পঞ্চম পুরুষ (Pancham Purus) : 16
পাহাড় থেকে নেমে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে মহানাম বললেন—‘আমি একটা দিন থেকে যাই। প্যানেলগুলো দেখতেই ব্যস্ত ছিলুম, সীলিং-এর কাজগুলো ভালো করে দেখা হয়নি। কয়েকটা ছবি, গুহার ফাসাদ্—এগুলোও দেখা দরকার।’
এষা বলল—‘আমার তো ফিরতেই ইচ্ছে হচ্ছে না আর। সম্ভব হলে কোনও বিহারে পাথরের বালিশে মাথা রেখে, পাথরের শয্যায় কাটিয়ে দিতুম। রোজ সকাল সন্ধে একবার করে ওই হর্ষ-বিষাদ আর ধ্যানমগ্ন অমিতাভকে দেখা যেত।’
বিক্রম বলল—‘নিবৃত্তি মার্গ বলে একটা ব্যাপার আছে না? আহা, আপনি যদি ওই মার্গে যান আরও কত গেরস্থ যে সন্নিসি হয়ে যেতে চাইবে এষাজী। সব গুহা-বিহার-সঙ্ঘারাম একেবারে জ্যাম-প্যাকড হয়ে যাবে। অমন কাজটিও করবেন না।’
নীলম আবিষ্ট স্বরে বলল—‘আমি মূর্খ মানুষ। যা দেখেছি তাই আমার যথেষ্ট। অরিত্র, আমি ফিরব।’
বিক্রম মহা উৎসাহে বলল—‘কোই বাত নেই। আমি তো ফিরছিই। নীলম ভাবী আমার সঙ্গে চলুক। বাস-টাস ধরবার দরকার নেই। চৌধুরীদাও নিশ্চয়ই থেকে যাবেন।’
নীলম ফেরবার কথা বলতে অরিত্র মহা বিপদে পড়ে গিয়েছিল। সে তো ঠিক অজন্তা দেখতে আসেনি। এষা দেখতে এসেছিল। এষা নিঃশেষ হয়নি। এষাকে এখানে মহানামের তত্ত্বাবধানে রেখে সে কেমন করে ফিরবে? অথচ নীলমের ফেরার সঙ্কল্পটা যে একটা চ্যালেঞ্জের মতো সেটা সে বেশ বুঝতে পারছে।
বিক্রমের কথায় তার সুবিধে হয়ে গেল। সে বলল—‘ন্যাচার্যালি। অজন্তা তো একদিনে দেখবার জিনিস নয়। আমাদের মতো আনাড়িদের জন্যও অন্তত দু’দিন। বিশেষত মহানামদা যেখানে গাইড সেখানে সুযোগ ছেড়ে দেওয়া বোকামি। নীলম, একটা রাত থেকে যেতে তোমার কি অসুবিধে?’
নীলম উদাস সুরে বলল—‘আমার যা দেখার, যা বোঝার দেখা, বোঝা হয়ে গেছে অরি, তুমি থাকো না। তোমাকে তো বারণ করছি না! আমি যাই।’
বিক্রম বলল—‘আমি খুব সাবধানে গাড়ি চালাব। নীলম ভাবী পুরো পেছনের সীটটা জুড়ে শুয়ে-বসে যেতে পারবে। কোনও ভাবনা নেই। তা ছাড়া সীমাও তো সঙ্গে রইল। সো স্মার্ট, সো রিসোর্সফুল, ভয় কি!’
বিক্রম প্রায় চোখ ছোট করে পিঠ চাপড়াচ্ছে অরিত্রর। গা ঝাড়া দিয়ে অরিত্র বলল—‘কী নীলম, তোমারও কি তাই-ই ইচ্ছে?’
নীলম বলল—‘এতোটা রাস্তা একা একা বাস বদল করে করে যাওয়ার চেয়ে সীমাদের সঙ্গে যাওয়াই তো ভালো। মহানামদা, আমি আসছি, এষা ভালো করে দেখো, তোমার জন্যেই আমার অজন্তা দর্শন হল। এতো কাছে থেকেও তো এতদিন দেখিনি।’
নীলম নীরবে দরজা খুলে গাড়ির পেছনে উঠে পড়ল। সীটে হেলান দিয়ে চোখ বুজল। অরিত্র জানলায় কনুই রেখে নিচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
‘নীলম, শরীর খারাপ করছে না কি?’
‘নাঃ, ক্লান্ত, খুব থকে গেছি।’
‘তোমার ওপর দিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই বড্ড খাটুনি যাচ্ছে। সেই আমার অ্যাকসিডেন্ট থেকে আরম্ভ হয়েছে। তোমার বাহনটি তো আসে আর যায়। তুমি গিয়ে সব কিছু ওই বাইকে দিয়ে করাবে বলে দিলুম। আর আমরা তো কালই ফিরে যাচ্ছি।’
নীলম মনে মনে বলল—আর কোনদিনও ফিরবে না অরিত্র। সে আমি বুঝতে পেরেছি। অমন ফেরা ফিরেও তোমার কাজ নেই।
অরিত্র বলল—‘বাড়ি গিয়েই পুপকে ফোন করো। ওকে সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি আসতে বলবে। আমরা ওকে ভীষণ মিস্ করেছি বলবে।’
নীলম মনে মনে বলল—পুপুকে তুমি আর পাচ্ছো না অরি। তোমাকেও কিছু মূল্য দিতে হবে। এ ক’টা দিন পুরো সময় পাবো। কাল বিকেলে পুপুর পরীক্ষা শেষ। তারপরে আমি আর পুপু শূন্য ঘর অনেক কথা দিয়ে ভরবো।
গাড়ি ছেড়ে দিল। ছাড়বার পরও অরিত্রর শেষ কথার রেশ নীলমের কানে লেগে রইল। পুপু, পুপে, পরীক্ষাটা ওর কেমন হল কে জানে! মাত্র দুদিন বাড়ি ছাড়া। অথচ মনে হচ্ছে যেন কত দিন! কত যুগ! পুপু যেন দুর্লঙ্ঘ্য ব্যবধানে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝখানে নদী ওই বহে চলে যায়। কিসের নদী? কি এমন নদী যা পার হওয়া যায় না? একি বিস্মরণের নদী!
সূর্য অস্ত গেল সাতটারও পরে। এখনও হালকা অন্ধকারে ভেসে আছে চারদিক। নিচের দোকান থেকে কিছু কেনাকাটা করার আশায় গিয়েছিল এষা। হতাশ হয়ে ফিরল। মহানাম বললেন—‘একটা জিনিস ভুল করছ এষা। কোণার্ক বা জগন্নাথ মন্দিরের শিল্পীদের উত্তরসাধক এখনও পর্যন্ত আশেপাশে শিল্পী পাড়ায় বাস করেন, তাঁদের হাতে স্মৃতি এখনও জাগ্রত। সেখানে তুমি কোণার্ক যক্ষীর ডুপ্লিকেট পেতে পারো। এখানে তেরশ বছরের ব্যবধান। তারা কে, কোথায় গেল, কেন গেল, সবটাই তো রহস্য!’
এষা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল—‘তাঁরা হয়ত মোক্ষ পেলেন, তাঁদের শিল্পও এবার নির্বাণ পাচ্ছে। মহাপরিনির্বাণ। আমাদের দেশে এই যে নিবৃত্তির সাধনার বাড়াবাড়ি, তারই জন্য কি আমাদের এতো অধঃপতন? বুদ্ধদেব নিজে তো প্রব্রজ্যা নিলেনই, সমকালীন ভারতবর্ষে যেখানে যত সম্ভাবনাময় পুরুষ ছিল তাদের সবাইকে নেওয়ালেন। তাঁর ভাই নন্দ যদি জনপদকল্যাণীকে বিবাহ করে শুদ্ধোদনের উত্তরাধিকারী হয়ে রাজ্য চালাতেন কি এমন ক্ষতি হত? রাহুলকেও যে পিতৃধন বলে বালক বয়সেই সন্ন্যাস দিলেন, আর কি তার সময় ছিল না? আনন্দও তো ওঁর খুড়তুত ভাই ছিলেন বলে শুনেছি। ক্ষত্রিয়দের এই তপস্বী বৃত্তি অবলম্বনকে আমি কিছুতেই কল্যাণকর বলে দেখতে পারি না মহানামদা। চৈতন্যও সেই একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করেছেন। কি দারুণ শক্তিমান, ধীমান, সংস্কারমুক্ত বীরপুরুষ ছিলেন, বীর্য আর জ্ঞানের সংমিশ্রণে কী অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব! সংকীর্তন আর ভাবসমাধি ছাড়া আর কিছু করে কি দেশের কাছে, জাতির কাছে, মানুষের কাছে তাঁর কর্তব্য করতে পারতেন না? একালে এলেন বিবেকানন্দ, দরিদ্র মানুষের সেবা করলেন, বীর্যের প্রয়োজন অনুভব করলেন। কিন্তু আবারও দেশময় সেই সন্ন্যাসী-সৃষ্টির মহোৎসব পড়ে গেল। তাহলে পরবর্তী প্রজন্মগুলো সৃষ্টি করার জন্য যুগে যুগে পড়ে থাকছে কারা বলুন তো? ওই কুটিল বুদ্ধশত্রুরা, দুশ্চরিত্র জগাই মাধাই, আর বাবু-কালচারের ‘সধবার একাদশী’র বাবুরা। এইভাবে দিনের পর দিন আমরা পেছু হটছি। আশ্চর্য কি, এই ভারতবর্ষ দুর্বল, ভীরু, বিশ্বাসঘাতক, ধান্দাবাজ আর হিংসুকদের জন্ম দেবে! ফিরে আসবে না আর কুরু পিতামহ ভীষ্ম, কি রামচন্দ্র, লক্ষণ, ভরত, পঞ্চপাণ্ডব যাঁরা প্রতিটি রক্তবিন্দু দেশ-দশ-সমাজের জন্য দান করে গেছেন! আপনি চিন্তা করে দেখুন রামচন্দ্রের সীতাত্যাগ বা পাণ্ডবদের কুরুক্ষেত্রের ভীষণতার পরেও রাজত্ব সে কি দশের মুখ চেয়েই নয়?’
অরিত্র বলল—‘ওরে বাপ রে! কি লেকচার! তুমি তোমার ছাত্র-ছাত্রীদের এইসবই বলো না কি উইথ সাচ প্যাশন? জাতির জীবনীশক্তি কি কয়েকটা মানুষের কাছে গচ্ছিত থাকে? তাহলে তো মহাযুদ্ধের পরবর্তী ইউরোপেও আর মানুষ জন্মাবার কথা নয়।’
‘মহাযুদ্ধের পরবর্তী ইউরোপ যে পড়ো জমি, আর তার মানুষরা যে সব ফাঁপা মানুষ সে কথা তো ওদের কবিই আমাদের বলে গেছেন অরিত্র। মহাযুদ্ধের পরের ইতিহাস আর য়ুরোপের নয়, আমেরিকার ইতিহাস। তবে জার্মানি যে কি মন্ত্রে এই বিপুল ক্ষতি হজম করে, দেশবিভাগ সহ্য করেও আবার এমন সুন্দর করে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে আমার জানা নেই।’
মহানাম বললেন—‘ভারতের অধঃপতনের কারণ তো কখনই একটা নয় এষা। বাইরের শত্রুর কাছে ভারত বরাবর হার মেনেছে অন্তর্কলহের জন্য—কৌরব-পাণ্ডব, অম্ভি-পুরু, জয়চাঁদ-পৃথ্বিরাজ, নেহরু-জিনাহ্, তারপর ইদানীং ভিন্দ্রানওয়ালে, ঘিসিং,⋯চলছে তো চলছেই। আর একটা বড় কারণ আমাদের বৃত্তিনির্ভর সমাজ-ব্যবস্থার আদি অভ্যাসগুলো। যে ব্রাহ্মণ সে খালি যজন-যাজন-অধ্যাপনাই করবে, আত্মরক্ষা করতে জানবে না, যে বৈশ্য সে খালি চাষ-বাস-ব্যবসা-বাণিজ্যই করবে অস্ত্রশিক্ষা করবে না, আর শূদ্রর তো কথাই নেই। অর্থাৎ শত্রু উপস্থিত হলে রক্ষা করতে মুষ্টিমেয় ক্ষত্রিয় ছাড়া আর কেউ নেই।’
এষা বলল—‘সেই ক্ষত্রিয়দেরও তরোয়াল ফেলে দিতে শেখানো হল। ওই যে বিশ্বান্তর জাতকে রাজপুত্র বিশ্বান্তর তরোয়াল দান করে দিলেন। প্রজারা যে ক্ষেপে উঠেছিল, সে তাদের বুদ্ধিশুদ্ধি ছিল বলেই।’
‘গোড়ায় কিন্তু এরকম ছিল না। দ্রোণাচার্য, পরশুরাম, অশ্বত্থামা এঁরা ব্রাহ্মণ হয়েও যুদ্ধ ব্যবসায়ী।’ —মহানাম বললেন।
অরিত্র বলল—‘এঁরা যে ব্যতিক্রম, সেটা বোঝাতে মহাভারত কিন্তু যথেষ্ট গল্প ফেঁদেছে।’
মহানাম বললেন—‘আদিতে যে শ্রেণীবিভাগহীন সমাজ ছিল, এঁরা সেই সমাজের শেষ চিহ্ন এ-ও হতে পারে। আসলে এই শ্রেণীবিভাগ ওরা মহেঞ্জোদড়োর দ্রাবিড় সভ্যতা থেকে পেয়েছিল। ভারতে প্রবেশ করবার আগে আর্যদের নারী, বালক সকলেই অস্ত্র ধারণ করতে জানত। সেইজন্যই ওইরকম সুসংগঠিত দ্রাবিড় সভ্যতা ধ্বংস করা ওদের পক্ষে সম্ভব হয়, তাদের চেয়ে বহু বিষয়ে অজ্ঞ এবং দীন হয়েও। তারপর সভ্যতার এই রোগ তাদেরও আক্রমণ করল। মেয়েরা ধনুর্বাণ ফেলে যাঁতা, বঁটি, খুন্তি তুলে নিল। বালকরা লাঠি আর কন্দুক। ফলে দ্যাখো আজ এমন বিশেষীকরণের দিন এসে গেল যে দাঁতের ডাক্তার আর কানে হাত দিতে পারে না।’
বলতে বলতে মহানাম উঠে পড়লেন—‘তোমরা বসো। আমি একটু ব্যায়াম করে আসি।’ মহানাম নিজের ঘরে চলে গেলেন। মহানাম আর অরিত্রর একটা ঘর। এষার ঘরে বসে কথা হচ্ছিল। খাটটা একপাশে, একটা টেবিল, দুটো চেয়ার। চেয়ার দুটোয় ওরা বসেছিল, এষা বসেছিল খাটের ওপর পা ঝুলিয়ে।
অরিত্র বলল—‘একটু চা কিংবা কফি বলি, কি বলো?’
এষা বলল—‘বলো।’
চায়ের কথা বলে অরিত্র ফিরে এলে এষা বলল—‘অরি, তোমার মনে পড়ে তুমি কিরকম আমাকে হেদুয়ার মোড় থেকে কালেক্ট করে মহানামদার বাড়ি নিয়ে গিয়েছিলে ডাফ লেনে, দারুণ একটা চমক দেবে বলে? মহানামদা সেইমাত্র অক্সফোর্ড থেকে ফিরে কত সিনিয়রকে টপকে নেহাত অল্প বয়সে প্রফেসর হয়েছেন বলে কী গণ্ডগোল, দুর্নাম! এদিকে ছাত্র-ছাত্রীরা সব হাঁ করে ওঁর লেকচার গিলছে! মনে আছে অরিত্র, আমি নিতান্ত অর্বাচীন আণ্ডার-গ্র্যাজুয়েট হয়ে ওঁর সঙ্গে কিরকম সমান তালে তর্ক করতুম!’
অরিত্র বলল—‘সবচেয়ে মজা হল মহানামদা যেদিন রবীন্দ্রনাথের গদ্যকে নস্যাৎ করলেন, সুধীন দত্তর প্রোজ স্টিলটেড বললেন, আর তুমি ভালো গদ্যের উদাহরণ চাইতে ‘মানুষের ধর্ম’ থেকে উদ্ধৃত করলেন। তুমি ঠকতে ঠকতে বেঁচে গেলে, তীরের মতো উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছো ‘রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ!’ এ দৃশ্যটা আমি এখনও দেখতে পাই।’
এষা বলল—‘তুমি কি রকম রেগে গিয়েছিলে? মহানামদা হাসতে হাসতে বলে দিলেন কোনও বড় লেখককে পুরোপুরি খারিজ করা যায় না, অমুকের গদ্য, তমুকের পদ্য বলে আলাদা একটা ব্যাপার তৈরি করা আমার খুব কৃত্রিম অভ্যাস বলে মনে হয়। তোমরা এইরকম করে ভাবো, ‘বসুন্ধরা’ অতিকথনদোষে দুষ্ট, ‘অসম্ভব’ একটি অনবদ্য গীতিকবিতা, ‘গোরা’-তে লেকচার প্রাণ পায়নি, ‘নৌকাডুবি’-তে অনুপম ন্যারেটিভের গুণে রোম্যান্স, উপন্যাস হয়ে উঠেছে, যা নিছক ‘রাধারানী’ হতে পারত তা ‘চন্দ্রশেখর’-এর কাছাকাছি এসে গেছে।’
‘তোমার মনে আছে তো ঠিক? আশ্চর্য!’ অরিত্র বলল
‘মনে থাকবে না কেন অরি, মহানামদার কাছ থেকেই তো সমালোচনার মূল নীতিগুলো কিভাবে ব্যবহার করতে হয় আমি শিখি, ওসব তো কখনো ক্লাসে শেখানো হয় না। ধোঁয়াটে কতকগুলো কথা ব্যবহার ছাড়া আর কি শেখায় ওরা বলো? ওঁর সঙ্গে সব বিষয়ে একমত হতে না পারি। কিন্তু পথটা ওঁরই দেখানো। মহানামদাকে জিজ্ঞেস করলে হত ‘বসুন্ধরা’ কবিতা আর ‘সাহিত্য’, ‘সাহিত্যের পথে’র গদ্য সম্পর্কে ওঁর মতামত উনি পুনর্বিবেচনা করেছেন কি না।’
অরিত্র বলল—‘যেরকম ‘মেঘদূত’ আওড়াচ্ছিলেন, মনে হচ্ছে এখন অনেক ভাবালুতা, অনেক অতিকথনই ওঁর বেশ পছন্দসই হয়ে গেছে। যাই হোক এষা, আমরা কি সারাক্ষণ মহানাম-কথাই আলোচনা করব? আমাদের নিজেদের কিছু কথা নেই?’
এষা হেসে বলল—
‘কথা যে ছড়িয়ে আছে জীবনের সবখানে, সব গানে
তারও পরে আছে বাঙ্ময় নীরবতা।’
এষা গা ধুয়ে এসে বসেছে। তার দিক থেকে অনেকক্ষণ ধরে একটা মৃদু সুগন্ধ হাওয়া আসছে যেন শ্রীবিশাল কালিদাসের কাল থেকেই। ঘন চুল খোলা, ফুলে রয়েছে। ও-ও কি ধূপের ধোঁয়ায় চুল শুকিয়েছে? চুল তার কবেকার·⋯।
‘না এষা না, এতযুগ পরে তুমি যদি এলেই, তবে শুধু ‘বাঙ্ময় নীরবতা’ ছাড়া আর কিছু আমাকে তোমার দেওয়ার নেই, এ কথা আমি ভাবতে পারি না।’
এষা বলল—
‘হয়ত বা দিয়ে যাই কবিতা না গান না
ডানা-ভাঙা পাখিটার কান্না
বিশাখা তারার মতো কোনও কোনও মুখোমুখি সন্ধ্যা
অজন্তাগন্ধা
আর কিছু নাই পারি, দেখা যায় যদ্দূর
মাওলি মৃত্তিকায় ধানী রং রোদ্দুর।’
অরিত্র, আমি তো তোমায় অনেকই দিয়েছি। পুরনো স্মৃতির উজ্জীবন, পুরনো অপরাধের ক্ষমা, অবিনাশী বন্ধুত্ব, আর কত দেব?’
অরিত্র প্রায় নতজানু হয়ে বসে পড়েছে। অস্ফুট গলায় বলল—‘এষা প্লীজ।’
‘আরও চাও?’ এষার মুখে আর হাসি নেই। চোখের তারায় কেমন একটা দুঃখ। কেমন একটা আত্মমগ্ন সুদূরতার সঙ্গে সে বলল—‘তোমাকে দিলুম ওই অজস্র পত্রপুষ্পহীন রুপোলি শিমূল যারা দীপ্র সূর্যালোকের মধ্যেও লাইটহাউসের মতো জ্বলে, দিলুম এই তীর্থপথের ধূসর করা ধূলি, অমিতাভ মুখের ওই অদ্ভুত হাসি আর বিষাদ যার কোনটারই অর্থ আমি এখনও পুরোপুরি বুঝতে পারিনি, বুঝতে চাইও না, আর কি চাও?’
অরিত্র এষার নবশাল্মলীপত্রের মতো পা দুটো নিজের বুকের ওপর চেপে ধরেছে —কি নরম, মসৃণ, উদার পদপল্লব। পায়ের ওপর গাল, অরি চুমোয় চুমোয় আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে পা।
এষা যেন হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। তার চোখে বিস্ময়, ভুরুতে ভ্রূ দুটি। এবার সে জোরে পা ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়াল, চাপা রাগের সঙ্গে ক্ষুব্ধ গলায় বলল —‘অরি, তুমি চলে যাও। তুমিও কি সীমার মতন মনে করো আমি একা বলেই আমায় নিয়ে যে যা খুশি করতে পারে?’
‘কেন বুঝছ না?’ অরিত্র আস্তে আস্তে বলল, ‘আমি তো তোমার কাছে নিজেকে সমর্পণ করছি, সমর্পণ করছি আমার জীবনের প্রথম এবং শেষ ভালোবাসা। তুমি যতটুকু দেবে আমি ততটুকুই নেবো। এষা, আমার কাছে তোমার জীবনের কতটা গচ্ছিত আছে তুমি জানো না। আমাকে না পেলে তুমিই বা পূর্ণ হবে কি করে?’
এষা বলল—‘অরি, তোমার কাছে আমার একটা অতীত অভিজ্ঞতার ঝুলি বই আর কিছু গচ্ছিত নেই। সে ঝুলিও একান্তই আমার। তোমার কাছ থেকে কিছু নিয়ে পূর্ণ হবার আমার প্রশ্ন নেই। তোমাতে আমার যে জীবনসত্য ছিল, তা আমি বহুকাল পেরিয়ে এসেছি। তুমি বোঝবার চেষ্টা করো অরি, আমার কাছে আমার বান্ধবী পিকুও যা, তুমিও ঠিক তাই। আমাদের সম্পর্কে আর কোনও লিঙ্গভেদ নেই।’
অরিত্র বলল—‘আমার শোণিত তার উল্টো সাক্ষ্য দিচ্ছে যে। পারস্পরিকতা ছাড়া এরকম হওয়া সম্ভব নয়। এষা, তুমি মিথ্যে বলছ। আসলে তুমি সংস্কার ত্যাগ করতে পারছো না।’
‘না, না।’ এষা তীব্র গলায় বলল, ‘সংস্কার ত্যাগ করতে না পারলে আমি তোমায় সে কথা জানাতুম। আসলে তোমার অহঙ্কারই স্বীকার করতে চাইছে না অরি, আই হ্যাভ টোট্যালি আউটগ্রোন ইউ। নীলমের মতো এমন অসাধারণ রূপসী গুণবতী স্ত্রী পেয়েও কিসের অভাবে তুমি আমার কাছে এমন কাঙালপনা করছ? ছি, অরি, ছি!’
‘হায় এষা, তার সমস্ত রূপ এবং গুণ যোগ করে এবং গুণ করেও নীলম যে তোমার পায়ের নখের যোগ্য নয়। আমি কেমন করে তোমাকে ভুলব!’
এষা বলল—‘ঘর থেকে যাও অরিত্র। আমি এবার শুয়ে পড়ব। ভালো লাগছে না আর। কিচ্ছু ভালো লাগছে না। এখানে এসে আমি ক্ষমার অযোগ্য ভুল করেছি।’
দরজা বন্ধ করে দিল এষা। সারারাত আর খুলল না। নির্বাক দরজার পেছনে সে যেন নিজেকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইছে। রাত্তিরের খাওয়ার সময় মহানাম বললেন—‘সে কি? ও খাবে না?’ অরিত্র দরজার কাছ থেকে ডাকাডাকি করে ফিরে এলো, বলল—‘ও খাবে না।’
মহানাম বললেন—‘তাহলে আর কি? এতো বড় ডাইনিং হলে আমরা দুটি মাত্র প্রাণী টিমটিম করছি। যা-ই বলল আমার কিন্তু খুবই খিদে পেয়েছে, এদের ডালভাজিটা খাসা করে। চলো খেয়ে নেওয়া যাক।’
রাত্রিবেলায় নিজের খাটে শুয়ে শুয়ে অজন্তার দিক থেকে যেন একটা ভীষণ হাওয়া আসছে টের পেল অরিত্র চৌধুরী। ভীষণ, প্রতিহিংসামূলক হাওয়া। তার বুকের ভেতরটা বেলুনের মতো ফুলে উঠতে উঠতে একসময়ে মনে হল বোধহয় ফেটে বেরিয়ে যাবে। এষা তাহলে এতদিনে, এইভাবে প্রতিশোধ নিল? এইভাবে তাকে শরীরে, মনে, স্মৃতিতে আপাদমস্তক জাগিয়ে দিয়ে এইভাবে পা ধরিয়ে, তারপর নিপুণ উদাসীনতায় ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া! এই জন্যেই, এরই জন্যে সে আজ আঠার বছর পরে এসেছিল! চমৎকার! শুয়ে শুয়ে অরিত্র যেন আয়নায় নিজের অপমানিত মুখখানা দেখতে পাচ্ছিল। জটাজুটধারী ভিখারি শিব, অপমানের ভস্মে লিপ্ত। তাকে দু’পায়ে দলিত পিষ্ট করে ডজনে ডজনে মৃত অরিত্রর মুণ্ড গলায় ঝুলিয়েছে মহাকালী, এষা তার দিকে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে।
মহানামকে যতটা উদাসীন ভোলানাথ ঠাউরে ছিল অরিত্র, ততটা তিনি মোটেই ছিলেন না। রাতে যখন এষা খেতে নামল না, এবং করিডর দিয়ে তার ঘর পার হবার সময়ে দরজা কি রকম অমোঘভাবে বন্ধ দেখলেন তখনই মহানাম বুঝতে পেরেছিলেন কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। এবং খুব সম্ভব অরিত্রই গণ্ডগোলটা পাকিয়েছে। খুব ভোরবেলায় ঘর থেকে বেরিয়ে দেখেন এষা সুটকেস হাতে সিঁড়ি দিয়ে নামছে। স্নান-টান সারা। চুলগুলো গোছা করে বাঁধা। ছাই-ছাই রঙের কেয়াফুল-ছাপ শিফন শাড়ি পরে একেবারে তৈরি। মহানামকে দেখে চমকে তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গিতে বলল—‘মহানামদা, আমি আর অজন্তায় উঠছি না। রাতটা থাকাই সার হল। এদের কাউন্টারে সুটকেসটা জমা রেখে একটু ঘুরে আসছি,’ একটু ইতস্তত করে বলল—‘আমি আর আপনাদের সঙ্গে পুনেও ফিরব না। ঔরঙ্গাবাদ থেকে সোজা বম্বে চলে যাবো। তারপর দেখি কি হয়!’
মহানাম বললেন—‘হঠাৎ প্ল্যান-পরিবর্তন? কি ব্যাপার এষা?’
‘আমি যেখানেই থাকি, সব বড্ড জট পাকিয়ে যায় মহানামদা, আমার ভাগ্য!’
মহানাম হঠাৎ গম্ভীর গলায় বললেন—‘সেবারও পালালে, এবারও পালাচ্ছ? অরিত্র চৌধুরী তাহলে বরাবরই তোমার ওপর জিতে যাবে?’
এষা বিষণ্ণ গলায় বলল—‘ও যে অবস্থায় পৌঁছেছে তাতে আমি না চলে গেলে নীলম সমূহ দুঃখ পাবে। দেখলেন না কাল ও কেমন করে চলে গেল? যেন আমাকে ফাঁকা মাঠ ছেড়ে দিয়ে, পরম ধিক্কারে! অথচ দেখুন, আমি মোটে খেলতেই নামিনি। নীলমই যদি একথা না বোঝে তো অরি কি করে বুঝবে বলুন! অরির ব্যবহারে নীলম গভীর দুঃখ পেয়েছে। উপলক্ষ্য তো আমিই!’
মহানাম বললেন—‘দুঃখটা কখন যে কার কাজে লেগে যায় কেউ বলতে পারে না এষা। আর তোমায় উপলক্ষ্য করে নীলম একটু দুঃখ পেলে শোধবোধ হয়ে যায়। বরাবর বেচারাকে ঋণী রেখে কি লাভ?’
হঠাৎ এষার বুকের মধ্যে ব্যাকুল কান্না ফেনিয়ে উঠল। গলার কাছে তাকে প্রাণপণে থামিয়ে রাখবার জন্য সে জোর করে মুখ নিচু করে রইল। মহানাম বললেন—‘সেবার আমার কাছে আসতে ভরসা পাওনি এষা, বাজারে খুব দুর্নাম রটেছিল। এবার যদি ভরসা করতে পারো তো আমি তোমার পাশে থাকব। অরিত্রকে সম্মুখ সমর দাও। এভাবে রণে ভঙ্গ দিও না। ওকে চুরমার করে না দিলে তোমরা কেউ কারো কাছ থেকে মুক্তি পাবে না।’
এষা পেছন ফিরে দাঁড়িয়েছে। মহানাম বুঝতে পারছেন ও নিঃশব্দে কাঁদছে। ভালোবাসা মরে গেছে। কিন্তু তার দেওয়া আঘাত এখনও কোথাও কোথাও টাটকা আছে। সেই কাঁচা ঘায়ে ভীষণ লাগিয়ে দিয়েছেন মহানাম। এষা এখন ঊনিশ বছরের তরুণী। যাকে ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয়েছে। সমিদ্ধা। সেই মুক্তা রঙের নিটোল গ্রীবার বাঁক, কানের কাছে কুচো চুল। অ্যান ইনফিনিটলি জেন্টল ইনফিনিটলি সাফারিং থিং। মহানাম অনুভব করছেন সান্ত্বনায় তাঁর হাত কাঁপছে। কিন্তু ও যে স্বাধীন, তেজী মেয়েও। সান্ত্বনা দিয়ে তো ওকে ছোট করা যায় না! সাহস দিতে হয়! আরও সাহস! তাঁর নিজেরও হাত যখন এমন দ্বিধায় কাঁপবে না, সম্পূর্ণ নিথর অথচ ভাবময় থাকবে, তখন, একমাত্র তখনই তিনি ওকে সাহসরূপ সান্ত্বনা দেবার অধিকারী হবেন।
মহানাম বললেন—‘তোমার অরিজিন্যাল প্ল্যান কি ছিল?’
‘এখান থেকে পুনে ফিরে, দু-একদিন কাটিয়ে বম্বে যাওয়ার কথা, বম্বে থেকে জাহাজে গোয়া, গোয়া থেকে বম্বে ফিরে গীতাঞ্জলি ধরব। মানে ধরার কথা ছিল। সেই মতই রিটার্ন টিকিট কাটা আছে।’
মহানাম বললেন—‘ঠিক আছে। তোমার পুরো ভ্রমণপঞ্জীটা আমি নিয়ে রাখছি। বরাবর তোমার সঙ্গী থাকছি, কলকাতা পর্যন্ত। আমি আছি। কিন্তু লড়াইটা তোমাকেই লড়ে জিততে হবে এষা।’
অরিত্র সারারাত ঘুমোয়নি। ভোরের দিকে তাই ঘুম চেপে ধরেছিল। উঠতে দেরি হয়ে গেছে। তৈরি হয়ে নিচে প্রাতরাশ খেতে নেমে দেখল মহানাম দরজার কাছে পুরো দৈর্ঘ্য মেলে দাঁড়িয়ে একটা লম্বা সিগারেট খাচ্ছেন। সাদা পুরোহাতা শার্টের আস্তিন গুটোনো, সাদা কালো ছিট ছিট ট্রাউজার্স। স্নাত, পরিচ্ছন্ন, দাড়ি চুল সব সুবিন্যস্ত। তুলনায় অরিত্র তার ঘুম-না-হওয়া লাল চোখে, সামান্য দাড়ির সবুজ গালে ফুটে-ওঠায় কেমন অপরিচ্ছন্ন। আসলে নীলমই তাকে টিপটপ রাখে, নয়ত অরিত্রর আদি অভ্যাস জামা-কাপড় সব কুণ্ডলী পাকিয়ে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলা। অফিস যাবার তাড়া না থাকলেও এখনও তাকে স্নান, দাড়ি-কামানো ইত্যাদির জন্য তাড়া দিতে দিতে নীলমের গলা ধরে যায়।
মহানাম অরিত্রকে নিয়ে ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসলেন। কাগজটা মেলে ধরতে ধরতে খুব অবহেলার সঙ্গে বললেন—‘হ্যাঁ অরি, এষা বলছিল ও প্রিয়লকর নগরে ফিরবে না। তোমাদের নাকি অসুবিধে হচ্ছে ও বুঝতে পারছে। স্পেস কম। আমি বরং ওকে চন্দ্রশেখরের বাড়িতে থাকবার ব্যবস্থা করে দিই।’
অরিত্র চমকে উঠল, ব্যগ্র হয়ে বলল—‘সে কি? আমাদের পুরো প্রোগ্রাম তো ছকা আছে। তা ছাড়া আমার বাড়ি না ফিরলে নীলম সাঙ্ঘাতিক ক্ষুণ্ণ হবে। এটা আপনি ওকে বুঝিয়ে বলুন মহানামদা। চন্দ্রশেখরের তো ব্যাচেলরের বাড়ি, থাকবে কি করে ওখানে?’
‘তাতে কি হয়েছে? এষা ওসব গ্রাহ্য করে বলে মনে হয় না। আর আমিই তো রয়েছি। কোনও অসুবিধে হবে না। চন্দ্রশেখর হ্যাজ এনাফ স্পেস।’
‘না, না, তা হয় না। এষা, এষা,’ অরিত্র তড়াক করে লাফিয়ে উঠে এষার ঘরের দিকে চলে গেল। দরজায় টোকা দিচ্ছে। —ওর চঞ্চলতা দেখে মহানাম মৃদু মৃদু হাসছেন।
এষা দরজা খুলে দাঁড়িয়েছে। অরিত্র মাথা নিচু করে বলল—‘এষা, এবারের মতো আমায় মাপ করো। তুমি অন্য কোথাও চলে গেলে আমি নীলমকে কি কৈফিয়ৎ দেবো বলো তো?’
ঔরঙ্গাবাদ হয়ে পুনে ফিরতে রাত প্রায় নটা বাজল। দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে মহানাম বিদায় নিলেন। কিছুতেই ভেতরে ঢুকলেন না।