পঞ্চগ্রামের জীবন-সমুদ্রে
পঞ্চগ্রামের জীবন-সমুদ্রে একটা প্রচণ্ড তরঙ্গোচ্ছাস উঠিয়াছিল। সেটা শতধা ভাঙ্গিয়া ছড়াইয়া পড়িল। সমুদ্রের গভীর অন্তরে অন্তরে যে স্রোতধারা বহিয়া চলিয়াছে, তরঙ্গবেগটা অস্বাভাবিক স্ফীতিতে উচ্ছ্বসিত হইয়া সেই স্রোতের ধারায় টান দিয়াছিল; একটা প্ৰকাণ্ড আবর্তনের আলোড়নের টানে নিচের জলকে উপরে টানিয়া তুলিতে চাহিতেছিল। সমুদ্রের অন্তঃস্রোতধারার আকর্ষণেই সে উচ্ছাস ভাঙিয়া পড়িল। নিরুৎসাহ নিস্তেজ জীবনযাত্রায় আবার দিন-রাত্রিগুলি কোনো রকমে কাটিয়া চলিল। মাঠে রোয়ার কাজ শেষ হইয়া গিয়াছে। ভোরে উঠিয়া চাষীরা মাঠে গিয়া নিড়ানের কাজে লাগে। হাতখানেক উঁচু ধানের চারাগুলির ভিতর হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া আগাছা তুলিয়া ধান ঠেলিয়া আগাইয়া যায়; এ-প্রান্ত হইতে ও-প্রান্ত পর্যন্ত, আবার ও-প্রান্ত হইতে এ-প্রান্তের দিকে আগাইয়া আসে। মাঠের আলের উপর দাঁড়াইয়া মনে হয় মাঠটা জনশূন্য।
মাথার উপর ভাদ্রের প্রখর রৌদ্র। সর্বাঙ্গে দরদরধারে ঘাম ঝরে, ধানের ধারালো পাতায় গা-হাত চিরিয়া যায়। তবু অন্তর তাহাদের আশায় ভরিয়া থাকে, মাঠের ওই সতেজ ধানের গাঢ় সবুজের প্রতিচ্ছায়াই যেন অন্তরে প্রতিফলিত হয়। আড়াই প্রহর পর্যন্ত মাঠে খাঁটিয়া বাড়ি ফেরে। স্নানাহার সারিয়া ঘোট ঘোট আড্ডায় বিভক্ত হইয়া বসিয়া তামাক খায়, গল্পগুজব করে। গল্পগুজবের মধ্যে বিগত হাঙ্গামার ইতিহাস, আর দেবু ঘোষ ও পদ্ম-সংবাদ। দুইটাই অত্যন্ত মুখরোচক এবং উত্তেজনাকর আলাপ। কিন্তু আশ্চর্যের কথা—এমন বিষয়বস্তু লইয়া আলাপআলোচনা যেন জমে না। কেন জমে না, তাহা কেহ বুঝিতে পারে না। সীতাকে অযোধ্যার প্রজারা জানি না চিনিত না এ কথা নয়, কিন্তু তবু সীতার অশোকবনে বন্দিনী অবস্থার আলোচনার নানা কুৎসিত কল্পনায় তাহারা মাতিয়া উঠিয়াছিল—এই মাতিয়া উঠার আনন্দেই। কিন্তু লঙ্কায় রাক্ষসেরা মাতে নাই। অবশ্য তাহারা সীতার অগ্নিপরীক্ষা প্রত্যক্ষ করিয়াছিল। মন্দোদরীর কথা লইয়া রাক্ষসেরা মাতে নাই। কারণ মাতনের আনন্দ অনুভব করিবার মত তাহাদের মানসিকতা লঙ্কার যুদ্ধে মরিয়া গিয়াছিল। তেমনিভাবেই বোধহয় এ অঞ্চলের লোকের মনের কাছে কোনো আলোচনাই জমিয়া ওঠে না। আষাঢ়ের রথযাত্রার দিন হইতে ভদ্রের। কয়েকদিন তাহাদের জীবনে একটা অদ্ভুত কাল। দিন যেন হাওয়ায় চড়িয়া উড়িয়া গিয়াছে। পঞ্চগ্রামের এতবড় মাঠে গোটা চাষটা হইয়া গেল হাজার দু-হাজার লোক খাঁটিল, একদিন একটা বচসা হইল না, মারপিট হইল না। আরও আশ্চর্যের কথা—এবার বীজধানের অ্যাঁটি কদাচিৎ চুরি গিয়াছে। চাষের সময় সে কি উৎসাহ! সে কত কল্পনা-রঙিন আশা! মাঠে এবার চার-পাঁচখানা গানই শোনা গিয়াছে এই লইয়া। বাউরি কবি সতীশের গানখানাই সবচেয়ে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল—
কলিকাল ঘুচল অকালে!
দুখের ঘরে সুখ যে বাসা বাঁধলে কপালে।।
কারু ভুঁয়ে কেউ জল না কাটে, মাঠের জল রইছে মাঠে,
(পরে) দেয় পরের কাটে আলের গোঙালে।।
ভুলল লোকে গালাগালি, ভাই বেরাদার-গলাগলি,
অঘটনের ঘটন খালি কলিতে কে ঘটালে।
দীন সতীশ বলে—কর জোড়ে— তেরশো ছত্তিশ সালে।।
সতীশের কল্পনা ছিল আবার চাষ হইয়া গেলে ভাসানের দলের মহড়ার সময় সে এই ধরনের আরও গান বাঁধিয়া ফেলিবে। কিন্তু রোয়ার কাজ শেষ হইয়া গিয়াছে, এখনও বাউরিডোমপাড়ায় ভাসানের দল জমিয়া ওঠে নাই। ছোট ছেলেদের দল বকুলতলায় সাজার হারিকেনের আলোটা জ্বালাইয়া ঢোলক লইয়া বসে-কিন্তু বয়স্কেরা বড় আসে না। সমস্ত অঞ্চলটার মানুষগুলির মধ্যে একটা অবসন্ন ছত্ৰভঙ্গের ভাব।
অন্ধকার পক্ষ চলিয়াছে। দেবু আপনার দাওয়ায় তক্তপোশের উপর হারিকেন জ্বালাইয়া বসিয়া থাকে। চুপ করিয়া বসিয়া ভাবে। কুসুমপুরের লোকে তাহাকে ঘৃণ্য ঘুষ লওয়ার অপবাদ দিয়াছিল। ইরসাদ-ভাই সত্য-মিথ্যা বুঝিয়াছে তাহার কাছে ইহা স্বীকার করিয়া তাহাকে প্রীতি-সম্ভাষণ করিয়া গিয়াছে—সে অপবাদের গ্লানি তাহার মন হইতে মুছিয়া গিয়াছে, সেজন্য তাহার দুঃখ নাই। শ্ৰীহরি ঘোষ তাহার সহিত পদ্মকে ও দুর্গাকে জড়াইয়া জঘন্য কলঙ্ক রটনা করিয়াছে, পঞ্চায়েতের বৈঠক বসাইবার উদ্যোগে এখনও লাগিয়া রহিয়াছে—সেজন্যও তাহার কোনো দুঃখ নাই, লজ্জা নাই, রাগ নাই। স্বয়ং ঠাকুর মহাশয় তাহাকে আশীর্বাদ করিয়াছেন। পঞ্চায়েত যদি তাহাকে পতিতও করে, তবুও সে দুঃখ করিবে না, কোনো ভয়ই সে করে না। কিন্তু তাহার গভীর দুঃখধর্মের নামে শপথ করিয়া যে ঘট এ অঞ্চলের লোক পাতিয়াছিল, সেই ঘট তাহারাই চুরমার করিয়া ভাঙিয়া দিল! ইরসা-রহম কি ভুলটাই করিল। সামান্য ভুলটা যদি তাহারা না করিত। তাহাকে যাহা বলিয়াছিল তাতেও ক্ষতি ছিল না। তাহাকে বাদ দিয়াও কাজ চলিত। কিন্তু এক ভুলেই সব লণ্ডভণ্ড হইয়া গেল।
লণ্ডভণ্ডই বটে। এই হাঙ্গামা মিটমাটের উপলক্ষ কঙ্কণার বাবুদের সঙ্গে কুসুমপুরের শেখেদের বৃদ্ধির ব্যাপারটাও চুকিয়া গিয়াছে। দৌলত এবং রহমকে মধ্যস্থ রাখিয়া বৃদ্ধির কাজ চলিতেছে। টাকায় দুই আনা বৃদ্ধি। সেদিকে হয়ত খুব অন্যায় হয় নাই। কিন্তু জমি বৃদ্ধিরও বৃদ্ধি দিতে হইবে স্থির হইয়াছে। কথাটা শুনিতে বা প্রস্তাবটা দেখিতে অন্যায় কিছু নাই। পাঁচ বিঘা জমির দশ টাকা খাজনা দেয় প্রজারা; সেখানে জমি ছয় বিঘা হইলে এক বিঘার বাড়তি খাজনা প্রজারা দেয় এবং জমিদারের ন্যায্য প্রাপ্য ইহা তো আইনসঙ্গত, ন্যায়সঙ্গত, ধর্মসঙ্গত বলিয়াই মনে হয়। কিন্তু অনেক গোলমাল আছে ইহার মধ্যে। জমিদার সেরেস্তায় বহুক্ষেত্রে জমিজমার অঙ্ক ঠিক নাই। মাপের গোলমাল তো আছেই। সেকালের মাপের মান একাল হইতে পৃথক ছিল।
দৌলতের বৃদ্ধি কি হারে হইয়াছে বা হইবে তাহা কেহ এখনও জানে না। রহম ওই হারেই বৃদ্ধি দিয়াছে। সে গোমস্তার পাশে বসিয়া মধ্যস্থতা করিবার সমান পাইয়াই সব ভুলিয়া গিয়াছে।
কুসুমপুরে বৃদ্ধি অস্বীকার করিয়াছে একা ইরসাদ।
শিবকালীপুরে শ্ৰীহরি ঘোষের সেরেস্তাতেও বৃদ্ধির কথাবার্তা পাকা হইয়া গিয়াছে। ওই মুখুয্যেবাবুদের দাগেই দাগা বুলাইবে সকলে। এ গ্রামে জগন এবং আরও দুই-একজন মাথা খাড়া করিয়া রহিয়াছে। বৃদ্ধ দ্বারিকা চৌধুরী কোনোদিন ধর্মঘটে নাই, কিন্তু প্রাচীনকালের আভিজাত্যের মর্যাদা রক্ষা করিবার জন্য বৃদ্ধি দিতে রাজি হয় নাই। সে আপনার সংকল্পে অবিচলিত আছে।
দেখুড়িয়ায় আছে কেবল তিনকড়ি। ভল্লারাও আছে, কিন্তু তাহাদের জমি কতটুকু? কাহারও দুই বিঘাকাহারও বড় জোর পাঁচ, কাহারও বা মাত্র দশ-পনের কাঠা।
শ্ৰীহরি ঘোষের বৈঠকখানায় মজলিস বসে। একজন গোমস্তার স্থলে এখন দুইজন গোমস্তা। সাময়িকভাবে একজন গোমস্তা রাখতে হইয়াছে। বৃদ্ধির কাগজপত্র তৈয়ারি হইতেছে। ঘোষ বসিয়া তামাক খায়। হুরিশ, ভবেশ প্রভৃতি মাতব্বরেরা আসে। মধ্যে মধ্যে এ অঞ্চলের পঞ্চায়েতমণ্ডলীর মণ্ডলেরাও আসে। দু-চারিজন ব্রাহ্মণপণ্ডিতও পায়ের ধূলা দেন। শাস্ত্র আলোচনা হয়। শ্রীহরির উৎসাহের অন্ত নাই। সে নিজের গ্রামের উন্নতির পরিকল্পনা দশের সম্মুখে সগর্বে প্রকাশ করিয়া বলে।
দুর্গোৎসব মহাযজ্ঞ আগামী বৎসর সে চণ্ডীমণ্ডপে দুর্গোৎসব করিবে। সকলে শুনিয়া উৎসাহিত হইয়া ওঠে। গ্রামে দশভুজার আবির্ভাবসে তো গ্রামেরই মঙ্গল। গ্রামের ছেলেদের লইয়া যাইতে হয় দ্বারিকা চৌধুরীর বাড়ি, মহাগ্রামে ঠাকুর মহাশয়ের বাড়ি, কঙ্কণায় বাবুদের বাড়ি।
—সেই তো! শ্ৰীহরি উৎসাহভরে বলে—সেই জন্যেই তো! চণ্ডীমণ্ডপে পূজা হবে; আপনারা দশজনে আসবেন, পূজা করাবেন। ছেলেরা আনন্দ করবে, প্রসাদ পাবে। একদিন গ্রামে জাতজ্ঞাত খাবে। একদিন হবে ব্রাহ্মণভোজন। অষ্টমীর দিন রাত্রে লুচি-ফলার। নবমীর দিন গাঁয়ের যাবতীয় ছোটলোক খিচুড়ি যে যত খেতে পারে। বিজয়ার বিসর্জনের রাত্রে বারুদের কারখানা করব।
লোকজন আরও খানিকটা উৎসাহিত হইয়া ওঠে। ব্রাহ্মণ পণ্ডিত কেহ উপস্থিত থাকিলে সংস্কৃত শ্লোক আওড়াইয়া—ঘোষের পরিকল্পনাকে রাজকীর্তির সহিত তুলনা করিয়া বলে–দুর্গোৎসব কলির অশ্বমেধ যজ্ঞ করবার ভারই তো রাজার! করবে বৈকি। ভগবান যখন তোমাকে এ গ্রামের জমিদারি দিয়েছেন, মা-লক্ষ্মী যখন তোমার ঘরে পা দিয়েছেন—তখন এ যে তোমাকেই করতে হবে। তিনিই তোমাকে দিয়ে করাবেন।
শ্ৰীহরি হঠাৎ গম্ভীর হইয়া যায়, বলে—তিনি করাবেন, আমি করব—সে তো বটেই। করতে আমাকে হবেই। তবে কি জানেন, মধ্যে মধ্যে মনে হয়—করব না, কিছু করব না আমি। গায়ের জন্যে। কেন করব বলুনঃ কিছুদিন ধরে আমার সঙ্গে সব কি কাণ্ডটা করলে বলুন দেখি? আরে বাপু, রাজার রাজ্য। তাঁর রাজ্যে আমি জমিদারি নিয়েছি। তিনি বৃদ্ধি নেবার একতিয়ার আমাকে দিয়েছেন তবে আমি চেয়েছি—দোব না দোব না করে নেচে উঠল সব গেঁয়ো পণ্ডিত একটা চ্যাংড়া ছোঁড়ার কথায়। মুসলমানদের নিয়ে জোট বেঁধে শেষ পর্যন্ত কি কাটা করলে বলুন দেখি!
সকলে স্তব্ধ হইয়া থাকে। সব মনে পড়িয়া যায়। সুস্থ জীবনাচ্ছ্বাসের আনন্দ-আস্বাদ, সুস্থ আত্মশক্তির ক্ষণিক নিৰ্ভীক প্রকাশের ঘুমন্ত স্মৃতি মনের মধ্যে জাগিয়া ওঠে। কেহ মাথা নামায়, কাহারও দৃষ্টি শ্রীহরির মুখ হইতে নামিয়া মাটির উপর নিবদ্ধ হয়।
শ্ৰীহরি বলিয়া যায়—যাক, ভালয় ভালয় সব চুকে গিয়েছে—ভালই হয়েছে। ভগবান মালিক, বুঝলেন, তিনিই বাঁচিয়ে দিয়েছেন।
–নিশ্চয়ই। ভগবান মালিক বৈকি।
–নিশ্চয়! কিন্তু ভগবান তো নিজে কিছু করেন না। মানুষকে দিয়েই করান। এক-একজনকে তিনি ভার দেন। সে ভার পেয়ে যে তার কাজ না করে, সে হল আসল স্বার্থপর–অমানুষ; জন্মান্তরে তার দুর্দশার আর অন্ত থাকে না। তাদের অবহেলায় সমাজ ছারখার হয়।
ব্রাহ্মণেরা এ কথায় সায় দেয়, বলে নিশ্চয়, রাজা, রাজকর্মচারী, সমাজপতি এরা যদি কর্তব্য না করে প্রজা দুঃখ পায়, সমাজ অধঃপাতে যায়। কথায় বলে, রাজা বিনে রাজ্য নাশ।
শ্ৰীহরি বলে—এ গ্রামে বদমায়েশি করে কেউ আর রেহাই পাবে না, দুষ্টু বদমাশ যারা তাদের আমি দরকার হলে গা থেকে দূরে করে দেব।
সে তাহার বৃহত্তর পরিকল্পনার কথা বলিয়া যায়। এ অঞ্চলে নবশাখা সমাজের পঞ্চায়েতমণ্ডলীর সে পুনর্গঠন করিবে; কদাচার, ব্যভিচার, ধর্মহীনতাকে দমন করিবে। কোথাও কোনন দেবকীর্তি রক্ষা করিবার জন্য করিবে পাকা আইনসম্মত ব্যবস্থা। দেবতা, ধর্ম এবং সমাজের উদ্ধারের ও রক্ষার একটি পরিকল্পনা সে মুখে মুখে ছকিয়া যায়।
সে বলে—আপনারা শুধু আমার পিছনে দাঁড়ান। কিছু করতে হবে না আপনাদের! শুধু পেছনে থেকে বলুনা, তোমার সঙ্গে আমরা আছি। দেখুন আমি সব শায়েস্তা করে দিচ্ছি। ঝড়-ঝঞ্ঝাট আসে সামনে থেকে মাথা পেতে পোব। টাকা খরচ করতে হয় আমি করব। পাঁচসাত কিস্তি উপরি উপরি নালিশ করলে—যত বড়লোক হোক জিভ বেরিয়ে যাবে এক হাত। স্ত্রীপুত্ৰ যায় আবার হয়। কত দেখবেন–
–সে আঙুল গনিয়া বলিয়া যায়—কাহার কাহার স্ত্রী-পুত্ৰ মরিয়াছে—আবার বিবাহ করিয়া তাহাদের সন্তানাদি হইয়াছে। সত্যই দেখা গেল, এ গ্রামের ত্রিশজনের স্ত্রীবিয়োগ হইয়াছে, তাহার মধ্যে আটাশজনেরই বিবাহ হইয়াছে। স্ত্রী-পুত্র দুই-ই গিয়াছে পাঁচজনের, তাহার মধ্যে চারজনেরই আবার স্ত্রী-পুত্র দুই-ই হইয়াছে। হয় নাই কেবল দেবু ঘোষের। সে বিবাহ করে নাই।
–কিন্তু শ্রীহরি হাসিয়া বলিল সম্পত্তি লক্ষ্মী, গেলে আর ফেরেন না! বড় কঠিন দেবতা। আর প্রজা যত বড় হোক কিস্তি কিস্তি বাকি খাজনার নালিশ হলে—সম্পত্তি তার যাবেই।
স্তিমিত স্তব্ধ লোকগুলি মাটির পুতুলের মত হইয়া যায়। শ্ৰীহরি তাহাদের সহায়, তাহারা ঘোষেরই সমর্থনকারী। শ্ৰীহরি বলিতেছে—তাহাদের জোরেই তাহার জোর, তবু তাহাদের মনে হয় তাহাদের মত অসহায় দুঃখী এ সংসারে আর নাই। উপরের দিকে মুখ তুলিয়া অকস্মাৎ গভীর স্বরে ভবেশ ভগবানকে ডাকিয়া ওঠে গোবিন্দ! গোবিন্দ! তুমিই ভরসা।
শ্ৰীহরি বলে—এই কথাটিই লোকে ভুলে যায়। মনে করে আমিই মালিক। হামসে দিগর নাস্তি। আরে বাপু—তা হলে ভগবান তো তোকে রাজার ঘরেই পাঠাতেন।
সকলে উঠিবার জন্য ব্যস্ত হয়, আপন আপন কাজের কথাগুলি যথাসাধ্য সংক্ষেপ করিয়া সবিনয়ে ব্যক্ত করে।
—আমার ওই জোতটার পুরনো খরিদা দলিল খুঁজে পেয়েছি শ্ৰীহরি। জমি যে বাড়ছে তার মানে হল গিয়ে—ওতে আবাদী জমি তোমার বার বিঘেই ছিল; তা ছাড়া ঘাস-বেড় ছিল পাঁচ বিঘে। এখন বাবা ঘাস-বেড় ভেঙে ওটাকে সুদ্ধ আবাদী জমি করেছে। তাতেই তোমার সতেরর জায়গায় কুড়ি বিঘে হচ্ছে।
–আচ্ছা, সুবিধেমত একদিন দেখাবেন দলিল।
ব্রাহ্মণরা বলেন—আমার দুবিঘে বেহ্মত্তোর মালের জমির মধ্যে ঢুকে গিয়েছে।
—বেশ, নমুদ আনবেন।
সকলে উঠিয়া যায়। শ্ৰীহরি সেরেস্তার কাজ খানিকটা দেখে, তারপর খাওয়াদাওয়া করিয়া কল্পনা করে—এবার সে লোকাল বোর্ডে দাঁড়াইবে। লোকাল বোর্ডে না দাঁড়াইলে এ অঞ্চলের পথঘাটগুলির সংস্কার করা অসম্ভব। শিবকালীপুর এবং কঙ্কণার মধ্যবর্তী সেই খালটার উপর এবার সাঁকোটা করিতেই হইবে। আর এই লোকগুলার উপর রাগ করিয়া কি হইবে? নির্বোধ হতভাগার দল সব। উহাদের উপর রাগ করাও যা—ঘাসের উপর রাগ করাও তাই।
হঠাৎ একটা জানালার দিকে তাহার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। নিত্যই আকৃষ্ট হয়। জানালা দিয়া দেখা যায় অনিরুদ্ধের বাড়ি। সে নিত্যই জানালা খুলিয়া দিয়া চাহিয়া দেখে। অন্ধকারের মধ্যে কিছু ঠাওর হয় না। তবে এক-একদিন দেখা যায় কেরোসিনের ডিবে হাতে দীর্ঘাঙ্গী কামারনী এঘর হইতে ও-ঘরে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে।
দেখুড়িয়ার তিনকড়ি আপনার দাওয়ার উপর বসিয়া গোটা অঞ্চলটার লোককে ব্যঙ্গভরে গাল দেয়। তিনকড়ির গালিগালাজের মধ্যে অভিসম্পাত নাই, আক্রোশ নাই, শুধু অবহেলা আর বিদ্রুপ। সে বৃদ্ধি দিবে না। ভূপাল তাহাকে ডাকিতে আসিয়াছিল; বেশ সম্মান করিয়া নমস্কার। করিয়া বলিয়াছিল—যাবেন একবার মণ্ডল মশায়। বৃদ্ধির মিটমাটের কথা হচ্ছে, মোড়লরা সব আসবে। আপনি একটু–
হঠাৎ ভূপাল দেখিল তিনকড়ি অত্যন্ত রূঢ়দৃষ্টিতে তাহার দিকে চাহিয়া আছে, সে থমকিয়া থামিয়া গেল এবং কয়েক পা পিছাইয়া আসিল। হঠাৎ মণ্ডল মহাশয়ের চিতাবাঘের মত ঘাড়ে লাফাইয়া পড়া মোটেই আশ্চর্য নয়।
তিনকড়ির মুখের পেশিগুলি এবার ধীরে ধীরে নড়িতে লাগিল। নাকের ডগাটা ফুলিয়া উঠিল, দুইপাশে জাগিয়া উঠিল অর্ধচন্দ্রাকারে দুইটা বঁকা রেখা, উপরের ঠোঁটটা খানিকটা উল্টাইয়া গেল; দুরন্ত ঘৃণাভরে প্রশ্ন করিল—কোথায় যাব?
–আজ্ঞে?
–বলি কোথায় যেতে হবে?
–আজ্ঞে ঘোষ মহাশয়ের কাছারিতে।
–ওরে বেটা, ব্যাঙাচির লেজ খসলে ব্যাঙ হয়, হাতি হয় না। ছিরে পাল ঘোষ হয়েছে। বেশ কথা! তার আবার মশায় কিসের রে ভেমো বাঙ্গা? কাছারিই বা কিসের?
ভূপালের আর উত্তর করিতে সাহস হইল না।
তিনকড়ি হাত বাড়াইয়া আঙুল দিয়া পথ দেখাইয়া বলিল—যা, পালা।
ভূপাল চলিয়াই যাইতেছিল হঠাৎ দাঁড়াইল, খানিকটা সাহস করিয়া বলিল—
—আমার কি দোষ বলেন? আমি হুকুমের গোলাম, আমাকে বললেন, আমি এসেছি। আমার উপর ক্যানে—
তিনকড়ি এবার উঠিয়া দাঁড়াইল, বলিলহুকুমের গোলাম! বেটা ছুঁচোর গোলাম চামচিকে। কোথাকার, বেরো বলছি, বেরো!
ভূপাল পলাইয়া বাঁচিল। তিনকড়ির কথায় কিন্তু তাহার রাগ হইল না। বিশেষ করিয়া ভল্লা, বান্দী, বাউরি, হাড়ি-ইহাদের সঙ্গে তিনকড়ির বেশ একটি হৃদ্যতা আছে। তিনকড়ির বাছবিচার নাই; সকলের বাড়ি যায়, বসে, গল্প করে, কল্কে লইয়া হাতেই তামাক খায়। এককালে সে মনসার গানের দলেও ইহাদের সঙ্গে গান গাহিয়া ফিরিত। আজও রসিকতা করে, গালিগালাজও করে, তাহাতে বড় একটা কেহ রাগ করে না। ভূপাল বরং পথে আপন মনেই পরম। কৌতুকে খানিকটা হাসিয়া লইল। গালাগালখানি বড় ভাল দিয়েছে মোড়ল। ছুঁচোর গোলাম চামচিকে অর্থাৎ ঘোষ মহাশয় ছুঁচো। তাহার নিজের চামচিকে হইতে আপত্তি নাই, কিন্তু ঘোষ মহাশয়কে ছুঁচো বলিয়াছে—এই কৌতুকেই সে হাসিল।
ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি। মাঝে মাঝে মেঘ আসে, উতলা ঠাণ্ডা বাতাস দেয়, গাছপালার ঘন পত্রপল্লবে শনশন শব্দে সাড়া জাগিয়া ওঠে; খানাডোবায় ব্যাঙগুলা কলরব করে; অশ্রান্ত ঝিঝির ডাক ওঠে, মধ্যে মধ্যে ফিনফিনে ধারায় বৃষ্টি নামে; তিনকড়ি দাওয়ার উপর অন্ধকারে বসিয়া তামাক টানে আর গালিগালাজও করে। বসিয়া শ্মশানে রাম ভল্লাতারিণী ভল্লা।
শেয়াল, শেয়াল! বেটারা সব শেয়াল, বুঝলি রাম, শেয়ালের দল সব। রাম ও তারিণী অন্ধকারের মধ্যেই সমঝদারের মত জোরে জোরে ঘাড় নাড়ে, বলে—তা বৈকি!
তিনকড়ির কোনো গালিগালাজই মনঃপূত হয় না, সে বলিয়া ওঠে—বেটারা শেয়ালও নয়। শেয়ালে তো তবু ছাগল-ভেড়াও মারতে পারে। ক্ষেপেও কামড়ায়। বেটারা সব কেশেয়াল।
ঘরের মধ্যে হারিকেনের আলো জ্বালিয়া পড়ে গৌর আর স্বর্ণ। তাহারা বাপের উপমা শুনিয়া হাসে।
–ভল্লুকের বাচ্ছা বেটারা সব উল্লুকের দল।
এবার স্বৰ্ণ আর থাকিতে পারে না–সে খিলখিল করিয়া হাসিয়া ওঠে।
তিনকড়ি ধমকাইয়া ওঠে—গৌর বুঝি ঢুলছিস?
গৌর হাসিয়া বলে—কই, না!
—তবে? তবে সুন্ন হাসছিল কেন?
গৌর বলে—তোমার কথা শুনে হাসছে স্বন্ন।
—আমার কথা শুনে? তিনকড়ি একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলে হাসির কথা নয় মা। অনেক দুঃখে বলছি না। অনেক তিতিক্ষেতে। ছেলেমানুষ তোরা, কি বুঝবি!
স্বৰ্ণ অপ্রস্তুত হইয়া বলে–বাবা, সেজন্য নয়।—একটু চুপ করিয়া থাকিয়া সঙ্কোচভরেই আবার বলে তুমি বললে নাভলুকের বাচ্ছা উল্লুক-তাই। ভল্লুকের পেটে উল্লুক হয়?
এবার তিনকড়িও হাসিয়া ওঠেও, তা বটে। ওটা আমারই ভুল বটে।
রাম আর তারিণীও এবার হাসে। ঘরের মধ্যে গৌর-স্বর্ণও আর একচোট হাসে; তিনকড়ি স্বর্ণের তীক্ষ্ণবুদ্ধির কথা ভাবিয়া খুশিও হয় খানিকটা। উৎসাহিত হইয়া বলে—খানিক মনসার পাঁচালি পড় স্বন্ন। আমরা শুনি। এই প্রসঙ্গেই সে আবৃত্তি করে–
দিন গেল মিছে কাজে, রাত্রি গেল নিদ্ৰে,
না ভজিনু রাধা-কৃষ্ণ-চরণারবিন্দে।।
দিনরাত যত বেটা ভেড়ার কথা ভেবে কি হবে? ভেড়া—ভেড়া, সব ভেড়া। বুঝলি রামা শেয়াল দেখলে ভেড়াগুলো চোখ বুজে দেয়। ভাবে আমরা যখন শেয়ালটাকে দেখতে পাচ্ছি না, শেয়ালটাও তখন আমাদের দেখতে পাচ্ছে না। বেটা শেয়ালের তখন পোয়াবার হয়ে যায়, ক্যাঁক করে ধরে আর নলীটা ছিঁড়ে দেয়। এ হয়েছে ঠিক তাই। ব্যাটা ছিরে পাল—শুধু ছিরে পাল ক্যানে, কঙ্কণার বাবুরা পর্যন্ত ধূও শেয়াল। আর এ বেটারা হল সব ভেড়া। মটমট ঘাড় ভাঙছে।
এবার জুতসই উপমাসম্মত গালাগালি পাইয়া তিনকড়ি খুশি হইয়া ওঠে।
স্বৰ্ণ ঘর হইতে জিজ্ঞাসা করে–কোন জায়গাটা পড়ব বাবা?
মনসার পাঁচালি তিনকড়ির মুখস্থ। এককালে সে ভাসানের গানের মূল গায়েন ছিল। সেই সময়েই কলিকাতা হইতে ছাপা বইখানা সে আনাইয়াছিল। সেকালে ভাসানের দল ছিল পাঁচালির দল; তিনকড়িই তাহাকে যাত্রার ঢঙে রূপান্তরিত করিয়াছিল। তখন সে সাজিত চান্দেবেনে; মধ্যে মধ্যে গোধার ভূমিকাতেও অভিনয় করিত। চন্দ্ৰধর সাজিয়া আঁকড়ের একটা এবড়োখবড়ো ডালের লাঠিকে হেমলের লাঠি হিসাবে আস্ফালন করিয়া বীররসের অভিনয়ে আসর মাত করিয়া দিত। যতবার সে আসরে প্রবেশ করিত, বলিত–
যে হাতে পূজিনু আমি চণ্ডিকা জননী,
সে হাতে না পূজিব কবু চ্যাঙ-মুড়ি কানি!
তারপর সনকার সম্মুখে গম্ভীরভাবে বলিতচন্দ্রধরের চৌদ্দ ডিঙ্গা ড়ুবেছে, ছয়-ছয় বেটা আমার বিষে কাল হয়ে অকালে কালের মুখে গিয়েছে, ওই—এই চ্যাঙ-মুড়ি কানির জন্য। আমার মহাজ্ঞান হরণ করেছে। বন্ধু ধন্বন্তরিকে বধ করেছে। আর যা আছে তাও যাক। তবু–তবু আমি তাকে পূজব না। না—না–না!
আজ সে বলিল—স্বন্ন মা, সেই ঠাঁইটে পড়। কলার মাঞ্চাসে করে বেউললা জলে ভেসেছে। মরা নখীন্দরকে নিয়ে বেশ সুর করে পড় মা।
তিনকড়ি বলিয়া দিল—এইখান থেকে পড় স্বন্ন। ওই যে—যেখানে চন্দ্ৰধর বলছে–
যদিরে কালির লাইগ পাই একবার।
কাটিয়া পুঁদিব আমি মরা পুত্রের ধার।
স্বর্ণ বই খুলিয়া সুর করিয়া পড়িল—
যে করিমু কানিরে আমার মনে জাগে।
নাগের উৎসিষ্ট পুত্ৰ ভাসাও নিয়া গাঙ্গে।
শ্বশুরের শুনিয়া বেউলা নিষ্ঠুর বচন।
বিষাদ ভাবিয়া পাছে করয়ে ক্রন্দন।।
তারপর সুর করিয়া ত্রিপদী ছন্দে আরম্ভ করিল–
মালি নাগেশ্বর খানিক উপকার করহ বেউলারে!
তুমি বড় গুণমণি তোরে ভাল আমি জানি
হের, আইস বুলি হে তোমারে!
যাও তুমি সাধু পাশ খুঁজিয়া লও রাম-কলার গাছ
বান্ধ সুরা যেমন প্রকারে,
হাতে কঙ্কণ ধর, খোলর মাঞ্জস গড়
অমূল্য রতন দি তোরে।।
বেহুলা বিলাপ করে আর আপনার বিবাহের বেশ খুলিয়া ফেলে; হাতের কঙ্কণ খুলিয়া ফেলিল-বাজুবন্ধ, জসম খুলিল—কানের কুণ্ডল, নাকের বেসর ফেলিয়া দিল; সিথির সিন্দুর মুছিল, বাসরঘরে সোনার বাটা ভরা ছিল পানের খিলি, বেহুলা সে সব ফেলিয়া লখীন্দরের মৃতদেহ কোলে করিয়া এক অনির্দিষ্টের উদ্দেশে ভাসিয়া চলিল। মৃত লখীন্দরের মুখের দিকে চাহিয়া খেদ করিতে করিতে ভাসিয়া চলিল—
জাগরে প্রভু গুঞ্জরি সাগরে।
তোমারে ভাসায়ে মাও চলিয়া যায় ঘরে।
বাপ মোগদ তাস পাষাণে বাঁধে হিয়া।
ছাড়িল তোমার দয়া সাগরে ভাসাইয়া।।
বেহুলা ভাসিয়া যায়। কাক কাঁদে, সে বেহুলার সংবাদ লইয়া যায় তাহার মায়ের কাছে, অন্য পাখিরা কাঁদে। পশুরা কাঁদে, শিয়াল আসে লখীন্দরের মৃতদেহের গন্ধে, কিন্তু বেহুলার কান্না দেখিয়া সেও কাঁদিতে কাঁদতে ফিরিয়া যায়।…
তিনকড়ি, রাম, তারিণী ইহারাও কদে। স্বর্ণের গলাও ভারী হইয়া আসে, সেও মধ্যে চোখের জল মোছে। সেই অধ্যায়টা শেষ হইতেই তিনকড়ি বলিল—আজ আর থাক্ মা স্বন্ন।
স্বৰ্ণ বইখানি বন্ধ করিয়া মাথায় ঠেকাইয়া তুলিয়া রাখিয়া বাড়ির ভিতর গেল; গৌর খানিক আগেই ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। তারিণী এবং রামও উঠিল।
–আজ উঠলাম মোড়ল।
–হ্যাঁ। অন্যমনস্ক তিনকড়ি একটু চকিতভাবেই বলিল–হ্যাঁ।
অন্ধকারের দিকে চাহিয়া সে বসিয়া রহিল। মনটা ভারাক্রান্ত হইয়া উঠিয়াছে। রাত্রে। বিছানায় শুইয়াও তাহার ঘুম আসে না। গাঢ় অন্ধকার রাত্রি, রিমিঝিমি বৃষ্টি। চারিদিক নিস্তব্ধ গ্রাম-গ্রামান্তরের লোকজন সব অঘোরে ঘুমাইতেছে। তাহারা পেটের দায়ে মান বলি দিয়া নিশ্চিন্ত হইয়াছে। শ্ৰীহরি ঘোষের গোলা খুলিয়াছে, কঙ্কণার বাবুদের গোলা খুলিয়াছে, দৌলত শেখের গোলা খুলিয়াছে তাহাদের জন্য। কিন্তু তাহাকে কেহ দিবে না। সে শহরে কলওয়ালার কাছে টাকা লইয়া একবার কিনিয়াছিল। সেই ধানের কিছু কিছু সে ভল্লাদের দিয়াছে। আবার ধান চাই। বড়লোকেরওই জমিদারের সঙ্গে বাদ করিয়াই চৌদ্দ ডিঙা মধুকর ড়ুবিয়া গেল। পৈতৃক পঁচিশ বিঘা জমির বিশ বিঘা গিয়াছে, অবশিষ্ট আর পাঁচ বিঘা। বেহুলার মত তার স্নেহের। স্বৰ্ণময়ী বাসরে বিধবা হইয়া অথৈ সাগরে ভাসিতেছে। একালে লখীন্দর বাঁচে না। উপায় নাই। কোনো উপায় নাই। হঠাৎ তাহার মনে পড়ে, সদর শহরে ভদ্রলোকের ঘরেও আজকাল বিধবা বিবাহ হইতেছে। সে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। সেকথা একবার সে তাহার স্ত্রীর কাছে। তুলিয়াছিল; কিন্তু স্বর্ণ তাহার মাকে বলিয়াছিল—না মা, ছি! … আর এক উপায়—স্বৰ্ণকে লেখাপড়া শেখানো। জংশনে সে মেয়ে-ডাক্তারকে দেখিয়াছে, মেয়ে-স্কুলের মাস্টারনীদের দেখিয়াছে। লেখাপড়া শিখিয়া এমনই যদি স্বর্ণ হইতে পারে। … সে বারান্দায় শুইয়া ভাবে।
কৃষ্ণপক্ষের আকাশে চাঁদ উঠিল! মেঘের ছায়ায় জ্যোৎস্না রাত্রির চেহারা হইয়াছে ঠিক ভোররাত্রির মত। মধ্যে মধ্যে ভুল করিয়া কাক ডাকিয়া উঠিতেছে।-বাসা হইতে মুখ বাড়াইয়া পাখার ঝাপটা মারিতেছে।
তিনকড়ি মনের সংকল্পকে দৃঢ় করিল। বহুদিন হইতেই তাঁহার এই সংকল্প; কিন্তু কিছুতেই কাজে পরিণত করিতে সে পারিতেছে না; কালই দেবুর সঙ্গে পরামর্শ করিয়া যাহা হয় একটা ব্যবস্থা করিবে।
—মণ্ডল মশায়! ও মণ্ডল মশায়! মণ্ডল মশায় গো!
তিনকড়ির নাসিকাধ্বনির সাড়া না পাইয়া চৌকিদারটা আজ তাহাকে ডাকিতেছে।
কুসুমপুরের মুসলমানেরা দৌলত শেখের কাছে ধান ঋণ পাইয়াছে। সারাটা দিন রমজানের রোজার উপবাস করিয়া ও সারাটা দিন মাঠে খাঁটিয়া জমিদারের সেরেস্তায় বৃদ্ধির জটিল হিসাব করিয়াছে। সূর্যাস্তের পর এফতার অর্থাৎ উপবাস ভঙ্গ করিয়া অসাড়ে ঘুমাইতেছে।
ইরসাদ প্ৰতি সন্ধ্যায় রোজার উপবাস ভঙ্গ করিবার পূর্বে তাহার একজন গরিব জাতভাইকে কিছু খাইতে দিয়া তবে নিজে খায়। তাহার মনে শক্তি নাই, অহরহ একটা অব্যক্ত জ্বালায় সে জ্বলিতেছে। দেবু-ভাই তাহাকে যে কথা বলিয়াছিল—সে কথা মনে করিয়াও সে মনকে মানাইতে পারে না।
সে স্পষ্ট চোখের উপর দেখিতে পাইতেছে কি হইতেছে। শুধু কি হইতেছে নয়, কি হইবে তাহাও তাহার চোখের উপর ভাসিতেছে। দৌলতের ঋণ সর্বনাশা ঋণ! তাহার কাছে টাকা কর্জ লইয়া কলওয়ালার দেনা শোধ করা হইয়াছে। কয়েক বৎসরের মধ্যেই এই ঋণের দায়ে সম্পত্তি সমস্ত গিয়া ঢুকিবে দৌলতের ঘরে। কলওয়ালার ঋণে যাইত ধান; দৌলতের ঋণ সুদে-আসলে যুক্ত হইয়া প্রবালদ্বীপের মত দিন দিন বাড়িবে। কয়েক বৎসরের মধ্যেই গোটা গ্রামটার জমির মালিক হইবে দৌলত। শিবকালীপুরের শ্ৰীহরি ঘোষের মত সে-ই হইবে তামাম জমির মালিক। রহম চাচাকেও খাজনা দিতে হইবে দৌলতকে।
অন্ধকার রাত্রের মধ্যে আকাশের দিকে চাহিয়া সে ঈশ্বরকে ডাকে। আল্লাহ-নূরাইয়াহ্ তুমি এর বিচার কর। প্রতিকার কর। গরিবদের বাঁচাও।
এ প্রার্থনা তার নিজের জন্য নয়। সে ঠিক করিয়াছে এ গ্রাম ছাড়িয়া সে চলিয়া যাইবে। তাহার শ্বশুরবাড়ির আহ্বানকে সে আর অগ্রাহ্য করিবে না। সে যাইবে। কাজ করিবার সঙ্গে পড়িবে, ম্যাট্রিক পাস করিয়া সে মোক্তারি পড়িবে। মোক্তার হইয়া তবে সে দেশে ফিরিবে। তার আগে নয়। তারপর সে যুদ্ধ করিবে। দৌলত, কঙ্কণার বাবু, শ্ৰীহরি ঘোষ প্রতিটি দুশমনের সঙ্গে সে জেহাদ করিবে।
মহাগ্রামে ন্যায়রত্ন বসিয়া ভাবেন।
চণ্ডীমণ্ডপে হারিকেন জ্বলে, কুমোরেরা দুর্গাপ্রতিমায় মাটি দেয়, অজয় বসিয়া থাকে। ওইটুকু ছোট ছেলে—উহার চোখেও ঘুম নাই। গভীর মনোযোগের সঙ্গে সে প্রতিমা-গঠন দেখে। শশীশেখরও এমনি ভাবে দেখিত; বিশ্বনাথও দেখিত; অজয়ও দেখিতেছে। পাড়ার ছেলেপিলেরা আসিয়া দাঁড়াইয়া আছে। চিরকাল থাকে। কিন্তু এ দাঁড়াইয়া থাকা সে দাঁড়াইয়া থাকা নয়–অর্থাৎ তাহারা ছেলেবেলায় যে মন লইয়া দাঁড়াইয়া থাকিতেন এ তাহা নয়।
জমজমাট মহাগ্রাম-ধন-ধান্যে ভরা সচ্ছল পঞ্চগ্রাম—অথচ উৎসব-সমারোহ কিছুই নাই। প্রাণধারা ক্রমশ ক্ষীণ হইতে ক্ষীণতর হইয়া আসিতেছে। সম্পদ গিয়াছে, মানুষের স্বাস্থ্য গিয়াছে; বর্ণাশ্রম সমাজ ব্যবস্থা আজ বিনষ্টপ্রায়; জাতিগত কর্মবৃত্তি মানুষের হস্তচ্যুত—কেহ হারাইয়াছে, কেহ ছাড়িয়াছে। আজই সকালে আসিয়াছিল কয়েকটি বিধবা মেয়ে। তাহারা ধান ভানিয়া অন্নের সংস্থান করিত, কিন্তু ধান-কল হইয়াছে জংশনে, তাহাদের কাজ এত কমিয়া গিয়াছে যে তাহাতে আর তাহাদের ভাত-কাপড়ের সংস্থান হইতেছে না। তিনি শুধু শুনিলেন। শুনিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলিলেন, কিন্তু উপায় কিছু তৎক্ষণাৎ বলিয়া দিতে পারিলেন না। এখনও ভাবিয়া পান নাই।
এ বিষয়ে তিনি অনেকদিন হইতেই সচেতন। এককালে কঠোর নিষ্ঠার সঙ্গে সমাজধর্ম অক্ষুণ্ণ রাখিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন বৈদেশিক মনোভাবকে দূরে রাখতে চেষ্টা করিয়াছিলেন, কিন্তু কালের উৎসাহে আপন পুত্ৰই বিদ্রোহী হইয়াছিল। তারপরও তিনি প্রত্যাশা করিয়াছিলেন হোক বিশৃঙ্খল সমাজ ব্যবস্থা, ধর্ম যদি অক্ষুণ্ণ থাকে তবে আবার একদিন সব ফিরিবে। আজ স্বয়ং ঈশ্বরই বুঝি হারাইয়া যাইতেছেন।
তাঁহার পৌত্র বিশ্বনাথ কালধর্মে আজ নাস্তিক, জড়বাদী।
বিশ্বনাথ চলিয়া গিয়াছে। দেবুর সহিত কথা প্রসঙ্গে সেদিন যে কথা উঠিয়াছিল—সেই আলোচনার পরিণতিতে সে বলিয়াছিল—আমার জীবনের পথ, আদর্শ, মত আপনার সঙ্গে সম্পূর্ণ আলাদা। আপনি আমার জন্যে শুধু কষ্ট পাবেন দাদু। তার চেয়ে জয় আর অজয়কে নিয়ে–
ন্যায়রত্ন বলিয়াছিলেন—না ভাই, সে যেয়ো না। হোক আমাদের মত ও পথ ভিন্ন। তা বলে কি এক জায়গায় দুজনে বাস করতে পারব না?
বিশ্বনাথ পায়ের ধুলা লইয়া বলিয়াছিল—সঁচালেন দাদু। জয়া, অজয় আপনার কাছে থাক, আর আমি–
—আর তুমি? তুমি কি–
–আমি? বিশ্বনাথ হাসিয়াছিল।—আমার কর্মক্ষেত্র দিন দিন যেমন বিস্তৃত–তেমনি জটিল হয়ে উঠেছে দাদু।
—এইখানে–তোমার দেশে থেকে কাজকর্ম কর তুমি।
—আমার কর্মক্ষেত্র গোটা দেশটাতে দাদু। আমি আপনার মত মহামহোপাধ্যায়ের পৌত্র, আমার কর্মক্ষেত্র বিরাট তো হবেই। এখানে কাজ করবে দেবু, দেবুর সঙ্গে আরও লোক আসবে ক্রমশ, দেখবেন আপনি। মানুষ চাপা পড়ে মরে, কিন্তু মানুষের মনুষ্যত্ব পুরুষানুক্রমে মরে না। তার অন্তরাত্মা উঠতে চাচ্ছে—উঠবেই। আপনাদের সমাজব্যবস্থা কোটি কোটি লোককে মেরেছে—তাই তাদের মাথাচাড়ায় সে চৌচির হয়ে ফেটেছে। সে একদিন ভাঙবে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা সমাজের কল্যাণ-চিন্তাই করতে চেয়েছিলেন, তাতে আমি সন্দেহ করি না। কিন্তু কালক্রমে তার মধ্যে অনেক গলদ, অনেক ভুল ঢুকেছে। সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতেই আমরা এ সমাজকে ভাঙবধর্মকে বদলাব।
প্রাচীন কাল হইলে ন্যায়রত্ন আগ্নেয়গিরির মত অগ্নগার করিতেন। কিন্তু শশীর মৃত্যুর পর হইতে তিনি শুধু নিরাসক্ত দ্রষ্টা ও শ্রোতা। একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া তিনি শুষ্ক হাসি হাসিয়াছিলেন।
বিশ্বনাথ বলিয়া গিয়াছে—একটা প্রচণ্ড শক্তিশালী রাজনৈতিক আন্দোলন আসন্ন, দাদু। আমার কলকাতা ছাড়লে চলবে না। জয়াকে কোনো কথা বলবেন না। আর আপনার দেবসেবার একটা পাকা বন্দোবস্ত করুন। কোনো টোলের ছেলেকে দেবতা বা সম্পত্তি আপনি লেখাপড়া করে দিন।
ন্যায়রত্ন তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিয়াছিলেন—যদি জয়াকে ভার দিই, বিশ্বনাথ? তাতে তোমার কোনো আপত্তি আছে?
বিশ্বনাথ একটু চিন্তা করিয়া বলিয়াছিল দিতে পারেন, কারণ জয়া আমার ধর্ম গ্রহণ করতে কোনোদিনই পারবে না।
ন্যায়রত্ন অন্ধকার দিগন্তের দিকে চাহিয়া ওই কথাই ভাবিতেছিলেন আর বিদ্যুচ্চমকের আভাস দেখিতেছিলেন। কোনো অতি দূর-দূরান্তের বায়ুস্তরে মেঘ জমিয়া বর্ষা নামিয়াছে, সেখানে বিদ্যুৎ খেলিয়া যাইতেছে; তাহারই আভাস দিগন্তে ক্ষণে ক্ষণে ফুটিয়া উঠিতেছিল। মেঘ-গৰ্জনের কোনো শব্দ শোনা যাইতেছে না। শব্দতরঙ্গ এ দূরত্ব অতিক্ৰম করিয়া আসিতে ক্রমশ ক্ষীণ হইয়া শেষে নৈঃশব্দের মধ্যে মিলাইয়া যাইতেছে। ইহার মধ্যে অস্বাভাবিকতা কিছুই নাই। ভাদ্র মাস হইলেও এখনও সময়টা বর্ষা। কয়েকদিন আগে পর্যন্ত এই অঞ্চলে প্রবল বর্ষা নামিয়াছিল; জলঘন মেঘে আচ্ছন্ন আকাশে বিদ্যুচ্চমক এবং মেঘগর্জনের বিরাম ছিল না। আবার আজ মেঘ দেখা দিয়াছে; খণ্ডখণ্ড বিচ্ছিন্ন মেঘপুঞ্জের আনাগোনা চলিয়াছেই, চলিয়াছেই। দিগন্তে এ সময়ে মেঘের রেশ থাকেই এবং চিরদিনই এ সময় দূর-দূরান্তের মেঘভারের বিদ্যুৎ-লীলার প্রতিচ্ছটা রাত্রির অন্ধকারের মধ্যে দিগন্তসীমায় ক্ষণে ক্ষণে আভাসে ফুটিয়া ওঠে। সমস্ত জীবনভোরই ন্যায়রত্ন এ খেলা দেখিয়া আসিয়াছেন। কিন্তু আজ তিনি এই ঋতুরূপের স্বাভাবিক। বিকাশের মধ্যে অকস্মাৎ অস্বাভাবিক অসাধারণ কিছু দেখিলেন যেন। তাঁহার নিজের তাই মনে। হইল।
গভীর শাস্ত্ৰজ্ঞানসম্পন্ন নিষ্ঠাবান হিন্দু তিনি। বাস্তব জগতের বর্তমান এবং অতীত কালকে আঙ্কিক হিসাবে বিচার করিয়া, সেই অঙ্কফলকেই ধ্রুব, ভবিষ্যৎ, অখণ্ড সত্য বলিয়া মনে করিতে পারেন না। তাহারও অধিক কিছু অতিরিক্ত কিছুর অস্তিত্বে তাহার প্রগাঢ় বিশ্বাস; মধ্যে মধ্যে তিনি তাহাকে যেন প্রত্যক্ষ করেন, সমস্ত ইন্দ্ৰিয় দিয়া, সমস্ত মন দিয়া পর্যন্ত অনুভব করেন। আকস্মিকতার মত অপ্রত্যাশিতভাবে জটিল রহস্যের আবরণের মধ্যে আত্মগোপন করিয়া সে। আসে; বাস্তববাদের যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগের মধ্যে আসিয়া পড়িয়া অঙ্কফল ওলটপালট বিপর্যস্ত করিয়া দিয়া যায়।
বিশ্বনাথ বলে–অঙ্ক কষিয়া আমরা সূর্যের আয়তন বলিতে পারি, ওজন বলিতে পারি।
হয়ত বলা যায়। জ্যোতিষীরা অঙ্ক কষিয়া গ্ৰহ-সংস্থান নির্ণয় করে। পুরাতন কথা। নূতন করিয়া সূর্যের এবং অন্যান্য গ্রহের আয়তন তোমরা বলিয়াছ। কিন্তু ওই অঙ্কটাই কি সূর্যের আয়তন-ওজন? কোটি কোটি মন। ন্যায়রত্ব হাসিয়াছিলেন, বলিয়াছিলেন—যে লোক দু-মন বোঝা বইতে পারে, চার মন তার ঘাড়ে চাপালে তার ঘাড় ভেঙে যায়, দাদু। সুতরাং দু-মনের দ্বিগুণ চার মন অঙ্ক কষে বললেও সেটা যে কত ভারী সে জ্ঞান তার নেই। অনুভূতি দিয়ে তাকে প্রত্যক্ষ করতে হয়। যার অতীন্দ্রিয় অনুভূতি নেই—নির্ভুল হলেও সর্বতত্ত্বের অঙ্কফল তার কাছে নিষ্ফল। যার আছে, সে বুঝতে পারে আজকের অঙ্কফল কাল পাল্টায় সূর্য ক্ষয়িত হয়, বৃদ্ধি পায়। অঙ্কাতীতকে এই ইন্দ্ৰিয়াতীত অনুভূতি দিয়ে প্রত্যক্ষ করতে হয়।
বিশ্বনাথ উত্তর দেয় নাই।
বিশ্বনাথ বুঝিয়াছিল—নিষ্ঠাবান হিন্দু ব্রাহ্মণের সংস্কারবশেই ন্যায়রত্ন এ কথা বলিতেছেন। তাহার সে সংস্কার ছিন্নভিন্ন করিয়া দিবার মত তর্কযুক্তিও তাহার ছিল, কিন্তু স্নেহময় বৃদ্ধের হৃদয়, বেশি আঘাত দিতে তাহার প্রবৃত্তি হয় নাই। সে চুপ করিয়াই ছিল, কেবল একটু হাসি তাহার মুখে ফুটিয়া উঠিয়াছিল।
ন্যায়রত্নও আর আলোচনা বাড়ান নাই। বিশ্বনাথ স্থির, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এখন তিনি শুধু দ্ৰষ্টা। অন্ধকার রাত্রে একা বসিয়া ন্যায়রত্ন ওই কথাই ভাবেন। ভাবেন অজয় আবার কেমন হইবে কে। জানে।
একটা বিপর্যয় যেন আসন্ন, ন্যায়রত্ন তাহার আভাস মধ্যে মধ্যে স্পষ্ট অনুভব করেন। নূতন কুরুক্ষেত্রের ভূমিকা এ। অভিনব গীতার বাণীর জন্য পৃথিবী যেন উন্মুখ হইয়া আছে।
তবু তিনি বেদনা অনুভব করেন বিশ্বনাথের জন্য। সে এই বিপর্যয়ের আবর্তে ঝাঁপ দিবার জন্য যোদ্ধার আগ্রহ লইয়া প্রস্তুত হইয়া উঠিতেছে।
জয়ার মুখ, অজয়ের মুখ মনে করিয়া তাহার চোখের কোণে অতি ক্ষুদ্র জলবিন্দু জমিয়া। ওঠে। পরমুহূর্তেই তিনি চোখ মুছিয়া হাসেন।
ধন্য সংসারে মায়ার প্রভাব! মহামায়াকে তিনি মনে মনে প্রণাম করেন।