নীলবসনা সুন্দরী : প্রথম খণ্ড – সপ্তম পরিচ্ছেদ – লতিমন
দেবেন্দ্রবিজয় লতিমন বাইজীর সন্ধানে বামুন-বস্তিতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন । লতিমনের প্রকাণ্ড দ্বিতল বাটী, বামুন-বস্তির আবালবৃদ্ধবনিতার পরিচিত । লতিমনও তদ্রূপ । তাহার জন্য দেবেন্দ্রবিজয়কে বিশেষ কষ্ট-স্বীকার করিতে হইল না; পাড়া প্রতিবেশীদিগের নিকট হইতে তিনি অল্পায়াসে লতিমন বাইজীর সম্বন্ধে অনেকখানি সংবাদ গ্রহণ করিয়া ফেলিলেন । লতিমন সর্ব্বদা বাটীর বাহির হয় না-কখন কখন দেশে-বিদেশে মজ্রো কর্তে যায়-সুতরাং লতিমন এখন বাড়ীতে আছে, কি বিদেশে গাওনা করিতে গিয়াছে, এই সম্বন্ধে কেহ কোন সন্তোষজনক উত্তর করিতে পারিল না । দেবেন্দ্রবিজয় আরও একটা সংবাদ পাইলেন, মনিরুদ্দীনেরও সেখানে যাতায়াত আছে । লতিমনের বাড়ীতে দিলজান নামে আর একটি ষোড়শী সুন্দরী বাস করে; মনিরুদ্দীন কোথা হইতে তাহাকে এখানে আনিয়া রাখিয়াছে । লতিমনের বাড়ী দ্বিমহল, ভিতর মহলে লতিমন নিজে থাকে; বাহির মহলের দ্বিতলে একটা প্রকাণ্ড হলঘরে দিলজান বাস করে ।
দেবেন্দ্রবিজয় মনে মনে স্থির করিলেন, দিলজানের সহিত দেখা করিলে লতিমন সম্বন্ধে সমুদয় সংবাদ পাওয়া যাইবে; তা’ ছাড়া মনিরুদ্দীনের সম্বন্ধেও অনেক বিষয় জনিতে পারা যাইবে ।
দেবেন্দ্রবিজয় লতিমন বাইজীর বাড়ীতে প্রবেশ করিলেন । একজন ভৃত্য তাঁহাকে উপরে একটী সুসজ্জিত প্রকোষ্ঠে লইয়া গিয়া বসাইল এবং সংবাদ লইয়া বাড়ীর ভিতরে চলিয়া গেল ।
দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, গৃহটী মূল্যবান্ আস্বাবে পূর্ণ । গৃহতলে গালিচা বিস্তৃত । গৃহ-প্রাচীরে উৎকৃষ্ট তৈল-চিত্র ও দেয়ালগিরি । একপার্শ্বে একখানি প্রকাণ্ড দর্পণ-সম্মুখে গিয়া কেহ দাঁড়াইলে তাহার মাথা হইতে পা পর্য্যন্ত তাহাকে প্রতিবিম্বপাত হয় । অপরপার্শ্বে গবাক্ষের নিকটে একটি হারমোনিয়ম রহিয়াছে, নিকটে একখানি মখমলমণ্ডিত চেয়ার ও একখানি কৌচ । দেবেন্দ্রবিজয় মনে করিলেন, হয়ত দিলজান বিবি ঐ চেয়ারে বসিয়া হারমোনিয়মের স্বরে কণ্ঠস্বর-সংযোগপূর্ব্বক শব্দতরঙ্গে সেই সুসজ্জিত প্রকোষ্ঠ প্লাবিত করিতে থাকে, আর মনিরুদ্দীন সেই কৌচে কান পাতিয়া পড়িয়া থাকেন ।
দেবেন্দ্রবিজয় পশ্চাদ্ভাগে হাত দুইখানি গোট করিয়া সেই কক্ষমধ্যে পরিক্রমণ করিতে করিতে গৃহের সমগ্র সামগ্রী সবিশেষ মনোযোগ সহকারে দেখিতে লাগিলেন । কিয়ৎপরে সহসা তাঁহার দৃষ্টি হারমোনিয়মের উপরিস্থিত মরক্কো-মণ্ডিত দুইটি ক্ষুদ্র বাক্সের উপরে পড়িল । বাক্স দুইটি দেখিতে একপ্রকার । দৈর্ঘ্যে অর্দ্ধ-হস্ত এবং প্রস্থে পাঁচ-ছয় অঙ্গুলি পরিমিত । দেবেন্দ্রবিজয় একটি বাক্স তুলিয়া লইলেন, এবং ডালাখানি ধীরে ধীরে খুলিয়া দেখিলেন, তন্মধ্যে একখানি সুদীর্ঘ সূক্ষাগ্র, ধারাল ছুরিকা রহিয়াছে । ছুরিখানির মূলদেশ উজ্জ্বল হস্তিদন্তনির্ম্মিত । অপর বাক্সটিও লইয়া খুলিয়া দেখিলেন । দেখিলেন, তন্মধ্যে কিছুই নাই, কিন্তু তন্মধ্যে যে ঠিক সেইরূপ একখানি ছুরি ছিল, তাহা দেবেন্দ্রবিজয়ের বুঝিতে বাকী রহিল না ।
বাক্স দুইটি একই ধরণের তৈয়ারী । হস্তস্থিত বাক্সটি যেখানে ছিল, সেইখানেই রাখিয়া দিলেন । তাহার পর গবাক্ষের সম্মুখে আসিয়া ছুরিখানি ঘুরাইয়া-ফিরাইয়া বিশেষ মনোনিবেশ পূর্ব্বক দেখিতে লাগিলেন । দেখিলেন, ছুরিখানির অগ্রভাগ তেমন উজ্জ্বল নহে-নীলাভ এবং খুব সূক্ষ; বিষাক্ত বলিয়া বোধ হইল । দেবেন্দ্রবিজয় মনে মনে স্থির করিলেন, এখন রাসায়নিক পরীক্ষা দ্বারা দেখিতে হইবে, এই ছুরিখানি বিষাক্ত কি না । তাহার পর কোন একটা বিড়াল বা কুকুরের গায়ে বিদ্ধ করিলেই বুঝিতে পারিব, এই বিষে কতক্ষণে কিরূপ ভাবে মৃত্যু ঘটে । মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া দেবেন্দ্রবিজয় কক্ষের চতুর্দ্দিকে দৃষ্টি সঞ্চালন করিয়া দেখিলেন, কেহ কোথায় নাই । তখন ছুরিখানি ব্যগ্রভাবে একখানি কাগজে জড়াইয়া নিজের পকেটে ফেলিলেন ; এবং একখানি চেয়ার টানিয়া বসিয়া রুমালে মুখ মুছিতে লাগিলেন ।
অনতিবিলম্বে পার্শ্ববর্ত্তী দ্বারপথ দিয়া একটি স্ত্রীলোক তথায় প্রবেশ করিল । তাহাকে দেখিতে তেমন সুন্দরী নহে – শ্যামবর্ণা-বয়ঃক্রমও ত্রিশ বৎসর হইবে । মুখে বসন্তের ক্ষতচিহ্ণ । সর্ব্বাঙ্গে স্বর্ণালঙ্কারে শোভিত । পায়ে জরীর কাজ করা চটিজুতা । দেবেন্দ্রবিজয় তাহার আপাদমস্তক সাভিনিবেশ দৃষ্টিসঞ্চালন করিতে লাগিলেন । ভাবিলেন, কে এ ! দিলজান কখনই নয়-মনিরুদ্দীন কি ইহারই প্রেমে মুগ্ধ হইয়া এ যাবৎ বিবাহ করে নাই ? একান্ত অসম্ভব !
সেই স্ত্রীলোকটি অপরিচিত দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের দিকে বিস্মিত চিত্তে চাহিয়া বলিল “আপনি কি সেই দিলজানের সহিত দেখা করিতে আসিয়াছেন ?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিল্লেন, “হাঁ, বিশেষ প্রয়োজন আছে, অপনার নাম কি দিল -”
বাধা দিয়া স্ত্রীলোকটি বলিল, ” না, আমার নাম দিলজান নয় । আপনার কি প্রয়োজন বলুন-আমি দিলজান্কে তাহা বলিব ।”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, “তাহার সহিত আমার দেখা করা দরকার ।”
স্ত্রী । এখন দেখা হইবে না-দিলজান এখন এখানে নাই । আপনি কোথা হইতে আসিতেছেন ?
দে (ইতস্ততঃ করিয়া ) আমি-আমি-এই মনিরুদ্দীনের নিকট হইতে আসিতেছি ।
স্ত্রী । আপনি মিথ্যা বলিতেছেন ।
দে । কেন ?
স্ত্রী । মনিরিদ্দীন এখন অখানে নাই । দিলজান্কে সঙ্গে লইয়া তিনি কোন্ দেশে বেড়াইতে গিয়াছেন ।
দেবেন্দ্রবিজয় বড় বিভ্রাটে পড়িলেন । দেখিলন, কথাটা ঠিক খাটিল না; পাছে অপ্রতিভ হইতে হয়, মনে করিয়া তিনি সে কথাটি একেবারে চাপা দিয়া বলিলেন, “ওঃ ! তা হবে; কিন্তু আরও একটা কথা আছে, আপনি বাহিরের খবর কিছু রাখেন ?”
স্ত্রী । কি খবর বুঝিলাম না । তা’ বাহিরের খবরের জন্য এখানে আমার কছে কেন ? বাহিরে অনেক লোক আছে ।
দে । এখানে প্রয়োজন আছে ।
স্ত্রী । আপনার কথা আমি ভাল বুঝিতে পারিতেছি না-আপনার অভিপ্রায় কি, স্পষ্ট বলুন । আপনার নামটি জানিতে পারি কি ?
দে । আমার নাম দেবেন্দ্রবিজয়-আমি পুলিস-কর্ম্মচারী ।
শুনিয়া স্ত্রীলোকটি চমকিত হইল । বিস্মিতনেত্র দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আপনার কি প্রয়োজন, বলুন ?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “লতিমন সম্বন্ধে আপনি কিছু জানেন ?”
পুনরপি স্ত্রীলোকটি চমকিত হইল; বলিল, “সে ত ঘরের সংবাদ – জানি । আপনি তাহার সম্বন্ধে কি জানিতে চাহেন বলুন ।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, ” লতিমন বাই খুন হইয়াছে-মেহেদী-বাগানে তাহার লাস পাওয়া গিয়াছে ।”
স্ত্রীলোকটি বলিল, “আপনার ভ্রম হইয়াছে ।”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, ” আমার ত তা’ বোধ হয় না । এই দেখুন দেখি, এটা চিনিতে পারেন কি না ।” বলিয়া তিনি সাগ্রহে কাপড়ে জড়ান সেই ওড়্নাখানি বাহির করিয়া তাহার হাতে দিলেন । ওড়্নাখানি দেখিয়া সেই স্ত্রীলোকটির হৃদয় অত্যন্ত উদ্বেগপূর্ণ হইয়া উঠিল এবং মুখমণ্ডলে সে চিহ্ণ সুস্পষ্ট প্রকটিত হইল । সোদ্বেগে কম্পিতকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, “হাঁ, চিনিতে পারিয়াছি-ইহা আপনি কোথায় পাইলেন ?”
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, ” মেহেদী-বাগানে যে স্ত্রীলোকটি খুন হইয়াছে, তাহারই গায়ে ইহা ছিল ।”
শুনিয়া স্ত্রীলোকটি দুইপদে পশ্চাতে হটিয়া গেল-কি এক ভয়ানক আশঙ্কায় তাহার চোখ-মুখ একবারে বিবর্ণ হইয়া গেল । রুদ্ধশ্বাসে কহিল, ” কি সর্ব্বনাশ ! এ কি ভয়ানক ব্যাপার !”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, ” ব্যাপার গুরুতর, লতিমন খুন হইয়াছে ।”
দারুণ উৎকণ্ঠার সহিত সেই স্ত্রীলোকটি বলিল, ” না-পনি ভুল করিয়াছেন, লতিমন খুন হয় নাই ।”
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, ” আপনি কিরূপে জানিলেন, লতিমন খুন হয় নাই ?”
স্ত্রীলোকটি ব্যাকুল্ভাবে বলিল, “আমারই নাম লতিমন ।”
দেবেন্দ্রবিজয় বিস্ময়বিহলনেত্রে লতিমনের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন ।