Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নূহর নৌকা || Bani Basu » Page 2

নূহর নৌকা || Bani Basu

বিকেল ছ’টা নাগাদ দরজায় চাবি ঘোরাবার শব্দ হয়। বেশ বড় অনুপমা হাউজিং এস্টেটের চত্বরটা। টালিগঞ্জ অঞ্চলে এ রকম অনেক গড়ে উঠছে। আসুন আসুন, ফ্ল্যাট বিক্রি আছে। শুধু ফ্ল্যাট নয়, মর্নিং ওয়াকের রাস্তা, বসে হাওয়া খাওয়ার পুকুর, সাঁতারের পুল, ক্লাব। আসুন, উন্নত মানের জীবনযাত্রার জন্যে। শিগগিরই হবে হেল্‌থ ক্লাব, বিউটি ক্লিনিক, মন্তেসরি স্কুল, ক্রেশ…। একটা ছোটখাটো স্বয়ংসম্পূর্ণ টাউন আর কী! মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত আর অত্যুচ্চবিত্ত তিনটি শ্রেণি। শ্রেণিবদ্ধ সমাজ। যতই জাতপাত তুলে দেওয়া যাক না কেন, আদি অকৃত্রিম ধনী দরিদ্র শ্রেণি, তাদের মধ্যে আরও অনেক স্তর, বিভিন্ন স্তরে আদান-প্রদানের অভাব, কারও হীনম্মন্যতা, কারও উচ্চম্মন্যতা— এ আছেই। উচ্চবিত্ত অর্থাৎ হাই-ইনকাম গ্রুপ ফ্ল্যাট দুটো পাশাপাশি। এ-ফ্ল্যাটে চাবি ঘোরালে ও-ফ্ল্যাটে আওয়াজ হয়। ও-ফ্ল্যাটে জানলা বন্ধ করলে এ-ফ্ল্যাটে শোনা যায়। তাই পাশের ফ্ল্যাটের দরজা নিঃশব্দে খুলে যায়। একটি শ্যামল মুখ, একজোড়া উজ্জ্বল চোখ দেখা যায়।
—আজ এত তাড়াতাড়ি দাদা!
—ও-ই!… শশাঙ্ক বলে, না তাড়াতাড়ি নয়। বরং সে প্রায় ছত্রিশ ঘণ্টা পরে বাড়ি ফিরছে। কালকে রাতে আসাটা আসাই নয়। এত কথা বলার মানুষ সে নয়। তার এড়ানো জবাবে মেয়েটির মুখ সামান্য ম্লান হল সে কি বুঝতে পারল? বলল— লোটনের ফোন এসেছিল নাকি?
কঙ্কণাও বেশি কথা বলতে চায় না। সে পারে। তার ইচ্ছেও করে। কিন্তু যে যে-রকম তার সঙ্গে সে-রকম চলাই ভাল। তাই সে সংক্ষেপে বলে— না।
শশাঙ্ক ঢুকে যায়। দরজাটা বন্ধ করে দেয়। এখন তার কারও সঙ্গে গপ্পো করবার মন নেই। কখনওই বা থাকে! নেহাত আনমনে সে চান-টান করে, জামা-কাপড় ধোপার বাক্সে ফেলে দেয় এবং পাজামা-পাঞ্জাবি গলিয়ে নেয়। শোওয়ার ঘরে যায় না। বাইরের ঘরে একটা ডিভানের ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে, চোখের ওপর আড়াআড়ি একটা হাত রাখে যেন আলো আড়াল করছে। অথচ আলো সে জ্বালেইনি। জানলা দিয়ে বাইরের আলো যেটুকু আসছে তা বিরক্ত করবার মতো নয়। কেমন একটা ঘুম আর জেগে থাকার মাঝামাঝি অবস্থায় অনেকটা সময় কেটে যায়। রক্তগঙ্গা বয়, সমস্ত স্মৃতি সত্তা জুড়ে, দুটি নরনারীর মৃতদেহ শুয়ে থাকে, বয়স্ক মৃতদেহ, তার জনক-জননী, তার ওপরে আরোপিত হয় আরও দুটি লাশ, যুবক-যুবতীর। এরাও জনক-জননী, একটি শিশুর। অনিচ্ছাকৃত পেশি কম্পন হয় শশাঙ্কর সারা শরীরে, সে অস্ফুটে বলে ওঠে, না না না।
তার পরই তার দরজায় বেল বাজে। রাতের খাবার নিয়ে এসেছে কঙ্কণা। এই ব্যবস্থাটা সে পছন্দ করে না আদৌ। কিন্তু তার বাড়ি থাকা, ফেরার সময় এতই বেঠিক যে, এই রুটিনের সঙ্গে মিলিয়ে কোনও রান্নাবান্নার লোক পাওয়া যায় না। কঙ্কণার কাছ থেকে চাবি নিয়ে তারই ব্যবস্থাপনায় পরিষ্কৃত হয় বলেই তার ফ্ল্যাটটা বাসযোগ্য আছে, তার বিছানাপত্তর শোওয়ার যোগ্য, তার জামা-কাপড় পরার যোগ্য আছে। সে এগুলো কোনওটাই পছন্দ করে না। কিন্তু বেশি না না করতে পারে না, তাই হাল ছেড়ে দিয়েছে। হোম সার্ভিসে বলে যে খাবার আনিয়ে নেবে, সেটাও সব সময়ে হয়ে ওঠে না। কেননা, তাদেরও সময়মত জানানো চাই। ঢুকতেও পারতে হবে। কঙ্কণার কাছে চাবি তো থাকেই, যে ভাবে ঘর পরিষ্কার হয়, সে ভাবেই খাবারও এসে যেতেই পারত। কিন্তু কঙ্কণা খুব দৃঢ় গলায় জানিয়েছে— এটাও তো হোম সার্ভিসই, না কী? দামটা দাদার ইচ্ছে হলে দিয়ে দেবেন। ৩৫ টাকা ফিশমিল, ৪০ টাকা চিকেন। ৪৫ টাকা মাটন, নিরামিষ ৩০ টাকা। এই ভাবে দামের তালিকাও সে গড়গড় করে বলে গেছে। মুখ গম্ভীর। ফাজলামি করছে কি না বোঝবার উপায় নেই।
কঙ্কণার একটা মূল প্রশ্ন আছে। গৃহকর্মনিপুণা সুশ্রী রমণীই তো বিয়ের পাত্রী হিসাবে খোঁজা হয়। গ্র্যাজুয়েট হবে অন্তত, পাঁচটা লোকের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারবে। সে তো সেই রকমটাই। ঘর গুছিয়ে মানুষকে যত্ন করে, খাইয়ে-দাইয়ে সুখ পায়। পাশে সে। আপন ভাইয়ের বউ থাকতে শশাঙ্ক কেন সামান্য রাতের খাওয়া বা একটু জলখাবারের ভাগ নিতে এত আপত্তি করে তা তার মাথায় ঢোকে না। সুতরাং সে এখন ক্ষুধার্ত ক্লান্ত মানুষটির জন্য যত্ন করে রুটি, মাংস, ডাল, পটলভাজার গরম গরম ডিনার নিয়ে এসেছে। খাবার দিয়ে কঙ্কণা নিতান্ত অনিচ্ছায় চলে আসে। বসে খাওয়াবার সাধ থাকলেও সে সব এখানে প্রশ্রয় পায় না।
এবং খেতে বসে এত দিনের এত দুর্ঘটনা দেখে দেখে অভ্যস্ত জার্নালিস্টের আজ হঠাৎ প্রবল বমি পেতে থাকে। ছাগমাংসে আর মানুষের মাংসে যেন কোনও তফাত নেই। পটলভাজা একটু ডাল দিয়ে কোনও ক্রমে কিছুটা খেয়ে শশাঙ্ক সব কিছু গার্বেজ বিন-এ ফেলে দেয়।
শহর মানে পাকা রাস্তা। শহর মানে বাড়ি। শহর মানে উপরন্তু প্রচুর যানবাহন, ভিড়, বাজার-দোকান, গোলমাল, কেনাকাটা, যাতায়াত, ব্যস্ততা, যানজট। শহর মানে কলের জল, বিজলি বাতি, রাস্তা সারাই। মূল নকশা একটা আছে ঠিকই, কিন্তু চালু হয়ে যাবার পর এইসান জোর দম দিয়ে খেলনাটাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে যে, সেটা নিজের বডির ওপরই উল্টোপাল্টি খাচ্ছে। ছেয়ে রঙের রাস্তাগুলো যানের তলায় কিলবিল করছে। গর্ত-গাড্ডায় হেঁচকি তুলছে। গাড়লের মতো কেশে কেশে ছুটে যাচ্ছে বে-মেরামত সরকারি-বেসরকারি বাস, অটো-রিকশা, ট্যাক্সি, প্রাইভেট কার, ট্রাক। হঠাৎ পাখির চোখে দেখলে মনে হবে শহরটা পাগলই হয়ে গেছে বুঝি। সে জানে না কী চায়, কোথায় যাবে। এখানকার কোনও রাস্তা কোথাও পৌঁছয় না, কোনও গৃহে শান্তি নেই, কোথাও কেউ ঘুমোয় না এখানে। সকাল থেকে রাত অবধি ধান্দা, শুধু ধান্দাতেই ব্যয় হয়ে যায় এখানে জীবন। এই দেখাটাই একমাত্র সত্যি না হতে পারে, অন্য রকম নানান দেখাও থাকা সম্ভব। কিন্তু কঙ্কণা তার পাঁচতলার পেছনের বারান্দা যা হাউজিং-এর দিকে পিঠ করে ব্যস্ত সড়কের দিকে মুখ করে ঝুলে আছে, সেখানে জামা-কাপড় শুকোতে এবং তুলতে এসে এই রকমটাই দেখে। সারা শহরে একমাত্র তারই হয়তো অবসর আছে এ ভাবে দেখবার, ভাববার। সে তো ধান্দাহীন কিনা! নিঃসন্তান গৃহিণী রমণী এক, যার স্বামী মাসের অর্ধেক ট্যুরে কাটায়। নৈর্ব্যক্তিক রাস্তা, গলি, ফটক, কেয়ারটেকার, ব্লক, বি সি, এ সবের দিকে তাকিয়ে কঙ্কণা ভেবে পায় না এত মায়া এত মোহ নিয়ে সে কী করবে! গান শোনে, বইও পড়ে কিছু কিছু। পাড়া-পড়শিদের সঙ্গে গল্প-গাছাও যে নেই, তা নয়। কিন্তু এগুলোর কোনওটাই নিজস্ব কাজ বলে তার মনে হয় না। সে যেন ওয়েটিং রুমে বসে আছে, ট্রেন আসছে না। জীবনটা শুরু হয়েও হচ্ছে না, এমনই মনে হয় তার। তখনই সে চড়ুই পাখির মতো ছটফট করে ওঠে। এক বার পেছনের বারান্দায়, আর এক বার সামনের বারান্দায় ছোটাছুটি করে। মন দিয়ে দেখে অফিস গাড়িগুলো বেরিয়ে গেল। স্কুলবাস দাঁড়িয়েছে প্রধান ফটকের বাইরে, হই হই করে একদল বাচ্চা উঠে গেল, বা নামল। চলমান জীবন দেখে সে। ওই ঊর্ধ্বশ্বাস দৌড়টা সত্যি, না তার এই অকর্মক ঘটনাহীন স্থির থাকাটা— সে ঠিক করে উঠতে পারে না। সবটাই তার খুব অসঙ্গত, সুতরাং অবাস্তব লাগে।
ফ্রক স্কার্ট-পরা দিনকালে লক্ষ্যগুলো ছিল ছোট ছোট। এক ক্লাস থেকে আর এক ক্লাসে ওঠা। আরও মার্কস পাওয়া, সেলাই আরও নিখুঁত। সাজগোজ আরও পরিপাটি।— এই দেখেছিস মিতালি ভুরু প্লাক করেছে! কী রকম অস্বাভাবিক ঢাকনার মতো গোলচে হয়ে গেছে! এই যাবি নাকি! জানিস, মুখের মধ্যে ছোট ছোট লোম থাকে বলে কালো লাগে। সেগুলো তুলে দিলেই ফর্সা। যাবি?— এই সব। রবীন্দ্রজয়ন্তী, সরস্বতী পুজো, অ্যানুয়াল সোশ্যাল— এই রকম ছোটখাটো ঢিপি-ঢিলা লাফিয়ে পেরনো। ফ্রেশার্সে কোরাস গান, স্বাধীনতা দিবসে প্যারেড। শ্রুতিনাটক…। বিয়ের পরও যদি এই রকম ছোট ছোট শৃঙ্গজয়ের ব্যাপারটা থাকত! শ্বশুর-শাশুড়ি জয়।— মা আপনি বসুন না, আমি আর এক বার চা করে আনছি।… তাতে কী হয়েছে! ননদের প্রেমে সাহায্য।— হ্যাঁ রে! সত্যি কুন্তল তোকে ভালবাসে। বয়সের অল্প তফাতই ভাল, বেশ বন্ধু বন্ধু। আমার তো বাবা কুন্তলকে খুব পছন্দ। ধুৎ, আমার জন্যে কেন, তোর জন্যে তোর জন্যে! ঠাকুরজামাই এলো বাড়িতে, হি হি। স্বামীর আস্থাভাজন হওয়া।— শোনো, আমি তোমার নামে একটা, আমার নামে একটা লাইফ ইনসিয়োরেন্স করাচ্ছি। শোনো, এয়ারকুলার কিনব, না কণ্ডিশনার, ভেবে বলবে। ন্যাচারালি, তুমি যা বলবে তাই হবে…, নিজের বন্ধুদের নিয়ে বেশ আড্ডা। বাড়িতে, বাইরে…। কাঁকনের শ্বশুরবাড়িটা ফ্যানটাস্টিক। যত খুশি গপ্পো মারো চমৎকার, বেগুনি, আলুর চপ এসে যাচ্ছে। স্বামীর বন্ধুদের পছন্দের বউদি হতে পারাটাও একটা লক্ষ্য বই কী! এ রকমটাই তো হয়ে থাকে বলে সে শুনেছে। কিন্তু তার বেলা হল না। দুই ভাইয়ের সংসার। তা-ও আলাদা। বড় ভাই বিয়েই করেনি। এদের মা-বাবা, বোন-টোন কোত্থাও কেউ নেই। ভালই এক হিসেবে। ভাল বলেই মা-বাবা দিয়ে ছিলেন। কিন্তু কোনও চাঁদমারি না থাকায় পুরোটাই এক ফাঁকা মাঠ। কী জয় করবে তুমি কাঁকন? কোথায় পৌঁছবে? স্বামীর বড় ভাইয়ের চাকরির দিন নেই, রাত নেই। আর স্বামী? তার কথা বলে কাজ নেই। অর্ধেক দিন হিল্লি-দিল্লি, চেন্নাই-পুণে। যখন এখানে থাকে সে এক জন আদর্শ স্ত্রীর মতো নিখুঁত সাপ্লায়ার থাকে। কিন্তু মৃগাঙ্ক সেটাকে তার কোনও বিশেষ কৃতিত্ব বলে মনে করে না। পড়ে-পাওয়া চোদ্দো আনা। অথচ, ঠিক এই সুখ তার অজানা ছিল। বোর্ডিং-এ মানুষ, তার ষোলো আনা স্বনির্ভর হওয়ারই তো কথা! যখন বাইরে যায় তেমনই থাকে। শার্ট-এর ভাঁজ, রুমালের গোছ, চাবি, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড সব আলাদা আলাদা খোপে। কিন্তু স্ত্রীর আওতার মধ্যে থাকলেই তোয়ালে গুণ্ডুলি পাকিয়ে পড়ে রইল, প্যান্টটা লাথি মেরে এ-দিকে, গেঞ্জিটা চড়চড় করে খুলে ছুড়ে ও-দিকে, সুখ-সুবিধেগুলো কেমন নির্বিকার ভোগ করে। কোথাও কোনও চমক যেন তার নেই। এ রকম ঘুম থেকে ওঠা মুখে গরম চা পাওয়া বা নানাবিধ অন্ন-ব্যঞ্জনের আহার, সুন্দর সুগন্ধ বিছানা, চমৎকার ইস্ত্রি করা পোশাক পরিচ্ছদ টিপটপ হাতের কাছে পাওয়া, এটাই যেন স্বাভাবিক।
বাচ্চা-কাচ্চা হলে তার জীবনটা একটা মানে পেয়ে যেত, একটা অভিমুখ যাকে বলে। হল না। দু’বার ফটাস ফটাস করে গর্ভপাত হয়ে গেল। কিছু দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার কথা ডাক্তার বলেছিলেন, মৃগাঙ্কর গা নেই। সে উচ্চাকাঙ্ক্ষার শাখায় শাখায় শাখামৃগ এখন।
হাতের কাছে এক জনই মানুষকে পায় সে, যাকে কিছু দিলে সে সম্ভ্রমে নেয়, ওটা তার প্রাপ্য বলে হেলাছেদ্দা করে না। কিন্তু চায় না তো! শশাঙ্কও স্বনির্ভর, কিন্তু তার ভাই মৃগাঙ্কর ধরনে নয়। মৃগাঙ্ক একটু বড় হতেই বোর্ডিংয়ে, কেননা তাদের মা-বাবা কোলিয়ারিতে ছিলেন। ম্যানেজার। প্রচণ্ড মাফিয়ার উৎপাত ওখানে। শশাঙ্ক হস্টেলে গেছে। কিন্তু কলেজ-জীবনে। মা-বাবার সঙ্গে স্নেহ ভালবাসা দায়-দায়িত্ব ভাগ করেই তার জীবনের গোড়ার দিকটা কেটেছে। এখনই না হয় কানকাটা সেপাই। কথাটা ওরা আলোচনা করতে চায় না। কিন্তু কঙ্কণা আত্মীয়দের কাছে শুনেছে, এদের বাবা-মা খুন হয়ে যান। মাফিয়াদের হাতেই সম্ভবত। কিন্তু তার কিনারা হয়নি। তার পরই তাদের ধানবাদের সঙ্গে সম্পর্ক চুকল। বাবার সঞ্চয় ও কোম্পানির ক্ষতিপূরণের টাকায় এই দুই ফ্ল্যাট। মৃগাঙ্কর পড়াশোনার শেষ পর্ব নির্বিঘ্নে চলতে থাকে। সে দিব্যি দায়হীন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে বড় হয়ে ওঠে। শশাঙ্ক খুব সম্ভব ভাইকে দাঁড়াতে সাহায্য করা আর কাজে নিজেকে ডুবিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনও পরিত্রাণ দেখতে পায়নি। সে-ই উদ্যোগ করে ভাইয়ের বিয়েটা দেয়। ভেতরে ভেতরে শশাঙ্ক যন্ত্রণা বয়ে বেড়ায়। বাবা-মার মর্মান্তিক মৃত্যু তাকে বিশ্রাম নিতে দেয় না। কথাগুলো বলে না ব’লেই ভেতরে আরও গুমোট— এগুলো কঙ্কণা বুঝতে পারে। দাদাকে সেবা-যত্নই তো করতে চায় সে। একটা সীমা পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু নিত্য দিন ভাইয়ের স্ত্রীর ওপর নির্ভরতা শশাঙ্ক পছন্দ করে না। সেভাবে দেখতে গেলে তাই বিয়ের পর কঙ্কণার কোনও শৃঙ্গজয়ই হয়ে ওঠেনি। এমনকী, হাতের কাছের ভাসুর পর্যন্ত না। স্বামীকেই বা পারল কই! সে কেমন নিজের তালে আছে। কীসে আরও প্রোমোশন, কীসে আরও কতক চাট্টি টাকা আসে! আরে অত প্রোমোশন টাকা দিয়ে করবি কী! গৃহসুখ বলতে কিছু যদি না-ই পাস? এবং গৃহস্থের খোকা-খুকু কিছু হল না।
কঙ্কণা এখন তার সেলাই-শিক্ষা কাজে লাগিয়ে চুপচাপ কিছু অর্ডার নিচ্ছে। এ যদি কোনও লক্ষ্যে পৌঁছবার চেষ্টা হয় তো তা-ই। কিন্তু চার পাশটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা। স্বভাবে সে চটপটে, হাসিখুশি। মুখভার করে থাকা তার পোষায় না। তাই শূন্যতাটার কথা তার জামসেদপুরের আপনজনেরাও কেউ জানে না।
কোল-বারান্দা সামনের দিকে। ঘাপটি মেরে বসে সে দ্যাখে যাওয়া-আসা। আলগা একটা চোখ ফেলে রাখে শুধু। ভেতরে জাল বুনে যায়, অভ্যস্ত চিন্তার জাল। মন চিন্তা ছাড়া থাকতে পারে না কিনা। মৃগাঙ্কর মন বড় অদ্ভুত! কী রকম স্পটলাইটের মতো। যেটুকুতে পড়ল সেটুকুকেই আলোকিত করল। সেই ছোট্ট বিন্দুটার বাইরে অতল অন্ধকার। সিগারেট খাচ্ছে। কিচ্ছু জিজ্ঞেস করো, বলবে— দেখছ একটা কাজ করছি। ধূমপান করাটা আবার কাজ? কঙ্কণা হয়তো হেসে উঠল। মৃগাঙ্ক বলবে— এর ভেতরে অনেক কথা আছে, ম্যাডাম। স্মোক করছি, ধোঁয়াটা গিলছি না। সিগারেটটা অর্ধেক বাইরে জ্বলছে, অর্ধেক মুখে। এতে কনসেনট্রেশন লাগে, তুমি তুশ্চু স্ত্রীলোক, তুমি কী বুঝবে। খেতে বসে গল্প হবে এঁটো হাতে, তবে না খাবার তৃপ্তি। তখন যদি সে অতীতের সেই ভয়ংকর দিনগুলোর কথা তোলে, সে বলবে— তুমি তো তখন ছিলেই না। এ সব নিয়ে তোমার মাথা ঘামানোর কথাই নয়।
মুখে মুখে জবাব দেবার মতো উপস্থিত বুদ্ধি কঙ্কণার জোগায় না সব সময়ে। পরে জবাবটা ধরা দেয়। যে মুহূর্তে এদের বাড়ির বউ হয়ে ঢুকেছে, এ পরিবারের ইতিহাসে তারও তো উত্তরাধিকার জন্মে গেছে! তার অধিকারেই সে অতীতের কথা তোলে। স্মৃতির মধ্যে ঢোকা মানেই পরিবারের গভীরে ঢোকা। নইলে তো তুমি বাইরের লোক রয়ে গেলে। নেহাত হাউজকিপার, শয্যাসঙ্গিনী। কোনও নারী, কোনও মানুষ এ ভাবে থাকতে পারে না কি? মৃগাঙ্ক এ সব সরু সরু কথা বুঝতে পারে না। সে মোটা মোটা খড়ির দাগের মানুষ।
‘প্রেস’ লেখা গাড়িটা ঢুকল। শশাঙ্ক তার দরজা খুলে বেরিয়ে এল। তার চলা-ফেরায় একটা সতর্কতা। চটপটে ভাব আছে ঠিকই, কিন্তু পুরো চেহারাটার ওপর ভীষণ একটা অন্যমনস্কতার ছাপ। সব সময়েই যেন কী ভাবছে। মনটা যেন এখানে নেই, অন্য কোথাও ঘুরে বেড়াচ্ছে। বেশ কিছু দিন ধরে এটা বেড়েছে। ঠিক কী ভাবে সে, কোথায় মনটা রেখে আসে, তারও কি কোনও স্পটলাইট আছে? খুব জানতে ইচ্ছে করে কঙ্কণার। সত্যিই তো, এখনও পর্যন্ত সে কোনও মানুষের মন জানল না, তার মনও কেউ জানতে চায়নি। এখন সন্ধে সাড়ে সাত।
তার বাড়ির বেলটা কি বাজল? কঙ্কণা বারান্দা থেকে দরজায় পৌঁছতে বেশি সময় নিল না। সে খুব ঝরঝরে চটপটে মানুষ। স্কিপিং করা মেয়ে বাবা! কী আশ্চর্য! বাইরে তো শশাঙ্কই দাঁড়িয়ে!
একটু অপ্রস্তুত ভাবে মাথায় হাতটা বুলিয়ে নিল শশাঙ্ক। দু’একটা লম্বা পাকাচুল বিপর্যস্ত হয়ে এ দিক ও দিক ছড়িয়ে পড়ল। বলল— হঠাৎ প্রচণ্ড খিদে পেয়ে গেল বুঝলে? কিছু আছে-টাছে? না থাকলে কষ্ট করতে হবে না।
—আছে আছে। কঙ্কণা তাড়াতাড়ি বলল, আপনি গিয়ে চান করুন, আমি এক্ষুনি নিয়ে আসছি।
মেয়েদের স্বভাব তারা শুধু নিজেদের জন্য কিছু করার উৎসাহ পায় না। কঙ্কণা তার ব্যতিক্রম হতে পারল কই? তার সত্যি বলতে কি কিছুই ছিল না। এখন চটপট প্রেশারে একটা হালকা খিচুড়ি করে নিল। তাতে তরিতরকারি যা ছিল বেছেকুছে দিল। মাছ ভাজল। চাটনি ছিল। ঠিক কুড়ি মিনিটের মাথায় শশাঙ্কর ফ্ল্যাটে পৌঁছল সে। মাথা থেকে মানুষটির পটপট করে জল পড়ছে। কোনও ক্রমে পায়জামার ওপর একটা গোলাপি মতন পাতলা পাঞ্জাবি চাপিয়েছে। জায়গায় জায়গায় ভিজে উঠেছে সেটা। শশাঙ্ক দরজা ছেড়ে দাঁড়াল।
কঙ্কণা ছোট খাবার-টেবিলটার ওপর তার ক্যাসেরোল রাখল। সঙ্গে আজ ঝুলিতে করে প্লেট-টেট নিয়ে এসেছে সে। প্লেট গ্লাস জলের বোতল। শশাঙ্কর ডেরার মুরোদ জানে সে।
হঠাৎ শশাঙ্ক বলল— একটু বসবে? তোমার সঙ্গে একটু কথা, একটু পরামর্শ ছিল।
কঙ্কণা খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল। তার সঙ্গে? কী কথা তাহার সাথে? তার সাথে? পরামর্শ? শশাঙ্ক দ্য গ্রেট। মৃগাঙ্ক দ্য গ্রেট-এর বড় ভাই, যিনি সাবধানে নিজেকে অকিঞ্চিৎকর ভাই-বউয়ের সাহচর্য সাহায্য থেকে বাঁচিয়ে চলেন, বস্তুত লোটনের কথা ছাড়া আর কোনও কথাই জিজ্ঞেস করেন না, সেই তিনি ভাই-বউ দ্য লিট্‌ল, কঙ্কণা দ্য লিট্‌ল-এর কাছে কী পরামর্শ চাইছেন! প্রেমে-ট্রেমে পড়েছেন না কি? কিন্তু এদের কাছে তার কোনও আবেগের প্রত্যাশা নেই। তাই সে সংযত থাকে। বলে— বলুন। বসছি। খিদে পেয়েছিল বলছিলেন যে? যেন সে পরামর্শের অন্তরঙ্গতাটা স্থগিত করে দিতে চাইছে।
—হ্যাঁ তাই। আসলে সারা দিন যে একেবারেই খাইনি। খালি চা, চা আর চা, মনে ছিল না। হঠাৎ বাড়িতে ঢোকবার সময়ে টের পেলুম খিদেটা। ক’দিন সমানে জাঙ্ক ফুড! ওই সব সাব ওয়ে-টোয়ে হয়েছে না? কেমন বিশ্রী লাগল হঠাৎ, তোমার কোনও অসুবিধে-টিধে…
কঙ্কণা কিছুই বোঝায় না এমন একটা হাসি দিল। তার অসুবিধের কথা ইনি বড্ড বেশি ভাবেন। কাঁটা হয়ে থাকেন একেবারে। সুবিধের কথাটা ভাবলে পারতেন বরং। ইনি যে তাকে একটা বিয়েই দিয়েছেন, গেরস্থালি বলতে কিছু দ্যাননি, সেটা কি ইনি বোঝেন? এঁদের, বিশেষ করে এঁর ভাইয়ের যে মলাট ছাড়া আর কিছু নেই— স্বাস্থ্যবান, বলতে কইতে ওস্তাদ, ভাল অঙ্কের মাস মাইনে, ব্যস ভেতরে ফক্কা। ইনি জানেন সেটা?
খাবার মুখে তুলল শশাঙ্ক।— বেশ। তার সারা মুখে একটা খুশি ছড়িয়ে পড়ল। এত দিন এত খাইয়েছে, কখনও এমন দেখেনি কঙ্কণা। হঠাৎ গোঁত্তা খেয়ে খুশিটা যেন থেমে গেল।
—ধরো একটা বাচ্চা ছেলে আড়াই-টাড়াই হবে, একটা ট্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে… হ্যাণ্ডল করতে পারবে?
—মানে? কঙ্কণা সোজা হয়ে বসল।— ল্যাজা নেই মুড়ো নেই, কী বলছেন ভাল করে বলুন!
শশাঙ্ক নিঃশব্দে খেতে থাকে। সে তো জানতই তাকে বিশদ হতে হবে। কেমন করে, সেটাই কথা। খুব জটিল হয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা। ও দিকে লোটনও নেই।
খাওয়া শেষ করে মুখ হাত ধুয়ে এল সে। হঠাৎ যেন মেয়েটির সামনে তার বে-আব্রু দশা। সে অসহায়, পরামর্শ চাইছে। সাহায্য চাইছে। নিজের চাকরি সূত্রে উৎপন্ন কিছু সমস্যার কথা বলতে হচ্ছে। তার ঢাকনা-পরানো স্বভাবে এমনটাই মনে হল।
কঙ্কণা থালা-টালা গুছিয়ে নিচ্ছে।
সে অগত্যা বলল— কই, কিছু বললে না?
—আপনিই বা কী বললেন? বাচ্চা হ্যাণ্ডল করতে পারব কি না? হ্যাঁ পারব। কিন্তু ব্যাপারটা তো আমাকে জানতে হবে!
জল বড্ড দূর গড়িয়েছে। মাস দেড় হল বাচ্চাটা হাসপাতালে। এখন তার ফেরবার সময়। সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছে। কিন্তু বাড়িতে বৃদ্ধ দাদু ছাড়া কেউ নেই। তার মাতৃ-পিতৃহীনতার কথাও তো শিশুটি জানে না। ভয় খায়, হঠাৎ হঠাৎ পোকা-পোকা বলে তুমুল কঁকিয়ে ওঠে।
শশাঙ্কর অবশ্য এ সব ভাবার কথা নয়। কিন্তু নিজের উদ্ধার করা শিশুটিকে সে প্রতি দিন দেখতে যেত। তাকে খুব চিনেছে। সে না গেলেই কান্নাকাটি করবে। তার দাদু কার্তিক সামন্ত এই ক’দিনে খুব ভেঙে-চুরে গেছেন। স্বাভাবিক। জোর তদন্তও চলছে। এক দিনই মাত্র তিনি আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে নাতিকে দেখতে এসেছিলেন। তারই মধ্যে কোনও ক্রমে শশাঙ্কর হাতে একটি চিরকুট গুঁজে দিয়ে যান। তাতে লেখা— চিনু ইন ডেঞ্জার। বাড়িতে নিয়ে গেলে ও এ বার খুন হয়ে যাবে। আপনি দয়া করে আমার নাতিকে বাঁচান। আমি পুলিশকেও বিশ্বাস করি না। সবাই টাকা খেয়ে গেছে।
প্রেসের তরফ থেকে আরও সংবাদ, পরবর্তী সংবাদের অছিলায় দু-তিন বার সে কার্তিক সামন্তর সঙ্গে দেখা করেছে। তা না না না করে তিনি যেটুকু বলতে পেরেছেন তা বড় ভয়ানক। তাঁর সম্পত্তি অনেক। একটি ছেলে একটি নাতি। ছোট ভাইয়ের পরিবার বেশ বড়। তারা তাঁরটা নানা ভাবে দখল করতে চেষ্টা করছে। ছেলে তারক খুব শক্ত ছেলে ছিল। সুবিধে হচ্ছিল না। মোটের ওপর তাঁর ধারণা এই খুনের পেছনে কোনও মস্তান নয়, তাঁর নিকট আত্মীয়রাই রয়েছে। কাউকে সুপারি-টুপারি দিয়ে করিয়েছে। চিনচিন নিকেশ হয়ে গেলে তারা কার্তিক সামন্তর সম্পত্তিটা পুরো পায়।
প্রাণঘাতী ভয়ে দাদু নিরুদ্দেশ করে দিতে চাইছেন নাতিকে। তাতে সাহায্য লাগবে শশাঙ্কর। এই মুহূর্তে সন্দেহের কথা বলাও বিপদ। কারণ ওই, পাড়া-মস্তান পুলিশ সবাই নানা ভাবে টাকা খেয়ে আছে। আশ্চর্য! শিশুটির জন্য তার কাকা-কাকিদের উদ্বেগ ও ভালবাসায় কোনও ঘাটতি তার চোখে পড়েনি। এত দিনের অভিজ্ঞতায় সে রাজনীতির লোকেদের হিপক্রিট বলে চিনেছিল। কিন্তু সাধারণ গৃহস্থ মানুষ, যারা খেয়ে পরে সুস্থ হয়ে চমৎকার বেঁচে থাকার সুযোগ পাচ্ছে, তারা ডবল পাওয়ার জন্য দু’জন নিকট আত্মীয়কে এবং বাড়ির একমাত্র সুন্দর একটি শিশুকেও খুন করতে পিছপা হচ্ছে না, এবং তারা এমন করে নিত্যকর্ম করে যাচ্ছে যে ব্যাপারটা টের পাওয়া শক্ত? শশাঙ্ক ব্যাপারটা তার সহকর্মীকে জানায়। সে বলে— এতে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে? দিবারাত্র এ সব ঘটনা ঘটছে এখন। মানুষ আর মানুষ নেই। পিশাচ হয়ে গেছে। তার কথার ধরন শুনে শশাঙ্কর মনে হল মানুষের মানুষত্ব বা পিশাচের পিশাচত্ব কোনওটাই সঠিক উপলব্ধি করে সে কথাগুলো বলল না। যে কোনও ঘটনাকে তার খবর-মূল্য অনুযায়ী দেখতে দেখতে সাংবাদিকদের এই অবস্থাই হয়।
সমস্ত শুনে কঙ্কণা স্তব্ধ হয়ে থাকে— এমনও হয়!
আমাকে এক বার নিয়ে যাবেন বাচ্চাটার কাছে?
—ও রিস্‌ক নিতে পারব না। তোমার সঙ্গে বাচ্চাটাকে কেউ যেন কানেক্ট করতে না পারে। আমি শুধু চুপচাপ ওকে তোমার কাছে এনে দিতে পারি। তার পর কী?
—আমি ওকে নিয়ে জামসেদপুরে চলে যেতে পারি। চট করে খোঁজ পাওয়া যাবে না। কিন্তু আপনার ভাইকে সামলাতে হবে। তার ওপর ধরা পড়লে আমাকে তো লোকে ছেলেচোর বলবে! ভেবে দেখুন।
—তা বলবে না। কার্তিক সামন্তর কাছ থেকে আমি লিখিয়ে নেব সব।
কী ভাবে দাদু হাসপাতাল থেকে আচমকা ফোন পেয়ে নাতিকে একলা রিলিজ করতে চলে এলেন। কী ভাবে দাদু রাস্তায় বেরলে একটি ঝাঁকড়াচুলো জোয়ান মতো লোক তাকে তাঁর কোল থেকে হাতিয়ে নিয়ে চম্পট দেয়, বৃদ্ধ রাস্তায় বসে হাপুস নয়নে কাঁদতে থাকেন। সে এক শ্বাসরোধকারী গল্প। কিন্তু শক্ত হাতে বোনা। তাতে না পুলিশ, না নিকটাত্মীয় কেউ কোনও খুঁত বার করতে পারে না। এবং সাঁঝের অন্ধকারে একটি সাধারণ দর্শন মারুতি ওয়াগন স্টিলসিটির দিকে রওনা হয়ে যায়। শিশুটি সামান্য ঠোঁট ফুলিয়েছিল। কিন্তু অচিরেই আদরে, খেলায় ভুলে যায়। নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে।
‘‘বেহালায় দম্পতি খুন ও শিশু অপহরণের ঘটনায় নতুন চমক, নতুন মোড়’’ বলে যে প্রতিবেদনটি পর দিনই বেরোয়, তার জন্য খাটতে শশাঙ্ক ৫/১ বাড়ি আর অফিস, অফিস আর ৫/১ বাড়ি করতে করতে ক’দিন নাইবার খাবার সময় পেল না।
একটাই খুঁত গল্পটাতে। কঙ্কণা তার অনুরোধে দুর্ঘটনায় মৃত দম্পতির অনাথ একটি শিশুর ভার নিয়েছে, এ কথা শশাঙ্ক তার ছোট ভাইকে জানিয়েছে। লোটন ক্ষুব্ধ। কিন্তু যেহেতু দাদা মনে করিয়ে দিয়েছে, সে এত দিন লোটনের গায়ে কোনও ঝড়-ঝাপটা লাগতে দেয়নি, আজ মানবিক সংকটে পড়ে দাদা যদি তার একটা সাহায্যই চায়, লোটন কি আপত্তি করতে পারে? করা সঙ্গত?
না, পারেনি। কিন্তু সে ক্ষুব্ধ। আসুক, তাকে বোঝাতে হবে। তারই তো ভাই। পাখনার তলায় রেখে বড় করেছে অথচ কী এমন তফাত বয়সের! বুঝবে। যুক্তির ভাষা নিশ্চয়ই বুঝবে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress