পঞ্চম পুরুষ (Pancham Purus) : 13
পিকুকে চিঠি লেখা শেষ করে এষা স্নান করতে চলে গেল। চার দুগুনে আট পাতার চিঠি। খুব সম্ভব পিকু অনেক দিন আগেই আশা করেছিল চিঠি। কিন্তু পুনেয় পৌঁছে একটা টেলিগ্রাম করে দেওয়া ছাড়া আর কোনও যোগাযোগ করেনি সে। পুনেয় সে জীবনের যে পর্বের সঙ্গে পুনর্যুক্ত হয়েছে পিকুর সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। আমার বন্ধু, বন্ধুর স্ত্রী খুব যত্ন করছে, ওদের মেয়েটিকে আমার খুব ভালো লেগেছে—এই রকম গোছের একটা না-রাম না-গঙ্গা চিঠি লেখা যেত, পিকুর তাতে মন ভরতো না। অথচ প্রিয়লকরনগর তার মনের মধ্যে কিভাবে পেঁয়াজের খোসা ছাড়িয়েছে, কিভাবে সেই ক’দিনের মধ্যে স্মৃতি-বিষাদ উপভোগ-জটিলতা-জট ছাড়ানোর নাটক ঘটে গেছে, কত পুরনো চেনা মানুষের সঙ্গে আবার দেখা হওয়ার আনন্দ ভয় এসব চিঠি লিখতে গেলে এসে পড়বেই। তার চেয়ে আজকের অভিজ্ঞতা অনেক নৈর্ব্যক্তিক। তাই আজ লিখতে বাধা নেই। ক্লান্তিও যে কত উপভোগ্য হতে পারে সেটা স্নান করতে করতেই বোঝা যাচ্ছে। বিবি কি মকবারা, ঔরংজীবের কবর, প্রত্যেকটা জায়গায় নেমে নেমে, ঘুরে ঘুরে পিকুর জন্য দৃশ্য ও তথ্য সংগ্রহ করতে হয়েছে। রেস্ট হাউসে ফিরল রোদে ঝলসা-পোড়া আধ ডজন উস্কো-খুশকো চুলো মানুষ। সারা সন্ধ্যে বিক্রম সীমা গান শুনিয়েছে, ওদের এনার্জি অফুরন্ত। ক্লান্তিটা যেন অঙ্গে অঙ্গে এলিয়ে আছে এখন, আলসে বিলাসে।
খুব সুন্দর সাবান আর ট্যালকামের ভুরভুরে গন্ধে ঘর ভরে দিয়ে এষা ঘরে ঢুকল। গোলাপি রাত পোশাকে নাইলন-ডলের মতো সীমা শুয়ে শুয়ে মুখের ক্রিম তুলছে। নীলম উপুড় হয়ে পিঠে হাওয়া লাগাচ্ছে। সাদা সাদা ফ্রিলগুলো ওর মাথার চারপাশে উড়ছে ফ্যানের হাওয়ায়। দৃশ্যটা এক নজর দেখে এষা চুল আঁচড়াতে লাগল। বিশ্রামের দৃশ্য দেখলেও যেন শরীর বিশ্রাম পায়।
সীমা উঠে বসে হঠাৎ বলল— ‘এষাদি, আপনি বিয়ে করেন নি কেন?’
এষা চুলটাকে বিনুনি করতে করতে বলল—‘এই হয়ে ওঠেনি আর কি!’
সীমা বলল— ‘আপনাদের মতো মেয়েদের কিন্তু বিয়ে-টিয়ে না করে থাকা উচিত নয়।’
এষা হেসে বলল— ‘কেন বলো তো? তুমি লেজ কেটেছ বলে সব শেয়ালেরই লেজ কাটতে চাইছ?’
সীমা বলল— ‘তা নয়। মেল ডমিনেটেড পৃথিবীতে নিজেকে রক্ষা করবেন কি করে?’
‘করছি তো। করলাম তো এতদিন!’
‘কি জানেন’, সীমা বলল— ‘লোভনীয় বস্তু বেওয়ারিশ পড়ে থাকলেই লোকে মনে করে সম্পত্তিটা জনগণের।’
এষা ঈষৎ গম্ভীর হয়ে গেল, বলল— ‘সীমা, তুমি কি নিজেকে বস্তু বলে ভাবো? সম্পত্তি বলে ভাবো? এখনও?’
‘আমি নিজে না ভাবলে কি হবে এষাদি, লোকের ভাবনা তো তাতে আটকায় না।’ বিষণ্ণ সুরে এষা বলল, ‘আমি যে নিজেকে সেভাবে ভাবতে পারি না, তাই লোকে মনে মনে কি ভাবছে সেটাও আদৌ আমার ভাবনার বিষয় হয় না, তোমার মনে আসছে জেনেও আমি ভীষণ মর্মাহত বোধ করছি। সীমা তুমি নিজেকে এবং আমাকে বস্তু বলে ভেবো না, লক্ষ্মীটি!’
সীমা বলল, ‘কি করব বলুন! আমাদের সমাজের পুরুষরা যে তাই ভাবে। রক্ষা করার দায়িত্বটা নিতে হয় বলেই বোধহয় ভাবে।’
‘হয়ত পুরুষরা ভাবে না সীমা, আমরাই তাদের ভাবতে বাধ্য করি। কারও ওপরেই কখনও খুব বেশি নির্ভর করতে নেই। পুলিশ এবং মিলিটারি ধরো আমাদের সবার রক্ষার দায়িত্বে আছে। তাই বলে কি জনসাধারণকে তারা বস্তু ভাবে, নিজেদের সম্পত্তি ভাবে? শ্ৰম ভাগ তো সমাজে থাকবেই, যার যার সামর্থ্যানুযায়ী। তোমার ওপরেও যাতে কেউ কেউ নির্ভর করতে পারে, এমনভাবে নিজেকে তৈরি করতে পারো না?’
‘আমার ওপর যার নির্ভর করার কথা সেই টিটো তো দেরাদুনে অন্য লোকের ওপর নির্ভর করতে শিখছে এষাদি। আর টিটোর বাবা? সে সম্পূর্ণ স্বাধীন।’
‘টিটোর বাবা স্বাধীন হলে কিন্তু তোমারও স্বাধীন হবার কথা, তোমার ওপর নির্ভর করে তিনি তোমাকে বন্দী করছেন না। তাহলে তোমার স্বাধীন হতে বাধা কোথায়?’
সীমা হাসতে লাগল—‘আপনি জানেন না এষাদি, এক এক জনের স্বাধীনতা অন্যের পরাধীনতার ওপর ভিত্তি করেই তৈরি হয়।’
এষা বলল— ‘না সীমা, আমি কিন্তু লক্ষ্য করেছি নিজেকে স্বামীর বা অন্য কোনও পুরুষের মুখাপেক্ষী ভাবতে মেয়েরা এক ধরনের গৌরব বোধ করে। ‘ওকে জিজ্ঞেস করে দেখি, ওর মত নেই, ও এই বলছিল’, এ রকম তুমি প্রায়ই এমন মেয়েদের বলতে শুনবে যারা উচ্চশিক্ষিত, অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বাধীন। এটার মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা কি আমি জানি না, তোমারও মনে হয় নিজেকে স্বামীর সম্পত্তি ভাবতে গর্ব হয়, আমার মতো স্বাধীন মেয়েদের থেকে নিজেকে অনেক উঁচুদরের মনে হয়, তাই না?’
‘এষাদি, আপনি আমার ওপর রাগ করলেন?’
নীলম এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল, বলল—, “বেওয়ারিশ’ ‘জনগণের সম্পত্তি’ কথাগুলো কিন্তু মোটেই সম্মানজনক নয় সীমা। তুমি এগুলো কেন ব্যবহার করলে আমি জানি না।’
এষা তাড়াতাড়ি বলল— ‘নীলম, সীমা ঠিক সেভাবে বলেনি, আমি ওর পয়েন্টটা বুঝতে পেরেছি। আমি কিন্তু রাগ করিনি। একটু বোধহয় উত্তেজিত হয়েছি শুধু। তবে আমার অভিজ্ঞতায় মেয়েরা অতি জটিল চরিত্র। তারা জানে না, তারা কি চায়। সমস্ত জিনিসের প্রতিই তাদের দ্বিধাগ্রস্ত মনোভাব। একই সঙ্গে চাওয়া ও না চাওয়া। এমন কেন হয় তা জানি না।’
নীলম উঠে বসে বলল— ‘এষা, তুমি একেবারে ঠিক বলেছ। একই সঙ্গে চাওয়া এবং না চাওয়া। কেন? কেন আমরা এমন সৃষ্টিছাড়া হলুম?’
সীমা বলল—‘এষাদি, আপনিও তাহলে এই একই সঙ্গে চাওয়া এবং না চাওয়ার রোগে ভোগেন? যদি এটা মেয়েদের সাধারণ চরিত্র লক্ষণ হয়!’
এষা বলল— ‘না সীমা। আমি ওই রোগে ভুগি না। আমি বোধহয় পুরোপুরি মেয়েও নই তাহলে। যা চাই তা কক্ষণো ভুল করে চাই না। কোনও সঙ্গত ইচ্ছে হলে যেমন এবার অজন্তা-দেখার প্রচণ্ড ইচ্ছে হয়েছিল, সেটাকে সম্ভব করতে যা করার সমস্ত করেছি, এখন মোটেই মনে হচ্ছে না, চাইনি, ভুল করেছি। তবে আমি আরেকটা রোগে ভুগি, সেটাকে রোগ বলবে কিনা অবশ্য তুমি ভেবে দ্যাখো, সেটা হল একই সঙ্গে পাওয়া এবং না পাওয়া।’
‘সেটা আবার কি?’ সীমা কৌতূহলী হয়ে বলল।
নীলম বলল—‘তুমি ছেলেমানুষ, বুঝবে না ওসব।’
সীমা কেমন ছোট্ট গলায় বলল— ‘না নীলমদি, তের বছরের ছেলে আমার, পনের বছর বিয়ে হয়েছে। একই সঙ্গে পাওয়া আর না পাওয়া কি জিনিস ভালো করেই বুঝি। আমারটা বুঝি। অন্যেরটা কি রকম, অর্থাৎ এষাদিরটা কি রকম, তোমারটা কি রকম বুঝতে চাইছিলুম শুধু।’
ঝিঁঝি ডাকতে শুরু করেছে বাইরে। লনের বড় আলোটা নিবে গেলো, মৃদু আলো জ্বলছে। রাত হতে যেন শান্তি। এ জায়গায় দিনের আলো মরতেই চায় না। জানলা দিয়ে ঘুমন্ত বাসগুলো দেখা যাচ্ছে দূরে। কাল সকালে আবার আড়মোড়া ভেঙে সচল হবে। কি নিবিড় বিশ্রাম ওদের। অথচ অরিত্রর যতবার চোখ বুজছে কতগুলো বিশ্রী দৃশ্য সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। নীলম সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হলে সে পরিপূর্ণ এষার দিকে ফিরতে পারে। কিন্তু নীলম তাকে সেই নিশ্চিন্ততা দিচ্ছে না। সে বিক্রমকে ডেকে এনেছে, মহানাম কোন সুদূর অতীত থেকে ভেসে উঠেছেন। মহানামকে সে জানিয়ে দিয়েছে যে সে তাঁর সন্তানের জননী। মহানাম ব্যাপারটা জানতেনই না। মহানামকে সে নিমন্ত্রণ করে খাইয়েছে। এবং এই ভ্রমণে তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে প্রধানত সেই-ই। মহানাম আসছিলেনই। কিন্তু তাঁকে এইভাবে অরিত্রর সঙ্গে, এষার সঙ্গে ভিড়িয়ে দেওয়া এটা নীলমের একটা কূট চাল। বড়ের চালে মাত হয়ে যেতে বসেছে যেন অরিত্র চৌধুরী। এক দিক থেকে পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে বিক্রম শীল, আর এক দিকে মহানাম রায়। নীলম নিজে অন্ধ বিচারদেবীর নির্ভুল নিক্তি হাতে নিয়ে তার সমস্ত কীর্তি-অকীর্তি তৌল করবার ইচ্ছায় তৃতীয় দিকে দাঁড়িয়ে। অথচ রক্তে কোন বিস্মৃত নদীর কলরোল। এষা যেন কোণার্কের সূর্য মন্দিরের সেই কিংবদন্তীর চুম্বক। অরিত্র পর্তুগীজ জাহাজ। গোটা যেতে না পারে তার শরীরের সমস্ত লোহা টুকরো টুকরো হয়ে এষার তটে গিয়ে আছড়ে পড়বে।
মহানাম চোখ বুজে শবাসন করছিলেন। রোজ সন্ধ্যায় ব্যায়াম করার অভ্যাস। আজ সারাদিন এতো ঘোরাঘুরি হয়েছে যে ব্যায়াম করতে আর ইচ্ছে হয়নি। সন্ধ্যেবেলায় বেশ ভালো গানের আসর বসেছিল। শবাসনে শুয়ে যতবার হাত পায়ের খিল খুলে দিয়ে নির্গ্রন্থে ডুব দিতে চাইছেন ততবার চোখের সামনে অস্পষ্টভাবে এসে দাঁড়াচ্ছেন শবাসনা। একি অদ্ভুত বিভ্রম। দেখে এলেন পার্বতীর গৌরীরূপ, অথচ সেই টাটকা স্মৃতি অনায়াসেই ছাপিয়ে উঠছে একি কোনও তান্ত্রিকের সংস্কার তাঁর রক্তে? শবাসনার সেই বিপুল কৃষ্ণতা আস্তে আস্তে ছেয়ে ফেলছে তাঁর মনোলোক। দৈবী তন্দ্রা তাঁর মন হরণ করে নিচ্ছে। মন যদি লয় পেয়ে যায় তাহলে কি দিয়ে বইয়ের পাতা ভরবেন মহানাম? মহানাম প্রাণপণে লড়াই করতে লাগলেন। বিবেকী মনঃশক্তিকে জাগিয়ে রাখতেই হবে। শূন্যতার আনন্দে, কৃষ্ণতার আনন্দে মজবার ইচ্ছে তাঁর এখন নেই। তাঁর ইচ্ছা আস্তে আস্তে সচেতন তন্দ্রার ভূমিতে তাঁকে রেখে চলে গেল। মহানাম গভীর এক নিশ্বাস ফেললেন।
হঠাৎ খুব ছোট্ট একটা শব্দ হল। মহানাম ইচ্ছাঘুম থেকে ইচ্ছাজাগরণে চলে এলেন। দেখলেন দরজাটা আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সচকিত হয়ে তিনি দেখলেন তাঁর পাশের এবং মাথার দিকের দুটো খাটই শূন্য। দুই সঙ্গীর এক জনও ঘরে নেই। ঘরে যথেষ্ট টাকাকড়ি। বিদেশ বিভূঁই। নিশুত রাত। মহানাম উঠে বসলেন। দরজা ভেজানো থাক। কিন্তু তিনি জেগে থাকবেন যতক্ষণ না এরা ফিরে এসে দরজা বন্ধ করে। বাঁদিকে দুটো বড় বড় জানলা। হঠাৎ মহানাম দেখলেন লনের মৃদু আলোর মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে বিক্রম। কিছুটা ব্যবধানে আস্তে আস্তে হাঁটছে অরিত্র। ওদের কি ঘুম আসছে না, বাইরে পায়চারী করতে গেছে। এই গভীর রাতে! ভুতুড়ে আলোয় ওদের দেখাচ্ছে বন্যপ্রাণীর মতো, বিক্রমকে তার দশাসই স্থূল চেহারার জন্য আর অরিত্রকে তার কেমন সতর্ক বেড়ালের মতো চলাফেরার জন্য। মহানাম আশ্চর্য হয়ে দেখলেন বিক্রম রাস্তা ছাড়িয়ে তাঁদের ঘরগুলোর দিকে এগিয়ে আসছে। পাশের ঘরে তিন মহিলা, সেই ঘরের বিশালাকৃতি জানলা বরাবর সে দাঁড়িয়ে আছে, হঠাৎ দেখলে ভয় হয় বুঝি জঙ্গল-টঙ্গল, কোনও গরিলা-জাতীয় মানবেতর প্রাণী। মহানাম জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়ালেন, একটু কেশে উঠলেন, সঙ্গে সঙ্গে বিক্রম পাশ ফিরে তাকাল, অরিত্রর সঙ্গে প্রায় মুখোমুখি হয়ে গেল।
চাপা ক্রুদ্ধ গলায় অরিত্র বলল— ‘কি করছ?’
‘আপনিই বা কি করছেন?’ —তেরিয়া ভঙ্গিতে বিক্ৰম বলল।
‘জানতে চাও কি করছি? তোমাকে হাতেনাতে ধরব বলে দাঁড়িয়ে আছি।’
‘চুরি করেছি নাকি আমি!’
‘পারলে করো!’
‘সাবধান চৌধুরীদা। অপমানের একটা সীমা আছে, এতো বাড়ালে সহ্য করব না, হাতাহাতি হয়ে যাবে।”
মহানামের হঠাৎ হাসি পেল। অরিত্রর সঙ্গে সবাই ডুয়েল লড়তে চাইছে। অরিত্র বীরপুরুষ হয়েই জন্মেছে। অন্য পুরুষের সঙ্গে তার সব সময়ে দ্বৈরথ। সম্মুখসমরে ছাড়া বোঝাপড়া হয় না। এই বিক্রমশীলটি আবার কি ধরনের পুরুষ কে জানে? অরিত্র যদি পৌরাণিক, ও বোধহয় তবে প্রাগৈতিহাসিক।
তিনি জানলা থেকে বললেন —‘কি ব্যাপার অরিত্র? বিক্রম?’
দু-জনেই জানলার দিকে চমকে ফিরে তাকাল। পাশের ঘরের জানলায়ও বোধহয় কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। জানলা বন্ধ হবার মৃদু শব্দ হল একটা। অরিত্র বড় বড় পা ফেলে ফিরতে লাগল। বিক্রম উল্টোদিকে চলে গেল। অরিত্র ঘরে ঢুকল, মহানাম শুয়ে পড়েছেন, অরিত্রর উত্তেজিত নিশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনলেন, সে চাপা গলায় আত্মগত বলল— ‘স্টুপিড, স্কাউন্ড্রেল!’ মিনিট দশেক পরে বিক্রম ঢুকল। দরজার ছিটকিনিটা তুলে দিয়ে শব্দ করে শুলো। খাটটা মচ্মচ্ করে উঠেছে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই তার নাক-ডাকার শব্দ শুনলেন মহানাম।
সকালে মেয়েরা রেড়ি হয়ে খাবার ঘরে একত্র হলে অরিত্র বলল— ‘আজ আমরা বাসে যাচ্ছি। চারটে সীট বুক করে এসেছি। অত ঠাসাঠাসি ভালো লাগে না।’
বিক্রম বলল— ‘কোই-ই বাত নেই।’
সীমা বলল— ‘ইস্স্ আমাকে একা-একা তোমার সঙ্গে গাড়িতে যেতে হবে।’
‘যাও না তুমি বাসে, কে বারণ করেছে? একা একা ড্রাইভ করতে আমার দারুণ লাগে।’
সীমা বলল, —‘হ্যাঁ আমি বাসে যাই। আর তুমি একটা অ্যাকসিডেন্ট করো।
‘রাস্তায় কটা গাড়ি যে অ্যাকসিডেন্ট হবে? টুরিজ্ম্-এর বাসটার পেছনে অবশ্য ভিড়িয়ে দিতে পারি। আহ! ফাঁকা রাস্তায় যা হাঁকাব না?’ গাড়ি হাঁকাবার মধ্যেও যে একটা প্রচণ্ড জৈব উল্লাস আছে, বিক্রমের চোখমুখ সেটাই ব্যক্ত করল। মোট কথা উল্লাসের কোনও না কোনও মাধ্যম সে খুঁজে নেবেই।
সীমা বলল— ‘কার-রেসগুলো দেখেছো? এক একটা গাড়ি কি রকম উল্টে যায়! দাউ দাউ আগুন। ভেতর থেকে বেগুন পোড়ার মতো ড্রাইভারকে টেনে বার করতে হয়! সুদ্ধু এই কারণেই আজ আমি তোমার গাড়িতে যাবো। এবং মাঝে মাঝেই তুমি আমার হাতে স্টিয়ারিং ছাড়বে।’ বিক্রমের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সীমা ঘরের অপর প্রান্তে চলে গেল। বলল, ‘অরিদা কেন বাসে সীট বুক করলেন আমি জানি। কালকে তোমাদের মধ্যে কথা কাটাকাটিটা কি নিয়ে হচ্ছিল? বেড়াতে এসে কি লড়াই না করলেই নয়?’
বিক্রম চোখ মটকে বলল— ‘চৌধুরীকে কালকে আচ্ছা করে খেপিয়েছি। চটে একেবারে বোম। এমনিতেই তো লোকটার মনটা নোংরা!’
সীমা গম্ভীর হয়ে বলল— ‘তুমি কি জানলার ভেতরে হাত বাড়িয়ে কাউকে টেনে বার করতে পারতে কাপড়ের পুতুলের মতো?’
বিক্রম হা হা করে হেসে উঠল— ‘টেনে বার করতে হবে কেন? তোমাকে ডাকলে তুমি চলে আসতে না? অমন চমৎকার ছমছমে রাত একা-একা ভালো লাগে?’
সীমা বলল— ‘ওইটা তোমার মস্ত ভুল ধারণা। আমাকে যখন তখন ডাকলেই আমি চলে আসব এ রকম আর ভেবো না।’
বিক্রম নিজের ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটা ঢাকতে তাড়াতাড়ি একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল— ‘আচ্ছা আচ্ছা নাও নাও। অনেক বাজে বকেছ। এবার চলো।’
একদম সামনের সারিতে জায়গা হয়েছে মহানাম ও নীলমের। পেছনে আর পাঁচটা সারি পরে অরিত্র এষাকে নিয়ে বসল। সীটগুলোর পেছন অনেকটাই তোলা। মহানাম অস্বাভাবিক লম্বা। শুধু পায়ের জন্য অনেক সময়ে মানুষে মানুষে দৈর্ঘ্যের তফাত হয়। কিন্তু মহানামের কোমর থেকে মাথা পর্যন্তও অন্যদের চেয়ে লম্বা। এবং সেই কারণেই ফিকে নীল কলার এবং তার ওপর চুলের ঢেউ ভর্তি মাথা পুরোটাই দেখা যাচ্ছে। একটু পাশ ফিরলেই স্পষ্ট হচ্ছে নাক, চোখের টান এবং দাড়ির রেখা। নীলম একদম ডুবে গেছে। তবু অরিত্র আজ নিশ্চিন্ত। নীলমের পাশে বিক্রম নেই। নীলমকে কোলে তুলে কৈলাস মন্দিরের রোয়াকে তুলে দিচ্ছে বিক্রম এই কুৎসিত দৃশ্যটার আর পুনরাবৃত্তি হবে না। অবশ্য নীলমের পাশটা মহানামকে ছেড়ে দিতে হয়েছে। কিন্তু মহানাম বিক্রম নয়। মহানামের পাশে বসে নীলম তার পুরনো কলেজী রোমাঞ্চের কিছু ফিরে পেলে পাক। অরিত্র এষার পাশে বসতে পেরেছে। অরিত্র এষার পাশে। অরিত্র এষা।
—ঘুরে-ফিরে, চোখের কোণ দিয়ে কটাক্ষে, সোজাসুজি নানাভাবে অরিত্র তার প্রিয়তম দৃশ্য এষাকে দেখছে। গলায় চিকচিকে হার, কানের পেছনে দু চার গাছি চুল কেমন গুটিয়ে ছোট্ট ছোট্ট হয়ে রয়েছে। নীল শাড়ি তার কপালে ছায়া ফেলেছে। অন্য দিনের থেকেও কালো লাগছে এষাকে। গতকালের রোদটাও তো সমস্তই মাথার ওপর দিয়ে গেছে। এই কালো কী প্রাণভরা, মন-ভরা। ম ম করছে কালোর আভায় গোটা বাসটা, অরিত্রর চিত্ত।
এষা বলল— ‘ওগুলো কি গাছ? বলো তো অরি। দৌলতাবাদ ফোর্টের ওদিকেও দেখেছিলুম!’
‘কোনগুলো? ওঃ। ওগুলো তো শিমূল।’
‘ওই রকম চকচকে রুপোলি গা? রোদ পড়ে কি রকম দেখাচ্ছে দেখো! একদম রুপোর গাছ বলে মনে হচ্ছে। শুধু ডালপালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফুলটুল নেই। কী অপরূপ। দ্যাখো দ্যাখো কী অজস্র! এ যেন আলোর গাছ! স্বর্গের বাগানে।’
‘মহারাষ্ট্রে তুলোর চাষ হয় জানো না? কি আশ্চর্য!’
‘ও এই বুঝি সেই তুলো? কালো মাটি এমনি আলোর জন্ম দেয়? অরি জানো, আমি ট্রেনে আসতে আসতে শুকনো নদীর খাতে পাথরের তৈরি হাতির পাল দেখে এসেছি। তোমাকে যদি দেখাতে পারতাম! একেবারে জাতকের গল্প। ছোট বড় মাঝারি নানান সাইজের হাতি!’
‘আমাকে দেখাতে চেয়েছিলে এষা! সত্যি করে বলো চেয়েছিলে দেখাতে!’
‘কাউকে একটা দেখাতে চাইছিলুম। ভাগ করে না নিলে কি দেখার আনন্দ পূর্ণ হয়?’
‘এষা, তুমি বড় নিষ্ঠুর। মিথ্যে করেও কি বলা যেত না আমাকেই দেখাতে চেয়েছিলে!’
‘বাঃ, মিথ্যে বুঝতে পারলে তোমার খারাপ লাগত না?’ এষা হেসে বলল, মুখ ফিরিয়ে তাকাল। অরিত্রকে এখানে কল্যাণ স্টেশনে দেখবার আগে সে তার কোনও স্পষ্ট অনুভূতি তার সম্পর্কে আদৌ ছিল না, এ কথা বললে অরিত্র তাকে আরও কত নিষ্ঠুর ভাববে?
‘এষা, তুমি আমার কাছে এসেছ, আমাকে দেখবার জন্য, দেখা দেবার জন্য, কাছে পাবার জন্য—একথা একবার বলো। অন্তত একবার!’
এষা বলল—‘অনেস্টলি অরি, আমি অজন্তা দেখতে এসেছি, অজন্তা আমাকে বেশ কিছুদিন ধরে যে কি টানা টানছে আমি তোমাকে বোঝাতে পারবো না। জীবনের কাছে প্রার্থনা আমার যেন সিসটিন চ্যাপেল দেখা হয়!’
অরিত্র গভীর বিষাদে বলল—‘তবু বললে না। মিথ্যা করেও বললে না আমার কাছে এসেছ। অজন্তার টান কি মানুষের টানের চেয়ে বেশি হতে পারে!’
এষা বলল—‘অরি, তুমি যে বলছিলে কবিরা কখনও পুরোপুরি মরে না। অজন্তার টান তুমি কবি হয়ে যদি বুঝতে না পারো, আমি আর কাকে বোঝাবো?’
এষার একটা হাত মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরে অরি বলল—‘নাই বলো কোনও মোহন মিথ্যা। অথবা গোপন সত্য। আমি যে অন্তত অজন্তার প্রসঙ্গেও তোমার মনে এসেছি এর থেকেও কি কিছু প্রমাণ হয় না?’
‘কি প্রমাণ হয়?’ এষা হাসছে।
‘প্রমাণ হয়—“চাই চাই আজও চাই তোমারে কেবলি
জনশূন্যতার কানে রুদ্ধ কণ্ঠে বলি, আজও বলি
অভাবে তোমার
অসহ্য অধুনা মোর, ভবিষ্যৎ বন্ধ অন্ধকার
অনন্ত ক্ষতির সংজ্ঞা জপে তব পরাক্রান্ত নাম—
নাম—শুধু নাম—শুধু নাম।”
এষা বলল—‘তোমাকে চাওয়া আমার সম্পূর্ণ নিঃশেষ না হলে আমি আসতামই না অরি। আসতে পারতামই না। তোমাকে চাইলে অপমান, প্রত্যাখ্যান, ব্যবহৃত হবার বেদনা এসব টাটকা ক্ষতের মতো দগদগে থাকতো। এসবের খুব স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছে। তোমাকে আমি সম্পূর্ণ নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পারছি।’
এষা প্রত্যেকটি কথা বলছে আর অরিত্রর বুকে ত্রিশূল বিঁধছে। বলল—‘এষা, প্রেষা, কি ভাবে তোমার কাছে ক্ষমা চাইব। কিভাবে। এষা, আমাকে মাপ করো।’
‘কি আশ্চর্য, সে তো অনেক দিন আগেই করা হয়ে গেছে অরিত্র! আমি যে বললুম একেবারে ভস্ম হয়ে তারা আকাশে ছড়িয়ে গেছে। ওইসব তীব্র অভিজ্ঞতা পেরিয়ে আসতে পেরেছি বলেই তো আমি আমি। আমার মনের জমিতে ওইসব স্মৃতির ভস্ম পড়েছে, নিশ্চয় তাকে উর্বর করেছে। আমি আনন্দিত যে ওই ব্যাপারটা ঘটেছিল, এবং চুকেও গিয়েছিল। এবং তারপর আমি তোমাকে অবলম্বন করে এখন অজন্তা যেতে পারছি নীলমকে সঙ্গে নিয়ে। অরি আমি, আমি অভিজ্ঞতার জন্য ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত, একেক সময় মনে হয় যদি আমার একশটা শরীর একশটা মন থাকত⋯’
‘তাহলে? তাহলেও কি তার একটা আমাকে দিতে না?’
‘জীবনকে গন্ডূষে গন্ডূষে পান করতে হয় যে অরিত্র, এত সময় লাগে! এতগুলো মন। বোধহয় জন্মের পর জন্ম একটা অভিজ্ঞতাকেই উল্টে-পাল্টে দেখতে কেটে যায়। উদ্বৃত্ত তো কখনও থাকে না। সব সময়েই যেন কম পড়ে যায়।’
‘এতো নিষ্ঠুর তুমি হতে পারলে এষা? শত শত জন্মের, শত শত শরীর মনের একটাকেও তুমি আমায় দিতে রাজি নও? না হয় আমি একটা ভুল, একটা অন্যায় করেই ফেলেছি!’
‘অরি, শোনো, ভুল কিছু তুমি করোনি। অন্যায় করেছ ঠিকই। গোটা জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে সে অন্যায়ের গুরুত্ব এমন কিছু নয়। আমাকে তো চিরকালের মতো ক্ষতিগ্রস্ত করোনি। বরং, বরং তোমার নির্বাচন ঠিকই হয়েছে। নীলমই সেই মেয়ে যে তোমাকে বাউণ্ডুলে থেকে এমন আদর্শ, সফল গৃহী করতে পেরেছে। ও-ই তোমার সঠিক জীবনসঙ্গী।’
‘আমার বাইরেটা বদলে গেছে। আমি সুখে আছি ঠিকই। কিন্তু এই ধরনের ঘরপোষা সুখই কি মানুষের চরম কাম্য হতে পারে। এষা তুমি সেই প্রেষণা যে আমাকে আমার নিজের কক্ষ পথে ঠিকঠাক ঠেলে দিতে পারত।’
এষা হেসে বলল—‘কিছু মনে করো নি অরি। কয়েকটা কবিতা লেখা না হলেও মানুষের খুব একটা এসে যাবে না, কিন্তু শান্তি, পিতা-মাতা-সন্তানের সুন্দর সফল ইউনিট যতই বাড়ে সমাজের পক্ষে তো ততই মঙ্গল। আর তাছাড়া দেখো, তুমি নীলমকে চেয়ে আমাকে ছাড়লে, নীলমকে পেয়ে আবার আমাকে চাইছ, আমাকে পেয়ে গেলে নিশ্চয় আর কাউকে চাইবে। তোমার মোটামুটি এই রকমই স্বভাব!’
‘বেশ তো, তোমাকে পেয়ে গেলে যদি আমি রাহুমুক্ত হই তো, তুমিও তো এরকম মুক্তি পাবে। পাবে না? যদিও তুমি আমাকে মোটেই ঠিক বিশ্লেষণ করোনি, তবু তোমার দৃষ্টি থেকেই বলছি।’
‘অরি, বারবার একই ভুল করছ কেন? তাছাড়া একটা ধারণা তোমার একদম ভ্রান্ত। তুমি মনে করছ নীলম শুধুই ঘরণী গৃহিণী, তার মধ্যে তুমি যাকে প্রেষণা বলছ তার কিছুই নেই, এটা ঠিক নয়। নীলমকে আসলে তুমি পুরোপুরি পাওনি। সেই না পাওয়ার কথাটা তুমি জানোই না।’
‘তুমি বলছ মহানামকেও এখনও মনে মনে⋯’
‘না, না’—এষা হেসে ফেলল, ‘আমি ওসব বলছি না সত্যি অরি, তুমি কমার্শিয়াল ফার্মে কাজ করে করে খুবই স্থূল হয়ে গেছো। তোমার মধ্যে ত্রিলোকেশ গৌরবকে সত্যিই আর একটুও খুঁজে পাচ্ছি না।’
নীলম বলল—‘মহানামদা, তুমি এবার জানলার ধারে বসো। তুমি দেখতে এসেছো।’
‘কেন? তুমি দেখতে আসোনি?’
‘এসেছি, তবে নিসর্গ নয়।’
‘শিল্পকলা দেখবে বলে নিসর্গ দেখবে না এমন প্রতিজ্ঞা করেছো কেন?’
‘নিসর্গের থেকেও কৌতূহলোদ্দীপক অনেক কিছু আছে এ যাত্রায়।’ নীলম উজ্জ্বল মুখে বলল।
‘যেমন?’
‘তুমি আছো, এষা আছে, অরিও আছে।’
‘স্টাডি করছ আমাদের? সীমা বা বিক্রম নেই? ওরাও কিন্তু দেখবার, শোনবার মতো।’
‘ওদের আমি দেখে শুনে ফুরিয়ে ফেলেছি। তুমি দেখো।’
—‘ফুরিয়ে ফেলোনি। আর সবার মতো ওরাও প্রতি ঘণ্টায় হয়ে উঠছে নীলম। মানুষের বৈচিত্র্যে যদি তোমার আগ্রহ থাকে তাহলে ওদের বাদ দেওয়া চলে না।’
‘আচ্ছা মহানামদা, আমার কাছে তো কোনও কৈফিয়ত দাবী করলে না?’ নীলম কি রকম ক্ষুণ্ণ স্বরে বলল।
মহানাম কি করে বলবেন—‘আমি তো তোমার পরে করিনি নির্মাণ
অভ্রভেদী স্বর্গের সোপান
ভুলিনি তো তুমি মুগ্ধ নিমেষের দান।’
তিনি বললেন—‘বেশ তো, কৈফিয়ত দাও। আমি তোমাকে কাঠগড়ায় তুলছি।’
নীলম বেশ আহত হয়েছে। বলল—‘তোমার চোখে হাসি চকচক করছে এ ভাবে কি কেউ কৈফিয়ত চায়?’
মহানাম বললেন—‘তবে চাইব না। “কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে?”’
‘হৃদয়ও নেই। বেদনাও নেই। কিছুরই বালাই নেই। কোনদিনও ছিল না।’
‘সেটাই বলো না। অত কাব্য করতে আর হবে না।’
শব্দ করে হেসে উঠলেন মহানাম।
পাঁচসারি পেছন থেকে অরিত্র বলল—‘নীলম, কি চুটকি গল্প-টল্প বলছে না কি?’
‘দারুণ হিউমার’—মহানাম উঠে দাঁড়িয়ে বললেন।
অরিত্র বলল—‘ওর স্টকে প্রচুর আছে মহানামদা। সবগুলোই আপনার কানের উপযুক্ত কি না জানি না অবশ্য।’
মহানাম বসতে নীলম ডুকরে ডুকরে হাসতে লাগল। মহানাম খুশি হয়ে বললেন—‘অরি তোমাকে সুখী করতে পেরেছে বলেই মনে হচ্ছে। সেইজন্যই তোমাকে আমি একদম বকাঝকা করলাম না। সেটা বুঝতে পেরেছ আশা করি। সুখী হওয়াটাই বড় কথা।’
‘কি করে মনে হল? মোটা হয়েছি দেখে?’
মহানাম আবার সশব্দে হেসে উঠলেন।
এষা বলল—‘নীলম কি সুন্দর মজা করতে করতে চলেছে। মহানামদা দারুণ এনজয় করছেন। আর তুমি যত রাজ্যের মর্বিড কথাগুলো আমার কানের কাছে তখন থেকে বলে যাচ্ছো। সহজ হও না অরি! সত্যেরে লও সহজে।’
‘সত্য সহজ হলে তো! আমার কাছে সত্য খুব জটিল রূপে দেখা দিয়েছে যে!
নীলম বলল—‘হাসবে না মহানামদা। স্থূলত্ব সুখ না হয়ে অসুখের চিহ্নও তো হতে পারে! সেটা হাসির কথা নয়!’
‘অসুখী? তুমি অসুখী?’
‘অসুখের কথা হচ্ছে, ‘ডিজিজ’, ‘আনহ্যাপিনেস’ নয়।’
‘কি হয়েছে তোমার?’
‘ড্রপসি হতে পারে।’
‘কি যে বলো! ড্রপসি হলে কেউ কাজকর্ম বেড়ানো এসব করতে পারে?’
‘গ্ল্যান্ডের গণ্ডগোল হতে পারে।’
‘তা পারে। তুমিও ডাক্তারের মেয়ে, আমিও ডাক্তারের বোনপো, দেখি ডায়াগনোজ করতে পারি কি না। থাইরয়েড-টয়েড না কি? চোখ দেখে তো মনে হচ্ছে না? বাজে কথা বলো না। বসে বসে খেয়ে খেয়ে মোটা হয়েছো। পার্টি-টার্টিতে মৈরেয়-মাধ্বীও হয় নাকি এক আধ চুমুক?’
‘এক আধ চুমুকে এমন হয়?’—নীলম হাসতে লাগল। তার হাসির আড়ালে কান্নাটা মহানাম দেখতে পেলেন না।
স্টপে থেমেছে বাস। যাত্রীরা হাত পা ছাড়িয়ে নিতে নেমে দাঁড়াচ্ছে বাস থেকে। বিক্রম দুহাতে দু গ্লাস আখের রস নিয়ে এগিয়ে এলো। নীলম আর এষার হাতে সে দুটো ধরিয়ে দিয়ে বিদ্যুদ্বেগে আর দু গ্লাস নিয়ে ফিরে এলো।
মহানামেরটা এগিয়ে দিয়ে অরিত্রর দিকে—এয়ার ইন্ডিয়ার মহারাজার ভঙ্গিতে গ্লাস বাড়িয়ে ধরে বলল—‘আসুন দাদা।’
‘তোমার মাথায় ঢালো ওটা’—অরিত্র রাগত গলায় বলল।
বিক্রম বলল—‘আরে মাথায় তো ঘোল ঢালতে হয়! ব্যাকরণে ভুল করলেন দাদা? রাগের ওই দোষ। রাগ চণ্ডাল। জানেন তো?’
সীমা গ্লাসটা ওর হাত থেকে নিয়ে এগিয়ে এলো—‘অরিদা, নিন প্লীজ।’
‘সিগারেট আছে মুখে সীমাচল’—হাসিমুখে অরিত্র বলল।
‘সিগারেট সব সময় থাকবে। ইক্ষুনির্যাস তো সব সময়ে থাকবে না।’
‘দাও’, অরিত্র হাত বাড়িয়ে বলল।
‘কি মোহিনী জানো বন্ধু, কি মোহিনী জানো
অবলার প্রাণ নিতে নাহি তোমা হেন’—বিক্রম উচ্চৈঃস্বরে আবৃত্তি করল, অঙ্গভঙ্গিসহ। নীলম, এষা এবং মহানাম সুদ্ধু না হেসে পারলেন না।