Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » পঞ্চম পুরুষ || Bani Basu » Page 14

পঞ্চম পুরুষ || Bani Basu

পাহাড়ের গায়ে থাক কাটা সিঁড়ি। ঠিক উল্টো দিকে রেস্ট হাউস। শান্ত পরিবেশ। গাইড বললেন—‘কয়েক মিনিট আপনারা ছুটি নিয়ে নিজের নিজের ইচ্ছে মতো ঘুরুন, ঠিক দশ মিনিট পরে এইখানে এসে জমায়েত হবেন।’ ইলোরা ছিল কেমন লোকালয়ের সঙ্গে সম্পর্কহীন, দূর, ধ্বংসপ্রাপ্ত নয়, অথচ পরিত্যক্ত। যেন তার মহিমাও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের সঙ্গে তার সম্পর্ক এতো গভীর যে সে একটু দূরে থাকতেই পছন্দ করে। অজন্তা যেন মানব সংসারের আর একটু কাছে এগিয়ে এসেছে। মানুষও তাই সাহস পেয়ে কাছাকাছি রচনা করেছে তার বিশ্রামকুঞ্জ।

গাইড বললেন—‘১৮১৭ খ্রীষ্টাব্দে একজন ইংরেজ সৈনিক অজন্তা পাহাড়ের ওপর শিকার করতে এসে নদীর ওপরে পাহাড়ের গায়ে সারি সারি খিলান আর স্তম্ভ দেখতে পায়। ইন্ধ্যাদ্রি পর্বতমালার ওপারে তাপ্তি বেসিন, এধারে দাক্ষিণাত্যের মালভূমি। ছোট্ট বাগোরা নদী পাহাড়ের মাঝখানের ফাঁক দিয়ে এগিয়ে এসেছে। সাতকুণ্ড জলপ্রপাতের কাছ বরাবর এই নদী একটি অশ্বক্ষুরাকৃতি বাঁক নিয়েছে। এখানেই অজন্তা গুহামালার অবস্থান। সবসুদ্ধ ত্রিশটি গুহা আছে। মাত্র পাঁচটি তার মধ্যে চৈত্য বা উপাসনাগৃহ। বাকি পঁচিশটিই সঙ্ঘারাম বা বিহার। দশম গুহা চৈত্যটি প্রধান। খ্রীষ্টপূর্ব দু’শ বছর থেকে খ্রীষ্ট পরবর্তী দু’শ এই চারশ বছরে একটু একটু করে গড়ে উঠেছে অজন্তা। মাঝখানে কিছু কিছু বছর বাদ দিয়ে আবার সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত চলেছে কাজ। অর্থাৎ ছ সাতশ বছরের পুরাকীর্তি।’

ধাপ গুনে গুনে এগোচ্ছে সীমা, বলল—‘এষাদি, ঠিক একশটা।’ যতই ওপরে যাচ্ছে অরিত্রর কাছ থেকে থেকে বিলীন হয়ে যাচ্ছে জে পি জে, প্রিয়লকরনগর পুনে, নীলম, কাছে চলে আসছে কলেজ স্ট্রীটের মোড়, হাজরা, কর্নওয়ালিস স্ট্রীট, আশুতোষ বিল্ডিং, এষা।

প্রথম গুহামন্দিরের মধ্যে ঢুকে এষা বলল—‘এটাই বোধহয় সর্বশেষ গুহা সময়ের দিক থেকে, না মহানামদা? চালুক্য রাজাদের সময়ে তৈরি বলে শুনেছি।’

আরেকটু ভেতরে ঢুকে ও স্তব্ধ হয়ে গেল। আয়তাকার এই সম্পূর্ণ মসৃণ, হলঘরের মতো গুহা পাহাড়ের ভেতর থেকে কেটে বার করা যায়? কী অদ্ভুত স্থাপত্য? কৈলাস মন্দির বিশাল, রাজকীয়। কিন্তু অজন্তার এই গুহা হল যেন কি অজ্ঞাত কারণে তার থেকেও বিস্ময়কর হয়ে উঠেছে। শীতল, যেন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত।

গাইড আলো ফেলে গর্ভমন্দিরে বুদ্ধমূর্তি দেখাচ্ছেন। সারনাথ মৃগদাবে পদ্মাসনে বুদ্ধ। এক এক দিকে আলো ফেললে মুখ ভাব এক এক রকম। একদিকে হাসিমুখ, অন্যদিকে বিষণ্ণতা, সামনে থেকে ‘এশিয়ার আলো’ ধ্যানমগ্ন।

মহানাম বললেন—‘শিল্পী মুখভাবের এই বৈচিত্র্য ইচ্ছে করে এনেছিলেন কি না জানি না। এনে থাকলে খুবই আশ্চর্য শিল্পী বলতে হবে। কিন্তু কোণার্কের তিন সূর্যমূর্তির মুখের এক্সপ্রেসন অবধারিতভাবে মনে পড়ে যায়। বালার্ক, মধ্যদিনের সূর্য, আর শেষবেলার শ্রান্ত বিষণ্ণ সূর্য—তোমার কি মনে আছে অরিত্র?’

অরিত্র অন্যমনস্কভাবে বলল—‘না। কোণার্কের সূর্যমূর্তি তো দিল্লিতে।’

এষা বলল—‘সে তো গর্ভগৃহের সূর্যদেব। মন্দিরের বাইরে নীল পাথরের মূর্তি আছে, মনে নেই!’

মহানাম বললেন—‘যে রাজকুমার মানুষের ব্যথা বেদনা দেখেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন, সারা-জীবনই তিনি তাঁর সেই প্রথম ব্যথার অনুভব ভুলতে পারবেন না, এমনই বোধহয় ধারণা ছিল ভাস্করের। দুঃখেষু অনুদ্বিগ্নমনা সুখেষু বিগতস্পৃহ উদাসীন সন্ন্যাসীকে শিল্পী মেনে নিতে পারেননি হয়ত। আধ্যাত্মিক শান্তির পাশাপাশি তাই এমনি হাসি-কান্না সিদ্ধশিল্পীর হাত দিয়ে আপনা হতেই বেরিয়ে গেছে।’

মহানামের অনুরোধে গাইড এবার অবলোকিতেশ্বর পদ্মপাণির আলেখ্যর সামনে আলো ধরলেন। ডান হাতে ফোটা পদ্ম, মাথায় মণিমাণিক্যময় রত্নমুকুট, কানে হীরের কুণ্ডল, কণ্ঠ বেষ্টন করে আছে মুক্তার শতনরী। মুক্তা আঁকতে অজন্তা শিল্পীরা খুব পটু। ত্রিভঙ্গ মূর্তিতে দাঁড়িয়ে আছেন অবলোকিতেশ্বর। ভাবাবেশে লীন। অপর দিকে অবলোকিতেশ্বর বজ্ৰপাণি। জরা-মৃত্যু-ব্যাধি অধ্যুষিত মরজগৎ। কি করে স্বার্থপর একক সাধনায় আত্মনিয়োগ করবেন? সমস্ত অলঙ্কার বসনের ঔজ্জ্বল্য, বিলাস-বাহুল্য মিথ্যে, অসার করে দিয়ে জেগে আছে অবলোকিতেশ্বরের ভাব-ব্যঞ্জনার গভীর ধ্যানমগ্ন কারুণ্য।

য়ুনেস্কো অ্যালবামের রঙগুলো বড্ড চড়া। আসলের রঙ আরও অনেক পাকা, অনেক নম্র।

‘প্রিন্টের থেকে অনেক ভালো, তাই না এষাদি?’ সীমা বলল।

‘ঠিক বলেছ, আমিও এক্ষুণি তাই ভাবছিলাম।’

অন্তরালের ছোট্ট ঘরটুকুতে বিরাট প্যানেলে তপস্যারত বুদ্ধ এবং মারের আক্রমণ। সসৈন্য তো বটেই। মারের তিন কন্যাও রয়েছে সঙ্গে।

মহানাম বললেন—‘তপস্যা ভঙ্গ করতে এসে এরাই তো মনে হচ্ছে তপস্যায় বসে যাবে।’

এষা বলল—‘তুলনামূলকভাবে সিদ্ধার্থের তেজ এত বেশি যে মার কন্যারাও তার কুহকে পড়ে গেছে। অভিভূত হয়ে যাচ্ছে এই অর্থেই পরাজিত হচ্ছে বোধহয়।’

বিক্রম বলল—‘এ ছবিগুলো তো একেবারেই লাইফ-লাইক নয়। এমনভাবে শরীরটাকে বাঁকিয়ে চুরিয়েছে যে নাচেও অতটা সম্ভব নয়। এরা সবাই কি ওড়িশি শিখত না কি বলুন তো?’

অরিত্র বলল—‘আর্ট কখনো লাইফ-লাইক হয় না ব্রাদার। এই দ্যাখোনা পুরো ফিগার যেখানে এঁকেছে কোমরের তলা থেকে ভালো করে দৃষ্টিই দেয়নি।’

এগোতে এগোতে বিক্রম বলল—‘আরে। এ যে দেখছি স্বর্গ। অমরাবতীতে খোদ ইন্দ্রের সভা! পুণ্যবানরা স্বর্গে গেলে তাদের এইভাবে সিংহাসনে বসিয়ে অপ্সরারা এনটারটেন করে। বাঃ! মানুষ যাতে এই স্বর্গের লোভেও পুণ্যকর্ম করে তাই শ্ৰমণরা কত কষ্ট করে গুহা-টুহা কেটে কুটে সব এঁকে-জুকে রেখেছেন,’ চোখ টিপে অরিত্রর দিকে তাকিয়ে বিক্রম বলল —‘কি বলেন চৌধুরীদা, এবার আপনাতে আমাতে পুণ্যকর্ম করতে আরম্ভ করব, অ্যাঁ?’

গাইড বললেন—‘এটা একটা জাতক কাহিনী। মহাজনক জাতক। বোধিসত্ত্ব রাজা মহাজনক হয়ে জন্মেছিলেন। এখানে প্রব্রজ্যা-গ্রহণের সংকল্প জানাচ্ছেন রানী সীবালির মুখ তাই এতো বিষণ্ণ! এই দেখুন থেমে গেছে নৃত্য-গীত। পুরাঙ্গনারা জল্পনা-কল্পনা করছেন।’

বিক্রম বলল—‘যাব্‌বাবা।’

কৃষ্ণা রাজকুমারীর চিত্রের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে এষা। এই সে-ই। যাকে সে স্বপ্ন দেখেছিল। বার বার তিনবার। য়ুনেসকোর অ্যালবাম দেখে। ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। নমিত চোখ। কোথা থেকে এই অতলান্ত বিষাদের ঠিকানা পেলেন শ্ৰমণ শিল্পী! অবলোকিতেশ্বরের বিষাদ আর এ ব্যথা তো এক জাতের নয়! —‘দেখো অরি, কি অলৌকিক বিষাদ! সমস্ত গুহাটাই যেন ছেয়ে গেছে এই বিষাদে’—এষা কেমন ব্যাকুল হয়ে বলল, ‘ওই সীবালি, এখানে মারকন্যা, নাগরানী সুমনা, এই রাজকুমারী সবাইকার মুখের আদল ভিন্ন ভিন্ন হলে কি হবে। একটা জায়গায় এসে এঁরা সবাই এক। দোসরহীন। জগতের যাঁরা শ্রেষ্ঠ পুরুষ, সমস্ত জগতের দুঃখ একটি নারীর ওপর চাপিয়ে তাঁরা সন্ন্যাস গ্রহণ করছেন।’

সীমা বলল—‘আমি তোমাকে বললুম এষাদি, একজনের দুঃখ না হলে আরেকজন আনন্দে পৌঁছতে পারে না। তুমি কি বলছ এই কৃষ্ণা রাজকুমারীও যশোধরাই।’

এষা বলল—‘খুব ভালো আইডিয়া সীমা। হতে পারে। ওদিকে যখন মার আক্রান্ত, সিদ্ধার্থ বুদ্ধত্ব লাভ করছেন মহাসমারোহে তখন সেই ছবির দিকে তাকিয়ে কোনও একজন শিল্পীর হয়তো মনে পড়ে গিয়েছিল—কপিলাবস্তুর নিরানন্দ প্রাসাদে দুঃখিনী রাজবধূকে। এ-ও হতে পারে সীমা এই সমস্ত জাতক কাহিনী ও বুদ্ধ চরিতের মধ্যে যে বঞ্চিত দুঃখিনী নারীর চরিত্রটি সর্বত্র দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, তাঁকেই সাধারণভাবে রূপক হিসেবে এখানে এঁকেছেন শিল্পী। এটা একটা প্রতীকী নারীমূর্তি, ওপন সিমবল। তোমার যেমন খুশি ব্যাখ্যা দিতে পারো এর।’

মহানাম পেছনে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন। বললেন—‘নীলা, তুমি কিছু বলবে না?

নীলমের চোখ ছলছল করছে, বলল—‘কি বলব, আমার খালি মনে হচ্ছে, এ এক হতভাগিনী নারী যে অনেক পেয়েও কিছুই পায়নি, অনেক পাওয়া যার মিথ্যা, ব্যর্থ হয়ে গেছে এক বিশাল না-পাওয়ায়।’

অরিত্র হেসে বলল—‘আমার ধারণা ছিল এককালে কবিতা-টবিতা লিখতুম, কাজেই দলের মধ্যে আমিই একমাত্র কবি। অজন্তার শিল্পীদের আমিই বোধহয় ঠিকঠাক বুঝতে পারছি। এখন দেখছি আমার এ ধারণা সর্বৈব ভুল। আমি নয়, এই তিনটে মেয়েতে মিলে এখানে আসল কবি।’

মহানাম ভাবুক গলায় বললেন—‘সপ্তম শতাব্দীর আলেখ্যের মধ্যে বিংশ শতাব্দীর তিন রমণী জীবনসত্য দেখতে পাচ্ছে। শিল্পীর সাফল্য কী বিরাট তার পরিমাপ করতে পারছো? আজ তিনি থাকলে কী করতেন বলো তো!’

“‘কেয়াবাত্ কেয়াবাত্‌’ বলে উঠতেন নিশ্চয়ই”—বিক্রম বলল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress