নিশুতি রাতের ডাক : 11
বিকেলে কর্নেল ছাদে গেছেন। কিন্তু তার প্রকৃতিজগতে ঢুকতে পারছেন না–মনে অস্থিরতা। সারাটা দিন প্রতীক্ষায় কেটে গেল। অরিজিৎ এলেন না। ওঁর দোষ নেই। প্রশাসনের হালচালই এই। ঘরে আগুন লেগেছে–ফাইলে নোট পাঠিয়ে এ-টেবিল থেকে সে-টেবিল ঘুরে কর্তার কাছে এবং কর্তার কাছ থেকে ফিরতে ফিরতে সব পুড়ে ছাই। কর্তা এক বছর ধরে লিখেছেন, দমকল ডাকো..হু, এই হল অবস্থা। নিজেদের জীবনে, কাজকর্মে এতটুকু আইন মানার তাগিদ নেই। অন্যের বেলা চুলচেরা হিসেব করে আইন মানা হয়েছে কি না সেই নিয়ে গবেষকদেরও হার মানানোর চূড়ান্ত নজির।
পাঁচটায় ষষ্ঠী দৌড়ে এল ছাদে। নালবাজারের নাহিড়িসায়েব, বাবামশাই!
–স্বপন কোথায়?
–ডাইনিং ঘরে টিভি দেখছেন দাদাবাবু! আজ ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের খেলা না?
হুঁ, টিভি বন্ধ করতে বলিসনি?
না তো! বলছি গিয়ে। ষষ্ঠী পা বাড়াল।
কর্নেল ধমক দিয়ে বললেন–থাম হতচ্ছাড়া। দৌড়োস নে বুনো গাধার মতো।
ষষ্ঠী পেছনে নামতে নামতে বলল–গাধাও কি বুনো হয় বাবামশাই?
–হয়। কচ্ছ এলাকার রানে বুনো গাধা আছে। তোর মতো দৌড়ায়।
কর্নেল ড্রয়িংরুমে ঢুকে লক্ষ্য করলেন অরিজিৎ মিটিমিটি হাসছেন। বললেন– আজ সারাদিন আপনার জন্য ঘোরাঘুরি করে ভীষণ টায়ার্ড। তবে শেষ পর্যন্ত আপনাকে খুশি করতে পেরেছি। এভরিথিং ওক্কে। সন্ধ্যা ছটায় কমিশনার সায়েব প্রেস কনফারেন্স ডেকেছেন। কাজেই বেশিক্ষণ বসব না।
–ইলেভেন টাইগার্সের কর্মকর্তারা কী বললেন?
–অধিকাংশের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা রাজি! কেউ কেউ খুবই রাজি। তারা স্বপনের প্রচণ্ড ফ্যান। অমর্তের জন্য মুখ খোলেননি এতকাল। তবে একটু দেরি হবে। মানে দুতিনটে দিন। বিশেষ জরুরি মিটিং ডেকে স্বপনের ব্যাপারে একটা ফর্মাল প্রস্তাব পাস করানোর ওয়াস্তা শুধু। অবশ্য স্বপন ইচ্ছে করলে কাল থেকে ক্লাবে যেতে পারে। এতে কারুর আপত্তি নেই। আর ফুটবল ফেডারেশনে অমর্ত্যবাবু স্বপনের নামে যে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রেখে গেছেন, সেটার জন্যও ক্লাব মুভ করবে। তারপর সব খেলাতেই স্বপনের যোগ দিতে আর বাধা থাকবে না। –আই মিন, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের খেলায়।
–অসংখ্য ধন্যবাদ, ডার্লিং! কী বলে যে তোমাকে
কর্নেলের গলা ধরে এল। স্বপনের জন্য বৃদ্ধের এত ভাবাবেগ কেন? অরিজিৎ চোখে ঝিলিক তুলে বললেন–টিভির শোরগোল শুনছি আসা অব্দি। আজ বড় খেলা আছে। কে টিভি দেখছে কর্নেল?
আবার কে? ষষ্ঠী। কর্নেল হাসলেন। ও আবার মোহনবাগানের সাপোর্টার।
অরিজিৎ উচ্চহাস্য করে বললেন-কর্নেল! আমি ডিটেকটিভ ডিপার্টের লোক। তা ছাড়া আপনার সঙ্গ গুণে আমিও ডিটেকটিভ পদ্ধতি ফলো করতে অভ্যস্ত হয়েছি। স্বপনকে ডাকুন। আলাপ করে যাই।
কর্নেল হাসিতে গলা মেলালেন। তারপর উঠে গিয়ে স্বপনকে ডেকে নিয়ে এলেন–আলাপ করিয়ে দিই। ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ী। এখন তোমার হিতৈষী বন্ধু।
অরিজিৎ হাত বাড়িয়ে বললেন–আসুন স্বপনবাবু! এখন আপনি একজন মুক্ত মানুষ। কাজেই সংকোচের কারণ নেই। আমার পাশে বসুন।
স্বপন বসল। মুখে উদ্বেগের ছাপ। কর্নেল বললেন কাল থেকে তুমি আবার মাঠে যাচ্ছ। ইলেভেন টাইগার্সের অন্যতম টাইগার হয়ে উঠতে জাস্ট দুতিনটে দিন। নতুন করে জীবন শুরু কর, ডার্লিং!
স্বপন তাকাল। সে বিশ্বাস করতে পারছিল না। অরিজিৎ তার কাঁধে হাত রেখে বললেন–হ্যাঁ, স্বপনবাবু! আমরা আপনার নামে সব কেস উইথড্র করছি। কালকের কাগজে দেখতে পাবেন। শুধু একটাই অনুরোধ আপনার কাছে কর্নেলের এবং আমার মুখ যেন রাখবেন ভাইটি। আপনি ছিলেন প্রমিজিং প্লেয়ার। আমরা দেখতে চাই, আপনি দেশের একজন শ্রেষ্ঠ ফুটবলার হয়েছেন। আপনাকে যাতে সবরকমের সাহায্য দেওয়া হয়, আমি সেদিকে লক্ষ্য রাখব। মনপ্রাণ দিয়ে আবার প্র্যাকটিশ শুরু করুন দুবেলা। ওঁদের নতুন কোচ আসছেন দিলীপ দেশাই। আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান কোচ।
স্বপনের ঠোঁট কাঁপছিল। প্রচণ্ড আবেগে তার চোখ ছলছল করে উঠেছিল। হঠাৎ সে দুহাতে মুখ ঢেকে ঝুঁকে পড়ল। সামলাতে পারল না নিজেকে। কর্নেল তার পিঠে হাত রাখলেন।
অরিজিৎ বললেন–আমি উঠি, কর্নেল! ছটায় প্রেস কনফারেন্স সি.পি.র ঘরে! আমাকেও থাকতে হবে। স্বপনবাবু, উইশ ইউ গুড লাক!
দশটা বছর ধরে একটু একটু করে যে দুঃখ, লোভ, আর ব্যর্থ ক্রোধ মনের মধ্যে জমে উঠেছিল, শিবশংকর হঠাৎ একদিন টের পেয়েছিলেন, তার প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটতে চলেছে। তখন যদি হাতের হাতুড়িটার দিকে ঘুরে না তাকাতেন, সেই বিস্ফোরণের চাপে তিনি নিজেই শেষ হয়ে যেতেন। হাতুড়িটা মুঠোয় ধরে তিনি ভেবেছিলেন, এই মুহূর্তে একটা কিছু করার সময় হয়েছে। নিজেকে বাঁচানোর জন্যই।
আসলে তার মানসিক প্রকৃতিতে চিরাচরিত আলস্যের গড়িমসি, ঝটপট কোনো সিদ্ধান্ত করতে পারেন না। তার হাঁটাচলা, তার কথা বলা এবং তার শারীরিক ভঙ্গিমার মতোই এক বহুব্যাপক শৈথিল্য ও দীর্ঘসূত্রিতার করায়ত্ত তিনি। আদালতে যেদিন মৃদুলার সঙ্গে তার চূড়ান্ত বিচ্ছেদ ঘটে গেল, সেদিন তিনি বারান্দায় চুপচাপ স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে আছেন এবং তার উকিল এসে বললেন–মেয়ে আপনার কাছে থাকতে চায়, অথচ তার মা তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। আপনি আটকান মেয়েকে। আইনত আপনিই মেয়েকে কাছে রাখতে পারেন। চলুন!
শিবশংকর শুধু চোখে চোখে তাকিয়ে রইলেন। কী বলবেন ভেবেই পেলেন না। একটু পরে আস্তে আস্তে হেঁটে রাস্তায় নামলেন। এখনও মনে পড়ে, হঠাৎ কি একটা মুক্তির হাওয়া এসে ঝাঁপটা মেরেছিল তাঁকে। আর তাকে স্ত্রীর পেছনে গোয়েন্দাগিরি করতে হবে না। অপালাকেও নষ্ট করে ফেলবে এই ভয়ে সব সময় তাকে আগলে রাখতে হবে না। ঝগড়াঝাটি হবে না। ভরণপোষণের দায়দায়িত্ব বইতে হবে না। যেখানে খুশি নিরুদ্বেগে ঘুরে বেড়াতে পারবেন। সত্যিই তো এ এক বিরাট মুক্তি!
অথচ মুক্তি পেলেন কই? মৃদুলা বলতেন–খালি কুচুটে স্বভাব। ছেক ছোঁক করে অন্যের পেছনে আড়ালে আড়ালে ঘুরে বেড়ানো–গোয়েন্দাগিরি। কোথায় পাপ? যত পাপ তো তোমার নিজের চোখে। আর খালি খুঁচিয়ে ঘা করার অভ্যাস! নিজের জ্বালায় নিজেই জ্বলে মরছ তুমি! আগে নিজেকে শুদ্ধ কর। তারপর অন্যকে শুদ্ধ করতে এস। ….ঠিক তাও নয়। শিবশংকর এখন। বুঝতে পারেন, তাঁকে ঈশ্বর যেন এমন একটা দৃষ্টি দিয়েছেন জন্মকাল থেকে, যা তাকে খারাপ জিনিসগুলোকেই বেশি করে দেখিয়ে দেয়। অন্য মানুষের এই দৃষ্টিশক্তিটা নেই। তারা ভাল-খারাপের পার্থক্য তাই করতে পারে না। শিবশংকর মুক্তি পেয়েও তাই নিশ্চিন্ত হতে পারেননি। মৃদুলা আরও কতটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে এবং মেয়েকেও কতখানি খারাপের দিকে ঠেলে দিচ্ছে তা দেখার জন্য ছটফট করেছিলেন।
অমিয় বক্সী তখন থাকতেন শ্যামবাজারে। মৃদুলাকে তিনি বিয়ে করলেন মৃদুলারও একটা আশ্রয় দরকার ছিল। কোথায় দাঁড়াবে নির্বোধ স্ত্রীলোক? ওদের বাড়ির পাশেই একটা ছোট বা তৈরির কারখানায় কাজ যোগাড় করেছিলেন শিবশংকর। দোতলা কারখানা বাড়িটার ওপরের জানলা থেকে নিচে অমিয়র জানলা চোখে পড়ত। ছোট একটা বাইনোকুলার কিনে এনেছিলেন শিবশংকর। চোখে রেখে খুঁটিয়ে কীর্তিকলাপ দেখতেন। দুঃখে, ক্ষোভে, রাগে ছটফট করতেন। কিন্তু কীই বা করতে পারেন? তিনি সামান্য মিস্তিরি মানুষ। অমিয় বক্সী সুশিক্ষিত ভদ্রলোক। পাড়ায় তার সম্মান। সদ্য সিনেমা করে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠেছেন অমিয়। কী করতে পারতেন ইলেকট্রিক মিস্তিরি?
আঃ! তখনও তার হাতে হাতুড়ি ছিল। অথচ তার অস্তিত্বটাই যেন নিঃসাড় হয়ে গিয়েছিল। টের পেতেন না করুণাময় ঈশ্বর তাঁর হাতেই পাপীদের বিচারের জন্য একটি ন্যায়দণ্ড তুলে দিয়েছেন। সাতটা বছর কি অদ্ভুত অবচেতন, নিষ্ক্রিয় আর আলস্যজড়িত জীবনধারণ করেছেন শিবশংকর। প্রতি মুহূর্তে বিষের জ্বালায় জ্বলেছেন। আর প্রতি মুহূর্তে খালি মনে হয়েছে তিনি এত অসহায়, এত দুর্বল!
হু, অপালা পালিয়ে গেল খুব আনন্দ হয়েছিল–যেমন আনন্দ হয়েছিল মৃদুলার মৃতদেহ মর্গে নিয়ে যাওয়া দেখে! মায়ের আত্মহত্যার পর অপালার না পালিয়ে উপায় ছিল না। জানোয়ারটা তখন তাকে নির্বিবাদে একা পেয়ে গিয়েছিল। অস্থির শিবশংকর একবার অমিয়র ঘরের দরজায় পর্যন্ত এসে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু আর সাহস পাননি। পাছে তাকে চোর ভেবে লোকেরা তাড়া করে, তাই পালিয়ে এসেছিলেন। ভেতরে অপালার কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। এখনও কথাটা মনে পড়লে নিজেকে গাল দিয়ে বলেন, ধিক শিবু! শত ধিক তোকে! তুই না বাপ? অমন করে নিজের প্রাণের ভয়ে পালিয়ে এলি! তোর মরণ হয় না রে হতচ্ছাড়া?
না, মরণ হয়নি, নিজেকে অক্ষমতার দায়ে দায়ী করে মেরে ফেলেননি বলেই তো পাপীদের পাপের চরম দণ্ড দিতে পেরেছেন শিবশংকর! তিনি মরতেন, আর ওই নারকীরা বেঁচে থাকত–আরও কতজনের সর্বনাশ করত, এ কি হয়? হিন্দুসকার সমিতির গাড়িতে করে যেদিন অপালাকে নিয়ে যাচ্ছিল, সেদিন তিনি হাসপাতালের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে। ক্যারি সায়েব অপালাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার খবরটা দিয়েছিল। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ভাবছেন, অপালার কাছে তাকে যেতে দেবে তো? সেই সময় সকার সমিতির গাড়িটা বেরিয়ে গেল। স্বপনকে যেতে দেখেই বুঝলেন, অপালা বাঁচল এতদিনে।
আনমনে সেই মুহূর্তে কাঁধের ঝুলন্ত কিটব্যাগের ভেতর হাতটা নিজের অজান্তে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন–হয়তো একটা কিছু আঁকড়ে ধরতে চাইছিলেন। হাতুড়ির হাতলে হাত পড়তেই মুঠো করে ধরলেন। সঙ্গে সঙ্গে সারা শরীরে যেন বিদ্যুতের শক লাগল। শিউরে উঠলেন। মুঠো শক্ত হয়ে গেল। হা ঈশ্বর! এই তো ন্যায়দণ্ড দিয়েছ শিবু মিস্তিরিকে! কবে থেকে দিয়ে রেখেছ–বোকা, গোঁফখেজুরে, ভিতুর শিরোমণি শিবু এই মর্মই বুঝতে পারেনি।
শিবশংকরের শরীর শক্ত হয়ে গিয়েছিল। ঠোঁট কামড়ে ধরেছিলেন। চোখ দুটো জন্তুর মতো নিষ্পলক নীল হয়ে গিয়েছিল। ওই শিবু! কাজে লেগে যাও! ঈশ্বর তোমার দিকে তাকিয়ে আছেন, দেখছেন তুমি কী কর…
কিরণময়ী ডাকছিলেন–শিবুদা! ও শিবুদা!
শিবশংকর ধড়মড় করে উঠে বসলেন।
কিরণময়ী একটু হেসে বললেন–ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করছিলে দেখে ডাকলুম। শোবে তো শোও। মোটে পাঁচটা বাজে।
শিবশংকর আড়মোড়া দিলেন। আমি চারটে সাড়ে-চারটেতে উঠে পড়ি। আর শোব না। দেখ, একটু চা দিতে পারিস নাকি।
–কেটলি বসিয়েছি। আমি তো ছটার আগেই উঠে পড়ি। ওরা সব সাতটার আগে ওঠে না।
শিবশংকর বাথরুমে গেলেন। মুখোমুখি দেড়খানা করে ঘর, মধ্যিখানে উঠোন। দুটো পরিবার থাকে। উল্টোদিকের পরিবারটি নতুন ভাড়াটে। স্বামী আর স্ত্রী। সদ্য বিয়ে হয়েছে। গতকালও দেখেছেন ওরা বেলা করে ওঠে। উঠবেই তো! নতুন জীবন-যৌবন। প্রাণভরে স্বাদ নিচ্ছে। ঈশ্বর মানুষকে স্বাভাবিক ও ন্যায়সম্মত কত সুখ দিয়ে রেখেছেন। কত সামাজিক আনন্দের উপকরণ মানুষের জীবন! তবু মানুষ কেন পাপের ডাকে অস্বাভাবিক ও অন্যায় আনন্দ কুড়িয়ে নিতে ছুটে যায়। নিজের ক্ষতি করে, অন্যেরও ক্ষতি করে।
বাথরুমের কাজ শেষ করে উঠে দাঁড়াতেই ঘুলঘুলি চোখে পড়ল। এই এক অভ্যাস। পেছনে খাটাল। খাঁটিয়ায় একটি স্ত্রীলোক শুয়ে আছে। খোলা স্তনে গাল রেখে ঘুমোচ্ছে একটি শিশু। আহা রে! কি স্বর্গীয় দৃশ্য! তারিয়ে তারিয়ে দেখতে থাকলেন। তার মরদ চা আনতে গিয়েছিল। এসে ওঠাল বউকে হৈ! উঠ! উঠ! উঠ যা! চায় লেইলা বা।
খোলা আকাশের নিচে জীবনের অনাবিল আনন্দ। শিবু তুইও তো তাই চেয়েছিলি। এর একটুও কম-বেশি নয়। এইটুকুই। তোকে তা পেতে দেয়নি। আঃ! শিবশংকর নাক ঝাড়লেন! হাতমাটি করে বেরিয়ে এসে এক মগ জল চাইলেন কিরণময়ীকে।– পরে দাঁত ব্রাশ করব। কুলকুচো করে ধুয়ে নিই মুখটা। কি বলিস কিরণ? সপ্তাটাক ছুটি নিয়েছি। একটু অনিয়ম করি। সারাটা জীবন তো নিয়ম করে কাটালুম।
কিরণময়ী হাসলেন। আজ তোমায় একটু ফ্রেশ দেখাচ্ছে শিবুদা!
বলছিস?
–কিন্তু দাড়িটা কি রেখে দেবে ভাবছ?
–থাক না। বুড়োদের দাড়ি রাখা ভাল। চুলও থাক। খাঁটি সাধুসন্ন্যাসী তো হওয়া গেল না, নকল হই।
চা খেতে খেতে কিরণময়ী বললেন–আজ তুমি বাজার করবে শিবুদা। কাল তো দেখলে নন্টু অতগুলো টাকায় কী এনে দিলে! ছেলেমানুষ পেয়ে রোজ ওকে ঠকায়। কী করব? আমি ওসব পারি না যে।
শিবশংকর একটু হেসে বললেন–আমিও যে তাই! বুঝলে না? প্রায় সারা জীবন হোটেলে খেয়ে কাটাচ্ছি। ওই যা শুধু দশ বারোটা বছর। তাও বেশির ভাগ দিন হোটেলেই খেতে হয়েছে। তোমার বউদিকে তো মনে আছে। থিয়েটার আর সিনেমা নিয়েই আজ একবার ভাবছি ব্রজদাকে দেখতে যাব। চা খেয়েই না হয় বেরিয়ে পড়ি। নইলে অফিসে বেরিয়ে যাবে।
–ব্রজদার নতুন ঠিকানা জান–যাবে যে?
–সে বাসায় নেই বুঝি?
–না। গড়পারের ওদিকে যেন কোথায় থাকে এখন।
–সে আমি খুঁজে বের করব। গড়পার রোডে আমার অফিসের একজন
বাজার করতে বলে বড় বিপদে ফেলেছে কিরণ। পরশু রাতে এসেছেন। কাল দিনমান শুয়ে কাটিয়েছেন। আজ একবার বেরুতেই হবে। এখন অবশ্য রাস্তায় লোকজন কম। কোথাও নিরিবিলি বসে থাকবেন বলে এলেন, দুপুরে বাইরে খেয়ে নেবেন। গলিটা পেরিয়েই বড় রাস্তার বাসস্টপ। ছটা বেজেছে। বাস আসতেই উঠে পড়লেন। কাঁধে ব্যাগটা নিতে ভোলেননি! বলা যায় না, কখন কী ঘটে যায়।
বাসে সকালের শিফটের কারখানাকর্মীদের সামান্য ভিড়। কিছু স্কুলের দিদিমণি, খোকাখুকুরা। চোখ ভরে দেখতে গেলেন শিবশংকর। মনে মনে বললেন, বেঁচেবর্তে থাক সব। ভাল থাক। পাপ যেন তোমাদের ছুঁতে পারে না। একটা বাচ্চার হাত ধরে আদরও করলেন। বাচ্চাটা মায়ের শরীরে মিশে গিয়ে প্যাট প্যাট করে তাকে দেখতে থাকল।
এসপ্ল্যানেডে এসে তড়াক করে উঠে নেমে এলেন শিবশংকর। এখনও বিশেষ লোকজন নেই। অসংখ্য হকার খবরের কাগজ গোছাচ্ছে মোড়ের ওধারে। একটা দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা কিনে ব্যাগে ঢুকিয়ে হাঁটতে থাকলেন হনহনিয়ে। গঙ্গার ধারে গিয়ে বসে থাকবেন। আঃ কতকাল গঙ্গাদর্শন হয়নি!
সতর্কতা সব সময় তার চোখের কোনায় তৈরি। তবে তার একটা বড় সুবিধে, খুব কম লোক তাকে চেনে। জীবনে মুখচোরা স্বভাবের জন্য বিশেষ মেলামেশা করেননি বড় একটা। তবে যারা তাঁকে চেনে, তাদের নিয়ে মাথাব্যাথা নেই–যতক্ষণ না কাগজে তার নামে কিছু বেরোচ্ছে। তিনি নিশ্চিন্ত যে পুলিস তাকে দেখলে চিনতে পারবে না। তার কোনো ছবি ওরা পাবে কোথায়? বহু আগে দুই একটা তুলিয়েছিলেন। কোথায় নষ্ট হয়ে গেছে তার সংসারের ধ্বংসস্তূপে।
হু। এক যদি স্টুডিও মহলের কেউ দেখে ফেলে। তবে তার চান্স একেবারে কম। দেখলেই তো আর তারা তাকে চেপে ধরে পুলিস! পুলিস! বলে চেঁচাবে না। যাবার সময় যথেষ্ট পাবেন।
গঙ্গার ধারে একটা বেঞ্চে বসে কাগজটা খুললেন শিবশংকর। খুলেই একটু চমকে উঠলেন। প্রথম পাতায় বক্স করে বোল্ড টাইপে খবর, পাশে স্বপনের প্রোফাইল।
ফুটবলার মুক্ত
স্টাফ রিপোর্টারঃ ইলেভেন টাইগার্সের প্রাক্তন ফুটবলার স্বপন অধিকারীর বিরুদ্ধে সমস্ত অভিযোগ পুলিস প্রত্যাহার করে নিয়েছে। আজ এক সাংবাদিক সম্মেলনে পুলিস কমিশনার এই খবর দিয়ে জানান, স্বপনকে ভুলক্রমে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। সে একজন প্রতিশ্রুতিবান ফুটবলার। তার খেলোয়াড় জীবনে ঘটনাচক্রে এবং কোনো-কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের চক্রান্তে এক বছর ছেদ পড়েছিল। কমিশনার এজন্য দুঃখ ও সহানুভূতি প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আশাকরি, অভিযোগমুক্ত স্বপন আবার ফুটবলের জগতে ফিরে যাবে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সাংবাদিক সম্মেলনের পর গভীর রাত্রে আমরা একটি গোপন স্থানে স্বপনের সাক্ষাৎকার নিতে যাই। স্বপন বলেন, তিনি তার পুরনো দলেই ফিরে যেতে ইচ্ছুক। তবে সেটা নির্ভর করছে ক্লাবের কর্মকর্তাদের ওপর। আগামীকালই তিনি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে যাবেন। স্বপনের মাথায় ব্যান্ডেজ দেখে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, বাস থেকে পড়ে গিয়ে সম্প্রতি আহত হয়েছিলেন। তবে ক্ষত সামান্য। ইতিমধ্যে সেরে গেছে। খেলার অভ্যাসের প্রশ্নে স্বপন বলেন, একটু জড়তা আসবে। তবে কয়েকদিনের প্র্যাকটিসে কাটিয়ে ফেলতে পারবেন।
শিবশংকরের দৃষ্টিশক্তি এ বয়সেও পরিষ্কার। চশমা নিতে হয় না। বার বার পড়লেন খবরটা। তার দুটো চোখ নিস্পলক আর উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল ক্রমশ। কাগজটা ভাজ করে এদিক-ওদিক তাকালেন। সকালের রোদে চারদিক ঝলমল করছে। গঙ্গায় একটা বড় জাহাজ নোঙর করে আছে। কয়েকটা লঞ্চ, ট্রলার, এক ঝাঁক নৌকো ছবির মতো স্থির। মা অপালা, লক্ষ্য রাখিস স্বর্গ থেকে।
উঠে আস্তে আস্তে হেঁটে চললেন বাবুঘাটের দিকে! কিছু খেয়ে নেবেন। আর ফিরে যাবেন না কিরণের বাসায়! গঙ্গার ধারেই আপাতত আস্তানা। এখান থেকে ফোর্ট উইলিয়ামের উত্তরের মাঠ হয়ে গেলে ইলেভেন টাইগার্সের টেন্ট এবং স্টেডিয়াম নাক বরাবর এক কিলোমিটারও নয়। ওই তো দেখা যাচ্ছে গাছপালার আড়ালে। ঘাটের মাথায় ধর্মশালায় রাতের আস্তানা মন্দ হবে না। তার মতো কত মূলছাড়া ভাসমান মানুষ এইভাবে বেঁচে আছে।
আনমনে ব্যাগে হাত ভরে ন্যায়দণ্ডটা এবার ছুঁলেন শিবশংকর!
ড্রইংরুমে অ্যাডভোকেট হরিসাধন দত্তকে বসিয়ে রেখে ষষ্ঠী ছাদে খবর দিতে গিয়েছিল কর্নেলকে। বিকেলের নরম আলোয় উদ্ভিদ জগতকে বিষণ্ণ দেখছিলেন যেন। কদিন থেকে এই একটা ব্যাপার হচ্ছে। মরুপ্রজাপতি দম্পতিকেও কেমন নির্জীব দেখাচ্ছে যেন। নিজেরই মনের প্রতিফলন। একটা দ্বিধা ক্রমশ চেপে বসছে। আইনের হাত যেখানে পৌঁছুতে পারে না, সেখানে হয়তো স্বয়ং ঈশ্বরের হাতই পৌঁছয়। ভুল করছেন না তো? জীবনে, অসংখ্য নির্মম হত্যাকারীকে গভীর অন্ধকারের রহস্যজাল ছিঁড়ে খুঁজে বের করেছেন। তৃপ্তি পেয়েছেন। প্রচ্ছন্ন অহঙ্কার জেগেছে মনে। কিন্তু এই কেসে বার বার তার মনে হচ্ছে, ভুল করছেন না তো?
পকেট থেকে আবার অপালার কচি মুখের ছবিটা বের করলেন। সীমন্তকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছেন। ছবিটা বিকেলের ম্লান আলোয় দেখতে দেখতে আবার মনে হল, ভুল করছেন। কেন শিবশংকরকে নিয়ে তার মাথা ব্যথা। পুলিস তাকে খুঁজে বের করুক। কেন তিনি তাকে ফাঁদে ফেলার চক্রান্ত করে বসলেন?
হু–স্বপনের জন্য। স্বপনকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। শিবশংকর ধরা না পড়লে এবং তাঁর শাস্তি না হলে স্বপন নিরাপদ নয়।
হঠাৎ মনে হল, যদি শিবশংকরকে খুঁজে বের করতে পারেন, তাকে সব কথা বুঝিয়ে বলেন, তাহলে কি তাঁকে নিবৃত্ত করা যাবে না? শিবশংকর তো আসলে একটা মানবিক মূল্যবোধের তাগিদেই হত্যাকারী হয়ে উঠেছেন হতে বাধ্য হয়েছেন। মানবিক মূল্যবোধ ছাড়া আর কী? স্ত্রী এবং কন্যার শোচনীয় পরিণতি দেখে তার বিচলিত হওয়ার কারণ তো ভালবাসা, স্নেহ মমতাবোধ, যা কিনা মানুষের শ্রেষ্ঠ মূল্যবোধ। উচ্চতম আদর্শ। সর্বকালে, সর্বসমাজে।
চঞ্চল হয়ে উঠলেন। যেভাবে হোক, শিবশংকরকে খুঁজে বের করতেই হবে। তার মন থেকে স্বপনের বিরুদ্ধে ভ্রান্ত ধারণা মুছে দিতে হবে। তারপর
আপাততঃ পরের কথা ভেবে লাভ নেই। আগে শিবশঙ্করকে খুঁজে বের করা দরকার। ছবিটা পকেটে ঢুকিয়ে চুরুট ধরালেন কর্নেল।
সেই সময় ষষ্ঠী এসে খবর দিল, কালো কোটপরা পেল্লায় এক ভদ্রলোক এসেছেন। কর্নেল শান্তভাবে নেমে গেলেন। ডাইনিং রুমে স্বপন টিভি দেখছে। আগামীকাল থেকে সে ক্লাবে যাবে।
কর্নেলকে দেখে অ্যাডভোকেট দত্ত উঠে দাঁড়ালেন–গুড আফটারনুন কর্নেল স্যার!
কর্নেল বললেন–রেজাল্ট বলুন মিঃ দত্ত।
মিঃ দত্ত কপালের ঘাম মুছে বললেন–ওঃ দশ বছরের পুরনো কোর্ট ডকমেন্ট খুঁজে বের করা কি সহজ কথা? আর কিছুদিন হলেই মহাফেজখানায় চলে যেত। তবে ভাববেন না। পেয়েছি। রায়ের কপি এনেছি। এই দেখুন।
কর্নেল দলিলটা নিয়ে বললেন–অসংখ্য ধন্যবাদ মিঃ দত্ত।
–আপনার সেবা করতে পারলেই খুশি, স্যার! মিঃ দত্ত পান এবং পোকায় খাওয়া লাল কালো দাঁতে হাসলেন। তবে এ অন্য কেউ পারত না। ডিভোর্স স্যুট আমার একমাত্র প্রফেশনা বলেই পারলুম! তার চেয়ে বড় কথা, এই কেসে আমিই ছিলুম অ্যাপ্লিকেন্টের ল-ইয়ার।
ষষ্ঠীকে ডেকে কফিদিতে বলে কর্নেল দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিলেন। তারপর বললেন–আপনিই মিসেস মৃদুলা গুপ্তের পক্ষে ছিলেন?
মিঃ দত্ত মাতৃভাষায় বললেন–হঃ, কৈলাম না, আমি স্পেশালিস্ট? যহন কৈলেন, তহন কিন্তু এক্কেবারে মনে আসছিল না। বুঝলেন না? মাথার ভেতরটা ডিভোর্সে-ডিভোর্সে চার্জড হইয়া গেছে বেবাক! এই প্রফেশনের বিশ বছরে অ্যাট লিস্ট বিশ হাজার ক্যাস তো করছি।
খ্যা খ্যা করে হাসতে লাগলেন আইনজীবী। ষষ্ঠী কফি আনল ঝটপট। কালো কোটপরা লোকটার প্রতি কোনো কারণে সে অপ্রসন্ন। হয়তো নিছক কালো কোটের জন্যই। চটজলদি বিদায় হলে তার অস্বস্তিটা কেটে যায়।
সে ইচ্ছে করেই কফিটা ঠাণ্ডা এনেছে। জল ফুটে ওঠার আগে কফি দিয়েছে। মিঃ দত্ত তার ফাঁদে পা দিতে দেরি করলেন না। কয়েক চুমুকে শেষ করে পকেট থেকে বিল বের করলেন। বিলটা লন স্যার! পেমেন্ট যহন খুশি করেন। আমি উঠি।
কর্নেল বিলে চোখ বুলিয়ে অবাক হলেন। দুর্বোধ্য হস্তাক্ষরে অনেকগুলো আইটেম। মোট দুশো সাতান্ন টাকা পঁচানব্বই পয়সা মাত্র! শুধু একটা ঠিকানা জানার জন্য এত খরচ। বললেন–বসুন এক মিনিট।
ড্রয়ার থেকে চেকবই বের করে চেক লিখে দিলেন। মিঃ দত্ত বিগলিতভাবে উঠে দাঁড়ালেন।–পুরান ক্যাস, বুঝলেন না স্যার? ঘুষঘাষ দিয়া তবে না
থ্যাঙ্কস মিঃ দত্ত।
–যহনই দরকার হইব, জাস্ট এটু রিং করবেন। হেয়্যাই তো আমার কাজ, বুঝলেন না?……
ষষ্ঠী মুখিয়ে ছিল। দরজা বন্ধ করে এসে বলল-কালো জিনিস, বাবামশাই, মোটেও ভাল নয়। কালো কাক, কালো কোট
–তোর মাথাটাও তো কালো, বাবা!
ষষ্ঠী জিভ কেটে স্থানত্যাগ করল। কর্নেল আদালতের দলিল থেকে প্রতিবাদী শ্রীশিবশংকর গুপ্তের বাবার নাম আর ঠিকানাটা টুকে নিলেন। দশ বছর আগের ঠিকানা। নিশ্চয় ভাড়া বাড়ি। তবু একটা সূত্র তো। অন্ধকারে হাতড়ানোর চেয়ে এই সূত্রটা ধরে যতটা এগোনো যায়। দুর্ভাগ্যক্রমে অপালার এক্সারসাইজ খাতায় ওর স্কুলের নামের অংশটা ছেঁড়া। নইলে স্কুলের সূত্রে এই ঠিকানাটা পাওয়া যেত বিনা খরচেই।
কর্নেল ঘড়ি দেখলেন। সাড়ে পাঁচটা বাজে। এখনই একবার ঘুরে আসবেন?
এদেশে গাড়িওলা মানুষ মানেই বড়লোক। তার প্রতি জনসাধারণের মোহ প্রবল-অবচেতন ঈর্ষা সত্ত্বেও। তাতে যদি চেহারা, পোশাক ও ব্যক্তিত্বে। সায়েবের আদল থাকে তো কথাই নেই। অসংখ্য সাহায্যের হাত এগিয়ে আসে। নকড়ি দত্ত লেনে কর্নেলের লাল ল্যান্ডমাস্টার ঘিরে ভিড় জমে উঠতে দেরি হল না। বাড়িটা তখন একতলা ছিল। এখন দোতলা হয়েছে। ওপর তলায় বাড়িওয়ালা বাস করছেন। জানা গেল, শিবশংকর বাসা ছেড়ে যাবার সময় জানিয়েও যাননি। জিনিসপত্র কিছু ছিল না। সব নাকি বেচে এবং বিলিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন।
তার আত্মীয়স্বজন সম্পর্কে কেউ কিছু জানেন কি? উৎসাহী লোকেরা আশেপাশে দস্তুরমতো অভিযানে নেমে গেল। তারপর টেনে নিয়ে এল একটা মধ্যবয়সী লোককে। সে নমস্কার করে বলল–শিবুদা এ বাসা ছেড়ে হাতিবাগানের ওখানে মেসে উঠেছিল।
–মেসটা চেনেন?
–চিনি। শিবুদার সঙ্গে একদিন গিয়েছিলুম। মেসটাও হয়তো আর নেই। সাত-আট বছর আগের কথা। তবে শিবুদার মাসতুতো বোন আছে ভবা পাগলা। লেনে। সে যদি বলতে পারে, পারবে।
–আপনি একটু নিয়ে যাবেন সেখানে?
লোকটার সঙ্গে সঙ্গে রাজি। গাড়িতে উঠে সে বলল–শিবুদা বড় একটা মিশত না কারুর সঙ্গে। শুধু আমার সঙ্গে মেলামেশা করত। কখনও কখনও আমাকে দিয়ে এটা-ওটা কিনে পাঠাত বোনকে। আমি দিয়ে আসতুম। বোনের অবস্থা ভাল ছিল না।
গলির পর গলির গোলকধাঁধা। তারপর লোডশেডিং। কর্নেলের প্রশ্নে লোকটা নিজের পরিচয় দিয়ে বলল–আস্তে স্যার, আমার নাম বনবিহারী দাশ।
বনবিহারী দাশ! কর্নেল চমকে উঠে তাকালেন। বেঁটে, একটু খুঁজো, শীর্ণকায় মানুষটি। পরনে যেমন তেমন একটা প্যান্ট হাওয়াইশার্ট। কর্মীর আদল মুখে ফুটে আছে। জীবনসংগ্রামে বিপর্যস্ত, অথচ শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত সংগ্রামের আশা করে বেঁচে আছে।
–আজ্ঞে স্যার। শিবুদাই হাতে ধরে কাজ শিখিয়েছিল আমাকে। নইলে কী করতুম বলুন? আপনাদের আশীর্বাদে একটা ডেকরেটার কোম্পানিতে কাজ করছি এখন। বাল্ব কোম্পানিটা চলেনি।
বাড়িতে কে আছে।
–তা আজ্ঞে স্যার, ফ্যামিলি-মেম্বার অনেক। দুই ছেলে চার মেয়ে। তারপর ধরুন, ওয়াইফ। একটা ভাই আছে। হায়ার সেকেন্ডারি পর্যন্ত পড়ে বসে আছে। এদিকে বুড়ো বাবা-মা।…বলে সে ঘুরল। ড্যাসবোর্ডের ক্ষীণ আলোয় তার কাচুমাচু মুখের করুণ হাসিটা অস্পষ্ট হয়ে ভাসছে। আমার ভাইয়ের জন্য একটা কাজ জুটিয়ে দিন না স্যার!
কর্নেল আস্তে বললেন–দেখব।
বনবিহারী উৎসাহী হয়ে বলল–তাহলে অ্যাড্রেসটা কাইন্ডলি লিখে দেবেন? ভাইকে পাঠাব।
কর্নেল বাঁ হাতে পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে দিলেন। কাজ জুটিয়ে দিতে পারবেন কি না, সে কথা এ মুহূর্তে তার মাথায় নেই। শুধু ভাবছেন, শিবশংকর বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছিল এই বেচারাকে? যদি তার আসল নাম উদ্ধার না করা যেত, করার সম্ভাবনাও ছিল না অপালার এক্সারসাইজ খাতাটা না পেলে তাহলে পুলিস এক বনবিহারী দাশকে খুঁজে বের করার জন্য উঠে পড়ে লাগত। এই বনবিহারীও ইলেকট্রিসিয়ান। খামোকা কয়েকটা দিন তাকে ভোগান্তিতে ফেলা হত। সরলবাবু সনাক্ত করতে এসে বলতেন–এ সে লোক নয়। কিন্তু বনবিহারীর ওপর প্রথমে একবার সন্দেহ হয়েছে যখন, তখন সহজে বেচারা নিষ্কৃতি পেত না। ভোলাই খেত। তারপর নিষ্কৃতি পেত আধমরাটি হয়ে। পুলিসের পদ্ধতিই যে এরকম। মৃদুলা গুপ্তের ডিভোর্স মামলার নথি খোঁজার হাঙ্গামা বরদাস্ত করত কি না সন্দেহ। অন্তত এখনও অরিজিতের মুখ থেকে এ কথা শোনা যায়নি।
–এই বাড়ি স্যার! থামুন, থামুন!
অন্ধকারে ইতস্ততঃ হলুদ আলো। দরজায় কিরণময়ীর সেই মেয়েটা দাঁড়িয়ে রাস্তার কলে জল ভরছে। বনবিহারী গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে ঢুকল–দিদি! ও কিরণদিদি!
একটু পরে হেরিকেন হাতে এক প্রৌঢ়া এলেন। কর্নেল নমস্কার করে বললেন–আপনি শিবশংকরবাবুর বোন?
–আজ্ঞে। উনি আমার মাসতুতো দাদা।
–শিবশংকরবাবুকে ভীষণ দরকার। ওঁকে কোথায় পাব বলুন তো?
কিরণময়ী চঞ্চল হলেন। –শিবুদা? শিবুদা তো পরশু রাতে এসেছে। কাল ছিল। গতরাতেও ছিল। আজ সকালে গড়পারে যাচ্ছি বলে বেরিয়ে গেল তো গেলই। এখনও ফিরল না। ভাবনা হচ্ছে। গড়পারে ওদের ঠিকানাও জানি না যে খবর নেব।
বনবিহারী বলল–শিবুদা চিরকাল ওইরকম। হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে যাবে তো যাবে। দশ মাস দশ বছর পরে হঠাৎ এসে হাজির হবে।
কর্নেল বললেন–কোথায় এখন থাকেন, বলেননি কিছু?
কিরণময়ী বললেন–না। ক্লিয়ার করে কিছু বলেননি। একটু মুখচোরা মানুষ। কথাবার্তা কমই বলেন।
কর্নেল গাড়িতে স্টার্ট দিলেন। একটা সুতো ধরে এগিয়ে এসেছিলেন এতটা। হঠাৎ পট করে সুতোটা ছিঁড়ে গেল। আবার অন্ধকার। শুধু বুঝতে পারছেন, শিবশংকর কলকাতায় আছেন। অন্তত সকাল পর্যন্ত ছিলেন।