নীলগঞ্জ মডেল হাই স্কুলের সায়েন্স টিচার
নীলগঞ্জ মডেল হাই স্কুলের সায়েন্স টিচার মবিনুর রহমান, বিএসসি (অনার্স), এমএসসি (প্রথম শ্রেণী) খুব সিরিয়াস ধবনের মানুষ। বয়স ছত্রিশ/সাঁইত্রিশ, রোগা লম্বা। গলার স্বরে কোনোরকম কোমলতা নেই। ভদ্রলোক এমনভাবে তাকান যাতে মনে হতে পারে যে সমস্ত পৃথিবীর উপর তিনি বিরক্ত। কোনো কারণে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেলে তিনি আরাম পাবেন।
এমএসসি পাস করার পর সব মিলিয়ে আঠারোবার তিনি চাকরির ইন্টারভ্যু দিলেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যা ঘটল তা হচ্ছে–তিনি ইন্টারভ্যু দিতে ঢুকলেন, বোর্ডের চেয়ারম্যান বললেন, বসুন।
তিনি বসলেন। বোর্ডের চেয়ারম্যান বললেন, আপনার নাম?
মবিনুর বহমান সহজ গলায় বললেন, নাম তো আপনি জানেন। এই নামেই ডেকে পাঠালেন। আবার জিজ্ঞেস করছেন কেন?
আচ্ছা। আপনি যেতে পারেন।
ধন্যবাদ।
তিনি শান্ত মুখে উঠে চলে এলেন।
এ জাতীয় মানুষদের কোনো চাকরি-বাকরি হবার কথা না। তবে মবিনুর রহমান হাল ছাড়লেন না। দুবছর চেষ্টা করলেন, প্রাণপণ চেষ্টা। ইন্টারভ্যু গাইড নামের সাতশ একুশ পৃষ্ঠার একটা বই প্রায় মুখস্ত কবে ফেললেন। পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব, ন্যাটো চুক্তিভুক্ত দেশের নাম, কোন কোন বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয় নি, আমেরিকান সব প্রেসিডেন্টের নাম এবং বংশ-পরিচয়–পাঠ্য তালিকা থেকে কিছুই বাদ গেল না। খুব ঈশ্বর-বিশ্বাসী না হয়েও মায়ের পীড়াপীড়িতে সিলেটে হয়রত শাহজালাল এবং হযরত শাহ পরাণের মাজার জিয়ারত কবে এলেন। রাজশাহীতে গিয়ে জিয়ারত করলেন শাহ মখদুমের মাজার এই তিন মহাপুরুষের কল্যাণেই হয়তো বা তিনি নীলগঞ্জ মডেল হাই স্কুলের সায়েন্স টিচারে চাকরিটা পেয়ে গেলেন। অবশ্যি এই চাকরি পাওয়ার পেছনে অনা একটি কারণ থাকতে পারে। এই চাকরির জন্যে তাকে ইন্টারভ্যু দিতে হয় নি। কাগজপত্ৰ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
যাই হোক, নীলগঞ্জ মডেল হাই স্কুলের চাকরির নিয়োগপত্র এবং দুকেজি মিষ্টি নিয়ে তিনি কুমিল্লার মতলবে তার মাকে দেখতে গেলেন। মা তখন রোগে শয্যাশায়ী। মবিনুর রহমানের চাকরির খবরে তাকে মোটেই আনন্দিত মনে হলো না। কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, শেষ পর্যন্ত স্কুলমাস্টার?
মবিনুর রহমান শান্ত গলায় বলেন, স্কুল মাস্টারি খারাপ কিছু না। নাও, মা মিষ্টি খাও।
আমি মিষ্টি খাব না, বাবা। তুই খা।
মিষ্টি না খেলে মনে কষ্ট পাব, মা।
ভদ্রমহিলা ছেলেকে মনোকষ্ট থেকে বাচানোর জন্য মিষ্টি খেলেন। এই মিষ্টিই তার কাল হলো। ভোরবেলা পেট নেমে গেল। সন্ধ্যার মধ্যে মৃত্যু।
আশেপাশের সবাই সান্ত্বনা দিতে ছুটে এসে দেখে মবিনুর রহমান পাথরের মতো মুখ করে মিষ্টি খাচ্ছে। নিতান্তই অস্বাভাবিক দৃশ্য কিন্তু আসলে তেমন অস্বাভাবিক নয়। মিষ্টিই তার মার মৃত্যুর কারণ কি-না এটাই মবিনুর রহমান পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন। দুকেজি কালোজাম খেয়েও তার যখন কিছু হলো না তখন তিনি মোটামুটি নিশ্চিত হলেন–বয়সজনিত কারণে মৃত্যু হয়েছে। এই মৃত্যুতে খুব বেশি দুঃখিত হবার কিছু নেই। প্রতিটি জীবিত প্ৰাণীকেই একটা নির্দিষ্ট সময়ের পাব মরতে হবে। তবে এই মৃত্যুর মানে পুরোপুরি ধ্বংস নয়। মানুষের শরীরের অযুত, কোটি, নিযুত পার্টিকেলস যেমন–ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন–এদের কোনো বিনাশ নেই। এরা থেকেই যাবে। ছড়িয়ে পড়বে সারা পৃথিবীতে। কাজেই মানুষের মৃত্যুতে খুব বেশি কষ্ট পাবার কিছু নেই।
মবিনুর রহমান তার বসতবাড়ি এবং অল্প যা জমিজমা ছিল বিক্রি করে দিয়ে নীলগঞ্জ চলে এলেন। তাঁর সঙ্গে দুই ট্রাংক বই, একটা ম্যাকমিলন কোম্পানির দুরবিন। দুরবিনটা ঢাকা থেকে অনেক দাম দিয়ে কেনা। ছাত্রজীবন থেকেই তাঁর শখ ছিল ভালো একটা দুরবিন কেনা। টাকার অভাবে কেনা হয় নি। জমি বিক্রির টাকাটা কাজে লাগল। এই সঙ্গে একটা মাইক্রোসকপি, কিনতে পারলে হতো। টাকায় কুলালো না।
নীলগঞ্জ হাই স্কুলে মবিনুর রহমানের আট বছর কেটে গেছে। শুরুতে তাকে যতটা বিচিত্র বলে মনে হয়েছিল এখন আর ততটা মনে হয় না। মবিনুব রহমান বদলান নি, আগের মতোই আছেন। ছাত্ররা এবং সহকমী শিক্ষকরা তার আচার-আচরণে অভ্যস্ত হয়ে গেছে এইটুকু বলা যায়। তাঁর আচার-আচরণের সামান্য নমুনা দেয়া যাক।
তাঁর বুক পকেটে সব সময় একটা গোলাকার নিকেলের ঘড়ি থাকে। নীলগঞ্জে আসার আগে চৌদ্দশ টাকায় ইসলামপুর থেকে এই ঘড়িটা কেনা হয়েছে। সাধারণ ঘড়ি নয়–একের ভেতর তিন। ঘড়ির সঙ্গে আছে স্টপ ওয়াচ এবং একটি আদ্রতা মাপক কাটা।
ক্লাসে ঢোকার আগে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি ঘড়িতে সময় দেখে নেন। ক্লাস শেষের ঘণ্টা পড়া মাত্র আবার ঘড়ি বের কবে সময় দেখেন। তখন যদি তাঁর কপাল কুঁচকে যায় তাহলে বুঝতে হবে ঘণ্টা ঠিকমতো পড়ে নি। দুএক মিনিট এদিক-ওদিক হয়েছে।
ক্লাসে ঢুকে প্রথমেই আজকের আবহাওয়া সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেন, যেমনআজ বাতাসের আর্দ্রতা ৭৭ পারসেন্ট। বৃষ্টিপাত হবার সম্ভাবনা। আবহাওয়া সম্পর্কে তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী খুব লেগে যায়। তিনি বৃষ্টি হবে বলেছেন। অথচ বৃষ্টি হয় নি এমন কখনো দেখা যায় নি।
তাঁর ক্লাসে ছাত্রদের নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকতে হয়। হাসা যায় না, পেনসিল দিয়ে পাশের ছেলের পিঠে খোঁচা দেয়া যায় না, খাতায় কাটাকুটি খেলা যায় না। মনের ভুলেও কেউ যদি হেসে ফেলে তিনি হতভম্ব হয়ে দীর্ঘসময় তার দিকে তাকিয়ে থেকে কঠিন গলায় বলেন, সায়েন্স ছেলেখেলা নয়। হাসাহাসির কোনো ব্যাপার এর মধ্যে নেই। সায়েন্স পড়বার সময় তুমি হেসেছি, তার মানে বিজ্ঞানকে তুমি উপহাস করেছ। অন্যায় করেছি। তার জন্যে শাস্তি হবে। আজ ক্লাস শেষ হবার পর বাড়ি যাবে না। পাটিগণিতের সাত প্রশ্নমালার ১৭, ১৮, ১৯ এই তিনটি অঙ্ক করে বাড়ি যাবে। ইজ ইট ক্লিয়ার?
মবিনুর রহমান স্কুল থেকে প্রায় দুমাইল দূরে দুকামরার একটা পাকা ঘরে একা বাস করেন। ঘরটি জরাজীর্ণ। ভেঙে পড়তে পড়তেও কেন জানি পড়ছে না। ছোটখাটো ভূমিকম্প কিংবা দমকা বাতাসের জন্যে অপেক্ষা করছে। তাকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হবে বলে মনে হয় না। বাড়িটি সাপেব আড্ডাখানা। বর্ষাকালে যেখানে-সেখানে সাপ দেখা যায়। বাড়ির মালিক কালিপদ রূপেশ্বর স্কুলের দপ্তরি। সাপের ভয়েই সে পূৰ্বপুরুষের ভিটায় বাস করে না। সাপের কামড়ে তার প্রথম পক্ষের স্ত্রী এবং দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর প্রথম সন্তান মারা গেছে। মবিনুর রহমান সেই বাড়িতে সুখেই আছেন। স্বপাক আহার করেন। তাকে নিরামিষভোজী বলা চলে। মাছ মাংস খান না। না খাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে মাছ-মাংস রাঁধতে জানেন না। তার বাড়িটা রূপেশ্বর নদীর ধারে। শীতকালে এই নদীতে পায়ের পাতাও ভিজে না। বর্ষাকালে কিছু পানি হয়। গত বর্ষায় মবিনুর রহমান দেড় হাজার টাকা দিয়ে একটা নৌকা কিনেছেন। নৌকার কোনো মাঝি নেই। নৌকা ঘাটে বাধা থাকে। মাঝে মাঝে তিনি নৌকার ছাদে সারারাত বসে থাকেন। নৌকার ভেতরটাও সুন্দর। ঘরের মতো। দুদিকে দরজা আছে। বাথরুম আছে। বিছানা বালিশ দিয়ে ভেতরটা চমৎকার গোছানো। মবিনুর রহমানের প্রিয় কিছু বই নৌকায় থাকে। অধিকাংশই গ্ৰহ নক্ষত্র বিষয়ক বই।
এই জাতীয় আধাপাগল নিঃসঙ্গ মানুষকে সবাই খানিকটা ভালোবাসার দৃষ্টিতে দেখে। মবিন্নুর রহমানের বেলায়ও তার ব্যতিক্রম হয় নি। এই অঞ্চলের মানুষদের প্রচুর ভালোবাসা তিনি পেয়েছেন। এই ভালোবাসা পাবার পেছনের আরেকটি কারণ হচ্ছে, তিনি শিক্ষক হিসেবে প্রথম শ্রেণীব। ইতিমধ্যেই অঙ্কের ড়ুবো জাহাজ হিসেবে তাঁর খ্যাতি বটেছে। ড়ুবো জাহাজ নামকরণের রহস্য হচ্ছে তিনি যে খুব ভালো অঙ্ক জানেন এটা বাইরে থেকে বোঝা যায় না।