নীলবসনা সুন্দরী : পঞ্চম খণ্ড – প্রথম পরিচ্ছেদ – কারাকক্ষে
মজিদ খাঁ এখনও হাজতে। কয়েক দিবস একস্থানে আবদ্ধ থাকায় তাঁহার মনটা অত্যন্ত খারাপ হইয়া গিয়াছে। বিশেষতঃ আজ-কাল তিনি আরও বিমর্ষ। উকীল হরিপ্রসন্ন বাবু মধ্যে মধ্যে তাঁহাকে দেখিতে আসিতেন। মজিদ খাঁ তাঁহার নিকটে এই হত্যাকাণ্ড সংক্রান্ত সমুদয় সংবাদ শুনিতে পাইতেন। শুনিয়া বুঝিতে পারিতেন, রহস্যের ক্রমশঃ উদ্ভেদ হইয়া অসিতেছে-শীঘ্রই তিনি মুক্তি পাইবেন। সৃজান সংক্রান্ত যে কথা তিনি গোপন করিবার জন্য প্রাণপণ করিতেছিলেন, এখন আত্মরক্ষার্থ আর তাহা প্রকাশ না করিলেও বিশেষ কোন ক্ষতি হইবে না।
এই কয়েকদিন মজিদ খাঁ একেবারে অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছেন। প্রাণসমা জোহেরাকে তিনি কতদিন দেখেন নাই, কতদিন তাহার মধুর কণ্ঠে সুমধুর প্রেমসম্ভাষণ শুনিতে পান্ নাই। একমাত্র জোহেরার চিন্তা অনুক্ষণ তাঁহার হৃদয়ে জাগরূক। নির্জ্জনে চিন্তা যেরূপ গভীর হইয়া উঠে, মজিদ খাঁর ঠিক তাহাই হইয়াছিল। অনেক সময়ে তিনি মনকে অন্যদিকে ফিরাইবার চেষ্টা করিতেন-পারিতেন না। কখনও মনে হইত, এই আমি যেমন একমনে কেবল জোহেরার ভাবনা ভাবিতেছি, জোহেরার কি আমার জন্য এমন কাতর হইয়াছে? কখনও ভাবিতেছেন, অন্যের ন্যায় জোহেরাও হয়ত আমাকেই হত্যাপরাধী বলিয়া বিশ্বাস করিয়াছে। আমার অপরাধের পরিমাণ আমি নিজে জানি; কিন্তু আমি তাহাকে কি করিয়া বুঝাইব, আমি সম্পূর্ণ নির্দ্দোষ? হায়, এই সূত্রে সে যদি আমাকে ঘৃণার চোখে দেখিতে আরম্ভ করে, তাহা হইলে ত সেখানেই আমার সকল আশা-ভরসা ঘুচিয়া যায়! কি করি, কিরূপে আমি সকল দিক্ বজায় রাখিয়া এত বিপদ-বিঘ্ন ঠেলিয়া মাথা তুলিতে পারিব? তাহার ত আর কিছুমাত্র সম্ভাবনা দেখিতেছি না। মজিদ খাঁ সেই নির্জ্জন কারা-কূপে পড়িয়া, আত্মহারা হইয়া ব্যাকুল হৃদয়ে অবিরত জোহেরার কথাই ভাবিতেছেন। ক্ষুব্ধ সিন্ধুবক্ষে যেমন তরঙ্গের পর তরঙ্গ উঠে, মজিদ খাঁর হৃদয়-সমুদ্র মথিত করিয়া তেমনই তরঙ্গ ছুটিতেছে-একটির পর একটি-তাহার পর আর একটি-ক্রমান্বয়ে-এক মুহুর্ত্তের জন্য বিরাম নাই-বিশ্রাম নাই-অবসর নাই। মোহ্যমান মজিদ খাঁ করতললগ্নশীর্ষ হইয়া নতমুখে নিজের ভবিষৎ চিন্তা করিতেছেন-বর্ত্তমানের ন্যায় ভবিষৎও তাঁহার অন্ধকারময় বোধ হইতেছে, কেবল অন্ধকার- নিরবছিন্ন দুর্ভেদ্য ঘোর অন্ধকার- সেই নিবিড় অন্ধকার ততোধিক অন্ধকারময়ী নিরাশার বিকটমূর্ত্তি ভিন্ন মজিদ খাঁ আর কিছুই দেখিতেছে না-সেখানে কোথায় আশার একটু ক্ষীণালোকরেখাও পড়ে নাই।
মজিদ খাঁ যখন আপন দুশ্চিন্তায় একেবারে বাহ্যজ্ঞান-রহিত তখন সহসা কাহার পদশব্দে তাঁহার চমক হইল। চকিতে চাহিয়া দেখেন, অন্ধকার সরিয়া গিয়াছে নয়নাগ্র হইতে সেই নিরাশার বিকটমূর্ত্তি অন্তর্হিত-চারিদিক্ দিবালোকপ্রদ্যোতিত-এবং আশার মোহিনীমূর্ত্তির ন্যায় কারাগৃহতলে অনতিদূরে দাঁড়াইয়া-তাঁহারই সেই হৃদয়ানন্দবিধায়িনী, অপরূপ রূপলাবণ্যময়ী জোহেরা যেন ভাস্কর-রচিত সকরুণ পাষাণ-প্রতিমা স্থিরনেত্রে তাঁহারই দিকে নীরবে দৃষ্টিপাত করিতেছে।
প্রথমে মজিদ খাঁ নিজের চক্ষুকে বিশ্বাস করিতে পারিলেন না। মনে হইল, দিনরাত যাহাকে মনে ভাবা যায়, কখন কখন স্বপ্নঘোরে তাহার মূর্ত্তি প্রকটিত হয়-ইহাও কি স্বপ্ন? তাঁহার মুখ দিয়া সহসা কথা বাহির হইল না; তিনি দুঃসহ বিস্ময়ে অবাক মুখে জোহেরার মুখের দিকে স্থিরনেত্রে চাহিয়া রহিলেন।
ত্খন বীণাবিনিন্দিত সুমধুর কণ্ঠে সুন্দরী জোহেরা হকিল, “একি! তুমি কি আমাকে চিনিতে পারিতেছ না? এমন করিয়া অপরিচিতের ন্যায় আমার দিকে চাহিয়া আছ কেন? আমি জোহেরা-আমি তোমাকে দেখিতে আসিয়াছি।”
সেই অমৃতবর্ষী স্নেহকণ্ঠ একান্ত পরিচিত-একান্ত মধুর-একান্ত করুণাময়, একবার শুনিলে আর তাহা সহজে ভুলিতে পারা যায় না। তখন সহজে মজিদ খাঁ তাহাকে চিনিতে পারিলেন। তাড়াতাড়ি উঠিয়া, দুই হাতে জোহেরার হাত দুখানি ধরিয়া নতমুখে দাঁড়াইলেন। ক্ষণপরে কম্পিতকণ্ঠে বলিলেন, “জোহেরা, তুমি এখানে! তুমি কেন এ কলঙ্কিত স্থানে আসিলে? এখানে কত তস্কর, কত দস্যু, কত পরস্বাপহারী, নরনারীহন্তা পদচিহ্ণ রাখিয়া গিয়াছে-তুমি কেন জোহেরা, না বুঝিয়া তাহার মধ্যে তোমার পদচিহ্ণ মিশাইতে আসিয়াছ? সহস্র নরপিশাচের পাপ-নিশ্বাসে এখানকার বায়ুও দুষিত, তাহা কি তুমি জান না? এখানে দয়া, মায়া, স্নেহ, প্রেম নাই-এখানকার লোকেরা এক স্বতন্ত্র জীব-এমন অপবিত্র স্থানে তোমাকে দেখিয়া আমি আজ বড় বিস্মিত হইলাম!”
জোহেরা মৃদুকণ্ঠে কহিল, “ইহাতে বিস্ময়ের কিছুই নাই, মজিদ; তুমি যেখানে আছ, সে স্থান জাহান্নাম্ হইলেও আমার নিকটে পরম পবিত্র।”
মজিদ খাঁ জিজ্ঞাসা করিলেন, ” তুমি কিরূপে এখানে আসিবার অনুমতি পাইলে?”
জোহেরা কহিল, “উকীল বাবু আমার সঙ্গে আসিয়াছেন; তাঁহারই সাহায্যে আমি এখানে আসিতে পারিয়াছি। তিনি এখনই এখানে আসিবেন। উকীল বাবু আমাদিগের মঙ্গলের জন্য অনেক চেষ্টা করিতেছেন।”
মজিদ খাঁ কহিলেন, “হাঁ, তাঁহার ঋণ অপরিশোধ্য। সত্যই তিনি আমাদিগকে আন্তরিক স্নেহ করেন; কিন্তু আমি এ জীবনে তাঁহার নিকটে অকৃতজ্ঞই রহিয়া গেলাম। আমি দেখিতেছি, আমার ভবিষৎ বড় ভয়ানক। এই ত অবস্থা-বিপাকে কি একটা ভয়ানক দুর্নাম কিনিলাম!”
জোহেরা কহিল, “ভবিষ্যতের তমোময় গর্ভে কি নিহিত আছে, কে জানে? যে সকল বিঘ্ন-বাধা এখন দুরতিক্রম্য বলিয়া বোধ হইতেছে, দুইদিন পরে তাহা সমুদয় দূর হইয়া যাইতে পারে। মানুষের হৃদয়ে বল থাকে কেন? বিপদ্ যেমন গুরুতর ভাবে চাপিয়া পড়ুক না কেন, ততই তাহার সহিত অন্তিমবলে যুঝিতে হইবে।”
মজিদ খাঁ ব্যগ্রভাবে কহিলেন, “জোহেরা, আমি যে ভয়ানক অপরাধে এখানে বন্দী রহিয়াছি, তাহা তুমি অবশ্যই শুনিয়াছ; কিন্তু জোহেরা, তুমি কি তাহা বিশ্বাস কর?”
জোহেরা কহিল, “একটী বর্ণও না। আমি কেন-কেহই ইহা বিশ্বাস করেন নাই। ডিটেক্টিভ দেবেন্দ্রবিজয় বাবু, মুন্সী সাহেব, মোবারক সকলেরই মনে ধারণা-তুমি নিরপরাধ।”
অত্যন্ত বিস্মিতভাবে মজিদ খাঁ বলিলেন, “মিবারক! মোবারকেরও ধারণা আমি নিরপরাধ? খুনের রাত্রিতে মোবারকই ত আমাকে মেহেদী-বাগানে একটা গলির মোড়ে দেখিতে পাইয়াছিল; ইহাতে বরং খুনী বলিয়া আমার উপরেই তাহার সন্দেহই হইতে পারে।”
জোহেরা বলিল, “না তোমার উপরে তাঁহার সন্দেহ হয় নাই।”
মজিদ খাঁ বলিলেন, “মোবারক আমার একজন প্রকৃত বন্ধু বটে। আমি তাহাকে অনেক দিন হইতে ভাল রকমে জানি।”
জোহেরা কহিল, “তুমি যতখানি প্রকৃত মনে করিতেছ, মোবারক ঠিক ততখানি নহেন-তিনি আমাকে বিবাহ করিবার চেষ্টায় আছেন।”
ম।(সাশ্চর্য্যে) কি আশ্চর্য্য-অসম্ভব!
জো। অসম্ভব নয়-পরশু সকালে এইজন্য তিনি আমার সঙ্গে দেখাও করিয়াছিলেন।
ম। তোমার সঙ্গে ! তুমি তাহাকে কি বলিলে?
জোহেরার চক্ষু জ্বলিয়া উঠিল। জোহেরা বলিল, “ইহা আবার তুমি আমায় জিজ্ঞাসা করিতেছ? তোমার সহিত যে আমার বিবাহ-সম্বন্ধ এক-প্রকার ঠিক হইয়া গিয়াছে, সে কথা আমি তাঁহাকে বলিলাম। তাহাতে মোবারক বলিলেন যে, তিনি এইরূপ শুনিয়াছেন বটে; কিন্তু কথাটা যে কতদূর সত্য, তাহা তিনি বুঝিতে পারেন নাই।”
মজিদ খাঁ ব্যগ্রভাবে বলিলেন, “তাহার পর তোমাকে সে আর কি বলিল?”
জোহেরা। তাহার পর তিনি তোমার এই বিপদের কথা তুলিয়া বলিলেন, আমি যদি তাঁহাকে বিবাহ করিতে সম্মত হই, তাহা হইলে তিনি তোমাকে নির্দ্দোষ সাব্যস্ত করিয়া এই বিপদ্ হইতে উদ্ধার করিতে পারেন।
মজিদ। অসম্ভব-মোবারক কিরূপে আমাকে উদ্ধার করিবে?
জোহেরা। তাহা আমি জানি না। তাঁহার কথায় আমার বড় রাগ হইল, তাঁহার সাহায্য ব্যতিরেকেও আমরা যে তোমাকে নিরপরাধ সপ্রমাণ করিতে পারিব, তোমার সেই প্রকৃত বন্ধুটিকে তখন আমি তাহা বলিলাম। বলিয়াই আমি সেখান হইতে চলিয়া গেলাম। ইহার পর তাঁহার সহিত আমার আর দেখা হয় নই।
মজিদ খাঁ বলিলেন, “মোবারক যে আমাকে এ বিপদ্ হইতে উদ্ধার করিবার জন্য ব্যস্ত হইয়াছে, ইহা ত বন্ধুর কর্ত্তব্য কর্ম্ম; কিন্তু সেই সাহায্যের বিনিময়ে তোমার নিকট হইতে সে যে প্রস্তাব করিয়াছে, তাহ খুবই গর্হিত। বিশেষতঃ আমার সহিত তোমার বিবাহ-সম্বন্ধের কথা সে যে না শুনিয়াছে, এমনও নহে।”
জোহেরা বলিল, ” শুনিয়াছেন সত্য, কিন্তু কথটা কতদূর সত্য, তাহা তিনি জানিতেন না; তাহা হইলে তিনি বোধ হয়, এ কথা তুলিতে সাহস করিতেন না। সকলেরই ধারণা ছিল, মনিরুদ্দীনের সহিত আমার বিবাহ হইবে।”