Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নিশুতি রাতের ডাক || Syed Mustafa Siraj » Page 12

নিশুতি রাতের ডাক || Syed Mustafa Siraj

আজকাল দেখছি কাগজগুলোকে ফুটবলের ভূতে পেয়েছে! শিবশংকর পাশের লোকটার দিকে তাকালেন। বাবুঘাটে চায়ের দোকানে তার মতো কর্মীশ্রেণীর মানুষদের ভিড় সারাবেলা। যত ট্রাক ড্রাইভার, ক্লিনার, মুটে-মজুর শ্রেণীর গতরজীবী মানুষেরা, ভিখিরি, ভবঘুরে, নৌকার মাঝি হরেকরকমের লোকজন থইথই করে সারাক্ষণ। মাঝে মাঝে কাঠখোট্টা প্রকৃতির দুএকজন কনস্টেবল বেটন হাতে গদাইলস্করি চালে এসে বসে। দেশোয়ালি ভোজপুরীতে কথা বলে চা-ওলা মেঠাই-ওলার সঙ্গে। গোঁফে তা দেয় বারবার। বুটজুতোয় বেটন ঠোকে অন্যমনস্কভাবে। রুটিন ডিউটির ফাঁকে-ফাঁকে তাদের চোখ ট্রাকের দিকে। ট্রাকের সারি চলে গেছে কত দূর পোড়া রেললাইনের সমান্তরালে! হঠাৎ উঠে সেই সারির ভেতর উধাও হয়ে যায় কোথায়। শিবশংকর আর গ্রাহ্য করেন না তাদের।

লোকটা তার কাগজটাই চেয়ে নিয়ে পড়ছে। ফিক ফিক করে আপন মনে হেসে ফেলছে। টুকিটাকি মন্তব্য করছে মাঝে মাঝে। ফের বলল–মাইরি! খালি স্বপন আর স্বপন প্রেত্যেক দিন! এর খেলা কখনও দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না। দেখছেন নাকি দাদা?

শিবশংকর মাথা দোলালেন। দেখেননি। কোনো খেলাই দেখেননি জীবনে। খেলা নিয়ে হই-চই দেখে তার বরাবর অবাক লেগেছে। স্রেফ পাগলামি! এই যে এক ছোকরাকে নিয়ে কদিন ধরে ঘ্যানঘ্যানানি চলেছে কাগজে, ওরা কি জানে সে আসলে কী? হুঁ! জানলেও পাত্তা দেবে না। তার যে চোখটা আছে, সেই চোখটাই যে কারুর নেই। তাই তারা মন্দগুলো দেখতে পায় না। ভালমন্দ তফাত করতে পারে না। ওই অমর্ত্য পাঁঠাটা! ওই উজ্জ্বল শুওরটা! ওই অমিয় কুকুরটা! ওদের মন্দগুলো কারুর চোখে পড়েনি। আর এই স্বপন নামে ছুঁচোটা! থুঃ থুঃ করে থুথু ফেললেন শিবশংকর।

কপাল মাইরি! লোকটা কাগজের ওপর ঝুঁকে বলল কী কপাল দেখছেন? টেন্টে আলাদা ঘর দিয়েছে থাকতে। সারাক্ষণ প্র্যাকটিসের জন্য। কোচ–ওরে বাবা! দিলীপ দেশাইয়ের মতো প্রাক্তন প্লেয়ার কোচ হয়ে এসেছে ক্লাবে। গেল ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান! ফিক ফিক করে আবার হাসতে লাগল সে। দেশাইবাবু বলেছে তিনদিনে স্বপনকে ফর্মে এনে দেবে। তারপর ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে ফ্রেন্ডলি গেমে নামাবে শুক্রবার! আজ কী বার যেন দাদা?

শিবশংকর বিরক্ত হয়ে বললেন–সোমবার।

লোকটা আঙুল গুনতে লাগল। বোঝা যাচ্ছিল যে খেলাটা না দেখে ছাড়বে না। এই সময় আরেকটা লোক এসে তার পিঠে হাত রাখল। সে মুখ তুলে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। কি লোক মাইরি তুমি! একঘণ্টা ধরে ওয়েট করছি। দাদার কাগজটা না থাকলে কখন কেটে পড়তুম।

–আরে ভাই, বাসের যে অবস্থা–এই সক্কালবেলাতেই! কাগজটা ফেরত দিয়ে তারা হনহন করে চলে গেল স্ট্যান্ড রোডের দিকে। শিবশংকর কাগজটা ভাঁজ করে ব্যাগে ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। নিরিবিলিতে একটু বসবেন কোথাও।

জলপুলিসের বাড়িটা ছাড়িয়ে গিয়ে গঙ্গার ধারে বটগাছের ছায়ায় বসে পড়লেন ঘাসের ওপর। নিচে ভাটার কাদা থকথক করছে। একদঙ্গল গাধাবোট গা ঘেঁষাঘেঁষি করে ভেসে আছে। তলার ফাঁক দিয়ে ভেসে এসেছে একটা কলাগাছের গুঁড়ি, জবাফুল, কচুরিপানার ঝাড়। মা অপালা, আর একটুখানি ধৈর্য ধর! একটু বেকায়দা হয়ে গেছে, নইলে এতদিনে

ফোঁস করে নাক ঝেড়ে জামার হাতায় নাক ঘষলেন শিবশংকর। অমিয় বক্সীকে যে ভাবে ফাঁদে ফেলেছিলেন, সেইভাবে একটা কিছু করতে হবে। অমিয় তাকে কখনও দেখেননি। স্বপনও দেখেনি। এই একটা বড় সুবিধে। অমিয়কে উড়ো চিঠি লিখেছিলেন। .আজ রাত ঠিক দশটায় মায়াপুরীর ভেতর পুকুরের ঘাটে যাবেন। আমার পরিচয় তখন দেব। অপালা কোথায় আছে আমি জানি! সব আপনাকে জানাব।

চিঠিটা পেয়েই ফাঁদে পা দিয়েছিলেন অমিয় বক্সী। তার পকেটে চিঠিটা খুঁজে না পেলে একটু চিন্তার কারণ ঘটত। পেয়েছিলেন শিবশংকর।

অপালা ছিল অমিয় বক্সীর দুর্বল জায়গা। সেই অপালাই চন্দ্রা নাম নিয়ে স্বপন ছোকরার একটা দুর্বল জায়গা হয়ে আছে। শিবশংকর ঠোঁট কামড়ে ধরে ভাবতে থাকলেন, একটা ইনল্যান্ড লেটার চাই।

–ব্রজগোপাল ঘোষ?

–আজ্ঞে হ্যাঁ। আমার ননদের স্বামী।

কী করেন তিনি?

কিরণময়ী ভেবে পাচ্ছিলেন না, এই দাড়িওলা বুড়ো সায়েবসুবো লোকটি কেন বার বার শিবুদার খোঁজ নিতে আসছেন। খুলেও বলছেন না কিছু। শিবুদা কোনদিন চোর-ছ্যাচড় প্রকৃতির লোক ছিল না। কারুর টাকা মেরে পালানো তার পক্ষে সম্ভভই নয়। বললেন ব্রজবাবু কোন অফিসে চাকরি করেন, আমি জানি না। কিন্তু শিবুদাকে কেন খুঁজছেন বললেন না তো বাবা?

কর্নেল হাসলেন–শিবশংকরবাবু পাকা ইলেকট্রিসিয়ান। সল্টলেকে বাড়ি করছি তো। তাই

এ কথাটা স্পষ্ট করে বললেই হত। কিরণময়ীর উদ্বেগ ঘুচে গেল। বললেনবুঝেছি। শিবুদা কাজে খুব এক্সপার্ট! ব্রজবাবুর ওখানে গেলে হয়তো পেয়েও যেতেন, কিন্তু ঠিকানা জানি না। গড়পার শুনেছিলাম–ওই পর্যন্ত।

–মানে গড়পার রোড?

সঠিক জানি না। ওই রাস্তায় নাকি গলি-টলিতে। তবে গড়পার এলাকার মধ্যেই। কিছুদিন হল গেছেন।

ব্রজবাবুর চেহারার বর্ণনা যদি দয়া করে দেন।

–আপনার মতোই কতকটা। বয়স আপনার চেয়ে কম। কপালে একটা গোটা আছে সুপুরির মতো।

—ফর্সা?

–মোটামুটি ফর্সাই। তবে আপনার মতো অতটা নয়। হ্যাঁ, মাথার পেছনে টাক আছে।

কর্নেল টুপি খুলে নিজের টাক দেখালেন। কিরণময়ী মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হেসে ফেললেন। কর্নেলও হাসতে হাসতে গাড়ি স্টার্ট দিলেন।….

গড়পার রোডে গিয়ে প্রথমে মুদির দোকানগুলো, তারপর কয়লাওয়ালা। শেষে রেশন দোকানে গিয়ে দেখেন সোমবার বন্ধ লেখা আছে। এগারোটা বেজে গেছে। হঠাৎ খেয়াল হল, পোস্ট অফিসে গিয়ে পোস্টম্যানদের কাছে খোঁজ নেবেন নাকি। শেষ চেষ্টা।

কিন্তু ওই বিটের পোস্টম্যান বেরিয়ে গেছেন। যারা ছিলেন, তারা হদিস দিতে পারলেন না। পোস্ট অফিস থেকে বেরিয়ে এসে গাড়িতে বসলেন কর্নেল। স্টার্ট দিতে যাচ্ছেন, হঠাৎ একজন পোস্টম্যান এসে বললেন–স্যার! পোস্টমাস্টারবাবু আপনাকে আসতে বললেন!

একটু অবাক হয়ে কর্নেল আবার পোস্ট অফিসে গেলেন। কালো লম্বাটে গড়নের এক প্রৌঢ় অমায়িক চেহারার ভদ্রলোক পোস্টমাস্টার–আপনি কার ঠিকানা খুঁজছিলেন যেন?

–ব্রজগোপাল ঘোষ। গড়পার এলাকায় নতুন এসেছেন ভদ্রলোক!

পোস্টমাস্টার হাসলেন। তখন নামটা বলছিলেন। কাজ করতে করতে কানে এসেছিল! হঠাৎ খেয়াল হল, ওই নামে এক ভদ্রলোক চিঠি লিখেছেন। ঠিকানা বদল করেছেন। নতুন ঠিকানায় যেন চিঠিপত্র ডেলিভারি দেওয়া হয়। হা–এই যে! আগে ছিলেন এই পোস্টাল জোনের মধু বারিক লেনে। গেছেন– ৩৫/২/এ গড়পার রোড।

ভদ্রলোক খসখস করে একটা চিরকুটে লিখে দিলেন ঠিকানাটা। মুচকি হেসে ফের বললেন–পাবলিক, স্যার, আমাদের দুর্নাম করে। আমরা সব সময় পাবলিকের সেবা করতে প্রস্তুত। কিন্তু পাবলিককেও তো কো-অপারেট করতে হবে!

–অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।…

কর্নেল গাড়ি স্টার্ট দিয়ে আবার গড়পাড় রোডে। এই বাড়িটার সামনে দিয়ে ঘোরাঘুরি করেছেন কিছুক্ষণ আগে। রেলিংয়ের উঁচু এক চিলতে বারান্দার ওপর নতুন লেটারবক্স দেয়ালে ঝকমক করছে বি. জি. ঘোষ।

কড়া নাড়লে একটি কিশোর বেরিয়ে বলল কাকে চাই? তারপর কর্নেলকে দেখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল! নিচে রাস্তায় লাল মোটরগাড়ি!

ব্রজগোপালবাবু কে হন তোমার? কর্নেল আদর করে বললেন।

বাবা। কিন্তু তিনি তো এখন অফিসে!

মাকে ডাক তো একটুখানি।

ব্রজগোপাল মোটামুটি সচ্ছল অবস্থার লোক বোঝা যাচ্ছে। নতুন বাসায় ওঠার কারণ সেটাই। কিরণময়ীর ঠিকানা না জানার কারণ স্পষ্ট। গরিব আত্মীয়ের সঙ্গে মাখামাখি পছন্দ করতে চাইছেন না আর। দরজা-জানলায় নতুন পর্দা! ভেতরে মোটামুটি একটা সোফাসেট নজরে পড়ছে। বাইরের ঘর সাজানোর ভঙ্গিতে-প্রাক্তন নিম্নমধ্যবিত্ত জীবনের অভ্যাসজনিত রুচি এখনও মুছে যায়নি।

কর্নেল চুরুট ধরালেন। ছেলেটি এসে বলল–আপনি ভিতরে এসে বসুন দাদু! মা আসছেন।

দাদু শুনে কর্নেল হাসতে লাগলেন। ছেলেটা বুঝতে পারল না এতে হাসির কী কারণ আছে।

তার মা এসে গেলেন। শাড়ি বদলেই এসেছেন, তাই একটু দেরি। জানলা দিয়ে নিশ্চয় আগন্তুককে দেখে মনে সম্ভ্রমের উদ্রেক হয়েছে। কর্নেল নমস্কার করে বললেন আমি এসেছি শিবশংকরবাবুর খোঁজে।

মহিলা একটু অবাক হলেন। শিবশংকর, মানে কোন্ শিবশংকরের কথা বলছেন?

ইলেকট্রিশিয়ান শিবশংকর গুপ্ত। শুনলুম, উনি কদিন আগে আপনার বউদি কিরণময়ীর ওখান থেকে আপনাদের বাসায় এসেছেন।

–কৈ, না তো! শিবুদার সঙ্গে আমার বহু বছর দেখা হয়নি। কোথায় থাকে তাও জানি না। বউদি তাই বলল বুঝি? আমাদের নতুন অ্যাড্রেস কোথায় পেলেন? বউদির তো জানার কথা নয়!

কর্নেল সে কথার জবাব না দিয়ে বললেন তাহলে শিবশংকরবাবু আসেননি?

না। আপনি কোত্থেকে আসছেন?

–আমি থাকি সাউথে। সল্টলেকে বাড়ি করছি। ইলেকট্রিশিয়ান হিসেবে শিববাবুর নাম আছে।

–আপনার নামটা?

কর্নেল এন, সরকার। কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। মহিলা অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন। ছেলেটি রাস্তায় নেমে হাত নেড়ে বলল–আবার আসবেন দাদু! টা টা!

টা টা! দুষ্টু ছেলে! হাত নেড়ে স্টার্ট দিয়ে জোরে বেরিয়ে গেলেন কর্নেল।..

বাড়ি ফিরে দেখেন রাখী ও সীমন্ত তার অপেক্ষায় বসে আছে। স্বপন ইলেভেন টাইগার্স ক্লাবের টেন্টে থাকে এখন। ক্লাব এলাকা ঘিরে সারাক্ষণ ওত পেতে আছে সতর্ক সাদা পোশাকের পুলিস। স্বপন জানে না তাকে টোপ করে ফাঁদ পাতা হয়েছে। জানলে তার প্রতিক্রিয়া নিশ্চয় বিরূপই হত। সে বড় জেদী আর খেয়ালি। সেটাই আশংকার কথা। সে পুরো ব্যাপারটা প্রচণ্ড অপমান বলে গণ্য করতে পারে। ভাবতেই পারে, খুনীকে পাকড়াও করার সঙ্গে তাকেও এই স্বর্গ থেকে এক ধাক্কায় ফেলে দেওয়া হবে আগের জায়গায় এবং তাকেও আদালতে দাঁড় করানো হবে। হ্যাঁ, এ কথা স্বপন না ভেবে পারবে না।

কিন্তু এমন অসময়ে সীমন্ত ও রাখীকে দেখে কর্নেল অবাক হলেন। তাদের মুখেও কি একটা উদ্বেগের ছায়া থমথম করছে। কিছু কি ঘটেছে? কর্নেলকে দেখে তারা অভ্যাসমতো হই-চই করল না। চুপ করে বসে আছে।

কর্নেল বসেই বললেন–কী হয়েছে ডার্লিং? পরস্পরের মধ্যে কি ঝগড়াঝাটি হয়েছে?

সীমন্ত বলল কর্নেল। আমরা এইমাত্র সেই বনবিহারীকে দেখে এলুম! দেখেই আপনার কাছে ছুটে এসেছি।

কর্নেল চমকে উঠলেন–কোথায় দেখলে তাকে?

–গঙ্গার ধারে। জাস্ট আধঘণ্টা আগে। এখনও গেলে ওকে পাওয়া যাবে।

–একটু ধীরে। হু, বল। ওখানে তোমরা কেন গিয়েছিলে? গোড়া থেকে শুরু কর।

সীমন্ত নার্ভাস ভঙ্গিতে হেসে বলল-রাখী আমার স্টুডিওতে গেল। দুজনে আজ ময়দানের টেন্টে স্বপনের কাছে খাবার কথা ছিল। আমরা গেলুম। স্বপন খুব গ্ল্যাডলি রিসিভ করল আমাদের। রাখীকে বলল, শিগগির মাকে দেখে আসবে গিয়ে। ওর সঙ্গে অনেকক্ষণ আড্ডা দিয়ে রাখী বলল, গঙ্গার ধারে একটু ঘুরে আসা যাক। তারপর ইডেনের পাশ দিয়ে এগিয়ে মোড়টা পেরিয়ে বাঁদিকে ঘুরেছি, হঠাৎ দেখি বাঁদিকে ফোর্টের কাছে যেখানে পাকিস্তানি ট্যাংকটা আছে, তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে বনবিহারী। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি দাঁড় করালুম। আমি নেমে গিয়ে ওকে ধরে চাঁচামেচি করে লোক জড়ো করব ভাবছি, রাখী বাধা দিল। কিছুতেই যেতে দিল না।

রাখী বলল রিস্ক নেওয়াটা কি ঠিক হত, বলুন কর্নেল? ওর কাছে ড্যাগার পিস্তল-টিল নিশ্চয় আছে। ওই ফাঁকা নিরিবিলি জায়গায়তা ছাড়া কাছাকাছি একটা পুলিস পর্যন্ত নেই!

কর্নেল বললেন–কোন দিকে যেতে দেখলে ওকে?

–ফোর্টের উত্তর-পশ্চিম দিক দিয়ে ঘুরে সোজা পূর্বে এগিয়ে যাচ্ছিল। ওর দিকে লক্ষ্য রেখে গাড়ি ঘুরিয়ে ইডেন পর্যন্ত এসেও ওকে দেখতে পাচ্ছিলুম। তারপর আর দেখিনি।

তাহলে ফাঁদের পরিকল্পনা সফল হবে মনে হচ্ছে। কাগজ পড়ে স্বপনের অবস্থিতির সব খবর শিবশংকর পাচ্ছেন। তাই ময়দানের ধারে কাছেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন বাঘের মতো। ওখানই কোথাও আস্তানা করে থাকতেও পারেন। নজর রাখার সুবিধে হবে তাহলে। বাঘ যেমন টোপের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়র আগে বহুবার আড়াল থেকে দেখে যায় টোপটাকে, শিবশংকরের গতিবিধিও সেই নিয়মে বাঁধা–তার প্রমাণ পাওয়া গেল।

কিন্তু এমনটি তো চান না কর্নেল! শিবশংকরের সঙ্গে কথা বলতে চান। স্বপন সম্পর্কে তার ভ্রান্ত ধারণা দূর করতে চান। তাই যেভাবেই হোক তার সঙ্গে দেখা করতেই হবে!

সীমন্ত বলল–এখনই চলুন কর্নেল! বনবিহারী আমাকে দেখতে পায়নি। সে ওখানেই কোথাও আছে।

কর্নেল ভাবছিলেন। দিনের আলো যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ শিবশংকর তার হাতুড়ি প্রয়োগ করতে পারবেন না এটা নিশ্চিত। অন্য অস্ত্র হলে কথা ছিল না। একটা হাতুড়িকে সক্রিয় করতে হলে অন্ধকার দরকার এবং যার মাথায় পড়বে, তার অসচেতন থাকাও সমান দরকার। সামনাসামনি এ জিনিস প্রয়োগ করা তার মতো লোকের পক্ষে অসম্ভব। তেমন গায়ের জোর তার থাকতেই পারে না। উল্টে নিজেই আক্রান্ত হবেন। কর্নেল বললেন–তোমরা শোন। বনবিহারীকে যে দেখেছ, এ কথা ভুলেও কাউকে বল না। স্বপনকেও না। আমি দেখছি।

রাখী ও সীমন্ত অবাক হয়ে চলে গেল।

কর্নেল জানলা দিয়ে রোদ্দুর দেখছিলেন। এই প্রচণ্ড উত্তাপে শিবশংকর হয়তো মাঠের কোনো গাছের ছায়ার বসে আছে। কিংবা ঘাসের ওপর শুয়ে আছে। কী ভাবছে সে? তার হতভাগিনী কন্যার কথা স্ত্রীর কথা?

ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ীর ফোন এল। কর্নেল, আজকের কাগজ দেখেছেন?

–হ্যাঁ। ওয়েল-ডান! চালিয়ে যাও।

–শুক্রবার ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে ফ্রেন্ডলি ম্যাচ হচ্ছে দেখেছেন তো?

হচ্ছে বুঝি?

–দেখেননি? অরিজিতের হাসি ভেসে এল। –অপরাধ নেবেন না। আপনার প্ল্যানিংয়ের সঙ্গে এটুকু আমার বাড়তি সংযোজন। পয়েন্টটা বলি শুনুন। আমরা যে ব্যহ সাজিয়ে রেখেছি, ধূর্ত শিবশংকরের তা চোখ না এড়াতেও পারে। তাই ওই খেলার আয়োজন করলুম। খেলার দিন স্টেডিয়ামে অসংখ্য লোক ঢুকবে। তার পক্ষে এই চান্সটা মিস করা অসম্ভব। আমি নিশ্চিত এ ব্যাপারে। ভিড়ে সঙ্গে মিশে সে স্টেডিয়ামে ঢোকার সুযোগ পাবে। তারপর খেলা শেষ হলে যখন সব দর্শক চলে যাবে, সে কোথাও লুকিয়ে থাকবে। লুকিয়ে থাকার জায়গা প্রচুর। স্টেডিয়ামের আসনের তলার দিকে কোথাও গুঁড়ি মেরে কাঠের ফ্রেমে বসে থাকলে কারুর নজরে পড়ার কথা নয়। তলাটা সব সময় অন্ধকার। অজস্র খুঁটি রয়েছে। মনে রাখবেন, লোকটা ইলেকট্রিশিয়ান। কাঠের খুঁটি বেয়ে ওঠা তার ডাল-ভাত। কিছু আঁকড়ে ধরে লম্বা হয়ে টিকটিকির মতো তক্তার তলার খাঁজে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লুকিয়ে থাকাও তার পক্ষে সহজ। আবার বলছি, সে ইলেকট্রিক মিস্তিরি। এই ভাবে তাকে কাজ করতে হয় বহু ক্ষেত্রে। তাই না?

–ঠিক বলেছ, ডালিং!

কনফিডেন্স নিয়ে বলছি কর্নেল! অহঙ্কার নয়, লজিক্যাল মেথড। আশা করছি, আমরা শনিবারের সব কাগজে শিবশংকরকে গ্রেফতারের খবর দিতে পারব। শুক্রবার রাতেই সে ফঁদে পা দেবে। সিওর চান্স নাইনটি নাইন পার্সেন্ট ধরে নিতে পারেন।

-কর্নেল একটু হেসে বললেন–ছাড়ি অরিজিৎ। আমার কাজ তো শেষ। বাকিটা এবার তোমাদের হাতে।

দোতলায় থাকেন মিসেস ডিসুজা। স্কুল-মিস্ট্রেস। তার ছোট্ট সাদা কুকুর রেক্সি মাঝে মাঝে সুযোগ পেলেই তিনতলায় এসে কর্নেলের ফ্ল্যাটের দরজায় খড়খড় করে নখের আঁচড় কাটে। ষষ্ঠীর কুকুরভীতি প্রচণ্ড। কিচেন থেকে টের পেলেই চেঁচায়–গেট আউট! গেট আউট! বন্ধ দরজার এদিকে দাঁড়িয়ে সে রেক্সিকে ধমক দেয় ইংরিজিতে। কর্নেলের মুখ থেকে শোনা কোনো শব্দ বা টুকরো বাক্য, তার মানে যাই হোক। নটি বয়। ইসটেরেঞ্জ (স্ট্রেঞ্জ)। ডার্লিং! মুখ বিকৃত করে দাঁত কটমটিয়ে বলে ষষ্ঠী–ডার্লিংব্যাটা!

আসলে রেক্সি আসে লোভে। তার গায়ের মতো সাদা গোঁফদাড়িওলা লোকটা তাকে আদর করে কোলে বসিয়ে পনির মাখানো বিস্কুট খাওয়ায়। কাঁধে চাপিয়ে নিয়ে ছাদে যায়। মিসেস ডি সুজার ফ্ল্যাটে প্রথম প্রথম মড়াকান্না পড়ে যেত রেক্সি পালিয়েছে বলে। পরে জানাজানি হয়ে গিয়ে ভদ্রমহিলা আর গা। করেন না। তবে রেক্সির বেরিয়ে পড়ার মূলে আছে তার মেয়ে লিন্ডা। লিন্ডা রেক্সির ছটফটানি দেখে টের পায়, সে তেতলার সাদা দাড়িওলা বুড়োর কাছে। যেতে চায়।

তিনটে বেজেছে। কিন্তু এখনও রোদ বড্ড কড়া। কর্নেল অনেকদিন পরে বেড়ানোর ছড়িটি হাতে নিয়েছেন। টুপিটি চড়িয়েছেন সদ্য। এমন সময় দরজায় রেক্সির আঁচড় কাটার শব্দ শুনতে পেলেন। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হল, ছড়ির সঙ্গে একটা কুকুরের সংযোজন ঘটলে বেড়ানোটা অত্যন্ত স্বাভাবিক হয়ে ওঠে।

দরজা খুলেই রেক্সিকে তুলে নিলেন। তারপর ডাকলেন-ষষ্ঠী।

ষষ্ঠী ভয়ে ভয়ে দূর থেকে সাড়া দিল–যান। দরজা বন্ধ করে দিচ্ছি।

–দূর হতভাগা! চারটে বিস্কুট আর পনির দিয়ে যা খানিকটা।…

একটু পরে দোতলায় এসে মিসেস ডি সুজার কাছে অনুমতি নিলেন, রেক্সিকে নিয়ে কিছুক্ষণ গঙ্গার ধারে খাচ্ছেন। চিন্তার কারণ নেই। লিন্ডা বলল–এ্যান্ডপা, হোয়াই নট মি অলসো?

আরও একটি সংযোজন স্বাভাবিকতাকে চূড়ান্ত করে তুলল। লিন্ডার বয়স বছর সাত-আষ্টেক। একটু ছটফটে মেয়ে। গাড় বের করলেন না দেখে সে অবাক হয়ে বলল জাস্ট ওয়াকিং? হেই ম্যান! নো ওয়াক!

কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন–গাড়ি খারাপ হয়ে আছে, ডার্লিং! তবে আমরা গড়িতেই যাব।

ট্যাক্সি পাওয়া গেল মোড়ে। কুকুর, বালিকা, হাতে ছড়ি মাথায় টুপি দাড়িওলা বুড়ো এসেছে গঙ্গার ধারে বেড়াতে। দাদু, নাতনি, একটা কুকুর। শনি রবিবার ছাড়া তত বেশি ভিড় হয় না। দ্বিতীয় হুগলি সেতুর মুখ থেকে হাঁটতে হাঁটতে জল-পুলিসের আস্তানা পর্যন্ত এলেন। মাঝে মাঝে বাইনোকুলারে চোখ। ডাইনে-বাঁয়ে কাছে ও দূরে। শিবশংকরের এনলার্জ করা ছবিটা দেখে দেখে মুখস্থ হয়ে গেছে মনে। বয়স বেড়েছে এখন। কিন্তু তার চেহারায় কতকগুলো জোরালো চিহ্ন আছে, যা বদলানোর নয়। খাড়া শক্ত নাক। তীক্ষ্ণ চিবুক। চিমসে গাল। লম্বাটে চোয়াল। একটু কুঁজো, সামনে ঝুঁকে দাঁড়ানো ভঙ্গি। কান দুটোও গড় মানুষের চেয়ে বেশি লম্বা। কানে প্রচুর লোম। ছবিটা পরিষ্কার এসেছে।

রাস্তা পেরিয়ে ফোর্টের ওয়াটার গেটের কাছে এলেন। লিন্ডা আর রেক্সি ঘাসে ছোটাছুটি করে খেলতে লাগল। বাইনোকুলারে প্রথম দক্ষিণ, তারপর উত্তর তন্নতন্ন করে খুঁজলেন কর্নেল। উত্তরে হাঁটতে শুরু করলেন। লিন্ডার ক্লান্তি নেই। খোলামেলা বিশাল আকাশের লায় মেয়েটা নিজেকে যেন ছড়িয়ে দিতে চাইছে। বরং রেক্সি বেচারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। চাটি খাচ্ছে লিন্ডার কাছে। কখনও কর্নেল, কখনও লিন্ডা তাকে তুলে নিচ্ছেন। কুকুরটা ক্রমশ যেন অবাক হয়ে যাচ্ছে ব্যাপার-স্যাপার দেখে।

ফোর্টের উত্তর-পশ্চিম হয়ে উত্তরে চলে এলেন হাঁটতে হাঁটতে। গড়খাইয়ের মাথায় কাঁটাতারের বেড়া। ঘন ঝোঁপ। একটা প্রতিষ্ঠানের ব্যায়ামাগার। পেছনে পার্কের মতো গাছে ঢাকা জমি। গাছের তলায় বেঞ্চ। খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে খোলা মাঠে নামলেন। বিকেলের সোনালি রোদে ঝলমল করছে চারদিক। শিবশংকর কোথাও নেই। কিশোর ও যুবকের দল ফুটবল খেলছে এখানে ওখানে। কোথাও কিছু দর্শক বসে বা দাঁড়িয়ে তা উপভোগ করছে। খড়ের গাদায় সুচ খুঁজছেন কর্নেল। রাস্তা পেরিয়ে ইলেভেন টাইগার্সের টেন্ট দেখতে পেলেন সামান্য দূরে। বাইনোকুলারে দেখলে, গেটের একটু তফাতে পুলিসভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। তারকাটার বেড়া ঘোরালো হয়ে গিয়ে স্টেডিয়ামের সঙ্গে মিলেছে। দু-একটা লোক বসে আছে বাইরে ঘাসের ওপর। বাদাম খাচ্ছে। ডাইনে এবং বাঁয়ে তেমনি একটা বা দুটো লোক একই ভঙ্গিতে বসে বা দাঁড়িয়ে। আবার একটা পুলিসভ্যান। অরিজিতের লোকেরা সজাগ পাহারা দিচ্ছে সন্দেহ নেই।

রাস্তার ধারে বিশাল-বিশাল গাছ। তাদের ছায়া এখন রাস্তা পেরিয়ে চলেছে। পূবের দুধারে দুটো ক্লাবের টেন্টের মাঝখানে অনেকটা খোলা জমি। সেখানে রোদ পড়ে আছে। পা বাড়াতেই গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসে থাকা একটি লোককে দেখতে পেলেন। থমকে দাঁড়ালেন কর্নেল। খোঁচাখোঁচা সাদা দাড়ি মুখে, মাথার চুল কালো এবং খুঁটিয়ে ছাঁটা। লম্বাটে খাড়া নাক। লম্বা কানের ওপর ঘন লোম। কোমরের পেছনে একটা ব্যাগ ঠেসে গোঁজা আছে। গায়ে ছোপ-ছোপ ময়লা মাখানো শার্ট, পরনে ছাইরঙা একটা যেমন তেমন প্যান্ট। স্যান্ডেল দুটো সামনে রাখা। একবার কর্নেলের দিকে তাকিয়েই দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল।

কর্নেল বললেন–লিন্ডা! নাও আই টেক রেস্ট ইউ প্লে।

কাম অন গ্র্যান্ডপা! কাম অন। নাইস গ্রাস ইউ সি।

ইয়া! ভেরি সফ্ট এ্যাস। ইউ প্লে ডার্লিং।

লিন্ডা আর রেক্সি খেলতে লাগল। কর্নেল ঘাসের ওপর বসলেন পা দুটো ছড়িয়ে। ছড়িটা পাশে রাখলেন। চুরুট ধরালেন। বাইনোকুলার আবার তুলে ইলেভেন টাইগার্সের মাঠটা দেখতে থাকলেন। স্বপনকে দেখা যাচ্ছে না। স্টেডিয়ামের ভেতরটা সোজাসুজি দেখা যায় না এখান থেকে। তবে কোচিং চলেছে বোঝা যায়।

বাইনোকুলার নামিয়ে ঘুরে বললেন বড্ড রোদ্দুর পড়েছিল আজ!

সায়েব ভেবেছিল। তাই বাংলা শুনে অবাক হয়েছে লোকটা। একটু হাসল অনিচ্ছাসত্ত্বেও।

–একেবারে বৃষ্টি হচ্ছে না। কি অবস্থা! কর্নেল হাসলেন–আপনার মতো রোগা লোকদের তত অসুবিধে হবে না। কিন্তু আমার মতো পেল্লায় লোকেরা মারা পড়ে যাবে।

লিন্ডা দৌড়তে গিয়ে আছাড় খেতেই লোকটা বলে উঠল–আহা রে! লাগল মা?

–আর বলবেন না। বড় দুষ্টু মেয়ে। বিদেশে থাকে বাবা-মায়ের সঙ্গে। বেড়াতে এসেছে।

বাংলা বলতে পারে না বুঝি?

না। সেখানেই জন্ম তো। বাংলা শেখার সুযোগ পায়নি।

–আপনার নাতনি বুঝি?

–হ্যাঁ।

–আহা! বেশ মুখখানি! দেখে বড় ভাল লাগে। খেল মা, খেলা কর! প্লে! কেয়ারফুল্লি প্লে!

কর্নেল হাসলেন। ছোটদের আপনার ভাল লাগে?

শ্বাস ছেড়ে বলল–আমারও এইরকম সুন্দর একটা মেয়ে ছিল, জানেন?

–ছিল, মানে এখন নেই?

নাঃ!

–অসুখ হয়েছিল?

শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বলল-ব্লাডক্যান্সার!

–ও রোগের তো চিকিৎসা নেই। কী আর করবেন? কর্নেল তার দিকে ঘুরে বসলেন। এই তো আমার চেনাজানা একটা মেয়ে, কুড়ি-একুশ বছর বয়স হবে হঠাৎ ব্লাডক্যান্সার ধরা পড়ল। যে ছেলেটির সঙ্গে ওর বিয়ের কথা ছিল, সেও চিকিৎসার জন্য কি চেষ্টা না করেছে! কিছুই

–কেন? তার মা-বাবা ছিল না?

কর্নেল একটু হাসলেন।– ব্যাপারটা খুলে না বললেন বুঝতে পারবেন না। মেয়েটা বাড়ি থেকে সৎবাবার অত্যাচারে পালিয়ে এসেছিল। তারপর এমন একটা জায়গায় আশ্রয় নেয় যে সেখানেও

সন্দিগ্ধ! চোখ দুটো নিষ্পলক হয়ে গেছে। আস্তে বলল–এমন হয়।

–তো সেখানে সব বজ্জাত প্রকৃতির লোক। তাদের পাল্লায় পড়ে গেছে। ছেলেটা তাকে সাধাসাধি করত, জানেন। কিন্ত ততদিনে মেয়েটারও স্বভাব বদলে গেছে। ছেলেটাকে আর পাত্তাই দিত না। শেষে ব্লাডক্যান্সার–ছেলেটা হসপিটালে নিয়ে যাবার জন্য মাথা ভাঙত। নিয়ে যাওয়াও কঠিন ছিল। বুঝতেই পারছেন ব্যাপার। যখন মেয়েটা মরো-মরো অবস্থায়, তখন ওকে বজ্জাতগুলো ফুটপাথে বসিয়ে দিল। ছেলেটি এসে সেই অবস্থা দেখে তাকে রিকশো করে হসপিটালে নিয়ে গেল। পথেই মারা গিয়েছিল।

শ্বাস ছেড়ে বলল–আপনার চেনা বলছেন, আপনি কেন–

–কি মুশকিল! আমি তো পরে সব শুনলুম। আমি অবশ্য খুব বেশি দূরে থাকি না। আমি থাকি ইলিয়ট রোড়ে, মেয়েটা থাকত ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে। কিন্তু ছেলেটা তো বোকা, আমাকে কিছু বলেনি। বললে তো

মনে পাপ ছিল, তাই বলেনি।

না! কর্নেল একটু হাসলেন। ব্যাপারটা তা নয়। ছেলেটার সঙ্গে মেয়েটার আলাপ রাস্তায়। পুলিশ মেয়েটাকে কলগার্ল বলে টানাটানি করছিল। ছেলেটা ব্যাপার দেখে এগিয়ে এসে নিজের বোন বলে পরিচয় দেয়। তা ছাড়া ছেলেটারও একটা পরিচয় ছিল। নামকরা ফুটবল প্লেয়ার। কাজেই পুলিস ওর খাতিরে মেয়েটাকে ছেড়ে দেয়। মেয়েটাকে পৌঁছে দিতে গিয়েই আলাপ হয়। তারপর ভাব-ভালবাসা হয় ক্রমশ।

গলার ভেতর ঘড়ঘড় করে বলল–কী নাম ছিল মেয়েটার?

–চন্দ্রা।

–চন্দ্রা? নিষ্পলক চোখে তাকাল। ফোঁস করে নাক ঝেড়ে বলল ফের– ছেলেটার?

–তার নাম শুনে থাকবেন। কাগজে রোজ বেরুচ্ছে। স্বপন অধিকারী, ইলেভেন টাইগার্স ক্লাবের সেন্টার ফরোয়ার্ডে খেলে। খুব তেজী ছেলে। তেমনি সাহসী? সেজন্য তারও খুব ভোগান্তি গেছে।

–আপনার নামটা কী স্যার?

কর্নেল এন. সরকার। কর্নেল দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আমি স্বপনকে চিনতুম। স্বপন আমাকে একদিন চন্দ্রার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। নিউ, মার্কেটের কাছে। তার বহুদিন পরে স্বপনের সঙ্গে আবার দেখা হল। ওকে চন্দ্রার কথা জিজ্ঞেস করলুম। ও বুক ফেটে কেঁদে উঠল। আমি তো অবাক।

–স্বপন কাঁদল?

–হ্যাঁ। খুব আঘাত পেয়েছিল। আমার ধারণা পরে যে ও লোককে মারধর আর হাঙ্গামা করে বেড়িয়েছে, তা একটা রি-অ্যাকশান-বুঝলেন? প্রচণ্ড ক্ষোভ। মানুষের ওপর আর বিশ্বাস করতে পারছিল না। আপনিই বলুন না, আমি বা আপনি যদি যুবক হতুম, কী করতুম?

–আঃ। লোকটা আবার নাক ঝাড়ল। ধরা গলায় বলল–এমন হয় সংসারে!

–আসলে স্বপনকে যতটা জানি, বরাবর অন্যায়ের প্রতিবাদ না করে পারে না। সেজন্যই মাঝখান থেকে ওর একটা বছর খেলোয়াড় জীবন বরবাদ হয়েছিল। ওর ক্লাবের ফুটবল-কোচ অমর্ত্য রায়কে চন্দ্রার জন্যই বেদম পিটিয়েছিল। অমর্ত্য লোকটা ছিল প্রচণ্ড লম্পট। মার খেয়ে অমর্ত্য স্বপনকে ক্লাব থেকে শুধু বের করে দিল না, ফেডারেশন থেকেও ওর বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাস করিয়ে আনল। ফলে কোনো বড় ক্লাবে ওর খেলার উপায় রইল না। কাগজে পড়েছি অমর্ত্যবাবুকে কে খুন করেছে। আপনি জেনে রাখুন, মেয়েঘটিত ব্যাপারেই খুন হয়েছে লোকটা। …লিন্ডা! লিন্ডা! ডোন্ট ডু দ্যাট! কাম হেয়ার! ও নটি গার্ল!

লোকটা মুখ নামিয়ে বসে আছে। চোখ দুটো বন্ধ।

কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। চলি ব্রাদার! মেয়েটা বড্ড দুষ্টুমি করছে।

কর্নেল লিন্ডার হাত ধরে টানলেন। কুকুরটাকে কাঁধে নিলেন। রাস্তায় উঠে একবার ঘুরে দেখলেন, শিবশংকর গুপ্ত তেমনি ভঙ্গিতে বসে আছেন মমির মতো…

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress