২১. অনেকগুলি মাস কেটে গেছে
অনেকগুলি মাস কেটে গেছে।
এতদিনে মহিম অনেক গড়েছে। যা তার ইচ্ছে হয়েছে তাই গড়েছে। কখনও দিগন্তে পাড়ি জমানো ডানা মেলে দেওয়া পাখি, শাবক হারানো উৎকণ্ঠিত দিশেহারা গাভী। গাঁয়েঘরের সবাইকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে তার সুক্ষ্ম কাজ সোনারবরণ ধানের গোছা। সেই ধানের গোছ উপহার দিয়েছে সে তার বাল্যসখী বনলতাকে। আর কাজ করতে করতে হরেরামের বউয়ের কান্না আড়ষ্ট করে দিয়েছে তার হাত, প্রাণ থমকে থেকেছে। তাড়াতাড়ি কাজ ফেলে নিরালায় ছুটে গেছে সে। এ কান্না তার সয় না। কিন্তু গত বছরের কোজাগরী পূর্ণিমার দিন থেকে তার জীবনে যা ঘটে গেছে তার ছায়া যে আজও তার মুখে এক বিচিত্র ছাপ রেখে গেছে। আগের চেয়ে অহল্যার কাছ থেকে সে দূরে সরে গেছে কিছুটা। কিন্তু উভয়ের কী যে বিচিত্র বন্ধন, যখনই মহিমের মনে হয় অকারণে প্রাণটা বড় বেশি ভারী হয়ে উঠেছে, অযথাই কেন যেন বুকের মধ্যে কান্না গুমরে ওঠে তখনই, সে ছুটে আসে অহল্যার কাছে। অহল্যা সেজন্য প্রতীক্ষা করে থাকে। দুজনে পাশাপাশি বসে অনেক কথা অনেকক্ষণ ধরে বলতে থাকে। নয়নপুরের কথা, তার মানুষের কথা, গোবিন্দবনলতার কথা, হরেরাম, তার পাগল বউয়ের কথা, সর্বোপরি মহিমের নিজের মনের বিচিত্র শিল্পী-স্বপ্নের সাধনার কথা।
বলে না শুধু নিজেদের দুজনের কথা, উমার কথা! তবু মহিম মাঝে মাঝে অহল্যাকে ধরে বসে শৈশবের গল্প বলার জন্য। খেলা, ঠাকুর গড়া আর অহল্যার সঙ্গে খুনসুটি করার গল্প। তার বাবা দশরথ মণ্ডলের কথাও জিজ্ঞেস করে সে।
অহল্যা সব কথাই বলে। বলে আর আড়ালে কিছুতেই কান্না সে রোধ করতে পারে না। এ জীবনে বুঝি এ লুকানো কান্নার শেষ নেই।
গোবিন্দের কাছে মহিম আজকাল খুব কমই যায়। আজকাল তার বন্ধু হয়েছে নরহরি বৈরাগী। নরহরি আজকাল অবসর সময়ে খালের মোহনার ধারে বসে থাকে। মহিমও যায়। একজন গান গায়, আর একজন শোনে। দমকা হাওয়ার মতো কখনও কখনও কুঁজো কানাইও আসে।
ইতিপূর্বে আমলা দীনেশ সান্যাল কয়েকদিন এসে গেছে মহিমের কাছে জমিদারের চাকরির প্রস্তাব নিয়ে। মহিম একদিন গিয়েছিল এবং স্পষ্ট জানিয়ে দিয়ে এসেছে, এ প্রস্তাব তার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। জমিদার হেমচন্দ্র ক্ষুব্ধ হয়েছেন, কটু কথা বলেছেন, এমন কী ছদ্মঠে শাসিয়েছেন। কিন্তু মহিম অটল। ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়, এতখানি সম্মানের লোভ সে কেমন করে ছেড়ে দিল।
জমিদার জননেতা বলে গান্ধীজির একখানি আবক্ষ প্রতিমূর্তি চেয়েছিলেন। কিন্তু মহিম তাতেও নারাজ হয়েছে। তিনি হরেরামের মূর্তিটা চেয়েছিলেন, মহিম তাতেও অস্বীকৃত হয়েছে।
এর পরে মহিম ও উমা অদেখার মধ্যে থাকলেও বুঝেছিল, একজনের ডাকা, আর একজনের যাওয়ার সেই পালা খেলাও শেষ হয়েছে। সেদিনও এল। বলল, সাধে কী আর তোদের গাল দিই। হরেরাম চাষার মুণ্ডু অখলের মোষ গড়ে ফষ্টি নষ্টি করছি, সাধা লক্ষ্মী পায়ে ঠেলছি! এখুনি তু বলে ডাক দিলে গণ্ডা কয়েক আর্টিস্ট কলকাতা থেকে ছুটে আসবে। আঁটি বাধা ছেড়েছিস যখন, লেগে পড়।
মহিম সেই একই কথার জবাব দিল, জমিদারের ঠাঁই মুই যাব না।
দীনেশ সান্যাল হেসে চোখ কুঁচকে বলল, তবে বুঝি বউঠাকুরানীর কাছে কলকাতায় যাবি?
হঠাৎ এতদিন বাদে সান্যালের মুখে একথা শুনে চমকে উঠল মহিম। সান্যাল বলল, কুৎসিত মুখভঙ্গি করে, তুই ব্যাটা বেশ খেলোয়াড় আছি। অ্যাকেবারে বউ-শশুরে ঝগড়া লাগিয়ে দিয়েছিস। সেইজন্যই তোকতার অত জেদ তোকে নেবার জন্য।
কথাটা বলে ফেলে সান্যাল অসম্ভব গম্ভীর হয়ে গেল। ভাবল, বোধ হয়, আনাড়ির মতো কথাটা বলে ফেলেছে সে। পরমুহূর্তেই মহিমের কাছে এগিয়ে ফিসফিস করে বলল, তা বেশ তো, ওই দুজনার কাছ থেকেই সেঁড়েমুষে কিছু কামিয়ে নে না।
কিন্তু আচমকা অন্ধকারে সাপের ফোঁস করে ওঠার মতো রান্নাঘরের দরজায় এসে অহল্যা বলে উঠল, মোরা কাউকে সেঁড়েমুষে কামাতেও চাই না আর কত্তারে বলে দিয়ে বাবু, তাদের বউ-শশুরের টানা পোড়েনের মধ্যে মোরা যাব না।
সান্যাল একমুহূর্ত চুপ করে বলল, কে, ভরতের বউ না? তা বেশ বলেছ, মণ্ডলবউ। ও-সব হেফাজতের দরকার কি গরিব মানুষের। ওরে জমিদারের সঙ্গে বিবাদ করাটা—
অহল্যা বলল, বিবাদ চাই না, সুবাদও চাই না। যেমন আছি তেমনি থাকব।
সান্যাল চোখ কুঁচকে চিবিয়ে বলল, তা কি থাকতে পারবে। মামলায় যে ভরত কাত মারতে বসেছে। তার মধ্যে তোমার দেওর আবার আটিস্ট হয়েছে। বলে হো হো করে হেসে উঠল। যেতে যেতে ফিরে আবার মহিমের কাছে এসে বলল, তা তোকে একটা বলি। আমার ছেলেটাকে তোর কারিগরি একটু শিখিয়ে দে না, ওকেই না হয় লাগিয়ে দিই? জবাবের প্রত্যাশায় আগ্রহে সান্যালের কপালের রেখাগুলো সাপের মতো এঁকেবেঁকে উঠল।
একমুহূর্ত নীরব থেকে মহিম বলল, ছেলে আপনার শেষটায় আমের আঁটির ভেঁপু ফুকে বেড়াবে, দরকার কি সানেল মশাই?
সান্যাল খোঁচা খাওয়া জানোয়ারের মতো দু-পা পেছিয়ে এসে একটা তীব্র ক্রুদ্ধ কটাক্ষ করে লাঠি ইকে বেরিয়ে গেল।
কয়েকদিন পর সন্ধ্যাবেলা ভরত এল সদর থেকে অসহ্য মাথা ধরা আর তীব্র জ্বর নিয়ে। দু-হাতে অহল্যার কাঁধে ভর দিয়ে বলল, তিন মাসের মেয়াদ দিয়েছে রে বড়বউ, দেনা শোধ না হলে ভিটেমাটি সবই যাবে। কিন্তু ভাবি অধম্মের একী জাদু রে, মুই হইলাম দেনদার জমিদারের কাছে!
এত বড় শোক সামলাতে না পেরে ভরত বিছানা নিল। অহল্যা স্বামীর বিছানা আঁকড়ে পড়ে রইল দিনের পর দিন। ভরতের বুকে মাথা রেখে বুকের কান্না চাপে সে। যত অবস্থা খারাপ হয় ভরতের ততই চাপা কান্না বাড়ে অহল্যার। এক বিচিত্র অনুশোচনা বাসা বেঁধেছে তার মনে যে, এ মানুষটিকে সে তার সব পাওনা বুঝি মেটায়নি। বুক তার তীব্র দহনে জ্বলে গেল। হায়, ভরত কেন তার সবটুকু আদায় করে নিল না। কিন্তু নিতে চাইলেই কি ভরতের তা মিলত? তেমন করে তো অহল্যার কোনও দিন মনেও পড়েনি। গর্তে বসে যাওয়া চোখে যেন সব আশা নির্বাপিত হতে বসেছে তার। যে আশায় বুক বেঁধে মাদুলি জলপড়া ঝাড়ফুঁক সবই করেছে, যে আশায় নিরালায় বিবস্ত্র হয়ে মুগ্ধ চোখে নিজেকে দেখেছে, সে ক্ষীণ আশা আজ নিঃশেষ হতে বসেছে বুঝি। আর কেবলি মনে হয়, ভরতকে সবটুকু দিলে বুঝি তার সে আশা পূর্ণ হত বা।
কিন্তু এর চেয়েও প্রচণ্ড বৈচিত্র্য ও বিপর্যয় লুকিয়ে ছিল তার মনের মধ্যে। তার প্রকাশ পেল, যখন সে দেখল উঠোনে গত বছরের মতো পরানকে এসে দাঁড়াতে উমার ডাক নিয়ে। আবার বউঠাকুরানী! চোখ ধকধক করে জ্বলে উঠল অহল্যার। সব ভুলে নিমেষে ভরতের বুক ছেড়ে উঠে এল সে। রোগা মুখ তার জ্বররা তাপে যেন তমতমে, তীব্র নিষ্ঠুর হাসিতে ঠোঁট বেঁকে উঠেছে।
পরান সে মুখ দেখে বিমুঢ় হয়ে গেল।
মহিম বলল, আজ মুই যেতে পারব না পরানদা।
তীব্র গলায় অহল্যা বলল, কোনও দিনই যেতে পারবে না।
জবাব নিয়ে পরান চলে গেল। তেমনি ব্যঙ্গ নিষ্ঠুর হাসি নিয়ে অহল্যা সেই দিকে তাকিয়ে রইল।
মহিম তাড়াতাড়ি কাছে এসে বলল, কী হইছে তোমার বউদি?
কিছু না।
তুমি কি মোরে অবিশ্বাস করো?
অবিশ্বাস! চমকে উঠল অহল্যা, শান্ত হয়ে এল তার মুখ, আগুন নিভল চোখের। গলা বন্ধ হয়ে এল কান্নায়। কান্নার তুফান বুঝি। কেবল বার বার মাথা নাড়ল, না না না…! ছুটে গেল সে ভরতের কাছে, ভরতের বুকে।
ভরত একটু বোধ হয় ভাল ছিল। বলল, কাঁদবার ঢের সময় পাবি বড়বউ, এখন থাক। তোকে একটা কথা বলব আজ।
কথা! ভয় হল অহল্যার। কী কথা বলবে ভরত। ভরত বলল, মরেও মোর শান্তি নেই তোর জন্য। তোকে তো কিছুই দিতে পারলাম না। …দ্যাখ, সদরের ডাক্তার একবার বলেছিল, বাঁজা শুধু মেয়েমানুষ হয় না, পুরুষেও হয়। বলতে বলতে আঁপিয়ে ওঠে ভরত। একটু চুপ থাকে। অহল্যার বুক কাঁপে। তার হাত একটা নিজের হাতে নিয়ে বলল ভরত, মুইও বাঁজা হতে পারি। মুই মরলে তুই আবার বিয়া বসিস। বুকে তোর ছাওয়াল আসতেও বা পারে।
অহল্যার মুখটা পুড়ে যেন ছাই হয়ে গেল। ভরতের বুকের কাছে মুখ গুঁজে বার বার বলতে লাগল সে, একী বলছ তুমি, একী বলছ গো!
ভরত বলল, জানতাম বললে তুই কাঁদবি। ভেবে দেখিস। তারপর বলল, মহী কুনঠাই?
মহিম এসব শুনে বেড়ায় মুখ চেপে কান্না রোধ করছিল। তাড়াতাড়ি এল ভরতের কাছে। ভরত বলল, তুই মোরে শনি বলছিলি, মুই তোরে মার দিছিলাম না রে?
মহিম তাড়াতাড়ি উদগত কান্না চেপে বলল, এ-সব কী বলছ দাদা?
ভরতের মৃত্যুন্মুখ সুষ্ঠু মুখ উৎকণ্ঠায় ভরে উঠল। বলল, কিন্তুক কুনঠাঁই মাথা গুঁজবি তোরা? বাঁচবি কেমন করে?
এই ভরতের শেষ কথা। সেই রাত্রেই মারা গেল সে।