২২. ভরতের মৃত্যু
ভরতের মৃত্যু মহিমকে নির্বাক করে দিয়ে গেল।
ভরতের মৃত্যুর পর অহল্যা এত দূরে সরে গেল যে, মহিম প্রায় অষ্টপ্রহরই নরহরির সঙ্গে খালের মোহনার ধারে গিয়ে বসে থাকত, আগে মহিম ঠাঁই নিয়েছিল এখানে অনেক দুঃখে। শুধু ঘর নয়, নয়নপুরের মধ্যে কোথাও শাস্তির লেশ পেত না সে। হরেরামের বাউরি বউ যেদিন থেকে পথে পথে হেসে কেঁদে বেড়াতে শুরু করল, সেদিন থেকে সে প্রকৃতপক্ষে গাঁয়ের পথ চলাই বন্ধ করে দিয়েছিল। গোবিন্দ জীবনের নিশানা পেয়েছে, প্রাণখুলে সে কথা সে বন্ধু মহিমকে বলেছে। বলেছে, ভাদ্রবউয়ের কথা, তার সর্বনাশের কথা। আচায্যির কথা। আগেও বলেছে। বলেছে, তবে মোর জীবনে গুরুদেব রইল অক্ষয় হইলে, সে গুরু মোর পাগলা ঠাকুর। তার মন্তরই মোর মন্তর। সে হইল, পাপ কুচাল থেকে এই দেশোদ্ধার। …আর বনলতা তার রহস্যময়ী হৃদয়ের দরজা খুলে দিয়েছে বিচিত্র হেসে তার বাল্যসখার কাছে, মাতাল চোখে নিজেকে দেখিয়ে বলেছে, নতুন মানুষ আসছে তার মধ্যে, গোবিন্দর আর বনলতার জীবন সৃষ্টি। তাদের নতুন ঘর। মহিমকে ঠাট্টা করে বলেছে, বউবিবাদীর দাবীদার তুমি একজন, নিত্যপ্রহর ঝগড়া বাধাবার নিমন্ত্রণ রইল তোমার।
খুশিতে প্রাণ ভরে উঠেছে মহিমের কিন্তু হাহাকারের চাপা ধ্বনিও কেন যেন উঠেছে বুকের একপাশ থেকে। তবু সব মিলিয়ে সে যখন সুর বাবার চেষ্টা করছে তখনই কুঁজো কানাইয়ের অপঘাত মৃত্যু প্রাণটাকে টুণ্ডা করে দিল তার। গত কয়েকদিন যে ঝড় বৃষ্টি গিয়েছে, সেই ঝড়বৃষ্টিতেই কালুমালার মেয়ের শ্বশুরবাড়ির ঘরের পেছনে গাছচাপা পড়ে মরেছে কুঁজো কানাই। সবাই বলল, ওর তো স্থানকালের বিচার ছিল না, নইলে ঝড়ের রাত্রে কে বা বন জঙ্গল টুড়ে মরতে যায়! সত্য কথা। কিন্তু মহিম বুঝল ঝড়ের রাত্রে কুঁজো কানাইয়ের প্রাণে ডাহুকের অসহ্য বিরহ বাসা বেঁধেছিল। কালু মালার সোন্দরী মেইয়েকে ছিটে বেড়ার ফাঁক দিয়ে একবার দেখার আকাঙক্ষায় আতুর করে তুলেছিল ওই ঝড়ের রাত্রিই।
জীবন্তে হল না, মরণের পর মহিম তার শিল্পসাধনার শরিক কুঁজো কানাইয়ের মূর্তি গড়া শুরু করল। কানাই মহিমের হাতে গড়া মূর্তি দেখে বলত, আচ্ছা, কোনওরকমে যদি পরানের ধুকধুকিটা ঠেসে দেওয়া যেত মূর্তির বুকটাতে, তবে তুমি হইতে বেহ্ম।… আজ মহিমের মনে হল, কোথায় পাওয়া যাবে সেই প্রাণের ধুকধুকি, যা দিয়ে কানাইদাকে জীবন্ত করে তোলা যায়। … ধুকধুকি নয়, কানাইয়ের প্রতিটি অঙ্গকে জীবন্ত করে তোলার সাধনাতেই আত্মনিয়োগ করল সে। আর বার বার মনে পড়ল কুঁজো কানাইয়ের সেই কথা, কুরচিতলায় পা ছড়িয়ে বসে কাঁদে কালুমালার সোন্দরী মেইয়ে, সে মুত্তি কি গড়া যায় না?
কিন্তু প্রাণে তার থমকে রইল কান্না। অহল্যা তো এল না তার মূর্তি গড়া দেখতে। জিজ্ঞেস করল না কোনও কথা, দুর থেকে একবার চোখ তুলে দেখল না। চকিত হাসির সেই অভিনন্দন, মাথায় হাত দিয়ে কাছে টেনে সেই স্নেহ আদর কোথায়।
এমনি সময় একদিন পরানকে সঙ্গে নিয়ে উমা এসে দাঁড়াল মহিমদের উঠোনে। এসে চমকে উঠল উমা। বাড়িটা যেন পোড়ড়া বাড়ির মতো নিস্তব্ধ খাঁ খাঁ করছে। মনে হয়, কেউ নেই। মণ্ডলবউ অহল্যার কোনও চিহ্ন দেখা গেল না। ঘরগুলির দরজা খোলা পড়ে রয়েছে। কাকপক্ষী অবাধে ঘরে বাইরে ঠেটি ঠুকে বেড়াচ্ছে।
নিঃসাড়ে মহিম বেরিয়ে এল। বিস্ময় নেই, দুঃখ নেই, আনন্দও নেই এমন একটি মুখ নিয়ে এসে দাঁড়াল সে। উমা দেখল, শিল্পী তার রোগা হয়ে গেছে, মাথার চুল বড় বেশি ঝুলে পড়েছে ঘাড়ের দিকে, চোখের কোল বসা। তবু সেই স্বপ্নময় চোখ, হাতে পায়ে মাটি মাখা, মুখে চুলেও মাটি।
উমা দ্রুত দাওয়ায় উঠে এল মহিমের কাছে। উৎকণ্ঠা তার মুখে। বলল, কী হয়েছে তোমার? মহিম হাসবার চেষ্টা করে বলল, কিছু হয় নাই তো। ঘরে আসেন।
উমা ঘরে এসে দেখল অর্ধসমাপ্ত এক কুঁজো মানুষের মূর্তি। প্রাণ চমকাল তার সেই মূর্তির চোখ দুটো দেখে। সে যেদিকে ফেরে সেদিকেই যেন কুঁজোর ঠেলে ওঠা বিহুল মুগ্ধ চোখ দুটো ওকে অনুসরণ করছে। কী দেখছে কুঁজো মুর্তি? কী রকম যন্ত্রণা হতে লাগল উমার বুকে সেই আকুল মুগ্ধ দৃষ্টির সামনে। সে তাড়াতাড়ি মুখ ফিরিয়ে নিল সেদিক থেকে। কিন্তু সে যেদিকে ফেরে সেদিকেই এ ঘরের মূর্তিগুলো আজ যেন বিচিত্র কটাক্ষে তার দিকে তাকিয়ে রইল। এ কী হল তার। সে তাড়াতাড়ি ফিরল মহিমের দিকে। কিন্তু আশ্চর্য! তার শিল্পী যেন আজ এ ঘরের মূর্তিগুলোর সঙ্গে বিচিত্রভাবে মিশে গেছে। সে দ্রুত কাছে এসে মহিমের হাত ধরে বলল, কী দেখছ তুমি?
উমা দেখল মহিম যেন কেমন হয়ে গেছে। তার জীবনে যেন কোন বোঝ চেপে বসেছে যার ভারে মরতে বসেছে তার শিল্পী। সে বলল বলল, এখনও কি তুমি যেতে চাও না। লাঞ্ছনা কি আরও পেতে চাও?
মহিম যেন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল উমার দিকে। উমা বলল, তোমাদের ভিটেবাড়ির কথা সব শুনেছি আমি পরানের মুখে। আমি টাকা দেব, আদালতে জমা দিয়ে তুমি সব মুক্ত করো। মণ্ডলবউকে সব দিয়ে তুমি চলো কলকাতায়। তোমার যে অনেক বড় জীবন পড়ে রয়েছে সেখানে। এ মুহূর্তের জন্য মনে হল উমার গলায় প্রকৃত সরলতা ও আবেগ ফুটে উঠেছে।
মহিম নির্বাক। তার মনের মধ্যে আলোড়িত হয়ে উঠল জীবনের সব বিপর্যয়। হঠাৎ তার মনে হল, সবই যেন শেষ হয়ে গেছে, নয়নপুর যেন ছেড়ে দিয়েছে তাকে। গোবিন্দবনলতা নতুন জীবনে ফিরে গেল, হরেরাম ভরত কুঁজো কানাই মরে গেল। পাগল ঠাকুরের সঙ্গে দিনেকের তরে দেখা হত না কিন্তু তার দেশত্যাগ যেন মহিমের বুকটাও খালি করে দিয়েছে। হরেরামের বাউরি বউ পথে পথে ঘোরে, নয়নপুরের বাতাসও বাউরি হয়েছে। নরহরির গানে শুধু কান্না। সর্বোপরি, অহল্যা আর সে অহল্যা নেই। সেও যেন ছেড়ে দিয়েছে মহিমকে, বন্ধন যেন কেটে গেছে। আর সব সইলেও এ সইল না তার। মানুষ শুধু তার নিজের কথাই চিন্তা করে। মহিমও তাই। একবারও ভেবে দেখল না অহল্যার কথা। কেন সে তার কাছে আসেনি, এ দুর্জয় অভিমানেই অহল্যার উপর মনটা বিরূপ হয়ে উঠতে লাগল তার। একবারও মনে হল না, অহল্যা জীবনের কোন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, কী হারিয়ে কী নিয়ে বসে আছে।
উমা বলল, কী দেখছ মহিম?
মহিম তাকাল উমার দিকে। হ্যাঁ, আকুল আহ্বান রয়েছে ওই চোখে, মিষ্টি ডাক রয়েছে ওই সুন্দর ঠোঁটে, উষ্ণ আলিঙ্গনের জন্য অপেক্ষা করে আছে ওই সুগঠিত আধখোলা বুক।
সে বলল, যাব আপনার সাথে।
আচমকা উল্লাসে মহিমকে দু-হাতে বেষ্টন করে উমা মহিমের চোখে বুলিয়ে দিল তার ঠোঁট।
সমস্ত শরীর ঝিম ধরে রইল মহিমের। মদের নেশার মতো চোখের পাতা বড় ভারী হয়ে গেল, জ্বলতে লাগল। মনে হল সমস্ত জগৎ যেন টলছে।
উমা বলল, আমাদের বাড়িতে যার হাসির কথা জিজ্ঞেস করেছিলে, তার কথা শুনবে?
যেন জ্বরের ঘোরে মহিম বললে, বলেন।
উমা বলল, মহিলাটি আমার খুড়ি শাশুড়ি। বয়স কম। ওঁর স্বামী যখন মারা যান তখন একটি ছেলে ওঁর বছর চারেকের। হঠাৎ ক-দিনের রোগে ছেলেটি মারা যায়। কিন্তু ওঁর ধারণা, সম্পত্তির ওয়ারিশকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য আমার শ্বশুর নাকি মেরে ফেলেছেন ওঁর ছেলেকে। সেই থেকে এরকম হয়ে গেছেন। ব্যাপারটা বাইরের লোকে অবশ্য জানে না। একটু হেসে বলল, তবে এসবই আমার বিয়ের আগে। তোমার বড় ভয় ওই হাসিতে, মা?
একদিন একথা শোনার খুবই আগ্রহ ছিল মহিমের। আজ সে কথা তার কানে গিয়েও গেল না। বিন্দুমাত্র কৌতূহল হল না।
উমার হাসি-মুখের দিকে তাকিয়ে মহিম বলল, ভয় ছিল, আর নাই।
উমা বলল, আমি এখন যাই। পরানকে ডাকতে পাঠাব, তুমি যেয়ো। বলে মহিমের হাতে একটু চাপ দিয়ে উমা আজ বেরিয়ে এল ছায়ামুক্ত মুখে। একবার দেখল বাড়িটার চারদিকে, তারপর পরানের সঙ্গে উচ্ছ্বসিত দ্রুত পদক্ষেপে চলে গেল সে।
মহিম বেরিয়ে মাতালের মতো টলতে টলতে খালের মোহনার পথ ধরে ছুটল। উদার শূন্য আকাশের তল ছাড়া আর কিছু চায় না সে।