পঞ্চম পুরুষ (Pancham Purus) : 04
নীলম এমনিতেই ওঠে বেশ ভোরে। একজন বাই এবং একটি জমাদার সম্বল। এদের কাজ-কর্ম দেখবার জন্যে দু হাত কোমরে লাগিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা তো আছেই। তারও পর যা বাকি থাকে তার পরিমাণও নেহাত কম নয়। অরি এবং পুপু বলে বাতিক। বাথরুম পরিষ্কার থেকে রান্নাঘর গোছানো পর্যন্ত নীলম একরকম স্বহস্তেই করে। এমনিতেই এখানে ধুলো ময়লা কালি নেই, তার ওপরে নীলমের বাতিক বা পরিচ্ছন্ন স্বভাব যার জন্যই হোক প্রত্যেকটি কোণ নিপুণভাবে ঝাড়া ধোয়া মোছা। যখন রান্না করছে, তখনও নীলমের হাতের কাছে দু তিন রকম ঝাড়ন। টালির ওপর একটু রান্নার তেল-মশলার দাগ পড়তে পারে না। বাসনের বাইরে বা কিনারেও না। নিজের হাতে তো নয়ই। অরি বলে বিজ্ঞাপনের রান্না। আজ নীলম স্নান এবং পুজোও সেরে নিয়েছে। অরির শোবার ঘরের সংলগ্ন ঠাকুর-তাক থেকে খুব ভোর থেকেই ফুল এবং ফুলের গন্ধ ছাপিয়ে ধূপের গন্ধ ঘুমন্ত মানুষটির তন্দ্রায় প্রবেশ করছে। সাধারণত ভোরের প্রথম চা নীলম রাত্রিবাস পরেই খায়। আজই স্নান-টান সেরে একটা পদ্মগন্ধের আবহ নিয়ে অরির বিছানার কাছে দাঁড়িয়েছে। দিনটা বিশেষ দিন। অরিত্র আজকে তিন মাস ছুটির পর অফিস যাচ্ছে। যদিও আর কদিন পরই আবার বেশ খানিকটা ছুটি মঞ্জুর করেছেন ডাক্তার।
চোখ মেলেই নীলমকে এতো স্নিগ্ধ দেখে অরির মন অসম্ভব ভালো লাগায় ছেয়ে যাচ্ছে। এই ভালো-লাগার সঙ্গে খুব সম্ভব শিশুকাল এবং মাতৃস্মৃতির খুব ঘনিষ্ঠ যোগ আছে। সারাজীবন ধরেই মানুষ কী পুরুষ, কী নারী, ফিরে ফিরে মাকে পেতে চায়। স্বীকার করে না কারুর কাছে। নিজের কাছেও। কিন্তু এই সব ছোটখাটো মুহূর্তের অকারণ ভালো লাগাগুলোই মায়ের সঙ্গে চিরন্তন নাড়ির যোগের নির্ভুল চিহ্ন।
অরি বলল—‘আজ এমন লাজবন্তী লাজবন্তী সেজে প্রাতশ্চা দিতে এসেছো। ব্যাপারখানা কি বলো তো?’
‘সে কি! আজকের দিনটা অন্যান্য দিনের থেকে যে আলাদা সে কথা কি তুমি ভুলে গেছো? নীলম ভুরু কুঁচকে বলল।’
অরি প্রাণপণে স্মৃতির ঘর হাতড়াচ্ছে। ঠিক যেন চোখ বেঁধে তাকে কানামাছি করে ছেড়ে দিয়ে গেছে কেউ। বিয়ের দিন? না তো! সে তো অক্টোবর! পুপুর জন্ম? জুনের কাঠফাটা গরমে। অরির নিজের জন্মদিন ডিসেম্বর, প্রতিবছর ওই দিনটা নীলমের জলুসওলা পার্টির উপলক্ষ। নীলমের জন্মদিন নাকি! যদ্দূর মনে পড়ছে সেটা ফেব্রুয়ারি-টারি হবে। নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। অরিত্র রহস্যময় মুখ করে বলল ‘ভুলে গেছি! ইস বললেই হল? আজ তব জন্মদিন। সদ্যই প্রাণের যাত্রাপথে⋯’
নীলম বলল—‘ইসস্ তুমি এই ভাবছ? আমার জন্মদিনটা ভুলে গেছো, আবার ভাব দেখাচ্ছ, সব মনে আছে। ছি ছি।’
‘আহা, অত ছিছিক্কারে দরকার কি? বলোই না বাবা আজ কী বিশেষ ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে!’
‘আজ তুমি অফিস জয়েন করতে যাচ্ছে। এটাও ভুলে গেছো?’
খুব হতাশ গলায় অরিত্র বলল—‘ওঃ টাকা কামাই করতে যাচ্ছি বলে! পঙ্গু টঙ্গু হয়ে তোমার গলগ্রহ না হয়ে, আবার জোয়াল কাঁধে নিয়েছি বলে এতো পুজো-টুজো। তাই-ই ঘরণীর দেহে এতো সুগন্ধ আজ!’
পাউডারের রেণু বাতাসে উড়িয়ে নীলম বসল স্পর্শ বাঁচিয়ে, চেয়ার টেনে। গম্ভীর হয়ে বলল— ‘কামাই করতে যাচ্ছে বলে নয়। সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছে বলে। আমার সিকিওরিটির জন্য টাকা-কামাইয়ের আর কি দরকার আছে? বাড়িটা আমার নামে। ইচ্ছে করলেও বার করে দিতে পারবে না। ডকুমেন্টস কোথায় আছে তাই-ই জানো না। তোমার টাকাকড়িরও বেশির ভাগ আমার নামে। আমারই বরং ইচ্ছে হলে তোমাকে বিপদে ফেলতে পারি। বেচাল থেকে সাবধান।’
শুনতে শুনতে অরিত্রর চোখ বিস্ফারিত হয়ে যাচ্ছিল। বলল—‘বলো কি, এতগুলো ভুল একসঙ্গে করে বসে আছি! সর্বনাশ! তোমাকে এবার থেকে খুব সমঝে চলতে হবে মনে হচ্ছে!’
নীলম চায়ে চুমুক দিয়ে ঠোঁট উলটে বলল—‘সমঝে তুমি আমাকে থোড়ি চলবে। যাই হোক সে তোমার ব্যাপার। বিক্রমকে একটা তার করে দিলুম।’
একটা যেন ইলেকট্রিক শক খেল অরিত্র।
—হঠাৎ।’
—‘আসতে লিখে দিলুম। বিশে মার্চ নাগাদ।’
বিমূঢ় অরিত্র বেশ কিছুক্ষণ পর বলল—‘অফেন্সে খেলছো?’
—‘শুধু ডিফেন্সে আর হচ্ছে কই? তাছাড়া ওভাবে নেবার দরকারই বা কি? এষা নিশ্চয়ই তোমার-আমার মুখ দেখতে আসছে না। ঘোরবার জন্যেই আসছে। তোমার এই অবস্থাতে ওকে ঘোরাবে কে? সাথী যোগাড় করে দিলুম। ধন্যবাদ দাও আমায়।’
অরিত্র বলল—‘একটা কথা তোমাকে, নীলম, বলে রাখি। এষা এলে, অথাৎ সত্যিই যদি শেষ পর্যন্ত আসে, তাকে আমি বিক্রমের সঙ্গে একা ছেড়ে দেবো না কখনও। তাছাড়া আমি যথেষ্ট ফিট হয়ে গেছি। আর এতো অবিশ্বাস, এতো ভয় থাকলে এখনও সময় আছে, আমি এষাকে বারণ করে জরুরী তার করে দিচ্ছি।’
—কিন্তু বিক্রম তো সস্ত্রীক আসছে। তোমার ভয়টা কোথায়? বিক্রমের সঙ্গে একা ছাড়ার তো প্রশ্ন উঠছে না!
—‘সস্ত্রীক বা অস্ত্রীক যে কোনও অবস্থাতেই বিক্রম বীভৎস। নিজের প্রবৃত্তি চরিতার্থ করতে বিক্রমের কাছে কোনও বাধাই কিছু নয়। ব্যাপারটা তুমি ভালো করেই জানো। আচ্ছা নীলম, এষা তো শুধু আমারই বন্ধু না, তোমারও। ওর সাথী হিসেবে বিক্রমের কথা তুমি ভাবতে পারলে কি করে?’
নীলম গম্ভীর হয়ে বলল—‘কি জানি, আমি যেমন প্রাপ্তবয়স্কা, এষাকেও তো তেমন প্রাপ্তবয়স্কা বলেই মনে হয়। তোমার চেতনায় এষা যদি এখনও অসহায়া, অবলা, অপাপবিদ্ধা কিশোরী থেকে থাকে তাহলেও তো বাস্তব সত্য বদলাবে না।’
অরিত্র বলল—‘নীলম, আমি তোমাকেও কোনদিন বিক্রমের সঙ্গে একলা ছেড়ে দিই নি। তুমিও প্রাপ্তবয়স্কাই ছিলে।’
‘প্রাপ্তবয়স্কা এবং আঠাশ উনত্রিশ বছরের যুবতী। তুমি বিক্রমকে ভয় পেতে, না আমাকে, তা আমার কাছে এখনও পরিষ্কার হয়নি।
অরিত্র বলল—‘আমারও তো অনেক কিছু পরিষ্কার জানা নেই বলেই মনে হচ্ছে।’
—‘জানবার প্রয়োজন বোধ করনি বলেই জানো না, অরি। বিবাহিত স্ত্রী, তা সে যতই উদ্দাম প্রেম করে বিবাহিত হোক, ওয়ান্স ম্যারেড শী ইজ ম্যারেড ফর এভার, পড়া বই, জানা গল্প, জেতা দেশ, কোনও পুরুষই আর তাকে বেশি জানাজানির চেষ্টা করে না। করে কি? তবে পাহারাটা আঁটসাঁট রাখবার প্রয়োজন সব সময়েই বোধ করে। এখন সে প্রয়োজনও ফুরিয়ে গেছে বলেই বোধহয় যা খুশি করা যেতে পারে বলে তোমার বিশ্বাস।’
—‘কাকে পাহারা দেওয়া। কাকে প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়া ইত্যাদি বলছো নীলম?’ অরিত্রর গলায় ক্ষোভের সঙ্গে বিরক্তি মিশেছে। তার প্রথম কাপ চা জুড়িয়ে একেবারে জল হয়ে গেছে। নরম সুরে অরিত্র বলল—‘তুমি যা ভাবছো, বা ভেবে থাকো, সবই ভুল, তোমার মনের বিকার। যা খুশি করার ইচ্ছে থাকলে এতোদিন করতে পারতুম না!’
—‘করেছ কি না তাই বা আমি কি করে জানব?’ নীলমের গলা চড়ে যাচ্ছে, পুপুর স্কুটারের শব্দ ছাপিয়ে। অরিত্র একটা সিগারেট ধরালো। সামান্য পরেই টেলিগ্রাম হাতে ঘরে ঢুকলো পুপু। টেলিগ্রামটা সেই দিন থেকে লিভিংরুমে মিউজিক সিসটেমটার তলায় পড়ে আছে। আজ বোধহয় উড়ে পড়েছে পুপুর হাতে।
—‘মাম, বাবা এষা খান কে? আমাদের বাড়ি আসছেন?’
নীলম একটু হেসে বলল— ‘তোমার বাবার গার্ল ফ্রেন্ড।’
অরি উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙে বলল—‘তোমার মারও।’
—‘হাউ ইন্টারেস্টিং!’ পুপু শুধুমাত্র দুটো শব্দ উচ্চারণ করে নিজের ঘরে চলে গেল। খুব সম্ভব মা বাবার স্বীকারোক্তি থেকে যতটুকু বোঝা গেল, গেল। বাকিটুকু নিজের বুদ্ধি ও কল্পনা দিয়ে পুষিয়ে নেবে।
একটু পরেই পুপু ওর বাড়ির ঢোলা জামা পরে বেরিয়ে এলো। মুখে জল চকচক করছে, হাতে তোয়ালে। হাত মুছছে। খুব সরল হাসি হেসে বলল—‘আমার ঘরে ফোল্ডিং খাটটা পেতে নিলেই তো ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তোমাদের অত ভাববার দরকার কি!’
পুপু কতটা বড় হয়েছে অরির জানা নেই। ওর বোধহয় ধারণা ওর বাবা যতই বন্ধুবৎসল হোক না কেন, নিজের নির্জনতার অধিকার কয়েকদিনের জন্য হলেও ছেড়ে দিতে তার অসুবিধে এবং কষ্ট হয়। তাই নিজের সে অধিকার ও অনায়াসেই ছেড়ে দিল। উৎসর্গ করে দিল বলা চলে। তাদের এই হাজার স্কোয়্যার ফুটের অধিকাংশটাই লম্বা লিভিং রুম কেড়ে নিয়েছে। বাকি অংশ থেকে বেরিয়েছে দুটো বাথরুম। বেশ প্রসরযুক্ত রান্নাঘর। ব্যালকনি, সামনের পোর্টিকো। ঘর দুটো বড় নয় খুব। ছোট ঘরটা অরিত্রর দখলে। বড় ঘরটা পুপু বলে মার, মা বলে পুপুর। পুপুর বড় খাটেই নীলম শোয়। যখন অরির এখন তখন অবস্থা, সেই সময়টাতেই খালি নীলম অরিত্রর ঘরে ছিল কটা দিন। তারপর থেকে বেচারার টানাটানি চলছে খালি। মাঝরাতে বার দুয়েক করে দেখে আসে। স্থির থাকতে পারে না নীলম। এক এক দিন পুপুও দেখে আসে।
নীলম উঠল। এইবারে পুপুকে খেতে দেবে। এইসময়ে পুপু সারাদিনের সবচেয়ে ভারি খাবারটা খেয়ে নেয়। আগের দিন রাত্রে একটু শুকনো মাংস কিংবা সবজি করা থাকে। এখন গরম গরম পরোটা করে দেবে। মেথি-পরোটা কিংবা আলু-পরোটা। ভালো করে খেয়ে নেবে পুপু আচার এবং স্যালাড সহযোগে। কলেজ বেরোবার সময়ে খালি দুধ। দুপুরে একটা দুটো ফল দিয়ে লাঞ্চ সারে। ক্বচিৎ কখনও টিফিন নেয়। এখন আস্তে আস্তে ওর দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। টি-স্কেল সেট স্কোয়্যার, বড় বড় সাদা কাগজ ছড়িয়ে ও ডায়াগ্রাম নিয়ে মগ্ন থাকবে। এই সব ড্রাফট সবই ওর কলেজের কাজ নয়। প্রচণ্ড নেশা ওর। দেশ-বিদেশ থেকে বই আনায়, নতুন বাড়ি, নতুন হাউজিং কমপ্লেক্স, নতুন শহর বানাবে ও। কতকগুলো সময়ে ঘরটা ওকে সম্পূর্ণই ছেড়ে দিতে হয়।
পুপু খেয়ে দেয়ে ঘরে ঢুকে গেলে অরিত্র স্নান সেরে বেরোবে। সকালের দিকে একসঙ্গে সময় কিছুতেই হয় না। বাবা-মেয়ে বেরিয়ে গেলে নীলম কোমর বাঁধবে। কেউ কোনও ঘরে পড়াশোনা করেছিল, কেউ স্নান করেছে, কেউ কোথাও বসেছিল, শুয়েছিল, হেঁটেছিল, তার কোনও চিহ্ন রাখবে না। একেবারে সিনেমার সেট বানিয়ে ফেলবে। বাই শোবার ঘর ঝাড়া-পোঁছা করছে, রান্নাঘর থেকে নীলমের হঠাৎ বুকের মধ্যে ধ্বক করে উঠবে, —‘বাই বাই, খাটের সাইডগুলো মুছেছো? জানলার পাটগুলো! ওকি সার্সিতে একটা দক্ষিণ আমেরিকার মতো দাগ কেন? মোছো মোছো! আর একটু লোশন দাও, হ্যাঁ এইবার হয়েছে।’
এখনও অনেক সময়। তবু অরিত্র স্নান করে ফেলেছে বলে খেতে বসলো। নীলম নিজের প্লেটটাও নিয়ে এসেছে। কফির পট এনে রাখল। সব গুছিয়ে বসতে বসতে মৃদু গলায় বলল— ‘একটা কথা। পুপু যে ব্যবস্থা বলল সেটাও ওর মতো করে বলেছে। বলেছে বলেই যে ওর কথাটা আমাদের মানতে হবে তার কোনও মানে নেই। এষা যদি আসে, যদি কেন আসবেই, আমি তোমার ঘরেই থাকবো। খাটটা একটু ছোট, তা হোক।’
অরি আনমনে খাচ্ছিল, বলল—‘তুমি তো এষা না এলেও আমার ঘরে থাকতে পারো। থাকো না কেন, তুমিই জানো।’
নীলম বলল—‘মিষ্টিটা আনতে ভুলে গেছি। খাও, আসছি।’ রান্নাঘরের দিকে চলে গেল জবাব না দিয়ে, অর্থাৎ জবাব এড়িয়ে। এখন ফ্রিজ থেকে মিষ্টি বার করবে। তাকে গরম জলে বসিয়ে ঠাণ্ডা ছাড়াবে। ততক্ষণ অরি হয়ত খাবে ঠিকই, কিন্তু নীলমের খাবার প্লেটের ওপর শুকোতে থাকবে। এইরকমই ওর অভ্যেস।
অরিত্রর মনে হল—নীলম কি তাকে পাহারা দিয়ে রাখতে চায়? ওদের এই বাড়ির মস্ত ত্রুটি হল, গেস্ট রুম নেই। অথচ ভিন্ন প্রদেশে যাদের আত্মীয়স্বজন তাদের গেস্ট রুমটা একান্ত জরুরী। অতিথি এলেই বাড়ির সমস্ত চলতি ব্যবস্থা ওলট-পালট হয়ে যায়। সেটা অরিত্রর একদম পছন্দ না। নিজের কাজের জিনিস খুঁজে পেতে অসুবিধে হয়। নিজস্ব জায়গাটাতে না শুতে-বসতে পেলে সারাক্ষণ একটা অস্বস্তি লেগে থাকে মনে। কিন্তু কেউ এলে এরকমই হয়। এতেই ওরা তিনজন অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এবারেও কয়েকটা দিন নিজের ঘরটা এষাকে দিয়ে সে অনায়াসেই লিভিং রুমে শুতে পারতো। সোফা-কাম-বেডের ওপর। স্টিরিওটা যে টেবিলে রয়েছে তার ওপর এবং ড্রয়ারগুলোতে নিজের জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে নিলে মহাভারত এমন কিছু অশুদ্ধ হয়ে যেত না। কিন্তু নীলম যদি এই ব্যবস্থা করে, এষা তাহলে একলা ঘর পাবে না, এটা যে কোনও অতিথিকেই পারলে দেওয়া উচিত। খুব ঘনিষ্ঠ, নিত্য আসা-যাওয়ার লোক হলে আলাদা কথা। কিন্তু এষা যে একেবারেই নতুন। এই অরিত্র, এই নীলম, তাদের যুগ্ম সংসার এবং বিশেষত পুপুকে সে চেনে না। তাকে পুপুর ঘরে থাকতে দেওয়াটা⋯। কে জানে এষার নিজের অভ্যাস কি রকম! অথচ এ ব্যবস্থার ওলটপালট মানেই ভুল বোঝাবুঝি সাংসারিক অশান্তি, এতো অশান্তি অরিত্রর সংসারে বিক্রমরা পুনে ছাড়বার পর কখনও হয়নি। বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ না করে মেনে নেওয়াই ভালো।
যেভাবেই হোক, যেভাবেই থাকতে হোক, এষা আসুক। এষা থাকুক। কাছাকাছি। এষাকে ছুঁয়ে সেই হাওয়া সারা বাড়ি ঘুরলেও একবার না একবার তো তাকে এসে ছুঁয়ে যাবেই। এষার উপস্থিতির সুরভি লাগবে অরির গৃহস্থালিতে। এতদিনে বুঝি অরির বিবাহে সত্যিকারের স্বীকৃতির সীলমোহর পড়বে। এষা দেখবে, এষা ছোঁবে, এষা থাকবে বলে।
হঠাৎ অরিত্র নিজের মধ্যেই একটা ধাক্কা খেল। এষার সঙ্গে তার সম্পর্ক কি? এষার স্বীকৃতিকেই এমন চরম এবং পরম ভাববার কোনও সঙ্গত কারণ আছে কি? আগেকার সম্পর্ক তো নেই-ই। সম্পর্ক আসলে খুব জটিল আকার ধারণ করেছে। যখন যেখানে থেকেছে, বছরে দু একবার করে এষার পুরনো ঠিকানায় নিজের ঠিকানা জানিয়ে চিঠি দিয়ে গেছে অরিত্র। পুজোর পর এবং নববর্ষে তো বটেই। মাঝেও কখনও কখনও আরেকটা দিয়েছে। একটারও জবাব পায়নি। একটারও না। প্রত্যেকবার চিঠি ফেলে দেহলিদত্তপুষ্প হয়ে থেকেছে। একটার পর একটা দিন চলে গেছে অর্থহীনতার কবলে। তারপর কাজে-কর্মে-গার্হস্থ্যে-চিকিৎসায়-প্রাত্যহিকতায় ভুল। কিছু যে পাওয়ার কথা ছিল, পাওয়া হয়নি সেটা ভুলে যাওয়া। কিন্তু বিস্মৃতির মর্ম থেকে রক্তের ঢেউয়ে নিজেরই অজ্ঞাতে দোল লাগে। বসন্তের আকাশময় কার নীল শাড়ি ছড়িয়ে থাকে। প্রিয়লকরনগরের বীথিকাপথে গাছের শরীর থেকে কোনও মানবীর মৃদু দেহগন্ধ ভেসে এসে হঠাৎ কিরকম একটা কষ্ট দেয়। সারা জুলাই সহ্যাদ্রি মুখ ভার করে থাকে। মৌসুমী বায়ুর ধাক্কায় কি রকম একটা চকচকে আধো-অন্ধকার , ধূমল অথচ ভেতর থেকে আলো বিকীর্ণ হচ্ছে, পেছনে বুঝি বা সূর্য আছে। এষার গাত্রত্বকের সেই ভাস্বর পেলবতা মেদুর বর্ষায়, ভুলে থাকা সেও যে ভোলা নয় পুরোপুরি।
কিন্তু আঠার বছর পর। আঠার বছর পর এষা কেমন আছে, কেমন হয়েছে। আর দু বছর হলেই সেই বিখ্যাত কুড়ি বছর পর হয়ে যেত। শিশির শিকার করে নিয়ে গেছে তারে। কুড়ি বছরের পরে সেই কুয়াশায়, পাই যদি হঠাৎ তোমারে।
কিন্তু এতদিন পর, আঠার বছরে গড়ে আঠার দুগুণে ছত্রিশখানা চিঠি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করার পর সে অরিত্রকে স্মরণই বা করল কেন! একটা সময় ছিল যখন এষা খুব বিপদে পড়লে অরিত্রর কাছে আসত। বিপদগুলো এষার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। অরির কাছে হাসির। এখনও ভাবলে হাসি পায়।
এষা তার ডায়েরি ট্রামে ফেলে এসেছে। সে ডায়েরির মধ্যে তার যা কিছু গোপন ব্যাপার। হঠাৎ বাড়িতে ফোন—এষার বউদি ডেকে দিয়েছেন। এষা ফোন ধরেছে। ‘হ্যাললো, মিস টেগোরকে ডেকে দিন না একটু।’
‘মিস টেগোর? মিস টেগোর বলে এখানে কেউ থাকে না।’
‘থাকেন না? কেন ভ্যানতারা করছেন মাইরি।’
‘জীবনে সুলগ্ন সব সেঁউতির কুঁড়ি থেকে ফুল
আশা আর আশাভঙ্গে, আনন্দ যন্ত্রণায় চুল-
চেরা মাত্র অবকাশ, ভোরের সুগন্ধ সেই ব্যথাকে আমূল
তুলিনি তো! যদি ফোটে আনন্দ বকুল!
এইসব ফুল-চুল-মূল ইকড়ি মিকড়ি রবিঠাকুরের বংশ ছাড়া কে লিখবে দিদি!’
এষা ছুটে এসেছে।
‘অরিদা অরিদা, অসভ্য ছেলেগুলো রোজ একবার দুবার করে ফোন করছে। বউদি নামিয়ে রেখে দিচ্ছে তা-ও। ভীষণ অসুবিধে হচ্ছে বাড়িতে। নানারকম গলা করতে পারে আবার। ওই ডায়েরির মধ্যে শুধু কবিতা নয়, রাশি, রাশি কোটেশন আছে, সেসবের ওরা কদৰ্থ করবে, অনেক ঠিকানা, ফোন নম্বর প্রত্যেককে বিরক্ত করবে।’
অরিত্র গম্ভীর হয়ে শুনছে, ছবি আঁকছে।
‘কিছু করো অরিদা, কিছু তো বলো!’
‘কি বলবো? ল্যাদাডুস মেয়েদের এমনিই হওয়া উচিত। মিলের পালটা সাধতে ডায়েরিটা যে যুক্তিযুক্ত নয় একেবারেই সে কথা অনেকবার বলেছি।’
এষা রাগ করে উঠে দাঁড়িয়েছে। মিল সাধার কথা বললে ও সাঙ্ঘাতিক রেগে যায়। ওর সব কবিতা নাকি আকাশ থেকে পড়ে। এষা পাশ ফিরল, এবার চলে যাচ্ছে কি অদ্ভুত ছবি তৈরি করে। বৈষ্ণবপদাবলী থেকে উঠে এলো নাকি? বিরতি আহারে রাঙাবাস পরে যেমতি যোগিনী পারা। ঈষৎ লালচে চুল মুখের আধখানা ঢেকে আছে। আঁখি পল্লব দেখা যাচ্ছে। লম্বা লম্বা পাপড়ি। নাকের ডগা চকচক করছে। স্ফূরিতাধর।
অরি বলল—‘এষা, শোনো, শোনো। এবার ফোন করলে ওদের ভিক্টোরিয়ার ইস্ট গেটে মানে ক্যাথিড্রাল রোডের দিকের গেটের কাছে ডেকো।’
‘কি বাজে কথা বলছো? আমি চললুম। বিপদে নিজের ওপর নির্ভর করাই ভালো।’
‘খারাপ কিছু বলছি না। তুমি বলবে—ডায়েরিটা আমার ভীষ্ষণ দরকার। প্লী-জ ফেরৎ দিন। ঠিক যেমনি করছি এমনি করে ন্যাকমি ঢেলে দেবে বিশেষ বিশেষ শব্দের ওপরে। তারপর ওরা অবধারিতভাবে ওটা দিয়ে দিতে চাইবে তোমার সঙ্গে দেখা করে।’
‘সে তো করছেই। আমি বলছি বাড়িতে আসতে। এলে ভালো করে খাইয়ে দেব বলছি। তা-ও আসছে না।’
‘বাড়িতে আসবে না। যে জায়গায় বললাম সেখানে ডাকো, আসবে। সুড়সুড় করে আসবে। তারপর নির্ধারিত সময়ে যাবে ডায়েরিটা খুব নিরুদ্বেগে হেসে হেসে নেবে। আবারও মীট করবার নেমন্তন্ন করবে⋯
‘বা। তারপর?’
‘তারপর আমার ওপর ভরসা রাখবে। বেশ কোমর বেঁধে যেও।’
‘মানে?’
‘মানে, চুল টুল খোলা রেখো না। আঁচলটা কোমরে গুঁজে নেবে। টেনে দৌড় মারবার জন্যে প্রস্তুতি থাকতে হবে।’
এষা গেছে কথামতো। সবুজ শাড়িতে লাল পাড়। লাল আঁচলটা কোমরে গুঁজেছে। টিয়া রং গাছ, ঘাস, টিয়া রং এষার শাড়ি। দূর থেকে দেখছে অরিত্র আর তার সাঙ্গোপাঙ্গরা। দূর থেকে। তিনটে মস্তান হাত পা নেড়ে একমুখ দাঁত বার করে কি বলছে এষাকে। এষার সামনে পড়ে ছেলেগুলো একটু থতমত খেয়ে গেছে। ঠিক যে ধরনের মেয়েলি ব্যক্তিত্বের সামনে এদের প্রতিভা পুরোপুরি বিকশিত হয়, এষা বোধহয় সে রকম নয়। ডায়েরিটা দিল একজন, পেছন থেকে একটু একটু করে এগিয়েছে অরিত্ররা।
‘আবার কবে আসছেন? আমাদের তিনজনকে তিনটে আলাদা ডেট দিতে হবে কিন্তু।’
অরিত্রর ক্লাব এবার হকি-স্টিক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এষা বিদ্যুতের মতো সরে গেছে অকুস্থল থেকে। মেয়েদের জন্য পৃথিবীতে কত যুদ্ধ হয়ে গেছে, মহাকাব্যের বাইরে কি আর সে সব লেখা আছে? রাত সাড়ে আটটায় অরিত্রদের এজমালি বাড়ির কুঠুরি ঘরে কৃতজ্ঞতা জানাতে এসেছে এষা। অরি যেন ঘুমিয়ে। চিবুকে কপালে স্টিকিং প্লাস্টার। অরির মা বলছেন —‘অমন হকি খেলবার দরকার কি বলো তো! গুচ্ছের কাটা ছেঁড়া নিয়ে ছেলে ঘরে এলেন।’ অরি চোখ বুজে মনে মনে হাসছে। হকি-স্টিকের যা দাপট, শত্রু পেটাতে গিয়ে কয়েকটা সেম-সাইড হয়ে গেল। তাকে ঘুমন্ত মনে করে এষা চলে যাচ্ছে। কৃতজ্ঞতার রূপটা আবার কোন পদাবলীর দেখা হল না যে অভিনয় করতে গিয়ে! এষা, তুমি এক দূরতর দ্বীপ, দূরতম, রাত্রির নক্ষত্রের কাছে। সেই তুমি কেমন করে এতো কাছে আসতে পারো? সেটাই অরিত্র চৌধুরীর মাথায় ঢুকছে না। পার্থিব জগতে সে কি প্রকাশিত হতে পারে? হঠাৎ দপ করে অরিত্রর মনে হল—না পারে না। পারে না বলেই এই অদ্ভুত অসম্ভব সম্ভব হতে চলেছে। আঠারটা বছর জীবনের ওপর দিয়ে বুলডোজার চালিয়ে চলে গেছে। এষা আর পদাবলীর এষা নেই। যেমন নীলমও আর নেই র্যাফেলের। এই সোজা কথাটা এতদিন কেন মনে আসেনি! বাইরের এষার সঙ্গে সঙ্গে ভেতরের এষারও বদল হয়ে গেছে। আঠার বছর আগেকার সেই রক্তমাংস মেদমজ্জাময় উচ্ছল-উদ্ভিন্ন কাতর-আতুর-বিরহী-আবিষ্ট যে নীলম সে-ও তো আজ শীতল পাথরের চাপ। গতিহীন হিমবাহ। এষার পক্ষেও কি আর সেই দীর্ঘপক্ষ্ম, নিবিড়, নিতল, সজল, স্থিতিস্থাপক শ্যামবিদ্যুৎ থাকা সম্ভব হয়েছে? এই আঠার বছর এষা কিভাবে কাটিয়েছে, তার কিছুই তো তার জানা নেই! কোনও উপায় ছিল না জানবার। এষার বাড়িতে সে চিরকাল অনভিপ্রেত। সেখানে খোঁজ নিতে যাবার কোনও অর্থই নেই। তবু লিখে গেছে, যেন হর কি পৌড়িতে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যারতির লগ্নে গঙ্গার জলে একটা করে দীপ ভাসিয়ে যাওয়া। স্রোতে ভাসতে ভাসতে দীপ চলে যায়— কস্মৈ দেবায়? কস্মৈ দেবায়! যার উদ্দেশে নিবেদিত হবিঃ সে কি পায়! সেই আধাপরিচিত দেবতা যাকে ধূপধুনোর মধ্য দিয়ে আবছা দেখা গেছে সেই অপার্থিব কি সত্যি? তার অলৌকিক মঞ্চ থেকে মানুষের দৃষ্টির সামনে সে কি নেমে আসবে? আসা সম্ভব? নাকি তার আগেই কোনও দুর্ঘটনা! অরির হতে পারে, এষার হতে পারে। ভেতরটা প্রচণ্ডভাবে শিউরে উঠল। এষার যদি কিছু হয়! অরি কি তার মৃত্যু চাইছে? পাছে তার স্বপ্নভঙ্গ হয়! না, না। সত্যকে দুচোখ দিয়ে দেখবার সাহস অরিত্রর আছে। এষা আর সে এষা নেই। অন্য এষা আসছে। অন্য নীলম, অন্য এষা, অন্য অরিত্র। জ্যামিতি বদলে গেছে। পুরনো ইতিহাসের পাতা ইরেজার দিয়ে মুছে মুছে মুছে অন্য ইতিহাস লেখা হবে। সেই ভালো। এই-ই ভালো। মৃদু হর্ন দিয়েছে পাটিল। টাইয়ের ফাঁসটা ঠিকঠাক বসিয়ে নিয়ে অরিত্র জুতোয় পা গলালো। নীলম ছোট প্যাকেটে করে ঠাকুরের ফুল এনে ওর মাথায় রাখলো, তারপর প্যান্টের পাশ-পকেটে গুঁজে দিল। দরজা খুলে গেছে। অনেক দিন পর আবার পুরনো রুটিন, কাজ, বহু লোকের সঙ্গে ডানহিল ঠোঁটে ঝুলিয়ে কথা, টেলিফোন, জিমখানায় লাঞ্চ, বিজ্ঞাপনের লে-আউট দেখা, ভিসুয়াল দেখতে বসে বিনয় দেশাইয়ের সঙ্গে পরামর্শ। কী অর্থহীন কাজে, সময়-অপচয়ে মানুষ মেতে থাকতে পারে। কী অর্থহীন উপকরণ চাহিদা আমদানির দুর্ভেদ্য দুষ্টবৃত্তে সভ্যতার নাড়ি পাকে চক্রে জড়িয়ে গেছে।