জালের মায়া মায়ার জাল (নূহর নৌকা)
সে যেন এক শক্তিহীন মাকড়সা। তার চার দিকে তার নিজেরই কার্যকলাপ থেকে শুঁড় বার হয়েছে সুতোর মতো। তাকে কেন্দ্রে রেখে একটা জাল বোনা হয়ে যাচ্ছে। সে আটকে যাচ্ছে। ভীষণ ভাবে আটকে যাচ্ছে। একটার পর একটা দায়। শশাঙ্ক চিঠি উইল এ সব নিয়ে বসে থাকে। কী করবে সে এখন? এ সব তো মহা ঝামেলার ব্যাপার। বসে থাকতে থাকতে সে টের পায় দীর্ঘ দিনের অনিয়মে তার শরীর বিদ্রোহ ঘোষণা করছে। উঠতে ইচ্ছে করছে না। ভীষণ তেষ্টা পাচ্ছে। অথচ, জলটাও যে নিয়ে আসতে হবে, এ ইচ্ছে নেই। পাশের ফ্ল্যাটের কথা ভাবে, ওহ্ ওটা তো তালা বন্ধ। সে তো বেল টিপে বলতে পারবে না কঙ্কণা, তোমার কাছে কিছু, মানে খাবার দাবার আছে? যদি অসুবিধে না হয়… শরীর মন পকেট। এ সব যত ক্ষণ ঠিকঠাক আছে তত ক্ষণ মনে হয় আমি স্বয়ংসম্পূর্ণ, কারওর দরকার নেই। ইচ্ছেমত কাজ করব, ইচ্ছেমত ভোগ করব। সবটাই চলবে আমার মর্জিমাফিক। যেমন ভেবেছিলেন শৈবাল সাধন ও সাহানা গুপ্ত। বিপদের দিনে এক জন আত্মীয়কেও পেলেন না। ভেবেছিলেন কার্তিক সামন্ত ও তাঁর ছেলে তারক সামন্ত। জ্ঞাতিদের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক রাখেননি। ঠিক যে নেই, লোভ ক্রমশ বিকট চেহারা নিচ্ছে বুঝেসুজেও তো নিশ্চিন্তে ছিলেন। আজ বৃদ্ধ একা, নাতি সম্পূর্ণ অনাত্মীয়র দয়ার ওপর নির্ভর। সেও তো ভেবেছিল, বেশ আছে। ঝাড়া হাত-পা, যা ভালবাসে তাই করবে, যেখানে সেখানে খিদে পেলে খেয়ে নেবে। বাড়িতে এসে একটা বিছানা পেলেই তো হল। এখন কী রকম ঘোর লাগা আবছা চোখে সে দেখল, বাড়িটা অকথ্য নোংরা। ধুলো জমে আছে। বিছানাটা চিট ময়লা। তার চার পাশে খালি অযত্ন, অবহেলা, নোংরা। এক মহানারকীয় রাতের মধ্যে সে ঢুকে যাচ্ছিল ক্রমাগত। ছেড়ে দিয়েছিল নিজেকে। ঠিক আছে, তাই হোক। চেতনার মধ্যে শুধু জেগেছিল মা বাবার রক্তাক্ত মৃতদেহ, মাফিয়া চক্রে খুন, একলা, সম্পূর্ণ একলা লড়াই। ভাই সুদূরের, কোনও দিন কাছে এল না, এবং ক্রূর স্বার্থপর মুখ সব মসৃণ মুখোশের আড়ালে। খালি খুন জখম, ধর্ষণ, দাঙ্গা, অগ্নিকাণ্ড, মানববোমা, বিশাল বিশাল মাপের চৌর্য পাবলিক মানির, জিঘাংসা, বুভুক্ষা, লিপ্সা ওহ্ একটা উন্মত্ত পৃথিবী তার মাথাময় দাপাদাপি করে বেড়াচ্ছে। এইই তো নরক! সে তা হলে যাচ্ছে নরক থেকে নরকান্তরে? ঠাণ্ডা একটা হাত সে এক সময়ে অনুভব করল কপালে। শীতল, বরফ ঠাণ্ডা। শিউরে উঠল গাটা, নরমও। এই তবে মৃত্যুর হাত! এ তো ভালই। মৃত্যুকে কেন এত ভয় পায় লোকে?
কেউ যেন ডাকল, আংকল! কাকু! কিন্তু মৃত্যু তাকে কেন আঙ্কল টাঙ্কল কাকু টাকু বলতে যাবে? তার পর এক জন একটু বয়স্কা এবং এক জন কিশোরী তাকে জলে চুবিয়েছে, ডাক্তার ডেকেছে, তাকে হাসপাতালায়িত করেছে, সে কিছুই জানতে পারেনি। জ্ঞান ফিরল কোনও আপাত পরিচ্ছন্ন টিপটপ ঘরে। আরে! এ তো একটা টিপিক্যাল নার্সিং হোম! যেন চেনা চেনা….
—এই তো, চোখ চেয়েছেন, এক জন সিঙ্গার এসে হেসে বললেন। বি পি, হার্ট বিট, পালস সব যথারীতি। স্যালাইন ঠেলা রয়েছে এক দিকে।
—ভাল আছেন? শরীরের দিকে একটু নজর দিতে হয়! যতই কাজ থাক। শরীরের নাম মোটেই মহাশয় নয়, বুঝলেন? সব সয় না।
ব্রেকফাস্ট এসেছে। কলা, পরিজ, ডিম, টোস্ট, দুধ।
—খান ভাল করে। অনেক দিন খান না। আপনারা এই ব্যাটাছেলেরা সত্যি কোনও দিন কিছু শিখবেন না। ওইটুকু একটা মেয়ে যা পারে, আপনারা জোয়ান মানুষ কেন যে….ভদ্রমহিলা কথা শেষ করলেন না। তার মনে হচ্ছে সে দুর্ভিক্ষের দেশ থেকে এসেছে। গোগ্রাসে খেল। খেতে খেতে ভাবল এই গোগ্রাসে খেতে চাওয়াই তা হলে জীবনের লক্ষণ! কতকগুলো শারীরবৃত্তীয় বোধ। শুধু তার তাড়না, তার ভজনা, তার প্রশমন। এইই কি সব?
খাওয়া দাওয়া হয়ে যেতেই একটা অখণ্ড শান্তি তৈরি হতে থাকে ভেতরে, কোনও দুঃখ নেই, চিন্তা নেই, সমস্যা নেই। দেবতা জাতীয় কেউ যদি সত্যিই থাকে তা হলে তাদের মধ্যে নিশ্চয়ই এই রকম প্রসন্নতা বিরাজ করে। আরামে চোখ বুজল সে। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শুনল, কাকু! কেবিনের দরজা আলো করে দাঁড়িয়ে আছে একটি বছর চোদ্দোর কিশোরী মেয়ে। চুলে পনিটেল, আলোর মতো ফর্সা, অনাবিল চোখ। মিলি এখানে কী করছে? তার পেছনে মায়া নামে নার্সটিকে সে চিনতে পারছে। একেই সে মিলির তত্ত্বাবধানে রেখেছে। ওরা ঢুকতে না ঢুকতেই ঢুকল অতুলদা।
—যা হোক একখানা দেখালে শশাঙ্ক।
সে বলল, ফ্ল্যাটের দরজা খুললে কী করে?
আরে, আমাকে একটা কল দিয়েছিলে। ভুলে মেরে দিয়েছি। ইতিমধ্যে মিলির ফোন। শশাঙ্ককাকু অনেক দিন আসেনি। কেন? তখন খেয়াল হল অফিসেও তো আসছ না। কী যা রাগ করছিলেন! একটা ফোন করবার সৌজন্যও নাকি তোমার নেই, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে তুমি এতই ব্যস্ত। তোমাদের দারোয়ানের কাছ থেকে ডুপ্লিকেট চাবি জোগাড় করি। ওহ্ শশাঙ্ক আই’ভ নেভার সিন সাচ আ মেস।
মিলি হঠাৎ শশাঙ্কর বেডের ওপর মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। এই মেয়েটিকে এ ভাবে কাঁদতে দেখেনি শশাঙ্ক তার চূড়ান্ত সর্বনাশের পরও। শক্ত ধাতের মেয়ে। সে বিষাদপ্রতিমা হয়ে গিয়েছিল, আর নয় তো রাগ করত, প্রচণ্ড অহেতুক ক্রোধ। যা পাচ্ছে ভেঙেচুরে দিচ্ছে। দিনের পর দিন শশাঙ্ক তার কাউন্সেলিং করিয়েছে। তার তত্ত্বাবধান করেছে বাড়িতে এই মায়া মহিলাটিকে সর্বক্ষণের জন্য রেখে। চার মস্তানের বিরুদ্ধে কেস উঠেছে এখন। এক জন শিল্পপতির ছেলে। এক জন টিভি সিরিয়ালের অভিনেতা, এক জন মন্ত্রীর ভাইপো আর চতুর্থ জন এক আই পি এস অফিসারের ছোট ভাই। এই কেসের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তার বিশ্রাম নেই। নিজের কাছে এমন প্রতিজ্ঞাই তো সে করেছিল। মানসিক বিপর্যস্ত মেয়েটিকে আদালতে নিয়ে যেতে ডাক্তারের বারণ আছে। তাই সমস্ত পদ্ধতিটাই স্থগিত হয়ে রয়েছে। তারা তিন জনকে পরিষ্কার শনাক্ত করতে পেরেছে। চতুর্থ জনের জন্যে মিলিকে দরকার। অথচ, সেটাও একটা বিপজ্জনক অভিজ্ঞতা হবে মেয়েটির পক্ষে। সেই যাকে বলে, আদালত ও একটি মেয়ে। এখন আবার ও কাঁদতে শুরু করল।
—তুমি কাঁদছ কেন?
—তুমি চলে যেও না, মরে যেও না, কাকু। আই হ্যাভ নো বডি টু টার্ন টু।
—আমি কোথাও যাব না। সে তার অনভ্যস্ত হাত মিলির মাথার ওপর রাখল। দিদি বা বোন। মা বা মেয়ে। কোনও নারী জাতিয়র সঙ্গে তার সংসর্গ কই? আবেগের বন্ধন কই? আত্মীয়তা? তাও তো নেই।
হঠাৎ তার চোখের সামনে ভেসে উঠল কালো চুলে ঘেরা শ্যামলা একটা মুখ। খুব ঢলঢলে। শহুরে চটক নেই, গ্রাম্য আনাড়িপনাও নেই একদম। ফড়ফড় করে কথা বলার পাত্র নয়, যা বলে করে সবই সুচিন্তিত। ভদ্র, বাড়াবাড়ি নেই কোনও। এবং সে কাজ বোঝে। এক্ষুনি কী করা দরকার চকিতে বুঝে ফেলে সেটা। যত দূর মনে পড়ছে খুব ঠিকঠাক করে সেটা বার বার।
সকালের ভিজিটিং শেষ হয়ে যাবার পর সে তাই সিস্টারকে দিয়ে সাকচিতে একটা কল করাল।
—কঙ্কণা আছে?
—কে মৃগাঙ্ক? হ্যাঁ বাবা, ডাকছি।
—আমি মৃগাঙ্কর দাদা।
ও দিকটা কিছু ক্ষণ নীরব। এই নীরবতার অর্থ অনুধাবন করবার সময় নেই শশাঙ্কর। কিছু ক্ষণ পর কঙ্কণার গলাটা ও দিকে বাজতেই সে বলল— তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে পারবে? ধরো কালই?
—পারব!
সে আর কিছু বলল না। কঙ্কণাও আর একটিও প্রশ্ন করল না।
—কী দরকার! কী এমন হল? সে কেমন আছে। বাচ্চাটার খবর, মৃগাঙ্কর খবর! কিচ্ছু না। আশ্চর্য অল্প কথার মানুষ এবং কোন মানুষ ঠিক কেমন, কোনটা তার খুব জরুরি, এ সব দরকারগুলো সে চট করে বুঝে ফেলে। এই ভাবে কঙ্কণার বিশ্লেষণ সে কখনও করেনি। সেও তো ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের মানুষ। তাই দিয়েই বুঝে ফেলে অর্ধেক। আজকে প্রথম ভাল করে ভাবল, বুঝল। বিকেলেই ছাড়া পেয়ে যাবে। বাড়িতে গিয়ে তার প্রথম কাজ হবে লোটনকে ফোন করা।
অতুলদা একেবারে ছুটির দরখাস্তটায় সই করিয়ে নিল। বলল
— আমি তোমাকে কাছাকাছি কোথাও থেকে একটু সুপ এনে দিয়ে যাচ্ছি। টোস্টটা তুমি যদি ম্যানেজ করতে না পারো তো আমি নাহয় আর একটু বসেই যাই। বাই দা ওয়ে, একটা লোক টোক রাখো না কেন?
—রেখেছি অনেক বার। দরজা খোলা না পেয়ে চলে যায়।
হা হা করে হাসল অতুল
— আরে বাবা, দরজা খোলা না পেলেও মাইনেটা তো পায়।
—তা পায়। তবু টেকে না।
—এ ব্যবস্থা চলতে পারে না। সদ্য হাসপাতাল ফেরত রোগীকে নিজে টোস্ট করে খেতে হবে! দিস ইজ টু মাচ।
—কিন্তু এটাই তো সিচুয়েশন, অতুলদা। আমি ও সব ভাবি না। ওগুলো প্রবলেম নয়।
—তোমার প্রবলেমগুলো কী জাতীয় আমি আন্দাজ করতে পারি শশাঙ্ক, অতুলদা হাসল।
— কিন্তু টিকে থাকাও তো দরকার! টোস্টার রয়েছে দেখলুম। করবে তো? না, পেটে কিল মেরে রাতটা কাটিয়ে দেবে?
—আজ কি তোমার আর কোনও অ্যাসাইনমেন্ট আছে?
—নাঃ, তবে কাল ফার্স্ট আওয়ার।
অতুলদা সুপ ফুপ আনতে চলে গেলে শশাঙ্ক হঠাৎ আবার খুব ক্লান্ত বোধ করল। পাশ ফিরে ক্লান্তির হাতে নিজেকে সমর্পণ করা ছাড়া আর কিছু নেই এখন। রিল্যাকসেশন। বেশ কিছু ক্ষণ ডিপ ব্রিদিং করো, তার পর নিজেকে ছেড়ে দাও। এ ভাবেই যদি নিজেকে চাঙ্গা করা যায়! এখন মাথার মধ্যে কিচ্ছু নেই। এত অবসন্ন, একলা, প্রায় অসহায় তার কখনও লাগেনি। সেও কি জীবনভর এক অন্তর্নিহিত ট্রমায় ভুগছে না? লোটনকে অব্যাহতি দিতে গিয়ে নিজের ওপর দু’জনের চিন্তার ভার তুলে নেয়নি কি? ক্ষয় তো ভেতরে ভেতরে চলছেই। কাজ না থাকলেই সেই অনুভূতিটা চেপে ধরে। সে ঘুমিয়েই পড়েছিল। উপর্যুপরি বেলের আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেল। অতুলদা এল বোধহয়। কিন্তু দরজা খুলে দিয়ে শশাঙ্ক দেখল কঙ্কণা দাঁড়িয়ে আছে। তার কোলে একটি লাজুক শিশু। হাতে একটা বাস্কেট।
—তুমি? এর মধ্যে?
—কত ক্ষণ লাগে? আপনার কী হয়েছে? হসপিটাল থেকে ফোন?
—ও কিছু না।
—আপনার তো কিছুতেই কিছু না। ইশশ্ কী করে রেখেছেন! যাক পরে শুনব। আমি আসছি। চিনচিনকে একটু খাইয়ে আসছি। দরজাটা বন্ধ করবেন না।
পেছন থেকে অতুল বণিক বলল, আচ্ছা! আপনি এসে গেছেন! ভাইয়ের মিসেস না? বাঃ টোস্টের সমস্যাটার সমাধান হয়ে গেল।
অতুল ভেতরে এসে টেবিলে রাখল সুপটা। একটা প্লাস্টিকের মুখবন্ধ কৌটোয় দিয়েছে।
— তা হলে আমি আসছি শশাঙ্ক।
—শুনুন শুনুন। কঙ্কণা ডাকল। কী ব্যাপার বলুন তো। কী হয়েছিল এঁর? হসপিটাল থেকে ফোন গেল!
—আরে, সে মহাভারত! দু’দিন জ্বর টরে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। মিলি আর আমি দু’জনেই এসে পড়ি ভাগ্যিস! প্র্যাকটিক্যালি মিলি আর মায়া মিলেই….। হাসপাতাল….স্যালাইন….দিন পাঁচেক ছিল। আরে, এর একটা বিয়ে দিন। বাউণ্ডুলে হয়ে জীবন কাটে ম্যাডাম?
অতুল নিশ্চিন্ত হয়ে কেটে পড়ল।কঙ্কণা অবাক হয়ে বলল, মিলি কে? মিলি, মায়া?
—সে অনেক কথা। ক্লান্তি আচ্ছন্ন করছে শশাঙ্ককে। সে ও পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ল। কারও কাছে কোনও জবাবদিহির শক্তি এখন নেই।
কঙ্কণা চিনচিনকে মেঝেতে ছেড়ে দেয়। সামনে তার প্রিয় প্লাস্টিকের বিল্ডিং ব্লক। আপন মনে খেলছে। কঙ্কণা বসেই থাকে, বসেই থাকে। এ কেমন মানুষ যে অন্যের বিপদে নিঃসঙ্কোচে তার কাছে পরামর্শ, সাহায্য চায়। নিজের বিপদে স্মরণও করে না? এরা খুব অদ্ভুত মানুষ, সত্যি! তার বাপের বাড়িতে মা বাবা ভাই আর বিবাহিত বোনে এই দূরত্ব নেই। এ তারা ভাবতেও পারে না। তার অসুখ করলে মা পাশে, বাবা ডাক্তারখানা, ভাই ওষুধ আনতে গেল। মায়ের কিছু হলে বাবার আর হাত পা আসে না। সে আর ভাইই তখন সব। বাবার কিছু হয় না চট করে। হলে সে সংসার সামলায়, মা রোগীর পাশে। ভাইটার অসুখ বিসুখ করে না। কিন্তু ফুটবল খেলে জখম হয় যখন তখন। সে সময়ে দিদি গরম গরম সেঁক দেবে আর সে আহা উ হু হু হু করবে এটাই নিয়ম।
মৃগাঙ্ক অবশ্য বলে থাকে, এগুলো আদিখ্যেতা। এই ধরনের গায়ে গায়ে ঘনিষ্ঠতা, নির্ভরশীলতা খুব গেঁয়ো ব্যাপার। আত্মনির্ভর হওয়াই উন্নত মানুষের লক্ষণ। কিন্তু মৃগাঙ্ক যদি একটি বার ফোন করে বলত, তুমি ছাড়া এই দেড় বছর প্রায় আমার যে কেমন করে কাটছে কাঁকন? কিংবা সেই যদি বলতে পারত কথাটা! আহ্ বড় আরাম হত। সোনা নয়, দানা নয়, দেশভ্রমণ নয়, সামান্য দুটো কথা মনটাই পাল্টে দিতে পারত! কিন্তু সে তো গেঁয়ো, এবং মৃগাঙ্ক প্রগতিশীল!
দাদার সেলফোনটা বাজল। চট করে কঙ্কণা ধরে সেটা। ঘুমটা না ভেঙে যায়। অতন্দ্র যে মানুষটাকে সে প্রতি দিন এক পায়ে খাড়া দেখে, আজ সে এমন অসময়ে যদি আচ্ছন্ন হয়ে থাকে সে ঘুম তার খুব দরকার।
—হ্যালো!
—আমি মিলি বলছি। কাকু বাড়ি ফিরেছেন? অতুলকাকু বলেছিলেন উনি রিলিজ করিয়ে নেবেন!
— হ্যাঁ, শশাঙ্কবাবু বাড়ি ফিরেছেন। অতুলবাবু পৌঁছে দিয়ে গেছেন।
—আমি যাচ্ছি মায়াদিকে নিয়ে। কাকুর এখন একা থাকা ঠিক নয় তো!
কঙ্কণা শুধু শুনছিল, মন্তব্য করছিল না। সামান্য চুপ। তার পর ও দিকের কণ্ঠটি বলল
— আপনি কে?
—আমি ওঁর ভাইয়ের স্ত্রী। ছিলুম না। এসে গেছি।
চুপ। তার পর আস্তে, তবুও। যদি আমরা যাই আপনি রাগ করবেন?
—না। তুমি চিনে আসতে পারবে?
—হ্যাঁ। গেছি তো এক দিন।
কঙ্কণা কোনও এক মিলি আর মায়াদির জন্যে বসে থাকে। মিনিট চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ পর দরজায় বেল বাজে। কঙ্কণা খুলে দেখে লম্বা স্কার্ট পরা, ভারী ছেলেমানুষ মেম মেম দেখতে মেয়ে একটি বিগ শপার হাতে। পেছনে শক্তপোক্ত পেটা চেহারার নরম মুখের এক চল্লিশোর্ধ্ব মহিলা হাতে সুটকেস, রোল অন লাগেজ একটা।
শশাঙ্ক এখনও ঘুমিয়ে যাচ্ছে। রোগা, ফ্যাকাশে। মিলি সোজা তার ডিভানের কাছে এসে একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়েই থাকে। তার পর হঠাৎ কথা না বার্তা না, সে পেছন ফিরে কঙ্কণার কাঁধে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। শব্দ বেশি নয়। কিন্তু অজস্র জমা জল ঝরছে।
চিনচিন খেলা থেকে মন উঠিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে বলল, দিদি কাঁদছে। মা, দিদি কাঁদছে। শশাঙ্কর ঘুম ভেঙে গেল। সে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে দৃশ্যটা। কঙ্কণার কাঁধে মুখ মিলির। মেঝেতে নামানো লাগেজ। মায়া চিনচিনকে কোলে নিতে হাত বাড়াচ্ছে। সে তড়াক করে উঠে বসল।
কঙ্কণা বলল, আপনি ও রকম হট করে উঠলেন কেন? কী রকম টলছেন! মায়া দাদাকে একটু শুইয়ে দাও তো! তোমরা বসো। আমি দাদার খাবার ব্যবস্থা করি। শশাঙ্ক কিছুই বুঝতে পারছিল না।
—এ সব কী? সে অস্ফুটে বলল।
—মিলিদিদি আপনার কাছে থাকতে এসেছে।
—কেন?
—ওখানে থাকতে পারছে না আপনার অসুখ শুনে।
—অসুখ হয়েছে, সেরে যাবে….এত সব….কোনও মানে হয়?
মিলি বলল, কাকু আমি এখানেই থাকব। ব্যস।
সারা দিন, সন্ধে অনেক ঘুমিয়েছে শশাঙ্ক। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে সে বলে উঠল, স্পার্টা স্পার্টা। তার পরেই একেবারে ভেঙে গেল ঘুমটা। স্পার্টা কেন? কেন বলে উঠল! সে কি কোনও স্বপ্ন দেখছিল? অনেক ভেবেচিন্তে তার মনে হল, সে আসলে চিন্তা ছাড়া থাকতে পারে না। ঘুরছে ফিরছে, মগজটা কিছু ব্যাখ্যা কিছু একটা বিষয় নিয়ে ভেবে চলেছে। সেই প্রক্রিয়াটা ভেতরে ভেতরে চলছিলই। শরীরের মধ্যে যন্ত্রগুলো তার বিগড়ে বসেছে। তাকে এক শীতার্ত পাহাড়ের সানুতে রেখে চলে গিয়েছিল তার বীর্য, তার স্বাস্থ্য, তার মানসিক ক্ষমতা, সব। অলস, শিথিল, ইচ্ছাশক্তিহীন অসহায়। অতুলদা তাকে টোস্ট করে নিতে বলেছিল। কিন্তু অসীম শৈত্য তার শরীর জুড়ে। সে পারত না এই সামান্য কাজও। ওই ঠাণ্ডা সুপটা গলাধঃকরণ করে শুয়ে পড়ত! মাঝরাতে প্রচণ্ড খিদে পেত। খানিকটা জল খেত। তার পর ঘুম না ঘুমের মাঝখানের অবসাদময় অনুভূতি। আস্তে আস্তে নাঙ্গা পাহাড়ের কঠিন পাথর, খোলা ধারালো হাওয়া, শীত। ক্রমশ তুষার আবৃত করত তার দেহ, পর্বতারোহীদের পতন ঘটলে তো এমনটাই হয়! স্পার্টার নিয়ম পৃথিবী মানলে সে পরিত্যক্ত হত। কিন্তু মানেনি। ঘোর থেকে উঠে সে অতুলদা ও মিলিকে দেখল। হাসপাতাল, নার্স, মায়া। কঙ্কণাকে সে খবর পাঠিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু নিজের জন্যে নয়। মিলির জন্যে। প্রত্যাশার অনেক আগেই কঙ্কণা এসে গেছে। গরম রুটি করে দিয়েছে তাকে। আলু চচ্চড়ি যে এত চমৎকার একটা খাদ্য, সে তো আগে জানতই না। তাদের ধানবাদের বাড়িতে রোজ মাংস, মাটন বা চিকেনের চল ছিল। গরগরে তরকারি। এই আলু চচ্চড়ি তাকে যে কী এক নতুন জন্ম দিল! বেশ ভরপেট খেয়ে ঘুমিয়েছে সে। এখন ঘুম ভেঙে মনে হচ্ছে সে স্পার্টান সভ্যতার কেজো, প্র্যাকটিক্যাল, নিষ্ঠুর কঠিন নিয়মগুলোর কথা ভাবছিল। স্পার্টা হেরে যাচ্ছে, এই অক্ষাংশ, এই দ্রাঘিমায়। এ তার কল্পনায় ছিল না। সে জানত, বাস্তব হল, সে একা। কল্পনাশক্তি, বুদ্ধি আজ অবধি শতকরা শতভাগ সে ব্যয় করেছে তার জীবিকার জন্য। নিরপেক্ষ, নিরুদ্বেগ, তথ্যসমৃদ্ধ, বুদ্ধিমন্ত পরিবেশনার জন্য সে সতীর্থ মহলে যথেষ্ট সমাদৃত। কিন্তু ওই পর্যন্ত। কল্পনা অন্য দিকে কাজ করেনি। আবেগও না। সে শিশুটিকে উদ্ধার করেছিল। তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিল একটা চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানে। মিলি নামে কিশোরীটিকেও সে বাঁচতে সাহায্য করছে, আবারও চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানে। কিন্তু শিশুটি যখন তার ভাই বউয়ের কোলে চেপে ঘরে এল, মিলি যখন কঙ্কণার কাঁধে মুখ রেখে কাঁদল, আগেও তার হাসপাতালের শয্যায় মাথা রেখে কেঁদেছে, তখন সে বুঝতে পারছে একটা অন্য রকম ছবি তৈরি হচ্ছে। অন্য কল্পনার তৈরি। সে নিমিত্ত হয়ে রইল এই ছবির এবং ছবিটা এখন তাকে জড়িয়ে নিচ্ছে, সেও ছবিটার বিষয় হয়ে যাচ্ছে, রঙে কালিতে লম্বা গোল আঁচড়ে। সে বরাবর ছবির বাইরে ঘটনার বাইরে নিরপেক্ষ দাঁড়িয়ে থেকেছে। আজ সব হিসেব গোলমাল হয়ে গেছে। ভাবতে ভাবতে সে আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
মিলি থাকে শশাঙ্কর ঘরে, কিন্তু সময় কাটায় কঙ্কণার কাছে। তার তো এখন স্কুল টুলের বালাই নেই। সে বালিগঞ্জ প্লেসের বাড়ি থেকে তার প্রিয় বইগুলো নিয়ে এসেছে। দুঃখের বিষয় যাবতীয় কিশোরপাঠ্য রোমাঞ্চ তার বিষ লাগছে। সে কঙ্কণার, শশাঙ্কর বুককেস ঘাঁটছে। বাংলা পড়তে আটকাত। কঙ্কণার সাহায্যে সড়গড় হয়ে যাচ্ছে বেশ। তা ছাড়া, তাদের দু’জনকেই মোহিত করে চিনচিন দিদি আর মাকে নানান তথ্য জানাচ্ছে, যেমন টিট্টিটি খেলে। পিঁপড়ে ধুলো খায়। আরশুলা চিনি খায় শুঁড় নাড়ে। বলতে বলতে এক এক সময়ে সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে, আতঙ্কে নীল হয়ে যায়। পোকা পোকা, গায়ে পোকা খাচ্ছে….। তাকে ভোলাতে বেশ বেগ পেতে হয় তখন। সে কথা বলতে শিখছে। দেরিতে। আটকে আটকে।