নিঃশব্দে বিদায়
অতীতকে একেবারে ভুলিয়া নূতনভাবে বাঁচিবার চেষ্টা কেহ যদি করিতে পারে তবে তাহার অধিকাংশ সমস্যাই সমাধান হইয়া যায়। পুরাতন তিক্ত সম্পর্ক, প্রিয়জন বিয়োগের দুঃখ, নিষ্ফল বাসনা— এই সকলের হাত হইতে মুক্তির উপায় হইল স্মৃতি হইতে অতীতকে মুছিয়া ফেলা। কিন্তু শত চেষ্টা সত্ত্বেও তিমির অন্ধকার ভেদ করিয়া সেই অতীতকেই অবলম্বন করিয়া প্রায় সকল মানুষই নগন্য প্রাণীর মত গভীর জলমধ্যে পড়িয়া খড়কুটার উপর ভর দিয়া বাঁচিয়া থাকিতে চায়।
মনুষ্য জাতির সহিত উদ্ভিদ জাতির এক অসাধারণ মিল খুঁজিয়া পাওয়া যায়। উদ্ভিদ যেরূপ জলবায়ু ও মাটির পরিবর্তনে নিজ প্রকৃতির মধ্যে রং-রূপ-স্বাদ-গন্ধ ইত্যাদির এক বিস্তর পরিবর্তন ঘটাইয়া নিজ বংশকে বাঁচাইয়া রাখে; মনুষ্য জাতিও সপ্তপুরুষের ভিটামাটি ত্যাগ করিয়া যখন অন্য কোন নব্য মনুষ্য সমাজের সংমিশ্রণে আসিয়া পড়ে তখন তাহার মাঝেও প্রাচীন প্রকৃতির নানাবিধ পরিবর্তন লক্ষিত হয়। মনুষ্য জাতি প্রাণীজগতের মধ্যে নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করিতে যাইয়া সব ব্যাপারেই যে প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছে তাহা নহে। অনেক ক্ষেত্রেই আবেগী মন পূর্ব প্রতিষ্ঠিত সামাজিক সংস্কারকে ভুলিয়া স্খলিত নক্ষত্রের ন্যায় নিষ্ক্রিয় হইয়া দূরে সরিয়া গিয়াছে।
অতীত জীবনের এক কষ্টকর সংগ্রামকে জয় করিয়া বিনোদবাবু এক নব্য সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছেন। কিন্তু, বিপত্নীক হওয়ার কারণে অতি অল্প বয়সেই কল্যাণী সংসারের খানিকটা দায়িত্ব কাধে লইয়া পিতা ও একমাত্র দাদার সেবাযত্ন করিতে মনস্থির করিল। কিছুদিনের মধ্যেই পিতৃবিয়োগ হওয়ায় দাদা ও বোনের ক্ষুদ্র সংসারে নিঃস্তব্ধতা দেখা দিল। ক্রমে ক্রমে দুইজনের সম্পর্কের মধ্যে এক দেওয়াল গড়িয়া উঠিল। কাজেই মনের ভাব প্রকাশ করিবার জন্য এই সংসারে কল্যাণীর আর কেহই রহিল না।
অন্যদিকে তাপস তাহার পৈতৃক ব্যবসায় মনোযোগী হইয়া খানিকটা ব্যস্ত হইয়া পড়িল। কল্যাণীর জীবনে আর্থিক কষ্ট না থাকিলেও মানসিকভাবে অবসাদের অবগুণ্ঠন ঘিরিয়া ফেলিল। ঘর হইতে বাহির হইয়া প্রতিবেশীর সঙ্গে একগাল কথা পাতিয়া মনের অবসাদকে বিন্দুমাত্র পরিমান লাঘব করিবার প্রবণতা তাহার স্বভাবে কোন কালেও ছিল না। কেহ আসিয়া সাগ্রহে দুই-চার কথা জানিতে চাহিলে তবেই কল্যাণীর বাকশক্তির প্রকাশ ঘটিত; তাহা না হইলে সপ্তাহকাল বিনা বাক্যব্যয়ে কাটিয়া যাইত। এই স্বল্পভাষী মেয়েটির গোপন মনে কি কোন কথা জমাট বাঁধিয়া আছে? আর যদি সত্যিই কিছু গোপনীয় থাকে তবে তাহা মুখ ফুটিয়া বাহির হইবার সম্ভাবনায় কত যে কাল অপেক্ষায় থাকিতে হইবে তাহা কে জানে?
অন্যদিকে বৈশাখের এক শুভদিনে তাপস এক অতীব সুন্দরী গ্রাম্য তরুণীকে বিবাহ করিয়া ঘরে লইয়া আসিল। সকলের ধারণা জন্মিল যে নূতন বৌদিদির আগমনে ভ্রাতা ও ভগিনীর মধ্যে আবারও সুসম্পর্কের বীজ স্থাপিত হইবে। এক বৈকালে বৌদিমনি আদরের ননদের সঙ্গে গল্প করিতে যাইয়া ‘কেঁচো খুঁড়িতে সাপ’ বাহির করিয়া ফেলিল। আবেগকেও যে এত কঠোরভাবে কারারুদ্ধ করিয়া রাখা যায় তাহা বৌদিমনির ভাবনার বাহিরে। কল্যাণী বিগত কয়েকটি বছর ধরিয়া এক যুবকের ভালবাসায় আবদ্ধ। এই গোপন তথ্যটি ফাঁস হইয়া যাওয়ায় বৌদিমনি ব্যাপারটিকে অতি আশ্চর্যের চোখে দেখিল না। আবেগ ও অনুভূতি প্রবণ মন সমব্যাথিতের পাশে ছুটিয়া যাইবে তাহাতে আর আশ্চর্যের কি? কিন্তু যে ব্যাপারটি লইয়া বৌদিমনির মাথায় বাজ পড়িল তাহা হইল যে যুবকটি বিধর্মীয় ! শুধু তাহাই নহে, কাজকর্ম করিয়া অর্থ উপার্জনের কোন সঠিক পথ সম্বন্ধে সে অজ্ঞ। উল্লেখ্য যে কাজকর্মহীন ছেলে মেয়েরাই বেশীরভাগ অবাধে প্রেমের তরীতে ঝাপ দিয়া থাকে। চট্ করিয়া লক্ষ্য স্থির করিতে না পারিলেও উভয় উভয়কেই অন্তরের একান্ত আপন বলিয়া উপলব্ধিটুকুই জীবনের মূল্যবান সঞ্চয় ভাবিয়া থাকে।
স্বীয় স্ত্রী নন্দীতার মুখে যাবতীয় গোপন রহস্য জানিতে পারিয়া তাপসের মাথায় যেন বিনামেঘে বজ্রপাত পরিল। মুহূর্তের মধ্যেই তাহার গৌরবর্ণ মুখখানি পাংশুল হইয়া গেল। পিতৃবিয়োগের পর একমাত্র ছোট বোনটির জন্য সৎপাত্রের খোঁজ করিতে যাইয়া ইতোমধ্যেই তাহাকে হিমশিম্ খাইতে হইয়াছে। তাহার উপর এমন বিরক্তিকর তথ্য শ্রবণে সঞ্চিত সুখটুকু বাষ্প হইয়া উড়িয়া গেল। তাপস মনঃক্ষুন্ন হইয়া নন্দীতাকে কাছে ডাকিয়া কহিল, “আর দেরী নয়, এবার কল্যাণীর জন্য এক সুপাত্র খোঁজ করে তাড়াতাড়ি বিয়ের ব্যবস্থা করা দরকার। অকর্মণ্য ও বিধর্মী পাত্রের সঙ্গে বিয়ের কথা ভাবাটা যে অন্যায়।”
আবেগের বশবর্তী হইয়া কাহাকেও ভালবাসিলে তাহাতে দোষ নাও থাকিতে পারে। কিন্তু বিবাহের ব্যাপার লইয়া ভাবিতে বসিলেই স্বজাতির প্রতিষ্ঠিত সংস্কার ও মূল্যবোধ সম্মুখে আসিয় দাঁড়ায়। কারণ, বিবাহ নামক বস্তুটি শুধুমাত্র দুইটি ব্যক্তির আবেগের মিলন নহে। দুইটি প্রতিষ্ঠিত পরিবারের সামাজিক মিলন।
ইতোমধ্যে বিভিন্ন পাত্রের সন্ধানে বছর ঘুরিয়া দাঁড়াইল। তাহাদের অনেকেই ধৈর্যচ্যুত হইয়া অন্য কোথাও সুপাত্রীর সন্ধান করিল। কিন্তু কোন ক্রমেই কল্যাণীর মনের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন সাধিত হইল না। চাতক পাখীর ন্যায় বৃষ্টির জলের অপেক্ষায় আকাশে চাহিয়া রহিল।
কল্যাণীর বয়স একটু বেশী হইলেও সে বিগত যৌবনা নহে। তাহার রূপ- সৌন্দর্যের কথা এখনও পাড়ার সকলে বলিয়া বেড়ায়। শুধু তাহার সম্মতির অপেক্ষাটুকু। তাহা না হইলে আজ সে যেকোন বড়লোক বাড়ীর গৃহিনী হইতে পারিত। এইভাবে বছর সাতেক কাটিয়া গেল। তাপস তাহার সর্বপ্রকার চেষ্টা করিয়াও কল্যাণীর মতের পরিবর্তন করিতে না পারিয়া এক প্রকার হাল ছাড়িয়া দিল।
প্রতিদিনের মতো সেইদিনও কল্যাণী সকালের কাজ সারিয়া স্নান করিয়া গামছা হাতে চুল ঝাড়িতেছিল। হঠাৎ তাপসের পাঁচ বছরের কন্যা মৃদুলা দৌড়াইয়া আসিয়া তাহার কাছে আবদার ধরিল। বলিল, “পিসিমা, এটা দিয়ে আমার কপালে একটি ফোঁটা লাগিয়ে দাও না।” তখনই কল্যাণীর চোখ মৃদুলার হাতের কৌটাটির দিকে পড়িল। বলিল, “আরে এ যে দেখছি সিঁদুরের কৌটো। যাও টেবিলে রেখে এসো।”
– কেন?
ওটা তোমার জন্য নয়। ওটা বড়দের।
—মা যখন স্নান করে এসে কপালে লাগায়, তখন মাকে কি সুন্দর দেখায়। তাই না পিসি।
হ্যাঁ।
—আচ্ছা, তুমিও তো বড় হয়েছ, তবে তুমি কেন সিঁদুর পর না? মার মতো সিঁদুর পরলে তোমাকেও সুন্দর লাগবে। তুমি কবে থেকে সিঁদুর পরবে পিসি? মৃদুলার এখন খেলার বয়স। সিঁদুরের মূল্য কি, সে তাহা বোঝে না। পিসির কথায় শুধু এইটুকু বুঝিল যে মায়ের মতো বয়স হইলে সেও সিঁদুর পরিতে পারিবে। রান্নাঘর হইতে নন্দিতা সবকিছু শুনিতে পাইয়া মৃদুলাকে কোলে করিয়া ঘরের ভিতর লইয়া গেল। যাইবার বেলায় বৌদিদির চোখে চোখ পড়ায় কল্যাণী স্পষ্ট বুঝিতে পারিল যে সে যে ঘরে যাইবে বলিয়া স্থির করিয়া রাখিয়াছে,সেই ঘরের বিবাহিতা রমণী কোনদিন সিঁদুর পরে না ।
সন্ধ্যাবেলায় কল্যাণী বৌদিদির কক্ষে ঢুকিয়া বলিল, “আমি আগামীকাল তোমাদের সংসার ছেড়ে আমার নিজের সংসারে চলে যাব। আমি জানি, দাদা এ বিয়েতে মত দিবে না। কিন্তু আমি মনস্থির করে ফেলেছি যে আগামীকাল বিকেলে আমি বিদায় নেব। ও আমাকে এসে নিয়ে যাবে।”
—“তুমি যখন একেবারে স্থির সংকল্প করেই ফেলেছ, তখন আর বাধা দিয়ে লাভ কিসের? শুধু এইটুকু বলে রাখি যে এখানে তুমি যে সংস্কারে মানুষ হয়েছে সেখানে সেটা না পেলেও নিজ সংসার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব তোমার উপরেই। আশাকরি সেই দায়িত্ব থেকে পিছু পা হবে না।” এই বলিয়া বৌদিদি আলমারি খুলিয়া গয়নার বাক্স বাহির করিয়া তাহার হাতে দিয়া বলিল, “এই বাক্সে তোমার বিয়ের জন্য কুড়ি ভরি গয়না রয়েছে। মা’র গয়না ছাড়াও তোমার বাবা ও দাদা তোমার জন্য বেশ কিছু গয়না বানিয়ে রেখেছে। এগুলি সবই তোমার। যাবার সময় নিয়ে যেও। আর হ্যাঁ, এই ব্যাগটিতে দাদা তোমার জন্য পাঁচলক্ষ টাকা রেখেছে। ইচ্ছে ছিল ধূমধাম করে তোমার বিয়ে দেবে। সেই ইচ্ছেটি তুমি রাখলে না। তোমার নতুন সংসারে এগুলো কাজে লাগিও।”
পরদিন অপরাহ্নে তাপস যখন চেয়ারে বসিয়া বিভোর ভাবে বিশ্রাম করিতেছিল, তখন কল্যাণী ধীরভাবে দাদার চরণ স্পর্শ করিয়া বলিল, “আমাকে আশীর্বাদ দিও, আমি তোমার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি।” এই বলিয়া সে একবার দাদার চক্ষুপানে চাহিয়া সজল নয়নে ঘর হইতে বাহিরে চলিয়া গেল।
তাপস স্তব্ধভাবে কল্যাণীর দিকে চাহিয়া রহিল।