নীললোহিতের অন্তরঙ্গ
বেচু রক্ষিত নামে একজন লোক কেষ্টনগর থেকে কলকাতায় আসছিলেন তাঁর ভগ্নিপতির বাড়িতে। ট্রেনে ওঠবার আগে চার টাকার সরপুরিয়া-সরভাজা কিনে নিয়েছেন দিদি-জামাইবাবুর জন্য। কলকাতায় তো আর দুধ-ক্ষীরের জিনিশপত্র পাওয়া যায়না, তাই কেষ্টনগরের নামকরা মিষ্টি নিয়ে চলেছেন ওদের খুশি করতে।
ব্যাপারটার শুরু এইখান থেকে। বেচু রক্ষিত মিষ্টির হাঁড়িটা বাঙ্কের ওপর সুটকেশ-বিছানার পাশে লুকিয়ে রেখে নিশ্চিন্তে ঘুম দিয়েছেন। এক ঘুমে কলকাতা। শিয়ালদা স্টেশনে পৌঁছেই ধড়মড় করে উঠে প্রথমেই তিনি খোঁজ নিয়েছেন মিষ্টির হাঁড়ির। না, কেউ চুরি করেনি, কেউ খোলেওনি। কিন্তু হাঁড়িটার ওপর দুটো নীলরঙের ডুমো ডুমো মাছি বসে আছে। ওরা সেই কেষ্টনগর থেকেই হাঁড়ির মধ্যে রসের খোঁজ পেয়ে হাঁড়ির গায়ে লেগে আছে। বিরক্ত হয়ে বেচু রক্ষিত হাতের ঝাপটায় মাছি দুটোকে তাড়িয়ে বললেন, যাঃ যাঃ! মাছিদুটো একটু ভনভন করে উড়ল আশেপাশে, তারপর হাতের ঝাপটার ভয়ে দূরে-দূরে রইল।
গাড়ি থেকে নেমে কাঁখালে সতরঞ্চি মোড়া বেডিং, বাঁহাতে টিনের সুটকেশ ও ডানহাতে মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে বেচু রক্ষিত শেয়ালদা স্টেশন থেকে এবং আমাদের এই কাহিনী থেকে বেরিয়ে গেলেন।
কেষ্টনগরের সেই নীল ডুমো মাছিদুটো ভন-ভন করে ওড়াউড়ি শুরু করে পরস্পরকে বলল, এ আবার কোথায় এলাম রে? চল, ভালো করে আগে জায়গাটা দেখে নেওয়া যাক! এই বলে, হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে তারা বেশ খানিকটা উঁচুতে উঠে গেল। মাছিদুটি যুবক ও যুবতী। যুবক মাছিটি একটু চালিয়াৎ গোছের, সে বলল, বুঝেছি, এ জায়গাটায় নাম নবদ্বীপ। যুবতী মাছিনী বলল, কী করে বুঝলে?
—একবার নবদ্বীপের এক মাছিনীর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল, সে বলেছিল, ওঃ, নবদ্বীপে একেবারে…
—বুঝেছি, সেই যে-মাছিনীটাকে পেয়ে তুমি আমাকে ছেড়ে কয়েকদিন…
—আর তুমি বুঝি তখন…
—যাক, আর ভ্যানভ্যান করতে হবেনা…
যাইহোক, ওরা দুজনে উঁচু থেকে খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরি করেই বুঝে ফেলল, ওরা কলকাতা শহরে এসেছে। কেষ্টনগরের আসল দুধ-ক্ষীর-খাওয়া মাছি তো, বুদ্ধি বেশ পরিষ্কার। কলকাতা শহরকে চিনতে পেরে ওরা একেবারে আহ্লাদে আটখানা। মাছি মাহিনীকে বলল, আর ঝগড়া করিসনি। আজ জীবনটা সার্থক হল। কলকাতা শহরের কত নাম শুনেছি, কোনদিন কি স্বপ্নেও ভাবতে পেরেছিলাম এখানে আসতে পারব? কেষ্টনগরের মিষ্টি খেয়ে খেয়ে মুখ পচে গেছে, এখানে ওসব মিষ্টিফিষ্টির পাট নেই, এখানে খুব ভালো-ভালো নোংরা, আঁস্তাকুড় আর জঞ্জাল আছে।
মাছিনী বলল, দ্যাখো না নিচে, কত মাছি গিসগিস করছে। কত দেশ থেকে মাছি আসে এখানে দ্যাখো, রাস্তাঘাট একেবারে ভরা!
কিন্তু নিচে নেমে এসে দেখল, একটাও মাছি নেই, সব মানুষ। মাছি দুটো খুব মুশকিলে পড়ল, সারা শহরে আর একটাও মাছি নেই, এমনকী মশা কিংবা পিঁপড়ে এইসব ছোটো জাতের প্রাণীও নেই। সব মানুষ। কলকাতার আকাশে মাত্র এই দুটো মাছি, অনেক লোক ওদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল। একটা বাচ্চা ছেলে বলল, বাবা, ও দুটো কি চড়ুই পাখির বাচ্চা! বাবা উত্তর দিলেন, না, ওদের বলে মাছি, মফস্বল থেকে হঠাৎ এসে পড়েছে বোধহয়। এই নিয়ে কাগজে একটা চিঠি লিখতে হবে তো!
সবকটা রাস্তা ধপধপে ঝকঝকে, কোথাও এক ছিটে ময়লা নেই, কোথাও জঞ্জাল জমে নেই, মাছিদুটো পড়ল মহামুশিকলে। ঝাড়ুদারেরা অনবরত রাস্তা সাফ করছে, ধুয়ে দিচ্ছে, নোংরা জমবার কোন সুযোগই নেই। এ কি আর কেষ্টনগর, ময়রার দোকানের সামনের ভাঙা ভাঁড়গুলোতে যা রস জমে থাকে তাতেই কত মাছির সংসার চলে যায়। ঝাড়ুদাররা দিনে মাত্র দুবার ঝাঁট দেয় কী না-দেয়। আর এ কলকাতা শহর, এখানে প্রত্যেক দোকানে কাচের বাক্স দিয়ে জিনিশপত্র ঢাকা, প্রত্যেক বাড়ির লোকেরা মুখ-বন্ধ টিনের বাক্সের মধ্যে ময়লা জমা রাখে, মেথররা অনবরত এসে সেগুলো পরিষ্কার করে নিয়ে যাচ্ছে।
মাছি মাছিনীকে বলল, শেষকালে কি এখানে এসে না খেয়ে মরব নাকি?
মাছিনী বলল, চল-না, মাছের বাজারে যাই, সেখানে তো মাছের কানকো নাড়িভুঁড়ি ফেলবেই।
ঘুরতে ঘুরতে এল মাছের বাজারে। মাছের বাজার ধোয়া-সাফ, কিচ্ছু নেই, মাছওলা মেছুনীরা বসে-বসে কীর্তন গাইছে খোল করতাল বাজিয়ে। নিরাশ মাছিন সঙ্গী মাছিকে বলল, আম-জামের সময় হলে রাস্তায় অন্তত দু-একটা আমের খোসা ঠিকই পড়ে থাকত। ক্ষিদে পেয়ে মাছির শরীর দুর্বল হয়ে গেছে, তার গলার আওয়াজ এখন ভনভনের বদলে পিনপিন, সে বলল, এ-শহরকে কিছু বিশ্বাস নেই। তাও হয়তো সঙ্গে-সঙ্গে পরিষ্কার করে ফেলে। আমের সময় না হোক, কলার তো সময়! রাস্তায় একটাও কলার খোসা দেখলি?
—সত্যিই এ শহরের লোকেরা কলা খায় না নাকি?
—খাবে না কেন? বোধহয় খোসাশুদ্ধু খায়!
—মাছিদের জন্য একটু দয়ামায়াও নেই!
ঘুরতে-ঘুরতে এল একটা বিরাট বাড়ির সামনে, যাকে বলে, রাইটার্স বিল্ডিং! মাছি-মাছিনী একেবারে বেপরোয়া হয়ে গেছে, ভালো-ভালো ময়লার বদলে ওরা এখন থুতু-কফ খেতেও রাজি। সেখানে গিয়েও ওরা অবাক। মাছি মাছিনীকে বলল, হ্যাঁরে, কলকাতার বদলে কি আমরা ভুল করে বিলেতে চলে এলাম? মাছিনী বলল, সত্যি মানুষগুলো এমন নিষ্ঠুরও হয়! রাইটার্স বিল্ডিংয়ের কোথাও একছিটে ময়লা নেই, দেয়ালে পানের পিক নেই, সিঁড়ির পাশে সিকনি নেই, আলুর দমের ঝোল মাখানো একটি শালপাতাও নেই পর্যন্ত। ঝকঝকে তকতকে সবকিছু, লোকগুলো নিঃশব্দে কাজ করে মাঝে-মাঝে উঠে থুতুটুতু ফেলার জন্য বারান্দায় গিয়ে থুক না-করে বাথরুমে গিয়ে ঢুকছে, আবার বেরিয়ে এসে সযত্নে বাথরুমের দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে। এরা কি মানুষ? মানুষ এমন হৃদয়হীন হয়?
মাছি বলল, চল, এখানকার মানুষেরা কিছুতেই ময়লা থাকতে দেবে না বুঝেছি। দেখি কোথায় এমন জায়গা আছে কিনা—যেখানে মানুষ নেই, সেখানে যদি আপনি-আপনি ময়লাটয়লা কিছু থাকে। কিন্তু কলকাতার লোক এমন বোকা নয় যে, ফাঁকাজায়গা রাখতে দেবে। কোথায় মানুষ নেই? মাঝে-মাঝে পার্কময়দান তাও মানুষ দখল করে রেখেছে, সব জায়গা মানুষ বসে-বসে পাহারা দিচ্ছে, যাতে কেউ কিছু নোংরা না-করে ফেলে।
নাঃ মাছিদুটো ভাবল, মানুষকে আর বিশ্বাস নেই। এবার জন্তুজানোয়ারের খোঁজ করা যাক। হ্যাঁরে এ-শহরে কি বেড়ালছানা মরেনা? কুকুর গড়িচাপা পড়েনা? তাদের মরা দেহগুলো কোথায় যায়? রাস্তায় একটাও তো নেই! মোষের গাড়ির মোষের কাঁধে ঘা পর্যন্ত নেই, ব্যাপার কী? মাছি মাছিনীকে বলল, বুঝলি, এসবই আমাদের না-খাইয়ে মারবার ষড়যন্ত্র।
মাছিনী বলল, চল, প্রাণ থাকতে-থাকতে এ শহর থেকে পালাই। আমাদের কেষ্টনগর এর থেকে ঢের ভালো ছিল!
এইজন্যই এ শহরে মিষ্টি বন্ধ করেছে, বুঝলি? যাতে আর কোন জায়গা থেকে মাছি না আসে! মিষ্টির গন্ধ পেলে দেশ-বিদেশ থেকে মাছি তো আসতই!
—মিষ্টি কে চাইছে? একটু পচা জঞ্জালও রাখতে নেই আমাদের জন্য। চারপাশের এত বড়-বড় বাড়ি মাঝখানে একটু ফাঁকা মতন জায়গা। ভালো করে ওরা লক্ষ করে দেখল, ঠিক ফাঁকা নয়, ছোট-ছোট ঘরের মতন। মাছিনী আহ্লাদে বলল, চল, ঐখানে যাই, ঐ ছোট-ছোট ঘরগুলো নিশ্চয়ই মানুষের নয়, ওখানে জন্তুরা থাকে। জন্তুরা তো নিজেদের ময়লা লুকোতে পারবেনা
ওপর থেকে নিচে নেমে এল আবার। কোথায় জন্তু-জানোয়ার? একটা বস্তি —এখানেও মানুষ। আর কী আদর্শ বস্তির আদর্শ মানুষ। পরিষ্কার নিকানো ঘরগুলো, অনেক ঘরের সামনে আবার আল্পনা দেওয়া, পরিচ্ছন্ন আবহাওয়া, নর্দমা দিয়ে যে-জল বইছে, তা পর্যন্ত পরিষ্কার। ছোট-ছোট ছেলেরা পর্যন্ত নাকের সিকনি ফেলে রাস্তা নোংরা করার বদলে নিজের সিকনি নিজেই খেয়ে ফেলছে!
—মাছিনী, আজ আর বাঁচার আশা নেই!
–এই নাকি কলকাতা? এই শহরের এত নামডাক? দূর-দূর…
-গুজব! মাছি সমাজে যে বলে কলকাতা একেবারে স্বর্গের মতন, যেখানে-সেখানে ময়লা-নোংরা ছড়ানো, এবার বুঝলি তো, সব গুজব! কলকাতা না-দেখেই কলকাতা সম্বন্ধে যত গল্প! বিলেত না-গিয়েই বিলেতফেরত।
বিকেলের দিকে মাছিদুটো একেবারে করপোরেশনের অফিসে গিয়ে উপস্থিত। স্বয়ং নগরপালের ঘরে গিয়ে তাঁর নাকের সামনে ভন-ভন করতে লাগল। নগরপাল আঁতকে উঠে বললেন, কী? আমার শহরে মাছি? তাজ্জব কাণ্ড! কে কোথায় আছিস?
একদল লোক ছুটে এল, সবাই মিলে তাড়া করতে লাগল, মাছিদুটোকে। কোথা থেকে দুটো উটকো মাছি শহরে ঢুকে পড়েছে, এই নিয়ে কলকাতার নামে কলঙ্ক রটে যাবে। কাল না এ-খবর আবার কাগজে বেরিয়ে যায়। মারো, মারো!
মাছিদুটো কিন্তু ভয় পেয়ে বেরিয়ে গেলনা। নগরপালের কাছাকাছি উড়তে লাগল। ক্ষুধাতৃষ্ণায় ওরা একেবারে মুমূর্ষু, সারাদিন কোথাও একটু বসারও জায়গা পায়নি, গায়ের সেই চিক্কণ নীল রং মলিন হয়ে গেছে, গলার আওয়াজ প্রায় শোনাই যায়না, ওরা মরীয়া হয়ে নগরপালের মুখের সামনে ঘুরে-ঘুরে কাতরভাবে অভিযোগ জানাতে লাগল, অন্যায়। এ আপনার অন্যায়, বিদেশ-বিভুঁই থেকে দু-একটা পোকা-মাছি এখানে বেড়াতে এলে—তাদের জন্য আপনি কোন ব্যবস্থাই রাখেননি? শহরের কোন একটা জায়গায় অন্তত একটুখানি ময়লা তাদের জন্য রাখা উচিত ছিল। সারা শহর ঘুরে দেখলাম, কোথাও একছিটেও ময়লা নেই। এ আপনার অন্যায়। আমাদের সেরে ফেলতে চান। এরকম করলে কলকাতায় বেড়াতে আসবে কী করে, অ্যাঁ? আমরা আর কতখানি খাব, অন্তত একরত্তি ময়লাও যদি রাখতেন—