাতৃভাষার মতো জানে। হুঁঃ!’

‘অদ্ভুত লোক কিন্তু।’

‘অদ্ভুত না কিম্ভুত! বেগমবাহার লুচি। যত্তসব!’

‘ইস খেয়ে দেখলে হত। ভুল করলুম।’

‘কিছু ভুল করোনি। কিপটে আসলে। রামকঞ্জুষ। কম চালাক নাকি! ট্রেটা একবার চোখের সামনে দুলিয়ে দিয়ে গেল। ওইরকমই করে। সারাদিনে ওই একবারই কতকগুলো আইটেম রান্না করে যজ্ঞেশ্বর, ব্রেকফাস্ট থেকে ডিনার অবধি ওই একই জিনিস চালায়। ওই এক যজ্ঞেশ্বর রাঁধুনি কাম চাকর-কাম-জমাদার-কাম বাজার সরকার⋯’

এ ধরনের কথোপকথনটা নেহাত আন্দাজই নয়। সদ্য অক্সফোর্ড প্রত্যাগত মহানাম সম্পর্কে তখন এ ধরনের গল্পই চলছিল। এগুলো ভালোই উপভোগ করতেন মহানাম। তিনি নাকি দাড়ি রেখেছেন চিবুকের পোড়া দাগ গোপন করার জন্য। অ্যাসিডের পোড়া দাগ। সে দাগ নাকি সুইসাইড করতে গিয়ে হয়েছিল। পেছন থেকে কোনও সাহেব সহপাঠী হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডের বোতলটা সরিয়ে না নিলে আজ মহানাম হরিনাম হয়ে যেতেন। এবং সুইসাইড নাকি কোন নীলনয়না আইরিন ম্যাককাচ্চনের জন্য। কানে আসত কথাগুলো, মহানাম প্রতিবাদ করতেন না। এইভাবেই এক একটা মানুষকে ঘিরে কিংবদন্তী গড়ে ওঠে। য়ুনিভার্সিটি চত্বরে একটা দীর্ঘস্থায়ী গপ্পের জন্ম দিচ্ছে তাঁর দাড়ি, যজ্ঞেশ্বর, মাৰ্বল প্যালেস এবং বিচিত্র কথাবার্তা—বেশ মজা লাগে।

সব কিংবদন্তীরই পেছনে একটা সত্য বীজ থাকে। আইরিন নয়, আইরিস, আসবার সময়ে উপহার দিয়েছিল একটা তিনকোণা গ্রানাইট পাথর। সেটা নাকি ও সালসবেরিতে স্টোন হেঞ্জের আশেপাশে কুড়িয়ে পেয়েছিল। একেবারে পালিশ করা, একটা ফোলা তিনকোণা পাথর। এতজনে এতরকম উপহার দিল, আইরিস দিল পাথর। সহাস্য মুখে জিজ্ঞেস করতে বলেছিল—‘ডু য়ু সীরিয়াসলি মীন য়ু ফেল টু রেকগনাইজ ইট।’

‘সীরিয়াসলি!’

‘ইট ইজ মাই হার্ট দ্যাট আই অ্যাম গিভিং আনটু য়ু।’

‘অ্যান্ড ইট ইজ মেড অফ স্টোন!’

‘ওহ নো। ইট ইজ অ্যাজ লাস্টিং অ্যান্ড অ্যাজ হেভি।’

স্বভাবসিদ্ধ অট্টহাস্য করতে গিয়ে মহানাম চুপ।

‘শোনো আইরিস, আই লুক আপন য়ু অ্যাজ মাই সিসটার অ্যান্ড ফ্রেন্ড।’ ‘ডু য়ু পীপল ইন ইন্ডিয়া কিস ইয়োর সিসটার্স দি ওয়ে ইড ডিড অন ক্রিসমাস ঈভ?’

‘আই বেগ ইয়োর পাৰ্ডন। ওয়ান নেভার নোজ হোয়াট ওয়ান ক্যান ডু আনডার দি ইনফ্লুয়েন্স অফ স্ট্রং লিকর। ওয়ান ডাজন্‌ট্‌ ইভন রিমেমবার।’

‘ইউ নীড ন্‌ট্‌ বেগ মাই পাৰ্ডন, নাম। উই আর ইউজ্‌ড্‌ টু বীয়িং জিল্টেড সিন্‌স দি গড্‌ড্যাম্‌ড্‌ ওয়র। মেন হ্যাভ থাউজ্‌ন্ড্‌স্‌ টু চূজ ফ্রম।

গ্রানাইট ভারি, তপ্ত একখানা আস্ত হৃদয় উপহার দিয়ে চলে গেল আইরিস। অ্যাসিডের দাগ থুতনিতে যদি হতেই হয় তো আইরিসেরই হবার কথা। মহানামের নয়। ছাত্র-ছাত্রীরা গল্পটা উল্টো শুনেছে। আসলে মেমসায়েব প্রত্যাখ্যান করা এখনও পর্যন্ত এরা ভাবতে পারে না। আর ‘বিলেত’ গিয়ে মেমসায়েব বিবি নিয়ে সায়েব হয়ে প্রত্যাবর্তন এই অতি-পরিচিত গল্পটা মহানামের খুব খারাপ লাগত। কিন্তু অ্যানি বেসান্ট, মার্গারেট নোবেল, মড গনের দেশের লোক হয়ে আইরিস কি করে অত সহজে বলল—‘উই আর ইউজ্‌ড্‌ টু বীয়িং জিল্টেড!’ আসলে এ এক ধরনের মেয়েলি মর্ষকাম। কোনও ভিত্তি নেই এসব ধারণার। মহানাম বরাবর মেয়েদের সব ব্যাপারে সমকক্ষ ভেবে এসেছেন। যে মহীয়সী মহিলার কাছে আবাল্য মানুষ হয়েছেন, তাঁর সঙ্গ পেলে কেউ কোনদিন মেয়েদের ছোট মনে করবার ভুল করবে না। যে বোনের কথা তুলে আইরিসকে নিবৃত্ত করবার চেষ্টা করেছিলেন মহানাম, সেই বোন কি জিনিস তা-ই তিনি জানেন না। অল্পবয়সে তাই পারিবারিক সম্পর্কগুলো নিয়ে মনের গোপন কোণে ভাবাবেগের আধিক্য থেকে থাকবে। মা বাবা ভাইবোনের স্বাদ কি জানেন না। কিন্তু ধাত্রী কাকে বলে, বন্ধু কাকে বলে তা ষোলো আনার জায়গায় আঠার আনা জানা হয়ে গেছে।

মহানামের কপাল চওড়া। বিদ্যাসাগরী না হলেও এবং কেশহীন না হলেও বেশ প্রশস্ত। নাকে আর্যতা স্পষ্ট। চিবুকটা সেই তুলনায় যেন ছোট। প্রতিবার দাড়ি কামাবার সময়ে আয়নাটা তাঁকে বকত—ছবির পটটাকে দুভাগে ভাগ করে নাও। ওপর দিকে অত রঙ চাপালে, ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে। তারপরই মহানাম দাড়ি রাখলেন। বেশ কালো কুচকুচে, ঢেউ খেলানো দাড়ি, প্রত্যেক দিনই তাকে কেটে ছেঁটে মুখের সঙ্গে সমঞ্জস করে নিতেন ট্রিনিটি কলেজে থাকতেই। দাড়ি নিয়ে যখন ফিরলেন পরিচিত বন্ধু বান্ধবেরা চিনতে পারে না। শুধু চেহারা নয়, পুরো ব্যক্তিত্বই নাকি পাল্টে গেছে মুখ ঘেরা দাড়ির গোছার জন্য।

সম্বরণ বলত—‘কি যে একটা অক্সো-ইরানিয়ান পার্সন্যালিটি করেছিস! মনে হচ্ছে টেলিস্কোপ দিয়ে দেখতে হবে। দাড়িটা ফ্যাল।’

মহানাম বলতেন—‘তোদের কেন আমি বোঝাতে পারছি না, দাড়িটা ফেললেও যা আছি তাই থাকব। ব্যক্তিত্বটারই বদল হয়েছে। তবে আমূল নয়; ওটা তোদের বোঝার ভুল। প্রথম প্রথম মনে হচ্ছে, পরে ঠিক হয়ে যাবে।’ সন্দীপ বলল—‘যাই বল একটা মিস্ত্রি আছে এর মধ্যে, আমি সেন্ট পার্সেন্ট শিওর। নয়ত সামান্য একটা দাড়ি কাটতে তোর এত আপত্তি হবে কেন? গোঁফ হলেও বা কথা ছিল। গোঁফের আমি গোঁফের তুমি তাই দিয়ে যায় চেনা।’

—‘দাড়িও তাই। তোকে যদি তোর ঝুরো-গোঁফ দিয়ে চেনা যায় আমাকেও তবে এই চাপ-দাড়িতেই চেন তোরা।’

দাড়ি দিয়েই সম্ভবত মহানামি রহস্যের শুরু। সন্দীপের মিস্ত্রি কথাটাকে অবলম্বন করে সব মহলে প্রশ্ন দানা বেঁধেছে। মহানাম কখনই বলেননি—‘থুতনিটা আমার পছন্দ হচ্ছিল না ওটা ঢাকতে দাড়ি রেখেছি।’ হাসিটা যেন অনেক-কথা-বলার-ছিল গোছের। মহানামের স্বভাবই হল— অনেক কথায় মশগুল থাকা, যার মধ্যে থেকে ব্যক্তিগত কথাটি খুঁজে নেওয়া মুশকিল। কিংবা অনেক হাসি, যার সবটাই শুধু আনন্দ বা শুধু প্রমোদের হাসি নয়। সুতরাং রহস্য।

জীবনের মূলে রহস্য তো সত্যিই ছিল। মা-বাপের ঠিক নেই যখন তখন লোকে ইচ্ছে করলেই বেজম্মা বলে গাল দিতে পারে। আঠার বছর বয়স হলে কস্তুরী মাসী বলেছিলেন—‘আর বলিস না। লোকে যে কি করে আর কতদূর করতে পারে তার সত্যিই কোনও হিসেব হয় না। তুই নির্বিঘ্নে ভূমিষ্ঠ হলি, তার পরদিন রাতেই তোর মা পালিয়ে গেল। ঠিকানা পরীক্ষা করে দেখি সব ভুয়ো। কিছুদিন হাসপাতালে বড় করে নিজের কাছে নিয়ে এলুম। দত্তক নিইনি, নিজের নাম দিইনি। নাম থাকলে তুই মহানাম হবি কি করে? আর শুধুমাত্র এই কারণেই আমি তোকে মা বলতে শেখাইনি। আমাকে মা ডাকবি তারপর একদিন সেই নাটকীয় অভিমানের মুহূর্ত আসবে যেদিন জানতে পারবি আমি তোর মা নই। তারপরই বদহজম সেন্টিমেন্টের তাড়নায় একগাদা মেলোড্রামা। মহানাম, তোর মা বাবা মৃত, সেটাই সত্য। তুই যেন আবার কর্ণ-টর্ণ হয়ে যাসনি। উপন্যাসের নায়কের মতো বাকি জীবনটা মায়ের খোঁজে ফিরিসনি যেন। তুই স্বয়ম্ভু। স্বয়ম্ভরও হবি। তোকে পৃথিবী তার প্রাথমিক বন্ধন থেকে মুক্তি দিয়েই পাঠিয়েছে। এত ভাগ্য সহসা হয় না। চট করে বন্ধন স্বীকার করিসনি কখনও। তবে যারাই তোর জন্ম দিক জিনগুলো ভালো ছিল রে’, বলে কস্তুরী মিত্র হাসতেন।

মহানাম তখন অকালপক্ক কিশোর। এই ইতিহাসের জন্যই কি না কে জানে পৃথিবীর সবার সঙ্গে নিজেকে সম্পর্কহীন মনে হয়, কারুর সঙ্গে সম্পর্ক পাতাতেও তেমন কোনও তাগিদ অনুভব করেন না। দুহাতে নেন যা পান। তার দুহাতে বিলিয়ে দ্যান যা আছে। তবু লোকে কয় কৃপণ। আইরিস তো বলেই ছিল। বন্ধু-বান্ধব সবাই অভিযোগ করত। স্বভাবের এই কূর্মতা ঢাকা পড়ে প্রচুর কথায়, পান ভোজনে, আড্ডায়, তর্কে মেলা মেশা দিয়ে। খালি যারা খুব কাছে আসতে চায় তারাই বুঝতে পারে, কোথাও একটা লৌহজাল আছে বুকের কাছে। সব তীর সেখানে ঠেকে যায়। আঘাতের তীরও, ভালোবাসার তীরও।

অনেক সময়েই মহানামের মনে হয় তিনি এখানে এই গ্রহে বেড়াতে এসেছেন। বা কোন কাজে এসেছেন। যেমন গিয়েছিলেন অক্সফোর্ডে। যেমন ঘুরে বেড়িয়েছেন ইউরোপের বিভিন্ন শহরে। ডাফ লেনের বাড়িটাতেই মাত্র তিনি একটা স্থিতির কাছাকাছি কিছু অনুভব করেন। এটা কি খুব বেশি ঘোরার জন্য? না কি আপন কেউ নেই বলে? না স্বভাব? চন্দ্রশেখর অবশ্য হেসে উড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এই শূন্যতাবোধ যা মাসির মৃত্যুর পর হলে বোধগম্য ছিল, তা এখন চল্লিশোত্তর মহানামকে মাঝে মাঝে ভাবায়। যাদের কাঁধে অনেক মানুষের, অনেক সমস্যার গুরুভার, সেই গৃহীরাও তো সুখী নয়! যাদের মা বাবা, ভাই বোন, স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে সবই আছে, তারা এইসব প্রিয়জনদের কাছ থেকে পালাবার জন্য অনেক সময় কি রকম হাস্যকর ভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তা-ও দেখা আছে। পৃথিবীতে কি মহানামের সত্যিই শেকড় নেই! তাঁরও কি কতকগুলো বন্ধনের দরকার ছিল? বন্ধনের বিতৃষ্ণা বোঝবার জন্য? জীবনের অভিজ্ঞতার স্কুলে ডবল প্রোমোশন পেয়ে যাওয়া কি তাহলে সৌভাগ্য নয়?

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress