আমি উদ্ভট না মিসফিট
আমি উদ্ভট না মিসফিট? এই জগৎসংসারে সবাই যেমন চলছে তেমন চলতে পারি না কেন? এই সব প্রশ্ন যখন মনে আসছিল ঠিক তখন একটা মারুতি ভ্যান দ্রুত গতিতে পাশ দিয়ে চলে যেতে যেতে ব্রেক করে চলে এল আমার পাশে। গাড়ির কাচ কালো, ভেতরে ঠাণ্ডা মেশিন। চলছে বলেই বোধহয় সেগুলো নামানো হয়নি। ড্রাইভারের পাশে আসনে যে বসেছিল সে কাচ নামিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, টাইগার সিনেমাটা কোন দিকে পড়বে?
কলকাতায় বাস করে টাইগার চেনে না এমন হতে পারে না। বুঝলাম এরা নতুন। আমি জায়গাটা বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম কিন্তু লোকটা বুঝতে পারছিল না। হঠাৎ মনে হল ওরা যদি আমাকে লিফট দেয় তাহলে আমি ধর্মতলা পর্যন্ত এগিয়ে যেতে পারি আর ওদেরও উপকার হবে। লোকটি বলল, আমরা কলকাতায় নতুন। আপনি কি এখানে থাকেন?
না। আমি ওদিকেই থাকি। বললাম, আপনার গাড়িতে জায়গা থাকলে সঙ্গে যেতে পারি।
তাই নাকি? খুব ভাল হয়। উঠে পড়ুন।
পেছনের দরজা খুলে দিতেই গাড়িতে উঠলাম। দরজা বন্ধ করতেই গাড়ি ছুটল। আমি রাস্তা বলতে গিয়ে শুনলাম পেছন থেকে গোঙানির আওয়াজ ভেসে আসছে। চমকে পেছন ফিরে দেখলাম কেউ একজন ডিকিতে পড়ে আছে। হাত পা মুখ বাঁধা তার। আমি পাশে তাকালাম। সেখানে দুজন লোক বসে আছে নিস্পৃহ ভঙ্গিতে। জিজ্ঞাসা করলাম, এসব কী ব্যাপার?
সামনের লোকটি বলল, ওর দিন হয়ে গেছে। আজ বলি হবে। আমরাই করব ঠিক ছিল। এখন মনে হচ্ছে সেটা তোকে দিয়ে করালে ভাল হয়। অন্তত পুলিশ জানবে আমরা খুন করিনি। চুপচাপ বসে থাক যদি প্রাণে বাঁচতে চাস। টাইগার চেনাচ্ছে। বলা মাত্র বাকিরা হো হো করে হেসে উঠল। মদের গন্ধ নাকে লাগল।
আমাকে নামিয়ে দাও। থামাও গাড়ি। থামাও। চিৎকার করে বলতেই একটা শক্ত কিছু দিয়ে পেটে আঘাত করল আমার। কক করে পেট চেপে ধরলাম। তীব্র যন্ত্রণাতে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল প্রায়। লোকটি বলল, আবার চিৎকার করলে জন্মের মতো থামিয়ে দেব।
গাড়ি ছুটে চলেছে নির্জন রাস্তা দিয়ে। সেদিকে তাকাবার মতো ক্ষমতা আমার নেই। যন্ত্রণাটা কিছুতেই কমছিল না। এরা মাস্তান না ডাকাত আমি জানি না। তবে এরা অত্যন্ত নিষ্ঠুর তা বুঝে গিয়েছি। পেছনের লোকটাকে এরা খুন করবে। আমাকে একা এত রাত্রে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তুলে নিয়েছে কাজটা করাবে বলে। না করলে আমার ভাগ্যে কি আছে আমি জানি না।
ভ্যানটা থামতেই সামনে থেকে হুকুম হল, চটপট।
ওপাশের দরজা খুলে লোক দুটো লাফিয়ে নামল। ডিকি খুলে লোকটাকে টেনে হিঁচড়ে নিজে নামাল। মনে হল এই সুযোগ পালিয়ে যাওয়ার। আমি দরজা খুলতে যেতেই সামনের লোকটা আমার দিকে রিভলভার উঁচিয়ে বলল, তোকে নামতে হবে না। তুই এখানে বসেই গুলি ছুঁড়বি। চালাকি আমি একদম পছন্দ করি না।
আমি অজান্তেই মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম। সেটা দেখে লোকটা জিজ্ঞাসা করল, আগে কখনও খুন করেছিস? করিসনি তো?
হঠাৎ কিছু একটা ভর করল আমার ওপর। তিলজলা থেকে বাপের কাছে একটা লোক আগে প্রায়ই আসত। বিশেষ করে ইলেকশনের সময়। লোকটার নাম মহিম গুপ্ত। মুখে কাটা দাগ ছিল। ছুরি মেরেছিল কেউ। সে এলেই বাপ সবাইকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলে। সমাজবিরোধী হিসেবে লোকটার নাম কয়েকবার কাগজে বেরিয়েছে। আজ হঠাৎ সেই মহিম গুপ্তকে মনে পড়ল। পড়তেই বললাম, শেয়ার দিতে হবে।
তার মানে? খিঁচিয়ে উঠল সে।
আমি মহিমের জন্যে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
মহিম? কোন মহিম?
তিলজলার মহিম গুপ্ত। ও শেয়ার ছাড়া কোনো কাজ করে না। আমি করাও যা আর ওর করাও তা। চেনা যাচ্ছে?
লোকটা হঠাৎ দরজা খুলে নেমে গেল। ওর সাকরেদদের সঙ্গে কথা বলল। তারপর এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, তোমার আস্তানা কোথায়?
তুই থেকে তুমিতে উঠেছে দেখে সাহস বেড়ে গেল। জায়গাটা বললাম। তারপর জিজ্ঞাসা করলাম, মহিমকে ফোন করবে? ও আমার বাপের চামচে।
চামচে? তোমার বাপের নাম কী?
জবাব শুনে লোকগুলো এর ওর দিকে তাকাল। তারপরেই মুখের চেহারা বেশ বদলে গেল লোকটার, খুব ভুল হয়ে গেছে দাদা। একদম সেমসাইড করে ফেলেছি। কিছু মনে রাখবেন না। আপনার বাবা কিংবা মহিমকে কিছু জানাবার দরকার নেই।
এ কে?
বহুৎ হারামি। আমাদের কয়েকজনকে ফাঁসিয়েছে। আজ মওকা বুঝে তুলেছি। এই উঠে পড়। লোকটা হুকুম করতেই বাকিরা উঠে পড়ল। গাড়িতে ওঠার আগে সামনের সিটের লোকটা রিভলভারে ট্রিগার টিপল। দুবার। দুটো শব্দ বাজল। দেখলাম লোকটা পাশ ফিরে পড়ে আছে হাত-পা বাঁধা অবস্থায়। অন্ধকারে রক্ত বের হয়েছে কি না বোঝা গেল না।
গাড়ি চলেছে ফুল স্পিডে। আমার চোখের সামনে একটা মানুষ খুন হয়ে গেল কিন্তু আমার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই? উল্টে আমাকে খুন করতে হল না বলে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছি। যদি মহিমের নামটা মুখে না আসত তাহলে ওরা আমাকে বাধ্য করত খুন করতে। আমার অন্য কোনো পথ ছিল না। কিন্তু বাপের নামটা শোনামাত্র ওরা পালটে গেল কেন? ওই মহিম গুপ্তের নাম ওদের এতখানি বিচলিত করেনি। বাপ জানতাম সরকারি মহলে খুব প্রতিপত্তিশালী নেতা কিন্তু সমাজবিরোধীরাও এত খাতির করে?
ওরা গাড়ি ছুটিয়েছে নর্থের দিকে। জিজ্ঞাসা করলাম, এদিকে?
আপনাকে নামিয়ে দিয়ে আসছি দাদা।
দাদা! নামিয়ে দিয়ে আসছে? আমাদের বাড়ি চেনে নাকি? অথবা শেষবার আমার পরিচয় যাচাই করতে যাচ্ছে। যাকগে, আমারই সুবিধে হচ্ছে। বউবাজারের মোড়ে একটা পুলিশের জিপ দাঁড়িয়েছিল। দুজন অফিসার হাত দেখিয়ে গাড়ি থামাল। একজন এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার? এত রাত্রে, কোথায় যাওয়া হচ্ছে? কার গাড়ি?
সামনে বসা লোকটি বলল, কাজ ছিল। আমার বাপের নাম বলে বলল, ওর ছেলেকে পৌঁছে দিতে যাচ্ছি বাড়িতে। আপত্তি আছে?
অফিসার উঁকি মেরে আমাকে দেখল, ঠিক আছে। যান। গাড়ি আবার স্পিড তুলল! সামনের লোকটি হাসল, দাদার নাম বললে দারুণ কাজ হয়।
আমি চুপচাপ বসেছিলাম। এসব কী হচ্ছে? যা আমি কোনো কালে চাইনি, সেই কাজটাই এরা করছে। আমার এতদিনের লড়াই তাহলে বৃথা হবে। হঠাৎ নজরে এল থানা আসছে। এই একটা জায়গায় আমি জীবনে যাইনি। তেইশ বছর বয়সে চাকরির দরখাস্ত করেছিলাম। সরকারি চাকরি। ইন্টারভিউ হয়েছিল লিখিত পরীক্ষার পরে। শুনেছিলাম পুলিশ ভেরিফিকেশনের পর অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার আসবে, খুব ভাল লাগছিল সে সময়। এই প্রথম কাউকে ধরে বা কারও দয়ায় আমি চাকরি পাচ্ছি না, একেবারে নিজের যোগ্যতায় চাকরি করতে চলেছি। ব্যাপারটা আমার বাপকে জানাইনি। একদিন সকালে একটা রোগামত লোক চোরের মতো বাড়িতে এল। বাপ তখন বাড়িতে নেই। এসে বলল ওই থানার একজন অফিসার আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। পাড়ার এক সেলুনে তিনি দাড়ি কামাচ্ছেন। আমার সঙ্গে পুলিশের কী কথা থাকতে পারে ভেবে যখন চুপ করেছিলাম তখন লোকটা বলল, আপনার চাকরির ব্যাপারে। বাবু খুব ভাল লোক, হয়ে যাবে। চলুন।
গিয়েছিলাম। ওই সেলুনটায় আমরা সাধারণত ঢুকি না। সবসময় হিন্দি গান বাজানো হয়। ঢুকে দেখলাম সেলুন ফাঁকা। পুলিশ দাড়ি কামাচ্ছে বলেই বোধহয় লপেটারা তখন বাইরে। লোকটা বেশ মোটা, মুখে সাবানের ফেনা। রোগা লোকটা বলল, এনেছি স্যার।
আপনি বিপ্লবচন্দ্র? আয়না দিয়ে লোকটা আমাকে দেখল।
না। আমি শুধু বিপ্লব।
ওই একই হল। ইন্টারভিউ তো ভালই হয়েছে। আমি এক কলম ফেবারে লিখলে চাকরি। বুঝতে পারছেন? তবে আমার তো না লিখে উপায় নেই। জলে বাস করে তো কুমিরের সঙ্গে ঝগড়া করা যায় না। আপনার বাবাকে কুমির বলিনি কিন্তু, ওটা কথার কথা। লোকটা হাসল, আসলে, আপনার বাবাও জানেন, এসব কেসে আমরা কিছু পেয়ে থাকি।
কী পান?
কী পাই? যার যেমন চাকরি সে তেমন দেয়। আপনার চাকরি মন্দ নয়।
কেন পান?
কেন পাই? লোকটা এবার সরাসরি আমাকে দেখল। মুখে সাবান থাকায় এর মুখ পরে চেনা মুশকিল হবে। তবে কপালে কাটা দাগ ছিল।
লোকটা হাসল, রসিকতা হচ্ছে? হে হে। ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। শুনুন আমি তো আপনার বাবাকে বলতে পারব না। বললে বড়বাবু, বড়বাবু থেকে এসি, ডি সি, সিপির কানে চলে যাবে কথাটা। দিয়ে দেবে রাইটার্সের ভি আই পি গেটে ডিউটি। জীবন কয়লা হয়ে যাবে। কিন্তু আপনাকে বলতে পারি। না, না টাকা পয়সা চাই না। পোস্টিং চাই। বড়বাজারে। লালবাজারকে ধরলে কিছু করতে পারব না। আপনার বাবা যদি বলে দেন তাহলে কর্তারা না করতে পারবে না। আপনি আমার হয়ে ওঁকে রাজি করাবেন বলতে। ঠিক আছে?
কেন?
কেন? কেন মানে? আমি যে খুব ভাল রিপোর্ট দেব আপনার ফাইলে।
আমি আজ পর্যন্ত কোনো খারাপ কাজ করিনি যে আপনি খারাপ রিপোর্ট দেবেন।
অ।
আমি যেতে পারি?
হেনা নামে একটা মেয়ে আপনার বন্ধু?
হেনার নাম ওর মুখে শুনব ভাবিনি। অবাক হয়ে বললাম, কেন?
ওর বাড়িতে যে যান তা আপনার বাবা জানেন?
কেন?
আমার রিপোর্টে সত্যি কথাটা যে লিখতে হবে। হেনাকে নিয়ে আপনি নার্সিং হোমে গিয়েছিলেন অ্যাবরশন করাতে। আপনার মর্যাল ক্যারেক্টার কিরকম তা জানলে এই চাকরি কি পাবেন। ভেবে দেখুন।
আপনি মিথ্যেবাদী। যদি পুলিশ না হতেন তাহলে আপনাকে মারতাম। কথাটা বলার সময় চিৎকার করে উঠলাম।
লোকটা চট করে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, এই, দেখছ কি, আমার টাইম নেই। দাড়ি কাটো।
আমি বেরিয়ে এলাম। রাগে শরীর জ্বলছিল। কীরকম বানিয়ে গল্প বলল লোকটা। এই হলো পুলিশ। বাবার নেতা এদের সভায় গিয়ে এদেরই প্রশংসা করেন। মনে হয়েছিল এত বড় মিথ্যে কাগজে কলমে কখনও লিখতে পারবে না লোকটা।
সেই রোগা লোকটা পেছন পেছন আসছিল, আপনি রাগ করবেন না। শুধু বাবাকে একটু বলে দিন, বাবু আপনার ভাল রিপোর্ট দেবে। বুঝতেই পারছেন।
আমি জবাব দিইনি। চাকরিটা আমার হয়নি। এই পুলিশ অফিসার কীরকম রিপোর্ট দিয়েছিল বোঝাই যাচ্ছে, কিন্তু কী লিখেছিল তা জানি না। বাপকে আমি কিছু বলিনি। বললেই তিনি নিশ্চয়ই আমাকে কৃতার্থ করতেন। সেটা চাইনি। ভেবেছিলাম, এমনিতেই চাকরিটা হয়ে যাবে। ভারতবর্ষে তা হয় না। এদেশে যারা ভোট দেয় তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার আছে। কিন্তু সেই অধিকার আদায় করতে গেলে টাকা লাগে। আর যেহেতু এদেশের নিরানব্বই ভাগ মানুষের টাকা নেই তাই ওসব অধিকার-টধিকার কাগুজে ব্যাপার। আমি শুধু নিজের মত প্রতিবাদ করে স্বস্তি পেতে পারি, জানি সেই স্বস্তিটাও হরিণের লুকানোর মতো।
থানাটার সামনে ভ্যানটাকে দাঁড় করতে বললাম আমি। সামনের লোকটা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকাল। খুব নরম গলায় জিজ্ঞাসা করল, খুব দরকার আছে ভাই?
আমি চুপচাপ মাথা নাড়লাম। ভ্যান থামল। দরজা খুলে নেমে সোজা থানায় চলে এলাম। দুটো সেপাই বসে গল্প করছিল। তাদের জিজ্ঞাসা করলাম, ওসি কোথায়?
বড়বাবু এখন কোয়াটার্সে। মেজবাবু আছেন, ভেতরে যান।
দ্বিতীয়জন জিজ্ঞাসা করল, কী কেন?
আমি উত্তর না দিয়ে ভেতরের ঘরে ঢুকে দেখলাম একটা লোক গেঞ্জি গায়ে টেবিলের ওপর পা তুলে দিয়ে চেয়ারে মাথা হেলিয়ে ঘুমোচ্ছে। এই লোকটাই কি মেজবাবু? আমি পেপার ওয়েট তুলে শব্দ করতে মেজবাবু ঘুম ভাঙল। চোখ খুলে পা না নামিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কী চাই?
একটু আগে ময়দানে একটা মার্ডার হয়েছে।
কোথায়?
ময়দানে। লোকটাকে গুলি করে মারা হয়েছে। আমি নিজের চোখে–।
হাত তুলে থামতে বললেন মেজবাবু, ময়দান আমাদের জুরিসডিকশন নয়। যত্তসব ঝুট ঝামেলা। এই এলাকায় খুন হলে আসবেন। যান।
দেখুন, যারা খুন করেছে তারা থানার বাইরে গাড়িতে বসে আছে।
অ্যাঁ?
হ্যাঁ। আপনি এখনই ওদের অ্যারেস্ট করুন।
ইয়ার্কি মারছেন? ময়দানে খুন করে কেউ আমার থানার সামনে এসে অপেক্ষা করবে ধরা দেওয়ার জন্যে। রাতবিরেতে ইয়ার্কি মারছেন?
বেশ চলুন। ওদের সঙ্গে রিভলবার আছে কিন্তু।
রিভলবার শব্দটায় কাজ হলো। মেজবাবু লাফিয়ে উঠে হাঁকাহাঁকি করতে লাগলেন। মিনিট দুয়েক মধ্যে রণসাজে সজ্জিত হয়ে বাইরে বার হওয়া মাত্র মারুতিটা সোঁ করে বেরিয়ে গেল সামনে থেকে। ধর ধর করেও তার নাগাল পাওয়া গেল না। আমার দেরি দেখে বোধহয় আগেই ইঞ্জিন চালু করে রেখেছিল।
মেজবাবু মিলিয়ে যাওয়া গাড়ির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ওই গাড়িতে কজন ছিল বলুন তো?
ড্রাইভারকে নিয়ে চারজন।
হুম। গাড়ির নাম্বারটা নোট করেছেন?
মনে করতে পারলাম না। গাড়িতে ওঠার সময় সন্দেহ হয়নি, তাই নাম্বার দেখিনি। গাড়িতে বসে থাকার সময় তো নাম্বার দেখার সুযোগ নেই। আর এখানে নামার সময় যদি আমি নাম্বার দেখতে যেতাম তাহলে ওরা আমাকেই সন্দেহ করত।
না। আমি দেখিনি।
তাহলে কী দেখেছেন? আসুন। সদলবলে মেজবাবু থানায় ঢুকে গেলেন।
আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। বেশ বুঝতে পারছিলাম থানায় গেলে আর কোনো কাজের কাজ হবে না, উল্টে আমাকে ঝামেলায় ফেলবে ওরা। অথচ লোকটার গাফিলতিতে খুনিরা ধরা পড়ল না, আমি ফুটপাতে ধরে হাঁটতে লাগলাম। বাঁ দিকের গলি দিয়ে গেলে পাড়ায় শর্টকাটে পৌঁছানো যায়। সেটাই ধরলাম। ময়দানে মৃতদেহ নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। তখন টনক নড়বে মেজবাবুর। কৃতিত্ব দেখানোর জন্যে তিনি আমাকে লালবাজার পাঠাবেন। আর সেখানে পুলিশ আমাকে জেরা করে জেরবার করে ছাড়বে। অপরিচিত লোকের গাড়িতে কেন আমি উঠলাম? অত রাত্রে ভবানীপুরের ফুটপাতে কেন দাঁড়িয়েছিলাম? কোথায় গিয়েছিলাম তার আগে? ওরা যখন কাউকে খুন করবেই আমাকে কেন সাক্ষী হিসেবে নিয়ে গিয়েছিল? আমাকে দিয়ে খুন করানোর গল্প যদি সত্যি হয়, তাহলে সেটা করল না কেন? তার ওপর ওই লোকগুলোর পরিচয় কী? বাপের নাম শুনে যদি ভয় পেয়ে থাকে, তাহলে আমার বাপ নিশ্চয়ই তাদের চেনে। এসব প্রশ্নের উত্তর ঠিকঠাক দিলেও ওরা খুশি হবে না অথচ খুনীদের ধরার কোনো সম্ভাবনা থাকবে না। আমি চেষ্টা করেছিলাম এটুকুই আমার সান্ত্বনা। মেজবাবু আমাকে পরিচয় জিজ্ঞাসা করেননি। তিনি আমাকে চেনেনও না। তাই আমার কাছে পৌঁছবার কোনো রাস্তা ওঁর কাছে খোলা নেই।
বাড়ির সামনে যখন পৌঁছলাম তখন রাত সাড়ে তিনটে। পাড়া নিঝুম। বাড়িতে একটাও আলো জ্বলছে না। ভাগ্যিস আমার ঘরের একটা দরজা রাস্তার দিকে আর সেটাও তালা দিয়ে আমি বের হই। তালা খুলে ভেতরে ঢুকলাম। জামাকাপড় খুলে পাজামা পরে শুয়ে পড়লাম অন্ধকারেই। বাথরুমে গেলে আলো জ্বালতে হবে। সেইটে চাইলাম না।
ঘুম ভাঙল বেশ বেলায়। ভাঙালো ছোটভাই। বাবা তোকে ডাকছে।
বুঝলাম ঝড় উঠবে। কী আর হবে? চলে যেতে বলবেন বড়জোর। ধীরে সুস্থে বাথরুম সেরে দাঁত মেজে খবর নিলাম, এ বাড়ির চায়ের পাট শেষ হয়ে গেছে। এখন রান্নার সময়। চা পাওয়া যাবে না। জামাপ্যান্ট পরে বাপের ঘরে ঢুকলাম। ঘরে তখন বাপ ছাড়া যে লোকটি বসে আছে তাকে দেখেই চিনতে পারলাম, মহিম গুপ্ত।
বাপ জিজ্ঞাসা করলেন, কাল রাত্রে কোথায় ছিলে?
আমার এক সহপাঠিনীর বাড়িতে গিয়েছিলাম। ফিরতে রাত হয়েছিল।
সেটা আমি জানি। মেয়েটি মাঝরাতে ফোনে জিজ্ঞাসা করেছিল তুমি বাড়ি ফিরেছ কি না। তারপর? তারপর কোথায় গিয়েছিলে?
কোথাও যাইনি। আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ একটা মারুতি ভ্যানে মিথ্যে কথা বলে আমাকে তুলে নেওয়া হয়।
তোমাকে মিথ্যে কথা বলে তুলল আর তুমি গেলে? বাচ্চা ছেলে নাকি? যদি তোমাকে দিয়ে খুন করাতো? পারতে সারাজীবন এই দায় থেকে নিজেকে বাঁচাতে? ছি ছি। তোমার আর কবে কাণ্ডজ্ঞান হবে বল তো? ওদের কাছে প্রথমে মহিমের নাম করেছ! মহিমকে তুমি চিনলে কী করে? বাপ গলার স্বর পাল্টালেন।
আপনার কাছে আসতে দেখেছি।
আমার কাছে তো হাজারটা লোক আসে। হোয়াই মহিম?
আমার মনে হয়েছিল উনি ক্ষমতাবান লোক।
মহিম তিলজলায় থাকে তা জানলে কী করে?
খবরের কাগজে পড়েছি।
মহিম গুপ্ত চুপচাপ শুনছিল। এবার হাত নাড়ল, ঠিক আছে দাদা। আপনি রাগ করবেন না। আমার নাম বলেছিল বলে প্রাণ বেঁচে গেছে। ওসব লোক খুব খতরনাক। তারপর আপনার ছেলে শুনে ভদ্রতা করে পৌঁছতে এসেছিল কিন্তু তখনই উনি বেইমানি করে ফেললেন বলে ওরা বলেছে। থানার বাইরে দাঁড় করিয়ে উনি ভেতরে গিয়েছিল পুলিশকে খবর দিতে। ঠিক তো?
এই প্রশ্নটা আমার উদ্দেশ্যে।
হ্যাঁ। আমি মনে করি খুনীদের শাস্তি হওয়া উচিত।
ঠিক কথা। কিন্তু ওরা আপনার জান বাঁচাল, বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছিল সেটা আপনি ভুলে গেলেন কেন? এটা কি ঠিক কাজ?
বাপ জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি পুলিশকে ঠিক কী বলেছ?
বলেছি ওরা ময়দানে একজনকে আমার সামনে গুলি করে মেরেছে। কিন্তু মেজবাবু বললেন ময়দান নাকি তার এলাকায় পড়ে না। তারপর যখন উঠলেন তখন ওরা নাগালের বাইরে চলে গিয়েছে।
বাঃ নাম-ধাম বলেছ? মহিমের নাম?
না। কিছুই বলিনি।
মহিম গুপ্ত জিজ্ঞাসা করল, গাড়ির নাম্বার?
নাম্বার আমি নিজেই দেখিনি তো বলব কী করে?
মহিম গুপ্তকে এবার একটু সহজ দেখাল। বলল, ওটা ওদের পলিটিক্যাল ব্যাপার ভাই। রোজ গ্রামে-গঞ্জে রাজনৈতিক সংঘর্ষে কত মানুষ মারা যাচ্ছে, কেউ এ নিয়ে মাথা ঘামায় না। এটা ঠিক যুদ্ধের মত। যুদ্ধে শত্রুকে মারলে তাকে খুন বলা হয় না। আপনি একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন। তবে ওরা ভেবেছিল আপনি আমার নাম আর গাড়ির নাম্বার পুলিশকে দিয়েছেন। তা যখন দেননি, তখন ওদের বুঝিয়ে বলব মাথা ঠাণ্ডা রাখতে। এসব নিয়ে আর চিন্তা করবেন না। আপনি কতবড় লোকের ছেলে। দাদার একটা আলাদা ইজ্জত আছে। যান।
আমি ফিরে যাচ্ছিলাম বাপ বলল, শোনো। তোমার ওই সহপাঠিনীর নামটা কী যেন? আমার মনে পড়ছে না!
হেনা।
হ্যাঁ। হেনা আমার বড়মাসির নাম হেনা ছিল। যাক গে, মেয়েটিকে বেশ বুদ্ধিমতী মনে হল। কোথায় আছে, মানে কী করে?
চাকরি করে।
কোথায়?
আমি জানি না। মনে হয় কোনো কোম্পানিতে।
সহপাঠিনীর বাড়িতে মাঝরাত পর্যন্ত আড্ডা মারো, অথচ সে কী করে তার খোঁজ রাখো না। ওয়ার্থলেস। মেয়েটি আমাকে বলেছে সে-ও চায় তুমি ব্যবসায় ঢোকো। আর সেটা করতে গেলে এন. আর. আই-দের অফারটা নেওয়া উচিত। একথা সে বলেছে। বুঝলাম তোমার মতো বাতাস খেয়ে বেঁচে থাকার মেয়ে সে নয়। একদিন আসতে বলবে, ওর সঙ্গে কথা বলে আমার ভাল লেগেছে। বাপ ইশারা করলেন চলে যেতে।
সেটা সম্ভব নয়। না বলে পারলাম না।
কেন? তিনি তাকালেন।
আমার সঙ্গে ওর কোনো সম্পর্ক নেই। ইনফ্যাক্ট একবছর ধরে নেই। কাল সেটা আরও স্পষ্ট হয়ে গেল। আমাকে ওর উদ্ভট বলে মনে হয়।
সত্যি? একথা বলেছে সে? ঠিক কথা বলেছে। তোমার মতো উদ্ভট লোকের সঙ্গে কোনো ভদ্রলোক সম্পর্ক রাখতে পারে না। মেয়েটার ওপর শ্রদ্ধা আমার আরও বেড়ে গেলে। শোনো, ওসব পাগলামি ছাড়ো। রোমে থাকতে হলে রোমান হওয়া উচিত।
তার মানে আপনার কাছে ওই আলমারির বইগুলো মিথ্যে?
না। কখনই না। চণ্ডীপাঠ, গীতাপাঠ করলেই যেমন সন্ন্যাসী হয়ে যায় না কেউ তেমনই কার্ল মার্কস, লেনিন পড়লেই সেই আমলের কম্যুনিস্ট হতে হবে তার কোনো মানে নেই। গীতা পড়েও যেমন লোক সংসারের প্যাঁচ-পয়জারে অভ্যস্ত থাকে, তেমনি ক্যাপিটাল পড়েও পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া উচিত।
চা খেতে খেতে খবরের কাগজের একটা খবরে চোখ আটকালো। মন্ত্রীর সঙ্গে তার সেক্রেটারির বিরোধ লেগেছে আলুর দাম বাঁধা নিয়ে। সেক্রেটারি পরিষ্কার বলেছেন মন্ত্রীর দুর্নীতির কারণেই আলুর দাম বাড়ছে এবং জনসাধারণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এত স্পষ্ট কথা বলা সত্ত্বেও সেই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। বছর পাঁচেক আগে হলে এরকম খবর পেলে খুব চিঠি দিতাম। আমি এখনও মনে করি আমাদের মতো সাধারণ মানুষের মতো প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম হল খবরের কাগজ। খবরের কাগজ সেটা যদি কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের মুখপাত্র না হয় তাহলে সেখানে মানুষ স্বাধীন মতামত প্রকাশ করতে পারে। দশটা চিঠির একটা ছাপা হয়েছে। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। যার উদ্দেশ্যে চিঠি তিনি গ্রাহ্য করেননি। আমি শেষবার যে চিঠি লিখেছিলাম তাতে প্রশ্ন তুলেছিলাম গত আঠারো বছরে পার্টি ক্ষমতায় আসার আগে উঁচু মাঝারি এবং নিচু তলার নেতাদের সম্পত্তির পরিমাণ কি ছিল এবং এখন কি হয়েছে তার একটা পরিসংখ্যান নেওয়া হোক। যদি কেউ ঠিকঠাক আয়ের উৎস না দেখাতে পারেন তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিক পার্টি।
কিন্তু সেই চিঠি ছাপা হলেও কোনো কাজ হয়নি। আমার চিঠি তো সামান্য, লক্ষ্য করেছি, আজ যা খবরের কাগজের হেডলাইন, খবর হিসেবে দারুণ চাঞ্চল্য তুলল, পরশু সেটা লোকে ভুলে যাচ্ছে, খবরের কাগজও নতুন খবরে উৎসাহী। সরকারও জেনে গিয়েছে কোনোমতে দিন সাতেক কাটিয়ে দিতে পারলেই সমস্যাটা নিয়ে কেউ আর মাথা ঘামাবে না। মনে পড়ছে দেবশ্রী রায়চৌধুরীর কথা। মেয়েটি যখন উধাও হয়ে গেল প্রতিটি খবরের কাগজে তাকে নিয়ে কত লেখালেখি। যে করেই হোক মেয়েটিকে খুঁজে বের করতেই হবে। শেষপর্যন্ত সে তার প্রেমিকের সঙ্গে ধরা পড়ল। কিন্তু পুলিশের অসাবধানতায় তারা পালিয়ে গেল ট্রেন থেকে। আর তাদের খোঁজ পাওয়া গেল না। দেবশ্রীর বাবা হন্যে হয়ে মেয়েকে খুঁজে শেষ পর্যন্ত হাওড়ার এক হোটেলে খুন হয়ে গেলেন। সেই দেবশ্রী আজও নিখোঁজ। আর কোনো খবরের কাগজে ওকে নিয়ে কোনো লেখা বের হয় না। কেউ ওর খোঁজে এখন সময় দিচ্ছে বলে জানা নেই।
চা শেষ করে একটা টাকা দিয়ে সোজা কলেজ স্ট্রিটে চলে এলাম। তখন সবে অফিস খুলছে। নিজের টেবিলে যাওয়া মাত্র বেয়ারা বলল প্রকাশক আমাকে ডাকছেন। গেলাম। ভদ্রলোক একটা ক্লাসিক ধরিয়ে বললেন, শোনো, আজ থেকে তোমাকে আর প্রুফ দেখতে হবে না।
কে? আর একটা খারাপ খবর শোনার জন্যে তৈরি হলাম।
সুভদ্রার কাছে তোমার কথা সব শুনলাম। তুমি যে আমার এখানে আটশো টাকার বিনিময়ে প্রুফ দ্যাখো একথাটা ওকে বলতে পারিনি। অতএব যা আমি বলতে পারিনি তা তোমাকে করতে দিতে পারি না। অন্তত আমার এখানে। বুঝতে পেরেছ? প্রকাশক জিজ্ঞাসা করলেন।
পরিষ্কার। নির্লিপ্ত হবার চেষ্টা করলাম।
কিন্তু তুমি এডিটিং-এর কাজটা করতে পার।
এডিটিং না বলে রিরাইটিং বলুন। অন্যের হয়ে লিখে দিতে হবে। না। আমি ভেবে দেখলাম এরকম কাজ আমার দ্বারা হবে না।
এমন ভাব দেখাচ্ছ যে তুমি স্বচ্ছন্দে পাতার পর পাতা চমৎকার উপন্যাসে লিখে ফেলবে, আর পাঠকরা সেটা স্বজনের উপন্যাস ভেবে লুফে নেবে?
সেই ঝুঁকি তো আপনি নিচ্ছেনই। আচ্ছা, তাহলে চলি।
বসো। তুমি এমন নীতিবাগীশ কেন হে?
কী করব বলুন। হয়ে গেছি।
আচ্ছা ধরো, তোমার খুব প্রিয়জনের মারাত্মক অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। এখন রক্ত দরকার। অথচ তার গ্রুপের রক্ত কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। এই সময় দালাল এসে প্রস্তাব দিল বেশি টাকা দিলে সে জোগাড় করে দিতে পারে। যেহেতু তখনই রক্ত না দিলে তোমার প্রিয়জন বাঁচবে না তুমি কী করবে? তাকে মেরে ফেলবে তোমার নীতির জন্যে? প্রশ্নটি করে প্রকাশক আমার দিকে স্থির চোখে তাকালেন।
আপনি একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতির কথা বলছেন।
না। ওই অ্যাকসিডেন্টের পেশেন্ট আর সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার সমস্যার মধ্যে পার্থক্য খুবই কম। এখন যা অবস্থা বেঁচে থাকা মানেই যুদ্ধ করা। আর এই যুদ্ধে ন্যায়নীতি নিয়ে যত কম মাথা ঘামাবে তত তুমি সুবিধে পাবে।
আপনি কী বলতে চাইছেন? উপন্যাসটা রিরাইট করা উচিত?
তুমি যেতে পার।
বেরিয়ে এসে নিজের চেয়ারে বসলাম। কিছুক্ষণ পরে এটাকে আর নিজের চেয়ার বলে ভাবতে পারব না। এই সময় ম্যানেজার ভদ্রলোক আমার সামনে এলেন, ভাই বিপ্লব। অত্যন্ত বিপদে পড়েছি। আমাকে সাহায্য করতে পার?
ওঁর দিকে তাকালাম। এইরকম কথা কখনও ওঁর মুখে শুনিনি।
তোমার বউদি অ্যানিমিক, শরীরে রক্ত কম। চিকিৎসা চলছিল। কদিন আগে জানতে পারলাম ব্লাড ক্যানসার। বাঁচিয়ে রাখার জন্যে প্রচুর টাকা দরকার। আমার মত গরিব মানুষের পক্ষে যা করা সম্ভব তা করছি। কিন্তু আরও টাকা দরকার। ভদ্রলোক করুণ গলায় বললেন।
সর্বনাশ। কিন্তু ওঁকে বাঁচাতে তো হবে। অফিস থেকে টাকা চেয়েছেন?
হ্যাঁ। স্যারকে বলেছি। শুনেই উনি কুড়ি হাজার টাকা দিয়েছেন। বিনা সুদে এরকম ধার কেউ দেবে না। এত টাকা আমি রিটায়ার করলেও পাব না। উনি বলেছেন, আগে স্ত্রীকে বাঁচান, টাকা শোধ করার কথা পরে ভাববেন। উনি আমার কাছে দেবতা। কিন্তু আরও দশহাজার দরকার। ওঁর কাছে চাইতে সঙ্কোচ হচ্ছে। তুমি যদি টাকাটা জোগাড় করে দাও, তাহলে চিরকৃতজ্ঞ থাকব ভাই।
দশ হাজার টাকা?
হ্যাঁ। ডাক্তার তাই বলেছেন। আমার অবস্থা দেখে খুব কম করে বলেছেন।
আমার মাথায় ঢুকছিল না কিছু। দশ হাজার টাকা দেবার ক্ষমতা নেই। অথচ ওই টাকা দিলে ভদ্রলোকের স্ত্রীকে বাঁচানো মুশকিল হবে। আমি এম. এ. পাশ করা এক আদর্শবান মানুষ অথচ দশ হাজার টাকা সঞ্চয়ে নেই, জোগাড় করে দেবার ক্ষমতা নেই।
বিপ্লব।
ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম। কী বলি? নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছিল। যদি মানুষের উপকারে আসতে না পারি তাহলে বেঁচে থাকার মানে কী?
তোমার ওপর খুব ভরসা করে আছি। একটু দ্যাখো ভাই।
দেখছি।
উনি নিজের জায়গায় চলে যেতেই কয়েকটা ভাবনা ভেবে ফেললাম। বাপকে বললে হয়তো টাকা পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু কী কারণে নিচ্ছি জানলে তিনি দেবেন না। যে টাকা ফেরত পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না, সেই টাকা উনি বের করবেন না। আর যদি বা দেন অনেক শর্ত আরোপ করবেন। ভদ্রলোকের স্ত্রীকে বাঁচাবার জন্যে না হয় আমার সব আদর্শ এক্ষেত্রে ভুলে থাকলাম। দ্বিতীয় ব্যক্তির কথা মনে করতে চাইলাম যে ধার দিতে পারে। অবশ্য ধার নিয়ে কবে শোধ করব সেটা আমিই জানি না। সঙ্গে সঙ্গে হেনার মুখ মনে পড়ল। হেনা ইচ্ছে করলে দিতে পারে। কখনও ওর কাছে অমি একটা টাকাও চাইনি। হেনা কি আমাকে শর্ত দেবে? একটু ভাবলাম। তারপর সোজা প্রকাশকের ঘলে চলে গেলাম। ভদ্রলোক কিছু লিখছিলেন, অবাক হয়ে তাকালেন।
ঠিক আছে, কাজটা আমি করব।
গুড। সুমতি হয়েছে বলে ধন্যবাদ।
কিন্তু তার জন্যে আমাকে অ্যাডভান্স দিতে হবে।
অ্যাডভান্স? কাজটা কেমন হল না দেখে কি টাকা দেওয়া যায়?
সেটা আপনার সমস্যা। কিন্তু আমার অ্যাডভান্স চাই।
হুম। কত?
দশ হাজার।
পাগল নাকি। চল্লিশ টাকা দামের বই একটা এডিশন হলে লেখকই অত টাকা পাবে না। কী বলছ ভেবে বলো। তোমাকে একটা কমিশন দেব ঠিকই সেটা কি দাঁড়াবে তা বিক্রির ওপর নির্ভর করছে। প্রকাশক সরাসরি বলে দিলেন।
কিন্তু ওঁর বই তো বছরে অন্তত পাঁচটা এডিশন হয়।
ভদ্রলোক আমার দিকে তাকালেন, হঠাৎ টাকার দরকার পড়ল কেন।
কারণটা বলতে গিয়ে সামলে নিলাম। ওটা বললে নিজের দর বাড়ানো হবে। আমি যে কত মহৎ, মানুষের উপকার করি, এটা বলতে ভাল লাগবে না। তাছাড়া ওই ম্যানেজারবাবুকেও জড়ানো হবে। আমি যা করি না, সেই মিথ্যে কথাই বললাম, আমার দরকার আছে।
ঠিক আছে। দিচ্ছি। কিন্তু দশ দিনের মধ্যে পুরো পাণ্ডুলিপি চাই। প্রকাশক চেক বই লিখতে লাগলেন। বললাম, অ্যাকাউন্ট পেয়ি করবেন না।
মামার বাড়ি নাকি? অডিটার কি আমার মামা?
টাকাটা আজই দরকার।
উঃ। ভদ্রলোক চেকটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। না, আমার কথা রেখেছেন উনি। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সোজা ম্যানেজারবাবুর সামনে গিয়ে চেকটা রাখলাম, এটা ক্যাশ করে নেবেন। আপনাকে তো ব্যাঙ্কে যেতেই হয়।
চেক দেখে ওঁর চোখ বড় হল, সে কী? স্যারের চেক? উনি–উনি!
ওঁকে আপনার কথা আমি কিছুই বলিনি। টাকা যে আপনার দরকার তা ওঁকে কেন বলতে যাব? এখন চেষ্টা করুন, যাতে আপনার স্ত্রী সুস্থ হয়ে ওঠেন। আমি সরে এলাম। টেবিলে বসেও দেখলাম ভদ্রলোক এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি বের করলাম। এখন আমি কাজটা করতে বাধ্য। যে কাজের জন্যে টাকা নিয়েছি সেটা নেবার আগে মনে হয়েছিল খুব সহজসাধ্য। এখন কি রকম ভয় করতে লাগল। যদি খারাপ হয়। যদি আমার কলম ছোঁয়ানোর কারণে এই বই তেমন বিক্রি না হয়?
প্রথম পাতাটা আবার পড়লাম। এবার মনে হল ভুলটুল যাই থাকুক না কেন প্রত্যেক লেখকের যেমন নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে স্বজনবাবুরও কিছু আছে। মাঝে মাঝেই আবেগের টোকা দিতে তিনি খুবই পটু। প্রথমবার লিখতে গিয়ে বুঝতে পারলাম কোনো লেখা পড়ে সমালোচনা করা অথবা সহজেই লেখা যায় বলে মনে হওয়া এক জিনিস আর সেটা কাগজে কলমে লেখা আর এক জিনিস। দেখে দেখে লিখছি। শুধু মাঝে মাঝে বাক্য পাল্টাচ্ছি কিন্তু তাতেই প্রচুর সময় বেরিয়ে যাচ্ছে। এইভাবে চললে দশ দিন কেন দশ মাসেও কাজটা করা যাবে না।
বিকেলবেলায় বের হলাম। সারাদিন বুঝে গিয়েছি একমাত্র বানান ঠিক করা আর ছোটখাটো শব্দ জোড়া ছাড়া আমার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। প্রত্যেকটা জিনিসের সাফল্যের পেছনে অনুশীলন করা প্রয়োজন, যে কখনও সাইকেল চালায়নি তাকে সাইকেল দিয়ে চালাতে বললে সে কিছুতেই সক্ষম হবে না। লেখার ক্ষেত্রে আরও কিছু বাড়তি ক্ষমতা দরকার। স্বজন মুখার্জি যত খারাপই লিখুন না কেন সেটার পেছনে তার দীর্ঘদিনের অধ্যবসায় রয়েছে, যা অস্বীকার করার উপায় নেই।
অতএব হার স্বীকার করতেই হবে। আর তা করলে দশ হাজার টাকা ফেরত দিতে হবে। কিন্তু আমি দশ হাজার টাকা কোথায় পাব? বাবার কাছে যাওয়ার বদলে হেনার ফ্ল্যাটের সামনে এসে যখন দাঁড়ালাম তখন সাতটা বেজে গিয়েছে। বেল টিপলাম। দরজা খুলল না। হেনা কি তাহলে এখন ফেরেনি? দ্বিতীয়বার একটু ধরে রাখলাম বোতামটা।
ঝট করে দরজা খুলে গেল। মাথায় তোয়ালে মোড়া, পরনে হাউসকোট, মুখে পৃথিবীর সমস্ত বিরক্তি নিয়ে হেনা দাঁড়িয়ে আছে।
কী ব্যাপার? আবার?
প্রশ্ন দুটো এমনভাবে করল সে যে আমার মনে হল ফিরে যাওয়া উচিত।
প্রয়োজন আছে।
কী প্রয়োজন? কেন তুমি এভাবে আমাকে বিরক্ত করতে আসো?
আমি আর বিরক্ত করব না।
কিসে মানুষ বিরক্ত হয় সে জ্ঞান তোমার আছে? সরে দাঁড়াল সে, যা বলবার তাড়াতাড়ি বলো। আমাকে আবার বেরুতে হবে।
ঘরে ঢুকলাম। দরজা বন্ধ করে সে তোয়ালে খুলে চুল মুছতে লাগল। বুঝতে পারলাম এতক্ষণ বাথরুমে ছিল। ওর কানের পাশের চুলে এখনও জল লেগে আছে। জলের ফোঁটা মুক্তোর মতো ঝুলছে। আলো পড়ায় সেটাকে আরও রহস্যময় মনে হচ্ছিল। হঠাৎ আমি তীব্র আকর্ষণ বোধ করতে লাগলাম। ওই জলের ফোঁটাকে স্পর্শ করতে খুব ইচ্ছে হলো। হেনাকে এখন কী দারুণ টাটকা লাগছে, এই রাগ বা বিরক্তি ওই শরীরের সঙ্গে মানাচ্ছে না।
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো হেনার দিকে এগোলাম।
হেনা খুব অবাক হয়ে শুধু বলতে পারল, আরে!
কিন্তু আমি ততক্ষণে সেই মুক্তোর ফোঁটা ছুঁয়ে ফেলেছি। ছোঁয়ামাত্র আমার আঙুল ভিজে গেল। মুক্তো নেই? হেনা চট করে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে চাইল আমি কী করছি। ওর গালে আঙুল লাগতেই শরীরে বিদ্যুৎ বয়ে গেল। আমি দুহাতে ওকে জড়িয়ে ধরে কাছে টানলাম। হেনার শরীর প্রতিবাদ করতেই ওর ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরলাম।
চুম্বনের স্বাদ কীরকম হয় আমার জানা ছিল না। ওই মুহূর্তে স্বাদের কথা চিন্তাও করতে পারলাম না। আসলে কোনো চিন্তা করার মত মাথার অবস্থা আমার ছিল না। হেনার ঠোঁটে ঠোঁট চেপে আমি পৃথিবীটাই ভুলে গেলাম। আমি তখন অসাড়। আর সেই মুহূর্তে সাড়া দিল হেনা। ওর জিভের ডগায় এক নতুন পৃথিবীর দরজা খুলে গেল। হেনার হাতের বাঁধন আরও শক্ত হলো। শেষপর্যন্ত ও মুখ নামিয়ে আমার বুকে মাথা রাখল। আমরা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ।
হঠাৎ এক পা সরে দাঁড়িয়ে এক রাশ বিস্ময় মুখে নিয়ে হেনা জিজ্ঞাসা করল, একী হল? আমি কি স্বপ্ন দেখছি? তুমি বিপ্লব তো?
আমি নিঃশ্বাস ফেললাম। হাসবার চেষ্টা করলাম।
তোমার মাথা ঠিক আছে তো? ঘাড় কাত করল হেনা।
তোমাকে এখন দারুণ দেখাচ্ছে। কোনো রকমে বলতে পারলাম আমি।
কিন্তু এ তুমি কী করলে?
আমি–আমি। কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
এতদিন আসছ, মনে হত ভাল হয়তো বাসো, কিন্তু কখনও সীমা ছাড়াওনি। মনে মনে তোমাকে আমি আর পাঁচটা মানুষের থেকে আলাদা বলে ভাবতাম। কিন্ত একী করলে?
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়েছিলাম। তখনও আমার নিঃশ্বাস স্বাভাবিক নয়, সমস্ত মনে এক লক্ষ অশ্বারোহীর দৌড়ে যাওয়ার চাপ।
তুমি কি জানো আজ পর্যন্ত কেউ আমাকে চুমু খায়নি?
জানি।
জানো? কী করে?
ব্যাখ্যা করতে পারব না।
আচ্ছা! নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা ছিল যে আমার স্বামী হবে শুধু তাকেই এই অধিকার দেব। কিন্তু তুমি শেষ পর্যন্ত জোর করে প্রতিজ্ঞা ভাঙলে?
প্রতিজ্ঞা ভাঙতে হবে কেন?
কেন? কী ভেবেছ তুমি। আজ সাত-আট বছর ধরে তুমি যাওয়া আসা করেছ। আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছ, কিন্তু কখনও স্পর্শ করোনি। ক্রমশ আমার মনে হয়েছিল তুমি সাধারণ সহজ নও। কিন্তু আমি তো মেয়ে। আমি সব সময় চাইব যে আমার প্রেমিক হবে আমার স্বামী হবে সে সহজ থাকবে। তার ওপর ওই আদর্শের বাসি ভূত যা আজকের যুগে অচল, তা তোমার ঘাড়ে এমন ভাবে জেঁকে বসেছে যে আমার পক্ষে মানিয়ে নেওয়া অসম্ভব। আমার অপছন্দ তুমি জানো। তা সত্ত্বেও তুমি আজ জোর করে এই কাণ্ড করলে। তারপরও বলছ, প্রতিজ্ঞা ভাঙতে হবে কেন?
আমাকে বিয়ে করতে তোমার আপত্তি আছে?
অবশ্যই। এই তোমাকে বিয়ে আমি কখনই করতে পারি না। আত্মহত্যা করার শখ আমার নেই।
আত্মহত্যা?
নয়তো কী? স্বামীর দায়িত্ব তুমি নিতে পারবে?
চেষ্টা করব!
কীভাবে? কটা টাকা রোজগার কর তুমি? তোমার ওই আদর্শ বাধ্য করবে তোমাকে আধপেটা খেয়ে থাকতে। ঝুপড়িতে থাকা মানুষের শান্তিটুকুও আমি পাব না। অথচ তুমি শিক্ষিত, রবীন্দ্রনাথ থেকে শেক্সপীয়র পড়া মানুষ। কিন্তু কতটুকু তোমার দাম?
কিন্তু আমি যদি বাবার প্রস্তাব অ্যাকসেপ্ট করি?
তার মানে?
ওই এন. আর. আই-দের সঙ্গে ব্যবসায় নামি?
তুমি কি আমার সঙ্গে রসিকতা করছ?
একদম না। আমি সিরিয়াস।
তোমার বাবার সুপারিশ নিতে লজ্জা করবে না?
করবে। কিন্তু আজ আমার অন্য উপলব্ধি হয়েছে।
কী রকম?
একজন পরিচিত মানুষ তার স্ত্রীকে বাঁচাবার জন্যে আমার কাছে দশ হাজার টাকা চেয়েছিলেন। আমি প্রথমে ভেবেই পাইনি কি করে দেব? সামান্য দশ হাজার টাকা, শেষে যে প্রকাশনা সংস্থায় প্রুফ দেখি তার মালিকের কাছে টাকাটা চাইলাম। তিনি আগে আমাকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন একটি পাণ্ডুলিপিকে রিরাইট করে দিলে কিছু কমিশন দেবেন। বইটার কোথাও আমার নাম ছাপা হবে না। আমি প্রথমে রাজি হইনি। পুরো ব্যাপারটা শুধু বেআইনি নয়, অনৈতিক। কিন্তু দশ হাজার টাকা আগাম নিয়ে শেষপর্যন্ত সম্মতি দিতে বাধ্য হলাম। অথচ কাজটা করতে গিয়ে দেখলাম আমি পারছি না। আদর্শের দোহাই দিয়ে সরে দাঁড়ানো এক কথা আর কাজে নেমে নিজের অক্ষমতা আবিষ্কার করা অন্য কথা। শেষেরটা বেশি যন্ত্রণাদায়ক। আর কাজটা না করতে পারলে দশ হাজার টাকা শোধ করব কী করে তাও বুঝতে পারছি না। আমি আর কিছুর সঙ্গেই তাল রাখতে পারছি না হেনা।
অদ্ভুত তো। একজন পরিচিত লোক দশ হাজার চাইল আর তুমি ধার করে সেটা দিয়ে দিলে? ভদ্রলোক ফেরত দেবেন কবে?
আমি জানি না। জিজ্ঞাসা করিনি। কারণে উনি উত্তরটা দিতে পারতেন না।
চমৎকার। কিন্তু লিখতে গিয়ে যেমন আবিষ্কার করলে লেখাটা তোমার পক্ষে সহজ ব্যাপার নয় তেমনি ঘটনাটা তো ব্যবসার ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে!
তার মানে?
তুমি জীবনে কখনও ব্যবসা করোনি। এন. আর. আই-রা যে ব্যবসা করতে চাইছেন তার সম্পর্কে কোনো ধারণাই তোমার নেই। তুমি কি করে ভাবছ দুম করে সেই ব্যবসায় নেমে রাতারাতি সফল হবে? কোনো ট্রেনিং বা অভিজ্ঞতা ছাড়াই সাফল্য আসবে? একি ছেলের হাতের মোয়া? আমি কী বলছি বুঝতে পারছ?
হেনা কাছে চলে এল।
পারছি। কিন্তু তা হলে কোনোদিনই কিছু করা সম্ভব নয়। হেনা আমি তোমার সাহায্য চাই।
কীরকম?
আমাকে মানসিক শক্তি দাও।
ওটা কেউ কাউকে দিতে পারে না। নিজেকে অর্জন করতে হয়! হেনা ঘুরে দেওয়াল-ঘড়ি দেখল, ইস। কী দেরি হয়ে গেল। আমি যে–!
যেতেই হবে?
মানে?
না গেলেই নয়। বসো না। তোমার সঙ্গে গল্প করি।
হেনার মুখের চেহারা বদলে গেল। এরকম লাজুক মুখ কখনও দেখিনি আমি। আমি ওর হাত স্পর্শ করলাম। হেনা মুখ ফেরাল, বসো। আমি কিছু খাবার তৈরি করি। নিশ্চয়ই অনেকক্ষণ খাওনি তুমি। সে হাত ছাড়িয়ে ছুটে গেল ভেতরে।
কীরকম সহজ হয় গেল পৃথিবীটা। আমার চারপাশের ঘনিষ্ঠ মানুষজন চাইছে তাদের কাছে যেটা স্বাভাবিক সেই ব্যাপারটা আমি করি। আমি যদি কেরানিগিরি করি তাহলে ঘুম থেকে উঠে কেরাসিনের লাইনে না দাঁড়িয়ে দুনম্বরি করে কেরোসিন নিয়ে আসি বাড়তি ক্যানে। বাজারে গিয়ে চোটপাট করে দাম কমাই বাড়ি ফিরে এসে ছেলেমেয়েকে পড়াতে বসে বিদ্যাসাগর নেতাজির আদর্শের কথা বলি। ট্রামে, বাসে এর ওর পা মাড়িয়ে সম্ভব হলে কন্ডাক্টারকে ফাঁকি দিয়ে অফিসে যাই এগারোটা নাগাদ। লেট কেন হলো এই প্রশ্নের জবাবে চিৎকার করে বড়বাবুর পিলে চমকে দিই, আগে ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা ঠিক করতে বলুন সরকারকে তারপর ঠিক সময়ে অ্যাটেনডেন্স চাইবেন। তারপর খবরের কাগজ বা পার্টির মুখপত্র খুলে বসি টেবিলে। সেকশনের অন্যদের কাজকর্ম সম্পর্কে খোঁজ নিই। টিফিনের সময় দলের সঙ্গে ঘরে-ঘরে ইউনিয়নের ইস্যুগুলো প্রচার করি। বিকেলে মিছিলে যাওয়ার আগে সেকশন থেকে দিনের প্রাপ্য উপরির অংশটুকু নিতে যেন না ভুলি। কালো হাত গুঁড়িয়ে দাও বলতে বলতে একসময় মিছিল থেকে সটকে পড়ে বাড়ি ফিরে বউ-এর শাড়ির ভাঁজে উপরির টাকা গুঁজে রাখি। তারপর ছেলেমেয়েদের গল্প শোনাই কীভাবে হাসতে হাসতে ক্ষুদিরাম দেশের জন্যে ফাঁসিতে ঝুলেছিলেন। কিন্তু সেইসঙ্গে এও বলতে হবে আগে পড়াশুনা শেষ করে ভাল চাকরি যাতে পাও, সেই চেষ্টা করো।
আর যদি কেরানি না হয়ে ওপরতলার চাকুরে অথবা বড় ব্যবসায়ী হই তাহলে জীবন অন্য খাতে বইয়ে দেবার নামই স্বাভাবিক হওয়া। সকালে উঠে চা খেয়ে টয়লেটে ঢোকা। স্নান শেষ করে ব্রেকফার্স্ট খেয়ে স্ত্রীকে আদর করে গাড়িতে উঠে বসতে হবে, যেটা আমাকে অফিসে পৌঁছে দেবে নটার মধ্যে। সেখানে সারাদিন নানার সমস্যার সমাধান করে এম. ডি-কে তুষ্ট করা আমার কর্তব্য হবে। এর মধ্যে কনফারেন্স আর মিটিং, লাঞ্চের সময় ধান্দাবাজি এসব তো আছেই। অফিসের পর বাড়ি ফিরেই বউকে নিয়ে পার্টিতে যেতে হবে নিজের বউকে অন্য লোকের সঙ্গে গল্প করার সুযোগ দিয়ে অন্যের বউ-এর সঙ্গে ফস্টিনস্টি করতে করতে মদ গিলতে হবে পাঁচ-সাত পেগ। তারপর বাড়ি ফিরে বিছানায় লুটিয়ে পড়ার নাম জীবনযাপন, সহজ এবং স্বাভাবিক।
হ্যাঁ। আমাকেও স্রোতে ভাসতে হবে। স্রোতের উল্টোদিকে সাঁতার কাটলে বেশিক্ষণ ভেসে থাকা যে যায় না, তা এতদিনে টের পেয়েছি। আমি যেমন হেনাকে হারাতে চাই না, তেমনি নিজের কাছেও হারতে চাই না। রাত দশটা নাগাদ হেনার ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এসে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে এইসব কথা ভাবছিলাম। একটু আগে হেনা বাপকে ফোন করেছিল। বাপ না বলে এখন আমার বাবা বলা উচিত। সব শুনে তিনি খুব খুশি হয়েছে। হেনাকে নাকি বাড়িতে যেতে বলেছেন। বলেছেন, তোমার জন্যে মা আমি বুড়ো বয়সে শান্তি পেলাম। হেনা আপ্লুত।
ঠিক সেইসময় মারুতি ভ্যানটা পাশে এসে দাঁড়াল। গাড়ির সামনের দরজা খুলে লোকটি নামল, এই যে স্যার! চেনা যাচ্ছে?
চিনলাম। মাথা নাড়লাম, হ্যাঁ। সেইসঙ্গে ভয় ভয় করতে লাগল।
কাল দুনম্বরি করলেন কেন? আমাদের ফাঁসাতে চেয়েছিলেন?
দুর। আমি হেসে উঠলাম, ওটা ভড়কি! মহিম গুপ্ত কিছু বলেনি? আমি তো তোমাদের বিরুদ্ধে পুলিশকে একটা কথাও বলিনি। গাড়ির নাম্বার দিইনি। দিয়েছি?
তা দেননি। কিন্তু থানায় ঢুকেছিলেন কেন?
তার আগে বলো এখানে আমি আছি সেটা কী করে জানলে?
আমার লোক আপনার পেছনে ছিল। শুনুন মহিম গুপ্ত বা আপনার বাবা আছেন বলে আপনাকে কিছু করিনি। কিন্তু খবর পেলাম বাইপাসের পাশে বিদেশিদের সঙ্গে কারখানা করবেন। আমার দশটা লোককে চাকরি দিতে হবে।
চাকরি?
হ্যাঁ।
এখনও কোনো কথাই ফাইন্যাল হয়নি।
হবে। হয়ে যাবে। মহিমা মিথ্যে খবর দেয় না।
তার চেয়ে এক কাজ করো। আমি হাসলাম। ছেলেটি তাকাল।
গাড়ির ডিকিতে কেউ আছে না কি হাত-পা বাঁধা অবস্থায়? ময়দানে নিয়ে চলো, কাল যা পারিনি, আজ সেটা করে দিচ্ছি।
রসিকতা করছেন?
না। চাকরি দেওয়ার চেয়ে কাউকে গুলি করে মারা অনেক সহজ।
আচ্ছা দুনম্বরি লোক তো আপনি। সে গাড়িতে ফিরে যেতেই ওটা হুস করে বেরিয়ে গেল। এত সহজে ছাড়া পাব ভাবতে পারিনি। আজ সকালেও এই কথাগুলো বলতে পারতাম না। বেঁচে থাকার জন্যে যে বর্মের দরকার হয় তা আমার হাতে এসে গেছে।
একটা ট্যাক্সি ডাকলাম। পেছনের সিটে বসে গন্তব্য বলে দিলাম। অনেক অনেক বছর পরে নিজের পয়সায় ট্যাক্সিতে চড়লাম। আধঘণ্টার মধ্যে বাড়িতে পৌঁছে জিজ্ঞাসা করলাম, কত হয়েছে?
তিরিশ টাকা দিন স্যার, ঊনত্রিশ হয়েছে।
আপনার মিটার খারাপ।
না স্যার।
আমি বলছি খারাপ। চলুন, থানায় চলুন।
থানায় নিয়ে যাবেন কেন স্যার। আমি এই গাড়ি তো চালাই না, আজ সন্ধেবেলায় বের করেছি। মিটার খারাপ থাকলে মাপ করে দেবেন।
কিন্তু সন্ধে থেকেই আপনি লোক ঠকাচ্ছেন। তাছাড়া একথাটাও মিথ্যে হতে পারে। পুলিশ ঠিক বের করবে কবে থেকে ট্যাক্সিটা চালাচ্ছেন।
আপনার কাছে হাতজোড় করছি স্যার, অন্যায় হয়ে গেছে। আর হবে না।
তাহলে কত দিতে হবে?
কিছু না। কিছু দিতে হবে না স্যার। আমি নেমে দাঁড়াতেই দ্রুত বেরিয়ে গেল ট্যাক্সিটা। কয়েক মুহূর্তে হতভম্ব ছিলাম। তারপরই মনে হল, বাঃ। কী সুন্দর ব্যবস্থা। আন্দাজে ঢিল ছুঁড়তেই ভাড়া দিতে হল না। এইটে আগে কখনও মাথায় আসতো না।
দরজার সামনে দুজন দাঁড়িয়ে আমাকে দেখে ফিসফিস করছিল। একজন এগিয়ে এল, দাদা, আপনার বাবার সঙ্গে দরকার ছিল। জরুরি।
হবে না। বাবা এখন আহ্নিক করছেন। কাল সকালে আসুন।
কাল। তখন তো খুব ভিড় হয়। পার্টির লোকজন দেখা করতে দেয় না।
আমার সঙ্গে দেখা করবেন। ব্যবস্থা করে দেব।
ঠিক আছে। আপনি যা বলবেন তাই হবে।
ও কে কাল দেখা হবে।
অনেক দিন পরে, বোধহয় জ্ঞান হবার পর এই প্রথম মধ্যরাত্রে বাড়ির সদর দরজার কলিং বেলের বোতাম টিপলাম আমি। এখন যে কোনো চরিত্রে চমৎকার অভিনয় করতে পারব, বাজি রেখে দেখুন।