নিয়তি : দুই
বৃদ্ধ ছিটকে খানায় পড়ে যাচ্ছিলেন, ধরে ফেললুম। একেবারেই পেছনে ছিলুম। বৃদ্ধ ভ্যাবাচাকা। জিজ্ঞেস করলুম, ‘কী দেখছেন?’
‘কেমন ধাক্কা মেরে চলে গেল। কোনো দৃকপাত নেই। ভাবছি, আমি গোরু, না ওই নব্যযুবকটি গোরু!’
‘কিচ্ছু ভাববেন না, ও যখন আপনার মতো বৃদ্ধ হবে, তখন ওর নেকস্ট জেনারেশন ওকে এর চেয়েও জোরে ধাক্কা মারবে। আপনাকে আমি ধরেছি। ওকে ধরার কেউ থাকবে না। নর্দমাতেই পড়ে থাকবে, পরের দিন স্ক্যাভেঞ্জার গাড়ি এসে ক্লিয়ার করে নিয়ে যাবে। কিচ্ছু ভাববেন না। তা এই নড়বড়ে শরীর নিয়ে চলেছেন কোথায়?’
‘স্কুল থেকে নাতনিতে আনতে।’
‘ছেলেবেলায় পড়েছিলাম, পথে বড়ো রিপু ভয়, মিনি, মিডি, অটো, টেম্পো, মোটর বাইক, সাইকেল রিকশা, ঠ্যালা, লরি, সাইকেল, স্টেট বাস, প্রাইভেট বাস, ট্যাকসি, প্রাইভেট, গোরু, ষাঁড়, কুকুর, মানুষ, এদের কেউ কি আপনাকে খাতির করবে? নাতনি আপনাকে রক্ষে করবে, না, আপনি নাতনিকে রক্ষা করবেন?’
‘কী করব বাবা! ছেলে সকাল আটটায় বেরিয়ে যায়, বউমা বেলা একটায় স্কুল থেকে ফেরে। আমি যদি এই কাজটুকু না করি, কথা হবে, রাগ হবে, সমালোচনা হবে! তাই যদ্দিন পারি!’
ধুতি—পাঞ্জাবি বৃদ্ধ, চোখে মোটা কাচের চশমা। রোদের তেজে নাকের ওপর কপাল তিন ভাঁজ খেয়ে আছে। ব্যস্ত বললে ভুল হয়। উদব্যস্ত বাজারে পথ ধরে, উন্নত বক্তৃতাসর্বস্ব আধুনিক কালের খানাখন্দে ভরা পথ মাড়িয়ে ধীরে ধীরে চলেছেন। বুঝতে পারছেন না, সবকিছু কেন এত এলোমেলো, নৃশংস, হৃদয়হীন।
না জানলেও আমি জানি, স্বাধীনতা যখন এক বছরের শিশু, তখন বাংলার ফেড়ে ফেলা অংশে জীবনের সব স্বপ্ন ফেলে রেখে, এক বস্ত্রে পরিবার—পরিজনদের নিয়ে আশ্রয় পেয়েছিলেন কুপারস ক্যাম্পে। সেখানে দরদি নেতা, মরমি দালাল, উদার লম্পট, ধূর্ত সমাজসেবী, তোমাদের ভালো করব, তোমাদের স্বর্গ দেখাব বলে, নরকের নরক দেখিয়েছিল। আকাশে ঝাঁক ঝাঁক শকুন, জমিতে নতুন ইহুদি। দিন বড়ো কষ্টের, রাত বড়ো মজার। শরীর বড়ো সস্তার।
সেই ঘেটো থেকে যৌবনের অদম্য শক্তিতে উঠলেন। শহরতলির নয়া বসতিতে নিজের আশ্রয় খুঁজে নিলেন। ছেলেকে দাঁড় করালেন, মেয়েদের বিয়ে দিলেন। ছেলে প্রেম করে বউ নিলে এল। উপহার পেলেন অবসর আর নাতনি। অহরহ শুনলেন, ইনকিলাব জিন্দাবাদ। সবসময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিবেশ, আলোহীন অন্ধকার রাত, জাপানি বোমায় সেই যে চুরমার হয়েছিল পথঘাট, সেই একই হাল। সৈনিকরা মার্চ করছে স্লোগানের তালে তালে, লড়াই, লড়াই, লড়াই, লড়াই। বৃন্দাবনের নিরেট ছেলে নেতা হয়েছে। পমেটম মাখা চুল। ঠোঁটে মুরলী নয়। বাঁকা সিগারেট, যেদিকে ধোঁয়া সেদিকের চোখ আধবোজা, গলায় ভাওয়েল—এ ই আই ও ইউ। কনসোনেন্ট নেই। কলের জাহাজের ভেঁপুর মতো কণ্ঠস্বর। সড়কের ওপর পাঁচতলা বেসমেন্টে বোমার ফ্যাকট্রি! তার ওপর আমদরবার। তার ওপর মধুবন। তার ওপর পরিবার—পরিজন। টঙে মন্দির। ওঁ শান্তি। সকালে ক্যাসেটে নাম—সংকীর্তন। দুখানি গাড়ি দু’পাশের গ্যারাজে। নাদুস ছেলেমেয়ে, গজেন্দ্রগামিনী স্ত্রী। পোড়া কাঠের মতো মা, পিতা ফুলের মালা দোলানো ছবি। মাঝে মাঝে লাল আলোর গাড়ি আসে। খালে লাশ ভাসে। মায়েরা বুকফাটা কান্না কাঁদে। বিরোধী নেত্রী ছুটে আসেন সান্ত্বনা দিতে। কাগজে ছবি ছাপা হয়। ঠোঙা হয়। অফিসের তাত্ত্বিকবাবুরা ঝালমুড়ি খান। ঢেউ মসৃণ হয়ে যায়। আলু, পটল, ফুচকা, ছোটোপর্দায় মাধুরী, অজয় দেবগণের ঢিসুম, ঢিসুম। দুই নেতার বৈঠক। ফিরিস্তির আদান—প্রদান। শান্তি, শান্তি। বেসমেন্টে বোমা। বাংলা বন্ধ। এপক্ষ—ফেলিয়োর। ওপক্ষ—ফুল বন্ধ। জনগণ, অভিনন্দন, অভিনন্দন। একটা লাল, একটা সাদা। খবরের কাগজে স্টক ছবি, খাঁ খাঁ হাওড়া ব্রিজ। রাস্তায় ব্যাট—বল।
বৃদ্ধকে প্রশ্ন, ‘কেন এইসব ভাবছেন! ওপর দিকে এখন এমন সব নেতা আছেন, যারা দাদার দাদা। হালকা জিনিস ওপর দিকেই ভেসে ওঠে। জমাট আদর্শ, আদর্শের গুরুভারেই তলিয়ে যায়। যদি মনে রাখি এই কথাটি—The apple is well known in history, but the grapefruit stays in the public eye. আপেলের অনেক উপকারিতা, কিন্তু মদিরা ফল দ্রাক্ষা চোখের সামনে দুল দুল করে দোলে। বড়োই নয়ন—লোভন। যত ক্যারদানি দেখাবে ততই হেডলাইন হবে। রোজ সকালে শহরের সব কাগজের ফ্রন্ট পেজে তোমার নাম দোল খাবে। তোমার মদ, মহিলার খেলা। আইনের গলায় কলস বেঁধে বুক ফুলিয়ে ঘোরা। আর থেকে থেকে বলা, সবই অযথা অপপ্রচার।
বৃদ্ধমহাশয় তাহলে শুনুন, সাতটি আশ্চর্যের মতো, সাতটি আধুনিক পাপের তালিকা :
Policies without principles
Pleasure without conscience
Wealth without work
Knowledge without character
Industry without morality
Worship without sacrifice
‘বৃদ্ধ! আপনার একি অবস্থা, প্ল্যাটফর্মে পড়ে আছেন কোমর ভেঙে!’
‘বাবাঃ, ডেলি প্যাসেঞ্জারে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে।’
‘অপরাধ?’
‘টিকিট কেটে, রিজার্ভেশান নিয়ে, আসানসোল থেকে কলকাতা আসছিলুম ভোরের ট্রেনে।’
‘তারপর?’
‘কয়েক স্টেশন পরেই ডেলি প্যাসেঞ্জাররা উঠতে লাগলেন। হুকুমের গলা, উঠুন, উঠুন, উঠে পড়ুন, অনেক বসেছেন। দলনেতা এ মাথা থেকে ও মাথা ফরমান জারি করতে করতে ঘুরছেন। কয়েকজন, মেয়েদের আসনের হাতলে ভারি নিতম্ব স্থাপন করে ঠেলতে মহিলারা বিনা প্রতিবাদে উঠে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে দখল হয়ে গেল আসন। একটাই আশ্চর্য, এই দল অবাঙালিদের কিছু বললেন না!’
‘কারণ অবাঙালিরাই বাঙালিদের অন্নদাতা। খুনোখুনির রাজনীতিতে পশ্চিমবাংলায় যখন থরহরি কম্প, বিদ্যাসাগরের মুণ্ডু কাটা হচ্ছে, বিবেকানন্দকে বেদি থেকে উৎপাটিত করা হচ্ছে, খুচরো বাঙালি ব্যবসাদারদের গলা কাটা হচ্ছে, তখন কিন্তু একটিও অবাঙালি শ্রেণিশত্রুর গায়ে হাত পড়েনি চেয়ারম্যানের নির্দেশে। বিবেকানন্দ রোডের দক্ষিণ ফুটপাথে নর্মাল লাইফ, উত্তরে সশস্ত্র বিপ্লব। কারণ অন্নদাতা পিতা! বুঝলেন কিছু?’
‘বুঝেছি।’
‘তারপর?’
‘আমাকে যখন হাত ধরে টানছে, সামান্য প্রোটেস্ট করেছিলুম। আমার টিকিট রয়েছে, রিজার্ভেশান রয়েছে, বৃদ্ধ মানুষ, হাই প্রেশার, চোখে দেখি না। আপনারা কি মানুষ!’
‘না, আমরা ডেলি প্যাসেঞ্জার!’
‘তারপর?’
‘তারপর আমাকে বল হরি বলে, ঝপাং। পড়ে আছি এইখানে। আমার ব্যাগ হাওড়া চলে গেছে।’
‘ভাবছেন না কিছু, ওঁদের ছেলেরা যখন বড়ো হয়ে ডেলি প্যাসেঞ্জার হবে, তখন তারা ড্রাইভার, কন্ডাকটারকেও ছুঁড়ে ফেলে দেবে।’
‘তাহলে ট্রেন চালাবে কে? কে চেক করবে টিকিট?’
‘ভূতে।’
একজন একটি মজার কথা বলেছিলেন, Everything is relative :
If a monkey had fallen from the tree in place of an apple, Newton would have discovered the origin of species instead of the Law of gravity. সবই আপেক্ষিক। বিবর্তন এখন ভিন্নমুখী। মানুষ থেকে বাঁদর, বাঁদর থেকে হায়না।
একালে প্রেমিক আছে প্রেমিকা আছে, শিক্ষালয় আছে শিক্ষক আছেন, গুরু আছেন, কাতারে কাতারে শিষ্য, দেশ আছে, ঝুড়ি ঝুড়ি নেতা; কিন্তু পিতা মাতা নেই, আচার্য নেই, আত্ম—অন্বেষণ নেই, সেবা নেই, ত্যাগ নেই। কৌশল করি বাঁচতে গিয়ে সব শেষ। ঘরে ঘরে অনন্ত আদিখ্যেতা; কিন্তু চরিত্র গঠনের চেষ্টা নেই। চরিত্র গঠনের কথা পুরনো কথা, শুনলে হাসি পায়। অর্থের কাছে চরিত্র এক ছিন্নবসন ভিখারি। শঙ্কর, বুদ্ধ, চৈতন্য, বিবেকানন্দ, হু আর দে! তাঁরা কি বিজনেস টাইফুন ছিলেন।
চিন্তাবিদরা বড়ো ধন্দে পড়েছেন, ব্যাপারটা হল কি? ভগবান মারা গেলেন, না মানুষ! দি ডেথ অফ দি ফ্যামিলি।
গভীর রাতে আমেরিকার রাজপথে একটি শিশু সাদা স্লিপিং স্যুট পরে দাঁড়িয়ে আছে। একেবারে রাস্তার মাঝখানে। একটা দামড়া লরি গাঁক গাঁক করে চলে গেল। এক চুলের জন্যে শিশুটি বেঁচে গেল। সাঁই সাঁই করে গাড়ি ছুটছে। এক প্রবীণ নিজের জীবন বিপন্ন করে শিশুটিকে উদ্ধার করে আনল। এইবার সভ্য মানুষের সভ্য কাহিনিটা কী! বাপ, মা ফুর্তি করতে গেছেন। শিশুটিকে রেখে গেছে বৃদ্ধ দাদুর কাছে। শিশুটি খাটে দাঁড়িয়ে সশব্দে দরজার খিল খুলেছে ইচ্ছে করে। দেখতে চায়, কেউ তার জন্যে জেগে আছে কি না! না, কেউ নেই। সে নিঃসঙ্গ! নোবডি লাভস মি। কাঁদতে কাঁদতে বললে, নোবডি লাভস মি!
প্রেমহীন সমাজ কি তৈরি করবে—দেবতা না দানব!
ফ্যাকট্রি থেকে ট্রাক বেরোবে, পরিবার থেকে মানুষ। ও কি খায়, ডিজেল। এ কি খায়, চিকেন চাও। ওর স্টিয়ারিং—এ শিক্ষিত হাত, এর স্টিয়ারিং—এ। কেউ নেই! একটি প্রাচীন কথা— If you want your children to turn out well, spend twice as much time with them, and half as much money.
ঘটনাটা লিখে ফেললুম। আমাদের রাতের দরবারে দুখীদাকে পড়ে শোনালুম। প্রবীর বললে, ‘বেশ ঝাঁঝ আছে।’
দুখীদা বললে, ‘অত জ্ঞান দিলি কেন? তোর জ্ঞানে দেশ বদলাবে? ছোট্ট একটা গল্প তৈরি করতে পারতিস!’
‘এই ছোট্ট এক লাইনের একটা ঘটনা থেকে গল্প কীভাবে হবে!’
‘কেন হবে না। বৃদ্ধকে হাত ধরে তুললি। তোলা মাত্রই তিনি ভীষণ রেগে বললেন, একটু দেখেশুনে হাঁট। দেখে কিছু বৃদ্ধ মানুষও আছে। বৃদ্ধ মানুষ, অসুস্থ মানুষ, শিশু, নারী। সবাই তোমাদের মতো অসভ্য যুবক নয়। ক্লাস ফাইভে পড়ি। বোশেখ মাস, ভরদুপুর বেলা। গোটাকতক ছেলে আমগাছে ঢিল ছুঁড়ছে। আমাদের অঙ্কের স্যারের পিঠে একটা ঢিল পড়ল। আমি সেই সময় ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিলুম। কী হল স্যার, কী হল স্যার বলে ছুটে গেলুম। স্যার আমাকে বেধড়ক পিটিয়ে দিলেন। শুধু তাই নয়, বাড়িতে এসে মাকে জানিয়ে গেলেন, ছেলেটা বাঁদর হয়ে গেছে। বড়ো হয়ে জেল খাটবে। এইবার আমি একটু জ্ঞান দি—দুনিয়ার নিয়মটা হল, উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে। দেখছিস না, অপরাধীরা বুক ফুলিয়ে ঘুরছে। নিরীহরা জেল খেটে মরছে।’
অনেক রাত। বাড়ি যেতে ইচ্ছে করে না। নিরেট একটা ঘর। একশো পাওয়ারের আলো। বিরাট একটা টেবিল। ভিক্টোরিয়া আমলের। একটা খাট। পাশ ফিরলেই ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ। রঙচটা একটা আলমারি। নেংটি ইঁদুরের দৌড়োদৌড়ি। ঘুম আসে। স্বপ্ন দেখিয়ে চলে যায়।
দোতলায় যত রাত বাড়ে তত ঝগড়া বাড়ে। দু’পক্ষের দাপাদাপি। এ এদিক দৌড়চ্ছে, ও ওদিকে। আবার ছেলেপুলেও হচ্ছে। মনুষ্যজীবনে ঘেন্না ধরে গেল। এ—পাড়ায় সবচেয়ে সুখী মিষ্টির দোকানের পলাশ। সারাদিন খাটে, রাতে বিভোর হয়ে বাঁশি বাজায়। চণ্ডীবাবুর ইনসমনিয়া। দোতলার বারান্দায় বসে বাঁশি শোনেন, ‘এইবার কেদারা ধরো। আজ আকাশে চাঁদ আছে। মিঠে বাতাস। আমার বউ কেদারা শুনতে ভালোবাসত। ধরো ধরো, ধরো ফ্যালো।’
অফিসটা কেমন যেন থমথমে মনে হচ্ছে। ভীষণ চুপচাপ সবাই। আমাদের স্টেনো—টাইপিস্ট আশালতা ফিসফিস করে বললে, ‘মোহন আত্মহত্যা করেছে। গলায় ফাঁস লাগিয়ে অফিসেরই বাথরুমে ঝুলছিল। সকালে সিকিউরিটির লোক এসে প্রথমে দেখে। এই তো এইমাত্র ডেডবডি পুলিশে নিয়ে গেল। পকেটে একটা কাগজে লিখে গেছে, ‘আমার মৃত্যুর জন্যে আমিই দায়ী।’
নিজের চেয়ারে এসে বসলুম। বিমর্ষ লাগছে। টাকাই কি মোহনের মৃত্যুর একমাত্র কারণ! সারাটা দিন মোহনের আলোচনা হল। টুকরো টুকরো যে যা জানে বলতে লাগল। তাই দিয়েই মোহনের জীবনের শেষ পর্বটা লিখে ফেলা যায়। একটা মানুষের ক্রমপতনের ইতিহাস। মোহন সম্পর্কে অনেকেই অনেক কিছু জানে! সত্যটা যা বেরলো, তা হল বেহিসেবি যৌবন কারোকে ক্ষমা করে না। সাপ নিয়ে খেলা করার মতো। ছোবল একদিন মারবেই।
পড়তি বনেদি বংশের ছেলে মোহন। চোখের সামনে পরিবারটাকে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে দেখেছে। শাসন করার কেউ ছিল না। ঝড়তি—পড়তি যা ছিল সব উড়িয়েছে যৌবনের বদ খেয়ালে। বিয়ে হয়েছিল বড়ো ঘরে। প্রথম পক্ষ। সে—বউ দুই মেয়ে রেখে চলে গেছে অকালে। খারাপ জায়গায় যাওয়ার অভ্যাস ছিল মোহনের। সেইখানকার একটা মেয়ে এসে চাপল মোহনের ঘাড়ে। কী বিয়ে হল, কেমন বিয়ে হল মোহনই জানে। সে এসে মোহনের জীবনটা শেষ করে দিলে। বাড়িটা হয়ে গেল বেশ্যালয়। মোহনকে ধরে ধরে পেটাত। পাড়ার এক ক্ষমতাশালী দাদা তার প্রেমিক। মোহনের মেয়ে দুটোকেও সে লাইনে নামিয়েছে জোর করে ভয় দেখিয়ে। তাদের আর পালাবার পথ নেই। জীবন কি সাংঘাতিক জিনিস! ইঞ্জিন একবার বেলাইন হলে গেলে আর সহজে লাইনে আনা দুঃসাধ্য ব্যাপার। তখন জীবন দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। মোহন তার প্রমাণ। মোহনের দ্বিতীয় স্ত্রীকে আমি একবার দেখেছি। সে এক অসম্ভব ব্যাপার। তাকাতে অস্বস্তি হয়। মনে কুভাব আসে। পাশে নিয়ে হাঁটা যায় না। মোহনকে তার পাশে মনে হত চাকর—বাকর। সিল্কের শাড়িতে শরীরের সাংঘাতিক সব ভাঁজ স্পষ্ট। চলার ছন্দে নিতম্ব দুলছে। উদর নাভি পর্যন্ত অনাবৃত। তাকানোর মধ্যে একটা ইঙ্গিত। কথায় কথায় খিলখিল হাসি। মদ্যপানে সুপটু। তিন, চার পেগে অটল। মোহন আত্মহত্যা করবে না তো কে করবে!
বিকেলে ঠিক হল সবাই মিলে ফুল নিয়ে শ্মশানে যাবে। মোহন আমাদের সকলেরই খুব প্রিয় ছিল। তার অতীত নিয়ে আমরা আর মাথা ঘামাতুম না। বর্তমানের সুন্দর মানুষটাকেই আমরা দেখতুম। বোঝাই যেত যৌবনে তাকে খুব সুন্দর দেখতে ছিল। কোঁকড়ানো চুল। খাড়া নাক। ধারালো মুখ। একটু লেখাপড়া শিখলে মোহন যে কতবড়ো হতে পারত। টপ একজিকিউটিভ।
অফিসের স্টেশান ওয়াগন করে আমরা কেওড়াতলায় গেলুম। আমাদের সঙ্গে আশালতাও রয়েছে। এই হল মানুষের ছিরি। মোহনকে কী বলব! নিজের মনের দিকে তাকালে ভয় পেয়ে যাই। ওই যে আশালতা। বেশ একটা চটক আছে চেহারায়। কথা বলে, হাসিঠাট্টা করে। হিউমার বোঝে। ইনটেলিজেন্ট। কেবল সুখ—দুঃখ, সংসারের কথা বলে না। নাটক, নভেল, সিনেমা, গান, রাজনীতি, খেলার প্রসঙ্গও আনে। বিদেশে বেড়াতে যাওয়ার কথাও তোলে। পরিপূর্ণ একজন বন্ধুর মতো। আবার আশালতা একজন মহিলা। সেটাও কম আকর্ষণের নয়। সেইভাবেও তাকে ভাবা যায়, তার সঙ্গ কামনা করা যায়। ভীষণ এক আকর্ষণ! মনকে যদি প্রশ্ন করি, কী আছে আশালতার মধ্যে! মন সঠিক কোনো উত্তর ঝট করে দিতে পারবে না। এইটুকু বুঝেছি মন একটা আলাদা লোক, বেপরোয়া, স্বাধীন। আমাদের দেহটাকে তার ইচ্ছামতো ব্যবহার করে। মন আর শরীর আলাদা। ওরই মধ্যে যা বুঝেছি, আশালতা থাকলে আনন্দ হয়। পরিবেশটা জমে ওঠে। মনে নানারকম কল্পনা আসে। কলেজের দিনগুলো মনে পড়ে যায়। মনে হয়, আবার আর একবার নতুন করে শুরু করি। সেই মাঠ, সেই গাছ, সেই ফুটবল, একটা সাইকেল, ডোরাকাটা নীল জামা, অকারণ উল্লাস, সেইসব বন্ধুরা একসঙ্গে গান গেয়ে ওঠা, একসঙ্গে সিনেমায় যাওয়া, সেই পরীক্ষার হল। গার্ড হাঁকছেন, হাফ—এন আওয়ার মোর, ফিফটিন মিনিটস মোর, ফাইভ মিনিটস মোর। পরীক্ষার হলের বাইরে এসে আলোচনা, কে কবার বাড়তি কাগজ চেয়েছে; যেন বেশি লিখলেই বেশি নম্বর।
গাড়ি দুলছে, গর্তে পড়ে লাফাচ্ছে, আশালতা আমার গায়ে ঢলে পড়ছে। কিছু মনে করছে না, কোনো সঙ্কোচ নেই। তার ভারী নরম ঊরু আমার ঊরুর পাশে স্পঞ্জের মতো লেগে আছে। গাঢ় নীল রঙের ব্লাউজ। সাদা ধবধবে হাত। সরু সরু আঙুল। এই ভালো লাগার জন্যে নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছে। মনে এইসব ভাবনা এলে আমার এমন মনে হত না। সমাজ এখন অনেক উদার। কিন্তু, আমি যে মনে মনে আশালতাকে উপভোগ করছি। এ তো ভালো নয়! আমি যাচ্ছি শ্মশানে। একজন মারা গেছে। তার সৎকার হবে। আমার মনে কোনো দুঃখ নেই। কেবল মুখে লোক—দেখানো আহা, আহা! মোহনের দ্বিতীয় পক্ষের নিন্দে করছিলুম দুপুরে। তার কী দোষ! আমরা টলি বলেই তো সে আমাদের টলিয়ে আনন্দ পায়। আমাদের মন শক্ত হলে ওরা পাত্তা পেত, না ওদের ব্যবসা চলত!
আশালতা হঠাৎ বললে, ‘কী অত ভাবছেন! আপনি সব ব্যাপারে বড়ো ইনভলভড হয়ে পড়েন। আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, জগৎটা এইরকমই। মন যত নরম হবে দুঃখ তত বাড়বে!’ আশালতার কথায় চমকে উঠলুম। নিজের অপরাধবোধ আরও বেড়ে গেল। বাইরে থেকে মানুষকে কিছুমাত্র চেনা যায় না। মানুষকে নিয়ে এই এক বিপদ!
আমি সঙ্গে সঙ্গে আমার ভেতরের অভিনেতাটাকে জাগিয়ে তুললুম। নকল গলায় বললুম, ‘কী করব, আমি যে পারি না, আমার ভেতরটা কেঁদে ওঠে। অনেক চেষ্টা করি ভেতরটাকে শক্ত করার, পারি না। মোহন আমাকে ভীষণ ভালোবাসত। লোকটা কী অদ্ভুতভাবে নিজেকে পালটে নিয়েছিল। বোঝাই যেত না, অতবড়ো একটা ফ্যামিলির ছেলে। মনে হত, একটা চাকর দীন, হীন। সারাদিন চেয়ারে বসে থাকত। মাঝে মাঝে সিগারেট খেত। সব পেরেছিল, দুটো জিনিস পারেনি। নিজের র্যাঙ্কের কারও সঙ্গে মিশতে পারত না। একটা দূরত্ব রেখে চলত আর পারেনি বড়ো ঘরের সহবত ছাড়তে। মোহনের জন্যে আমি কিছুই করতে পারিনি।’
এইবার আমার গলা ধরে আসছে। জল আসছে চোখে। অভিনেতার মৃত্যু হচ্ছে। আসল মানুষটা জাগছে। অন্যের দুঃখে কাঁদতে পারলে ভেতরটা বেশ পবিত্র হয়ে যায় মন্দিরের মতো। দুঃখের মতো পবিত্র আর কিছুই নেই। দুঃখই ভগবান। হঠাৎ রবীন্দ্রনাথের সেই গান মনে পড়ে গেল। আশালতার কানে কানে বললুম,
‘দুঃখের বরষায় চক্ষের জল যেই নামল
বক্ষের দরজায় বন্ধুর রথ সেই থামল।
মিলনের পাত্রটি পূর্ণ যে বিচ্ছেদ—বেদনায়;
অর্পিণু হাতে তার, খেদ নাই আর মোর খেদ নাই।।’
আশালতা খপ করে আমার হাতটা ধরে বললে, ‘গ্রেট! আমারও ঠিক এইরকম একটা কিছু মনে হচ্ছিল। আপনার আর আমার মন বোধহয় একসুরে বাঁধা। আপনি ভীষণ পবিত্র!’
আশালতার কবজিতে সোনালি রঙের ঘড়ি। কালো ডায়ালে অক্ষর জ্বলজ্বল করছে। মনে হচ্ছে, পৃথিবীর রাজপথে আশালতাকে নিয়ে হারিয়ে যাই। কোনো এক সমুদ্র ঢেউ ভাঙছে।
আশালতা বললে, ‘কারও জন্যে কিছু করা যায় না। যে নিজে করে নিতে পারে সেই পারে! এই দেখুন না, আজ পর্যন্ত কেউ আমার একটা বিয়ে দিতে পারলে না। আমি তো হতকুচ্ছিত নই, সামান্য রোজগারও করি। আমি নিজে কোনো ব্যবস্থা করতে পারলুম না বলে হল না। শেষ বয়েসে কে আমাকে দেখবে! বুড়ি থুত্থুড়ি। মেয়েদের একটা বিয়ে করা উচিত, তা না হলে বেশি বয়েসে ক্যাডাভ্যারাস হয়ে যায়! বুঝি, কিন্তু কিছু করার নেই। প্রেম করার অনেকে আছে, দায়িত্ব নেবার কেউ নেই। কত প্রস্তাব আমার কাছে আসে, দিঘা চলো, গোপালপুর চলো, একদিনের জন্য ডায়মন্ডহারবার। বুঝি কি চায়! পারি না! সেভাবে মানুষ হইনি।’
আশালতা নিচু গলায় গুনগুন করে, ঘরোয়া সুরে কথা বলছে। গাড়ির শব্দে কেউ শুনতে পাচ্ছে বলে মনে হয় না। শুনতে পেলে এতক্ষণে অনেক টীকা—টিপ্পনী হত।
তবু দুম করে বলে বসলুম, ‘কেন! আমি তো আছি!’
কথাটা মুখ দিয়ে বেরিয়ে যেতেই ভীষণ ভয় হল, ইস! মেয়েটা আমাকে যা—তা ভেবে বসবে। ভাববে দিঘা—পার্টি। কথা তো ফেরানো যাবে না। ভয়ে চোখ বুজিয়ে গাড়ির দুলুনিতে দুলতে লাগলুম।
আশালতা কিন্তু কিছু মনে করল না, বরং অদ্ভুত একটা কথা বললে। বললে, ‘আপনি বলার আগেই আমি আপনার ওপর নির্ভর করতে শুরু করেছি। আপনার ভেতরে আমার দেখা আদর্শ বেঁচে আছে, বেঁচে আছে আমার অতীত।’
আশালতার নরম কোলের ওপর আমার হাত তার হাতের সঙ্গে জড়াজড়ি করে পড়ে আছে। হঠাৎ মনে হল, তাই যদি হয়, তাহলে আমাকে ভালো হতে হবে, ভীষণ ভালো। চরিত্রে ভালো চিন্তায় ভালো। সমস্ত ওপর—চালাকি আমাকে ছাড়তে হবে। কর্তব্যপরায়ণ হতে হবে, আন্তরিক হতে হবে।
আশালতা বললে, ‘অতীত জিনিসটা ভীষণ বেয়াড়া। বর্তমানের ঘাড়ে চেপে বসে থাকে। আমার অতীত! আমার মা আত্মহত্যা করেছিলেন। মা যে কেন আত্মহত্যা করেছিলেন, তা আজও আমার কাছে তেমন পরিষ্কার নয়। অনেকেই অনেক কথা বলে। আমার মনে হয়, মায়ের একটা ভালোবাসা ছিল। আমার এও মনে হয়, আমি আমার বাবার মেয়ে নই। কারণ মা মারা যাবার পর আমার মায়ের মাস্টারমশাই আমাকে ভীষণ ভালোবাসতে শুরু করলেন। তিনি অবিবাহিত ছিলেন। কিছুদিন আগে মারা গেছেন। মৃত্যুর পর জানা গেল, তিনি আমাকে তাঁর ছোট্ট বাড়িটা দান করে গেছেন। সেই মানুষটির মুখের সঙ্গে আমার মুখের বেশ মিল আছে। অমন রোম্যান্টিক মানুষ আমি জীবনে দেখিনি। চাঁদের আলোয় বসে বেহালা বাজাতেন। গরমকালে গায়ে খসখসের আতর মাখতেন। আর আমাকে মাঝে মাঝে বলতেন, ‘বেটি সুখ হল সোনার পাথর বাটি।’
আমরা শ্মশানে এসে গেলুম। বৈদ্যুতিক চুল্লির সামনে মোহন লাইন দিয়েছে। মোহনের আগে আরও একজন আছে। কোনো সাজসজ্জা নেই মোহনের। মোহনের বউ পাড়ার দাদার সঙ্গে দূরে বসে আছে। খুব শোকার্ত বলে মনে হল না। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে—’তুমি সধবা হলে, না বিধবা হলে মা!’
সব শেষ হয়ে গেল। একটা নতুন গাড়ি চড়ে মোহনের বউ চলে গেল। পাশে একজন মোটাসোটা অবাঙালি। আমাদের অফিসের ভুবনদা, বনেদি বাড়ির ছেলে, অসম্ভব সৎ, সুন্দর, রসিক, পরোপকারী।
ভুবনদা এসে বললেন, ‘দেখার কিছু নেই, চাকা আর টাকা, দুটোই গোল। ইঁদুরে বই কাটবে, মিষ্টিকে পিঁপড়ে ধরবে, কাদায় পা পিছলোবে, চোর চুরি করবে, খুনি খুন করবে, যদ্দিন পৃথিবী তদ্দিন এইসব। জীবনদর্শন। মোদ্দা কথা টাকা আর চাকা। দুটোই গোল, দুটোই গড়ায়, চল, কোথাও বসে চা খাই। সুখেও চা, দুখেও চা। চায়ের মতো বন্ধু নেই। একটা কথা তোরা একটু ভেবে দেখিস, গীতা না পড়েই আমরা কিন্তু দুঃখ—সুখের পারে চলে গেছি। আমাদের আনন্দও বেশিক্ষণ থাকে না, দুঃখও বেশিক্ষণ থাকে না। আমার বাবার মৃত্যুটা জানিস কি? আচ্ছা চল, চা খেতে খেতে।’
ভবানীপুর হল ভুবনদার জমিদারি। রেস্তোরাঁর দোতলায় নির্জনে বসা গেল। টেবিলের এদিকে দুটো চেয়ার, ওদিকে দুটো চেয়ার। বসা নিয়ে একটু ঝামেলা হল। আশালতার পাশে কে বসবে? আমি ভুবনদাকে বসাতে চেয়েছিলুম। ওই বনেদি চেহারা। সুন্দরী আশার পাশে দারুণ মানাবে! ভুবনদা বললে, ‘আমার চরিত্র ভালো নয়। তুই বোস। তোদের এখন প্রেম করার বয়েস, কেন যে তোরা শুকিয়ে মরিস?’
এরপর আর কি পাশাপাশি বসা যায়! গাড়িতে জায়গা ছিল না। হঠাৎ মনে হল, আমি কি বোকা! ভুবনদার পাশেই তো বসা যায়! আশালতা একাই বসুক না। বেসিনে হাত ধুতে গিয়ে নিজের মুখটা ভালো করে দেখলুম। কোনো ছিরি—ছাঁদ নেই। শেয়ালের মতো সরু। নির্বোধের মতো দুটো চোখ। কোনো মেয়ে এই চেহারার একটা ছেলেকে ভালোবাসতে পারে না। আশালতার অন্য কোনো মতলব আছে। বিপদে পড়ার আগে ভেতর থেকে কেউ আমাকে বলে দেয়, সাবধান!
ভুবনদা তাঁর বাবার গল্প শুরু করলেন। ‘খুব ভালো সাঁতার জানতেন। গঙ্গায় চান করতে গিয়ে একটা গাধাবোটের তলায় ঢুকে গিয়েছিলেন। তখন জোয়ার ছিল। ভরা গঙ্গা। পরের দিন ভাটার সময় লাশ পাওয়া গেল। মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়েস। বাবার মৃত্যুতে আমার কত সুবিধে হল। এক ছেলে। বাবা বেঁচে থাকলে আরও দু—তিনজন ভাগীদার এসে যেত। শাসন করারও কেউ রইল না। ওড়ো আর ওড়াও। যেমন পায়ের মাপ সেইরকম জুতোর মাপ। একেবারে ফিট। সেইরকম সব চামচা ফিট হয়ে গেল। মার মার কাট কাট। বুদ্ধি না পাকলে ধন—সম্পত্তি সব বরবাদ হয়ে যায়। বেশি দেরি লাগল না বুঝতে। মানুষের জীবনে ভালো আর মন্দ দুই—ই আসে। কলেজের সহপাঠী কল্যাণ একদিন শেষ বেলায়, শীতেরও শেষ। ফুরফুরে বসন্ত। গড়ের মাঠে মনুমেন্টের তলায় আমাকে নিয়ে বসল। পকেট থেকে একটা প্যাকেট বের করল। ছোটো ছোটো বিস্কুট। সেকালে আমরা বলতুম কাঁই বিস্কুট।
একমুঠো সামনে দূরে ছড়িয়ে দিল। নিমেষে একগাদা কাক এসে গেল। কল্যাণ আমার ডান হাত তার হাতের মুঠোয় নিয়ে বললে, যত ছড়াবি তত আসবে। কাকই আসবে। অকৃতজ্ঞ কাক। না পেলে ঠোকরাবে।
এরপর মোটামুটি ভালো জামাকাপড় পরা একজন ভিখিরি এসে সামনে হাত পেতে দাঁড়াল, মুখে কোনো কথা নেই। আমি পকেটে হাত ঢোকালুম। কল্যাণ আমার হাত চেপে ধরে রইল। হাত নেড়ে লোকটাকে ভাগিয়ে দিল। ততক্ষণে কাকের দল আর একটা দিকে চলে গেছে। সেখানে একটা টেরি—কাটা কাপ্তেন টাইপের লোক এক মহিলাকে নিয়ে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে আছে। ঝালমুড়ি চিবোচ্ছে, আর মাঝে মাঝে পেছনদিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে। কাকগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে খাচ্ছে। কলসি ঝুলিয়ে ময়দান—চা ঘুরছে। তিন ফুট, চার ফুট।
হঠাৎ সেই মহিলা একলাফে উঠে পড়ে মনুমেন্টের আড়ালে রেড রোডের দিকে পালাল। ব্যাপারটা কী হল! কল্যাণ দেখালে, ওই দ্যাখো দূরে, পুলিশের হল্লা গাড়ি। গোটা দুয়েক ময়দান—মহিলাকে পাকড়েছে। কল্যাণই বলেছিল, টাকা আর চাকা।
এরপর আমাকে পার্ক স্ট্রিটের দিকে নিয়ে গেল। তখন রাত হয়েছে। ঝকমকে আলোর চমক। রঙ—বেরঙের গাড়ির বাহার। টাকা আর ফুর্তির জোয়ার। মাতালরা কেউ ফক্সে, কেউ গাম্বোতে ঢুকছে। আরও মাতাল হয়ে বেরিয়ে আসছে। ষোলো থেকে সাঁইত্রিশ রাতচরা সুন্দরীরা শিকারে বেরিয়েছে। ফোড়ে, গুন্ডা, পিম্প, কলগার্ল। আলোর তলায় দাঁড়িয়ে কল্যাণ আমার কানে কানে বললে, Youth is a blunder : manhood a struggle, old age a regret.
কল্যাণ এর পর আমাকে খিদিরপুরে নিয়ে গেল। কল্যাণ খিদিরপুরেই থাকত। আমাকে একটা বস্তিতে নিয়ে গেল। হিন্দু—মুসলমান সবাই মিলেমিশে থাকে। কোথাও সেলাই কল চলছে, কোথাও কাঠের কাজ। ওইখানেই একটা চালার তলায় স্কুল বসেছে। একটি মেয়ে আর একটি ছেলে পড়াচ্ছে, আর প্রায় পঞ্চাশজন ছেলেমেয়ে মন দিয়ে পড়ছে। কোথাও কোনো গোলমাল নেই, আবর্জনা নেই, দুর্গন্ধ নেই। কল্যাণ হল লিডার। পাশেই একটা কমিউনিটি কিচেন। বালক—বালিকাদের জন্যে রান্না করছেন বস্তির তিনজন মা। মুখে হাসি, কপালে ঘাম। মনে আনন্দ, উৎসাহ।
কল্যাণ বললে, ওই দ্যাখ, কী লিখে রেখেছি :
He who gives a child a treat
Makes joy-bells ring in Heaven’s street.
And he who gives a child a home
Build palaces in Kingdom come.
আমি চারটে লাইন সঙ্গে সঙ্গে মুখস্থ করে ফেললুম :
একটি শিশুকে যত্ন করো
স্বর্গের রাজপথে বেজে উঠবে আনন্দের ঘণ্টাধ্বনি।
একটি শিশুকে যদি ঘর দিতে পারো
তাহলে তোমার আগত সাম্রাজ্যে হবে প্রাসাদ রচনা।
আমি তো কবি নই। ওই হল আর কী! কল্যাণ আমার গুরু। জীবনটা ঘুরিয়ে দিলে। মানুষে ভগবান কতটা আছেন বোঝা শক্ত, ছটফটে একটা শয়তান খুব আছে, কেবল দুষ্কর্মের পরামর্শ দেয়। আজকের রাতটা খুব ঝলমলে। শ্মশানে একটা মানুষের শেষ দেখে এসে আমরা কেমন ব্রেস্ট কাটলেট চিবোচ্ছি মাস্টার্ড মাখিয়ে! মাঝে মাঝে স্যালাড ঠেলে দিচ্ছি মুখে। দ্যাখো, আমি তোমাদের চেয়ে অনেকটা আগে পৃথিবীতে এসেছি। তখন সময় ছিল অন্যরকম। এখন সব পালটে যাচ্ছে। খানিক মনের কথা বলি, সব জীবেরই একটা সমাজ আছে। বাঘের আছে। সিংহের আছে। পাখির আছে। কুকুরেরও আছে। সাধারণ কিছু নিয়ম তারা মেনে চলে। ঝাঁকের পাখি, ঝাঁকের মাছ কদাচিৎ নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি করে। ক্যানিবলিজম নেই বললেই চলে। বাঘে বাঘ মারে না। গোয়ালে দুটো গোরু পাশাপাশি বাঁধা থাকলে রাতে একটা আর একটাকে খেয়ে ফেলে না, বা গুঁতিয়ে মেরে ফেলে না। গোয়ালের দরজা খুলে মুংলি গাই প্রতিবেশীর গোয়ালে ঢুকে ঝুমরি গাইকে বলে না, চল মাধুকে বাঁশ দিয়ে আসি।
মানুষ খুব বুদ্ধিমান প্রাণী। ভাবতে জানে, ভাবাতে জানে। সারা পৃথিবী তার পায়ের তলায়। আকাশের দূরপ্রান্ত তার দখলে। সুচারু চেহারা। বড়ো বড়ো দাঁত নেই। নখঅলা সাংঘাতিক থাবা নেই। মানুষের গ্রন্থাগারে জ্ঞান ঠাসা বই। মগজে জ্ঞান—বিজ্ঞানের বীজ। মুখে বড়ো বড়ো কথা। প্রেম, ভালোবাসা, আত্মোৎসর্গ, হিতসাধন। তবু মানুষের মতো অনিশ্চিত প্রাণী জীবজগতে আর দুটি নেই।
সাপ ছোবল মারবে জানা আছে। বাঘ ঘাড় মটকাবে ধরে নিতেই পারি। কাকের বাসায় খোঁচাখুঁচি করলে ঠুকরে চাঁদি ছ্যাঁদা করে দেবে, অজানা নয়। মানুষ কী করতে পারে জানা নেই। নির্জন পথে ট্যাক্সি—ড্রাইভার হঠাৎ পেটে ভোজালি চেপে ধরে যাত্রীর সব কেড়ে নিতে পারে। ট্রেনের সহযাত্রী হঠাৎ সশস্ত্র ডাকাতের চেহারা নিতে পারে। ক্ষমতালোভী নেতা মায়ের কোল থেকে তার শিশুটিকে কেড়ে নিয়ে ধড়, মুণ্ড খণ্ড খণ্ড করতে পারে। মানুষ মানুষের হাত ধরে টেনে তুলতে পারে, আবার গলায় ছুরিও চালাতে পারে।
মানুষের ইতিহাস নিয়ে নাড়াচাড়া করলে মানুষের ওপর বিশ্বাসের চেয়ে অবিশ্বাসই এসে যায়। ইতিহাসের ধারায় মানুষ যত শিক্ষিত, আলোকপ্রাপ্ত হয়েছে ততই মানুষ সংকীর্ণ আর স্বার্থপর হয়েছে। মানুষের সমাজ বলে আর কিছু নেই। সকলেই আমরা অসামাজিক, আত্মসেবী প্রাণী। স্বার্থ ছাড়া মানুষের সম্পর্ক আজকাল আর টেকে না। যতদিন স্বার্থ ততদিন আসা—যাওয়া। স্বার্থের আদান—প্রদান শেষ হয়ে গেলেই আর টিকির দেখা নেই। প্রবাদটি ভারি সুন্দর : ‘কাজের সময় কাজি, কাজ ফুরোলেই পাজি। অমুককে ধরলে ছেলের চাকরি হতে পারে। সকাল—বিকাল আসা—যাওয়া। কুশল বিনিময়। বাড়ির কে কেমন আছে, এমনকি কুকুরটা কেমন আছে! কতই যেন হিতৈষী বন্ধু! তারপর আর পাত্তা নেই। যাকে মনে হয়েছিল মরলে খাটের সামনের দিকে কাঁধ দেবে, দেখা গেল সে বাঁশ নিয়ে তেড়ে আসছে। বিদ্যাসাগর মশাইয়ের কালে যা ছিল এখনও তাই আছে। বরং আরও বেড়েছে। অমুকের পাড়ায় খুব হোল্ড আছে, হবু নেতার হাত এসে পড়ল একেবারে কাঁধে। ভাই সম্বোধন। নেতা যেই এম.এল.এ. হয়ে টাটে বসলেন, অমনি অমুক হয়ে গেল লোফার। স্বামী—স্ত্রীর সম্পর্কও স্বার্থের সম্পর্ক। প্রেম, প্রীতি, সাতপাকের অবিচ্ছেদ্য বন্ধন, যদিদং হৃদয়ং মম একটা মানসিক সান্ত্বনা, হ্যালুসিনেশান, বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো। যতদিন করতে পারবে ততদিন খাতির। স্বার্থের রোদে প্রেমের শিশির শুকোতে থাকে। শেষটা পরস্পর পরস্পরকে দন্ত প্রদর্শন করে বেঁচে থাকা। স্ত্রী আগে সরে পড়লে, বয়েস থাকলে আবার পিঁড়িতে গিয়ে বোসো। স্বামী আগে গেলে হাতড়াও বিত্ত কী পড়ে রইল। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, তবে একসেপশান ইজ নো ল। প্রচলিত প্রথা আর বিশ্বাসের তলায় নগ্ন সত্য চাপা পড়ে থাকে। সত্যপ্রকাশে মানুষের সভ্যতা এখনও লজ্জা পায়।’
ভুবনদা মনের আনন্দে কলকল করে কথা বলে যাচ্ছেন। এদিকে টেবিলের তলায় আশালতার একটা পা আমার পায়ের পাতার ওপর। ইচ্ছে করে রেখেছে, না অনিচ্ছায়! মাঝে মাঝে চাপ দিচ্ছে। কতরকম কী করছে! আমি কী অতসব বুঝি। আমার ভেতরটা অদ্ভুত এক ভালো লাগায় কেমন কেমন করছে। আমি বেশ বুঝতে পারছি, আশালতা একটু একটু করে আমাকে খেয়ে ফেলছে।
ভুবনদা আবার অর্ডার দিয়ে ফিশফিঙ্গার আনিয়েছেন। বেশ ভালো লাগছে। মাস্টার্ডের ঝাঁঝ নাকে টের পাচ্ছি। রাত নামছে বাইরে। আলোর খেলা। গাড়ি বাড়ছে, লোক বাড়ছে। কোলাহল বাড়ছে। মৃত্যু, দুঃখ, শোক এসব কিছু আছে না কি?
ভুবনদা আবার শুরু করলেন, ‘মানুষকে বলতে শুনবি, মানুষকে ভালোবাস।
আমি মানুষ বড়ো ভালোবাসি। কখন? যখন বোঝার ভারে ক্লান্ত। তখন শক্তসমর্থ একজন মানুষ চাই। তার মাথায় মালটি তুলে দিয়ে পেছনে পেছনে চলো, ঝাড়া হাত—পায়ে। আমি মানুষ বড়ো ভালোবাসি। কখন? আমার জমিতে ফসল ফলাবে কে? কে আমার গোলা ভরে দেবে? কারা আমাকে, আমার বাছাকে দুধে—ভাতে রাখবে? খেতমজুর। কে আমার উৎপাদন যন্ত্রের চাকা ঘুরিয়ে আমাকে শিল্পপতি বানাবে? দিনমজুর। আমি মানুষ বড়ো ভালোবাসি। কখন! যখন আমার কুটোটি নাড়ার অভ্যাস থাকে না, তখন মানদা আর মোক্ষদা আমার বড়ো প্রিয়। আমার এসট্যাবলিশমেন্টের দরজায় বন্দুকধারী মানুষ, আমি ওপরে উঠব, আমার পায়ের তলায় মানুষের পিঠ। আমি তীর্থে যাব পুণ্য সঞ্চয়ে মানুষের কাঁধে চড়ে। এমনকী চিতায় চড়তে যাব চার কাঁধে চেপে; কিন্তু মনেপ্রাণে আমি চার দেয়ালের বাসিন্দা। তোমরা সবাই থাকো আমার প্রয়োজনে। তোমার প্রয়োজনে আমি নেই।
আমার জন্মের জন্যে একজন পিতা ও একজন মাতার প্রয়োজন ছিল। বুদ্ধি না পাকা পর্যন্ত তাঁদের রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন ছিল। যেই আমার পিপুলটি পাকল তখন আমি এক স্বতন্ত্র অস্তিত্ব। হাতখরচের টাকা না পেলে সন্তান পিতার কান কামড়ে দিতে পারে। পিতাও সন্তানের হাত কামড়ে দিতে পারে। শেষে দুজনেই হাসপাতালে। এ যুগের প্রকাশিত ঘটনা। যা প্রকাশ পায়নি তা আমরা মনে পুষছি।’
এই রেস্তোরাঁর সবাই ভুবনদার খুব প্রিয়। আঙুলের ইশারা করতেই একজন ছুটে এলেন, ‘চা ঠিক জমছে না রে! হার্ড টকস হচ্ছে তো! কফি চাই। তোমরা কফি খাবে?’
আশা বলল, ‘অবশ্যই খাব।’
ভুবনদার চেহারাটা দেখার মতো। টকটকে ফরসা। এতখানি উঁচু নাক। একমাথা এলোমেলো চুল। তাকিয়ে দেখছি, আর ভাবছি, ভগবানের কী খেলা! কারোকে মর্কট করেছেন, কারোকে রাজপুত্র। যত রাত বাড়ছে আশালতার রূপও তত খুলছে। শ্যাম্পু করা চুল, ঘাড়ের কাছে দুলছে। বাতাসে উড়ছে। মুখের ত্বকের তলায় যেন আলো জ্বলছে। একটা আভা। চোখ দুটো যেন স্বপ্নের দেশে গেছে।
ভুবনদা কত কী বলছেন! আশালতা পায়ে পায়ে খেলা করছে। ভালো ভালো সুখাদ্য জিভ ছুঁয়ে, গলা পেরিয়ে পেটে ঢুকছে। এপাশে—ওপাশে কতজন আসছে যাচ্ছে। কোনোকিছুই মনে ধরছে না আমার। আমার একটা ইচ্ছা হচ্ছে, আশালতাকে ভুবনদার পাশে বসাই। জীবনের পাশে। খুব সিম্পল একটা রেজিস্ট্রি ম্যারেজ। আজ থেকে আমি ভগবানের কাছে প্রার্থনা করব, ঈশ্বর এমন একটা ঘটনা ঘটিয়ে দাও। যারা সুখে আছে, তাদের আরও সুখী করো ভগবান।
ভুবনদা কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘পারফেক্ট।’ তারপর আবার সেই কথা, ‘দ্যাখ, সকলেরই এক বক্তব্য, আমরা এক সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে চলেছি। সমাজ বলে আর কিছু থাকবে কি? আমরা প্রত্যেকেই উদাসীনতার শেষ সীমায় হাজির। পরস্পর মারমুখী। মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে, দেশে দেশে হাতাহাতি। আইনস্টাইন ঠিক এই আলোচনাই করতে গিয়েছিলেন আর এক বিখ্যাত চিন্তাবিদের সঙ্গে। আর একটি বিশ্বযুদ্ধ মানেই মানবজাতির সম্পূর্ণ ধ্বংস। তাতে সেই জ্ঞানী ব্যক্তি বলেছিলেন, Why are you so deeply opposed to the disappearance of the human race?
সামাজিক বিশৃঙ্খলার জন্যে বিজ্ঞান অনেকাংশে দায়ী। মানুষ আর মানুষের ওপর নির্ভরশীল নয়। তৈরি হয়েছে যন্ত্রসমাজ। দয়া, মায়া, প্রেম, প্রীতি বেরিয়ে চলে গেছে। নতুন দৃষ্টিভঙ্গি হল মানুষও এক যন্ত্র। থিকিং, থিংকিং অ্যানিম্যাল। আহার, নিদ্রা, মৈথুন, প্রজনন। সংখ্যায় বাড়ো। রাষ্ট্রনায়ক সৈনিক চায় প্রতিবেশী রাজ্যে হামলার জন্যে। ক্যাপিটালিস্ট মানুষ চায় ক্রেতা হবার জন্যে। যন্ত্রে উৎপাদন জৈব মানুষের ভোগে লাগাতে হবে, তবেই না মুনাফা! তবেই না আমার গাড়ি, বাড়ি, ফ্যান, ফোন, ফ্রিজ। সংখ্যায় বাড়ো। রাজনীতি ঝান্ডা তোলার মানুষ চায়। মানুষের মধ্যে জাতিভেদ না থাক ধনভেদ থাকা চাই। একের পেছনে আর এক যদি লেগে না থাকে শাসনের সহজিয়া পদ্ধতি ভেঙে পড়বে। নীতিটা যে, এলোমেলো করে দে মা, লুটেপুটে খাই। মানুষকে মানুষ দিয়েই মারতে হবে। মানুষ দিয়েই ভয় দেখাতে হবে। কমিউনিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা আঙুল তুলে দেখাবে, দ্যাখো, দ্যাখো, কমপালশান আর টেরার বাধ্যবাধকতা আর ভীতির কী জাদু! আমাদের শক্তি আজ কোথায় উঠেছে। সোস্যাল ডেমক্রেসি পৃথিবীতে অচল। Full intellectual growth is dependent on the foundation of open or concealed slavery.
এই বিশাল, বৈরী পৃথিবীতে মানুষ কখনোই একা বাঁচতে পারবে না। জীবন একটা যৌথ প্রচেষ্টা। চাঁদির চাকতি ছুঁড়ে আলু, পটল, ঢ্যাঁড়শ পাওয়া যায় ঠিকই। সেবাও হয়তো পাওয়া যায়। তার মানে এই নয়, সামাজিক সদ্ভাবের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। জনপদ মধ্যরাতে যখন ঘুমে অচেতন মানুষ তখন কার ভরসায় চার দেয়ালের আশ্রয়ে পড়ে থাকে! চৌকিদার! বিজ্ঞানের যুগেও কোনো কোল্যাপসিবল গেট, রোলিং শাটার, কী থান্ডার লক নিরাপত্তার শেষ কথা নয়। তবু ঘুম আসে, স্বপ্ন আসে। কেন আসে? সেই বোধ থেকে আসে, আমি মানুষের সমাজে বাস করছি। মহাশূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছি না। ভারি সুন্দর একটি ইহুদি—প্রবাদ আছে—A man can eat alone, but not work alone.
জ্ঞানের অভাব নেই তবু চিন্তাশীল মানুষ আজ একঘরে। কে কার কথা শোনে! যন্ত্রের যুগে মানুষ এক বোধশূন্য গতি। কোনোকিছুতেই আর আস্থা রাখা যায় না। সমস্ত প্রতিষ্ঠান মর্যাদা হারিয়েছে। সমস্ত ইজম খড়ের পুতুল। সমস্ত আশ্বাস এক ধরনের ভাঁওতা। পৃথিবী এখন বড়ো বেশি উত্তপ্ত। মানুষ যেসব বাঁধন দিয়ে পশুটিকে খাঁচায় আটকে রেখেছিল সে বাঁধন খুলে গেছে। পশ্চিমের দেহবাদ আর জড়বাদ আমাদের মগজ ধোলাই করে দিয়েছে। সংস্কৃতি মৃত। সহবত অদৃশ্য। সংকর মতবাদে মানুষ একটি ফুটো চৌবাচ্চা। মুখ দিয়ে ঢোকাও, পেছন দিয়ে বের করে দাও, পেছন দিয়ে বের করে দাও আর ইন্দ্রিয়ে পাখার বাতাস মারো। ও মরছে মরুক, আমি তো বেঁচে আছি। দুটো হাত নিজের সেবাতেই ব্যস্ত। দুটো পা শুধু নিজের লক্ষ্যবস্তুর দিকেই ছুটছে। চোখ দুটো নিজের ভালো ছাড়া কিছুই দেখতে পায় না। মগজ কু—চক্রে ঠাসা। এমন জীবের সমাজ থাকে কী করে! তাই যে—কোনো বাড়িতে সারারাত ধরে ডাকাতি হতে পারে। নিত্য বোমাবাজি যেন মন্দিরের সন্ধ্যারতি। দশজনে ধরে একজনকে পেটাতে পারে। কেউ মাথা ঘামাবে না। গৃহবধূর গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া চলে। রামের ঘর সামলাতে শ্যামের উপদেশ পাওয়া যাবে না। শিক্ষিত মানুষ শুধু একটি কথাই বলতে শিখেছে—নান অফ মাই বিজনেস। আমি বেশ থাকলেই বেশ হয়ে গেল। মাঝে মাঝে শুধু অভিযোগ—পাড়ায় আর টেকা যায় না ভাই। কুকুর আর অ্যান্টি—সোস্যালস এত বেড়েছে। চতুর্দিকে করাপশান। অ্যান্টি—সোস্যালস তো আমরা সকলেই। অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, দুজনেই তো এক শ্রেণিতে। আমরা নিজের ত্বকে ক্রিম ঘষছি, আয়নায় মুখ দেখছি, বড়ো বড়ো উপদেশ ছুঁড়ছি আর শ্যান পাগল বুঁচকি আগল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। সমাজের ত্বকে খড়ি ফুটছে, চুল উসকো, চোখ লাল। নিজের পেটে ভিটামিন, অন্যের পেটে বাতাস। এক ধরনের ধর্মও বেঁচে আছে। বাঁক কাঁধে তারকেশ্বর। কালীর মন্দিরে দীর্ঘ লাইন। হাতে চ্যাঙারি, লটকানো জবাব শুঁড় দুলছে, কোণে গোঁজা ধূপ ধোঁয়া ছাড়ছে। এদিকে ভিখিরি দেখলে গৃহকর্তা তেড়ে উঠছেন। চিবিয়ে চিবিয়ে উপদেশ ঝাড়ছেন—’চাকরি করতে পারো না! মহাশয় এদেশে চাকরি আছে। ক্ষমতা থাকলেও বঙ্গ সন্তানের জন্যে আপনার বুক কাঁদবে। আমি ছাড়া সবাই লোফারস, স্ক্যাম অফ দি আর্থ।’
নীরবে কিছুক্ষণ কফি খেয়ে ভুবনদা খুব দুঃখের গলায় বললেন, ‘মানুষ যতটা অমানুষ হয়েছে অমানুষ তার চেয়ে বেশি অমানুষ হয়নি। কুকুর কুকুরই আছে। বাঘের স্বভাব বাঘের মতোই আছে। মানুষ আর মানুষ নেই।’
আমরা রাস্তায় বেরিয়ে এলুম। হাজরা রোড সামনে পড়ে আছে। ওপাশে কালীঘাট। খুব ইচ্ছে করছে মায়ের কাছে একবার যাই। সেখানে আমার মতো কত অসহায় লোক আছে।
আশালতা একটি ট্যাক্সি ধরেছে। কিছু বলা বা বোঝার আগেই ‘ওঠো, ওঠো’ বলে পেছনের সিটে ঢুকিয়ে আমার পাশে বসে পড়ল। ট্যাক্সি শুনে নিল কোথায় যেতে হবে। রাস্তা উলটোদিকে ছুটছে। আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছে। মনে হচ্ছে, ফাঁদে পড়ে গেছি। ভেতরটা ছটফট করছে। পাড়ায় ফিরতে দেরি হয়ে যাবে। প্রবীর, দুখীদা আমার জন্যে বসে থাকবে।
বেল বাজাতেই, প্রথমে বেরিয়ে এলেন কাজের মহিলাটি। মধ্যবয়সি। বেশ ফিটফাট, আধুনিকা। না, এটা খুবই ভালো। সমান স্ট্যাটাস। পেছনে পেছনে এল ছোট্ট, সাদা, লোমঅলা কুকুর। তার কী লম্ফঝম্ফ আদর! তাকে সামলে ভেতরে ঢুকতে খানিক সময় লেগে গেল।
প্রবেশ দরজাটা বন্ধ হতেই মনে হল কবরের নিস্তব্ধতা। নিজেদের পায়ের শব্দ, পোশাকের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। বাইরে অতবড়ো একটা শহর গুলতানি করছে, তবু কেমন যেন গা ছমছম করছে। দোতলায় ওঠার সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে আশালতা বলল, ‘ভূতের বাড়ি। কী, ভয় করছে?’
‘ভয় নয়, কেমন একটা অনুভূতি হচ্ছে।’
দোতলায় উঠে এলুম। লম্বা, টানা বারান্দা। ডানপাশে সার সার নানা মাপের ঘর। ঘরের ভেতর ঘর। বেশ সাজানো। পরিচ্ছন্ন। সেই ঘরে বসলুম।
‘আমি কিন্তু বেশিক্ষণ বসতে পারব না। অনেক দূর যেতে হবে।’
‘তোমার কে আছে, যে প্রদীপ জ্বেলে সারারাত জানলার ধারে বসে থাকবে। আজ তুমি এইখানে আমার কাছে থাকবে। আমার পাশে শোবে। দুজনে অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করব।’
‘দুজনে সারারাত না খেয়ে বসে থাকবে আমার জন্যে।’
‘কে তারা?’
‘আমার দুই বন্ধু, প্রবীর আর দুখীদা।’
দূরে দেয়াল ঘেঁষে ঝকঝকে একটা ড্রয়ার, তার ওপর সুন্দর ফোটোফ্রেমে তিনটি ছবি। একটা সুন্দর ফুলদানিতে ফুল।
আশালতা সেইটার সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে ডাকলে, ‘এখানে এসো, একটা আশ্চর্য জিনিস দ্যাখো! মাঝখানের ছবিটা।’
চমকে উঠলুম, ‘এ কি? এ তো আমার ছবি!’ পেছনে সমুদ্র।
সমুদ্রের ধারে আমার কোনো ছবি নেই। আমার কোনো ছবিই নেই। এ আবার কী? আজকের রাতটা ভীষণ গোলমেলে। নেশাভাঙ করলে এমন হতে পারে।
আশালতাকে জিজ্ঞেস করলুম, ‘এ কে?’
‘স্কটিশে আমরা একসঙ্গে পড়তুম। আমার বন্ধু। ভীষণ বন্ধু।’
‘এখন কোথায়?’
‘আমার সামনে।’
শ্মশান থেকে বেরোবার পর, আমরা আপনি থেকে তুমি হয়ে গেছি। আশালতার হাত দুটো চেপে ধরে বললুম, ‘প্লিজ বলো না।’
‘পিছু হেঁটে চলে গেল।’
‘কোথায় গেল?’
‘দেখছ না পেছনে কী!’
‘সমুদ্রে? সমুদ্রে চলে গেল?’
‘সমুদ্র নিয়ে গেল।’
‘সমুদ্র যদি নিয়েই গেল আমি বেঁচে রইলুম কী করে?’
‘সে তুমিই জানো!’
এইবার আমার পিছু হাঁটার পালা। সোফায় বসে পড়লুম। নিস্তব্ধ বাড়ি। সুন্দর কিছু রান্না হচ্ছে। গন্ধ ভেসে আসছে। লোমঅলা কুকুরটা আর একটা সোফায় বড়ো আরামে ঘুমোচ্ছে।
জিজ্ঞেস করলুম, ‘নাম কী ছিল?’
‘তমাল।’
‘পদবি?’
‘বোস।’
‘আমি তো ব্যানার্জি। পৃথিবীতে একই রকম দেখতে দুটো লোক হয়?’
‘হয়। যমজ হলে হয়।’
‘আমি যাই। আর এক মিনিটও আমি বসব না!’
‘ঠিক আছে, যাও। কাল দেখা হবে। তবে সমাধান মনে হয় আমার কাছেই আছে। সাবধানে যাও—বি অ্যালার্ট, অ্যাকসিডেন্ট অ্যাভার্ট।’
রাস্তায় বেরিয়েই একটা বাস পেয়ে গেলুম। রাত হয়েছে। মধ্যবিত্ত মানুষের দাপাদাপি কমেছে। কেষ্টবিষ্টুরা সব বারে ঢুকে পড়েছে। উত্তর কলকাতার বারনারীরা এলাকা ছেড়ে বড়ো রাস্তায়। দুখীদার দোকানে যখন ঢুকলুম ঠিক এগারোটা।
‘আগে দু’ গেলাস জল।’
‘সে না হয় দিলুম, ছিলে কোথায়?’
প্রবীর বাসি খবরের কাগজ পড়ছিল, মুখ না তুলে বললে, ‘শ্মশানে, ওদের এক কোলিগ আত্মহত্যা করেছে।’
‘তুই জানলি কী করে?’
‘তোদের অফিসে গিয়েছিলুম তোর খোঁজে।’
দুখীদা বললে, ‘মন খারাপ করো না। ভীরুরাই আত্মহত্যা করে।’
‘দুখীদা! তুমি তো পৃথিবীর এতকিছু জানো, আমার একটা সমস্যার সমাধান করে দেবে?’
‘বল কি সমস্যা?’
‘আমার কি কোনো যমজ ভাই ছিল?’
দুখীদা হাতের জল ঝেড়ে আমার সামনে এসে বসল। প্রবীর খবর—কাগজ থেকে মুখ বের করেছে। দুখীদা বললে, ‘এ পাড়ার পুরনো লোকেরা বলতে পারবে। তোমার যমজ ভাই থাকলে, সে গেল কোথায়? তোমারই তো জানার কথা!’
‘এ—পাড়ার পুরনো মানুষরা বলতে পারবে না। আমার তিন বছর বয়সে, আমার পিসিমা এখানে এনে মানুষ করেন। আমাদের আদি বাড়ি ছিল কোন্নগরে।’
‘তাহলে কোন্নগরে গিয়ে জানতে হবে। হঠাৎ এই সমস্যাটা এল কোথা থেকে? না জানলেই বা ক্ষতি কী?’
প্রবীর আমার পাশে বসে বললে, ‘কী ব্যাপার বল তো?’
প্রবীরের শরীর খুব ঠান্ডা। আমার খুব গরম, পিত্তির ধাত, তাছাড়া মেয়েদের কথা ভাবি। প্রবীর আমার পিঠে তার ঠান্ডা হাতটা রেখেছে। বড়ো ভালো লাগছে।
‘আশালতার বাড়িতে ফোটোফ্রেমে আমার একটা ছবি।’
‘আশালতা কে?’
‘আমার সঙ্গে কাজ করে।’
‘তোকে ভালোবেসে তোর একটা ছবি রেখেছে। রাখতেই পারে।’
‘জীবনে কেউ কখনো আমার ছবি তোলেনি, তার ওপর সমুদ্রের ধারে।’
‘তারপর? ছবিটা যার, তার নাম?’
‘তমাল বোস।’
‘তা, সেই তমালকে জিজ্ঞেস করলেই তো হয়।’
‘তমালকে পাওয়া যাবে না। সে ওপরে।’
‘তমালের ঠিকানা নিয়ে তার বাড়িতে যা। তমালের বাবার নাম, তমালের মায়ের নাম?’
‘আশালতা হয়তো বলবে, তার আগে আমার দিক থেকে আমার রহস্য খুঁজে বের করতে বলেছে।’
‘তুই আশালতার বাড়িতে গেলি কেন? তুই কে, তোর জানার দরকার কী? এইভাবেই চলুক না।’
‘শ্মশানে গিয়েছিলুম, সেখান থেকে ধরে নিয়ে গেল।’
প্রবীর আর কিছু বললে না। কেমন যেমন গম্ভীর হয়ে গেল। দুখীদা টেবিলে খাবার—দাবার সাজাতে সাজাতে বললে, ‘নামটা খুব সুন্দর, আশালতা।’
ঘরের তালা যখন খুলছি, তখন রাত ঠিক বারোটা। সেই বিরাট ভিক্টোরিয়া টেবিল। ক্যাচোর— ম্যাচোর খাট। সাত দিন হয়ে গেল ঘরটা পরিষ্কার করা হয়নি। ধুলো ধুলো গন্ধ। জামা—টামা খোলার আগে গোদা চেয়ারটায় বসলুম। খুব হাসতে ইচ্ছে করছে। আমার এমন বরাত, আপনার লোক কেউ আর বেঁচে নেই। বাবার মৃত্যুর তিন মাস পরে আমার জন্ম। জন্মের সাত দিন পরে মা গত। তারপর কে জানে কী হয়েছিল! আমার বাবার কোনো ছবি নেই। মায়ের একটা ছবি ওই দেয়ালে ঝুলছে। বিশ্বাস করে নিতে হবে, ওই আমার মা।
এক—একটা মানুষ কী দুর্ভাগা!
আমার কেউ কোথাও নেই। একেবারে নিঃসঙ্গ। আমি আছি আর আছে একটা ঢাউস পৃথিবী। মালিক বসে আছে টাটে। পাল্লা ঝুলিয়ে, ‘ফ্যালো কড়ি মাখো তেল, আমি তোমার পর’! তেমন শিক্ষা নেই যে আমেরিকা চলে যাব। তেমন বংশপরিচয় নেই যে এখানে, স্বদেশে বুক ফুলিয়ে বেড়াব! ভীষণ রাগ হচ্ছে আমার। এক মানব আর মানবী হয়তো কোনো এক শ্রাবণের রাতে জৈব নিয়মে শরীরে শরীর রেখেছিল। আর ঠিক দশ মাসের ব্যবধানে ঢ্যাঁ করে নেমে এল আর একটি মানব সন্তান। ভাগ্যের পুরিয়া কপালে নিয়ে।
এ তো এক সর্বনাশা ব্যাপার! পুরুষ আর রমণী। আমি বেশ জানি আজ রাতে আমি যদি আশালতার কাছে থাকতুম, তাহলে আমি কিছু না জেনেও সবকিছু জানার পরীক্ষায় পাশ করে যেতুম। ভেতরে আছে ‘মিলনবিদ্যা’। এই বিদ্যায় পাগলও পটু। তা নাহলে আমাদের পাড়ার পাগলিটার অমন নিটোল সুন্দর একটি ছেলে হত না। পাগলি তাকে নর্দমার জল খাওয়াত। কোন পাগলে পাগলির সঙ্গে প্রেম করেছিল! সেই ছেলেটা মরে গেল না। এক নিঃসন্তান ব্যবসাদার দম্পতি তাকে গ্রহণ করেছে। আদরে মানুষ হচ্ছে।
আজ রাতে এই ঘরে থাকলে কাল সকালে আমি নির্ঘাত পাগল হয়ে যাব। আমরা দু’ভাই। আমি ব্যানার্জি রইলুম, আর আমার দেহসংলগ্ন ভাইটা হয়ে গেল বোস। তাকে কেউ নিয়ে গেল! আমার মৃত্যুপথযাত্রী মায়ের পাশ থেকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল। অতি দ্রুত কাজ সেরেছে। এমনও হতে পারত, আমাকেই নিয়ে গেল। আমি ‘আমি’ বলছি কী করে। পাশাপাশি দুটো ‘আমি’ শুয়েছিল। কোন ‘আমি’টা আমি? ছবির ‘আমি’টা, যে আর পৃথিবীতে নেই, সেইটা? মা এইটা? যেটা বসে আছে এই গোদা চেয়ারে। এই ‘আমি’টা যদি ‘বোস’ হত, তাহলে আজ আর পৃথিবীতে থাকত না। সমুদ্রে তলিয়ে যেত। কী সর্বনাশা! সামান্য এদিক—ওদিক হলে আমি আর নেই! আশালতার টেবিলে আমি ফ্রেমে বাঁধানো একটা ছবি। আশাকে বিয়ে করলে ‘কায়া’ আর ছায়া এক হয়ে যাবে। নতুন ছবি তুললে বলা যাবে, এইটা যখন আমি ছাত্র ছিলুম, আর এইটা হল এখন। ওটা ‘অতীত’, এইটা ‘বর্তমান’।
রাত একটা। সেই সাঁ সাঁ শব্দটা শুরু হল। ওপরে একজনের হাঁপানি আছে। শ্মশান ঘুরে আসা অফিসের পোশাক ছেড়ে ফেললুম। অনেক ঘুরেছি আজ। চেষ্টা করে দেখি ঘুম আসে কিনা! চোখ বুজিয়ে আশালতাকে দেখছি। চুল, মুখ, আরও অনেক কিছু।
প্রত্যেকের জীবনেই সঙ্গীর প্রয়োজন। দুটো মনের কথা, প্রাণের কথা। আশা বলেছিল, আজ তুমি আমার পাশে শোবে। একা আমি শহরের এ—প্রান্তে, একা আশা শহরের ও—প্রান্তে। আশার সঙ্গে জীবন জুড়লে আমাকে এ—পাড়ার পাট উঠিয়ে দিতে হবে। দুখীদা, প্রবীর, এদের ছেড়ে আমি থাকব কী করে? আমরা তিনজনে তো একটা পরিবার। সেই কত দিন থেকে চলছে আমাদের জীবন। একসঙ্গে বিয়ের নিমন্ত্রণ খেতে গেছি। থিয়েটার দেখতে গেছি। শীতকালে পিকনিক করেছি।
আমি আর তমাল একই সঙ্গে, একই মায়ের পেট থেকে, একই সময় ভূমিষ্ঠ হলুম। তমালের ভাগ্য একরকম হল, আমার ভাগ্য আর—একরকম। তমাল বড়োলোক হয়েছিল। বাঁচল না বেশিদিন। আত্মহত্যা করল, না দুর্ঘটনা! সবকিছু জানতে চাই। জানাবার কেউ নেই।
এখন আমি কী করি!
ভোর হল। একটু পরেই দুখীদার দোকান খুলবে। দিনের আলোয় ঘরের অন্ধকার পুরোটাই পালাল, মনের অন্ধকারও অনেকটা গেল। মর্নিং ওয়াকে বেরোবার আগে যাঁরা দোকানে আসেন, তাঁদের ঠোঁটে কাপ উঠে গেছে। দুখীদা আমার দিকে একটা কাপ এগিয়ে দিলে।
‘প্রবীর?’
‘ওই তো আসছে।’
প্রবীর আমার পাশে বসে বললে, ‘নিশ্চয়ই ঘুমোতে পারিসনি?’
‘ওই একবার করে আসে, আবার চলে যায়।’
‘আচ্ছা শোন, আশালতার বাড়িতে না গেলে ছবিটা তুই কোনোদিনই দেখতে পেতিস না।’
‘তা ঠিক।’
‘তাহলে মনে কর, তুই দেখিসনি। জলের তলায় পৃথিবীর তিনের চার ভাগ তলিয়ে আছে। তুইও সেইরকম জন—অরণ্যে তলিয়ে যা।’
‘কিন্তু আশালতা!’
‘কী বলছে?’
‘বলছে, তুমি তমাল।’
‘পরিষ্কার করে বল।’
‘আমাকে চাইছে। আমি তোদের ছেড়ে, আমাদের এই সুন্দর জীবন ছেড়ে যেতে পারব না। অসম্ভব!’
‘চাইছে মানে?’
‘বলছে, আমার সঙ্গে থাকো।’
‘বিয়ে? একালের আধুনিকারা অবশ্য বিয়ে নাম উচ্চারণ করে না। থাকাই বলে। গ্রামে—গঞ্জে বিয়ে হয়।’
প্রবীর বললে, ক্যাট—ক্যাটে সকালে এইসব আলোচনা চলে না। রাত্তিরে হবে। দুখীদার এই সময়টায় ভীষণ খদ্দেরের চাপ। কথা বলার সময় নেই। আমাদের তিন কাপ চা খাওয়া হয়ে গেল। আর না। দোকানের পেছন দিক থেকে মায়ার গলা ভেসে আসছে। কাকে খুব বকাবকি করছে।
অফিসের দোরগোড়ায় গিয়ে মনে হল, আজ আর অফিস করা যাবে না। একটা নকল পরিচয় নিয়ে ঘুরছি। কে আমি? জ্ঞান যখন হল তখন দেখলুম এক শ্যামবর্ণ মহিলাকে আমি পিসিমা বলে ডাকছি। ভীষণ মোটা এক ব্যবসায়ী ভদ্রলোককে পিসেমশাই বলছি। ভদ্রলোক বেশ ভালো ছিলেন। আমার বরাতে ভালো মানুষ টেঁকে না। এক জ্যোতিষী বলেছিলেন, ‘তোমাকে যে ভালোবাসবে, হয় সে দূরে চলে যাবে, না হয় মরে যাবে।’
একটা বুথ থেকে অফিসে ফোন করে আশালতাকে চাইলুম।
‘আসবে?’
‘কোথা থেকে বলছ?’
‘নিচে থেকে। রাস্তা।’
‘অফিসে আসবে না?’
‘না।’
‘শিবমন্দিরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকো।’
মিনিট পনেরোর মধ্যে এল। ‘কী হল?’
‘আগে অফিস পাড়ার বাইরে চলো।’
আধঘণ্টার মধ্যে আমরা সেই বাড়িটায় চলে এলুম। কাল রাতে অতটা বোঝা যায়নি। সাবেক আমলের সুন্দর বাড়ি। অতীতে ব্রাহ্মরা এইরকম বাড়ি করতেন।
‘মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি?’
‘হ্যাঁ।’
‘ব্রাহ্ম ছিলেন?’
‘কী করে জানলে?’
‘গিরিডিতে আমি এইরকম বাড়ি দেখেছি।’
দোতলার সেই ঘর। আশালতা পোশাক পালটে এল।
‘কি, রহস্যের সমাধান হল?’
‘না। আমার দিক থেকে হওয়ার আশা নেই। আমার ইতিহাস হারিয়ে গেছে। পঁচিশ বছর ধরে যা বিশ্বাস করে এসেছি সব ভুল। তুমি আমার পরিচয় বলে দাও।’
‘তোমার পরিচয়?’ আশালতা হাসছে।
কাল সারারাত ঘুম নেই। এখনও পর্যন্ত পেটে মাত্র তিন কাপ চা পড়েছে।
‘তোমার পরিচয়?’ আশা আবার প্রশ্ন করল।
আশালতা খুব ধীরে, খুব সন্তর্পণে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমার বাধা দেবার শক্তি নেই। আমার মুখ ঢুকে গেছে বুকের নরম তরঙ্গে। তমাল ডুবেছিল সাগরে। বন্ধন ক্রমশ দৃঢ় হচ্ছে।
আশালতা বলছে, ‘বারোটা বছর আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলে। সাগরের তীরে। তোমার পরিচয়—তুমি সাগর থেকে উঠলে। আর কতকাল একা একা থাকা যায়।’
ঘুমিয়ে পড়েছিলুম আশালতার বিছানায়। এত সুখ। যখন ঘুম ভাঙল তখন রাত। ধড়মড় করে উঠে বসলুম, আমাকে যেতে হবে। আমার প্রবীর, দুখীদা। রাত এগারোটা।
আশালতা ঘরে ঢুকে বললে, ‘উঠেছ? কুম্ভকর্ণও হেরে যাবে।’ কাছে এসে কানে কানে বললে, ‘পাশের ঘরে দেখবে চলো।’
সব আলো জ্বলছে। সাজানো খাবার টেবিলে ঝকঝকে ডিশ—প্লেট। ফুলদানিতে ফুলের স্তবক। সুন্দর সুন্দর চেয়ার। দুখীদার কাঠের খটখটে বেঞ্চ, কাঠের রংচটা টেবিল নয়।
তখন আমার মনে হল তমাল সাগরে ডুবেছিল, আমি কীসে ডুবলুম!