Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নিষিদ্ধ লোবান || Syed Shamsul Haque » Page 8

নিষিদ্ধ লোবান || Syed Shamsul Haque

লাশ আর লাশ

তারপর সেই দৃশ্য দেখা যায়। বাজারের খোলা চত্বরময় ছড়িয়ে আছে লাশ! বেড়াহীন উলঙ্গ দোকানের খুঁটি আঁকড়ে পড়ে আছে লাশ। আলোর দিকে ঢালু হয়ে নেমে গেছে যে গলিটা, তার ওপরে উপুড় হয়ে আছে লাশ। লাশের পর লাশ। এক, দু, তিন, চার, ছয় সারি চোখে পড়ে–বাজারে হয়তো ফল বেচাতে এসেছিল গাছের, দুটো বাচ্চা উল্টে থাকা গরুর গাড়ির ছাউনি জড়িয়ে ধরে–লাশ; সমস্ত চত্বর আর খালের ঢালু জুড়ে ইতস্তত বাঁশের গোল গোল ঝাকা, কলস, সবজি; আর সমস্ত কিছুর ওপরে স্তব্ধতা, স্থিরতা, প্রত্যাবর্তনের আশাহীন অক্ষমতা।

মৃত্যুর মতো স্পন্দনহীন হয়ে যায় দুজন। বাস্তবের অতীত অথচ সত্যের সীমানার অন্তর্গত দৃশ্যটির দিকে স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে থাকে বিলকিস আর সিরাজ।

তারপর, দুজনেই একসঙ্গে, রক্তের ভেতরে অভিন্ন বোধ প্রবাহ নিয়ে একে অপরের দিকে তাকায়। ক্ষণকাল পরে সিরাজ হঠাৎ মুখ ঢাকে দুহাতে। টিনের বেড়ার ওপর মাথা ঠেকিয়ে নিশ্চল হয়ে যায়।

বিলকিস আবার ফিরে তাকায় চাঁদের মেঘাক্রান্ত আলোয় উদঘাটিত চত্বরের দিকে। খোকার মুখে প্রস্রাব করে দেবার কথা শোনার মুহূর্ত থেকে যে ক্ৰোধ তার ভেতরে তলোয়ারের মতো খাড়া হয়ে ছিল, এখন তা ঝলসে ওঠে। তার দ্যুতিতে ম্লান হয়ে যায় সব কিছু। লাশগুলো ছাড়া আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হয় না তার। সে সমুখের দিকে পা ফেলে।

ছায়ার মতো কী একটা অপসৃত হয়!

বিলকিসের চেতনায় সেই ছায়া কোনো রেখাপাত করে না।

কিছুটা দূরে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা লাশের দিকে স্থির চোখ রেখে সে এগোয়। অচিরে সে পাট গুদামের ছায়ার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে; আসে খোলা আলোর নিচে, অস্পষ্ট তার ছায়া তাকে অনুসরণ করে; সে এগিয়ে যায়।

বিস্ফারিত চোখে সিরাজ তাকিয়ে দ্যাখে। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় সে। তার মনে হয়, ঘুমন্ত অনেকগুলো মানুষ, তার ভেতরে প্রেতের মতো হেঁটে চলেছে এক রমণী; সেই রমণীকে বর্তমানের মনে হয় না, অতীতেরও নয়, কিংবা কোনো আগামীর। স্তম্ভিত সময়ের করতলে ক্ষণকাল ছবিটি উদ্ভাসিত থেকে নাতিধীর গতিতে মলিন হয়ে যায়।

সিরাজ তাকিয়ে দ্যাখে, এক খণ্ড ধূসর মেঘ চাঁদটাকে ঢেকে দিয়েছে। ধূসর সেই মেঘের পেছনে অতি দ্রুত গতিতে আরো অনচ্ছ আরো ধূসর মেঘ ছুটে আসে এবং চাঁদটাকে গ্রাস করে ফেলে।

সম্মুখে তাকিয়ে দ্যাখে, বিলকিসকে আর দেখা যায় না।

লাশগুলোকে খণ্ডিত কিছু অন্ধকার বলে বোধ হয়।

চত্বরে দৌড়ে যায় সে। প্রথমে খুঁজে পায় না বিলকিসকে। যেন এই বাস্তবতাকে নিঃশব্দে গ্রাস করে ফেলেছে অথবা মৃতেরা তাকে দলে টেনে নিয়েছে।

পায়ের কাছে নরম একটা কিছুতে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায় সিরাজ। দ্যাখে, বিলকিস মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে একটি লাশের মুখ উপুড় হয়ে দেখছে।

মধ্যবয়সী কৃষকের চোখ দুটি বিস্ফারিত, ঠোঁট দিয়ে রক্ত পড়ছিল, জমাট বেঁধে আছে; দাঁতগুলো দেখা যাচ্ছে একটু, যেন সাক্ষাতে সাড়া দিয়ে মৃদু হাসছে।

বিলকিসকে টেনে তোলে সিরাজ–আপা।

বিলকিস স্থির কণ্ঠে বলে, এত লাশ, সিরাজ!

চারদিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিপাত করে সিরাজ হাত ধরে টান দেয়–এদিকে আসুন।

একটা চালার আড়ালে তাকে টেনে এনে সিরাজ তিরস্কার করে। আপনার কি মাথা খারাপ? কে কোথায় আছে না আছে।

না। নেই।

কী করে বুঝলেন?

একটা শিয়াল দৌড়ে গেল। শেয়াল মানুষ থাকলে আসত না।

সিরাজ কান খাড়া করে। কিছু শুনতে পায় না কোথাও। কেবল খালপাড়ে জলের মৃদু অনবরত অভিঘাত বেজে চলে। শ্রুতির ভেতর যতটা নয়, আত্মার ভেতর দিয়ে জলের সেই শব্দ বয়ে যায়।

তবু সাবধান হবেন না?

আবার চারদিকে তাকায় সিরাজ।

জানেন, ওরা লুকিয়ে থাকতে পারে? হুকুম দিয়েছে লাশ কেউ ছুঁতে পারবে না। কাছে এলেই গুলি করবে।

জানি।

ওরা কি একা ফেলে রেখেছে, মনে করেন? কখনো না।

তুমি ফিরে যাও, সিরাজ।

আপনি?

আমি খোকাকে খুঁজে বের করব। নিজের হাতে মাটি দেব।

চাঁদ মুক্ত হয়ে যায়। যখন তারা চত্বরের দিকে তাকায় কাফনের মতো ধবধব করে সবকিছু। বিলকিস বলে, আমার মৃত্যুভয় নেই। সিরাজ। আমি পারব ওদের হুকুম উপেক্ষা করতে। সিরাজ কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, আপা, আপনি মনে করেন, প্ৰাণের আমার মায়া আছে? আমার বাবাকে ওরা মেরে ফেলে নি, আমার বোনকে ওরা নিয়ে যায় নি?

সিরাজের কাঁধে হাত রাখে বিলকিস। চুপ। কাঁদতে নেই।

আমি কাঁদছি না। আমি আর একটা বোন হারাতে চাই না।

বিলকিস এক মুহূর্ত সময় নেয় কথাটা বুঝতে। তারপর সিরাজকে বুকের কাছে টেনে নেয়। ছিঃ কাঁদে না। কাঁদতে নেই। আমি কি চাই না। আমার ভাই আমার সঙ্গে থাকবে, আমরা এক সঙ্গে খোকাকে কবর দেব?

বাজার সড়কের শেষ বাঁকে, পাট গুদামের সারিগুলো পেরিয়ে, ব্যাপারিদের টিনের আপিসঘর ছাড়িয়ে চত্বরটা চোখে পড়বার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব যে দুলে উঠেছিল। এতক্ষণে তা স্থিরতর হয়।

যেন দূরের একটি লক্ষ্যস্থল স্পষ্ট এবং উজ্জ্বল হয়ে যায়।

বিলকিস আর সিরাজ নিঃশব্দে চত্বরে নামে।

বিলকিস ফিসফিস করে বলে, তুমি ঠিক বলেছ, ধরা পড়ে গেলে খোকাকে কবর দিতে পারব না।

আপা দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হবে না। বসে পড়ি।

ধরা পড়তে চাই না, সিরাজ। আমরা ধরা পড়তে চাই না। ধরা না পড়ে, খোকাকে কবর দিয়ে, আমি দেখিয়ে দিতে চাই, খোকা মানুষ, খোকা পশু নয় যে তার লাশ পড়ে থাকবে।

বিলকিস কথাগুলো একটানা বলে না। থেমে থেমে বলে, আর হামাগুড়ি দিয়ে একেকটা লাশের কাছে যায়। তার মুখ ফিরিয়ে দ্যাখে, আবার নিঃশব্দে নামিয়ে রাখে। সব লাশের কাছে যায় না। মুখ না দেখেও বোঝা যায়। পোশাক দেখে অনুমান করা যায়, খোকা নয়, দোকানদার, বাজারের কুলি, গ্রামের গৃহস্থ।

দূরে একটা লাশ দেখে দুজনেই একসঙ্গে সচকিত হয়ে ওঠে।

পরনে ট্রাউজার, গায়ে হাফশার্ট, পেটে হঠাৎ ব্যথা উঠলে মানুষ যেভাবে যন্ত্রণায় উপুড় হয়ে পেট চেপে ধরে, অবিকল সেই ভঙ্গিতে পড়ে আছে। তার শরীরের গড়ন দেখে যুবক মনে হয়।

খোকা?

মুখ দেখে আর্তনাদ করে ওঠে সিরাজ।

কে?

এরফান।

আস্তে করে মাথাটা নামিয়ে রাখে বিলকিস।

ভালো ফুটবল খেলত এরফান। ফুটবলের জন্য পড়া হয় নি। বাজারে লাইব্রেরি দিয়েছিল।

অদূরে আরও একটি যুবকের লাশ চোখে পড়ে। তার মুখ পোশ ফেরানো। বুকের কাছে পা ভাঁজ করে, শীতের দিনে পাতলা কাঁথার নিচে শুয়ে থাকার মতো গুটিশুটি হয়ে আছে। একটা হাত, যেটা ওপরে, পেছনের দিকে টানটান প্রসারিত।

নান্টু।

কোন বাড়ির?

ভোলা ডাক্তারের বড় ছেলে। বিলকিসের মনে আছে ভোলা ডাক্তারকে। ছোটবেলায় কত ওষুধ খেয়েছে তার। বায়না ধরলে মাঝে মাঝে ছোট শাদা মিষ্টি বড়ি দিতেন খেতে। জলেশ্বরীর সবচে নামকরা হোমিওপ্যাথ।

বিলকিস বলে, নাটুকে কতদিন দেখি নি!

নান্টুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে বিলকিস। আবার ঝুঁকে পড়ে দ্যাখে। আলতো একটা হাত রাখে নান্টুর গালে। তার বিস্ময় যায় না, সেই ছোট্ট নাটু কত বড় হয়ে গেছে! দাড়ি কামায় এখন। মুখের আদালটা একটু একটু করে স্মৃতির ছোট ছেলেটির সঙ্গে মিলে যায়।

নান্টু এত বড় হয়েছিল?

সিরাজ এতক্ষণ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসেছিল। নাটুকে সে এভাবে দেখতে পারছিল না। মুখ ফিরিয়ে রেখেই সে অবরুদ্ধ গলায় বলে, সময় চলে যাচ্ছে, আপা।

দাঁড়াও। নাটুকে ভালো করে শুইয়ে দি।

তারপর হামাগুড়ি দিয়ে আঁধারে আবার তারা এগোয়। খোকাকে তবু পাওয়া যায় না। সিরাজ, খোকাকে ওরা নিয়ে যায় নি তো?

না। মনে তো হয় না।

খোকা সত্যি এখানে ছিল?

মকবুলদা, আলেফ মোক্তার, দুজনেই বলেছেন। আলেফ মোক্তারকে, বললাম না, ওরা কী করতে বলেছিল?

লাফ দিয়ে ক্ৰোধ ফিরে আসে। সটান হয়ে দাঁড়ায় বিলকিস।

সিরাজ, শোনো।

বিলকিসের কণ্ঠস্বরে কী ছিল, ভয় পেয়ে যায় সিরাজ।

সে উঠে দাঁড়াতেই বিলকিস তার হাত শক্ত করে ধরে, সিরাজ, আমরা সবাইকে কবর দেব। হাঁ, সবাইকে।

খোকা ভাইকে খুঁজব না?

খুঁজতে হবে না। খোকা এখানেই আছে। একটার পর একটা কবর দিতে দিতে খোকাকেও আমরা পেয়ে যাব।

দুজনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্তব্ধ হয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর নীরবতা প্রথম ভাঙ্গে বিলকিস। আগে একটা জায়গা দেখতে হয়।

উল্লেখ করতে হয় না, কীসের জায়গা।

কিছুক্ষণ চিন্তা করে সিরাজ বলে, বেশি দূরে তো যেতে পারব না খালপাড়ের মাটি নরম আছে। সেখানে কবর দিলে আপনাদের কোনো কিছু অশুদ্ধ হবে না তো?

বিস্মিত হয়ে বিলকিস সিরাজের দিকে তাকায়–আমাদের মানে?

হঠাৎ চঞ্চল হয়ে ওঠে সিরাজ। থতিমতো খেয়ে বলে, আমি ঠিক জানি না। কবর কীভাবে দেয়। গোরস্তানে যেতে পারব না, তাই বলেছিলাম। খালপাড়ে কবর দিলে অসম্মান হবে। কিনা, আর কিছু না। আচ্ছা, আমি না হয় দেখে আসি।

সিরাজ গলি দিয়ে খালপাড়ের দিকে চলে যাবার পরও বিস্ময়টুকু তীক্ষ্ণ হয়ে থাকে। তারপর চত্বরের দিকে চোখ পড়তেই বলবান বাস্তব সমস্ত কিছুকেই পরাজিত করে ফেলে মুহূর্তে। লাশগুলোর পড়ে থাকার ভঙ্গি দেখে মনের ভেতরে ছবি তুলতে চায় বিলকিস, আজ দুপুরে কী হয়েছিল।

আলেফ মোক্তার লাইন করে দাঁড় করাবার কথা বলেছিলেন, মনে পড়ে যায়। নান্টু আর এরফানের লাশ–দেখে অনুমান করা যায়, এক লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল। তাহলে খোকা কি লাইনে ছিল না। দ্বিতীয় একটি লাইন করা হয়েছিল। শুধু দুটি? তৃতীয় লাইন কি হয় নি?

আবার কিছু বিক্ষিপ্ত লাশ দেখে, তাদের হাতের কাছে ঝাকা, ব্যাগ, সবুজি দেখে মনে হয়, বেপরোয়া গুলি চলেছিল অকস্মাৎ। মানুষগুলো দৌড়ুতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়েছিল।

কোনটা আগে হয়েছিল? লাইন করিয়ে গুলি, না, বাজারের জনতার ওপর গুলি?

আপা, খালপাড়ে একটা গর্ত করা আছে। আপনি দেখবেন?

দুসারি দোকানের ভেতর দিয়ে খালের দিকে গলি। কোনো দোকানে ঝাঁপ ফেলা নেই। ভেতরের তাক, আলমারি, আসন সব ভেঙেচুরে উল্টে, হা খোলা পড়ে আছে।

লুটও করেছে ওরা।

তা করবে না? এর আগেও দুবার লুট করেছিল।

বিলকিস এমনভাবে হেঁটে যায়, যেন ধরা পড়বার ভয় নেই। হয়তো ধরা পড়বার কথা সে ভুলে গেছে অথবা এতক্ষণে নিশ্চিত হয়েছে, বাজারে কেউ পাহারায় নেই।

সিরাজ যাকে গর্ত বলেছিল, ঠিক গর্ত নয়। খালপাড়ের ভাঙন ঠেকাবার জন্যে বাঁশের বেড়া লম্বা করে দেওয়া আছে। তবু ভেতর থেকে মাটি খসে যায় বলে মাঝে মাঝে মাটি কেটে ভরাট করতে হয়। সেই মাটি কেটে নেবার দরুন কিছুটা দূরে পাগারের মতো হয়ে আছে। তার ভেতর নেমে পড়ে বিলকিস। মাটিতে হাত দিয়ে পরীক্ষা করে। মাটি ঝুরঝুরে নরোম বালির মিশেল।

উৎসুক চোখে সিরাজ তাকিয়ে থাকে বিলকিসের দিকে।

বিলকিস বলে, তবু একটা দিক আরো একটু খুঁড়তে হবে। ওদিকে গর্ত কম। তারপর সে গর্তের দৈর্ঘ্য-প্ৰস্থ একবার হেঁটে আসে। বলে, খুব হলে আট নজনের মতো জায়গা হবে। আরেকটা বড় কবর খুঁড়তে হবে যে!

আগে যেটা আছে, আমরা কবর দিয়ে নি?

তা ভালো।

সিরাজ ইতস্তত দৃষ্টিপাত করে। এমন একটা কিছু সে খোজে, যা দিয়ে গর্তটা গভীর করা যায়। কিন্তু কিছু চোখে পড়ে না।

বিলকিস বলে, বাজারে হয়তো পাওয়া যেতে পারে।

দুজনে আবার উঠে আসে চত্বরে। এ দোকান সে দোকান উঁকি দেয়, অন্ধকারে ভালো ঠাহর করা যায় না। কোদাল বাঁ খন্তা জাতীয় কিছুই চোখে পড়ে না। লাশগুলোও এখন আর তাদের নিশ্চল বাঁ স্তম্ভিত করে না। যেন এ ব্যাপারে অনেক আগেই একটা নিম্পত্তি হয়ে গেছে; লাশগুলো সহিষ্ণুভাবে অপেক্ষা করছে তাদের শেষকৃত্যের।

হঠাৎ টিনের একটা টুকরো পাওয়া যায়। আঁশটে গন্ধ। এমনকি মাছের আঁশ লেগে আছে। জেলেদের কেউ ঝাকার ওপর এই টিন বিছিয়ে মাছ বেচত।

এটাই বেশ।

সিরাজ সায় দেয়।

আরেকটা দরকার।

আঁশটে গন্ধ ধরে এগোতেই মাছ-এলাকায় এ রকম আরো কয়েকটা টিনের টুকরো পাওয়া যায়। দুজনে টিন দুটো নিয়ে তরতর করে ফিরে যায়। খালপাড়ে।

যতটা সহজ মনে হয়েছিল, মাটি যত নরম মনে হয়েছিল, ঠিক তা নয়। বালির পাতলা স্তরের পরেই কালো শীতল এঁটেল মাটির পুরু স্তর। সর্বাঙ্গে মাটি-কাদা মাখামাখি হয়ে যায়। তবু একরোখার মতো দুজনে গর্ত গভীর করে চলে। চাঁদ কখনো আলো দেয়, কখনো মেঘের আড়ালে কৃপণ হয়ে যায়।

আধা ঘণ্টাখানেক খুঁড়বার পর বিলকিস সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলে, এই থাক।

এতক্ষণে টের পায়, পিঠ টনটন করছে। গর্তের খাড়াইতে বসে পড়ে বিলকিস। বসে। হাঁপাতে থাকে। সিরাজও এতক্ষণ পরিশ্রম করে ঘামে ভিজে উঠেছিল। এক হাতে কপালের ঘাম মুছে সেও বসে পড়ে।

বিলকিস বলে, লক্ষ করেছ সিরাজ, সারা বাজারে কটা পাহারা নেই?

হাঁ, তাই দেখছি।

সিরাজ তবু সাবধানী দৃষ্টিপাত করে চারদিকে। খালের অপর পাড়েও দেখে নেয় সে। ফসলের মাঠের পর কালো ফিতের মতো অন্ধকার গাছপালার সার।

হুকুম শুনে মনে হয়েছিল, দিনরাত পাহারা দিয়ে আছে।

আশ্চর্য!

কীসের আশ্চৰ্য, সিরাজ? রাতের অন্ধকারকে ওরা ভয় করে।

সিরাজ তবু সতর্কতা ত্যাগ করে না। ঘন ঘন সে মাথা ফিরিয়ে ডানে-বায়ে দেখে নিতে থাকে।

বিলকিস উঠে দাঁড়িয়ে বলে, যেখানে সবচে কঠিন হুকুম জারি করেছিল, সেখানেই ওদের সবচে বেশি ভয়।

আমার মনে হয়, তবু আমাদের তাড়াতাড়ি করা দরকার।

সিরাজও উঠে দাঁড়ায়।

খালপাড়ে উঠে গিয়ে নিচে কবরটার দিকে ফিরে তাকায় দুজনে। গর্তের শূন্যতাকে বাস্তবের চেয়েও অনেক গভীর এবং ব্যাপকতর বলে বোধ হয়।

গলিটা চত্বরে গিয়ে পড়বার মুখেই একটা লাশ কাৎ হয়ে পড়েছিল। মধ্যবয়সী গরীব কোনো রমণী। খাটো শাড়ি হাঁটুর ওপরে উঠে গেছে। বুক খোলা। নিচের চোয়াল বিকৃত হয়ে এক পাশে ঠেলে সরে গেছে। রুক্ষ চুলে আধখানা ঢেকে আছে তার মুখ।

নীরবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে যায়। রমণীটিকে দিয়েই শুরু করে।

সন্তৰ্পণে, যেন এখনও প্ৰাণ আছে–ব্যথা পাবে, বিলকিস রমণীর হাত দুটি মুক্ত করে নেয়, পাঁজরের নিচ থেকে।

তুলতে পারলে ভালো হতো।

তোলা মুশকিল হয়ে পড়ে। মানুষ মৃত্যুর পরে ভারী হয়ে যায়। আত্মাই মানুষকে লঘু রাখে। যতক্ষণ সে জীবিত, পাখির মতো উর্ধে উঠে যাবার সম্ভবপরতাও তার থাকে। প্ৰাণ এবং স্বপ্নের অনুপস্থিতিতে মানুষ বিকট ভারে পরিণত হয়। লাশটিকে তখন টেনে নিয়ে যায় ওরা, আস্তে আস্তে গলিটা পার হয়ে ঢালু বেয়ে নিচে নামে। তার পর গর্তের এক প্রান্তে শুইয়ে রেখে আবার ওরা ফিরে যায় চত্বরে। আবার একটি লাশ আনে। প্রথমে যাকে পায় তাকেই আনে। এমনি করে করে ছটি লাশ নামিয়ে আনে তারা। বিলকিস অনুমান করেছিল আট নজনের মতো সংকুলান হবে। দেখা যায়, ছজনেই আর জায়গা নেই। তখন মুহূর্তের জন্য অবসন্নতা পেয়ে বসে দুজনকেই। মোট কত লাশ গুণে দেখে নি, কিন্তু এর চেয়েও অনেক বড় কবরের যে দরকার হবে, তা তারা অনুভব করে।

দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বিলকিস বলে, হয়তো এখানেই বাচ্চা দুটোর জায়গা হয়ে যাবে।

পায়ের দিকে কিছুটা জায়গা খালি আছে। সেদিকে তাকিয়ে সিরাজ বলে, আপনি উত্তর দিকে মাথা দিতে বললেন, বাচ্চাদের তো উত্তর দিকে হবে না।

না হোক।

সিরাজ তবু ইতস্তত করে।

দেরি করো না।

দুজনে বাচ্চা দুটোকে কোলে করে নিয়ে আসে খলপাড়ে। হঠাৎ চোখে পড়ে, দূরে কী জ্বলজ্বল করছে দুটো! এক পলকের জন্যে শীতল হয়ে যায় শিরদাঁড়া। পরীক্ষণেই বুঝতে পারে–শেয়াল। মৃতের সংখ্যা যেখানে বেশি সেখানে জীবিত দুজনকে সে অতটা ভয় করে নি। অথবা পশু তার রক্তের ভেতরে অনুভব করতে পেরেছে, এরাও প্রায় মৃত কিংবা অবসন্ন।

তাড়াতাড়ি কবরের ভেতরে বাচ্চা দুটোকে পায়ের কাছে শুইয়ে দেয় ওরা। ফিরে তাকিয়ে দেখে, শেয়ালটা সেখানে আর নাই। চারদিকে দৃষ্টিপাত করেও তার আর সন্ধান পাওয়া যায় না।

কবরের ভেতর থেকে উঠে আসে ওরা। ওপরে দাঁড়িয়ে বিলকিস বলে, তুমি কি জান, মাটি দেবার সময় কোন সূরা দোয়া পড়তে হয়?

সিরাজ চুপ করে থাকে কবরের ভেতরে শায়িত লাশগুলোর দিকে চোখ রেখে।

তুমি আল্লাহ বিশ্বাস কর?

সিরাজ বিলকিসের দিকে তাকায়। নিঃশব্দে কয়েকবার ঠোঁট কেঁপে ওঠে তার।

সিরাজ বলে, না।

বিলকিস সচকিত হয়ে সিরাজের দিকে তাকায়। তারপর নিজেই অনুভব করে তার নিজের ঠোঁট প্রসারিত হচ্ছে। বড় পরিচিত সেই সম্প্রসারণ–খুব ভেতর থেকে, সুদূর থেকে হাসি পেলে ঠোঁটের পেশিতে এই পরিবর্তন হয়।

বিলকিস বলে, তাহলে, আমরা না হয় বলি, যে মাটি থেকে এসেছিলে সেই মাটিতে ফিরে যাও।

ঝুঁকে পড়ে দুমুঠো মাটি তুলে নেয় দুজন। সযত্নে ধীরে কবরের ভেতর মাটি ঝরে পড়ে জীবিত দুটি মানুষের আঙ্গুলের ভেতর দিয়ে। হাত শূন্য হয়ে যাবার পরও অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তারা।

সিরাজ?

দিদি।

হয় আমাকে আপা বল, না হয় দিদি! হাত চালাও, মাটি দিয়ে ভরে দিতে হবে না?

যতটুকু মাটি সদ্য খুঁড়ে তোলা হয়েছিল তাতে অর্ধেক কবর কোনো রকম ভরাট হয়। আবার তারা সেই টিনের টুকরো দুটি হাতে নেয়। পাড় থেকে ঢালু মাটি কেটে আনতে সুবিধে হয়। সেই মাটি এনে ভরে দিতে থাকে কবর।

ঠিক তখন পটপট করে গুলি শোনা যায়।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress