নিরুদ্দিষ্ট নাকফুল -3
নাকের ঘাঁ শুকোতেই শর্মিকে দেওয়া আমীর হোসেনের নাকফুল গিয়ে উঠল সোজা সাদেকা মামীর নাকে। সবাই উপহারটির খুবই প্রসংশা করল। খুব ছোট একটা কিউট জিনিস ছিল নাকফুলটা। মাঝখানে ক্ষুদ্রকায় একটা কাচ পাথর ঘিরে ছড়িয়ে পড়া ছোট ছোট বেলী ফুলের স্বর্ণ পাপড়ি। খুবই সামান্য ডিজাইন। সাদেকা মামীর ডিম্বাকৃতির ফর্সা মুখ আর টিকালো নাকে অসাধারাণ মানিয়ে গেল আমীর হোসেনের নাকফুল। নাকফুরটি পরে আয়নায় মুখ দেখে নাক ফোঁড়ানোর কষ্টের কথা ভুলে গেলেন সাদেকা মামী। এমনিতে আজহার মামা সাদেকা মামীর সাজসজ্জার দিকে তেমন খেয়াল দেন না। সেদিন রাতে বাসায় ফিরে সাদেকা মামীর দিকে অনেকক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থেকে হঠাৎ করে বললেন-
– সাদেকা তুমি আগে নাকফুল পরনি কেন ?
সবাই যখন নাকফুলটা ভীষণ মানিয়েছে বলে প্রশংসা করল সাদেকা মামী এত খুশি হলেন যে, আমীরকে টেলিফোনে বললেন আমীর ভাই বিকালে চা খেতে আসবেন আমাদের বাসায়। চা খেতে খেতে আজাহার মামা ঠাট্টা করে বললেন কি আমীর মিঞা নতুন চাকুরী পেয়ে মহিলাদের খুব নাকি গহনা বিলিয়ে বেড়াচ্ছ ? মেয়ে মহলে প্রিয়তা বাড়ানোর এটা একটা অব্যর্থ কৌশল বটে। কিন্তু টেকনিকটা খুব ব্যয়সাপেক্ষ। চালিয়ে যাও ভায়া। আজাহার মামার কথা শুনে আমীর হোসেন খুব লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে হাসছিল। লজ্জা পেলে আমীর ভাই বেকুবের মতো মাথা নিচু করে হাসত আর চোখ পিট পিট করত।
একদিন লুকিয়ে আমীর ভাইয়ের চিঠি পড়তে গিয়ে হাতে নাতে ধরা পড়ে গেলাম আম্মার কাছে। সেই চিঠি নিয়ে আম্মা তার ভাইয়ের কাছে কেঁদে লুটিয়ে পড়লেন।
– দ্যাখেন ভাইয়া শর্মি এসব কী করছে। আমার শর্মিরে আপনি বাঁচান ভাইয়া।
আম্মা আজাহার মামার পাশে বসে চোখে আঁচল চেপে হাউমাউ করে কেঁদে চলেছেন। আজাহার মামা খুব মনোযোগ দিয়ে আমীর হোসেনের চিঠিটা পড়লেন। তারপর আম্মার দিকে তাকিয়ে বললেন-
– তুই একটুও ভাবিস না রওশন। দ্যাখ কীভাবে আমি সব ঠিক করে দিই।
পরের দিন বিকাল বেলার ঘটনা। আজাহার মামার পরিমিত পানাহারের অভ্যেস। আজ বুঝি একটু বেশিই খেয়েছিলেন। ড্রিঙ্ক করে বোম হয়ে ড্রয়িংরুমে বসেছিলেন। কারো সাথে তিনি কথা বলছিলেন না। এই সময় দেখা গেল রিকশা থেকে নেমে গেট পেরিয়ে শর্মিদের বাসার দিকে হেঁটে আসছে আমীর হোসেন। জানালায় দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে আমীর হোসেন কে চলে যেতে ইশারা করছিল শর্মি। শর্মিকে আমীর হোসেন দেখতে পেল না। বসার ঘরে ঢুকে হাসতে হাসতে আজাহার মামাকে কিছু বলতে যাচ্ছিল। আজাহার মামা সোফা থেকে উঠে ঢুলতে ঢুলতে আমীরের সামনে চলে এলেন। জড়িয়ে যাওয়া কন্ঠে বিকট শব্দে গর্জে উঠলেন-
তুই আবার এসেছিস শুয়োরের বাচ্চা ?
আমীর হোসেন আজাহার মামার আকস্মিক আক্রমনে ঘাবড়ে গিয়ে ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে তাকিয়ে থাকে।
– বামন হয়ে চাঁদে হাত দিতে চাস শালা! তোর এত বড় সাহস আমার ভাগ্নীকে প্রেমপত্র লিখিস। সন অব আ বীচ !
আজাহার মামা আমীর হোসেনকে ক্রমাগত ধাক্কাচ্ছিলেন। ধাক্কাতে ধাক্কাতে দরজার ওপর ফেলে দিলেন। দরজায় চৌকাঠে আমীর হোসেনের মাথা ঠুকে গেল। আমীর ভাই কী বলবে বুঝতে পাচ্ছিল না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে বেকুবের মতো চোখ পিট পিট করছিল। মদাসক্ত আজাহার মামা উত্তেজনায় হাঁফাচ্ছেন। ফিরে গিয়ে সোফায় বসে পড়লেন। আবার উঠে এলেন। নেশার ঘোরে সব তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন। এসেই হঠাৎ আমীর হোসেনের পেটে ঝেড়ে লাথি মারলেন। আমীর হোসেন ছিটকে বারান্দার সিঁড়ি টপকে হুমড়ি খেয়ে উঠানে গিয়ে পড়ল। এক হাতে ভর দিয়ে উঠানের ধুলাবালির মধ্যেই মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ বসে রইল। আমীর হোসেন তখন হাঁপাচ্ছিল। একটু পর উঠে দাঁড়ালো। শার্টের খুট দিয়ে ঠোঁট থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত মুছে নিল। একবার এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো কেউ দেখছে কিনা। তারপর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গেটের কাছে গিয়ে একটা অটো থামিয়ে সেটায় উঠে পড়ল। পুরো ব্যাপারটাই খুব অল্প সময়ের মধ্যে বাড়ির সবার চোখের সামনে ঘটে গেল। বাড়ির সবাই আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে দেখেছিল। কেউ আজাহার মামার সামনে যাওয়ার সাহস পাচ্ছিল না।
পরের ঘটনা খুবই সংক্ষিপ্ত, খুবই দ্রুত। আজাহার মামা পূর্ণোদ্যমে তার আদরের বোনকে দেওয়া প্রতিশ্রুতিখানি কড়ায় গন্ডায় পালন করলেন। সপ্তাহ না ঘুরতেই শর্মির বিয়ের ব্যবস্থা পাকাপাকি হয়ে গেল। আজাহার মামার আমেরিকা প্রবাসী বিবাহযোগ্য এক বন্ধু পুত্রকে উড়িয়ে নিয়ে আসা হলো। উচ্চশিক্ষিত হ্যান্ডসাম বড় চাকুরে বর। শর্মি খুব লাকি, আত্মীয়জনরা একযোগে রায় দিলো। আজাহার মামা সিদ্ধান্ত নিলেন বিয়ের পর শর্মিকে আর ঢাকায় রাখার দরকার নেই। বরের সাথে আমেরিকায় চলে যাওয়াই ভালো। আজকালকার ছেলেদের দিয়ে বিশ্বাস নেই। আমীর হোসেন আবার কখন কী ঝামেলা বাধায় কে জানে।
শর্মির বিয়ের দিন দুপুরে পলাশ এসে আশেপাশে ঘুরঘুর করছিল। বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনের ভিড়ে কিছুতেই শর্মিকে একা পাওয়া যাচ্ছিল না। শর্মি বুঝতে পারছিল পলাশ কিছু বলতে চাইছে। একবার ওর আশপাশের ভিড়টা একটু হালকা হতেই শর্মি বারান্দায় চলে গেল। পলাশ শর্মির খুব কাছে এসে তরতর করে বলে গেল-
শালাকে কোথাও খুঁজে পেলাম না। ওর বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনের বাড়ি আর সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজ নিয়েছি। কোথাও যায়নি। মগবাজারে যে মেসটাতে থাকত ওখানকার বাসিন্দারা বলল আমীর হোসেন কোথায় চলে গেছে কেউ জানে না। ওর জিনিসপত্রও নাকি সব ওখানেই পড়ে আছে।
শর্মিদের এয়ারপোর্টে যাবার প্রস্তুতি চলছিল। শর্মি শাড়ি পড়ে যাবে নাকি সালোয়ার কামিজ পরবে এ নিয়ে আত্মীয়দের মধ্যে ডিবেট হচ্ছিল। কেউ বলছিল অনেক লম্বা প্লেন জার্নি শাড়ির চেয়ে সালোয়ার কামিজই বেশি কনভেনিয়েন্ট হবে। অন্যরা বলল বিয়ের পর বরের সাথে প্রথম বাইরে যাচ্ছে শাড়িই তো পড়া উচিত। শোবার ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আব্বুর ছবিটার দিকে তাকিয়েছিল শর্মি। সাদেকা মামী কাছে এসে জানতে চাইলেন-
– কীরে শর্মি, শাড়ি পড়বি নাকি সালোয়ার কামিজ ? নাকি জিনসের সাথে শার্ট ? বল আমি তোর কাপড় গুছিয়ে দিই।
শর্মি সাদেকা মামীর দিকে চেয়ে একটু হাসল। অন্য কেউ যেন শুনতে না পায় গলার স্বর এমনি নিচু করে বলল-
– আমার সবকিছু তো তোমরাই ঠিক করে দাও। এটাও না হয় তোমরাই ডিসাইড করো।
সাদেকা মামী শর্মির দিকে কিছুক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে চলে গেলেন। একটু পর সাদেকা মামী ফিরে এলেন। শর্মিকে হাত ধরে পাশের ঘরে নিয়ে গেলেন। বিছানায় পাশে বসালেন। বললেন-
তোর একটা জিনিষ এতদিন আমার কাছে ছিল। আমি অনেক পরে বুঝতে পেরেছিলাম ওই নাকফুলটা আসলে আমীর হোসেন তোর জন্য এনেছিল। তোর লাল সুটকেসে তোর বিয়ের শাড়ির ভাজে টিসু পেপারের মধ্যে রেখে দিয়েছি।
সাদেকা মামী শর্মির একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে বললেন-
– স্যরি শর্মি। আমি তোর জন্য কিছুই করতে পারিনি। আপা আর তোর মামা কারো কথাই শুনতে চাইলেননা।
শর্মি কিছু বলল না। শুধু মাথা নিচু করে করে সাদেকা মামীর শরীর ঘেঁষে বসে রইল। সাদেকা মামী হঠাৎ চোখে আঁচল চেপে ডুকরে কেঁদে উঠলেন।