নৌকাডুবি (16-20)
নৌকাডুবি ১৬
চিঠি বিলি করিয়া দিতে রাত হইয়া পড়িল। রমেশ শুইতে গেল, কিন্তু ঘুম হইল না। তাহার মনের ভিতরে গঙ্গাযমুনার মতো সাদা-কালো দুই রঙের চিন্তাধারা প্রবাহিত হইতেছিল। দুইটার কল্লোল একসঙ্গে মিশিয়া তাহার বিশ্রামক্ষণকে মুখর করিয়া তুলিতেছিল।
বারকয়েক পাশ ফিরিয়া সে উঠিয়া পড়িল। জানালার কাছে দাঁড়াইয়া দেখিল তাহাদের জনশূন্য গলির এক পাশে বাড়িগুলির ছায়া, আর-এক পাশে শুভ্র জ্যোৎস্নাররেখা।
রমেশ স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। যাহা নিত্য, যাহা শান্ত, যাহা বিশ্বব্যাপী, যাহার মধ্যে দ্বন্দ্ব নাই, দ্বিধা নাই, রমেশের সমস্ত অন্তঃপ্রকৃতি বিগলিত হইয়া তাহার মধ্যে পরিব্যাপ্ত হইয়া গেল। যে শব্দবিহীন সীমাবিহীন মহালোকের নেপথ্য হইতে চিরকাল ধরিয়া জন্ম এবং মৃত্যু, কর্ম এবং বিশ্রাম, আরম্ভ এবং অবসান, কোন্ অশ্রুত সংগীতের অপরূপ তালে বিশ্বরঙ্গভূমির মধ্যে প্রবেশ করিতেছে–রমেশ সেই আলো-অন্ধকারের অতীত দেশ হইতে নরনারীর যুগল প্রেমকে এই নক্ষত্রদীপালোকিত নিখিলের মধ্যে আবির্ভূত হইতে দেখিল।
রমেশ তখন ধীরে ধীরে ছাদের উপর উঠিল। অন্নদাবাবুর বাড়ির দিকে চাহিল। সমস্ত নিস্তব্ধ। বাড়ির দেয়ালের উপরে, কার্নিসের নীচে, জানালা-দরজার খাঁজের মধ্যে, চুনবালি-খসা ভিতের গায়ে জ্যোৎস্না এবং ছায়া বিচিত্র আকারের রেখা ফেলিয়াছে।
এ কী বিসময়! এই জনপূর্ণ নগরের মধ্যে ঐ সামান্য গৃহের ভিতরে একটি মানবীর বেশে এ কী বিসময়! এই রাজধানীতে কত ছাত্র, কত উকিল, কত প্রবাসী ও নিবাসী আছে, তাহার মধ্যে রমেশের মতো একজন সাধারণ লোক কোথা হইতে একদিন আশ্বিনের পীতাভ রৌদ্রে ঐ বাতায়নে একটি বালিকার পাশে নীরবে দাঁড়াইয়া জীবনকে ও জগৎকে এক অপরিসীম-আনন্দময় রহস্যের মাঝখানে ভাসমান দেখিল–এ কী বিস্ময়! হৃদয়ের ভিতরে আজ এ কী বিসময়, হৃদয়ের বাহিরে আজ এ কী বিস্ময়!
অনেক রাত্রি পর্যন্ত রমেশ ছাদে বেড়াইল। ধীরে ধীরে কখন এক সময়ে খণ্ড-চাঁদ সম্মুখের বাড়ির আড়ালে নামিয়া গেল। পৃথিবীতলে রাত্রির কালিমা ঘনীভূত হইল–আকাশ তখনো বিদায়োন্মুখ আলোকের আলিঙ্গনে পাণ্ডুবর্ণ।
রমেশের ক্লান্ত শরীর শীতে শিহরিয়া উঠিল। হঠাৎ একটা আশঙ্কা থাকিয়া থাকিয়া তাহার হৃৎপিণ্ডকে চাপিয়া ধরিতে লাগিল। মনে পড়িয়া গেল জীবনের রণক্ষেত্রে কাল আবার সংগ্রাম করিতে বাহির হইতে হইবে। ঐ আকাশে যদিও চিন্তার রেখা নাই, জ্যোৎস্নার মধ্যে চেষ্টার চাঞ্চল্য নাই, রাত্রি যদিও নিস্তব্ধ শান্ত, বিশ্বপ্রকৃতি ঐ অগণ্য নক্ষত্রলোকের চিরকর্মের মধ্যে চিরবিশ্রামে বিলীন–তবু মানুষের আনাগোনা যোঝাযুঝির অন্ত নাই, সুখে-দুঃখে বাধায়-বিঘ্নে সমস্ত জনসমাজ তরঙ্গিত। এক দিকে অনন্তের ঐ নিত্য শান্তি, আর-এক দিকে সংসারের এই নিত্য সংগ্রাম–দুই একই কালে একসঙ্গে কেমন করিয়া থাকিতে পারে, দুশ্চিন্তার মধ্যেও রমেশের মনে এই প্রশ্নের উদয় হইল। কিছুক্ষণ পূর্বে রমেশ বিশ্বলোকের অন্তঃপুরের মধ্যে প্রেমের যে একটি শাশ্বত সম্পূর্ণ শান্ত মূর্তি দেখিয়াছিল, সেই প্রেমকেই ক্ষণকাল পরে সংসারের সংঘর্ষে, জীবনের জটিলতায়, পদে-পদে ক্ষুব্ধ ক্ষুণ্ন দেখিতে লাগিল। ইহার মধ্যে কোন্টা সত্য, কোন্টা মায়া?
নৌকাডুবি ১৭
পরদিন সকালের গাড়িতে যোগেন্দ্র পশ্চিম হইতে ফিরিয়া আসিল। আজ শনিবার, কাল রবিবারে হেমনলিনীর বিবাহের কথা। কিন্তু যোগেন্দ্র তাহাদের বাসার দ্বারের কাছে আসিয়া উৎসবের স্বাদগন্ধ কিছুই পাইল না। যোগেন্দ্র মনে করিয়া আসিতেছিল এতক্ষণে তাহাদের বাসার বারান্দার উপর দেবদারুপাতার মালা ঝোলানো শুরু হইয়াছে–কাছে আসিয়া দেখিল, শ্রীহীন মালিন্যে পাশের বাড়ির সঙ্গে তাহাদের বাড়ির কোনো প্রভেদ নাই।
ভয় হইল পাছে কাহারো অসুখ-বিসুখ করিয়া থাকে। বাড়িতে প্রবেশ করিয়া দেখিল চায়ের টেবিলে তাহার জন্য আহারাদি প্রস্তুত রহিয়াছে এবং অন্নদাবাবু অর্ধভুক্ত চায়ের পেয়ালা সম্মুখে রাখিয়া খবরের কাগজ পড়িতেছেন।
যোগেন্দ্র ঘরে ঢুকিয়াই জিজ্ঞাসা করিল, “হেম কেমন আছে?” অন্নদা। ভালো। যোগেন্দ্র। বিবাহের কী হইল? অন্নদা। কাল রবিবারের পরের রবিবারে হইবে। যোগেন্দ্র। কেন? অন্নদা। কেন, তাহা তোমার বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করো। রমেশ আমাদের কেবল এইটুকু জানাইয়াছে যে, তাহার বিশেষ প্রয়োজন আছে, এ রবিবারে বিবাহ বন্ধ রাখিতে হইবে।
যোগেন্দ্র তাহার অক্ষম বাপের উপরে মনে মনে বিরক্ত হইয়া কহিল, “বাবা, আমি না থাকিলে তোমাদের নানান গলদ ঘটে। রমেশের আবার প্রয়োজন কিসের? সে স্বাধীন। তাহার আত্মীয় বলিতে কেহ নাই বলিলেই হয়। যদি তাহার বৈষয়িক বিশেষ কোনো গোলযোগ ঘটিয়া থাকে, সে কথা খুলিয়া বলিবার কোনো বাধা দেখি না। রমেশকে তুমি এত সহজে ছাড়িয়া দিলে কেন?”
অন্নদা। আচ্ছা, বেশ তো, সে তো এখনো পালায় নাই–তুমিই তাহাকে প্রশ্ন করিয়া দেখো-না। যোগেন্দ্র শুনিয়া তৎক্ষণাৎ এক পেয়ালা গরম চা তাড়াতাড়ি নিঃশেষ করিয়া বাহির হইয়া গেল। অন্নদাবাবু কহিলেন, “আহা যোগেন, এত তাড়াতাড়ি কিসের? তোমার যে খাওয়া হইল না।” সে কথা যোগেন্দ্রের কানে পৌঁছিল না। সে রমেশের বাসায় ঢুকিয়া সশব্দ দ্রুতপদে সিঁড়ি বাহিয়া উপরে উঠিয়া গেল।–”রমেশ! রমেশ!”–রমেশের কোনো সাড়া নাই। ঘরে ঘরে খুঁজিয়া দেখিল–রমেশ শুইবার ঘরে নাই, বসিবার ঘরে নাই, ছাদে নাই, একতলায় নাই। অনেক ডাকাডাকির পর বেহারাটাকে সন্ধান করিয়া লইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “বাবু কোথায়?”
বেহারা কহিল, “বাবু তো ভোরে বাহির হইয়া গেছেন।” যোগেন্দ্র। কখন আসিবে? বেহারা জানাইল–বাবু তাঁহার কতক-কতক কাপড়-চোপড় লইয়া চলিয়া গেছেন। বলিয়া গেছেন ফিরিয়া আসিতে তাঁহার চার-পাঁচ দিন দেরি হইতে পারে। কোথায় গেছেন তাহা বেহারা জানে না। যোগেন্দ্র গম্ভীর হইয়া চায়ের টেবিলে ফিরিয়া আসিল। অন্নদাবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী হইল?” যোগেন্দ্র বিরক্ত হইয়া কহিল, “হইবে আর কী, যাহার সঙ্গে আজ বাদে কাল মেয়ের বিবাহ দিবে তাহার কী কাজ পড়িয়াছে, সে কখন কোথায় থাকে, তাহার খোঁজখবর তোমরা কিছুই রাখ না। অথচ তোমার বাড়ির পাশেই তাহার বাসা।” অন্নদাবাবু কহিলেন, “কেন, কাল রাত্রেও তো রমেশ ঐ বাসাতেই ছিল।” যোগেন্দ্র উত্তেজিত হইয়া কহিল, “তোমরা জান না সে কোথায় যাইবে, তাহার বেহারা জানে না সে কোথায় গেছে, এ কিরকম লুকোচুরি ব্যাপার চলিতেছে? আমার কাছে এ তো কিছুই ভালো ঠেকিতেছে না। বাবা, তুমি এমন নিশ্চিন্ত আছ কী করিয়া?”
অন্নদাবাবু এই ভর্ৎসনায় হঠাৎ অত্যন্ত চিন্তিত হইবার চেষ্টা করিলেন। গম্ভীর মুখ করিয়া কহিলেন, “তাই তো, এ-সব কী?”
কাণ্ডজ্ঞানহীন রমেশ অনায়াসে কাল রাত্রে অন্নদাবাবুর কাছে বিদায় লইয়া যাইতে পারিত। কিন্তু সে কথা তাহার মনে উদয়ও হয় নাই। ঐ-যে সে ‘বিশেষ প্রয়োজন আছে’ বলিয়া রাখিয়াছে, তাহার মধ্যেই তাহার সকল কথা বলা হইয়া গেছে এইরূপ রমেশের ধারণা। ঐ এক কথাতেই আপাতত সকল রকমের ছুটি পাইয়াছে জানিয়া সে তাহার উপস্থিত কর্তব্যসাধনে বিব্রত হইয়া বেড়াইতেছে।
যোগেন্দ্র। হেমনলিনী কোথায়?
অন্নদাবাবু। সে আজ সকাল-সকাল চা খাইয়া উপরেই গেছে।
নৌকাডুবি ১৭ (২)
যোগেন্দ্র কহিল, “রমেশের এই-সমস্ত অদ্ভুত আচরণে বেচারা বোধ হয় অত্যন্ত লজ্জিত হইয়া আছে-সেইজন্য সে আমার সঙ্গে দেখা হইবার ভয়ে পালাইয়া রহিয়াছে।”
সংকুচিত ও ব্যথিত হেমনলিনীকে আশ্বাস দিবার জন্য যোগেন্দ্র উপরে গেল। হেমনলিনী তাহাদের বড়ো ঘরে চৌকির উপরে চুপ করিয়া একা বসিয়া ছিল। যোগেন্দ্রের পদশব্দ শুনিয়াই সে তাড়াতাড়ি একটা বই টানিয়া লইয়া পড়িবার ভান করিল। যোগেন্দ্র ঘরে আসিতেই বই রাখিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া হাসিমুখে কহিল, “এই-যে দাদা, কখন এলে? তোমাকে তো তেমন বিশেষ ভালো দেখাইতেছে না।”
যোগেন্দ্র চৌকিতে বসিয়া-পড়িয়া কহিল, “ভালো দেখাইবার তো কথা নয়। আমি সব কথা শুনিয়াছি হেম! কিন্তু এ সম্বন্ধে তুমি কোনো চিন্তা করিয়ো না। আমি ছিলাম না বলিয়াই এইরকম গোলমাল ঘটিতে পারিয়াছে। আমি সমস্ত ঠিক করিয়া দিব। আচ্ছা হেম, রমেশ তোমাকে কোনো কারণ বলে নাই?”
হেমনলিনী মুশকিলে পড়িল। রমেশ সম্বন্ধে এই-সকল সন্দিগ্ধ আলোচনা তাহার পক্ষে অসহ্য হইয়া উঠিয়াছে। রমেশ তাহাকে বিবাহদিন পিছাইবার কোনো কারণ বলে নাই, এ কথা যোগেন্দ্রকে বলিতে তাহার ইচ্ছা নাই, অথচ মিথ্যা বলাও তাহার পক্ষে অসম্ভব। হেমনলিনী কহিল, “তিনি আমাকে কারণ বলিতে প্রস্তুত ছিলেন, আমি শোনা দরকার মনে করি নাই।”
যোগেন্দ্র মনে করিল, ইহা গুরুতর অভিমানের কথা এবং এরূপ অভিমান সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। কহিল, “আচ্ছা, তুমি কিছুই ভয় করিয়ো না, ‘কারণ’ আমি আজই বাহির করিয়া আনিব।”
হেমনলিনী কোলের বইখানার পাতা অনাবশ্যক উল্টাইতে উল্টাইতে কহিল, “দাদা, আমি ভয় কিছুই করি না। ‘কারণ’ বাহির করিবার জন্য তুমি তাঁহাকে পীড়াপীড়ি কর, এমন আমার ইচ্ছা নয়।”
যোগেন্দ্র ভাবিল, ইহাও অভিমানের কথা। কহিল, “আচ্ছা, সে তোমাকে কিছুই ভাবিতে হইবে না।” বলিয়া তখনি চলিয়া যাইতে উদ্যত হইল।
হেমনলিনী তখনি চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া কহিল, “না দাদা, এ কথা লইয়া তুমি তাঁহার সঙ্গে আলোচনা করিতে যাইতে পারিবে না। তোমরা তাঁহাকে যাহাই মনে কর-না কেন, আমি তাঁহাকে কিছুমাত্র সন্দেহ করি না।”
তখন যোগেন্দ্রের হঠাৎ মনে হইল, এ তো অভিমানের মতো শুনাইতেছে না। তখন স্নেহমিশ্রিত করুণায় তাহার মনে মনে হাসি পাইল। ভাবিল, ইহাদের সংসারের জ্ঞান কিছুই নাই; এ দিকে পড়াশুনা এত করিয়াছে, পৃথিবীর খোঁজখবরও অনেক রাখে, কিন্তু কোন্খানে সন্দেহ করিতে হইবে সে অভিজ্ঞতাটুকুও ইহার হয় নাই। এই নিঃসংশয় নির্ভরের সহিত রমেশের ছদ্মব্যবহারের তুলনা করিয়া যোগেন্দ্র মনে মনে রমেশের উপর আরো চটিয়া উঠিল। ‘কারণ’ বাহির করিবার প্রতিজ্ঞা তাহার মনে আরো দৃঢ় হইল। যোগেন্দ্র দ্বিতীয় বার চলিয়া যাইবার উপক্রম করিলে হেমনলিনী কাছে গিয়া তাহার হাত ধরিয়া কহিল, “দাদা, তুমি প্রতিজ্ঞা করো যে, তাঁহার কাছে এ-সব কথা একেবারে উত্থাপনমাত্র করিবে না।”
যোগেন্দ্র কহিল, “সে দেখা যাইবে।”
হেমনলিনী। না দাদা, দেখা যাইবে না। আমার কাছে কথা দিয়া যাও। আমি তোমাদের নিশ্চয় বলিতেছি তোমাদের কোনো চিন্তার বিষয় নাই। একটিবার আমার এই একটি কথা রাখো।”
নৌকাডুবি ১৭ (৩)
হেমনলিনীর এইরূপ দৃঢ়তা দেখিয়া যোগেন্দ্র ভাবিল তবে নিশ্চয় রমেশ হেমের কাছে সকল কথা বলিয়াছে, কিন্তু হেমকে যাহা-তাহা বলিয়া ভুলানো তো শক্ত নয়। কহিল, “দেখো হেম, অবিশ্বাসের কথা হইতেছে না। কন্যাপক্ষের অভিভাবকদের যাহা কর্তব্য তাহা করিতে হইবে তো। তোমার সঙ্গে তার যদি কিছু বোঝাপড়া হইয়া থাকে সে তোমারই জান, কিন্তু সেই হইলেই তো যথেষ্ট হইল না–আমাদের সঙ্গেও তাহার বোঝাপড়া করিবার আছে। সত্য কথা বলিতে কি হেম, এখন তোমার চেয়ে আমাদেরই সঙ্গে তাহার বোঝাপড়ার সম্পর্ক বেশি–বিবাহ হইয়া গেলে তখন আমাদের বেশি কথা বলিবার থাকিবে না।”
এই বলিয়া যোগেন্দ্র তাড়াতাড়ি চলিয়া গেল। ভালোবাসা যে আড়াল, যে আবরণ খোঁজে, সে আর রহিল না। হেমনলিনী ও রমেশের যে সম্বন্ধ ক্রমে বিশেষভাবে ঘনিষ্ঠ হইয়া দুই জনকে কেবল দুই জনেরই করিয়া দিবে, আজ তাহারই উপরে দশ জনের সন্দেহের কঠিন স্পর্শ আসিয়া বারংবার আঘাত করিতেছে। চারি দিকের এইসেকল আন্দোলনের অভিঘাতে হেমনলিনী এমনি ব্যথিত হইয়া আছে যে, আত্মীয়বন্ধুদের সহিত সাক্ষাৎমাত্রও তাহাকে কুণ্ঠিত করিয়া তুলিতেছে। যোগেন্দ্র চলিয়া গেলে হেমনলিনী চৌকিতে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল।
যোগেন্দ্র বাহিরে যাইতেই অক্ষয় আসিয়া কহিল, “এই-যে, যোগেন আসিয়াছ। সব কথা শুনিয়াছ তো? এখন তোমার কী মনে হইতেছে?”
যোগেন্দ্র। মনে তো অনেক রকম হইতেছে, সে-সমস্ত অনুমান লইয়া মিথ্যা বাদানুবাদ করিয়া কী হইবে? এখন কি চায়ের টেবিলে বসিয়া মনস্তত্ত্বের সূক্ষ্ম আলোচনার সময়?
অক্ষয়। তুমি তো জানই সূক্ষ্ম আলোচনাটা আমার স্বভাব নয়, তা মনস্তত্ত্বই বলো, দর্শনই বলো, আর কাব্যই বলো। আমি কাজের কথাই বুঝি ভালো–তোমার সঙ্গে সেই কথাই বলিতে আসিয়াছি।
অধীরস্বভাব যোগেন্দ্র কহিল, “আচ্ছা, কাজের কথা হবে। এখন বলিতে পারো রমেশ কোথায় গেছে?”
অক্ষয় কহিল, “পারি।”
যোগেন্দ্র প্রশ্ন করিল, “কোথায়?”
অক্ষয় কহিল, “এখন সে আমি তোমাকে বলিব না–আজ তিনটার সময় একেবারে তোমাকে রমেশের সঙ্গে দেখা করাইয়া দিব।”
যোগেন্দ্র কহিল, “কাণ্ডখানা কী বলো দেখি। তোমরা সবাই যে মূর্তিমান হেঁয়ালি হইয়া উঠিলে। আমি এই ক’দিন মাত্র বেড়াইতে গেছি, সেই সুযোগে পৃথিবীটা এমন ভয়ানক রহস্যময় হইয়া উঠিল! না না অক্ষয়, অমন ঢাকাঢাকি করিলে চলিবে না।”
অক্ষয়। শুনিয়া খুশি হইলাম। ঢাকাঢাকি করি নাই বলিয়া আমার পক্ষে একপ্রকার অচল হইয়া উঠিয়াছে-তোমার বোন তো আমার মুখ দেখা বন্ধ করিয়াছেন, তোমার বাবা আমাকে সন্দিগ্ধপ্রকৃতি বলিয়া গালি দেন, আর রমেশবাবুও আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হইলে আনন্দে রোমাঞ্চিত হইয়া উঠেন না। এখন কেবল তুমিই বাকি আছ। তোমাকে আমি ভয় করি–তুমি সূক্ষ্ম আলোচনার লোক নও, মোটা কাজটাই তোমার সহজে আসে–আমি কাহিল মানুষ, তোমার ঘা আমার সহ্য হইবে না।
যোগেন্দ্র। দেখো অক্ষয়, তোমার ঐ-সকল প্যাঁচালো চাল আমার ভালো লাগে না। বেশ বুঝিতেছি একটা কী খবর তোমার বলিবার আছে, সেটাকে আড়াল করিয়া অমন দর-বৃদ্ধি করিবার চেষ্টা করিতেছ কেন? সরলভাবে বলিয়া ফেলো, চুকিয়া যাক।
অক্ষয়। আচ্ছা বেশ, তাহা হইলে গোড়া হইতেই বলি–তুমি অনেক কথাই জান না।
নৌকাডুবি ১৮
রমেশ দরজিপাড়ায় যে বাসায় ছিল, সে বাসার মেয়াদ উত্তীর্ণ হইয়া যায় নাই, তাহা আর-কাহাকেও ভাড়া দেওয়া সম্বন্ধে রমেশ চিন্তা করিবার অবসর পায় নাই। সে এই কয়েক মাস সংসারের বাহিরে উধাও হইয়া গিয়াছিল, লাভক্ষতিকে বিচারের মধ্যেই আনে নাই। আজ সে প্রত্যুষে সেই বাসায় গিয়া ঘর-দুয়ার সাফ করাইয়া লইয়াছে, তক্তপোশের উপর বিছানা পাতাইয়াছে এবং আহারাদিরও বন্দোবস্ত করিয়া রাখিয়াছে। আজ ইস্কুলে ছুটির পর কমলাকে আনিতে হইবে।
সে এখনো দেরি আছে। ইতিমধ্যে রমেশ তক্তপোশের উপর চিত হইয়া ভবিষ্যতের কথা ভাবিতে লাগিল। এটোয়া সে কখনো দেখে নাই–কিন্তু পশ্চিমের দৃশ্য কল্পনা করা কঠিন নহে। শহরের প্রান্তে তাহার বাড়ি-তেরুশ্রেণীদ্বারা ছায়াখচিত বড়ো রাস্তা তাহার বাগানের ধার দিয়া চলিয়া গেছে–রাস্তার ও পারে প্রকাণ্ড মাঠ, তাহার মাঝে মাঝে কূপ, মাঝে মাঝে পশুপক্ষী তাড়াইবার জন্য মাচা বাঁধা। ক্ষেত্রসেচনের জন্য গোরু দিয়া জল তোলা হইতেছে, সমস্ত মধ্যাহ্নে তাহার করুণ শব্দ শোনা যায়–রাস্তা দিয়া প্রচুর ধুলা উড়াইয়া মাঝে মাঝে এক্কাগাড়ি ছুটিয়াছে, তাহার ঝন্ ঝন্ শব্দে রৌদ্রদগ্ধ আকাশ জাগিয়া উঠিতেছে। এই সুদূর প্রবাসের প্রখর তাপ, উদাস মধ্যাহ্ন ও শূন্য নির্জনতার মধ্যে সে তাহার রুদ্ধদ্বার বাংলাঘরে সমস্ত দিন হেমনলিনীকে একা কল্পনা করিতে গেলে ক্লেশ অনুভব করিত। তাহার পাশে চিরসখীরূপে কমলাকে দেখিয়া সে আরামবোধ করিল।
রমেশ ঠিক করিয়াছে, এখন সে কমলাকে কিছু বলিবে না। বিবাহের পর হেমনলিনী তাহাকে বুকের উপর টানিয়া লইয়া সুযোগ বুঝিয়া সকরুণ স্নেহের সহিত ক্রমে ক্রমে তাহাকে তাহার প্রকৃত ইতিহাস জানাইবে, যত অল্প বেদনা দিয়া সম্ভব কমলার জীবনের এই জটিল রহস্যজাল ধীরে ধীরে ছাড়াইয়া দিবে। তাহার পরে সেই দূর বিদেশে তাহাদের পরিচিত সমাজের বাহিরে, কোনোপ্রকার আঘাত না পাইয়া কমলা অতি সহজেই তাহাদের সঙ্গে মিশিয়া আপনার হইয়া যাইবে।
তখন দ্বিপ্রহরে গলি নিস্তব্ধ; যাহারা আপিসে যাইবার, তাহারা আপিসে গেছে, যাহারা না যাইবার, তাহারা দিবানিদ্রার আয়োজন করিতেছে। অনতিতপ্ত আশ্বিনের মধ্যাহ্নটি মধুর হইয়া উঠিয়াছে–আগামী ছুটির উল্লাস এখনি যেন আকাশকে আনন্দের আভাস দিয়া মাখাইয়া রাখিয়াছে। রমেশ তাহার নির্জন বাসায় নিস্তব্ধ মধ্যাহ্নে সুখের ছবি উত্তরোত্তর ফলাও করিয়া আঁকিতে লাগিল।
এমন সময়ে খুব একটা ভারী গাড়ির শব্দ শোনা গেল। সে গাড়ি রমেশের বাসার দ্বারের কাছে আসিয়া থামিল। রমেশ বুঝিল, ইস্কুলের গাড়ি কমলাকে পৌঁছাইয়া দিতে আসিতেছে। তাহার বুকের ভিতরটা চঞ্চল হইয়া উঠিল। কমলাকে কিরূপ দেখিবে, তাহার সঙ্গে কী ভাবে কথাবার্তা হইবে, কমলাই বা রমেশকে কী ভাবে গ্রহণ করিবে, হঠাৎ এই চিন্তা তাহাকে আন্দোলিত করিয়া তুলিল।
নীচে তাহার দুই জন চাকর ছিল–প্রথমে তাহারা ধরাধরি করিয়া কমলার তোরঙ্গ লইয়া আসিয়া বারান্দায় রাখিল–তাহার পশ্চাতে কমলা ঘরের দ্বারের সম্মুখ পর্যন্ত আসিয়া থমকিয়া দাঁড়াইল, ভিতরে প্রবেশ করিল না।
রমেশ কহিল, “কমলা, ঘরে এসো।”
কমলা একটা সংকোচের আক্রমণ কাটাইয়া লইয়া ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। ছুটির সময়ে রমেশ তাহাকে বিদ্যালয়ে ফেলিয়া রাখিতে চাহিয়াছিল, সে কান্নাকাটি করিয়া চলিয়া আসিয়াছে, এই ঘটনায় এবং কয়েক মাসের বিচ্ছেদে রমেশের সঙ্গে তাহার যেন একটু মনের ছাড়াছাড়ি হইয়া গেছে। তাই কমলা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া রমেশের মুখের দিকে না চাহিয়া একটুখানি ঘাড় বাঁকাইয়া খোলা দরজার বাহিরে চাহিয়া রহিল।
রমেশ কমলাকে দেখিবামাত্র বিস্মিত হইয়া উঠিল। যেন তাহাকে আর-একবার নূতন করিয়া দেখিল। এই কয় মাসে তাহার আশ্চর্য পরিবর্তন ঘটিয়াছে। অনতি-পল্লবিতা লতার মতো সে অনেকটা বাড়িয়া উঠিয়াছে। পাড়াগেঁয়ে মেয়েটির অপরিস্ফুট সর্বাঙ্গে প্রচুর স্বাসেথ্যর যে একটি পরিপুষ্টতা ছিল, সে কোথায় গেল? তাহার গোলগাল মুখটি ঝরিয়া লম্বা হইয়া একটি বিশেষত্ব লাভ করিয়াছে, তাহার গালদুটি পূর্বের শ্যামাভ চিক্কণতা ত্যাগ করিয়া কোমল পাণ্ডুবর্ণ হইয়া আসিয়াছে, এখন তাহার গতিবিধি-ভাবভঙ্গিতে কোনোপ্রকার জড়তা নাই। আজ ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া যখন সে ঋজুদেহে ঈষৎ-বঙ্কিম-মুখে খোলা জানালার সম্মুখে দাঁড়াইল, তাহার মুখের উপরে শরৎ-মধ্যাহ্নের আলো আসিয়া পড়িল, তাহার মাথায় কাপড় নাই, অগ্রভাগে লাল ফিতার গ্রনিথবাঁধা বেণীটি পিঠের উপরে পড়িয়াছে, ফিকে হলদে রঙের মেরিনোর শাড়ি তাহার স্ফুটনোন্মুখ শরীরকে আঁটিয়া বেষ্টন করিয়াছে–তখন রমেশ তাহার দিকে কিছুক্ষণ চাহিয়া চুপ করিয়া রহিল।
নৌকাডুবি ১৮ (২)
কমলার সৌন্দর্য এই কয় মাসে রমেশের মনে আবছায়ার মতো হইয়া আসিয়াছিল, আজ সেই সৌন্দর্য নবতর বিকাশ লাভ করিয়া হঠাৎ তাহাকে চমক লাগাইয়া দিল। সে যেন ইহার জন্য প্রস্তুত ছিল না।
রমেশ কহিল, “কমলা, বোসো।”
কমলা একটা চৌকিতে বসিল। রমেশ কহিল, “ইস্কুলে তোমার পড়াশুনা কেমন চলিতেছে?”
কমলা অত্যন্ত সংক্ষেপে কহিল, “বেশ।”
রমেশ ভাবিতে লাগিল এইবার কী বলা যাইবে। হঠাৎ একটা কথা মনে পড়িয়া গেল; কহিল, “বোধ হয় অনেকক্ষণ খাও নাই। তোমার খাবার তৈরি আছে। এইখানেই আনিতে বলি?”
কমলা কহিল, “খাইব না, আমি খাইয়া আসিয়াছি।”
রমেশ কহিল, “একটু কিছু খাইবে না? মিষ্টি না খাও তো ফল আছে–আতা, আপেল, বেদানা–”
কমলা কোনো কথা না বলিয়া ঘাড় নাড়িল।
রমেশ আর-একবার কমলার মুখের দিকে চাহিয়া দেখিল। কমলা তখন ঈষৎ মুখ নত করিয়া তাহার ইংরাজিশিক্ষার বহি হইতে ছবি দেখিতেছিল। সুন্দর মুখ সোনার কাঠির মতো নিজের চারি দিকের সুপ্ত সৌন্দর্যকে জাগাইয়া তোলে। শরতের আলোক হঠাৎ যেন প্রাণ পাইল, আশ্বিনের দিন যেন আকার ধারণ করিল। কেন্দ্র যেমন তাহার পরিধিকে নিয়মিত করে–তেমনি এই মেয়েটি আকাশকে, বাতাসকে, আলোককে আপনার চারি দিকে যেন বিশেষভাবে আকর্ষণ করিয়া আনিল–অথচ সে নিজে ইহার কিছুই না জানিয়া চুপ করিয়া বসিয়া তাহার পড়িবার বইয়ের ছবি দেখিতেছিল।
রমেশ তাড়াতাড়ি উঠিয়া গিয়া একটা থালায় কতকগুলি আপেল, নাসপাতি, বেদানা লইয়া উপস্থিত করিল। কহিল, “কমলা, তুমি তো খাবে না দেখিতেছি, কিন্তু আমার ক্ষুধা পাইয়াছে, আমি তো আর সবুর করিতে পারি না।”
শুনিয়া কমলা একটুখানি হাসিল। এই অকসমাৎ হাসির আলোকে উভয়ের ভিতরকার কুয়াশা যেন অনেকখানি কাটিয়া গেল।
রমেশ ছুরি লইয়া আপেল কাটিতে লাগিল। কিন্তু কোনোপ্রকার হাতের কাজে রমেশের কিছুমাত্র দক্ষতা নাই। তাহার এক দিকে ক্ষুধার আগ্রহ, অন্য দিকে এলোমেলো কাটিবার ভঙ্গি দেখিয়া বালিকার ভারি হাসি পাইল-সে খিল্ খিল্ করিয়া হাসিয়া উঠিল।
রমেশ এই হাস্যোচ্ছ্বাসে খুশি হইয়া কহিল, “আমি বুঝি ভালো কাটিতে পারি না, তাই হাসিতেছ? আচ্ছা, তুমি কাটিয়া দাও দেখি, তোমার কিরূপ বিদ্যা।”
নৌকাডুবি ১৮ (৩)
কমলা কহিল, “বঁটি হইলে আমি কাটিয়া দিতে পারি, ছুরিতে পারি না।”
রমেশ কহিল, “তুমি মনে করিতেছ বঁটি এখানে নাই?” চাকরকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “বঁটি আছে?”
সে কহিল, “আছে–রাত্রের আহারের জন্য সমস্ত আনা হইয়াছে।”
রমেশ কহিল, “ভালো করিয়া ধুইয়া একটা বঁটি লইয়া আয়।”
চাকর বঁটি লইয়া আসিল। কমলা জুতা খুলিয়া বঁটি পাতিয়া নীচে বসিল এবং হাসিমুখে নিপুণহস্তে ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া ফলের খোসা ছাড়াইয়া চাকলা চাকলা করিয়া কাটিতে লাগিল। রমেশ তাহার সম্মুখে মাটিতে বসিয়া ফলের খণ্ডগুলি থালায় ধরিয়া লইল।
রমেশ কহিল, “তোমাকেও খাইতে হইবে।”
কমলা কহিল, “না।”
রমেশ কহিল, “তবে আমিও খাইব না।”
কমলা রমেশের মুখের উপরে দুই চোখ তুলিয়া কহিল, “আচ্ছা, তুমি আগে খাও, তার পরে আমি খাইব।”
রমেশ কহিল, “দেখিয়ো, শেষকালে ফাঁকি দিয়ো না।”
কমলা গম্ভীরভাবে ঘাড় নাড়িয়া কহিল, “না, সত্যি বলিতেছি, ফাঁকি দিব না।”
বালিকার এই সত্যপ্রতিজ্ঞায় আশ্বস্ত হইয়া রমেশ থালা হইতে এক টুকরা ফল লইয়া মুখে পুরিয়া দিল।
হঠাৎ তাহার চিবানো বন্ধ হইয়া গেল। হঠাৎ দেখিল, তাহার সম্মুখেই দ্বারের বাহিরে যোগেন্দ্র এবং অক্ষয় আসিয়া উপস্থিত।
অক্ষয় কহিল, “রমেশবাবু, মাপ করিবেন–আমি ভাবিয়াছিলাম, আপনি এখানে বুঝি একলাই আছেন। যোগেন, খবর না দিয়া হঠাৎ এমন করিয়া আসিয়া পড়াটা ভালো হয় নাই। চলো, আমরা নীচে বসি গিয়া।”
বঁটি ফেলিয়া কমলা তাড়াতাড়ি উঠিয়া পড়িল। ঘর হইতে পালাইবার পথেই দুজনে দাঁড়াইয়া ছিল। যোগেন্দ্র একটুখানি সরিয়া পথ ছাড়িয়া দিল, কিন্তু কমলার মুখের উপর হইতে চোখ ফিরাইল না–তাহাকে তীব্রদৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করিয়া দেখিয়া লইল। কমলা সংকুচিত হইয়া পাশের ঘরে চলিয়া গেল।
নৌকাডুবি ১৯
যোগেন্দ্র কহিল, “রমেশ, এই মেয়েটি কে?”
রমেশ কহিল, “আমার একটি আত্মীয়।”
যোগেন্দ্র কহিল, “কী রকমের আত্মীয়? বোধ হয় গুরুজন কেহ হইবেন না, স্নেহের সম্পর্কও বোধ হইল
না। তোমার সকল আত্মীয়ের কথাই তো তোমার কাছ হইতে শুনিয়াছি–এ আত্মীয়ের তো কোনো বিবরণ শুনি নাই।”
অক্ষয় কহিল, “যোগেন, এ তোমার অন্যায়–মানুষের কি এমন কোনো কথা থাকিতে পারে না যাহা বন্ধুর
কাছেও গোপনীয়?” যোগেন্দ্র। কী রমেশ, অত্যন্ত গোপনীয় নাকি?
রমেশের মুখ লাল হইয়া উঠিল; সে কহিল, “হাঁ গোপনীয়। এই মেয়েটির সম্বন্ধে আমি তোমাদের সঙ্গে
কোনো আলোচনা করিতে ইচ্ছা করি না।”
যোগেন্দ্র। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে, আমি তোমার সঙ্গে আলোচনা করিতে বিশেষ ইচ্ছা করি। হেমের সহিত যদি তোমার বিবাহের প্রস্তাব না হইত, তবে কার সঙ্গে তোমার কতটা-দূর আত্মীয়তা গড়াইয়াছে তাহা লইয়া এত তোলাপাড়া করিবার কোনো প্রয়োজন হইত না–যাহা গোপনীয় তাহা গোপনেই থাকিত।
রমেশ কহিল, “এইটুকু পর্যন্ত আমি তোমাদিগকে বলিতে পারি–পৃথিবীতে কাহারো সহিত আমার এমন সম্পর্ক নাই যাহাতে হেমনলিনীর সহিত পবিত্র সম্বন্ধে বদ্ধ হইতে আমার কোনো বাধা থাকিতে পারে।”
যোগেন্দ্র। তোমার হয়তো কিছুতেই বাধা না থাকিতে পারে, কিন্তু হেমনলিনীর আত্মীয়দের থাকিতে পারে। একটা কথা আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করি, যার সঙ্গে তোমার যেরূপ আত্মীয়তা থাক্-না কেন তাহা গোপনে রাখিবার কী কারণ আছে?
রমেশ। সেই কারণটি যদি বলি, তবে গোপনে রাখা আর চলে না। তুমি আমাকে ছেলেবেলা হইতে জান-কোনো কারণ জিজ্ঞাসা না করিয়া সুদ্ধ আমার কথার উপরে তোমাদিগকে বিশ্বাস রাখিতে হইবে।
যোগেন্দ্র। এই মেয়ের নাম কমলা কি না? রমেশ। হাঁ। যোগেন্দ্র। ইহাকে তোমার স্ত্রী বলিয়া পরিচয় দিয়াছ কি না?
রমেশ। হাঁ, দিয়াছি।
যোগেন্দ্র। তবু তোমার উপরে বিশ্বাস রাখিতে হইবে? তুমি আমাদিগকে জানাইতে চাও এই মেয়েটি তোমার স্ত্রী নহে, অন্য সকলকে জানাইয়াছ এই তোমার স্ত্রী–ইহা ঠিক সত্যপরায়ণতার দৃষ্টান্ত নহে।
অক্ষয়। অর্থাৎ বিদ্যালয়ের নীতিবোধে এ দৃষ্টান্ত ব্যবহার করা চলে না, কিন্তু ভাই যোগেন, সংসারে দুই পক্ষের কাছে দুইরকম কথা বলা হয়তো অবস্থাবিশেষে আবশ্যক হইতে পারে। অন্তত তাহার মধ্যে একটা সত্য হওয়াই সম্ভব। হয়তো রমেশবাবু তোমাদিগকে যেটা বলিতেছেন সেইটেই সত্য।
রমেশ। আমি তোমাদিগকে কোনো কথাই বলিতেছি না। আমি কেবল এই কথা বলিতেছি, হেমনলিনীর সহিত বিবাহ আমার কর্তব্যবিরুদ্ধ নহে। কমলা সম্বন্ধে তোমাদের সঙ্গে সকল কথা আলোচনা করিবার গুরুতর বাধা আছে–তোমরা আমাকে সন্দেহ করিলেও সে অন্যায় আমি কিছুতে করিতে পারিব না। আমার নিজের সুখ-দুঃখ মান-অপমানের বিষয় হইলে আমি তোমাদের কাছে গোপন করিতাম না, কিন্তু অন্যের প্রতি অন্যায় করিতে পারি না।
নৌকাডুবি ১৯ (২)
যোগেন্দ্র। হেমনলিনীকে সকল কথা বলিয়াছ?
রমেশ। না। বিবাহের পরে তাঁহাকে বলিব এইরূপ কথা আছে–যদি তিনি ইচ্ছা করেন, এখনো তাঁহাকে বলিতে পারি।
যোগেন্দ্র। আচ্ছা, কমলাকে এ সম্বন্ধে দুই-একটা প্রশ্ন করিতে পারি?
রমেশ। না, কোনোমতেই না। আমাকে যদি অপরাধী বলিয়া জ্ঞান কর তবে আমার সম্বন্ধে যথোচিত বিধান করিতে পার, কিন্তু তোমাদের সম্মুখে প্রশ্নোত্তর করিবার জন্য নির্দোষী কমলাকে দাঁড় করাইতে পারিব না।
যোগেন্দ্র। কাহাকেও প্রশ্নোত্তর করিবার কোনো প্রয়োজন নাই। যাহা জানিবার জানিয়াছি। প্রমাণ যথেষ্ট হইয়াছে। এখন তোমাকে আমি স্পষ্টই বলিতেছি–ইহার পরে আমাদের বাড়িতে যদি প্রবেশের চেষ্টা কর, তবে তোমাকে অপমানিত হইতে হইবে।
রমেশ পাংশুবর্ণমুখে স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল।
যোগেন্দ্র কহিল, “আর-একটি কথা আছে, হেমকে তুমি চিঠি লিখিতে পারিবে না–তাহার সঙ্গে প্রকাশ্যে বা গোপনে তোমার সুদূর সম্পর্কও থাকিবে না। যদি চিঠি লেখ, তবে যে কথা তুমি গোপন রাখিতে চাহিতেছ সেই কথা আমি সমস্ত প্রমাণের সহিত সর্বসাধারণের কাছে প্রকাশ করিব। এখন যদি কেহ আমাদের জিজ্ঞাসা করে তোমার সঙ্গে হেমের বিবাহ কেন ভাঙিয়া গেল, আমি বলিব এ বিবাহে আমার সম্মতি নাই বলিয়া ভাঙিয়া দিয়াছি–ভিতরকার কথাটা বলিব না। কিন্তু তুমি যদি সাবধান না হও, তবে সমস্ত কথা বাহির হইয়া যাইবে। তুমি এমন পাষণ্ডের মতো ব্যবহার করিয়াছ, তবু যে আমি আপনাকে দমন করিয়া রাখিয়াছি সে তোমার উপরে দয়া করিয়া নহে–ইহার মধ্যে আমার বোন হেমের সংস্রব আছে বলিয়াই তুমি এত সহজে নিষ্কৃতি পাইলে। এখন তোমার কাছে আমার এই শেষ বক্তব্য যে, কোনোকালে হেমের সঙ্গে তোমার যে কোনো পরিচয় ছিল, তোমার কথায়-বার্তায় বা ব্যবহারে তাহার যেন কোনো প্রমাণ না পাওয়া যায়। এ সম্বন্ধে তোমাকে সত্য করাইয়া লইতে পারিলাম না, কারণ, এত মিথ্যার পরে সত্য তোমার মুখে মানাইবে না। তবে এখনো যদি লজ্জা থাকে, অপমানের ভয় থাকে, তবে আমার এই কথাটা ভ্রমেও অবহেলা করিয়ো না।”
অক্ষয়। আহা, যোগেন, আর কেন? রমেশবাবু নিরুত্তর হইয়া আছেন, তবু তোমার মনে একটু দয়া হইতেছে না? এইবার চলো। রমেশবাবু, কিছু মনে করিবেন না, আমরা এখন আসি।
যোগেন্দ্র-অক্ষয় চলিয়া গেল। রমেশ কাঠের মূর্তির মতো কঠিন হইয়া বসিয়া রহিল। হতবুদ্ধি-ভাবটা কাটিয়া গেলে তাহার ইচ্ছা করিতে লাগিল, বাসা হইতে বাহির হইয়া গিয়া দ্রুতবেগে পদচারণা করিতে করিতে সমস্ত অবস্থাটা একবার ভাবিয়া লয়। কিন্তু তাহার মনে পড়িয়া গেল কমলা আছে, তাহাকে বাসায় একলা ফেলিয়া রাখিয়া যাওয়া যায় না।
রমেশ পাশের ঘরে গিয়া দেখিল, কমলা রাস্তার দিকের জানালার একটা খড়খড়ি খুলিয়া চুপ করিয়া বসিয়া আছে। রমেশের পদশব্দ শুনিয়া সে খড়খড়ি বন্ধ করিয়া মুখ ফিরাইল। রমেশ মেজের উপরে বসিল।
কমলা জিজ্ঞাসা করিল, “উহারা দুজনে কে? আজ সকালে আমাদের ইস্কুলে গিয়াছিল।”
রমেশ সবিস্ময়ে কহিল, “ইস্কুলে গিয়াছিল?”
কমলা কহিল, “হাঁ। উহারা তোমাকে কী বলিতেছিল?”
রমেশ কহিল, “আমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছিল তুমি আমার কে হও?”
নৌকাডুবি ১৯ (৩)
কমলা যদিও শ্বশুরবাড়ির অনুশাসনের অভাবে এখনো লজ্জা করিতে শেখে নাই, তবু আশৈশব-সংস্কারে বশে রমেশের এই কথায় তাহার মুখ রাঙা হইয়া উঠিল।
রমেশ কহিল, “আমি উহাদিগকে উত্তর করিয়াছি, তুমি আমার কেউ হও না।” কমলা ভাবিল, রমেশ তাহাকে অন্যায় লজ্জা দিয়া উৎপীড়ন করিতেছে। সে মুখ ফিরাইয়া তর্জনস্বরে কহিল, “যাও!”
রমেশ ভাবিতে লাগিল, ‘কমলার কাছে সকল কথা কেমন করিয়া খুলিয়া বলিব।’
কমলা হঠাৎ ব্যস্ত হইয়া উঠিল। কহিল, “ঐ যা, তোমার ফল কাকে লইয়া যাইতেছে।” বলিয়া সে তাড়াতাড়ি পাশের ঘরে গিয়া কাক তাড়াইয়া ফলের থালা লইয়া আসিল।
রমেশের সম্মুখে থালা রাখিয়া কহিল, “তুমি খাইবে না?”
রমেশের আর আহারের উৎসাহ ছিল না, কিন্তু কমলার এই যত্নটুকু তাহার হৃদয় স্পর্শ করিল। সে কহিল, “কমলা, তুমি খাবে না?”
কমলা কহিল, “তুমি আগে খাও!”
এইটুকু ব্যাপার, বেশি-কিছু নয়, কিন্তু রমেশের বর্তমান অবস্থায় এই হৃদয়ের কোমল আভাসটুকু তাহার
বক্ষের ভিতরকার অশ্রু-উৎসে গিয়া যেন ঘা দিল। রমেশ কোনো কথা না বলিয়া জোর করিয়া ফল খাইতে লাগিল।
খাওয়ার পালা সাঙ্গ হইলে রমেশ কহিল, “কমলা, আজ রাত্রে আমরা দেশে যাইব।”
কমলা চোখ নিচু, মুখ বিষণ্ন করিয়া কহিল, “সেখানে আমার ভালো লাগে না।”
রমেশ। ইস্কুলে থাকিতে তোমার ভালো লাগে?
কমলা। না, আমাকে ইস্কুলে পাঠাইয়ো না। আমার লজ্জা করে। মেয়েরা আমাকে কেবল তোমার কথা
জিজ্ঞাসা করে।
রমেশ। তুমি কী বল?
কমলা। আমি কিছুই বলিতে পারি না। তাহারা জিজ্ঞাসা করিত, তুমি কেন আমাকে ছুটির সময়ে ইস্কুলে
রাখিতে চাহিয়াছ–আমি–
কমলা কথা শেষ করিতে পারিল না। তাহার হৃদয়ের ক্ষতস্থানে আবার ব্যথা বাজিয়া উঠিল।
রমেশ। তুমি কেন বলিলে না, তিনি আমার কেহই হন না। কমলা রাগ করিয়া রমেশের মুখের দিকে কুটিল কটাক্ষে চাহিল–কহিল, “যাও!”
আবার রমেশ মনে মনে ভাবিতে লাগিল কী করা যাইবে? এ দিকে রমেশের বুকের ভিতরে বরাবর একটা চাপা বেদনা কীটের মতো যেন গহ্বর খনন করিয়া বাহির হইয়া আসিবার চেষ্টা করিতেছিল। এতক্ষণে যোগেন্দ্র হেমনলিনীকে কী বলিল, হেমনলিনী কী মনে করিতেছে, প্রকৃত অবস্থা কেমন করিয়া হেমনলিনীকে বুঝাইবে, হেমনলিনীর সহিত চিরকালের জন্য যদি তাহাকে বিচ্ছিন্ন হইতে হয়, তবে জীবন বহন করিবে কী করিয়া–এই-সকল জ্বালাময় প্রশ্ন ভিতরে ভিতরে জমা হইয়া উঠিতেছিল, অথচ ভালো করিয়া তাহা আলোচনা করিবার অবসর রমেশ পাইতেছিল না। রমেশ এটুকু বুঝিয়াছিল যে, কমলার সহিত রমেশের সম্বন্ধ কলিকাতায় তাহার বন্ধু ও শত্রুমণ্ডলীর মধ্যে তীব্র আলোচনার বিষয় হইয়া উঠিল। রমেশ যে কমলার স্বামী, এই গোলমালে সেই জনশ্রুতি যথেষ্ট ব্যাপ্ত হইতে থাকিবে। এ সময়ে রমেশের পক্ষে কমলাকে লইয়া আর এক দিনও কলিকাতায় থাকা সংগত হইবে না।
নৌকাডুবি ১৯ (৪)
অন্যমনস্ক রমেশের এই চিন্তার মাঝখানে হঠাৎ কমলা তাহার মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, “তুমি কী ভাবিতেছ? তুমি যদি দেশে থাকিতে চাও, আমি সেইখানেই থাকিব।”
বালিকার মুখে এই আত্মসংযমের কথা শুনিয়া রমেশের বুকে আবার ঘা লাগিল; আবার সে ভাবিল কী করা যাইবে? পুনর্বার সে অন্যমনস্ক হইয়া ভাবিতে ভাবিতে নিরুত্তরে কমলার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।
কমলা মুখ গম্ভীর করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আচ্ছা, আমি ছুটির সময়ে ইস্কুলে থাকিতে চাহি নাই বলিয়া তুমি রাগ করিয়াছ? সত্য করিয়া বলো।”
রমেশ কহিল, “সত্য করিয়াই বলিতেছি, তোমার উপরে রাগ করি নাই, আমি নিজের উপরেই রাগ করিয়াছি।”
রমেশ ভাবনার জাল হইতে নিজেকে জোর করিয়া ছাড়াইয়া লইয়া কমলার সহিত আলাপ করিতে প্রবৃত্ত হইল। তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “আচ্ছা, কমলা, ইস্কুলে এতদিন কী শিখিলে বলো দেখি।”
কমলা অত্যন্ত উৎসাহের সহিত নিজের শিক্ষার হিসাব দিতে লাগিল। সম্প্রতি পৃথিবীর গোলাকৃতির কথা তাহার অগোচর নাই জানাইয়া যখন সে রমেশকে চমৎকৃত করিয়া দিবার চেষ্টা করিল, রমেশ গম্ভীরমুখে ভূমণ্ডলের গোলত্বে সন্দেহ প্রকাশ করিল। কহিল, “এ কি কখনো সম্ভব হইতে পারে?”
কমলা চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া কহিল, “বাঃ, আমাদের বইয়ে লেখা আছে–আমরা পড়িয়াছি।”
রমেশ আশ্চর্য জানাইয়া কহিল, “বল কী! বইয়ে লেখা আছে? কতবড়ো বই?”
এই প্রশ্নে কমলা কিছু কুণ্ঠিত হইয়া কহিল, “বেশি বড়ো বই নয়, কিন্তু ছাপার বই। তাহাতে ছবিও দেওয়া আছে।”
এতবড়ো প্রমাণের পর রমেশকে হার মানিতে হইল। তার পরে কমলা শিক্ষার বিবরণ শেষ করিয়া বিদ্যালয়ের ছাত্রী ও শিক্ষকদের কথা, সেখানকার দৈনিক কার্যধারা লইয়া বকিয়া যাইতে লাগিল। রমেশ অন্যমনস্ক হইয়া ভাবিতে ভাবিতে মাঝে মাঝে সাড়া দিয়া গেল। কখনো-বা কথার শেষ সূত্র ধরিয়া এক-আধটা প্রশ্নও করিল। এক সময়ে কমলা বলিয়া উঠিল, “তুমি আমার কথা কিছুই শুনিতেছ না।” বলিয়া সে রাগ করিয়া তখনি উঠিয়া পড়িল।
রমেশ ব্যস্ত হইয়া কহিল, “না না, কমলা, রাগ করিয়োনা–আমি আজ ভালো নাই।”
ভালো নাই শুনিয়া তখনি কমলা ফিরিয়া আসিয়া কহিল, “তোমার অসুখ করিয়াছে? কী হইয়াছে?”
রমেশ কহিল, “ঠিক অসুখ নয়–ও কিছুই নয়–আমার মাঝে মাঝে অমন হইয়া থাকে–আবার এখনি চলিয়া যাইবে।”
কমলা রমেশকে শিক্ষার সহিত আমোদ দিবার জন্য কহিল, “আমার ভূগোল-প্রবেশে পৃথিবীর যে ছবি আছে, দেখিবে?”
রমেশ আগ্রহ প্রকাশ করিয়া দেখিতে চাহিল। কমলা তাড়াতাড়ি তাহার বই আনিয়া রমেশের সম্মুখে খুলিয়া ধরিল। কহিল, “এই-যে দুটো গোল দেখিতেছ, ইহা আসলে একটা। গোল জিনিসের দুটো পিঠ কি কখনো একসঙ্গে দেখা যায়?”
রমেশ কিঞ্চিৎ ভাবিবার ভান করিয়া কহিল, “চ্যাপ্টা জিনিসেরও দেখা যায় না।”
কমলা কহিল, “সেইজন্য এই ছবিতে পৃথিবীর দুই পিঠ আলাদা করিয়া আঁকিয়াছে।”
এমনি করিয়া সন্ধ্যাটা কাটিয়া গেল।
নৌকাডুবি ২০
অন্নদাবাবু একান্তমনে আশা করিতেছিলেন–যোগেন্দ্র ভালো খবর লইয়া আসিবে, সমস্ত গোলমাল অতি সহজে পরিষ্কার হইয়া যাইবে। যোগেন্দ্র ও অক্ষয় যখন ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিল, অন্নদাবাবু ভীতভাবে তাহাদের মুখের দিকে চাহিলেন।
যোগেন্দ্র কহিল, “বাবা, তুমি যে রমেশকে এতদূর পর্যন্ত বাড়াবাড়ি করিতে দিবে, তাহা কে জানিত। এমন জানিলে আমি তোমাদের সঙ্গে তাহার আলাপ করাইয়া দিতাম না।”
অন্নদাবাবু। রমেশের সঙ্গে হেমনলিনীর বিবাহ তোমার অভিপ্রেত, এ কথা তুমি তো আমাকে অনেকবার বলিয়াছ। বাধা দিবার ইচ্ছা যদি তোমার ছিল, তবে আমাকে-
যোগেন্দ্র। অবশ্য একেবারে বাধা দিবার কথা আমার মনে আসে নাই, কিন্তু তাই বলিয়া-
অন্নদাবাবু। ঐ দেখো, ওর মধ্যে ‘তাই বলিয়া’ কোথায় থাকিতে পারে? হয় অগ্রসর হইতে দিবে, নয় বাধা দিবে, এর মাঝখানে আর কী আছে?
যোগেন্দ্র। তাই বলিয়া একেবারে এতটা-দূর অগ্রসর-
অক্ষয় হাসিয়া কহিল, “কতকগুলি জিনিস আছে, যা আপনার ঝোঁকেই অগ্রসর হইয়া পড়ে, তাহাকে আর প্রশ্রয় দিতে হয় না–বাড়িতে বাড়িতে আপনিই বাড়াবাড়িতে গিয়া পৌঁছায়। কিন্তু যা হইয়া গেছে তা লইয়া তর্ক করিয়া লাভ কী? এখন, যা করা কর্তব্য তাই আলোচনা করো।”
অন্নদাবাবু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করিলেন, “রমেশের সঙ্গে তোমাদের দেখা হইয়াছে?”
যোগেন্দ্র। খুব দেখা হইয়াছে–এত দেখা আশা করি নাই। এমন-কি, তার স্ত্রীর সঙ্গেও পরিচয় হইয়া গেল।
অন্নদাবাবু নির্বাক্ বিস্ময়ে চাহিয়া রহিলেন। কিছুক্ষণ পরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কার স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় হইল?”
যোগেন্দ্র। রমেশের স্ত্রী।
অন্নদাবাবু। তুমি কী বলিতেছ, আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। কোন্ রমেশের স্ত্রী?
যোগেন্দ্র। আমাদের রমেশের। পাঁচ-ছয় মাস আগে যখন সে দেশে গিয়াছিল, তখন সে বিবাহ করিতেই গিয়াছিল।
অন্নদাবাবু। কিন্তু তার পিতার মৃত্যু হইল বলিয়া বিবাহ ঘটিতে পারে নাই।
যোগেন্দ্র। মৃত্যুর পূর্বেই বিবাহ হইয়া গেছে।
অন্নদাবাবু স্তব্ধ হইয়া বসিয়া মাথায় হাত বুলাইতে লাগিলেন। কিছুক্ষণ ভাবিয়া বলিলেন, “তবে তো আমাদের হেমের সঙ্গে তাহার বিবাহ হইতেই পারে না।”
যোগেন্দ্র। আমরা তো তাই বলিতেছি-
অন্নদাবাবু। তোমরা তো তাই বলিলে, এ দিকে যে বিবাহের আয়োজন সমস্তই প্রায় ঠিক হইয়া গেছে–এ রবিবারে হইল না বলিয়া পরের রবিবারে দিন স্থির করিয়া চিঠি বিলি হইয়া গেছে–আবার সেটা বন্ধ করিয়া ফের চিঠি লিখিতে হইবে?
নৌকাডুবি ২০ (২)
যোগেন্দ্র কহিল, “একেবারে বন্ধ করিবার দরকার কী–কিছু পরিবর্তন করিয়া কাজ চালাইয়া লওয়া যাইতে পারে।”
অন্নদাবাবু আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, “ওর মধ্যে পরিবর্তন কোন্খানটায় করিবে?”
যোগেন্দ্র। যেখানে পরিবর্তন করা সম্ভব সেইখানেই করিতে হইবে। রমেশের বদলে আর কোনো পাত্র স্থির করিয়া আসছে রবিবারেই যেমন করিয়া হউক কর্ম সম্পন্ন করিতে হইবে। নহিলে লোকের কাছে মুখ দেখাইতে পারিব না।
বলিয়া যোগেন্দ্র একবার অক্ষয়ের মুখের দিকে চাহিল। অক্ষয় বিনয়ে মুখ নত করিল।
অন্নদাবাবু। পাত্র এত শীঘ্র পাওয়া যাইবে?
যোগেন্দ্র। সে তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।
অন্নদাবাবু। কিন্তু হেমকে তো রাজি করাইতে হইবে।
যোগেন্দ্র। রমেশের সমস্ত ব্যাপার শুনিলে সে নিশ্চয় রাজি হইবে।
অন্নদাবাবু। তবে যা তুমি ভালো বিবেচনা হয় তাই করো। কিন্তু রমেশের বেশ সংগতিও ছিল, আবার
উপার্জনের মতো বিদ্যাবুদ্ধিও ছিল। এই পরশু আমার সঙ্গে কথা ঠিক হইয়া গেল, সে এটোয়ায় গিয়া প্র্যাক্টিস করিবে, এর মধ্যে দেখো দেখি কী কাণ্ড!
যোগেন্দ্র। সেজন্য কেন চিন্তা করিতেছ বাবা, এটোয়াতে রমেশ এখনো প্র্যাক্টিস করিতে পারিবে। একবার হেমকে ডাকিয়া আনি, আর তো বেশি সময় নাই।
কিছুক্ষণ পরে যোগেন্দ্র হেমনলিনীকে লইয়া ঘরে প্রবেশ করিল। অক্ষয় ঘরের এক কোণে বইয়ের আলমারির আড়ালে বসিয়া রহিল।
যোগেন্দ্র কহিল, “হেম, বোসো, তোমার সঙ্গে একটু কথা আছে।”
হেমনলিনী স্তব্ধ হইয়া চৌকিতে বসিল। সে জানিত তাহার একটা পরীক্ষা আসিতেছে।
যোগেন্দ্র ভূমিকাচ্ছলে জিজ্ঞাসা করিল, “রমেশের ব্যবহারে সন্দেহের কারণ তুমি কিছুই দেখিতে পাও না?”
হেমনলিনী কোনো কথা না বলিয়া কেবল ঘাড় নাড়িল। যোগেন্দ্র। সে যে বিবাহের দিন এক সপ্তাহ পিছাইয়া দিল, তাহার এমন কি কারণ থাকিতে পারে যাহা আমাদের কারো কাছে বলা চলে না!
হেমনলিনী চোখ নিচু করিয়া কহিল, “কারণ অবশ্যই কিছু আছে।”
যোগেন্দ্র। সে তো ঠিক কথা। কারণ তো আছেই, কিন্তু সে কি সন্দেহজনক না?
হেমনলিনী আবার নীরবে ঘাড় নাড়িয়া জানাইল, “না।”
তাহাদের সকলের চেয়ে রমেশের উপরেই এমন অসন্দিগ্ধ বিশ্বাসে যোগেন্দ্র রাগ করিল। সাবধানে ভূমিকা করিয়া কথা পাড়া আর চলিল না।
যোগেন্দ্র কঠিনভাবে বলিতে লাগলি, “তোমার তো মনে আছে, রমেশ মাস-ছয়েক আগে তাহার বাপের সঙ্গে দেশে চলিয়া গিয়াছিল। তাহার পরে অনেক দিন তাহার কোনো চিঠিপত্র না পাইয়া আশ্চর্য হইয়া গিয়াছিলাম। ইহাও তুমি জান যে, যে রমেশ দুই বেলা আমাদের এখানে আসিত, যে বরাবর আমাদের পাশের বাড়িতে বাসা লইয়া ছিল, সে কলিকাতায় আসিয়া আমাদের সঙ্গে একবারও দেখাও করিল না, অন্য বাসায় গিয়া গা-ঢাকা দিয়া রহিল–ইহা সত্ত্বেও তোমরা সকলে পূর্বের মতো বিশ্বাসেই তাহাকে ঘরে ডাকিয়া আনিলে! আমি থাকিলে এমন কি কখনো ঘটিতে পারিত?”
নৌকাডুবি ২০ (৩)
হেমনলিনী চুপ করিয়া রহিল।
যোগেন্দ্র। রমেশের এইরূপ ব্যবহারের কোনো অর্থ তোমরা খুঁজিয়া পাইয়াছ? এ সম্বন্ধে একটা প্রশ্নও কি
তোমাদের মনে উদয় হয় নাই? রমেশের ‘পরে এত গভীর বিশ্বাস!
হেমনলিনী নিরুত্তর।
যোগেন্দ্র। আচ্ছা, বেশ কথা–তোমরা সরলস্বভাব, কাহাকেও সন্দেহ কর না–আশা করি, আমার উপরেও তোমার কতকটা বিশ্বাস আছে। আমি নিজে ইস্কুলে গিয়া খবর লইয়াছি, রমেশ তাহার স্ত্রী কমলাকে সেখানে বোর্ডার রাখিয়া পড়াইতেছিল। ছুটির সময়েও তাহাকে সেখানে রাখিবার বন্দোবস্ত করিয়াছিল। হঠাৎ দুই-তিন দিন হইল, ইস্কুলের কর্ত্রীর নিকট হইতে রমেশ চিঠি পাইয়াছে যে, ছুটির সময়ে কমলাকে ইস্কুলে রাখা হইবে না। আজ তাহাদের ছুটি ফুরাইয়াছে–কমলাকে ইস্কুলের গাড়ি দরজিপাড়ায় তাহাদের সাবেক বাসায় পৌঁছাইয়া দিয়াছে। সেই বাসায় আমি নিজে গিয়াছি। গিয়া দেখিলাম, কমলা বঁটিতে আপেলের খোসা ছাড়াইয়া কাটিয়া দিতেছে, রমেশ তাহার সুমুখে মাটিতে বসিয়া এক-এক টুকরা লইয়া মুখে পুরিতেছে। রমেশকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘ব্যাপারখানা কী?’ রমেশ বলিল, সে এখন আমাদের কাছে কিছুই বলিবে না। যদি রমেশ একটা কথাও বলিত যে, কমলা তাহার স্ত্রী নয়, তা হলেও না হয় সেই কথাটুকুর উপর নির্ভর করিয়া কোনোমতে সন্দেহকে শান্ত করিয়া রাখিবার চেষ্টা করা যাইত। কিন্তু সে হাঁ-না কিছুই বলিতে চায় না। এখন, ইহার পরেও কি রমেশের উপর বিশ্বাস রাখিতে চাও?
প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষায় যোগেন্দ্র হেমনলিনীর মুখের প্রতি নিরীক্ষণ করিয়া দেখিল তাহার মুখ অস্বাভাবিক বিবর্ণ হইয়া গেছে, এবং তাহার যতটা জোর আছে দুই হাতে চৌকির হাতা চাপিয়া ধরিবার চেষ্টা করিতেছে। মুহূর্তকাল পরেই সম্মুখের দিকে ঝুঁকিয়া পড়িয়া মূর্ছিত হইয়া চৌকি হইতে সে নীচে পড়িয়া গেল।
অন্নদাবাবু ব্যাকুল হইয়া পড়িলেন। তিনি ভূলুন্ঠিতা হেমনলিনীর মাথা দুই হাতে বুকের কাছে তুলিয়া লইয়া কহিলেন, “মা, কী হইল মা! ওদের কথা তুমি কিছুই বিশ্বাস করিয়ো না–সব মিথ্যা।”
যোগেন্দ্র তাহার পিতাকে সরাইয়া তাড়াতাড়ি হেমনলিনীকে একটা সোফার উপর তুলিল; নিকটে কুঁজায়
জল ছিল, সেই জল লইয়া তাহার মুখে-চোখে বারংবার ছিটাইয়া দিল, এবং অক্ষয় একখানা হাতপাখা লইয়া তাহাকে বেগে বাতাস করিতে লাগিল।
হেমনলিনী অনতিকাল পরে চোখ খুলিয়াই চমকিয়া উঠিল; অন্নদাবাবুর দিকে চাহিয়া চীৎকার করিয়া বলিল, “বাবা, বাবা, অক্ষয়বাবুকে এখান হইতে সরিয়া যাইতে বলো।”
অক্ষয় পাখা রাখিয়া ঘরের বাহিরে দরজার আড়ালে গিয়া দাঁড়াইল। অন্নদাবাবু সোফার উপরে হেমনলিনীর
পাশে বসিয়া তাহার মুখে-গায়ে হাত বুলাইতে লাগিলেন, এবং গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কেবল একবার বলিলেন, “মা!”
দেখিতে দেখিতে হেমনলিনীর দুই চক্ষু দিয়া জল ঝরিয়া পড়িতে লাগিল; তাহার বুক ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিল; পিতার জানুর উপর বুক চাপিয়া ধরিয়া তাহার অসহ্য রোদনের বেগ সংবরণ করিতে চেষ্টা করিল। অন্নদাবাবু অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলিতে লাগিলেন, “মা, তুমি নিশ্চিন্ত থাকো মা! রমেশকে আমি খুব জানি–সে কখনোই অবিশ্বাসী নয়, যোগেন নিশ্চয়ই ভুল করিয়াছে।”
নৌকাডুবি ২০ (৪)
যোগেন্দ্র আর থাকিতে পারিল না; কহিল, “বাবা, মিথ্যা আশ্বাস দিয়ো না। এখকার মতো কষ্ট বাঁচাইতে গিয়া উহাকে দ্বিগুণ কষ্টে ফেলা হইবে। বাবা, হেমকে এখন কিছুক্ষণ ভাবিবার সময় দাও।”
হেমনলিনী তখনি পিতার জানু ছাড়িয়া উঠিয়া বসিল, এবং যোগেন্দ্রের মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, “আমার যাহা ভাবিবার, সব ভাবিয়াছি। যতক্ষণ তাঁহার নিজের মুখ হইতে না শুনিব, ততক্ষণ আমি কোনোমতেই বিশ্বাস করিব না ইহা নিশ্চয় জানিয়ো।”
এই কথা বলিয়া সে উঠিয়া পড়িল। অন্নদাবাবু ব্যস্ত হইয়া তাহাকে ধরিলেন; কহিলেন, “পড়িয়া যাইবে।”
হেমনলিনী অন্নদাবাবুর হাত ধরিয়া তাহার শোবার ঘরে গেল। বিছানায় শুইয়া কহিল, “বাবা, আমাকে একটুখানি একলা রাখিয়া যাও, আমি ঘুমাইব।”
অন্নদাবাবু কহিলেন, “হরির মাকে ডাকিয়া দিব? বাতাস করিবে?”
হেমনলিনী কহিল, “বাতাসের দরকার নাই বাবা!”
অন্নদাবাবু পাশের ঘরে গিয়া বসিলেন। এই কন্যাটিকে ছয় মাসের শিশু-অবস্থায় রাখিয়া ইহার মা মারা যায়, সেই হেমের মার কথা তিনি ভাবিতে লাগিলেন। সেই সেবা, সেই ধৈর্য, সেই চিরপ্রসন্নতা মনে পড়িল। সেই গৃহলক্ষ্মীরই প্রতিমার মতো যে মেয়েটি এতদিন ধরিয়া তাঁহার কোলের উপর বাড়িয়া উঠিয়াছে তাহার অনিষ্টআশঙ্কায় তাঁহার হৃদয় ব্যাকুল হইয়া উঠিল। পাশের ঘরে বসিয়া বসিয়া তিনি মনে মনে তাহাকে সম্বোধন করিয়া বলিতে লাগিলেন, ‘মা, তোমার সকল বিঘ্ন দূর হউক, চিরদিন তুমি সুখে থাকো। তোমাকে সুখী দেখিয়া, সুস্থ দেখিয়া, যাহাকে ভালোবাস তাহার ঘরের মধ্যে লক্ষ্মীর মতো প্রতিষ্ঠিত দেখিয়া, আমি যেন তোমার মার কাছে যাইতে পারি।’ এই বলিয়া জামার প্রান্তে আর্দ্র চক্ষু মুছিলেন।
মেয়েদের বুদ্ধির প্রতি যোগেন্দ্রর পূর্ব হইতেই যথেষ্ট অবজ্ঞা ছিল, আজ তাহা আরো দৃঢ় হইল। ইহারা প্রত্যক্ষ প্রমাণও বিশ্বাস করে না–ইহাদিগকে লইয়া কী করা যাইবে? দুইয়ে দুইয়ে যে চার হইবেই, তাহাতে মানুষের সুখই হউক আর দুঃখই হউক, তাহা ইহারা স্থলবিশেষে অনায়াসেই অস্বীকার করিতে পারে। যুক্তি যদি কালোকে কালোই বলে, আর ইহাদের ভালোবাসা তাহাকে বলে সাদা, তবে যুক্তি-বেচারার উপরে ইহারা ভারি খাপা হইয়া উঠিবে। ইহাদিগকে লইয়া যে কী করিয়া সংসার চলে তাহা যোগেন্দ্র কিছুতেই ভাবিয়া পাইল না।
যোগেন্দ্র ডাকিল, “অক্ষয়!”
অক্ষয় ধীরে ধীরে ঘরে প্রবেশ করিল। যোগেন্দ্র কহিল, “সব তো শুনিয়াছ, এখন ইহার উপায় কী?”
অক্ষয় কহিল, “আমাকে এ-সব কথার মধ্যে কেন মিছামিছি টানো ভাই? আমি এতদিন কোনো কথাই বলি নাই, তুমি আসিয়াই আমাকে এই মুশকিলে ফেলিয়াছ।”
যোগেন্দ্র। আচ্ছা, সে-সব নালিশের কথা পরে হইবে। এখন হেমনলিনীর কাছে রমেশকে নিজের মুখে সকল কথা কবুল না করাইলে উপায় দেখি না।
অক্ষয়। পাগল হইয়াছ! মানুষ নিজের মুখে-
যোগেন্দ্র। কিম্বা যদি একটা চিঠি লেখে, তাহা হইলে আরো ভালো হয়। তোমাকে এই ভার লইতেই হইবে। কিন্তু আর দেরি করিলে চলিবে না।
অক্ষয় কহিল, “দেখি, কতদূর কী করিতে পারি।”