নীলবসনা সুন্দরী : প্রথম খণ্ড – দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – অন্ধকারে
মোবারক যখন রাজাব-আলির বাটী পরিত্যাগ করিল, তখন রাত তিনটা। পথে জনপ্রাণী নাই। পথ বড় অন্ধকার – কুজ্ঝটিকাবৃত। দুই-একটা কুকুর বা শৃগাল পথের এদিক্ ওদিক্ করিয়া ছুটাছুটি করিতেছে; তাহাদিগকে দেখা যাইতেছে না – তাহাদিগের সঞ্চারণের শব্দমাত্র শুনা যাইতেছে। যখনকার কথা বলিতেছি, তখন গ্যাসের আলোক ততটা বিস্তৃতি লাভ করে নাই, কলিকাতা সহরেও সকল পথে তখন গ্যাসের আলো ছিল না। অনেক বড় রাস্তাতেও তখন খুব তফাতে তফাতে প্রোথিত কাষ্ঠস্তম্ভের মস্ত্কে এক-একটা কেরোসিন তৈলের আলো একান্ত নিস্তেজভাবে জ্বলিত। গলিপথমাত্রেরই ব্যবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় ছিল- সেখানে আলোকের কিছুমাত্র বন্দোবস্ত ছিল না। পথিপার্শ্বস্থ গৃহস্থদিগের বাতায়ননিঃসৃত আলোকই পথিকদিগের ভরসাস্থল; কিন্তু অধিক রাত্রে তাহাও দুষ্প্রাপ্য ছিল।
জানবাজারে রাজাব-আলির বাটী। মোবারক জানবাজার ছাড়িয়া কলিঙ্গাবাজারের পথে প্রবেশ করিল। পথ নির্জ্জনতায় একান্ত নিস্তব্ধ এবং অন্ধকারে অত্যন্ত ভীষণ! অনেক দূরে দূরে এক-একটা আলো- তাহাও কুজ্ঝটিকাবৃত। চারিদিকে অন্ধকার – অন্ধকারে বিপুল রাজত্ব। মোবারকের বাসা বালিগঞ্জে। মোবারক অন্যপথ দিয়াও বাসায় ফিরিতে পারিত; তথাপি সে কলিঙ্গাবাজারের সোজা পথ ধরিল। অনেক রাত হইয়াছে, বোধ করি, শীঘ্র বাসায় উপস্থিত হইবার জন্য দ্রুতপদে পথ অতিক্রম করিয়া চলিতে লাগিল। ক্রমে মেহেদী-বাগানে আসিয়া পড়িল। এবং সেখানকার একটা অন্ধকার গলিমধ্যে প্রবেশ করিল। দুই-চারি পদ গিয়াছে, এমন সময়ে সম্মুখদিক্ হইতে কে একটা লোক সবেগে তাহার গায়ের উপরে আসিয়া পড়িল। এত অন্ধকার, কেহ কাহাকে স্পষ্ট দেখিতে পাইল না, উভয়েই চমকিত হইয়া দুইপদ পশ্চাতে হটিয়া দাঁড়াইল। যে লোকটা অন্ধকারে না দেখিতে পাইয়া, মোবারকের গায়ের উপরে আসিয়া পড়িয়াছিল, সে বলিল, “মহাশয়, মাপ করিবেন-আমি অন্ধকারে আপনাকে দেখিতে পাই নাই।” বলিয়াই তাড়াতাড়ি পাশ কাটাইয়া চলিয়া যাইবার উপক্রম করিল।
স্বর মোবারকের পরিচিত। মোবারক তৎক্ষণাৎ তাহার হাত ধরিল ; বলিল, “কেও, মজিদ নাকি – আরে দাঁড়াও। অনেক দিন পরে তোমার সহিত দেখা।”
মোবারক তাহাকে চিনিতে পারায় মজিদ মনে মনে কিছু বিরক্ত ও ব্যতিব্যস্ত হইয়া উঠিল। স্তম্ভিত হইয়া ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল , “মোবারক নাকি! কি আশ্চর্য্য! তুমি এখানে কবে আসিলে? আমি মনে করিয়াছিলাম, তুমি এখনও নেপালে আছ। এত রাত্রে এ পথে কেন হে?”
মোবারক বলিল, “রাজাব-আলির বাটীতে নিমন্ত্রণ ছিল; সেখানে হইতেই ফিরিতেছি। আমি সপ্তাহখানেক এখানে আসিয়াছি। চল-আমার বাসায় চল; আজ তোমাকে ছাড়িব না।”
ব্যস্ত-সমস্ত্ভাবে মজিদ বলিল, ” না-না-এখন না-আজ আমি যাইতে পারিব না – এখন আমার- আমি কিছু ব্যস্ত আছি, ভাই! কি জান – কাল নিশ্চয় যাইব। বাসাটা কোথায়? ”
মোবারক বলিল , ” এই বালিগঞ্জে।”
“বটে, তবে ত নিকটেই। কাল আমি এক সময়ে যাইব – সেই ভাল,” বলিয়া মজিদ পুনরপি মোবারকের পাশ কাটাইয়া চলিয়া যাইবার উপক্রম করিল।
মোবারক একবারও তাহাকে যাইতে দিল না। “দাঁড়াও,” বলিয়া পুনরায় তাহার হাত চাপিয়া ধরিল বলিল, “তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে- এত ব্যস্ত কেন? মনিরুদ্দীন এখন কোথায়, ভাল আছে ত? কখন তাহার সহিত দেখা হইবে, বল দেখি? তাহার সহিত আমাকে একবার দেখা করিতে হইবে ; একটা বিশেষ প্রয়োজন আছে।”
মজিদ বলিল, “মনিরুদ্দীন আজ এগারটার ট্রেনে ফরিদপুরের জমিদারীতে গিয়াছে। এখন তাহার সহিত দেখা হইবে না।”
মোবারক জিজ্ঞাসা করিল, “কতদিন পরে ফিরিবে?”
মজিদ বলিল, “ঠিক বলিতে পারি না। বোধ হয়, কিছু বিলম্ব হইবে। আমাকে এখন ছেড়ে দাও – কাল আমি বাসায় গিয়া তোমার সহিত দেখা করিব, এখন আমি কিছু-বিশেষ বড় ব্যস্ত আছি।”
মজিদের এইরূপ পীড়াপীড়িতে মোবারক তাহার হাত ছাড়িয়া দিল। হাতছাড়া হইতেই মজিদ নিবিড় কুজ্ঝটিকা ও অন্ধকারের মধ্যে কোথায় অন্তর্হিত হইয়া গেল – আর তাহাকে দেখিতে পাওয়া গেল না।
মোবারক মজিদের এইরূপ উদ্বিগ্নভাব দেখিয়া বিস্মিত হইল। কারণও কিছু ঠাওর হইল না। সে মজিদের কথা ভাবিতে ভাবিতে সেই গলির ভিতরে অগ্র্সর হইয়া চলিল। কিছুদূর গিয়া দেখিল, একজন কর্ত্তব্যপরায়ণ পাহারাওয়ালা প্রজ্বলিত লণ্ঠনহস্তে পথিপার্শ্বস্থ এক প্রকাণ্ড কদম্ব্তরুতলে বিরাজ করিতেছে।
মোবারক তাহাকে বলিল, ” পাহারাওয়ালা সাহেব, জ্যরা মদৎ কর্নে সকোগে।”
পাহারাওয়ালা বলিল, “ফরমাইয়ে।”
মোবারক কহিল, “তোম্হারে পাশ রৌস্নি হৈ, অগর মুঝে ইস্ গল্লিকে বাহার কর দেওতো – ইনাম মিলেগা।”
ইনামের নাম শুনিয়া পাহারাওয়ালা সহেব, ” জনাব্কা যো হুকুম, ” বলিয়া মোবারকের পশ্চাদনুসরণ করিল।
গলির প্রায় শেষ সীমান্তে আসিয়া মোবারক পাহারাওয়ালার হাতে কয়েকটি তাম্রখণ্ড প্রদান করিয়া বলিল, ” অব্ তোম্হারে আনে কোই জরুরৎ ন্যহি,” বলিয়া দ্রুতপদে একা গলির মোড়ের দিকে যাইতে লাগিল। পাহারাওয়ালা যেখানে নিজের পারিশ্রমিক পাইয়াছিল, সেইখানেই হস্তস্থিত লণ্ঠনটা উর্দ্ধে তুলিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। তাহার পর যেমন সে স্বস্থানে ফিরিবার জন্য কিছুদূর অগ্রসর হইয়াছে, এমন সময়ে শুনিতে পাইল, সেই ইনাম্দাতা ভদ্রলোকটি ‘পাহারওয়ালা’ ‘পাহারওয়ালা’ বলিয়া চীৎকার করিয়া তাহাকে ডাকিতেছে। শুনিবামাত্রই হস্তস্থিত লণ্ঠন দোলাইয়া পাহারাওয়ালা সেইদিকে ছুটিয়া চলিল। য্থাস্থানে উপস্থিত হইয়া দেখিল, ভদ্রলোকটি সেইখানে জানুপরি ভর দিয়া বসিয়া আছে, তাহার সম্মুখে কাপড় জড়ান কি একটা স্তূপীকৃত হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে।